৩. বঙ্গে বারভুঞা

সতীশচন্দ্র মিত্র

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – বঙ্গে বারভুঞা

১১৯৮ খৃষ্টাব্দে বঙ্গদেশে প্রথম মুসলমান আক্রমণ হয় এবং সেই সময়ে পাঠান রাজত্বের ভিত্তি স্থাপিত হয়। কিন্তু একদিনে সমগ্র বঙ্গ অধিকৃত হয় নাই; এমন কি পূর্ব্ববঙ্গ শাসনাধীন করিতে প্রায় দেড়শত বর্ষ লাগিয়াছিল। ততদিন বঙ্গের রাজত্ব দিল্লীর অধীন ছিল। সমগ্র বঙ্গ মুসলমান অধিকারে আসিবার পর একদিন এক বঙ্গীয় পাঠান শাসনকর্তা দিল্লীর অধীনতা অস্বীকার করিয়া, প্রকাশ্য স্বাধীনতা ঘোষণা করেন (১৩৪০)। সেই সময় হইতে ১৫৭৬ খৃষ্টাব্দে আকবর কর্তৃক বঙ্গবিজয়ের কাল পর্য্যন্ত বঙ্গীয় স্বাধীন-শাসন যুগ ধরা যাইতে পারে। কিন্তু স্বাধীন পাঠান রাজত্বের পতন হইলেই যে মোগল শাসন প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, তাহা নহে। পাঠানেরা বিজিত হওয়ার পর দেশের মধ্যে ছড়াইয়া পড়িল; প্রজ্বলিত বহ্নি ভস্মাচ্ছাদিত হইল; উহা নিৰ্ব্বাপিত না হইয়া, বরং ভিতরে ভিতরে সন্ধুক্ষিত হইতে হইতে, অশান্তি সৰ্ব্বব্যাপী করিয়া তুলিল। যে যেখানে নেতার মত দাঁড়াইতে পারিল, সেই নেতৃত্ব পাইল; শত শত পলায়িত হিন্দু পাঠান তাহার পতাকার নিম্নে আশ্রয় পাইল। যাহারা পূর্ব্বে সামন্ত রাজা বা ভূম্যধিকারী ছিল, তাহারাই আকস্মিক নেতা হইবার সুযোগ পাইল; ক্রমে আরও বিস্মৃত স্থান দখল করিয়া প্রবল হইয়া দাঁড়াইল। কেহ বা পূৰ্ব্বে কিছুই ছিল না; এখন দৈবযোগে দেহের বলে ভূম্যধিকারী সাজিল।

আত্মরক্ষার জন্য ইহাদের সকলকেই সর্ব্বদা সতর্ক ও সশস্ত্র থাকিতে হইত। যখন তাহাদের আত্মরক্ষার চেষ্টা কমিত, তখন তাহারা অধিকার বিস্তারে মনোযোগ দিত। সে বিবাদের ফলে অনর্থের উৎপত্তি হইলে, তখনই পুনরায় নিজের গণ্ডীর ভিতর দাঁড়াইত এবং কুটমন্ত্রণা বা ষড়যন্ত্রের বলে উহারা আত্মপ্রতিষ্ঠায় প্রবৃত্ত হইত। এই ভূম্যধিকারীদিগকে ভুঞা বা ভৌমিক বলিত। পাঠান ও মোগলের সন্ধিযুগে এমন কত ভুঞা যে দেশমধ্যে জাগিয়াছিল, তাহার সংখ্যা নাই। অধিকারের বিস্তৃতি অনুসারে ইহাদের ক্ষমতার ন্যূনাধিক্য বুঝা যাইত।

উহাদের কাহারও বা শাসনস্থল একটি পরগণাও নহে, আবার কেহ বা এক খণ্ড-রাজ্যের অধীশ্বর। কোথাও বা দশ বার জন ভুঞা একজনকে প্রধান বলিয়া মানিয়া তাহার বশ্যতা স্বীকার করিত। কখনও বা একজন প্রতাপান্বিত ভুঞা অন্য ভুঞার সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত হইতেন। তখন রণ-রঙ্গ রাজায় রাজায় না হইয়া ভুঞায় ভুঞায় চলিত, আর প্রজাদিগের সকলকেই সেই যুদ্ধ- ব্যাপারে যোগ দিয়া ফলভাগী হইতে হইত। এই অরাজকতার যুগে কেহ নির্লিপ্ত থাকিতে পারিতেন না। সকলকেই রাজনৈতিকতায় যোগ দিতে হইত, নতুবা আত্ম-পরিবারের প্রাণ রক্ষা পৰ্য্যন্ত অসম্ভব হইত। দৈশিক অশান্তির একটা অশুভ ফল আছে বটে, কিন্তু উহাতে যে মানুষকে অনলস ও কর্ম্মঠ করিয়া জাতীয় প্রাণের সাড়া দিয়া থাকে, তাহাতে সন্দেহ নাই।

ঐ যুগে দেশের মধ্যে শত অশান্তির ভিতর একটা প্রাণের পরিচয় ছিল। জীবদেহে স্নায়ু- সন্ধির মত দেশের মধ্যে এই ভুঞাগণ জাতীয় প্রাণের স্পন্দনকেন্দ্র ছিলেন। আদ্যোপান্ত মুসলমান শাসনের উপর দৃষ্টিপাত করিলে আমরা কি দেখিতে পাই? দেখি পশ্চিম দ্বার ভেদ করিয়া রাজ্যলিপ্স বৈদেশিক জাতি, ভিন্ন ধর্ম্ম ও ভিন্ন আচার-ব্যবহার লইয়া, একের পর এক ভারতে প্রবেশ করিয়া আধিপত্য স্থাপন করিতেছে; দীর্ঘকাল ধরিয়া দেশমধ্যে অত্যাচার, রক্তপাত, অশান্তি, বিদ্রোহ বা বিপ্লব চলিতেছে; অপেক্ষাকৃত অল্পকাল মাত্র কোন কোন সবল সুশাসকের রাজত্বে দেশ শান্তির মুখ দেখিয়াছে, যুদ্ধের ঘনঘটা অপসৃত হইয়াছে এবং শান্তির সুফল স্বরূপ শিল্প ও শিক্ষার সমুন্নতি হইয়াছে। প্রজাদের সাধারণ অবস্থা আমরা বড় কমই জানি, কত লক্ষ লোক মরিয়াছে তাহার কোন সংবাদ নাই। নবাগত মুসলমানের মত হিন্দুরাও যুদ্ধ করিত, মরিত, দপ্তরে হিসাব রাখিত, রাজস্ব সংগ্রহ করিত, কিন্তু অসংখ্য ইতিহাসে তাহার প্রসঙ্গ নাই।[১]

যে দুই চারিজন সুশাসক রাজতক্ত সুশোভিত করিতেন, তাঁহাদের রাজত্বকালে দেশের লোকে হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিত; অনেক মনের ক্ষত আরোগ্যলাভ করিত। তাঁহাদের সদায়শতায় সময় সময় অর্থবৃষ্টি হইত; তাঁহাদের জাঁকজমকপ্রিয়তার জন্য অনেক বিপুল সৌধ শিরোত্তোলন করিত। বাস্তবিকই বঙ্গদেশে পাঠান শাসনকালের যে সকল প্রাচীন মসজিদ বা অট্টালিকা এখনও বিদ্যমান আছে, শিল্প হিসাবে উহা খুব উচ্চাঙ্গের স্থাপত্য-নিদর্শন না হইলেও, সে সকল যে এক গৌরবের যুগের জীবন্ত সাক্ষী, তদ্বিষয়ে সন্দেহ নাই।[২] হুসেন শাহ সেইরূপ একজন সুশাসক, সে কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি। হুসেনের মৃত্যুর পর হইতে যে বিপ্লব আরব্ধ হইয়াছিল, সের শাহের অতি সংক্ষিপ্ত রাজত্বে তাহা নিবৃত্ত হয় নাই। কারণ সের শাহ যতদিন বঙ্গে ছিলেন, ততদিন তিনি অত্যাচারী যোদ্ধা এবং তিনি দিল্লী গেলে, তাঁহার সুশাসনের নিদর্শন বঙ্গে পৌঁছিবার পূর্ব্বে তাঁহার মৃত্যুসংবাদ প্রচারিত হইয়াছিল। ১৫২৬ খ্ৰীষ্টাব্দে বাবরের রাজ্যারম্ভ হইতে ১৫৫৬ অব্দে আকবরের রাজ্যলাভ পর্য্যন্ত বঙ্গে কোন সুশাসন প্রবর্তিত হয় নাই। সুলেমানের কঠোর শাসনের মধ্যে যে শান্তিটুকু ছিল, তাঁহার সেনাপতি কালাপাহাড়ের অমানুষিক অত্যাচারে তাহার ফল শুভজনক হয় নাই। তৎপুত্র দায়ুদ মোগলের নিকট পরাজয়ের পর যখন সেনাপতি মুনেমের সহিত সন্ধিসূত্রে উড়িষ্যার স্বামিত্ব লাভ করিয়াছিলেন, তখন তিনি উড়িষ্যাবাসীর হৃদয়ের উপর কোন অধিকার বিস্তার করিতে পারেন নাই। তজ্জন্যই তাঁহাকে অচিরে সে রাজ্য ত্যাগ করিয়া ইতোভ্ৰষ্টস্ততোনষ্ট অবস্থায় মৃত্যুর অনুসরণ করিতে হইয়াছিল। মোট কথা, হুসেনের মৃত্যুর পর হইতে ষোড়শ শতাব্দীর শেষ পর্য্যন্ত বঙ্গদেশে কোন সুশাসন ছিল না।

এই সময়ে গৌড়, তাণ্ডা বা রাজমহল যেখানেই রাজপাঠ প্রতিষ্ঠিত হউক না কেন, প্রকৃতপক্ষে দেশের নানাস্থানে পূর্ব্বোক্ত ভুঞাদিগের শাসন প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল। এই সন্ধিযুগেই কবিকঙ্কণ নিজে মোগল কর্মচারী কর্তৃক অত্যাচারপীড়িত হন। তিনি তাঁহার চণ্ডী কাব্যের প্রারম্ভে মোগল ডিহিদার বা তহশীলদারগণের অত্যাচার বর্ণনা করিয়াছেন। উহাতে তাহার কিরূপে প্রজার খিল (পতিত) ভূমি লাল (উর্ব্বর) লিখিয়া বিনা উপকারে খতি (ঘুষ) খাইয়া প্রজাকুল ব্যাকুল করিয়া তুলিয়াছিল, তাহা দেখান হইয়াছে।[৩]

ভুঞাগণ অনেক স্থলে ঐ সকল ডিহিদারের হস্ত হইতে রক্ষা করিয়া বিদ্রোহী প্রজাকে আশ্রয় দিয়া, দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হইয়াছিলেন। তাহাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য বা প্রকৃতি যাহাই থাকুক, তাহারা দেশভক্ত সাজিয়া আত্মপ্ৰাধান্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন।

উক্ত ভুঞা বা ভুঁইয়াগণকে শুদ্ধ ভাষায় ভৌমিক বলিত। এখনকার হিসাবে উহাদিগকে জমিদার বলা যায়। এখন যেমন অস্ত্রশস্ত্রসৈন্যবিহীন রাজা মহারাজা স্বচ্ছন্দে রাজস্ব সংগ্রহ করিয়া, নানাভাবে সদসৎ ব্যবহার করিতে পারেন, তখন সেরূপ হইত না; তখন আত্মরক্ষা বা রাজস্বসংগ্রহ জন্য যথেষ্ট সৈন্য রাখিতে হইত; দুর্গ, অস্ত্রশস্ত্র বা নৌবাহিনীর আয়োজন করিতে হইত; শত্রুর অপেক্ষায় তাহাদিগকে বীরবেশে বহু রাত্রি বিনিদ্র হইয়া থাকিতে হইত। বীর বলিয়া ভুঞাগণের খ্যাতি হইত, বীর বলিয়া প্রজারা তাহাদিগকে ভয় ভক্তি করিত। অধিকন্তু তাহাদের মধ্যে যিনি ধৰ্ম্মপ্রধান বা প্রজারঞ্জক হইতেন, সকলে মিলিয়া তাহাকে নিত্য পুষ্পাঞ্জলি দিত। উহার ফলে তিনিও নিজকে গৌড়েশ্বর বা দিল্লীশ্বর হইতে কম মনে করিতেন না।

এইরূপে কত ভুঞা যে দেশের কোণে সঙ্গোপনে ছিলেন, সকলে তাহার খোঁজ রাখিত না। তবে তাঁহাদের মধ্যে যাঁহারা বীরত্বে অগ্রগণ্য, যাঁহাদের রাজত্ব বিস্তীর্ণ এবং যাঁহারা বিপুল সৈন্যবলে শক্তিসম্পন্ন হইতেন, তাঁহাদেরই খ্যাতি স্থায়ী হইত। প্রবাদ এই, মোগলদিগের বঙ্গবিজয়ের প্রাক্কালে বা পরে এইরূপ বার জন্য ভুঞা প্রাধান্য লাভ করিয়াছিলেন। বলিতে গেলে এক প্রকার তাঁহারাই বঙ্গদেশকে বা নিম্নবঙ্গের দক্ষিণ ভাগকে[৪] নিজেরা ভাগ করিয়া লইয়াছিলেন; এই জন্য বাঙ্গালাকে তখন ‘বারভুঞার মুলুক’ বা ‘বারভাটি বাঙ্গালা’ বলিত। কিন্তু তাঁহারা যে সংখ্যায় ঠিক বার জনই ছিলেন এবং সেই বারজন ঠিক এক সময়েই ছিলেন, তাহা বলা যায় না। হয়ত এক জনের রাজত্বের শেষ সময়ে অন্যের রাজত্ব আরব্ধ হইয়াছিল, অথবা কোন প্ৰধান ভুঞার মৃত্যুর পর, তাঁহার কোন বংশধর নামমাত্র শাসন পরিচালন করিতেন, কিন্তু হিসাবেব বেলায় তিনিও বার ভুঞার অন্যতম বলিয়া গণ্য হইতেন।

দ্বাদশ সংখ্যাটি যেমন হিন্দুর নিকট প্রিয় ও পবিত্র, দ্বাদশ জন রাজার সম্মিলনও তেমনি ভারতের একটি বিশেষত্ব। অতি প্রাচীন কাল হইতে দ্বাদশ জন সামন্তরাজের প্রসঙ্গ চলিয়া আসিতেছে। মনুসংহিতা প্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থে প্রধান বা মণ্ডলেশ্বর রাজার পার্শ্ববর্ত্তী নানা সম্বন্ধযুক্ত দ্বাদশ প্রকার নৃপতির উল্লেখ আছে।[৫] প্রাচীন বাঙ্গালা গ্রন্থেও যে সকল প্রধান রাজার উল্লেখ আছে, তাঁহারা রাজসভায় আসিলেই সাধারণতঃ বারভুঞা বেষ্টিত হইয়া বসিতেন।[৬] বাঙ্গালার মত আসামেও বার জন রাজা বা বার জন মন্ত্রী না হইলে রাজ্য শাসন হইত না এবং ‘পাঁচ পীরের’ নাম করিতে গিয়া যেমন নানা জনে নানা পীরের নাম করিয়াছেন, আসামে বারজন রাজার তালিকা পুরাইতেও বিভিন্ন নাম কথিত হয়।[৭] আরাকান, শ্যাম প্রভৃতি দেশেও প্রধান রাজার রাজ্যাভিষেক কালে বার জন্য সামন্ত রাজা বা ভুঞার আবশ্যক হইত এবং উহাদের অভিষেকও এক সময়ে সম্পন্ন হইত।[৮] এখনও আমাদের দেশে বার জনে ভিন্ন কোন কাজ হয় না; বহুজনকে লইয়া যে কাজ হয়, তাহাকে বার-ইয়ারী বা বারোয়ারী কার্য্য বলে। উহাতে ঠিক বার জনই থাকিবে, এমন নিয়ম নাই। বাঙ্গালার বারভুঞার কাণ্ডটিও প্রায় ঐ একই প্রকারের। কতকগুলি প্রধান প্রধান ভুঞা বঙ্গে আধিপত্য লাভ করিয়াছিলেন বলিয়াই উহাদিগকে ‘বারভুঞা’ বলিত; প্রকৃতপক্ষে তাঁহারা যে সংখ্যায় এক সময়ে ঠিক বার জন ছিলেন, এমন বোধ হয় না। প্রধান একটা কারণ এই যে, বহুজনে ‘বারভূঞা’র কথা লিখিয়াছেন, কিন্তু কেহই ঠিক ভাবে বার জনের নাম বা বিভিন্ন লেখক একই বার জনের নাম দিতে পারেন নাই; প্রত্যেকেই কোন মতে ১২ সংখ্যা পূর্ণ করিয়া দিয়াছেন কিন্তু কাহারও সহিত কাহারও মিল নাই। বাস্তবিক এই বারজন ভুঞা কে কে ছিলেন, তাহাই দেখিবার জন্য আমরা এক্ষণে এ সম্বন্ধে বিদেশী ও স্বদেশী লেখকদিগের বিবরণী হইতে সারাংশ গ্রহণ করিব।

ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে জেসুইট সম্প্রদায়ভুক্ত মিশনরীগণ ভারতবর্ষে আসেন। মোগল আমলের ইতিহাস সম্বন্ধে তাঁহাদের বিবরণী বিশেষ প্রামাণিক।[৯] উঁহাদের মধ্যে নিকলাস্ পাইমেণ্টা প্রধান, তিনি গোয়াতে ছিলেন। ঐ সময়ে ফার্ণাণ্ডেজ্, সোসা, ফন্সেকা ও বাউয়েস্ এই চারিজন জেসুইট মিশনরী বঙ্গে আসিয়াছিলেন, এই চারিজনের মধ্যে ফার্ণাণ্ডেজ প্রধান।[১০] ফার্ণাণ্ডেজ ১৫৯৯ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গ হইতে পাইমেণ্টার নিকট কতকগুলি পত্র লিখিয়াছিলেন। তিনি এই সকল পত্রের সার সঙ্কলন করিয়া পরবৎসর জেসুইট সম্প্রদায়ে সৰ্ব্বাধ্যক্ষ একোয়া ভিবার (Aqua Viva) নিকট এক বিবরণ পাঠাইয়া দেন (১৬০০)। ডু-জারিক নামক একজন স্পেনদেশীয় জেসুইট পাইমেণ্টার পত্রাবলী ও অন্যান্য স্পেনীয় ইতিহাসের উপর নির্ভর করিয়া বাঙ্গালার ঐতিহাসিক প্রসঙ্গে এক প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্থ মূল ফরাসী হইতে ক্রমে জগতের বহু ভাষায় অনূদিত হইয়াছে।[১১] এই গ্রন্থে বঙ্গদেশের যে প্রসঙ্গ আছে, তাহাতে বার ভুঞার উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। তাঁহারা বার জনে পাঠান রাজ্য দ্বাদশ ভাগে বিভক্ত করিয়া মোগলদিগকে বঞ্চিত করতঃ নিজেরা পৃথক্ পৃথক্ রাজ্য ভোগ করিতে থাকে। এই বার জনের মধ্যে ঈশা খাঁ মসনদ-আলি সৰ্ব্বশ্রেষ্ঠ। হিন্দু ভুঞাত্রয় শ্রীপুর, বালা ও চ্যাণ্ডিকান বা চাঁদ খানের অধিপতি।[১২]

উইলফোর্ড সাহেব এবং অধ্যাপক ব্লকম্যান বার ভুঞার প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়াছেন বটে, কিন্তু তাঁহারা উঁহাদের নাম দেন নাই।[১৩] ডক্টর ওয়াইজ বিশেষভাবে বার ভুঞার ইতিহাস উদ্ধারের চেষ্টা করেন; তৎপরে মহামতি বিভারিজও কিছু কিছু নূতন তথ্যের আবিষ্কার করিয়াছেন।[১৪] ওয়াইজ মহোদয় বার জনের মধ্যে সাত জনের নাম দিয়া তাহার পাঁচ জনের বিবরণ লিখিয়াছেন। সেই সাত জন যথা :

১॥ ভাওয়ালের ফজল গাজী, ২ বিক্রমপুরে চাঁদ রায়, কেদার রায়, ৩ ভুলুয়ার লক্ষ্মণমাণিক্য, ৪॥ চন্দ্রদ্বীপ বা বাক্‌ক্লার কন্দর্প নারায়ণ, ৫॥ খিজিরপুরের ঈশা খাঁ, ৬॥ যশোহর বা চ্যাণ্ডিকানের প্রতাপাদিত্য এবং ৭॥ ভূষণার মুকুন্দরাম রায়।

ইহার মধ্যে তিনি প্রথম পাঁচ জনের বিবরণ দিয়াছেন।

ইহা হইতে দেখা গেল যে, ওয়াইজ সাহেবের উল্লিখিত সাত জনের মধ্যে পাঁচজন হিন্দু এবং দুই জন মুসলমান। সুতরাং অবশিষ্ট পাঁচ জন সকলেই মুসলমান হইলে, বার ভুঞার মধ্যে মুসলমানের সংখ্যা সাত জনের অধিক হয় না। ডু-জারিকের বিবরণীতে যে চারি জনের নাম পাইয়াছিলাম, ওয়াইজ সাহেবের তালিকায় তাঁহারা ব্যতীত আরও তিন জনের নাম অতিরিক্ত পাওয়া গেল।

ম্যানরিক্ নামক একজন স্পেনদেশীয় ধৰ্ম্মযাজক ১৬২৮ খৃষ্টাব্দ হইতে ১৬৪১ খৃষ্টাব্দ পর্য্যন্ত বঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা পর্য্যটন করিয়া এক ভ্রমণ-বৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করেন।[১৫] উহাতেও বার ভুঞার উল্লেখ আছে। তাঁহার মতে ১২টি ভুঞা রাজ্যের নাম :

১॥ বাঙ্গালা, ২॥ হিজলী, ৩॥ উড়িষ্যা, ৪॥ যশোর, ৫ চ্যাণ্ডিকান, ৬ মেদিনীপুর, ৭॥ কৰ্ত্তাভু, ৮॥ বালা ৯॥ সলিমাবাজ, ১০ ভুলুয়া, ১১ ঢাকা ও ১২॥ রাজমহল।

ইহার মধ্যে আমরা পূর্ব্বকথিত সাতটি রাজ্যের মধ্যে চ্যাণ্ডিকান, কর্তাভু, বালা, ভুলুয়া ও ঢাকা বা শ্রীপুর এই পাঁচটি রাজ্য পাইতেছি। সে সাতটির অবশিষ্ট ভাওয়াল ও ভূষণার উল্লেখ ম্যানরিকের তালিকায় নাই; সম্ভবতঃ ১৬৪০ খৃষ্টাব্দের প্রাক্কালে সে দুইটি ভুঞা রাজ্য বিলুপ্ত হইয়াছিল।

এক্ষণে ম্যানরিকের তালিকার অবশিষ্ট সাতটি রাজ্যের পরিচয় দেওয়া আবশ্যক। তন্মধ্যে ‘বাঙ্গালা’ যে সুবর্ণগ্রাম বা সোণারগাঁও-এর নামান্তর, তাহাতে সন্দেহ নাই। ইহা ঢাকা সাহিত্য- পরিষদ হইতে বীরেন্দ্রনাথ বসু ঠাকুর মহাশয় তাঁহার ‘বাঙ্গালা নগরী’’ নামক পুস্তিকায় সর্ব্ববিধ মতের সুন্দর সমালোচনা করিয়া নিঃসংশয়রূপে সপ্রমাণ করিয়াছেন। আমরা এস্থলে তাহার পুনরুল্লেখ না করিয়া স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করিতে পারি।[১৬] সোণারগাঁও এবং কর্ত্তাভু পরস্পর নিকটবর্ত্তী স্থান; ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর তাঁহার উত্তরাধিকারিগণের দুই শাখা এই দুই স্থানে রাজত্ব করিতেছিলেন। ঈশার পুত্র মুসা খাঁ যে ‘বাঙ্গালার’ অধিপতি ছিলেন, তাহা বৈদেশিক বিবরণীতে উল্লিখিত আছে।[১৭] মোগল কর্তৃক বঙ্গবিজয়ের সময়ে হিজলীতে আর একটি ক্ষুদ্র রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। উড়িষ্যার শাসনকর্তা কতলু খাঁর মৃত্যুর পর তাঁহার উকীল এবং জ্ঞাতিভ্রাতা ঈশা খাঁ লোহানীর পুত্র ওসমান উড়িষ্যায় রাজত্ব করিতেছিলেন।[১৮] উক্ত ঈশা খাঁ স্বয়ং হিজলীতে এক দুর্গ ও রাজধানী স্থাপন করেন। সেই হিজলী এখনও মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত বিখ্যাত বন্দর। মেদিনীপুরের ইতিহাস হইতে জানা যায় যে, ১৫৮৩ খৃষ্টাব্দে জ্বালামুটা ও মাজনামুটা নামক দুইটি জমিদারী হিজলী হইতে বিচ্যুত হইয়া পৃথকভাবে শাসিত হইতে থাকে।[১৯] সম্ভবতঃ ম্যানরিক্ উহাকেই মেদিনীপুর রাজ্য বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। চ্যাণ্ডিকান বা যশোর যে অভিন্ন রাজ্য ছিল, তাহা আমরা পরে দেখাইব। যশোরাধিপতি মহারাজ প্রতাপাদিত্যের পতনের পূর্ব্বে ভবেশ্বর রায় মোগলদিগকে সাহায্য করিবার পুরস্কারস্বরূপ ‘যশোহরের রাজা’[২০] উপাধি পাইয়া, ভৈরবকূলে বর্তমান যশোহর নগরীর সান্নিধ্যে চাঁচড়া রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এই চাঁচড়া রাজ্যই সম্ভবতঃ ম্যানরিকের বিবরণীতে যশোর রাজ্য বলিয়া কথিত হইয়াছে। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে কিঙ্কর সেন নামক এক ব্যক্তি দ্বিগঙ্গা হইতে[২১] আসিয়া বর্তমান বরিশালের অন্তর্গত সেলিমাবাদে ১৪টি ভূখণ্ড দখল করিয়া লন; মহারাজ প্রতাপাদিত্য উহার ১৩টি হস্তগত করিয়াছিলেন। প্রতাপের পতনের পর কিঙ্করের পুত্র মদনমোহন মালিকশূন্য পরগণাগুলি পুনরায় স্বাধিকৃত করিয়া মোগল-সরকার হইতে উহার সনন্দ লাভ করেন। ইহাই সেলিমাবাদ রাজ্য। মদনমোহন বা তৎপুত্র শ্রীনাথ রায়ের সময়ে ম্যানরিক্ এ দেশে আসেন। কিঙ্কর সেন ‘ভুঞা কিঙ্কর’ বলিয়া খ্যাত ছিলেন, তাঁহার বংশধরগণ ‘রায়ের কাটি’ নামক স্থানে বাস করিতেন। এইজন্য সেলিমাবাদের রাজগণ এক্ষণে রায়ের কাটির জমিদার বলিয়া খ্যাত।[২২] মোগল পক্ষীয় শাসনকর্তা মহারাজ মানসিংহ বঙ্গবিজয়কালে ১৫৯৫ খৃষ্টাব্দে আকমহল নামক স্থানকে আকবর নগর বা রাজমহল নাম দিয়া তথায় রাজধানী স্থান করেন।[২৩] তাহাই প্রকৃতপক্ষে বাঙ্গালা দেশে তখনকার মোগল রাজধানী এবং ম্যানরিকের সময়ে অন্য ভুঞা রাজ্যগুলি এক প্রকার রাজমহলের অধীন ছিল।

পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, ভৌমিকেরা সকলে এক সময়ে এক সঙ্গে ছিলেন না। এখন দেখা গেল, মোগল কর্তৃক বঙ্গবিজয়ের প্রাক্কালে যে সকল ভৌমিক ছিলেন, তাঁহাদের অনেকেই ম্যানরিকের ভ্রমণকালে বর্তমান ছিলেন না। এমন কি, তাঁহাদের বংশধরগণের অনেকে তখন রাজ্যলাভে বঞ্চিত বা অন্যভাবে তিরোহিত হইয়াছিলেন। মোগল-বিজয়ের সমকালে যাঁহারা বঙ্গে স্বাধীনতা অবলম্বনের প্রয়াসী ছিলেন, তাঁহাদের প্রসঙ্গই আমাদের বিশেষ প্রয়োজনীয়; কারণ, মহারাজ প্রতাপাদিত্য উঁহাদের অন্যতম এবং তাঁহারই সহিত যশোহর-খুলনার ইতিহাস ঘনিষ্ঠভাবে বিজড়িত। এই প্রতাপাদিত্যের সহিত প্রায় অন্যান্য সকল ভুঞার সম্বন্ধ স্থাপিত বা সংঘৰ্ষ উপস্থিত হইয়াছিল; সেইরূপ সম্পর্ক ছিল বলিয়াই আমাদিগকে দ্বাদশ ভৌমিকের তথ্যানুসন্ধান করিতে হইতেছে। প্রতাপাদিত্য সংস্রবেই যশোহর-খুলনার ক্ষুদ্র ইতিহাসের সহিত তখন সমগ্র বঙ্গের, এমন কি, বিশাল ভারতের ইতিহাসের সম্বন্ধ হইয়াছিল। সেই দেশব্যাপী বিরাট রাজনৈতিক ব্যাপারের একটি সজীব আভাষ দিবার জন্য আমাদিগকে বিশেষ প্রয়াস পাইতে হইতেছে।

যাঁহারা কোন না কোন প্রসঙ্গে এই মোগল-পাঠানের সন্ধিযুগের ইতিহাস আলোচনা করিয়াছেন, তাঁহারাই দ্বাদশ ভৌমিকের পরিচয় দিতে বা তাঁহাদের সংখ্যাপূরণ করিতে চেষ্টা করিয়াছেন এবং নানা জনে নানা ভাবে এই সংখ্যা পূরণ করিয়াছেন। কোন একটি নির্দিষ্ট বৎসরের উল্লেখ না করিলে, সেই বৎসরের নির্দ্দিষ্ট সংখ্যক ভৌমিকগণের নামোল্লেখ করা যায় না। বৎসরানুসারে সেরূপ হিসাব ইতিহাসে কোথাও নাই। পাইলেও সে সংখ্যা সব বৎসর বার জন হইত কিনা সন্দেহ। বঙ্গের ইতিহাস তখন এমনভাবে নিত্য পরিবর্তিত হইতেছিল যে, কোন বৎসর বার জন ভৌমিক থাকিলেও দুই এক বর্ষের মধ্যে তাহার অনেক পরিবর্তন হইত। এইরূপে ভুঞাদিগের প্রাদুর্ভাবের সময় সম্বন্ধে বিতর্ক আছে এবং থাকিতেও পারে; তবে আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, তাঁহাদের কয়েকজনের সম্বন্ধে কোন মতভেদ নাই; আবার উঁহারাই ভুঞা শ্রেণীতে প্রধান এবং তাঁহাদিগেরই সহিত রাজনৈতিক ব্যাপার লইয়া যশোহর-খুলনার সম্পর্ক দেখিতে পাওয়া যায়। এইজন্য আমরা প্রথমতঃ ভুঞাদিগের নামোল্লেখ ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় মাত্র দিয়া প্রতাপাদিত্যের ইতিহাস আরম্ভ করিব এবং সেই ইতিহাসের সহিত ভুঞাগণের সম্বন্ধ যথাস্থানে উল্লেখ করিব।

ভৌমিকগণের দ্বাদশ সংখ্যা পূর্ণ করিতে হইলে, আমরা নিম্নলিখিত কয়েকজন প্রধান ব্যক্তির নাম করিতে পারি। নতুবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভৌমিকের সংখ্যা বেশী ছিল।

১. ঈশা খাঁ মসনদ্-আলি : খিজিরপুর বা কত্রাভু।

২. প্রতাপাদিত্য : যশোহর বা চ্যাণ্ডিকান।

৩. চাঁদরায়, কেদার রায় : শ্রীপুর বা বিক্রমপুর।

৪. কন্দর্প রায় ও রামচন্দ্র রায় : বালা বা চন্দ্ৰদ্বীপ।

৫. লক্ষ্মণমাণিক্য : ভুলুয়া।

৬. মুকুন্দরাম রায় : ভূষণা বা ফতেহাবাদ।

৭. ফজল গাজী, চাঁদ গাজী : ভাওয়াল ও চাঁদপ্ৰতাপ।

৮. হামীর মল্ল বা বীর হাম্বীর : বিষ্ণুপুর।

৯. কংসনারায়ণ : তাহিরপুর।

১০. রামকৃষ্ণ : সাতৈর বা সান্তোল।

১১. পীতাম্বর ও নীলাম্বর : পুঁটিয়া।

১২. ঈশা খাঁ লোহানী ও ওসমান খাঁ : উড়িষ্যা ও হিজলী।

ইঁহাদের মধ্যে প্রথম ছয় জনই বিশেষ বিখ্যাত। তাঁহারাই তদানীন্তন রাজনৈতিক গগনে সমুজ্জ্বল এবং তাঁহারাই মোগলদিগের দিগ্বিজয়ের পথে কণ্টক হইয়াছিলেন। আমরা তাঁহাদের কথা পরে বলিব। অপর ছয় জনের মধ্যে কেবলমাত্র উড়িষ্যা ও হিজলীর পাঠান ভুঞাদিগের সহিত প্রতাপাদিত্যের সম্বন্ধ ছিল এবং তাঁহারাই পাঠান বিদ্রোহের অন্যতম নেতা। মোগল কর্তৃক বঙ্গ-বিজয়ের পর উড়িষ্যাই পাঠানদিগের আশ্রয়স্থল হয়; সেই স্থান হইতে পাঠানেরা বঙ্গের নানা স্থানে বিক্ষিপ্ত হইয়া বিদ্রোহ-বহ্নি ছড়াইয়াছিল। বিজয়ী মোগলের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হওয়াই ভুঞাদিগের প্রধান কৃতিত্ব বা প্রধান অপরাধ। এ বিষয়ে যিনি যে পরিমাণে কৃতী, মোগলদিগের নিকট তিনি সেই পরিমাণে অপরাধী। প্রথম অপরাধী ওসমান— কতলুর প্রধানমন্ত্রী ঈশা খাঁর পুত্র ওসমান খাঁ উড়িষ্যা হইতে পাঠানের রাজতক্তের উত্তরাধিকারের দাবি করিতেন। সেই দাবির পক্ষপাতের জন্যই বঙ্গ ভরিয়া বিদ্রোহ জাগিয়াছিল। প্রতাপাদিত্য সেই দাবির প্রধান পক্ষপাতী। হিজলীর ঈশা খাঁ ও উড়িষ্যার কতলু খাঁ একই লোহানী বংশসম্ভূত। এজন্য ঈশা খাঁ ও তৎপুত্র ওসমানকে আমরা এক পর্যায়ভুক্ত করিয়াছি। কেহ কেহ উহাদিগকে দ্বাদশ ভৌমিকের অন্তর্ভুক্তই করেন না।[২৪] কিন্তু দায়ুদের মৃত্যুর পর যখন ওসমানের অধীনে পাঠানগণ বহুকাল পর্য্যন্ত দোৰ্দ্দণ্ড প্রতাপে উড়িষ্যায় ভূম্যধিকারী ছিলেন, হিজলীর শাসনকর্তা অবশেষে মোগলের বশ্যতা স্বীকার করিলেও যখন স্বীয় প্রদেশে প্রতাপান্বিত ছিলেন, তখন তাঁহারা নিজেরা ভুঞা নাম ধারণ করুন বা না করুন, তাঁহাদিগকে ভুঞা পর্যায়ভুক্ত না করিয়া উপায়ান্তর কি আছে? আকবরের বহু পরে যে ম্যানরিক্ এ দেশে ভ্রমণার্থ আসিয়াছিলেন, তিনিও উড়িষ্যা ও হিজলীতে ভুঞা রাজ্য দেখিয়া গিয়াছিলেন। অপর পাঁচ জন ভুঞার মধ্যে পূর্ব্ববঙ্গের গাজীগণ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দাঁড়ান নাই। বিষ্ণুপুরের হাম্বীর মল্ল বহুদিন পর্য্যন্ত স্বাধীনতা রক্ষা করিলেও যশোহরের সহিত তাঁহার বিশেষ কোন ঘনিষ্ঠতার পরিচয় পাই না। পূৰ্ব্ববঙ্গীয় বিদ্রোহ দমনের জন্য মোগল বাহিনীর যে যাতায়াত চলিতেছিল, তিনি একপ্রকার তাহার দর্শকমাত্র ছিলেন। অবশিষ্ট তিনজন অর্থাৎ তাহিরপুর, সাঁতোড় ও পুঁটিয়ার ভুঞাগণ উত্তরবঙ্গে প্রাধান্য লাভ করিয়াছিলেন সত্য এবং ঘোড়াঘাটের পলায়িত পাঠানের সহিত তাঁহাদের গুপ্ত সন্ধি থাকাও অসম্ভব নহে, কিন্তু মোগলেরা সেদিকে তেমন মনোযোগী হন নাই; কারণ নিম্নবঙ্গের বিদ্রোহ-তরঙ্গ যখন মোগলের নূতন রাজধানী পর্য্যন্ত পৌঁছিতেছিল, তখন বঙ্গরাজ্য করায়ত্ত রাখিতে নিম্ন-বঙ্গের দিকেই অধিক চেষ্টার প্রয়োজন হইয়াছিল। বিশেষতঃ উত্তরবঙ্গের ব্রাহ্মণ ভুঞাত্রয় বঙ্গের স্বাধীনতাকে মূলমন্ত্র স্থির না করিয়া সামাজিক প্রতিপত্তির দিকে অধিক মনোযোগী হন। সমাজপতি বলিয়াই তাহিরপুরের কংসনারায়ণ সৰ্ব্বত্র পূজিত হইতেন। এক্ষণে আমরা শেষোক্ত ছয়জন ভুঞার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতেছি।

গাজীগণ : ভাওয়াল

খৃষ্টীয় চতুৰ্দ্দশ শতাব্দীতে পালবংশীয় জমিদারদিগকে ধ্বংস করিয়া পলোয়ান শাহ নামক একজন ধর্মপ্রচারক যোদ্ধা ভাওয়াল অঞ্চলে এক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তৎপুত্র কারফরমা সাহেব সাধু ছিলেন এবং তাঁহার অনেক অদ্ভুত কর্ম্মের গল্প আছে। তাঁহারই অধস্তন সপ্তম পুরুষে মহতা গাজীর পুত্র ফজল গাজী আকবরের সময়ে ভুঞা ছিলেন। মানসিংহ যখন ঈশা খাঁ প্রভৃতি ভুঞাগণের বিরুদ্ধে পূর্ব্ববঙ্গে আসেন, তখন গাজীগণ সহজে অধীনতা স্বীকার করেন।[২৫] চাঁদপ্রতাপের চাঁদগাজী এই একই বংশের অন্য শাখা। সুতরাং তাঁহাকে পৃথক্ ভুঞা বলিয়া উল্লেখ করা যুক্তিযুক্ত নহে।[২৬]

হাম্বীর মল্ল : বিষ্ণুপুর

বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত বিষ্ণুপুরের প্রাচীন নাম মল্লভূমি এবং এখানকার রাজাবা মল্ল বলিয়া খ্যাত। খৃষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে রঘুনাথ সিংহ নামক একজন ক্ষত্রিয় রাজপুত্র বৃন্দাবন অঞ্চল হইতে আসিয়া এখানে এক রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বিষ্ণুপুরের আদিমল্ল। তৎপরে ৪৭ জন রাজার পর বীর হাম্বীর রাজত্ব পান (১৫৯৬)। তিনিই আকবরের সময়ে বিখ্যাত ভুঞা নৃপতি। সে সময়ে তিনি মোগলের নিকট নামে মাত্র অধীনতা স্বীকার করেন। মুর্শিদকুলি খাঁর সময়েই এই বংশের সহিত প্রথম জমিদারী বন্দোবস্ত হয়।[২৭]

কংসনারায়ণ : তাহিরপুর

ভট্টনারায়ণের বংশধর, বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ-কুলভূষণ বিজয় লস্কর তাহিরপুরের জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতা। কথিত আছে, তিনি দিল্লীশ্বর বা বঙ্গের কোন স্বাধীন সুলতান কর্তৃক বঙ্গের পশ্চিম দ্বার রক্ষার ভারপ্রাপ্ত জমিদার হইয়া। ২২ পরগণা এবং ‘সিংহ’ উপাধি লাভ করেন। বারাহী নদীর তীরে রামবামা নামক স্থানে তাঁহার রাজধানী ছিল। তৎপুত্র উদয়নারায়ণের সময় তাহিরপুর ব্যতীত অন্য পরগণাগুলি বাজেয়াপ্ত হয়। এই উদয়ের পৌত্রই প্রসিদ্ধ কংসনারায়ণ। তিনি বারেন্দ্রকুলের প্রধান সংস্কারক এবং তদানীন্তন বাঙ্গালী হিন্দুসমাজের নেতা ছিলেন। কেহ কেহ বলেন,

তিনি সুলেমান কররাণীর অধীন ফৌজদার ছিলেন এবং টোডরমল্ল তাঁহাকে ‘রাজা’ উপাধি দিয়া বঙ্গ বিহারের দেওয়ান করিয়াছিলেন। এমন কি, গৌড়ের মহামারীতে মুনেম খাঁর মৃত্যু হইলে, তিনি অস্থায়ীভাবে কিছুকাল সুবেদারী করিয়া গৌড়েশ্বর হইয়াছিলেন। পরে তিনি কেবলমাত্র বঙ্গের দেওয়ান ছিলেন। তিনিই বঙ্গে দুর্গোৎসব নামক মহাযজ্ঞের প্রথম প্রবর্তন করেন। সমগ্র বঙ্গের ভুঞা নৃপতিগণ অবনত মস্তকে তাঁহার উপদেশ গ্রহণ করিতেন।[২৮]

রামকৃষ্ণ : সাতৈর

সামউদ্দীন ইলিয়াস্ যখন বাঙ্গালার প্রথম স্বাধীন সুলতান (১০৩৯-৫৮), তখন তিনি বিশিষ্টভাবে দুইজনের সাহায্য পান, —উভয়ই বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ, শিখাই সান্যাল ও সুবুদ্ধি ভাদুড়ী। উভয়েরই খাঁ উপাধি ও বিস্তীর্ণ জমিদারী হইয়াছিল। সুবুদ্ধির বংশধরেরা ভাদুড়ী চক্র বা ভাতুড়িয়া পরগণার জমিদারী পান; এই বংশীয় রাজা গণেশ বঙ্গের স্বাধীন সুলতান হইয়াছিলেন। শিখাই বা শিখিবাহন সান্যালের পুত্র বলাই সাঁতোড়ের রাজা হন।[২৯] টোডরমল্ল এই বংশীয় রাজা রামকৃষ্ণকে সামন্ত নৃপতি বলিয়া স্বীকার করেন এবং তিনি ভাতুড়িয়ার জমিদারী হ্রাস করিয়া সাঁতোড়ের বিস্তৃতি ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করিয়া দেন। এইরূপে ভাতুড়িয়ার জমিদারী হ্রাস করা হইয়াছিল বলিয়া তথাকার ভূস্বামী দ্বাদশ ভৌমিকের অন্যতম বলিয়া স্বীকৃত হন না। নতুবা আকবরের পূর্ব্বে ভাতুড়িয়ার অধিপতি একজন প্রধান ভৌমিক ছিলেন। ৩০ রামকৃষ্ণ বিদ্যোৎসাহিতা ও পুণ্যকীর্তির জন্য সুবিখ্যাত ছিলেন। রামকৃষ্ণের পত্নী শর্ব্বাণী দেবীর মৃত্যুর পর এই রাজ্য নাটোরের রামজীবনের সহিত বন্দোবস্ত হয়।

পীতাম্বর : পুঁটিয়া

বৎসাচার্য্য নামক এক সন্ন্যাসী পুঁটিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। ইনি বাগ্‌চি উপাধিধারী এবং বারেন্দ্রব্রাহ্মণবংশীয় কুলীন। সম্ভবতঃ টোডরমল্লই লস্করপুর পরগণা বৎসাচার্য্যের পুত্র পীতাম্বরের সহিত বন্দোবস্ত করেন। তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা নীলাম্বরই প্রথম ‘রাজা’ উপাধি পান। এক্ষণে এই নীলাম্বরের ধারাই চলিতেছে। পীতাম্বর একজন ভৌমিক ছিলেন বটে, কিন্তু তিনি যে অন্যান্য প্রধান ভৌমিকদিগের মত কোন বিশিষ্ট বীরব্রতে দীক্ষিত হইয়াছিলেন, এমন প্রমাণ নাই। নীলাম্বরের প্রপৌত্র দর্পনারায়ণের সময় নাটোর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রঘুনন্দন সামান্য কাৰ্য্যে পুঁটিয়া সরকারে প্রবেশ করেন এবং পুঁটিয়ার উকীলরূপেই মুর্শিদাবাদে নবাব-দরবারে প্রেরিত হন।[৩১]

লোহানীগণ : উড়িষ্যা ও হিজলী

সুলেমান কররাণী কর্তৃক উড়িষ্যা বিজয়ের সময় হইতে আফগান জাতীয় কতলু খাঁ লোহানী পুরীর শাসনকর্তা ছিলেন।[৩২] তাঁহারই এক জ্ঞাতি ভ্রাতা ঈশা খাঁ লোহানী তাঁহার উকিল স্বরূপ রাজধানীতে থাকিতেন। সুলেমানের পুত্র দায়ুদ স্বাধীনতা ঘোষণা করিলে, কতলু খাঁ উড়িষ্যার সৰ্ব্বেসর্বা হন এবং ঈশা খাঁ তখন হইতে তাঁহার প্রধানমন্ত্রী হন। কতলুর মৃত্যুর পর (১৫৮৯) তাঁহার নাবালক পুত্রগণের[৩৩] পক্ষ হইতে ঈশা খাঁ বঙ্গের সুবাদার রাজা মানসিংহের সহিত সন্ধি করেন। ইহার পূর্ব্ব হইতে তিনি হিজলীতে এক নূতন রাজ্য স্থাপন করিয়াছিলেন। তিনি নিজের জীবদ্দশায় কিছুকাল মোগলের সহিত সন্ধিসূত্র অবিকৃত রাখেন।[৩৪] কতলু খাঁর জীবদ্দশায় ঈশার পুত্র ওসমান খাঁ উড়িষ্যা রাজ্যের প্রধান সেনাপতি ছিলেন।[৩৫] পিতার মৃত্যুর পর হইতে তিনি উড়িষ্যা অঞ্চলে মোগলের বিপক্ষে ভীষণ বিদ্রোহ উপস্থিত করেন। মানসিংহ এই বিদ্ৰোহ দমন করিতে পারেন নাই। অবশেষে জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে ইসলাম খাঁ যখন বঙ্গের সুবেদার হইয়া আসেন, তখনই ওসমান পরাজিত ও নিহত হন (১৬১২)।[৩৬] ভুঞা বিদ্রোহ দমনের জন্য মোগলদিগকে বহুবৎসর ধরিয়া যে ভাবে ত্রস্ত ও ব্যতিব্যস্ত হইতে হইয়াছিল, তাহা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় সমঙ্কিত রহিয়াছে। তন্মধ্যে আবার ঈশা ও তাঁহার বীর পুত্রের প্রাণান্ত চেষ্টা, কূটনীতি ও দোৰ্দ্দণ্ড প্রতাপ মোগলকে বিংশাধিক বর্ষকাল যথেষ্ট বিড়ম্বিত করিয়াছে। খিজিরপুরের ঈশা খাঁর মত হিজলী অঞ্চলের এই ঈশা খাঁ লোহানীও যে ভুঞাদিগের অন্যতম ছিলেন তৎপক্ষে সন্দেহ নাই। ওসমানের পতন সৰ্ব্বশেষে হইয়াছিল বলিয়া আমরা তাঁহাকে ভুঞার তালিকায় সর্ব্বশেষে স্থান দিয়াছি। নতুবা রাজনৈতিক কৌশল এবং বীর্য্যগৌরবে তিনি অনেকের অগ্রগণ্য ছিলেন।

প্রথম ও প্রধান ছয় জন ভুঞার মধ্যে খিজিরপুরের ঈশা খাঁই সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য। কারণ দায়ুদের পতনের পর তিনি বহুসংখ্যক পাঠান সেনার অধিনায়ক হইয়া সুদূর পূর্ব্ববঙ্গে এক রাজ্য স্থাপন করিয়া প্রথম ভাগে প্রতাপশালী হইয়া উঠিয়াছিলেন। তবে তিনি যে সকলের প্রধান ছিলেন এবং অন্যান্য ভুঞাদিগের উপর আধিপত্য বিস্তার করিতে সক্ষম হইয়াছিলেন, তাহা বোধ হয় না। ৩৭ পাইমেণ্টার বিবরণী হইতে আমরা জানিতে পারি যে, তৎকালীয় ভুঞাদিগের মধ্যে কেদার রায়, প্রতাপাদিত্য ও ঈশা খাঁ প্রধান। কিন্তু এই তিনজনের মধ্যে ঈশা খাঁ সৰ্ব্বাগ্রে (১৫৯৫) বশ্যতা স্বীকার করেন। অপর দুইজন উহার বহু পরেও বশ্যতা স্বীকার করেন নাই, স্বদেশের জন্য প্ৰাণ দিয়া তাঁহাদের অবসান হইয়াছিল। সুতরাং প্রধান স্থান দিতে হইলে সর্ব্বাগ্রে বিচার করিতে হইবে, প্রতাপাদিত্য ও কেদার রায় এই উভয়ের মধ্যে কাহার প্রাপ্য। আমরা তাহা পরে দেখিব। অপর তিনজন ভুঞার মধ্যে ভূষণার মুকুন্দরামই বহুদিন পর্যন্ত মোগলের বিপক্ষতাচরণ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন উহার প্রধান কারণ এই যে, তিনি মোগলের স্বপক্ষীয় বা বিপক্ষ ইহাই বুঝিতে বিলম্ব হইয়াছিল, তিনি তখনও মোগলের বশ্যতা স্বীকার করিতেন, সামান্য পেশকস্ দিতেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে রাজ্যবিস্তার করিতে না পারিলেও অন্য ভুঞার সহিত গুপ্ত সন্ধি করিতেন এবং এক প্রকার স্বাধীনভাবে রাজ্যশাসন করিতেন। বাক্লার কন্দর্প রায় ও তৎপুত্র রামচন্দ্র এবং ভুলুয়ার লক্ষ্মণমাণিক্য মোগলের শত্রু হওয়া অপেক্ষা নিজেদের মধ্যে আত্মকলহেই অধিক বিব্রত ছিলেন। রামচন্দ্র লক্ষ্মণমাণিক্যকে হত্যা করেন, পরে নিজেই মোগল চরণে অবনত হইয়া পড়েন। কিন্তু এই কয়েক জন ভুঞা সম্বন্ধে কোন সমালোচনা করিবার পূর্ব্বে তাঁহাদিগের সংক্ষিপ্ত পরিচয় জানা আবশ্যক।

ঈশা খাঁ

সুলেমান কররাণীর মৃত্যুর পর বায়াজিদের শাসনকালে ঈশা খাঁ৩৮ প্রথম সৈনিক বিভাগে প্রবেশ করেন এবং অসামান্য প্রতিভাবলে অচিরে আড়াই হাজারী সেনানায়ক হন। দায়ুদের সময়ে তিনি একজন বিশিষ্ট সেনানী ছিলেন এবং আকমহলের যুদ্ধে প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়াছিলেন। দায়ুদের মৃত্যুর পর তাঁহার সৈন্যদলের অনেকে ঈশার আশ্রয় গ্রহণ করে। তিনি উহাদের সাহায্যে সোনারগাঁও-এর অন্তর্গত খিজিরপুরে রাজধানী স্থাপন করেন। শ্রীপুরের চাঁদ রায় ও কেদার রায়ের সহিত তাঁহার বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু তিনি দৈবক্রমে একদিন চাঁদ রায়ের বিধবা কন্যা সোনামণিকে দর্শন করিয়া রূপোন্মত্ত হন ও পরে চাঁদ রায়ের বিশ্বাসঘাতক কৰ্ম্মচারী শ্রীমন্ত খাঁকে হস্তগত করিয়া সোনামণিকে হরণ করিয়া লইয়া বিবাহ করেন।[৩৯] এই অপমানে চাঁদ রায় অচিরে প্রাণত্যাগ করেন (১৫৮৩) এবং কেদার রায় প্রতিশোধ লইবার জন্য আজীবন বিদ্বেষবহ্নি প্রদীপ্ত রাখিয়াছিলেন। ঈশা খাঁ প্রথমতঃ বাদশাহের আনুগত্য স্বীকার করিয়া বাজুহা ও সোণারগাঁ এই দুই সরকারের শাসনভার পান এবং কতকগুলি নূতন দুর্গ নির্ম্মাণ ও পুরাতন দুর্গের সংস্কার করিয়া লন। তৎপরে যথেষ্ট সৈন্য সংগ্রহ করিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৫৮৫ খৃষ্টাব্দে শাহবাজ খাঁ তাঁহার বিরুদ্ধে প্রেরিত হইয়া প্রকৃতপক্ষে তাঁহার কিছুই করিতে পারেন না।[৪০] ঈশা খাঁ সোণারগাঁয়ে ও পরে কোচরাজাকে পরাজিত করিয়া জঙ্গলবাড়ীতে পৃথক রাজধানী স্থাপন করেন। অবশেষে রাজা মানসিংহ তাঁহার বিরুদ্ধে প্রেরিত হইয়া প্রথমতঃ একডালা ও পরে এগারসিন্ধু দুর্গে তাঁহাকে অবরুদ্ধ করিয়া যুদ্ধ করেন। তিনি ঈশা খাঁর সাহসিকতায় প্রীত হইয়া তাঁহার সহিত সন্ধি করেন। ঈশা খাঁ তাঁহার সহিত আগ্রায় গিয়া ২২ পরগণার জমিদারী ও মসনদ-ই-আলি উপাধি লাভ করেন। ১৫৯৯ খৃষ্টাব্দে তাঁহার মৃত্যু হয়।[৪১]

কেদার রায়

চাঁদ রায় ও কেদার রায় দুই ভ্রাতা। তন্মধ্যে চাঁদ রায় জ্যেষ্ঠ। প্রবাদ এই, নিম রায় নামক এক ব্যক্তি কর্ণাট দেশ হইতে আসিয়া বিক্রমপুরের অন্তর্গত আড়া ফুলবাড়িয়া নামক স্থানে বাস করেন এবং পরে বঙ্গজ কায়স্থ সমাজে প্রবেশ করিয়া ঘৃতকৌশিক গোত্রীয় দেব-বংশীয় বলিয়া আত্মপরিচয় দেন। সম্ভবতঃ চতুৰ্দ্দশ শতাব্দীর প্রারম্ভে নিম রায় আগমন করেন। সে যুগে দেববংশের কয়েক শাখা বঙ্গের নানাস্থানে বসতি করিতেছিলেন।[৪২] চাঁদ রায় ও কেদার রায় নিম রায় হইতে অধস্তন সপ্তম পুরুষ। পাঠান রাজত্বের পতনের পর ১৫৮০ খৃষ্টাব্দে যে সময় বঙ্গ ভরিয়া ঘোর বিদ্রোহবহ্নি জ্বলিয়াছিল, তাহার পূর্ব্ব হইতেই দুই ভ্রাতা সুবর্ণগ্রামের সন্নিকটস্থ শ্রীপুরে রাজধানী স্থাপন করিয়া, সবিক্রমে শাসনদণ্ড পরিচালনা করিতে থাকেন। তাঁহারা প্রতাপশালী হইয়া যথেষ্ট নৌবল সঞ্চয় করেন এবং সন্দ্বীপ প্রভৃতি অধিকার করিয়া লন। দায়ুদের প্রথম পরাজয়ের পর (১৫৭৫) মোগল পক্ষীয় ইতিমদ্ খাঁ প্রভৃতি কয়েকজনে সোনারগাঁও দখল করিতে আসেন।[৪৩] তখন সন্দ্বীপ চাঁদ রায়ের হস্তচ্যুত হইয়া ফতেহাবাদ সরকারের অন্তর্ভুক্ত হয়। ঈশা খাঁর সহিত বিবাদের জন্য কেদার রায় বহুদিনমধ্যে সেদিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিতে পারেন নাই। এই সময়ে কার্ভালো প্রভৃতি পর্তুগীজগণ ঐ দ্বীপ অধিকার করিয়া কিছুকাল শাসন করিয়াছিলেন। কিন্তু অবশেষে উহা আরাকান রাজ্যের অধিকৃত হয় (১৬০২)। তখন কার্ভালো কতকগুলি জীর্ণতরী লইয়া আশ্রয়ের জন্য শ্রীপুর অভিমুখে যান। এই সময় মানসিংহ মুণ্ডা রায় নামক এক সেনাপতিকে শ্রীপুর অধিকার করিবার জন্য প্রেরণ করেন। পথে নৌযুদ্ধকালে কার্ভালো কেদার রায়ের পক্ষে নেতৃত্ব করেন। সে যুদ্ধে মুণ্ডা রায় পরাজিত ও নিহত হন।[৪৪] তখন মানসিংহ স্বয়ং আসিয়া কেদার রায়কে পরাজিত করেন। কেদার রায় সপরিবারে সমুদ্রাভিমুখে প্রস্থান করেন। মানসিংহ তখন তাঁহার সহিত সন্ধি করিয়াছিলেন। কিন্তু কেদার সন্ধিমত কর না দিয়া পূৰ্ব্ববৎ স্বাধীন ভাবেই ছিলেন। তখন মানসিংহের আদেশক্রমে সেনাপতি কিলমক্‌ আসিয়া বিপুলবাহিনী সহ শ্রীপুর আক্রমণ করেন। কিন্তু তিনিও যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হইলেন। এইবার মানসিংহ স্বয়ং আসিয়া ফতেজঙ্গপুরের বিখ্যাত যুদ্ধে কেদার রায়কে পরাজিত ও নিহত করেন এবং পূর্ববঙ্গ অধিকার করিয়া লন।[৪৫] ধর্ম্মনিষ্ট মান শ্রীপুর পরিত্যাগ করিবার সময় কেদার রায়ের শিলাময়ী দেবীকে লইয়া প্রস্থান করেন।[৪৬]

মুকুন্দরাম রায় : ভূষণা

সেনাপতি মুনেম খাঁ যখন (১৫৭৪) সসৈন্যে বঙ্গে আসেন, তখন মোরাদ খাঁ নামক একজন সেনানী তাঁহার সহচর ছিলেন। তিনি ফতেহাবাদ[৪৭] সরকারে বিদ্রোহ দমন করেন।[৪৮] ভূষণাই এই সরকারে প্রধান জমিদারী ছিল। ১৪৮৪ খৃষ্টাব্দে লিখিত বিজয় গুপ্তের ‘মনসামঙ্গলে’ দেখিতে পাই, তখন অৰ্জ্জুন নামক এক রাজা ফতেহাবাদের জমিদার ছিলেন।

‘উত্তরে অৰ্জ্জুন রাজা প্রতাপেতে যম
মুল্লুক ফতেয়াবাদ বঙ্গরোড়া তক সীম।’
–দীনেশ সেন, ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’, ১৬৭ পৃ

এই অৰ্জ্জুন রাজার সহিত পরবর্ত্তী জমিদার মুকুন্দরামের কোন রক্তসম্বন্ধ ছিল কি না, জানা যায় না। দায়ুদের সহিত মুনেম খাঁর সন্ধি হইলে, মোরাদ জলেশ্বরের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। মুনেমের মৃত্যুর পর যখন দায়ুদ পুনরায় বিদ্রোহী হইয়া ভদ্রকের শাসনকর্তা নজর বাহাদুরকে হত্যা করেন, তখন মোরাদ পুনরায় ফতেহাবাদে প্রেরিত হন এবং তথায় তাঁহার মৃত্যু হয়।[৪৯] মৃত্যুর পর তৎপ্রদেশীয় জমিদার ভূষণাধিপতি মুকুন্দরাম মোরাদের পুত্রগণকে অন্যায়রূপে হত্যা করিয়া সমগ্র ফতেহাবাদের রাজা হন।[৫০] টোডর মল্ল তাঁহাকেই ভূষণার জমিদার বলিয়া স্বীকার করেন (১৫৮২)। মুকুন্দরাম মধ্যে মধ্যে নামে মাত্র সামান্য পেশকস্ পাঠাইয়া বাদশাহের অধীনতার ভাণ করিতেন কিন্তু কার্য্যতঃ তিনি স্বাধীনই ছিলেন। আকবরের রাজত্বের অবশিষ্টকাল তিনি অন্যান্য ভুঞাগণের সহিত নানাসূত্রে যোগদান করিয়া দেশব্যাপী বিদ্রোহের অন্যতম নেতা ছিলেন। প্রতাপাদিত্য বা কেদার রায়ের রাজত্ব উৎসন্ন হইলেও মুকুন্দরাম দমিত হন নাই। জাহাঙ্গীরের সময়ে ইসলাম খাঁ (১৬০৮) বঙ্গের শাসনকর্তা হইয়া আসিলে, তিনি মুকুন্দরামের সহিত বন্ধুত্ব স্থাপন করেন এবং তাঁহার অধীন একদল সৈন্য পাঠাইয়া কোচহাজো (কামরূপ) অধিকার করিয়া লন। তখন মুকুন্দরাম পাণ্ডু ও গৌহাটির থানাদার নিযুক্ত হন। পরে তিনি সে পদে স্বীয় পুত্ৰ সত্রাজিৎকে রাখিয়া স্বয়ং ভূষণায় আসেন। এবং প্রবল পরাক্রান্ত হইয়া পেশকস্ বন্ধ করেন। কথিত হয়, এই সময়ে তিনি বঙ্গের শাসনকর্তা সৈয়দ খাঁ কর্তৃক পরাজিত ও নিহত হন ৫১ জাহাঙ্গীরের শাসনকালে যখন ইসলাম খাঁ বঙ্গের সুবেদার হইয়া আসেন, তখন সত্রাজিৎ ঢাকায় আসিয়া তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করেন। অধ্যাপক যদুনাথ সরকার কর্তৃক আবিষ্কৃত আবদুল লতীফের ভ্রমণ-কাহিনী বিষয়ক ফার্সী গ্রন্থ হইতে [পরিশিষ্ট দ্র., শি মি] জানিতে পারি, ইসলাম খাঁর ঢাকা যাইবার পথে ভূষণার রাজা সত্রাজিৎ বা শাহজাদা রায় কয়েকটি হাতী উপহার দিয়া নবাবের সহিত সাক্ষাৎ করেন (প্রবাসী, ১৩২৬, ১ম খণ্ড, ৫৫২ পৃ)। নবাব পুনরায় কোচহাজো অধিকার করিবার জন্য যে সৈন্য প্রেরণ করেন, তাহার সহিত সত্রাজিৎ ছিলেন। কিন্তু কাৰ্য্যতঃ সত্রাজিৎ কোচহাজোর রাজাভ্রাতা বলদেবের সহিত গুপ্ত ষড়যন্ত্র করিয়া মোগলের গতিবিধি সমস্ত বিজ্ঞাপিত করেন। তখন সত্রাজিৎ বন্দী হইয়া ঢাকায় আনীত হইয়া নিহত হন (১৬৩৬)।

কন্দর্পনারায়ণ : চন্দ্রদ্বীপ

চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের আদিপুরুষ দনুজমদনের বৃদ্ধ প্রপৌত্র জয়দেব অল্পকাল রাজত্বের পর অপুত্রকে মৃত্যুমুখে পতিত হন।[৫২] তাহার একমাত্র কন্যা কমলার সহিত বলভদ্র বসুর বিবাহ হয় কমলার পুত্র পরমানন্দ বসু রাজ্যের উত্তরাধিকারী হন। তৎপুত্র জগদানন্দ বাব্লার জলোচ্ছ্বাসে প্রাণত্যাগ করেন (১৫৮৪)।[৫৩] জগদানন্দের পুত্রের নাম রাজা কন্দর্পনারায়ণ। ইনিই বারভুঞার অন্যতম। কন্দর্পনারায়ণ বরিশালের নিকটবর্ত্তী কচুয়া হইতে স্বীয় রাজধানী মাধবপাশা নামক স্থানে স্থানান্তরিত করিয়া ১৪/১৫ বৎসরকাল সদর্পে রাজত্ব করেন। ইঁহার সময়ে ভুঞাদিগের মধ্যে আত্মকলহে এবং মগ ও ফিরিঙ্গির (পর্তুগীজ) অত্যাচারে দেশ উৎসন্নপ্রায় হইয়াছিল। কন্দর্পনারায়ণ বীরপুরুষ ছিলেন তিনি বহুবার মগ ও ফিরিঙ্গির সহিত যুদ্ধ করিয়া দেশ রক্ষা করিয়াছিলেন।[৫৪] ভুলুয়ার লক্ষ্মণমাণিক্য ঈর্ষান্বিত হইয়া কন্দর্পের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন; এবং মগাদি দস্যুর হস্ত হইতে দেশরক্ষাকল্পে কন্দর্প ও প্রতাপাদিত্য এই উভয় মহাবীরের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপিত হইয়াছিল। প্রসঙ্গক্রমে আমাদিগকে পরে এই সব ঘটনা বিবৃত করিতে হইবে। কন্দর্পনারায়ণের মৃত্যুর পর তাঁহার অপ্রাপ্তবয়স্ক পুত্র রামচন্দ্র রাজা হন। ইনি প্রতাপাদিত্যের জামাতা। প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসে ইঁহার বিবরণ দেওয়া হইবে।

লক্ষ্মণমাণিক্য : ভুলুয়া

কথিত আছে পাঠানদিগের দ্বারা বঙ্গবিজয়ের অব্যবহিত পরে বঙ্গাধিপ আদিশুরের বংশীয় রাজা বিশ্বম্ভর রায় চন্দ্রনাথতীর্থে যাওয়ার পথে মেঘনা নদের এক নবোত্থিত চরে ভুলুয়া নামে এক নূতন রাজ্য স্থাপন করেন।[৫৫] বিশ্বম্ভরের পর একাদশ পুরুষে লক্ষ্মণমাণিক্য প্রাদুর্ভূত হন। বীরত্বের খ্যাতিতে তিনি বারভুঞার অন্যতম বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন। লক্ষ্মণমাণিক্যের সহিত কন্দর্পের পুত্র রামচন্দ্রের বিবাদ ছিল। তাহারই ফলে রামচন্দ্র বহু রণতরী লইয়া গিয়া ভুলুয়া আক্ৰমণ করিয়া লক্ষ্মণমাণিক্যকে বন্দী করিয়া আনেন। পরে রামচন্দ্রের আদেশে মাধবপাশা রাজবাটীতে লক্ষ্মণ নিহত হন।[৫৬ লক্ষ্মণমাণিক্য শুধু বীর ছিলেন না, তিনি অসাধারণ পণ্ডিত ও সুকবি ছিলেন।[৫৭]

প্রতাপাদিত্য

আমরা এ পর্যন্ত একাদশজন ভুঞার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়াছি, এখন অবশিষ্ট মাত্র প্রতাপাদিত্য; ইনি ভুঞাগণের মধ্যে সর্ব্বাপেক্ষা বিশিষ্ট এবং বীরত্বে ও রাজশক্তি পরিচালনায় সর্ব্বাগ্রগণ্য। ইঁহারই জন্য এক সময় যশোহর প্রাচীন গৌড়ের যশঃ হরণ করিয়া ‘যশোহর’ হইয়াছিল; মোগল আমলের যশোহরের ইতিহাসে ইনিই প্রধান ব্যক্তি। আমরা এখন যশোহর- খুলনার যে যুগের ইতিহাস লইয়া ব্যাপৃত, তাহাকে প্রতাপাদিত্যের ইতিহাস বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। ২৫ বৎসর মাত্র প্রতাপাদিত্যের রাজত্বকাল বা বীরত্বের যুগ হইলেও, পরবর্ত্তী দুইশত বৎসর ধরিয়া তাঁহার এবং তদীয় সেনাপতিবর্গের কীর্তিকাহিনী এমন করিয়া যশোহর-খুলনার অঙ্ক অলঙ্কৃত করিয়া রাখিয়াছে, তাঁহাদের প্রতিভা ও প্রতিপত্তি এমনভাবে এদেশের সমাজকে অনুপ্রাণিত বা স্মৃতিমুগ্ধ করিয়া রাখিয়াছে যে, যশোহর-খুলনা যেন ‘প্রতাপময়’ হইয়া গিয়াছে। এইজন্য পরবর্ত্তী অধ্যায় হইতে অপেক্ষাকৃত বিস্তৃতভাবে আমরা প্রতাপের কথা বলিব। প্রতাপের কথা বলিতে গিয়া আমাদিগকে স্থানে স্থানে প্রসঙ্গতঃ ভুঞারাজগণের কথা উল্লেখ করিতে হইবে। সেজন্য এ অধ্যায়ে প্রধান প্রধান ভুঞাগণের পরিচয় মাত্র দিয়া রাখিলাম।

মোগলের বিপক্ষতাচরণ করাই ভুঞারাজগণের প্রধান উদ্দেশ্য এবং এইজন্য তাহাদের সমবেত চেষ্টা নিয়োজিত হইয়াছিল। নতুবা তাঁহাদের মধ্যে পরস্পরের কোন প্রকার মিলন বা সহানুভূতি ছিল না। তাঁহাদের সকলেই কোনও না কোন ভাবে পাঠান নৃপতিদিগের নিকট অনুগৃহীত ছিলেন; মোগলের আক্রমণে যখন পাঠানেরা ক্রমে ক্রমে বঙ্গ হইতে উৎখাত হইতেছিলেন, তখন তাঁহারা এই দেশীয় রাজন্য বা ভৌমিকগণের নিকট সাহায্যপ্রার্থী হন। ভুঞাগণ লবণের মর্য্যাদা রক্ষা করিবার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে অবতরণ করেন। সকলের এক উদ্দেশ্য, তাই তাঁহাদের মধ্যে ভিতরে ভিতরে একটা সম্পর্ক ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিবিশেষের আত্মগরিমা বা জাতীয় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার কল্পনা যে ছিল না, তাহা নহে; তবে আত্মরক্ষা এবং পাঠানদিগকে সাহায্য করাই প্রধান সাধনা হইয়াছিল। শুধু পশ্চিম দেশ হইতে আগত মোগল নহে, ভুঞাদিগের আরও শত্রু ছিল; দক্ষিণ ও পূর্ব্বদিক হইতে আগত আরাকানী মগ, এবং ফিরিঙ্গি বা পর্তুগীজ দস্যুগণের পাশবিক অত্যাচারে দেশ উৎসন্ন ও মনুষ্যশূন্য হইয়া যাইতেছিল; সকলের না হউক, অন্ততঃ যাঁহাদের রাজ্য সমুদ্রকূলবর্ত্তী, তাঁহারা প্রজার জীবন রক্ষার জন্য এদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ না করিয়া পারিতেন না। তাই সময়ে সময়ে কয়েকজন মিলিয়া এই সাধারণ শত্রুর সহিত যুদ্ধ করিতেন। সে শত্রুগণও সহজ দস্যু নহে, তাহারাও রাজনৈতিক কূটকৌশলে অতুলনীয়; নানাভাবে ভুঞাদিগের দরবারে প্রবেশ লাভ করিয়া কখনও উৎকোচ উপহার দিয়া, কখনও স্বার্থের মোহে অন্ধ করিয়া, ভেদনীতিদ্বারা ভুঞাসম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসানল জ্বালাইয়া দিত। তখন ভুঞাগণ আত্মঘাতীর মত পরস্পরের সহিত যুদ্ধরত হইতেন এবং সাগরতরঙ্গ বা নদীবক্ষ নররক্তে রঞ্জিত করিয়া নিজেরাই দুর্ব্বল হইয়া পড়িতেন। মোগলের বিপুল বাহিনী যাঁহাদের দ্বারে দ্বারে হানা দিতেছিল, তাঁহাদের পক্ষে এইরূপভাবে বলক্ষয় বা ধনক্ষয় দ্বারা দুর্ব্বল হইয়া পড়া বিশেষ আশঙ্কার বিষয়ই ছিল এবং তাহাতে উঁহাদের পতনের পথই পরিষ্কার করিয়া দিতেছিল। মগ- ফিরিঙ্গির অত্যাচার মোগলেরই কার্য্যসিদ্ধির সহায় হইয়াছিল। পরে যখন ভুঞাদিগের পতন হইয়া গেল, তখন ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে মোগলদিগকে অসংখ্য রণতরী পাঠাইয়া চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই সকল শত্রু নিপাত করিতে হইয়াছিল। বঙ্গের বারভুঞা পরাক্রান্ত আকবর বাদশাহের রাজশক্তিকে পরীক্ষা করিয়া লইয়াছিল; যদি সে পরীক্ষায় আকবর জয়ী না হইতেন, তবে পাঠানের করচ্যুত রাজদণ্ড কাহার হস্তে শোভা পাইত তাহা বলা যায় না! সময় অল্প বা সুযোগ স্বল্প হইলেও, ভুঞাগণ আপন আপন ক্ষেত্রে যে রণদক্ষতা ও রাজনৈতিক মস্তিষ্কের পরিচয় দিয়াছিলেন, অপর পক্ষে মানসিংহ বা টোডরমল্লের অসাধারণ প্রতিভার সহায়তা না থাকিলে, তাঁহারা বঙ্গের ভাগ্য নূতন করিয়া গড়িতে পারিতেন। অবশেষে ভুঞাদিগের অভ্যুত্থান বিফল হইলেও তাঁহাদের শক্তিসঞ্চয় ও প্রচেষ্টার ফল বহুদূর পর্য্যন্ত গড়াইয়াছিল। প্রতাপাদিত্যের ইতিহাস হইতে আমরা তাহার সুস্পষ্ট আভাস পাইব। তাঁহার সাধনার ফলে এমনভাবে যশোহর- খুলনার ভাগ্যসূত্র সমগ্র বঙ্গের সহিত মিশিয়া গিয়াছিল যে, এই ক্ষুদ্র রাজ্যখণ্ডের ইতিহাসকে বঙ্গেতিহাস হইতে পৃথক্ করা যায় না।

পাদটীকা :

১. Bourdillon, J. A. – Bengal under the Mahomedans, p. 23.

২. Smith, V. A. – Akbar, p. 147. MMM

৩. ধন্য রাজা মানসিংহ, বিষ্ণুপদে যেন ভৃঙ্গ, গৌড়-বঙ্গ-উৎকল মহীপ।
রাজা মানসিংহ কালে, প্রজার পাপের ফলে, ডিহিদার মামুদ সরীপ।।
উজীর হইল রায়জাদা, বেপারির দেয় খেদা, ব্রাহ্মণের বৈষ্ণবের হ’ল অরি।
কোণে কোণে দিয়া দড়া, পনর কাঠায় কুড়া, নাহি শুনে প্রজার গোহারি।।
সরকার হইলা কাল, খিলভূমি লেখে লাল, বিনা উপকারে খায় খতি।
পোদ্দার হইল যম, টাকায় আড়াই আনা কম, পাই লভ্য লয় দিন প্ৰতি।।
জমিন্দার প্রতীত আছে, প্রজারা পলায় আছে, দুয়ারে চাপিয়া দেয় থানা।
প্রজা হইল ব্যাকুলি, বেচে ঘরের কুড়লি, টাকার দ্রব্য বেচে দশ আনা।।

—কবিকঙ্কণ চণ্ডী, ৫ পৃ

৪. ‘Bhati is a low country and received this name because Bengal is higher.’-Akbar-nama, (Beveridge), Vol III, pp. 645-6. ‘The low marshy lands of Hegellee anciently called Batty as being in a great part subject to the overflowing of the tide.’-Fifth Report, p. 257; cf. also, Jarrett, Vol. ii, p. 116; Blochmann, p. 42; j. A.S.B. for 1873 p. 226. for 1913 p. 446; Elliot, Vol. Vi, p. 72.

৫. মনুসংহিতা, ৭ম অধ্যায়, ১৫৫-৬ শ্লোক।

৬. ‘বার ভুঞা বেষ্টিত বসেছে নরপতি।’-মাণিক গাঙ্গুলী, ধৰ্ম্মমঙ্গল, সা, পৃ, সং, ১৫১ পৃ

‘বার ভুঞে বেষ্টিত ভূপতি কর ভূষা’–ঐ, ১৫০ পৃ

‘ভূপতি দক্ষিণ ভাগে পাত্ৰ মহামদ,
রায়রেঞা বার ভুঞা বৈসে সারি সারি,
কোলে করি কাগজ যতেক কর্ম্মচারী।’—ঘনরামের ধর্মমঙ্গল, বঙ্গবাসী সং ১৫১ পৃ
‘হাতে বুকে বেষ্টিত বসেছে বার ভুঞা,
রায় রাঞা মোগল পাঠান মীর মিঞা।’–ঐ, ১৭৬ পৃ
‘গুজরাটে কালকেতু খ্যাতাইল রাজা,
আর কত ভুঞা রাজা সবে করে পূজা।’—কবিকঙ্কণ চণ্ডী।

৭. ‘It is not clear why the number twelve should always be associated with them. Both in Bengal and Assam, whenever they are enumerated, twelve persons are always mentioned but the actual names vary.’—Gait, Edward, History of Assam, p. 37.

৮. ভ্রমণকারী Manrique ১৬৩১ খৃষ্টাব্দে আরাকাণ রাজের রাজ্যাভিষেককালে স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন, এবং উহার বর্ণনাকালে লিখিয়াছেন—’… That the new dignitary had himself proclaimed, not only Lord of the twelve Boines (Bhuiyas) of Bengala, but of the twelve kings on he crown of whose heads the soles of his feet always rested.’ – Hosten’s Twelve Bhuiyas of Bengal, J. A. S. B. Vol. IX, p. 447; Manrique, S. – Itinerario, P. 206; Historical Accounts of Discoveries and Travels in Asia, Vol. I, pp. 110-11.

৯. ‘The reports of the Jesuit missionaries for the Mogul period possess special value, having been writ- ten by men highly educated, specially trained and endowed with powers of keen observation.’— Smith V. A, Oxford History of India, p. XXI.

১০. Nicholas Pimenta, Francis Fernandez, Dominic da Sousa, and Andrewes Bowes.

১১. Du Jarric, Pierre – Histoire des Indes orientales. Bordeaux. 1608. ইহার প্রয়োজনীয় অংশের বঙ্গানুবাদের জন্য নিখিলনাথ রায় প্রণীত ‘প্রতাপাদিত্য’ ৪৩৯-৫৯ পৃ দ্রষ্টব্য। [বর্তমান সংস্করণের ২৭শ পরিচ্ছেদ এবং পরিশিষ্টে অধ্যাপক যদুনাথ সরকারের ‘প্রতাপাদিত্যের সভায় খৃষ্টান পাদরী’ প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য— শি মি)।

১২. ‘All the Patans and native Bengalis obey these Boyons; Three of them are Gentiles namely those of Chandican, of Sripur and of Bacala. The others are Saracens.’ —J. & Pro. A. S. B. (H. Hosten) 1913 p. 437-8; Purchas-Pilgrimes. Part IV. Book V. p. 511.

আরও পর্তুগীজ ঐতিহাসিকদিগের পুস্তকে এই ভুঞা (Boyons or Bujoes of Bengala ) দিগের উল্লেখ পাওয়া যায়। তন্মধ্যে Philip De Brito এবং Bishop Dom Pedro, এই দুই জন প্রধান। — Ibid.

শ্রীপুর এখানে বিক্রমপুরের নামান্তর; বরিশাল বা চন্দ্রদ্বীপের নাম বালা; প্রাচীন যশোর বা প্রতাপাদিত্যের রাজ্যের অন্য নাম চ্যাণ্ডিকান। ইহার বিশেষ বিবরণ স্থানান্তরে প্রদত্ত হইবে।

১৩. Asiatic Researches, Vol. XIV, (Wilford), p. 451; Blochmann – Contributions to the History and Geography of Bengal, 1873, p. 18.

১৪. J. A. S. B. 1874, (Dr. J. Wise ), pp. 214; 1875, pp. 181 – 3; Beveridge – Bakarganj, p. 29; J.A.S.B. 1904, pp. 57-63.

১৫. Sebastian Manrique নামক স্পেনদেশীয় ভ্রমণকারী ১৬২৮ অব্দে ভারতবর্ষে আসেন। তিনি স্বদেশে গিয়া Itinerario de las Missiones নামক এক গ্রন্থ রোম হইতে প্রকাশিত করেন। উহা সাধারণতঃ Manrique’s Itinarary বলিয়া পরিচিত।

১৬. বীরেন্দ্রনাথ বসু ঠাকুর—’বাঙ্গালা নগরী’, শ্রীনাথ প্রেস, ঢাকা। এই পুস্তকে বিভারিজ বালাকে এবং হোষ্টেন টাড়াকে বাঙ্গালা বলিতে চান, এইরূপ আরও অনেক মতের খণ্ডন করা হইয়াছে। Beveridge-Bakarganj, p. 445; J.A.S.B. 1913. (Hosten), pp. 444-5.

১৭. ‘Minimican, son of Massacan, who had been Emperor of Bengal before the Moors conquered it – An unpublished letter of Fr. John Cabral, 1633. Moncmohan Chakravarti identifies Massacan with Muchha khan, son of Isa khan of katrabuh, J.A.S.B. 1913. p. 445; – বাঙ্গালা নগরী’, ৫০ পৃ।

১৮. Ain (Blochmann). p. 373 note; Dorn — History of the Afghans, Vol. I p. 183. হিজলীতে ঈশার দুর্গের চিহ্ন এখনও দেখিতে পাওয়া যায়।

১৯. A letter written on the 13th of October, 1812, by Mr. Crommelin, Collector of Hidgellee, quoted by Mr. Price, Settlement officer of Midnapur, in his report on Majnamutha, 1874-5, as well as by Mr. Bayley’s Settlement Report of Jalamutha Estate, 1844, both preserved in the Midnapur Collectorate. উহা হইতে জানিতে পারি যে, হিজলী রাজ্যের কর্মচারী কৃষ্ণ পাণ্ডে এবং ঈশ্বরী পট্টনায়ক যথাক্রমে জ্বালামুটা ও মাজনামুটা জমিদারী প্রতিষ্ঠা করেন। মছন্দরী ও মসনদ-আলি একই কথা; সে যুগে যে কোন পদস্থ ও সম্ভ্রান্ত মুসলমান আপনাকে মসনদ-আলি বলিয়া কীৰ্ত্তিত করিতেন।

২০. ১৫৮৮ খৃষ্টাব্দে ভবেশ্বরের মৃত্যু হয়। তৎপুত্র মহতাব রায় (১৫৮৮-১৬১৯) প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে মানসিংহকে সাহায্য করেন। তৎপুত্র কন্দর্প রায়ের সময়ে ম্যানরিক্ আসিয়াছিলেন। তিনি এই কন্দৰ্পকেই যশোহরের ভুঞা বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন।— Westland, Report of Jessore, p. 45; Hunter-Statistical Accounts, Vol. II, p. 203; আনন্দনাথ রায়-’বারভুঞা’, ১৯৪ পৃ।

২১. বর্ত্তমান পুস্তকের ১ম খণ্ড, ১০০-১১৮ পৃ।

২২. রোহিনীকুমার সেন—’বালা, ২৩০-৪ পৃ; Beveridge – Bakarganj, p. 121.

২৩. Ain-i-Akbari (Blochmann ), 340; Smith – Akbar, p.

২৪. পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, বঙ্গীয় লেখকদিগের মধ্যে নানা জনে নানা ভাবে ভুঞাদিগের গণনা করিয়াছেন। প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় জেসুইট মিশনরীদিগের প্রমাণানুসারে আমাদের তালিকাভুক্ত প্রথম চারিজনকেই ভুঞা বলিয়া স্বীকার করেন (‘প্রতাপাদিত্য’ ৪৭-৫০ পৃ)। পণ্ডিত সত্যচরণ শাস্ত্রী (‘প্রতাপাদিত্যের জীবনচরিত’, ২ পৃ) প্রথম ১১ জনের নাম স্বীকার করিয়াছেন। তবে তিনি সাঁতোড়ের নামোল্লেখ না করিয়া ‘পাবনা’ লিখিয়াছেন। এতদ্ব্যতীত তিনি দিনাজপুরের রাজাকে ভুঞা বলিতে চান, কিন্তু আমরা যে সময়ের আলোচনা করিতেছি, তখনও দিনাজপুরের রাজ্যের উৎপত্তি হয় নাই (কালীপ্রসন্ন—’নবাবী আমল’, ৪৮৮-৯ পৃ)। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, মহোদয় (‘কেদার রায়’, ১০ পৃ) চাঁদ গাজী ও ফজল গাজীকে পৃথক্ পৃথক্ উল্লেখ করিয়া মাত্র ১০ জনের নাম দিয়াছেন। এতদ্ব্যতীত প্রমাণাভাবে পুঁটিয়া, তাহিরপুর ও দিনাজপুর পরিত্যাগ করিয়াছেন। আনন্দনাথ রায় মহাশয় ‘বারভুঞা’ নামক পুস্তকে কত ভুঞারই উল্লেখ করিয়াছেন, তন্মধ্য হইতে ১২ জন বাছিয়া লওয়া দুষ্কর। মোট কথা, সে পুস্তকে ঐতিহাসিকের মত কোন বিচার বা শৃঙ্খলা কিছুই নাই। কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় মহোদয় ‘নবাবী আমলের বাঙ্গালার ইতিহাসে’ (৪৮৩-৪ পৃ) বারভুঞার উল্লেখ করিয়াছেন, কিন্তু স্পষ্টভাবে নাম দেন নাই। হরিসাধন মুখোপাধ্যায় মহোদয় ‘কলিকাতা সেকালের ও একালের’ নামক বিরাট গ্রন্থে বারভুঞার তালিকা দিয়াছেন। তাহাতে আমাদের তালিকার প্রথম ৯ জনের নাম আছে। ভাওয়াল ও চাঁদপ্রতাপ পৃথকভাবে উল্লেখ করিয়া আর একটি সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়াছেন এবং দিনাজপুরের গণেশ রায় ও পূর্ণিয়ার অজানিত রাজাকে অবশিষ্ট ভুঞা বলিয়া নিৰ্দ্দেশ করিয়াছেন।

২৫. Elliot— Vol, VI, p. 105; J. A. S. B. Vol. XLIII, 1874, pp. 199-201

২৬. ‘According to tradition, the principality ruled over by this family consisted of the pergannahs, now called Chand-pratap, then Chandgazi. Telibabad or Tala Gazi and Bhawal or Bara Gazi’-Dr. Wise,-Bara Bhuia, in J. A. S. B. 1874, p. 201.

২৭. Annals of Rural Bengal, Vol, 1. App. 1; Statistical Accounts. Vol. IV. P. 230; ‘বাঙ্গলার ইতিহাস’ (কালীপ্রসন্ন), ৪৮৭ পৃ।

২৮. ‘বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’, ১২৩ পৃ; ‘রাজসাহীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’, ১১৭-৮ পৃ; ‘নাবী আমলের বাঙ্গালার ইতিহাস’, ৪৮৩ পৃ।

২৯. এই রাজ্যের অধিকাংশ এক্ষণে ফরিদপুরের অন্তর্গত। সংস্কৃতে ইহাকে সান্তালি বলা হইত। সান্তালি বৈদিক ব্রাহ্মণের একটি প্রধান সমাজ। বাঙ্গালা ভাষায় ইহাকে সাতৈর, সাতৈল বা সাঁতোড় প্রভৃতি নানা নাম দেওয়া আছে। এক্ষণে সাতৈরের সে নাম বা রাজপ্রতিপত্তি নাই। জেলার বিবরণীতে সাতৈরের শীতলপাটি বিখ্যাত, এই মাত্র উল্লিখিত হইয়াছে। — Hunter, Statistical Accounts. Vol. V, p. 292.

৩০. ‘বঙ্গের সামাজিক ইতিহাস’, ১১৯ পৃ, বারেন্দ্র কুলশাস্ত্রের প্রমাণ অন্যত্র পাওয়া যায় না, এইজন্য এই গ্রন্থ আলোচ্য; ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ (রাখালদাস), ২য় খণ্ড, ১৮৬-৭ পূ; ‘নবাবী আমলের বাঙ্গালার ইতিহাস’, ৭৪ পৃ।

৩১. Mitra, Kishori Chand, The Rajas of Rajshahi, Calcutta Review, 1873, p. 3.

৩২. Badaoni, II, P. 174; Ain. (Blochmann), p. 366.

৩৩. কতলু খাঁ তিনটি নাবালক পুত্র রাখিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হন— নসিব শাহ, লোদী খাঁ এবং জামাল খাঁ, ঈশা খাঁ লোহানীর পাঁচ পুত্র ছিল—- সুলেমান, ওসমান, ওয়ালী, মুল্হী এবং ইব্রাহিম (Makhzan-i-Afghani) See, Dorn-History of the Afghans, Vol. II, p. 115. ব্লকম্যান ঈশার এক পুত্রের নামোল্লেখ করিতে ভুলিয়াছেন [Ain, (Blochmann), p. 520 (2nd ed. p. 586 –শি মি)]. কতলুর মৃত্যুর পর সম্ভবতঃ তৎপুত্র নসিবের নামে উড়িষ্যার সনন্দ গৃহীত হয়, তজ্জন্য নসিবের নামে ‘শাহ’ সংযোগ দৃষ্ট হয়। ১৫৮৯ খৃষ্টাব্দে মানসিংহ বঙ্গের সুবেদার হইয়া আসেন, সেই বৎসরই কতলুর মৃত্যু হয়। তৎপুত্র জামাল খাঁ প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি ছিলেন।

৩৪. ইনি মিঞা বা খাজে ঈশা খাঁ লোহানী নামে কথিত হন। সে যুগে মুসলমানদিগের মধ্যে যে কেহ কোন প্রদেশের শাসকরূপে গদিতে বসিতেন, তিনিই ‘মসনদ-আলি’ উপাধিভূষিত হইতেন। উহারই অপভ্রংশে ‘মছন্দরী’ হয়। নাটকে নভেলে গল্পকথায় এই ঈশা খাঁ মছন্দরীর সহিত যশোরের রাজা বসন্ত রায়ের বন্ধুত্বের কথা শুনিতে পাই। ‘মগজানী আফগানী’ নামক ইতিহাস হইতে জানিতে পারি; ‘After him (kotloo), Isa Khan Lohani Miankhail, his prime Minister, seized the reins of the state and held up the banner of sovereignty for the space of five years; during which he gallantly fought Akbar’s legions until he also took leave of life’.-Dorn, History Vol. I, p. 183 ষ্টুয়ার্ট সাহেব তদীয় ইতিহাসে এই জীবনকাল ২ বৎসর করিয়াছেন, উহা ভুল বলিয়া বোধ হয়। ( See, Stewart, History of Bengal, sect. VI.) তিনি বলেন ‘…as long as khuaje Issa, the Prime Minister of the Afghans, lived the peace was preserved inviolate on both sides.’ কিন্তু যখন মগজানী আফগানী ষ্টুয়ার্টের উক্তির মূল গ্রন্থ, তখন তাহার অনুবাদের ‘পাঁচ বৎসর’ অবিশ্বাসযোগ্য নহে। Dorn কৃত অনুবাদের ১ম খণ্ডে Dr. Lee কতকগুলি ভুল প্রদর্শন করিয়াছিলেন, কিন্তু সেখানে ‘৫ বৎসর’ ভুলের তালিকায় পড়ে নাই। সম্ভবতঃ ঈশা খাঁ অবশিষ্ট ৫ বৎসর জীবনের মধ্যে প্রথম দুই বৎসর উভয় পক্ষের সন্ধি স্থির ছিল, পরে বিবাদ হয় এবং তাহারই ফলে তিনি মোগল সৈন্যের সহিত যুদ্ধ করেন। এই বিদ্রোহ উপস্থিত হইলেই মানসিংহ আকবরের অনুমতি লইয়া (১৫৯২) পুনরায় উড়িষ্যায় গিয়া যুদ্ধ জয় করেন এবং কটক ও পুরী দখল করিয়া উড়িষ্যা মোগল রাজ্যভুক্ত করিয়া লন।—Stewart, History, p. 208 (Bangabasi edition) (1813 ed. pp. 185-6 –শি মি); Ain. (Blochmann), p. 340. মানসিংহ এবার আফগানদিগকে সুবর্ণরেখা পার করিয়া দেন। সম্ভবতঃ এই সময় হইতে হিজলীতে ঈশা খাঁ ও তৎপুত্রগণের প্রধান কেন্দ্র হয়।

৩৫. মানসিংহ বঙ্গে আসিয়া যখন উড়িষ্যা অভিযানের জন্য আয়োজন করিতেছিলেন, তখন তাঁহার পুত্র জগৎসিংহ অল্পসংখ্যক সৈন্য লইয়া অগ্রবর্ত্তী হন এবং ওসমানের সহিত যুদ্ধে কারারুদ্ধ হন। পরে কতলুর মৃত্যুর পর নিষ্কৃতি পাইয়া উভয় পক্ষের সন্ধির সাহায্য করেন। এই মূল ঘটনার উপর ভিত্তি রাখিয়া সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার ‘দুর্গেশনন্দিনী’ রচনা করেন। ষ্টুয়ার্ট ওসমানকে কতলুর পুত্র বলিয়াছেন, ডর্ণের পুস্তকেও এক স্থলে (Vol. I, p. 183) তিনি দায়ুদের কনিষ্ঠ ভ্রাতা বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছেন। Dr. Lee এই ভুল সংশোধন করিয়াছেন। (Dorn, Vol. II. Annotations, p. 115 ), বঙ্কিমচন্দ্র ওসমানকে কতলু খাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র ধরিয়া লইয়াছেন। উহাই ঠিক, কারণ ঈশা কতলু খাঁর সহোদর ভ্রাতা না হইলেও জ্ঞাতি ভ্রাতা যে ছিলেন, তৎপক্ষে সন্দেহ নাই।

৩৬. ঈশা খাঁর মৃত্যুর পর “Sulaiman ‘reigned’ for a short time. He killed, in a fight with the Imperialists. Himmatsingh, son of Raja Mansingh. “ – Ain (Blochmann ), 2nd ed, p. 586; Dorn, Vol. I. p. 183. ‘Usman succeeded him and received from Mansingh lands in Orissa and Satgaon and later in Eastern Bengal, with a revenue of 5 or 6 lacs per annum’. – Ain (Ibid). ওসমানের শেষ পরাজয় উড়িষ্যায় সুবর্ণরেখা নদীতীরে হয়, সে সময়ে ইসলাম খাঁ বঙ্গের সুবেদার হইয়া ঢাকায় রাজধানী স্থাপন করিয়াছেন। ঐ স্থান যে ঢাকা হইতে ১০০ ক্রোশ দূরে ছিল, তাহা ব্লকম্যানও বলিয়াছেন; ডর্ণ প্রভৃতি সকলেই যুদ্ধস্থানকে ঢাকা কোহিস্তান (Kohistan of Dakka) বলিতে চান। — Dorn, Vol. 11, p. 116. Firishta, Part IV, p. 358, ও Stewart, p. 275 [ 1813 ed, p. 212 শি মি]—এই দুই স্থানে ইহার বর্ণনা আছে। ষ্টুয়ার্ট যুদ্ধের স্থান সুবর্ণরেখা তীরেই নির্দ্দেশ করিয়াছেন। এস্থলে তিনি হয়ত ঢাকার নিকটবর্ত্তী অন্য কোন যুদ্ধের বর্ণনা ইহার সহিত ভুলক্রমে যোগ করিয়া দিয়াছেন (See, Hunter- Orissa Vol. II, p. 23)। ব্লকম্যানের (Ibid) নিজের মূল ‘মগজানী’ পুঁথিতে যুদ্ধস্থানের নাম — Nek Ujyal’ আছে। আমরা এই Ujyal-কে হিজলী মনে করি এবং হিজলীই ওসমানের পৈতৃক বাসস্থান ছিল। ওসমানের পরাজয় সম্বন্ধে Tuzuki-Jahangiri (Rogers and Beveridge), Vol. I, pp. 208-14, এবং Riaz -us-Salatin (Salam), pp. 174-9 দ্রষ্টব্য। সম্প্রতি ‘বহারিস্থান’ নামক নবাবিষ্কৃত ফার্সী গ্রন্থ হইতে জানা গিয়াছে যে, এই যুদ্ধস্থান শ্রীহট্ট অঞ্চলে ছিল। এখনও এ বিষয়ের শেষ মীমাংসা হয় নাই। [অধ্যাপক যদুনাথ সরকার এই যুদ্ধস্থান শ্রীহট্টে মৌলবিবাজারের ৪/৫ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত বলিয়া নির্দিষ্ট করিয়াছেন—’প্রবাসী’ ১৩২৮, অগ্রহায়ণ, ১৪৮ পৃ–শি মি

৩৭. ‘The king of Patanaw was Lord of the greatest part of Bengala, until the Mogol slew their last king. After which twelve of them (i.e.the Bhuyas) joined in a kind of Aristocracy and vanquished the Mogolls and still, notwithstanding the Mogoll’s greatness, are great lords, specially he of siripur and of Ciandecan, and above all Moasudalim.’- Purchas, Pilgrimes, part IV, Book V, p. 511 আকবরনামায় আছে, ‘Isa acquired fame by his ripe judgment and deliberateness and made the twelve zemindars of Bengal subject to himself. ‘ – Akbarnama (Beveridge), Vol. III, p. 648.

৩৮. ঈশা খাঁর জীবনী বিচিত্র। কথিত আছে, কালিদাস গজদানী নামক একজন বৈশ্য রাজপুত অযোধ্যা প্রদেশ হইতে গৌড়ে আসেন এবং তথায় মুসলমান হইয়া সুলেমান খাঁ নাম ধারণ করেন। তিনি বাদশাহ হুসেন শাহের এক কন্যার পাণিগ্রহণ করেন। ঈশা ও ইসমাইল নামে তাঁহার দুই পুত্র হয়। কিছুদিন পরে সের খাঁর পুত্র সেলিম খাঁ যখন গৌড় আক্রমণ করেন, তখন সুলেমান যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন এবং তাঁহার পুত্র ঈশা ও ইসমাইল তুর্কী হস্তে বন্দী হন। পরে তাহার খুল্লতাত কুতবউদ্দীন উহাদিগের উদ্ধার সাধন করিয়া নিজের দুই কন্যার সহিত উহাদের বিবাহ দেন (Ain. (Blochmann), p. 342; J. A. S. B 1874, p. 210 ) ইহার সকল কথা বিশ্বাসযোগ্য নহে। প্রথমতঃ, তাঁহার খুল্লতাত কুতবউদ্দীন কে, তাহার পরিচয় পাওয়া যায় না। কেহ কেহ তাঁহাকে ‘মাতুল’ বলেন, কিন্তু উহারও প্রমাণ নাই (গৌড়ের ইতিহাস’, ২য় খণ্ড, ২৬৯ পৃ)। দ্বিতীয়তঃ মুসলমানেরা কখনও মুসলমান বন্দীকে দাসরূপে বিক্রয় করেন না; তাহা হইলে সুলেমানের পুত্রগণ কিরূপে বিক্রীত হইলেন, বুঝা যায় না। — Akbarnama (Beveridge), III, p. 643, Note. কেহ কেহ বলেন হুসেন শাহের ভ্রাতুষ্পুত্রী ফতেমা ঈশার মাতা ছিলেন। . ‘যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত’ কেদার রায়; ৩০ পৃ।

৩৯. স্বরূপচন্দ্র রায়—’সুবর্ণ গ্রামের ইতিহাস’, ১০৩-০৪ পৃ; Bradley Birt – Romance of an Eastern Capital., pp. 78-80; যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত—’কেদার রায়’, ৩২-৩৩ পৃ।

৪০. Ain. (Blochmann), P. 400; Akbarnama ( Beveridge), Vol. III, pp. 657-60.

৪১. ‘ময়মনসিংহের ইতিহাস’, ৫৬ পৃ।

৪২. কেহ কেহ বলেন চাঁদ রায়ের পুত্র কেদার রায়। সে কথা সত্য বলিয়া বোধ হয় না। যোগেন্দ্ৰনাথ গুপ্ত মহাশয় নানাস্থান হইতে সংগৃহীত বংশাবলী হইতে দেখাইয়াছেন যে, চাঁদ ও কেদার রায় উভয়ে যাদব রায়ের পুত্র।—’কেদার রায়’, ১৯-২১ পৃ। কি জন্য ইঁহাদের পূর্ব্বপুরুষ নিম্নশ্রেণীর কায়স্থ মধ্যে পরিগণিত হন, তাহা জানিবার উপায় নাই। তবে ইঁহারা অকুলীন বলিয়া দেশীয় ঘটককারিকাদি ইঁহাদের সম্বন্ধে নীরব। এই জন্য এই প্রসিদ্ধ ভুঞাবংশ সম্বন্ধে অতি অল্প কথাই জানিতে পারা যায়।

৪৩. Akbarnama ( Beveridge), Vol. III, p. 119.

৪৪. Campos-Portuguese in Bengal, p. 21; Purchas – Pilgrimes, Part IV, P. 513. কার্ভালোই মুণ্ডা রায়কে হত্যা করেন, ইহাই পর্তুগীজ ইতিহাসের মত। কার্ভালোর বিশেষ বিবরণ প্রতাপাদিত্য প্রসঙ্গে প্রদত্ত হইবে।

৪৫. Elliot, Vol. VI, p. 111; আনন্দনাথ রায়—’বারভুঞা’, ১০৭ পৃ; ‘কেদাররায়’, ৬১ পৃ।

৪৬. মানসিংহ প্রতাপাদিত্যের যশোরেশ্বরীকে অম্বরে লইয়া যান নাই; তিনি কেদার রায়ের শিলাময়ী দেবী মূর্ত্তি লইয়া গিয়াছিলেন। সে মূর্ত্তি এখনও ‘সল্লাদেবী’ নামে অম্বরের রাজধানীতে পূজিত হইতেছেন। এ বিষয়ের সম্যক্ আলোচনা পরে করা যাইবে। [এই অংশের ৩১শ পরিচ্ছেদ দ্র,—শি মি] নিখিলনাথ রায়,– ‘প্রতাপাদিত্য’, ৪৯৮-৫১৩ পৃ দ্রষ্টব্য।

৪৭. ফতেহাবাদকে সাধারণতঃ এক্ষণে ফরিদপুর বলে। সম্ভবতঃ বঙ্গেশ্বর ফতে শাহের রাজত্বকালে (১৪৮২- ৮৭) ফতেহাবাদ নামের উৎপত্তি হয়। ফতে শাহ হইতে আরম্ভ করিয়া হোসেন শাহ, নসরৎ শাহ প্রভৃতি বহু নৃপতির ফতেহাবাদ নামাঙ্কিত মুদ্রা পাওয়া যায়। Catalogue of Coins in Indian Museum, Vol. II, Part II, Nos. 153-54, 163, 169-70 and 202.

৪৮. Ain-i-Akbari (Blochmann), p. 374.

৪৯. মোরাদ সম্ভবতঃ খানখানাপুরে অবস্থিতি করিতেন। কেহ কেহ অনুমান করেন নিকটবর্ত্তী রাজবাড়ীতে কোন বিদ্রোহী রাজার রাজধানী ছিল (Riaz-us-Salatin. p. 42); কিন্তু তদ্ব্যতীত ভূষণা যে প্রাচীন কাল হইতে রাজধানী ছিল, তাহার পরিচয় আছে। দিগ্বিজয়প্রকাশে দেখিতে পাই, ধেনুকর্ণ রাজার পুত্র কণ্ঠহার ‘বঙ্গভূষণ’ উপাধি ভূষিত ছিলেন এবং তিনি যশোরের উত্তরভাগ অধিকার করিয়া ভূষণ বা ভূষণা নাম রাখেন। মুকুন্দরাম ও সীতারামের সময়ে ভূষণা বহু বিস্তীর্ণ সমৃদ্ধ নগরী ছিল। সে পরিচয় পরে দিব। পাদশানামা এই মুকুন্দকেই ‘Mukindra of Bosnah’ বলিয়াছেন।

৫০. ‘Murad Khan died a natural death. Mukund, the landholder of that part of the country. invited his sons as his guests and put them to death and laid hold of his estate’.—Akbarnama (Beveridge), Vol. III, p. 469.

কেহ কেহ বলেন মুকুন্দ মোরাদের রাজ্য কাড়িয়া লইয়া তাঁহার পুত্রগণকে ভূ-বৃত্তি প্রদান করেন (‘বারভুঞা’ ১৩৮ পৃ); ব্লকম্যান সাহেব সুন্দরবনে মোরাদখানা নামে এক আবাদি মহল ছিল উল্লেখ করিয়াছেন। উহা মুকুন্দ প্রদত্ত ভূভাগ হইতে পারে। —J. A. S. B 1873, p. 229.

৫১. ‘বারভুঞা’, ১৩৮ পৃ। ষ্টুয়ার্ট, ওয়াইজ বা অন্য কেহ মুকুন্দরামের পতনের কথা উল্লেখ করেন না। মানসিংহের অনুপস্থিতিকালে (১৫৯৩-৪) যখন সৈয়দ খাঁ বঙ্গের সুবেদার হন, তখন হয়ত মুকুন্দের সহিত যুদ্ধ হয়। ইসলাম খাঁর সময়ে মুকুন্দ জীবিত ছিলেন বলিয়া বোধ হয় না। সত্রাজিৎই মোগল শাসকদিগকে অধিক বিরক্ত করিয়াছিলেন। ব্লকম্যান বলেন, ‘Satrajit gave Jahangir’s Governors of Bengal no end of troubles, and refused to send in the customary peskash or do homage at the Court of Dacca.’ For Said khan, See. Ain. (Blochmann). pp. 331-2.

৫২. বর্তমান ইতিহাসের ১ম খণ্ড, ২৯৭-৯৮ পৃষ্ঠায় চন্দ্রদ্বীপ রাজগণের বংশলতিকা প্রদত্ত হইয়াছে। এ প্রসঙ্গে রোহিণীকুমার সেন, ‘বাকলা’, ১৬৩ পৃ দ্রষ্টব্য।

৫৩. আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে এই জলোচ্ছ্বাসের বর্ণনা আছে (See, (Jarrett ) Vol. II, p. 123 ); এই জলপ্লাবনে লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু হয় ও রাজধানী বাকলা বিনষ্ট হয়। ঘটকগণের কুলগ্রন্থে দেখিতে পাই, রাজপুত্র জগদানন্দ এই প্লাবনে মৃত্যুমুখে পতিত হন। আবুল ফজল সম্ভবতঃ ভ্রমক্রমে জগদানন্দের স্থলে তাহার পিতা পরমানন্দের নাম করিয়াছেন।—’বাকলা’, ১৬৬ পৃ। ব্লকম্যান এই ঘটনার তারিখ ১৫৮৫ বলিয়াছেন।— J. A. S. B 1868 Dec; See also, Beveridge – Bakarganj, p. 28.

৫৪. র‍্যাফ ফিট্ (Ralph Fitch) নামক এক ভ্রমণকারী ১৫৮৬ খৃষ্টাব্দে বাকলা পরিদর্শন করিয়া কন্দর্পনারায়ণের বীরত্বের পরিচয় দিয়া গিয়াছেন। See, Hackluyt’s Voyages, Vol. II, p. 257; ‘বিশ্বকোষ’, ৩য় খণ্ড ৮৫ পৃ। কন্দর্পের সময়ের একটি পিত্তলের কামান এখনও বৰ্ত্তমান আছে।—’বাকলা’, ১৬৭ পৃ; J. A. S. B., 1875, p.

৫৫. ভুলুয়ার পত্তন সম্বন্ধে বহু কিম্বদন্তী আছে। এখানে তাহার উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। Dr. Wise উহার আলোচনা করিয়াছেন, (J. A. S. B., 1874, p. 203 )। ভুলুয়ার পত্তনের সময় সম্বন্ধে কোন সিদ্ধান্ত হয় নাই। আনুমানিক ১২০০ খৃষ্টাব্দে বঙ্গ বিজয় ধরিলে, তদপেক্ষা অন্ততঃ ৩৭৫ বৎসর পরে লক্ষ্মণমাণিক্যের আবির্ভাব ধরিতে হয়। কৈলাসচন্দ্র সিংহের ‘রাজমালা’ গ্রন্থে (৩৯৪ পৃ) ভুলুয়া রাজবংশের যে বংশাবলী প্রদত্ত হইয়াছে, তদনুসারে লক্ষ্মণ বিশ্বম্ভরের ৭ম পুরুষ। সে হিসাব ঠিক হইলে আনুমানিক ১৩৬০ খৃষ্টাব্দে বা বঙ্গের স্বাধীন পাঠান শাসন প্রতিষ্ঠার সময়ে ভুলুয়ার পত্তন ধরিতে হয়, অথবা লক্ষ্মণকে সপ্তম পুরুষ ন বলিয়া ১১শ পুরুষ ধরিতে হয়—’বিশ্বকোষ’ ১৭শ খণ্ড, ১২২ পূ; নগেন্দ্র বসুর ‘বঙ্গজ কায়স্থ কাণ্ড’ প্রকাশিত হইলে বিশেষ বিবরণ জানা যাইবে। [দুর্ভাগ্যবশতঃ উক্ত খণ্ড আর প্রকাশিত হয় নাই—শি মি

৫৬. কেহ কেহ বলেন বীর লক্ষ্মণ-মাণিক্য অসজ্জিতভাবে রামচন্দ্রের রণতরীতে গেলে, রামচন্দ্র অন্যায়রূপে তাঁহাকে বন্দী করেন। ইহা সত্য বলিয়া বোধ হয় না। ঘটককারিকায় আছে, রামচন্দ্র ‘জিত্বা লক্ষ্মণমাণিক্যং ভুলুয়াধিপতিং বরং। স্বরাজ্যে হ্যানয়ামাস বদ্ধা তং নৃপশার্দূলং’ সুতরাং যুদ্ধে জয় করিয়া বন্দী করাই সম্ভবপর।—’রাজমালা’ ৩৯৮ প্; নিখিলনাথ রায়, ‘প্রতাপাদিত্য’, ৭৩ পৃ। আনন্দনাথ রায় মহাশয় রামচন্দ্রের আদেশে লক্ষ্মণের প্রাণদণ্ডের কথা বিশ্বাস করেন না; তিনি বলেন, ১৬০১ খৃষ্টাব্দে সন্দ্বীপে মগদিগের সহিত যে ভীষণ যুদ্ধ হয়, লক্ষ্মণমাণিক্য তথায় বীরের মত যুদ্ধ করিয়া প্রাণত্যাগ করেন।—’বারভুঞা’, ১৫৭ পৃ।

৫৭. কথিত আছে, লক্ষ্মণমাণিক্য শ্রীহর্ষের ‘রত্নাবলী’র মত ‘বিখ্যাত বিজয়’ নামক এক বীররসপ্রধান সংস্কৃত নাটক প্রণয়ন করিয়াছিলেন। উহাতে ‘শ্রীমল্লক্ষ্মণভূপতেরভিনবস্তাদৃক্ প্রবন্ধোত্তরঃ’ বলিয়া ভণিতা আছে।— ‘রাজমালা’, ৩.৬-৭ প্

সকল অধ্যায়

১. ১. উপক্রমণিকা
২. ২. পাঠান রাজত্বের শেষ
৩. ৩. বঙ্গে বারভুঞা
৪. ৪. প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের উপাদান
৫. ৫. পিতৃ-পরিচয়
৬. ৬. পাঠান রাজত্বের পরিণাম ও যশোর-রাজ্যের অভ্যুদয়
৭. ৭. যশোর-রাজ্য
৮. ৮. বসন্ত রায়
৯. ৯. যশোহর-সমাজ
১০. ১০. গোবিন্দদাস
১১. ১১. বংশ-কথা
১২. ১২. প্রতাপাদিত্যের বাল্যজীবন
১৩. ১৩. আগ্রার রাজনীতি ক্ষেত্ৰ
১৪. ১৪. প্রতাপের রাজ্যলাভ
১৫. ১৫. যশোরেশ্বরী
১৬. ১৬. প্রতাপাদিত্যের রাজধানী
১৭. ১৭. প্রতাপের আয়োজন
১৮. ১৮. মগ ও ফিরিঙ্গি
১৯. ১৯. প্রতাপের দুর্গ-সংস্থান
২০. ২০. নৌ-বাহিনীর ব্যবস্থা
২১. ২১. লোক-নির্বাচন
২২. ২২. সৈন্যগঠন
২৩. ২৩. প্রতাপের রাজত্ব
২৪. ২৪. উড়িষ্যাভিযান ও বিগ্ৰহ-প্ৰতিষ্ঠা
২৫. ২৫. বসন্ত রায়ের হত্যা
২৬. ২৬. সন্ধি-বিগ্রহ
২৭. ২৭. খৃষ্টান পাদরীগণ
২৮. ২৮. কার্ভালো ও পাদ্রীগণের পরিণাম
২৯. ২৯. রামচন্দ্রের বিবাহ
৩০. ৩০. প্রথম মোগল-সংঘর্ষ : মানসিংহ
৩১. ৩১. মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ ও সন্ধি
৩২. ৩২. দ্বিতীয় মোগল-সংঘর্ষ : ইসলাম খাঁ
৩৩. ৩৩. শেষ যুদ্ধ ও পতন
৩৪. ৩৪. প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৩৫. ৩৫. যশোহর-রাজবংশ
৩৬. ৩৬. যশোহরের ফৌজদারগণ
৩৭. ৩৭. নলডাঙ্গা রাজবংশ
৩৮. ৩৮. চাঁচড়া রাজবংশ
৩৯. ৩৯. সৈয়দপুর জমিদারী
৪০. ৪০. রাজা সীতারাম রায়
৪১. ৪১. সীতারাম : বাল্যজীবন ও জমিদারী
৪২. ৪২. সীতারাম : রাজ্য ও রাজধানী
৪৩. ৪৩. সীতারাম : রাজত্ব ও ধৰ্ম্মপ্রাণতা
৪৪. ৪৪. সীতারাম : মোগল সংঘর্ষ ও পতন
৪৫. ৪৫. সীতারাম : বংশ, রাজ্য ও কীর্ত্তির পরিণাম
৪৬. ৪৬. সীতারাম সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৪৭. ৪৭. প্রাক্-ইংরাজ আমলে রাজন্য-বংশ
৪৮. ১. বৃটিশ-শাসন ও হেঙ্কেলের কীৰ্ত্তি
৪৯. ২. যশোহর-খুলনা : গঠন ও বিস্তৃতি
৫০. ৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
৫১. ৪. ভূসম্পত্তির স্বত্ব-বিভাগ
৫২. ৫. নড়াইল জমিদার-বংশ
৫৩. ৬. নব্য জমিদারগণ
৫৪. ৭. বাণিজ্য-তুলা, চিনি ও নীল
৫৫. ৮. নীলের চাষ ও নীল-বিদ্রোহ
৫৬. ৯. রেণী ও মরেল-কাহিনী
৫৭. ১০. সমাজ ও আভিজাত্য
৫৮. ১১. শিল্প ও স্থাপত্য
৫৯. ১২. সাহিত্য
৬০. এক – প্রতাপাদিত্যের পতন
৬১. দুই – প্রতাপাদিত্যের সভায় খ্রীষ্টান পাদরী
৬২. তিন – প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে কিছু নূতন সংবাদ
৬৩. সতীশচন্দ্র মিত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন