সতীশচন্দ্র মিত্র
দায়ুদের পতনের পর টোডরমল্ল আগ্রায় প্রত্যাগত হইয়া সম্মানিত হন (১৫৭৬)। কিন্তু তখনই গুজরাটে শাসন-বিভ্রাট উপস্থিত হওয়ায় তিনি শাসনকৰ্ত্তা হইয়া সেখানে প্রেরিত হন। বৎসরান্তে তিনি বিদ্রোহাদি দমন করিয়া পুনরায় আগ্রায় আসেন; তখন বাদশাহ তাঁহাকে উজীরের পদে উন্নীত করিয়া রাজা উপাধি দেন (১৫৭৮)। ইহারই কিছুদিন পরে বসন্ত রায়ের পত্র লইয়া প্রতাপাদিত্য আগ্রার দরবারে উপনীত হন। সে দরবারে টোডরমল্লের বিপুল সম্মান; প্রতাপ পত্ৰ লইয়া তাঁহারই নিকট গিয়াছিলেন এবং তিনিই প্রতাপকে সুযোগমত বাদশাহের সহিত পরিচিত করাইয়া দেন। ১৫৭৫ হইতে বাদশাহ আকবর অধিকাংশ সময় তাঁহার নূতন রাজধানী ফতেপুর-শিকরীতেই কাটাইতেন এবং যে সময় প্রতাপাদিত্য গিয়াছিলেন, তখন তিনি সেই স্থানেই ছিলেন। ১৫৭৮ অব্দে পাঞ্জাব হইতে শিকরীতে প্রত্যাবর্তন করিবার পর বাদশাহ নূতন ধর্ম্মমতস্থাপনের উদ্দেশ্যে অবিরত অগন্যুপাসক, খৃষ্টান ও জৈন প্রভৃতি বহু ধর্ম্মাবলম্বীর সহিত বাদবিতর্ক করিয়া দিনপাত করিতেন। সম্ভবতঃ আগ্রা হইতে টোডরমল্লের সহিত শিকরীতে গিয়া প্রতাপাদিত্য বাদশাহের সহিত সাক্ষাৎ লাভ করিয়াছিলেন।
বসন্ত রায়ের প্রতিনিধি স্বরূপ যখন তাঁহার পত্র লইয়া প্রতাপ রাজা টোডরমল্লের সহিত দেখা করিলেন, তখন সুলিখিত পত্রের বিনীত ভাষা অপেক্ষা পত্র বাহক যুবরাজের তেজোদীপ্ত মূৰ্ত্তিই তাঁহাকে অধিকতর আকৃষ্ট করিয়াছিল। তিনিও প্রতাপের কথা খুব ভাল ভাবেই আকবরকে জানাইলেন। কয়েক বৎসর পূর্ব্বে যশোর-রাজ্যের সনন্দ দিবার সময় বাদশাহ মহারাজ বিক্রমাদিত্যের কথা শুনিয়াছিলেন; আজ তিনি সেই সামন্তরাজের পুত্রকে সস্নেহে সম্ভাষণ করিলেন। মানসিংহ বা টোডরমল্লের বীরত্ব খ্যাতিতে যিনি মুগ্ধ, সেই উদার নৃপতি আজ উদীয়মান বঙ্গীয় যুবরাজের বীরত্ব-ব্যঞ্জক মূর্ত্তির অনাদর করেন নাই, বরং অতিরিক্ত সমাদরই করিয়াছিলেন।[১]
প্রতাপাদিত্য যখন আগ্রাতে অবস্থান করিতে ছিলেন, তখন মিবারপতি প্রতাপসিংহের অদ্ভুত প্রতাপ ও বীরত্ব কাহিনী রাজধানীর ঘরে ঘরে গীত হইতে ছিল। ১৫৭৫ খৃষ্টাব্দে মোগলের নিকট হদিঘাটের বিখ্যাত যুদ্ধে পরাভূত হইয়া প্রতাপসিংহ পাৰ্ব্বত্য বন্দরে, বনে বনে ভ্রমণ করিতেছিলেন। তাঁহার রাজ্য-রাজধানী, আত্মীয়বন্ধু, ধনজন, এমন কি আশ্রয়স্থান পৰ্য্যন্ত নাই; তিনি পুত্র পরিবার, সৈন্যসামন্ত ও প্রজাবর্গ লইয়া পৰ্ব্বতে পৰ্ব্বতে বনে বনে, কত দুঃখকষ্টে, অনাহারে অনিদ্রায় কালযাপন করিতে ছিলেন, কিন্তু মোগলের করে স্বাধীনতাধন বিসৰ্জ্জন দেন নাই; মোগলের সহিত বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হইয়া বংশ-গৌরব বিনষ্ট করেন নাই; সামান্যভাবে একটু অবনতি স্বীকার করিয়াও মোগলের পায়ে আত্মাহুতি প্রদান করেন নাই। আরাবল্লীর গিরিকন্দর হইতে যখন প্রত্যহ সেই স্বদেশ প্রেমিক রাজর্ষি প্রতাপের অপার স্বার্থত্যাগ ও সহিষ্ণুতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত প্রবাদ-বাক্যের মত রাজদ্বারে ধ্বনিত হইতেছিল, তখন বঙ্গীয় যুবরাজের মানস-নয়নে স্বদেশ-সেবার এক অতি সজীব আদর্শ প্রকটিত করিয়াছিল। একথা কোন প্ৰামাণিক ইতিহাসে না থাকিতেও পারে, কিন্তু ইহা সত্য না হইয়াও পারে না। যখন প্রতাপাদিত্য রাজধানীতে ছিলেন, তখন এমন কেহ তথায় ছিল না, যে প্রতাপসিংহের বীরত্ব-কাহিনী শুনিয়া তাঁহার প্রতি ভক্তিযুক্ত হয় নাই। প্রতাপাদিত্যের কথা ত স্বতন্ত্র; তাহার ছিল যোদ্ধৃজীবন, অদম্য আশা ও রাজ্য-পিপাসা; সম্মুখে নিজেরই নামধারী রাজপুতবীরের অলৌকিক আদর্শ; উভয়েরই স্বাধীনতার শত্রু মোগল, প্রতাপাদিত্যের যে স্বাধীন হইবার বাসনা নূতন করিয়া জাগিবে, সে কিছু বিচিত্র কথা নহে।
বিকানীরের রাজকুমার কবিবর পৃথ্বীরাজ সম্রাট আকবরের সভাসদ ছিলেন। তিনি প্রতাপসিংহের ভ্রাতা শক্তসিংহের কন্যার পাণিগ্রহণ করেন। প্রতাপসিংহের বীরত্ব পৃথ্বীর হৃদয় উদ্বেলিত করিত। এক সময়ে মিবারেশ্বরের কঠোর প্রতিজ্ঞা দৈব কারণে মন্দীভূত হইবার উপক্রম হইলে, কিরূপে পৃথ্বীরাজের কবিত্বপূর্ণ পত্রে তাঁহাকে পুনরুদ্দীপিত করিয়াছিল, ইতিহাস তাহার সাক্ষ্য দিয়াছে। রাজধানীতে পৃথ্বীরাজের খ্যাতি সর্বত্র; বাদশাহ দরবারে পরিচিত হওয়ার পর প্রতাপও পৃথ্বীর সহিত পরিচিত হন। পৃথ্বীরাজের বাক্যে প্রতাপসিংহের প্রতি তাহার হৃদয় আরও আকৃষ্ট হয়। আগ্রা হইতে প্রতাপ নিজ সঙ্গী সূর্য্যকান্ত ও শঙ্করকে লইয়া তীর্থ পর্যটনে বাহির হন; সম্ভবতঃ তিনি যখন নূতন রাজধানী শিকরীতে গিয়াছেন, তখন তথা হইতে আজমীর ও চিতোর যান; মিবারের রাজধানী চিতোর তখন মোগল কবলিত; সেখানে প্রতাপাদিত্য সহজে প্রবেশ লাভ করিয়াছিলেন। চিতোরই তাহার নিকট প্রধান তীর্থক্ষেত্র হইল। তিনি চিতোর দুর্গের সংস্থান ও নিৰ্ম্মাণ কৌশল দেখিয়া আসিয়াছিলেন। দেশে বিদেশে রাজপুতের সেই বীরত্ব-খ্যাতি, শত্রুমিত্র মোগল-পাঠান সকলের নিকট সেই স্বদেশপ্রেমিক বীরজাতির চরিত্রের প্রতিপত্তি, আর সর্ব্বোপরি প্রতাপসিংহের কঠোর প্রতিজ্ঞার জীবন্ত দৃষ্টান্ত যুবরাজ প্রতাপাদিত্যকে একেবারে বিমুগ্ধ করিয়াছিল। খোসরোজের দিন হিন্দু রমণীর প্রতি আকবরের অত্যাচার কাহিনী এবং সামন্ত রাজগণের নিকট হইতে কন্যা আনিয়া বিবাহ করিবার প্রথা নানা বর্ণে অতিরঞ্জিত হইয়া মোগল বাদশাহের প্রতি স্বজাতিভক্ত হিন্দুর একটা তীব্র ঘৃণা জন্মাইয়া দিতেছিল। ৩
প্রতাপ তীর্থভ্রমণ করিয়া রাজধানীতে পৌঁছিবার পূর্ব্বেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইলেন যে, একবার কোনরূপে স্বদেশে গিয়া রাজতক্তে বসিতে পারিলে, যতশীঘ্র সম্ভব উপযুক্ত ব্যবস্থা করিয়া মোগলের কবল হইতে স্বাধীনতা গ্রহণ করিবেন। মহাপ্রাজ্ঞ বসন্ত রায়ের নিকটও যে মোগলের অধীনতা কিছু প্রিয় পদার্থ ছিল, তাহা নহে। তবে তিনি মোগলের শক্তি বুঝিতেন, এজন্য অনর্থক চেষ্টা করিয়া হাস্যাস্পদ হইতে চাহিতেন না। বিশেষতঃ যে বয়সে লোকে অসম্ভবকে সম্ভব করিতে চায়, পরিণাম চিন্তা না করিয়া দুস্তর সাগরে ঝাঁপ দিতেও কুণ্ঠিত হয় না, বৃদ্ধ বসন্ত রায়ের সে বয়স আর ছিল না। আবার প্রতাপ মিবারের যে জ্বলন্ত আদর্শ দেখিলেন, মোগল সরকারের যে রাজনৈতিক অবস্থার পর্যালোচনা করিলেন, শত্রুপক্ষের যে সব অভাব ও দুর্ব্বলতার পরিচয় পাইলেন, যশোহরে রাজভ্রাতৃদ্বয় তাহার কিছুই জানিতেন না। সুতরাং প্রতাপ দেখিলেন, তাঁহাদিগকে কথায় ভুলাইয়া আত্মমতে আনয়ন করা যাইবে না। অথচ রাজতক্তে বসিয়া রাজবল করায়ত্ত করিতে না পারিলে, স্বাধীনতা ঘোষণার উপযোগী কোন আয়োজনই করা যায় না। যৌবনের চাঞ্চল্যে বিলম্ব সহ্য করা যায় না; এজন্য প্রতাপ বন্ধুগণের পরামর্শে এক কৌশলের অবতারণা করিলেন। কিন্তু টোডরমল্ল তখন আগ্রায় থাকিলে, কোনও কৌশল খাটিত না।
১৫৮০ অব্দের প্রারম্ভে বঙ্গ বিহারে জায়গীরদারদিগের ভীষণ বিদ্রোহ হয়। তখন রাজা টোডরমল্ল সে বিদ্রোহ দমন জন্য বঙ্গে আসেন এবং পরবর্ত্তী বৎসরে বঙ্গের শাসনকর্তা নিযুক্ত হইয়া দুই বৎসরকাল অতি সুন্দরভাবে শাসনকার্য সম্পন্ন করেন। প্রতাপাদিত্য ১৫৭৮ অব্দের শেষভাগে আগ্রায় গিয়া দুই তিন বৎসরকাল সেখানে ছিলেন। টোডরমল্লের অনুপস্থিতিকালে প্রতাপাদিত্য এক কৌশল অবলম্বন করিয়া যশোর-রাজ্য নিজহস্তে লইবার জন্য চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তিনি রাজধানীতে থাকার সময় বসন্ত রায় বাদশাহের রাজস্ব প্রতাপের নিকটই পাঠাইতেন। প্রতাপ দুই তিন বারের প্রেরিত টাকা সরকারে জমা না দিয়া আত্মাসৎ করিলেন এবং সুযোগমত বাদশাহকে জানাইলেন যে, যশোরের ভুঞাগণ রীতিমত রাজস্ব আদায় করিতেছেন না। বঙ্গীয় বিদ্রোহের পর এ সংবাদ বড় শুভসূচক বোধ হইল না। অপরপক্ষে প্রতাপ প্ৰকাশ করিলেন যে বাদশাহ্ যদি কৃপাপরবশ হইয়া তাহাকে যশোরের সামন্তরাজ করিয়া সনন্দ দেন, তাহা হইলে তিনি রীতিমতভাবে বাকী রাজকর পরিশোধ করিয়া দিয়া চিরদিন মোগলের ছন্দানুগত রহিবেন।
গুণগ্রাহী সম্রাট প্রতাপের প্রতি সুদৃষ্টি করিয়াছিলেন। সুতরাং প্রতাপের কথায় বিশ্বাস করিয়া, তাহার মত একজন উদীয়মান বীরযুবকের নামে যশোর রাজ্যের দ্বিতীয় সনন্দ লিখিয়া দিলেন এবং উপযুক্ত খেলাত, যানবাহন ও সৈন্যসামন্ত দিয়া অনুগৃহীত রাজকুমারকে স্বদেশে পাঠাইলেন। প্রতাপ সঞ্চিত অর্থ হইতে বাকী রাজস্ব পরিশোধ করিয়া দিয়াছিলেন। এ সময়েও টোডরমল্ল বঙ্গদেশে ছিলেন; তখনকার সময়ে সম্রাট কখনও কোনভাবে প্রধান কর্মচারীদিগের মতাপেক্ষা করিতেন না। এজন্য তিনি বা বসন্ত রায় এ ব্যাপারের কিছুই জানিতে পারিলেন না। প্রতাপাদিত্য যথাসময়ে যশোরে পৌঁছিলেন এবং অকস্মাৎ সেই বাদশাহী লস্কর সহ অসন্দিগ্ধ যশোহর-দুর্গ অবরোধ করিয়া বসিলেন (১৫৮২)। এই স্থানেই প্রতাপাদিত্যের পিতৃদ্রোহিতার প্রথম উন্মেষ।
পাদটীকা :
১. প্রবাদ আছে, একদা সুরসিক বাদশাহ আকবর সমবেত কবি ও রাজন্যবর্গের পূরণ করিবার জন্য সভায় একটি সমস্যা উপস্থিত করেন, সেটি এই— স্বেত তুজঙ্গিনী যাঁত চলি হেঁ।’ যখন কেহই সন্তোষজনক ভাবে সে সমস্যা পূরণ করিতে পারিলেন না, তখন প্রতাপাদিত্য উঠিয়া সে সমস্যা নিম্নলিখিতভাবে পূরণ করেন :
‘শো বর কামিনী নীর নাহারতি রিত (রীত) ভালি হেঁ।
চির মচরকে গচপর বাবিকে, ধারেছ চল্ল চলি হেঁ।।
রায় বেচারি আপন মনমে উপমা ও চারি হেঁ।
কে ছঙ্গ মরোরতি সেত (শ্বেত) তুজঙ্গিনী, জাত চলি হেঁ।।
—রামরাম বসু, ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র,’ মূল গ্রন্থ ২৬ পৃ
অর্থাৎ সেই শ্রেষ্ঠরমণী জলে স্নান করিতে ছিলেন, এ রীতি ভাল। পরে পুষ্করিণীর ঘাটের উপর বস্ত্র নিঙ্গড়াইয়া উহার ধারে ধারে চলিয়া যাইতেছিলেন। তাহা দেখিয়া রায় বেচারা আপন মনে এই উপমা স্থির করিলেন যেন মূর্তিমতী স্বেত তুজঙ্গিনী চলিয়া যাইতেছিলেন।
— নিখিলনাথ রায়, “প্রতাপাদিত্য’, মূল ১৬-৭পৃ
“বিশ্বকোষে” (১২শ খণ্ড, ২৬৩ পৃ) ‘চির মচরকে’ স্থলে ‘চির আঁচারকে, ‘গচপর’ স্থলে ‘গঠ পর” ও “কে ছঙ্গ মরোরতি স্থলে ‘কৈছন মরাবতী’ আছে। ‘চির আঁচরকে’ অর্থে বস্ত্ৰাঞ্চল বুঝায়; ‘চির মচরকে’ থাকিলে; চির=বস্ত্র, মচরকে= নিঙ্গড়াইয়া; গচপর ও গঠপর উভয়েরই একই অর্থ : ঘাটপর বা ঘাটের উপর; বাকিকে=বাপীকে=পুষ্করিণীর।
এই সমস্যাপূরণের গল্প কোথা হইতে পাওয়া গিয়াছিল, তাহা জানা যায় না। সম্ভবতঃ, ‘রাজনামা’ প্রভৃতি যে পারসী গ্রন্থানুসারে বসু মহাশয় নিজ পুস্তক প্রণয়ন করেন, তাহাতেই এই সমস্যাপূরণের গল্প থাকিতে পারে। ‘বহারিস্তানে’ এ গল্প আছে বলিয়া জানিতে পারি নাই।
বসু মহাশয় বলেন, এই সমস্যাপূরণ হইতে প্রতাপের পরিচয় হয়; তাহা আমরা বিশ্বাস করি না; তবে সমস্যাপূরণের সময় হইতে তিনি বাদশাহের সুনজরে পড়েন, এটুকু সত্য হইতে পারে। বসু মহাশয়ের গ্রন্থে আছে, ‘ইহাতে বাদশাহের অনুমতিতে উজির উহাকে খেলাত দিয়া সম্ভ্রান্ত করিলেন।’— ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ২৬ পৃ।
২. সতীশচন্দ্র মিত্র, ‘প্রতাপসিংহ’, ৩য় সংস্করণ, ১৪৬ পৃ।
৩. বাদশাহ আকবার বাস্তবিকই উচ্চবংশীয় সামন্তরাজগণের পরিবার হইতে এক একটি কন্যা লইয়া নিজে বিবাহ করিয়াছিলেন অথবা নিজ বংশীয় কাহারও সহিত বিবাহ দিয়াছিলেন। এইরূপ চতুর শাসন নীতিবলে তিনি বহু রাজপুত বংশের সহিত বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া তাহাদের বংশ ও চরিত্র কলঙ্কিত করিয়াছিলেন। এইরূপ ভাবে গৃহীত কন্যাকে সাধারণতঃ ডোলার কন্যা বলিত। উত্তরকালে প্রতাপাদিত্যও এইরূপ এক ডোলার কন্যা সম্প্রদান করিয়াছিলেন বলিয়া রামরাম বসু মহাশয় যে উল্লেখ করিয়াছেন, তাহা সত্য নহে।—রামরাম বসুর মূল গ্রন্থ, ১২৬ পৃ; নিখিলনাথ রায়ের ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ১১৪-৫ পৃ। স্থানান্তরে এ বিষয় পুনরায় আলোচিত হইবে।
৪. পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, সে সময়কার বঙ্গের শাসনকর্তা মুজঃফর খাঁর কঠোরতার জন্য জায়গীরদারগণ বিদ্রোহী হন। এই ভাবে তিনি যাহাদিগকে অত্যন্ত অসন্তুষ্ট করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে কাঁকশাল জাতি প্রধান। এই তেজস্বী জাতি বহু বৎসর যাবত প্রাণ দিয়া মোগল সিংহাসন রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন এবং সেই জন্য বঙ্গদেশে আসিয়া তাহারা বহু জায়গীর পাইয়াছিলেন। মুজঃফর ভুলক্রমে তাহাদের কয়েকজনকে অপমানিত করিয়া বঙ্গে বিদ্রোহ প্রজ্জ্বলিত করেন। কাঁকশালগণ অনেকে বিদ্রোহের মন্ত্রণা স্থির করিতে এবং বিতাড়িত পাঠানের সহিত সহযোগিতা করিতে বিক্রমাদিত্যের রাজ্য যশোরে আসিয়াছিলেন। রাজধানীর উত্তর-পূর্ব্বকোণে যমুনার পূর্ব্ব পারে বসন্ত রায় তাহাদের জন্য আবাসস্থান নির্দ্দেশ করিয়া দেন। ঐ স্থানকে কাঁকশিয়াল বলিত। কাঁক ও শিয়ালের সহিত এ নামের সম্বন্ধ নাই। ইংরাজ আমলে ঐ স্থানের মধ্যদিয়া কালীগঞ্জ হইতে পূৰ্ব্বমুখে যে খাল খনিত হয়, তাহাকে কাঁকশিয়ালীর খাল বলে, উহা এক্ষণে নদীর মত প্রশস্ত এবং কলিকাতা হইতে পূৰ্ব্বগামী নৌকাসমূহের জলপথ হইয়াছে। ইংরাজিতে উহাকে এক্ষণে Coxeali বলে (khulna Gazetteer p. 9)। কাঁকশালদিগের বিরক্তির কারণ জানিয়া, আকবর তাহাদিগকে শান্ত করিবার জন্য মুজঃফরকে আদেশ প্রদান করেন। কিন্তু তখন কাঁকশালদিগের সহিত যুদ্ধের উপক্রম হইয়াছিল এবং মুজঃফরও শান্তি সংস্থাপনে নিপুণ ছিলেন না। বাবা খাঁ কাঁকশাল বিহার হইতে আগত মাশুম খাঁ কাবুলীর সহিত একযোগে এমন বিদ্ৰোহ উপস্থিত করিলেন যে, তাহাদের হস্ত হইতে বঙ্গ রক্ষা করা দায় হইয়া পড়িল। ষ্টুয়ার্ট সাহেব এই অবস্থার বর্ণনা করিতে গিয়া লিখিয়াছেন : ‘The throne of Akbar was at no period so shaken as by the rebellion here described.’ stewart, History of Bengal, p. 191. কালীগঞ্জের নিকটবর্ত্তী কাঁকশিয়ালীর খালকে Goodlad creek বলিত, কারণ উহা Goodlad সাহেবের ব্যবস্থায় খনিত হয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন