সতীশচন্দ্র মিত্র
যে সৃষ্টির পশ্চাতে জীবনব্যাপী সাধনা থাকে, তাহা রচয়িতার জীবনদর্শনও ঘোষণা করে অনিবার্যরূপে। ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাসে’ও তাহা অব্যক্ত থাকে নাই। পুণ্যশ্লোক সতীশচন্দ্ৰ ছিলেন ইতিহাসের অধ্যাপক। কাব্য অনুগামী বর্ণনায় এবং ছোট ছোট গল্পে ইতিহাসকে সজীব করিয়া তুলিবার ধরনই ছিল তাঁহার একান্ত। ১৯২৯ অব্দে একদিন সতীশচন্দ্র অনুরূপ অধ্যাপনায় মগ্ন। ইতিহাস পাঠের কক্ষটি ছিল প্রতাপসিংহ, শিবাজী, নানাসাহেব প্রভৃতির তৈলচিত্রে সুসজ্জিত। গল্পও বলিতেছিলেন মহারাষ্ট্রের নায়কদের। সেই গল্পেরই অনুবর্ত্তনে পরাধীনতার গ্লানিকে বিকটিত করিয়া যেন সংগ্রামী আহ্বানের ধ্বনিতে ধীরলয়ে ঘোষণা করিলেন, ‘আমি মসী ধরিয়াছি, পারিলে তোমরা অসি ধরিও।’—শতাধিক ছাত্রের সে কক্ষ নিস্তব্ধ হইয়া ছিল অনেকক্ষণ।
এই দৃপ্ত ঘোষণার পশ্চাতে যে জীবনদর্শনের ইঙ্গিত রহিয়াছে, তাহাই ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্রের জীবনের মর্ম্মবাণী। তাঁহার আজীবন অধ্যবসায় ও তন্নিষ্ঠ সাধনালব্ধ ‘যশোহর- খুলনার ইতিহাসে’রও মর্ম্মবাণী।
বাঙলার মানস জগৎ তখন ‘নবজাগরণের যুগ’ অতিক্রম করিয়া সংগ্রামী যুগে অগ্রসর হইতেছে। রামমোহন হইতে বিদ্যাসাগর পর্য্যন্ত শিক্ষা-দীক্ষা, ইতিহাস, সাহিত্য, ধৰ্ম্ম, সংস্কৃতি ও রাজনীতির নবোন্মেষের পটভূমি বিরচিত হইয়া গিয়াছে। ব্যর্থ বিক্ষোভে বঙ্গদেশ তখন নানা মঞ্চে উদ্বেলিত—প্রকাশন ও সংবাদপত্র-স্বাধীনতার আন্দোলন, সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মসমাজের অভ্যুদয়, ভূমি-ব্যবস্থায় অসন্তোষ, ওয়াহবী ও তিতুমিরের আন্দোলন, নীল-বিদ্রোহ, সিপাহী বিদ্রোহ, শিক্ষা-সংস্কার আলোড়ন, হিন্দুমেলার জন্ম। বঙ্গভূমি তখন বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠে’র যুগের জন্য প্রতীক্ষমাণ। এমনি যুগসন্ধিক্ষণে ১৪ই ডিসেম্বর, ১৮৭২ (১লা পৌষ, শনিবার পূর্ণিমা, ১২৭৯ সাল) সতীশচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। ‘মিত্রবংশমঙ্গল’ নামক পাণ্ডুলিপির আপন পিতৃ-পরিচয় অধ্যায়ে তিনি লিখিয়া গিয়াছেন :
‘খৃঃ ১৮৬১ বা ১২৬৭ সালে সুবিখ্যাত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অতি অল্প বয়সে খুলনার ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট হইয়া আসেন। তখন পিতার বয়স ১৮/১৯ বৎসর। এ সময়ে তিনি চাকরীর লোভে আফিসে ঢুকিয়াছিলেন, তাঁহার তীক্ষ্ণবুদ্ধি, প্রদীপ্ত চেহারা এবং শিক্ষা ও সুন্দর হস্তাক্ষর তাঁহার চাকরীর পথ প্রথম হইতেই পরিষ্কার করিয়াছিল। ঘটনাক্রমে তিনি বঙ্কিমবাবুরও মুন্সী বা পেশকারের পদ পাইয়াছিলেন। তিনি প্রায়ই বঙ্কিমচন্দ্রের সহিত মফস্বলে যাইতেন। ১৮৬১ অব্দে যখন মোরেলগঞ্জের মোরেল সাহেব ও তাহার দলবল নিকটবর্ত্তী বারুইখালি প্রভৃতি গ্রামের প্রজাদিগকে মারিয়া ধরিয়া উৎসন্ন করিয়া দিয়াছিল, তখন সে সংবাদ ফকিরহাটের সন্নিকটে বঙ্কিমচন্দ্রের নিকট পৌঁছে। এ সময় পিতাও তাঁহার সঙ্গে ছিলেন এবং পরে যখন বঙ্কিমবাবু অসমসাহসে মোরেলগঞ্জ গিয়া পরিদর্শন ও বহুলোক গ্রেপ্তার করেন, তখন তিনি সে সকল কার্য্যের সাক্ষীস্বরূপ সঙ্গে ছিলেন। বঙ্কিমবাবু সম্বন্ধে অনেক কথা পিতার নিকট শুনিয়াছি। ১৮৬২ অব্দে নূতন পিনাল কোড বাহির হয়; মোরেলের মোকদ্দমা পুরাতন মতানুসারে খুলনায় বিচার হয়।’
‘কয়েক বৎসর পর পিতা মোল্যাহাটে পোষ্টমাষ্টার ও অন্যান্য কার্য্যের ভারপ্রাপ্ত হইয়া যান। তিনি সেখানে কিছুকাল পুলিসের কার্য্যও অস্থায়ীভাবে করিয়াছিলেন। পুলিশের কার্য্য না থাকিলেও মোকদ্দমায় তদন্ত প্রভৃতি ব্যাপারে তিনি পুলিসকে সাহায্য করিতেন। বহুদিন যাবৎ তিনি মোল্যাহাটে লোকপ্রিয় হইয়া সুচারুরূপে কাৰ্য্য চালাইয়াছিলেন। এই সময় ১৮৭২ অব্দে বা ১২৭৯ সালে পৌষ মাসে আমার জন্ম হয়। জন্মকালে মাতা পিত্রালয়ে [পাইকপাড়া, খুলনা ছিলেন। জন্মের পর ৩/৪ বৎসর বয়স পৰ্য্যন্ত আমি পিতা-মাতার সঙ্গে মোল্যাহাটে ছিলাম। শিশুকাল আমার পরম সুখে কাটিয়াছিল।’
পরবর্ত্তীকালে সতীশচন্দ্রের সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক জীবনের উপর বঙ্কিমচন্দ্রের যে অসামান্য প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, তাহার সূত্রপাত তাঁহার পিতা প্যারীমোহনের সহিত বঙ্কিমচন্দ্রের এই যোগাযোগ হইতে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রকৃত সাহিত্যিক জীবন আরম্ভ হয় খুলনাতেই, এবং তাঁহার সর্ব্বপ্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ খুলনা বসিয়াই রচিত।
অল্প কয়েক বৎসরের মধ্যেই প্যারীমোহন উক্ত সরকারী চাকুরী ইস্তাফা দেন; এবং তখন হইতে দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবনের সূত্রপাত। এই অবস্থায় সতীশচন্দ্রের প্রাথমিক শিক্ষা আরম্ভ হয়। আশেপাশের এ-গ্রাম সে-গ্রামে থাকিয়া তিনি একে একে বৃত্তিসহ প্রাথমিক শিক্ষার স্তরগুলি উত্তীর্ণ হইতে থাকেন। মুছব্বরপুর হইতে নিম্ন-প্রাথমিক পরীক্ষায় (১৮৮৪) মাসিক ২ টাকা, নন্দনপুর হইতে উচ্চ-প্রাথমিক পরীক্ষায় (১৮৮৬) মাসিক ৩ টাকা, সেনহাটি স্কুল হইতে মধ্যছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় (১৮৮৮) মাসিক ৪ টাকা এবং খুলনা জিলা-স্কুল হইতে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় (১৮৯২) মাসিক ১০ টাকা বৃত্তি পাইয়া উত্তীর্ণ হন।
পরবর্তীকালে সতীশচন্দ্রের কর্ম্মময় ও সাহিত্যিক জীবনের সম্ভাবনা কৈশোরেই সূচিত হইয়াছিল। মধ্যছাত্রবৃত্তি পরীক্ষাতে জেলার মধ্যে বাঙলা রচনায় প্রথম হইয়া শ্রীপুর-হিতসাধনী সভা হইতে রৌপ্যপদক লাভ করেন। মননশীল রচনার প্রতি তাঁহার পাঠানুরাগ কিরূপ ছিল, সে বিষয়ে গল্প করিতে গিয়া তিনি বলিতেন যে, স্কুল জীবনেই তাঁহার Abbot’s Life of Napoleon আদ্যোপান্ত পাঠ হইয়া গিয়াছিল। অন্যদিকে ১৮৯৩ অব্দে ‘বেলফুলিয়া দরিদ্র লাইব্রেরী’ প্রতিষ্ঠা করিয়া ছাত্রজীবনেই কর্ম্মক্ষমতারও পরিচয় দেন।
১৮৯২ হইতে ১৮৯৮ অব্দ পর্য্যন্ত প্রায় সাত বৎসর কাল কলিকাতায় কখনও মেসে, কখনও বা কাহারও গৃহে আশ্রিত হইয়া একদিকে যেমন কলেজে অধ্যয়ন চালাইয়া যান, তেমনি অন্যদিকে দারিদ্র্যের সঙ্গে কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত হন। ছাত্র পড়াইয়া শুধু থাকা ও পড়ার সঙ্গতি করিলে হইত না, এই সময়ে তাঁহাকে সংসার খরচও পাঠাইতে হইত। মেট্রপলিটান কলেজ হইতে ১৮৯৪ অব্দে এফ, এ, এবং সিটি কলেজ হইতে ১৮৯৭ অব্দে বি, এ পাশ করেন এবং ইহার পর এক বৎসর কাল একই সঙ্গে আইন পড়িতে ও ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেটী পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হইতে থাকেন। কিন্তু ‘রাইডিং’ সার্টিফিকেটে’র অভাবে সে পরীক্ষা দেওয়া হইল না। ১৮৯৮ অব্দের এম, এ, পরীক্ষা সমীপবর্ত্তী। সেই সুযোগ লইবার চেষ্টায় মাত্র চারমাস পড়িয়া পরীক্ষা দিলেন, কিন্তু কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিলেন না। ছাত্রজীবনের এইখানেই সমাপ্তি। ‘বংশ-মঙ্গলে’ লিখিয়াছেন, “তখন সাংসারিক অবস্থা এত খারাপ যে চাকরী না করিয়া আর চলে না। তাই বাহির হইলাম।’
বাহির হইলেন বটে, কিন্তু তাঁহার পরবর্ত্তী জীবনের নিয়ামকের দুটি সূত্রে গ্রথিত হইয়া গেলেন। প্রথমতঃ, এফ, এ, পড়িবার সময়ে যে মেসে ছিলেন, সেখানে তখন পরবর্ত্তীকালে হাইকোর্টের লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল ব্রজলাল শাস্ত্রী মহাশয়ও থাকিতেন। ‘বংশমঙ্গলে’ উল্লেখিত আছে : ‘এই সময় হইতে ভবিষ্যত কাৰ্য্যক্ষেত্রে ব্রজবাবুর সহিত সহযোগিতার সূচনা হয়।’ শাস্ত্রী মহাশয়ের একান্ত প্রচেষ্টায় ১৯০২ অব্দে দৌলতপুর হিন্দু একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, এবং তাঁহারই আহ্বানে সতীশচন্দ্র ১৯০৪ অব্দে এই কলেজে ইতিহাস, অঙ্ক, এবং বাঙলা ভাষার অধ্যাপক হিসাবে যোগ দিয়া এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সমুন্নত করিবার সর্ব্ব দায়িত্ব গ্রহণ করিয়া প্রাণপাত করেন। সতীশচন্দ্র এই শিক্ষায়তনের প্রাণ ছিলেন বলিলে অত্যুক্তি হয় না। এই বিদ্যামন্দিরে কার্য্যরত অবস্থায় এবং ইহারই এক প্রাঙ্গণে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কলেজের অপর এক প্রান্তে ভৈরবকূলে সতীশচন্দ্রের স্মৃতিফলক অদ্যাবধি বিরাজমান।
দ্বিতীয়তঃ, ১৯৮৯ অব্দে যখন মেট্রপলিটান কলেজে ইংরাজিতে এম, এ, পড়িতেছিলেন, তখন তাঁহার শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন ইতিহাস-সম্রাট স্যর যদুনাথ সরকার। সতীশচন্দ্রের নিজের কথায় — ‘এই সময় হইতে যদুবাবু আমাকে অত্যন্ত ভালবাসিতেন।’ এই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উত্তর জীবনে শুধু অক্ষুণ্ণ ছিল না, প্রগাঢ় হইয়াছিল। যুদনাথের উপদেশ মত সতীশচন্দ্র তাঁহার ‘প্রতাপসিংহ’ নামক পুস্তকের আমূল সংস্কার করেন। এই গ্রন্থের পরিবর্দ্ধিত তৃতীয় সংস্করণ যদুনাথের দীর্ঘ ভূমিকা সম্বলিত। প্রাঞ্জল ভাষায় রচিত এই পুস্তকখানি বহুভাবে দেশবিদেশে প্রশংসিত ও সমাদৃত হয়। ইহার হিন্দী ও ইংরাজি অনুবাদও প্রকাশিত হয়; ইংরাজি সংস্করণের ভূমিকা লর্ড রোনাল্ডসে (জেল্যাণ্ড) স্বেচ্ছায় স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া লিখিয়া দেন। পরবর্ত্তীকালে ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’, বিশেষতঃ ইহার দ্বিতীয় খণ্ড রচনাকালে যদুনাথের সাহায্য ও সহযোগিতা অপরিসীম। অন্যদিকে ‘প্রতাপাদিত্য’ সম্পর্কে যদুনাথের যে প্রবন্ধ ‘প্রবাসী’তে বাহির হয়, তাহার টিপ্পনী সতীশচন্দ্রের লেখা। এই গুরু-শিষ্য সম্পর্ক ও সহযোগিতা কতদূর প্রগাঢ় ছিল, তাহা ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকায় শ্রদ্ধা নিবেদনের ভাষা হইতে অনুমিত হইবে : ‘সর্ব্বাগ্রে আমার ঐতিহাসিক গুরুদেব বিশ্ববিশ্রুত প্রত্নতাত্ত্বিক অধ্যাপক শ্রীযুক্ত যদুনাথ সরকার মহোদয়ের চরণে প্রণাম করিতেছি।’
এই প্রসঙ্গে ইহাও উল্লেখযোগ্য যে ছাত্রজীবনে সতীশচন্দ্রের অধ্যয়ন ও গবেষণার কেন্দ্রস্থল ছিল চৈতন্য লাইব্রেরী এবং ইউনিভার্সিটি ইনষ্টিটিউট লাইব্রেরী।
ছাত্রজীবন পশ্চাতে রাখিয়া ১৮৯৯ অব্দে সতীশচন্দ্র কর্ম্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিলেন। হেডমাষ্টার বা প্রধান-শিক্ষকরূপেই এই জীবন আরম্ভ। একে একে অনেকগুলি স্কুলেরই হেডমাষ্টার হইলেন এবং হেডমাষ্টারি জীবনে সৰ্ব্বত্র এমন অশেষ সুনাম ও লোকপ্রিয়তা অর্জ্জন করেন যে, এই সময়ে সকলের নিকট তিনি সাধারণভাবে ‘হেডমাষ্টার’ রূপেই পরিচিত ছিলেন। এমনকি, বিশ বছর পরেও ঐতিহাসিক মহামতি বিভারিজ সাহেব ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাসে’র পরিচয় দিতে গিয়া সতীশচন্দ্রকে ‘হেডমাষ্টার’ রূপেই বর্ণনা করিয়া বসেন।
ইহার পর ১৯০৪ অব্দে দৌলতপুর হিন্দু একাডেমিতে অধ্যাপক পদে বৃত হন এবং তখন হইতে আজীবন এই প্রতিষ্ঠানের মঙ্গলকামনায় ও উন্নতির প্রচেষ্টায় ব্রতী ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের সাধারণ অগ্রগতির দায়িত্ব ব্যতিরেকে ইহার যে দুইটি বিভাগ তিনি স্বহস্তে গড়িয়া তুলিয়াছিলেন, তাহা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রথমটি হইল ইহার গ্রন্থাগার। প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত তিনি ইহার লাইব্রেরীয়ান বা গ্রন্থাগারিক ছিলেন। তখনকার দিনে মফস্বল কলেজগুলির মধ্যে ইহা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থাগার বলিলে অত্যুক্তি হয় না, বিশেষতঃ ইহার ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থসম্ভার অতুলনীয়। এই গ্রন্থাগার লইয়া পক্ষপাতিত্ব এবং অযথা অর্থব্যয়ের নিন্দাবাদ তাঁহাকে কম সহ্য করিতে হয় নাই। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা তাঁহার ‘বংশমঙ্গলে’ লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। তখন মারকুইস্ অফ্ জেটল্যাণ্ড বাঙলার ছোটলাট। দৌলতপুর কলেজের সুনামে আকৃষ্ট হইয়া তিনি ইহা পরিদর্শন করিতে আসিয়াছিলেন। নিবিষ্টমনে এই গ্রন্থাগার দেখিতে দেখিতে লাট সাহেব একখানি ছোট বই হস্তগত করেন। অবশেষে বিদায় লইবার প্রাক্কালে সতীশচন্দ্রের ডাক পড়িল। তাঁহাকে লাটসাহেব বলিলেন,–দেখুন, আপনার অমূল্য গ্রন্থাগার হইতে একখানি বই পড়িবার লোভ সামলাইতে পারি নাই। কাহাকেও না বলিয়াই লইয়া আসিয়াছি, ইহার শাস্তিস্বরূপ গ্রন্থাগারের জন্য ৫০০ টাকার এই চেক গ্রহণ করিয়া বাধিত করুন।
দ্বিতীয়টি হইল, এই প্রতিষ্ঠানের একটি ছোট যাদুঘর। যশোহর-খুলনার ঐতিহাসিক বা প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদগুলির প্রতি তাঁহার মমতা ছিল অপরিসীম। ইহা নষ্ট বা অবহেলিত হইতে দেখিলে তিনি খড়গহস্ত হইয়া উঠিতেন এবং কার্য্যকারককে প্রকাশ্যে ও সংবাদপত্রে নিদারুণ নিন্দাবাদ করিতে কখনও কুণ্ঠিত হন নাই। যে-সব সাহেবেরা এই সময় জেলার শাসনে উচ্চপদে কাজ করিতে আসিতেন, তাঁহাদের মধ্যে অনেক গৃহ সজ্জিত করিবার লোভে এইসব সম্পদ বিলাতে লইয়া যাইতেন। প্রকাশ্যে নিন্দাবাদের দ্বারা ইহা রোধ করিবার জন্য সতীশচন্দ্র অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। একবার খুলনার কালেক্টর জে, সি, ফ্রেঞ্চ সাহেব কষ্টিপাথরের একটি ছোট বিষ্ণুমূৰ্ত্তি লইয়া খান। পত্রাঘাতের পর পত্রাঘাত করিয়া সতীশচন্দ্র এই সম্পদ খুলনা জেলায় ফিরাইয়া আনিতে সমর্থ হন।
যে-সম্পদ যেখানে বা যে-গ্রামে উদ্ধার হইত, সেখানেই তাহা সযত্নে রাখিবার তিনি পক্ষপাতী ছিলেন। উহা স্থানচ্যুত করার একান্ত বিরোধী ছিলেন। এমনকি, কোন গ্রামে মূৰ্ত্তি আবিষ্কৃত হইলে, সেই স্থানে উহার পুনঃপ্রাণ-প্রতিষ্ঠার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করিতেন। সেখহাটির অপূর্ব্ব ভুবনেশ্বরী মূর্তি আবিষ্কৃত হইলে তিনি নিজে সর্ব্ব ব্যবস্থা করিয়া উহা পুনরায় উক্ত স্থানেই প্রতিষ্ঠা করেন এবং তৎসূত্রে অতীতের ন্যায় পুনরায় বাৎসরিক মেলা আরব্ধ করাইয়া দেন। তবে যে-সব সম্পদের স্বস্থানে সযত্নে রক্ষিত হইবার সম্ভাবনা থাকিত না, সেগুলি কলেজের এই যাদুঘরে স্থান পাইত। এখানে বহু প্রাচীন মুদ্রা, প্রস্তরমূর্ত্তি, মৃৎ-ফলক, দারুমূর্ত্তি এবং বঙ্গদেশে মনুষ্য-বিক্রয়ের একখানি শেষ দলিল সংগৃহীত ছিল।
সতীশচন্দ্রের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয় বলিতে গেলে ছাত্র অবস্থা হইতেই। ১৮৯৪ অব্দে ‘শিক্ষা’ নামে একখানি সাপ্তাহিক পত্রে ‘আর কি সেদিন আসিবে?’ শিরোনামায় তাঁহার প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়। তখন তিনি বি, এ, ক্লাসে তৃতীয় বার্ষিক শ্রেণীর ছাত্র। ইহার পর ক্রমান্বয়ে কবিতা এবং সাহিত্য, রাজনৈতিক আন্দোলন, ধৰ্ম্ম ও ইতিহাস-বিষয়ক প্রবন্ধ ও পুস্তক রচিত হয়। এতৎসংলগ্ন রচনা-পঞ্জী অনুসরণ করিলে দেখা যাইবে, তাঁহার সমগ্র সৃষ্টির মধ্যে দুইটি ধারা বর্ত্তমান—কাব্য ও ইতিহাস।
কবিতা প্রথম হইতেই লিখিতেন। উহার অনেকগুলি ‘সমুত্থান’ শিল্প ও সাহিত্য’ প্রভৃতি পত্রে প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলি উচ্চাঙ্গের না হইলেও আবেগময় বর্ণনাত্মক ও শব্দ-ঝঙ্কার সম্বলিত। তাঁহার সর্ব্বপ্রথম প্রকাশিত পুস্তিকা ‘মা’ উচ্ছ্বাসময় কবিতার সমষ্টি। পদ্যানুবাদও কতকগুলি প্রকাশিত হয়, তন্মধ্যে ১৯০৫ অব্দে প্রকাশিত ‘জননীর চিত্রদর্শনে’ (On Receipt of My Mother’s Picture, by William Cowper) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কাব্যের এই ধারা তাঁহার মানসজগতে শেষ অবধি ছিল। পরিণত বয়সে বহু গান রচনা করিয়াছিলেন কিন্তু সেগুলি আত্মপ্রকাশ করে নাই। উহার পাণ্ডুলিপি দেশ-বিভাগ জনিত ঘূর্ণাবর্ত্তে লুপ্ত হইয়াছে এবং উদ্ধারের আর আশা নাই বলিলেই চলে।
অন্য ধারা এবং অত্যন্ত প্রবল ধারা ছিল, ইতিহাস-অনুসন্ধিৎসা। একস্থানে আত্মপরিচয়সূত্রে লিখিয়াছেন— ‘বংশকাহিনী সংগ্রহের প্রবৃত্তি বর্তমান গ্রন্থকারের বংশগত সম্পত্তি’ (২য় খণ্ড, ২য় অংশ, ১০শ পরিচ্ছেদ)। বংশগত হউক বা না হউক, ছাত্রজীবনের অব্যবহিত পর হইতে রচিত প্রায় সকল প্রবন্ধগুলিই ইতিহাসমূলক। প্রবন্ধের বিষয়বস্তু ইতিহাস না হইলেও, তাঁহার সকল বক্তব্যই ঐতিহাসিক পটভূমিকাতেই উপস্থাপিত হইয়াছে। দেখা যায়, তাঁহার লেখনী হইতে প্রথম প্রসূত প্রকৃত ইতিহাস- অনুসন্ধিৎসামূলক প্রবন্ধ—’সেনাপতি কালী’। উহা ‘ভারতী’ নামক পত্রে ১৯০৩ অব্দে (১৩১০, পৌষ) বাহির হয়। এই মাসিক পত্রে এই সময় রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের বহু লেখা প্রকাশিত হইত। সতীশচন্দ্ৰ ইতিপূর্ব্বেই, অর্থাৎ ১৯০০ অব্দের পূর্ব্বেই যশোহর-খুলনার ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহে প্রবৃত্ত, এবং ইহার পর হইতে কয়েক বৎসর ‘ভারতী’, ‘শিল্প ও সাহিত্য’, ‘ঐতিহাসিক চিত্ৰ ‘ প্রভৃতি পত্রে যে-সকল গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক প্রবন্ধ লিখিয়াছিলেন, তাহার অনেকগুলিই যশোহর- খুলনার ইতিহাস বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত। ইহাও লক্ষ্য করা যায় ১৯০৪-০৫ এই দুই বৎসর যখন ‘শিল্প ও সাহিত্য’ মাসিক পত্রিকার যুগ্ম-সম্পাদক, তখন তাঁহার লেখনী হইতে এই পত্রে দেশাত্মবোধক প্ৰবন্ধ রচিত হইতে থাকে। ‘বন্দেমাতরম’, রাখী-বন্ধন’, ‘স্বদেশী-আন্দোলন’ প্রভৃতি রচনাতে দেশ-প্রেমে উদ্বুদ্ধ তদানীন্তন গণ-আন্দোলনের প্রতি তাঁহার প্রগাঢ় আকর্ষণ ও আবেগ পরিলক্ষিত হয়।
সমভাবে আবেগধর্মী প্রবন্ধ ও অন্য রচনাও বাহির হইতে থাকে। ইতিপূৰ্ব্বে ‘সত্যানন্দ’ ছদ্মনাম ধরিয়া অনেকগুলি এইরূপ প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। অবশেষে তাঁহার জীবনের সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হইল। ১৯০৮ অব্দে ইতিপূর্ব্বে প্রকাশিত কতকগুলি আবেগময় রচনার সহিত নূতন কয়েকটি সমগোত্রীয় প্রবন্ধ সংযোজিত করিয়া ‘উচ্ছ্বাস’ নামে একখানি পুস্তক প্রকাশ করেন। ১৯১০ অব্দে ইহার এক কপি আচার্য্য, প্রফুল্লচন্দ্রকে উপহার দেন। তাহার উত্তরে আচার্য্যদেব ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ লিখিবার জন্য অপূর্ব্ব ব্যঞ্জনা ও ভাষায় যে অমোঘ বাণী প্রেরণ করেন, তাহা তাঁহার মত ঋষিকল্প সিদ্ধপুরুষোপম। এই বাণীর আহ্বানে সতীশচন্দ্র কিভাবে উদ্বোধিত হইলেন এবং জীবনের অবশিষ্ট বৎসরগুলি ইহার জন্য কি কঠোর সাধনায় লিপ্ত হইলেন, তাহা তিনি নিজস্ব অনুপম ভাষা ও বর্ণনায় ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাসে’র ভূমিকাগুলিতে লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন।
সতীশচন্দ্রের মানসজগতের দুই ধারা – কাব্য ও ইতিহাস-অনুসন্ধিৎসা, এইবার একত্রিত হইয়া এইরূপ দুর্লভ ইতিহাস সৃষ্টি সম্ভব করিল। তাঁহার ইতিহাস-অনুসন্ধিৎসার পশ্চাতে ছিল মানব-প্রীতি ও দেশাত্মবোধ এবং বঙ্কিমচন্দ্রের অসামান্য প্রভাব। স্বদেশী-আন্দোলনের সমকালে তাঁহার লেখাগুলিতে দেশাত্মবোধের পরিচয় যে স্পষ্ট তাহা পূৰ্ব্বেই উল্লেখিত হইয়াছে। আর বঙ্কিমচন্দ্রের প্রভাবের কথা প্রথম খণ্ডের ভূমিকাতে আত্মবিশ্লেষণচ্ছলে তিনি নিজেই ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন। ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস চাই; নহিলে বাঙ্গলার ভরসা নাই। কে লিখিবে? তুমি লিখিবে, আমি লিখিব…..’-বঙ্কিমের এই আহ্বান তাঁহাকে যেন পাইয়া বসিয়াছিল।
ইতিহাসের দর্শন তিনি কিভাবে গ্রহণ করিয়াছিলেন, কি বা কাহাদের লইয়া ইতিহাস, অথবা কিসের বা কাহাদের জন্য ইতিহাস—এ সম্পর্কে তাঁহার দৃষ্টিভঙ্গি তদানীন্তন ইতিহাস-বিদদের হইতে যথেষ্ট ভিন্নমুখী ছিল। প্রবাদপুঞ্জ হইতে সার সত্য সংগ্রহ করা কঠিন হইলেও সকল প্রবাদ হইতেই মূল সত্যের একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায় এবং রাশীকৃত ইতিকথা হইতে সত্যের নির্যাস নির্গত করিয়া লওয়া যে সম্ভবপর, সে কথা বিশ্লেষণ করিতে গিয়া বলিয়াছেন : ‘কিন্তু প্রকৃত প্রশ্ন এই, লিখিত ইতিহাস কয়জনের পাওয়া যায়? এবং যাহা আছে, তাহাই যে রঞ্জিত বা পক্ষপাতদুষ্ট নহে, তাহার প্রমাণ কি? দেশের মধ্যে কয়জনের কার্য্যকলাপের দৈনন্দিন লিপি প্রস্তুত হইত? শিলালিপি বা স্মারকলেখমালা হইতে দুই চারিজন রাজা ব্যতীত কয়জন প্রাচীন কৃতীপুরুষের জীবনী সংগ্রহ করা যায়? আর সেই ইতিহাস পাইলেই কি দেশের ইতিহাস হইল? দেশ কি শুধু কতিপয় রাজা বা রাজপুরুষের সমষ্টি লইয়া গঠিত? রাজা শুধু দেশের রক্ষক মাত্র; রাজার ইতিহাস শুধু দেশ-শাসনের ইতিহাস—দেশের বাহ্যাবরণের ইতিহাস। প্রজাই দেশের প্রাণ; সে প্রাণের স্পন্দন বা অবস্থার ইতিবৃত্ত দেশের প্রকৃত ইতিহাস। আমরা যে সমস্ত ইতিহাস পড়ি, তাহার অধিকাংশই রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত মাত্র। প্রজার কাহিনী বা দেশের প্রকৃত চিত্র তাহাতে নাই। যুগের পর যুগ ধরিয়া জনশ্রুতি, প্রবাদ বা গল্পকথার মধ্যে সে চিত্র ক্রমে লুক্কায়িত হইয়া পড়ে।’ (২য় খণ্ড, চতুর্থ পরিচ্ছেদ) – জনগণের এই লুক্কায়িত প্রাণস্পন্দনের উপর আলোকপাত করিবার জন্যই সতীশচন্দ্রের সামগ্রিক ঐতিহাসিক প্রচেষ্টার পশ্চাতে ছিল তাঁহার প্রাণপাতী সাধনা। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে যখন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদদের প্রবণতা ছিল একমাত্র রাজবংশের নীলরক্ত অনুসরণ করিয়া ইতিবৃত্ত রচনা করা, তখন এ কথা বলা দুঃসাহসিক বৈকি—’সমাজের ইতিহাস ব্যতীত দেশের ইতিহাস সম্পূর্ণ হয় না। জাতীয় চরিত্রের অভিনয় সামাজিক চিত্রেই পাওয়া যায়। রাজনৈতিক অবস্থার মূল সমাজ; সমাজেই সভ্যতার আশ্রয়স্থল।’ (২য় খণ্ড, ২য় অংশ, ১০শ পরিচ্ছেদ)
স্বাভাবিকভাবেই এই ইতিহাসে অগণিত জাতি, শ্রেণী, বর্ণ, বংশ ও মানুষের কাহিনী ভীড় করিয়া গ্রন্থের কলেবরকে দীর্ঘায়ত করিয়াছে। নামকরা অনেক ঐতিহাসিক ইতিহাসকে এমনভাবে ভারাক্রান্ত করা ইতিবৃত্ত—বিজ্ঞানসিদ্ধ নহে বলিয়া সমালোচনা করিতে কুণ্ঠিত হন নাই। তাহার প্রত্যুত্তরে সতীশচন্দ্র বলিয়াছেন যে, তেমন সঙ্কুচিত করিলে তাঁহার ইতিহাস লেখার উদ্দেশ্যই যে ব্যৰ্থ হইয়া যায়! একটি উদ্ধৃতিতে বোধহয় এ বিষয়ে তাঁহার মূল কথা ধরা দিবে। যশোহর-খুলনার নিরক্ষর কবিদের সম্পর্কে এক দীর্ঘ পরিচ্ছেদের প্রারম্ভে বলিয়াছেন : ‘মাইকেল, দীনবন্ধু প্রভৃতি যাঁহারা আমার দেশের মুখোজ্জ্বলকারী, তাঁহাদের গুণগ্রামের কথা স্থগিত রাখিয়াও আমি এই সকল স্বল্পশিক্ষিত বা নিরক্ষর কবির নাম ও কীর্তিকাহিনী চিরস্থায়িনী করিতে প্রয়াসী।’ (২য় খণ্ড, ২য় অংশ, ১২শ পারচ্ছেদ)
অন্যদিকে, ইতিহাস কিসের বা কাহাদের জন্য—সে বিষয়েও তাঁহার দৃষ্টিভঙ্গি গতানুগতিক ছিল না। ইতিহাসচর্চ্চা তাঁহার কাছে নিতান্ত শাস্ত্রানুশীলন বা পণ্ডিতী চর্চ্চার বিষয়বস্তু ছিল না। দেশের ইতিহাসের সঙ্গে দেশবাসীর ‘ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা স্থাপন’ করাই তাঁহার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল (২য় খণ্ড, ভূমিকা)। অতীতের দেশ, কাল ও পাত্রের আলোচনাকে কখনও বৰ্ত্তমান হইতে বিচ্ছিন্ন করেন নাই। আধুনিক সমতটবাসিগণের সামগ্রিক জীবনের প্রতিটি দুর্ব্বলতা ও সবলতার পশ্চাতে অতীতের পদধ্বনি শোনাইবার ব্যগ্রতার অন্ত ছিল না। দেশের ইতিহাসের সহিত দেশবাসীর এই আত্মীয়তা স্থাপনের প্রেরণায় শেষ দিকে তিনি ‘শিশুপাঠ্য যশোহরের ইতিহাস’ এবং ‘শিশুপাঠ্য খুলনার ইতিহাস’ অতি সহজবোধ্য ভাষায় রচনা করেন। এবং এই পুস্তিকাদ্বয়ের শেষে জেলার সমগ্র ইতিহাসকে কিশোর মনের উপযোগী ছড়ার ছন্দে গ্রথিত করার অভিনব পন্থা গ্রহণ করেন :
‘জলদান পুণ্য, আর পরহিত প্রাণ।
ধন্য করি রাখিয়াছে খাঞ্জালির নাম।।
তুমি মা খুলনা কি বা তুলনা তোমার।
স্বাধীনতা বীজমন্ত্র করিলে প্রচার।।
বঙ্গজ কায়স্থ বীর প্রতাপ আদিত্য।
ভুবনে ঘোষিছে যার অতুল বীরত্ব।।’
*** —‘শিশুপাঠ্য খুলনার ইতিহাস’, ১৪২ পৃ
যশোহর-খুলনার অধিবাসীদের শৈশব হইতেই ইতিহাসের সঙ্গে আত্মীয়তাবোধ জাগ্রত করাইবার গ্রন্থকারের ব্যাকুলতা ও আন্তরিকতা উপরোক্ত পংক্তি ও পদ্ধতি হইতেই অনুমেয়। তিনি বলিতেন, ‘মাতৃভাষা যেরূপ সকল ভাষায় প্রবেশ লাভের প্রথম সোপান, নিজের দেশের কথাও সেইরূপ সকল দেশের ইতিহাস আলোচনার দ্বারস্বরূপ।’ একই উদ্দেশ্যে উদীয়মান লেখককে নিজ নিজ গ্রামের ইতিহাস প্রণয়নে উৎসাহ দিবার আনন্দে তিনি অধীর হইতেন। এইভাবে ‘মহেশ্বরপাশা পরিচয়’, ‘সেনহাটির ইতিহাস’, প্রভৃতি গ্রন্থও তাঁহারই প্রেরণায়, কখনও বা তাঁহারই ভূমিকা সম্বলিত হইয়া রচিত হয়। কলেজের ছাত্রদের ইতিহাসের আকর্ষণকে অনুরাগে পর্যবসিত করার পদ্ধতিও ছিল তাঁহার অভিনব। আপন আপন গ্রামের ইতিহাস যে যতটুকু জানে বা সংগ্রহ করিতে পারে, তাহা লিখিয়া ছাত্রদের প্রথমেই তাঁহাকে দেখাইতে হইত—ইতিহাসের সহিত আত্মীয়তা স্থাপনের এই পন্থাই ছিল তাঁহার অন্যতম দীক্ষা। সতীশচন্দ্রের এই প্রচেষ্টাগুলি যে সামগ্রিক রূপ নিয়াছিল, তাহাতে বলা যায়—যশোহর-খুলনায় সতীশচন্দ্র ও ইতিহাস একাকার হইয়া গিয়াছিল।
কাহাদের লইয়া বা কাহাদের জন্য ইতিহাস, সে প্রশ্ন ছাড়াও ইতিহাস রচনা উপাদান সংগ্রহের পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁহার একটি দৃঢ়মত ছিল। কোন অঞ্চলের মাটি ও মানুষের সঙ্গে সর্ব্বভাবে পরিচিত না হইয়া, সম্পূর্ণরূপে একাত্ম না হইয়া, সে দেশের ইতিহাস লিখিবার প্রচেষ্টাকে মূঢ়তা বলিয়া বারম্বার ধিক্কার দিয়াছেন। এই মাটি ও মানুষের সহিত পরিচিতির বলে এবং চাক্ষুষ প্রমাণের সাহায্যে সতীশচন্দ্র কত গণ্যমান্য ইতিহাসবিদদের ‘শহরের ত্রিতল গৃহে বসিয়া’ শুধুমাত্র পুঁথিপত্রের উপর নির্ভর করিয়া উপস্থাপিত সিদ্ধান্তগুলিকে অপসিদ্ধান্ত প্রমাণিত করিয়াছেন, তাহার স্বাক্ষর যশোহর-খুলনার ইতিহাসের প্রতি পরিচ্ছেদে। এই ইতিহাস সঙ্কলনের জন্য সমগ্র সমতটে চট্টগ্রাম হইতে মেদিনীপুর পর্যন্ত এমন কোনও ইতিবৃত্ত-সংশ্লিষ্ট স্থান ছিল না যেখানে গ্রন্থকার চাক্ষুষ প্রমাণ সংগ্রহার্থে উপস্থিত হন নাই। যশোহর-খুলনার তো কথাই নাই, এমন কোনও গ্রাম নাই, যেখানে তিনি ঘুরিয়া বেড়ান নাই, এমন কোন বংশ নাই যাহার নিকট ইতিহাসের ইঙ্গিত পাইবার জন্য বা ‘কারিকা’ সংগ্রহের জন্য দ্বারস্থ হন নাই। খুলনা জেলার অর্দ্ধাংশ জুড়িয়া দুর্গম সুন্দরবন। আর এই বনের ইতিহাস-সংশ্লিষ্ট স্থানগুলি ততোধিক দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল। কেননা, গভীর বনাঞ্চলে ভগ্নমন্দির ও গৃহগুলি যেমন দূরতিক্রম্য বনাকীর্ণ হয়, তেমনি সর্ব্বপ্রকার বন্য ও হিংস্র জন্তুর দ্বারা সর্ব্বাপেক্ষা অধ্যুষিত হয়। প্রমাণ হাতে করিয়া দুর্ব্বার ইতিহাস-অনসুন্ধিৎসার প্রেরণায় সতীশচন্দ্র এ হেন স্থানগুলিতেও পদচারণ করিতে কুণ্ঠিত হন নাই বা দ্বিধা করেন নাই।
মাটি ও মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের এই প্রচেষ্টায় পদে পদে তাঁহার প্রাণ বিপন্ন হইয়াছে। সুন্দরবনে পথহারা হইয়া রাত্রের অন্ধকারে একবার সমূহ বিপদে পড়িবার বিবরণ নিজেই লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। মহম্মদপুরে সীতারামের ইতিহাস সংগ্রহ কার্য্যে একবার দুর্গম বনাকীর্ণ ভগ্নস্তূপের মধ্যে বন্যশূকর দ্বারা আক্রান্ত হইয়া প্রাণ হারাইতে বসিয়াছিলেন। সাতক্ষীরায় একবার মহামারী অধ্যুষিত অঞ্চলে ঐতিহাসিক অনুসন্ধান করিতে গিয়া অতি ভীষণ বসন্ত-রোগে আক্রান্ত হন এবং প্রায় জীবনাবসানের অবস্থা হয়। তবু এই ঐতিহাসিকের মাটি ও মানুষের সঙ্গে পরিচয়ের প্রচেষ্টা স্তব্ধ হয় নাই।
ইতিহাসকে উপলব্ধি করিবার তাঁহার বিশেষ পদ্ধতি একটি উদ্ধৃতি হইতে স্পষ্টতর হইবে। মানসিংহের যশোর-রাজ্য আক্রমণের কত তথ্যই তো আছে, কত প্রামাণ্য বিবরণও তো আছে—তাহা নিঃশেষ করিয়াও সতীশচন্দ্র ক্ষান্ত নহেন। নবগঠিত ‘গৌড়বঙ্গের রাস্তা’ ধরিয়া যখন মানসিংহ সদলবলে যশোররাজ্য আক্রমণে অগ্রসর হইতেছিলেন, তখন তাঁহাকে কি কি সমস্যার সম্মুখীন হইতে হইয়াছিল তাহার বর্ণনাকালে লিখিয়াছেন— ‘অজানা অচেনা নিম্ন-বঙ্গে ত্বরিত গতিতে পথ রচনা করিতে করিতে বিরাট মোগলবাহিনী কেমন করিয়া সন্তর্পণে অগ্রসর হইতেছিল, সেইসব পুরাতন কাহিনীর চিন্তা লইয়া আমি মানসিংহের এই রাস্তায় বহু মাইল পৰ্য্যন্ত পদব্রজে ভ্রমণ করিয়াছি।’ (২য় খণ্ড, ৩০শ পরিচ্ছেদ)
এই সূত্রে সতীশচন্দ্রের আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখযোগ্য। বিশেষত বাংলা সাহিত্যে অধুনা ভূরি ভূরি ঐতিহাসিক উপন্যাস সৃষ্টির পটভূমিতে ইহা বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাঁহার মতে— “উপন্যাস ও ইতিহাসে বিস্তর প্রভেদ। অবিকৃত, অকৃত্রিম, কঠোর সত্য লইয়াই ইতিহাস গঠিত, আর সামান্য অস্থিমজ্জার উপর কল্পনার উন্মেষে কৃত্রিম ঘটনাবলীর ঘনসন্নিবেশে উপন্যাস রচিত হয়। কঙ্করময় কঠোরই হউক, বা কোমল শ্যামল শষ্পাচ্ছাদিতই হউক, ইতিহাসের পথ একটি, সে পথ আছে, তোমাকে সেই পথে যাইতেই হইবে। উপন্যাসের পথ বহুসংখ্যক, লেখক ও পাঠকের রুচি অনুসারে, সে পথ ইচ্ছামত আঁকিয়া বাঁকিয়া চলিয়া যায়; ইতিহাসের লেখক ও পাঠক বড় স্বল্প। উপন্যাসের লেখক ও পাঠক অসংখ্য, পয়সা ও পসার উভয়ই ঔপন্যাসিকের একায়ত্ত। ইতিহাসকে অতি সহজেই উপন্যাস করা যায়, ইতিহাসের ঐতিহাসিকতা রক্ষা না করিলেই উপন্যাস হইয়া পড়ে। কিন্তু উপন্যাসকে কোন মতেই ইতিহাস করা চলে না। আজকাল আমাদের দেশে ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস’ নামে একজাতীয় পুস্তক প্রকাশিত হইতেছে। উহাদের নায়ক-নায়িকা ঐতিহাসিক ব্যক্তি হইতে পারেন, দুই একটি প্রধান ঘটনাও সত্যানুগত হইতে পারে, কিন্তু বস্ত্রালঙ্কার ও পত্র-পল্লব অধিকাংশই ঔপন্যাসিক ও কাল্পনিক। এ জাতীয় গ্রন্থ দ্বারা আমাদের যথেষ্ট ক্ষতি হইতেছে। সুখপ্রিয় বাঙ্গালীর দেশে উপন্যাসের আদর এতই বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং উপন্যাসের কৃত্রিম কৌশলে অনেক চিত্র এতই বিকৃত হইয়া পড়িয়াছে যে, এক্ষণে ইতিহাসের সত্যবার্ত্তাও কাল্পনিক বলিয়া উপেক্ষিত হইতেছে” (২য় খণ্ড, ৪০শ পরিচ্ছেদ)। বলা বাহুল্য উপরোক্ত কঠিন মানদণ্ডে সতীশচন্দ্র সাহিত্যরথী বঙ্কিমচন্দ্র ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকেও সমালোচনা করিতে দ্বিধা করেন নাই। (২য় খণ্ড, ২৯শ, ৪০শ ও ৪৪শ পরিচ্ছেদ)
কিন্তু শুধুমাত্র কাব্য ইতিহাস-অনুসন্ধিৎসা এবং প্রগতিশীল ইতিহাসচেতনা হইতেই এমন দুর্লভ ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সেদিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়া বলিয়াছেন,— ‘আপনার ইতিহাসে আমাদের দেশের পাঠকেরা সত্য-সন্ধানের কঠিন সাধনা উপলব্ধি করিতে পারিবে, ইহাই আমি আশা করি।’ কি পরিমাণ কঠিন সাধনায় যে তিনি ব্রতী হইয়াছিলেন তাহার পরিচয় এই ইতিহাসের প্রতি ছত্রে। কি অসাধারণ মানসিক ও কায়িক পরিশ্রমের দায়িত্ব পালন করিয়াছিলেন, কতবার যে জীবনকে বিপন্ন করিয়াছিলেন, তাহার ইয়ত্তা নাই। শুধু ইতিহাস নহে, যে কোন বিষয়ে এমন নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা বিফল যাইবার নহে। ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ পুনর্মুদ্রণের বিষয় লইয়া এইবার অধ্যাপক নির্মলকুমার বসু মহোদয়ের নিকট উপস্থিত হইলে প্রসঙ্গত তিনি বলিতে থাকেন— ‘তোমরা তো তখন ছেলেমানুষ, তোমরা তো জান না! আমরা তখন কি উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে উন্মুখ হয়ে থাকতাম সতীশচন্দ্রের লেখার জন্য। ভাবতেও আমাদের গা শিউরে উঠতো— একক একটি মানুষ দুর্গম বনে জঙ্গলে নদনদী উপেক্ষা করে, সমস্ত বিপদ আপদ অবহেলা করে পায়ে হেঁটে হেঁটে গোটা দুটি জেলার ইতিহাস তৈরি করছেন, আর এক একবার ছুটে আসছেন কলকাতার গ্রন্থাগারগুলিতে তাঁর লব্ধ তথ্যকে মিলিয়ে নেবার জন্য।’
এই কঠোর সাধনা চরিতার্থ করিতে চরিত্রের যে দৃঢ়তা, তেজস্বিতা ও আদর্শ-নিষ্ঠা থাকা আবশ্যক, তাহাও তাঁহার ছিল অপরিমেয়। এ সম্পর্কে তাঁহার অন্যতম প্রিয় ছাত্র অধ্যক্ষ গোপালচন্দ্ৰ মজুমদার মহাশয় রচিত ‘অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মিত্র’ নামে পুস্তিকায় আছে : ‘একাধারে তাঁহার গুণসম্পদসমূহ কদাচিৎ দৃষ্টিগোচর হয়। তিনি শিষ্টালাপী, উচিতবক্তা, তেজস্বী, বিদ্বান ও ভক্তিনিষ্ঠ সাধক ছিলেন। ছাত্রগণকে তিনি সন্তানের মত ভালবাসিতেন। গম্ভীরাকৃতি পুরুষ, হঠাৎ তাঁহার সম্মুখে যাইয়া আলাপ করা কঠিন ছিল, কিন্তু সেই গম্ভীরাকৃতির ভিতর যে স্নেহ-কোমল হৃদয় ছিল, যে একদিন তাহার পরিচয় পাইয়াছে, সে কখনই সে স্নেহের কথা ভুলিতে পারিবে না। আমরণ নির্লোভ চিত্তে, ঐহিক সম্পদের কথা ভুলিয়া তিনি এই দরিদ্র দেশে জ্ঞান-বিতরণরূপ মহান্ কাৰ্যে আপনাকে ব্রতী করিয়াছিলেন। সম্মানের দিকে তাঁহার দৃষ্টি অধিক ছিল না— কিন্তু সম্মান যথেষ্টই তাঁহার আসিয়াছিল। প্রথিতনামা ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ প্রভৃতি এবং বঙ্গের পূর্বতন গভর্নর বাহাদুর লর্ড রোণাল্ডশে তাঁহার বিদ্যাবত্তায় এবং চরিত্রে মুগ্ধ হইয়া দেশে প্রত্যাগমন করার পরেও তাঁহার নিকট পত্রাদি দিতেন। তাঁহার মৌলিক ঐতিহাসিক গবেষণার জন্য প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক বিভারিজ সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি রয়েল এসিয়াটিক সোসাইটির মেম্বর [M.R.A.S. নির্ব্বাচিত হন। এবং তাঁহার সাহিত্যচর্চ্চার জন্য ভারতধর্ম্মমহামণ্ডল হইতে ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি লাভ করেন। যশ তাঁহার যথেষ্ট লাভ হইয়াছিল, কিন্তু সে দিকে তাঁহার ভ্রূক্ষেপ ছিল না।’
সতীশচন্দ্রের ব্যক্তিগত জীবনের একটি ঘটনা তাঁহার চরিত্রের দুই দৃঢ়তা ও আদর্শনিষ্ঠার এক মর্মান্তিক চরম সাক্ষ্য হইয়া রহিয়াছে। ১৯৩১ অব্দে বঙ্গদেশ সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে উদ্বেলিত। যাঁহার আহ্বান ছিল, ‘পারিলে তোমরা অসি ধরিও’, তিনি এই আন্দোলনের কথা উঠিলে বলিতেন, সময় এখনও আসে নাই, দেশ এখনও প্রস্তুত হয় নাই। এই সময়ে গুরুতররূপে পীড়িত হইয়া সতীশচন্দ্র মৃত্যুশয্যা গ্রহণ করেন। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে যুক্ত হওয়ায় তাঁহার পুত্র কারারুদ্ধ থাকাকালে পুলিশ বেষ্টিত হইয়া মৃত্যুশয্যায় দেখা করিতে আসিলে এই ঘটনা ঘটে। পুলিশ প্রস্তাব করিল, মুচলেকা দিলেই তখনই মুক্তি দেওয়া হইবে। এই মুচলেকা দিতে অনুরোধ করাইবার জন্য কলেজের অধ্যাপক সহকর্মিগণ সকলে মিলিয়া তখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত যন্ত্রণাকাতর সতীশচন্দ্রের নিকট আবেদন করিলেন। এই দেশপ্রেমিক ঐতিহাসিকের আদর্শনিষ্ঠা ও দৃঢ়তা তাঁহারা পরিমাপ করিতে পারেন নাই। তাঁহাদের আবেদনের প্রত্যুত্তরে সতীশচন্দ্র অতি ধীরে এবং ক্ষীণস্বরে বলিলেন,–”কাহাকেও তাহার আদর্শ হইতে বিচ্যুত হইতে বলিতে পারিব না…না, তাহা হয় না। কথাগুলি শেষ হইতে না হইতে তাঁহার দুই গণ্ড বাহিয়া অশ্রুধারা ঝরিয়া পড়িল।
পরদিন সতীশচন্দ্র শেষবারের মত জ্ঞানহারা হইলেন, এবং সেই অবস্থায় দুইদিন কাটাইয়া ১৯৩১ অব্দে ৭ই জুন অন্তিম নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সতীশচন্দ্রের বংশ-পরিচয়
দক্ষিণ রাঢ়ীয় মিত্র-বংশ : বড়িষা সমাজ : কনিষ্ঠ সত্যবান মিত্রের সন্তান : গুয়াতলীর মিত্র : ‘মধ্যাংশ দ্বিতীয় পুত্র’-কুলীন। বংশ-ধারা এইরূপ—
১ কালিদাস মিত্র (আদিশূরের সময় আগত পঞ্চ কায়স্থের অন্যতম)-২ শ্রীধর-৩ শুক্তি—৪ সোভারি—৫ হরি—৬ সোম—৭ কেশব—৮ মৃত্যুঞ্জয়—৯ ধুই মিত্র (বড়িষা সমাজ)—১০ চক্রপাণি—১১ বিভাকর—১২ কুবের (ছোট)–১৩ লক্ষ্মীপতি—১৪ রাম – ১৫ সত্যবান (কনিষ্ঠ কুলীন) – ১৬ রাজীব (মধ্যাংশ ২য় পুত্র) –১৭ বিষ্ণুদাস – ১৮ অভিরাম (গুয়াতলী)—১৯ প্রাণবল্লভ (পাগলা)–২০ আনন্দিরাম—২১ রামকৃষ্ণ—২২ রামজয় (নন্দনপুর)–২৩ গৌরমোহন ২৪ প্যারীমোহন (আইচগাতি) – ২৫ সতীশচন্দ্র মিত্র (দেয়াড়া) – ২৬ শিবশঙ্কর।
রচনাপঞ্জী
[সতীশচন্দ্রের সকল পুস্তকই এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে; তারকা (*) চিহ্নিত পুস্তক বা সংস্করণগুলি প্রত্যক্ষভাবে পরীক্ষা করা সম্ভবপর হয় নাই। পত্রিকায় প্রকাশিত রচনাগুলিও প্রায় সম্পূর্ণরূপে তালিকাভুক্ত হইয়াছে; ইহা ছাড়া দুই-একটি রচনা হয়ত থাকিতে পারে, কিন্তু বহু চেষ্টা করিয়াও তাহার কোন সন্ধান পাওয়া যায় নাই।—শি মি]
মৌলিক গ্রন্থ
মা*॥ কলিকাতা, ননীগোপাল মুখোপাধ্যায়, ১৮৯৬; ১৮ সেমি (কবিতা সঙ্কলন) প্ৰতাপসিংহ।। কলিকাতা, ষ্টুডেন্টস্ লাইব্রেরী ১৯০৪; এক টাকা তিন আনা, ৮২ পৃ; সম্মুখচিত্র, ১৮ সেমি (ভারত-প্রতিভা গ্রন্থাবলী-১) ২য় সংস্করণ; ১৯০৬; পঞ্চাশ পয়সা, ৮২ পৃ (অন্য তথ্যাদি অনুরূপ) ৩য় সংস্করণ; পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত; কলিকাতা, ষ্টুডেন্টস্ লাইব্রেরী, ১৯১৭; এক টাকা ছয় আনা, ১৭৫ পৃ; সম্মুখচিত্র, ৫ পট, ১ মানচিত্র ১ নক্শা ১৮.৫ সেমি (স্যর যদুনাথ সরকার লিখিত ভূমিকা), ৪র্থ সংস্করণ; ১৯২৮; এক টাকা পঞ্চাশ পয়সা, ১৭৫ পৃ (অন্য তথ্যাদি অনুরূপ) হিন্দী সংস্করণ;* ১৯০৬, ইংরাজি সংস্করণ; ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ অনূদিত; কলিকাতা, চক্রবর্ত্তী চাটার্জি, ১৯২৮; পঁচাত্তর পয়সা, ২০০ পৃ; সম্মুখচিত্র, ৫ পট, ১ মানচিত্র, ১ নক্শা; ১৮.৫ সেমি (Foreword by Rt. Hon. The Eari of Ronaldshay)
উচ্ছ্বাস। কলিকাতা, ষ্টুডেন্টস্ লাইব্রেরী, ১৯০৮; ছয় আনা, ১০৬ পৃ; ১৮ সেমি যশোহর-খুলনার ইতিহাস, ১ম খণ্ড॥ কলিকাতা, চক্রবর্ত্তী-চাটার্জ্জী ১৯১৪; এক টাকা পঁচিশ
পয়সা, ৪৩৫ পৃ, সম্মুখচিত্র (রঙীন), ৩৫ পট (২ রঙীন), ৪ মানচিত্র (২ রঙীন), ৫ নক্শা (১ রঙীন), ২১ সেমি, ২য় সংস্করণ, পরিশোধিত ও পরিবর্দ্ধিত; কলিকাতা, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়, ১৯২৮ এক টাকা পঁচাত্তর পয়সা, ৪৬৪ পৃ; সম্মুখচিত্র (রঙীন), ৩৬ পট (২ রঙীন), ৪ মানচিত্র (২ রঙীন), ৫ নক্শা (১ রঙীন), ২১ সেমি, ৩য় সংস্করণ, শিবশঙ্কর মিত্র সম্পাদিত; কলিকাতা, শিবশঙ্কর মিত্র, ১৯৬৩; দুই টাকা পঁচিশ পয়সা, ৪৯৫ পৃ; সম্মুখচিত্র, ৩৭ পট (৩ রঙীন), ৪ মানচিত্র, (১ রঙীন) ৩ প্রতিলিপি, ৫ নক্শা, ২১.৫ সেমি
যশোহর-খুলনার ইতিহাস, ২য় খণ্ড॥ কলিকাতা, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়, ১৯২২; এক টাকা ছয় আনা, ৮৮৫ পৃ; সম্মুখচিত্র, ১০ চিত্র, ৫৮ পট, ৩ মানচিত্র (১ রঙীন), ১ প্ৰতিলিপি, ২ নক্শা, ২১ সেমি। ২য় সংস্করণ, শিবশঙ্কর মিত্র সম্পাদিত; কলিকাতা, শিবশঙ্কর মিত্র, ১৯৬৫; দুই টাকা, ৯৬৩ পৃ; সম্মুখচিত্র, ৬ চিত্র, ৬৯ পট, ৪ মানচিত্র (১ রঙীন), ৩ প্রতিলিপি, ২ নক্শা, ২১.৫ সেমি
হরিদাস ঠাকুর। কলিকাতা, আশুতোষ লাইব্রেরী, ১৯২৫; চৌদ্দ আনা, ১১৭ আনা, ১১৭ পৃ+দুই আনা পৃষ্ঠাঙ্ক, ৪০ পৃ; সম্মুখচিত্র (রঙীন), ৩ পট, ১৮ সেমি (ভক্ত প্রসঙ্গ-১) [পরিশিষ্ট: শ্রীগোসাঁই গোরাচাঁদ রচিত শ্রীশ্রী সঙ্কীর্ত্তনবন্দনা]
সপ্ত গোস্বামী কলিকাতা, আশুতোষ লাইব্রেরী, ১৯২৭; এক টাকা, ৩৫৯ পৃ; ৭ পট, ১৮ সেমি (ভক্ত-প্রসঙ্গ-২)
শিশু পাঠ্য খুলনার ইতিহাস। কলিকাতা, ষ্টুডেন্টস্ লাইব্রেরী, ১৯২৭; ছয় আনা, ১৪৪ পৃ; চিত্র, ১৮
সেমি, ২য় সং ১৯২৯ (অন্য তথ্যাদি অনুরূপ), ৩য় সং ১৯৩২ (অন্য তথ্যাদি অনুরূপ) শিশু পাঠ্য যশোহরের ইতিহাস॥ কলিকাতা, ষ্টুডেন্টস্ লাইব্রেরী, ১৯২৮; পঁচিশ পয়সা, ১৩৯ পৃ; চিত্র, ১৮ সেমি
শিশু পাঠ্য খুলনার ভূগোল। কলিকাতা, সুভাষ লাইব্রেরী, ১৯২৯; পঁচিশ পয়সা ৪৮ পৃ; মানচিত্র,
১৮ সেমি, ২য় সংস্করণ; ১৯৩১ (অন্য তথ্যাদি অনুরূপ), ৩য় সংস্করণ; ১৯৩৩ (অন্য তথ্যাদি অনুরূপ)
শিশু পাঠ্য যশোহরের ভূগোল। কলিকাতা, সুভাষ লাইব্রেরী, ১৯২৯; তিন আনা, ৬৪ পৃ; মানচিত্র,
১৮ সেমি; ২য় সংস্করণ; ১৯৩২ (অন্য তথ্যাদি অনুরূপ)
অনুবাদ ও সম্পাদনা
ধম্মপদ। অনূদিত; কলিকাতা, ষ্টুডেন্টস্ লাইব্রেরী, ১৯০৫; দুই টাকা, ১৩৭ পৃ; ১২.৫ সেমি (পালি হইতে পদ্যে অনূদিত)
শ্রী অদ্বৈত-প্ৰকাশ (ঈশান নাগর প্রণীত) সম্পাদিত; কলিকাতা, আশুতোষ লাইব্রেরী, ১৯২৭; এক টাকা তিন আনা, ২৮৩ পৃ; ১৮ সেমি
শিল্প ও সাহিত্য (মাসিক পত্রিকা)॥ সম্পাদনা, কলিকাতা, ১৩১২-১৪ (১৩১২ আষাঢ় হইতে) দুই
বৎসর কাল মন্মথনাথ চক্রবর্ত্তী এবং সতীশচন্দ্র মিত্র যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।
পাঠ্যপুস্তক
প্রাথমিক বাঙ্গলার ইতিহাস। * কলিকাতা, ষ্টুডেন্টস্ লাইব্রেরী, ১৯০২
ভারতবর্ষের ইতিহাস॥ কলিকাতা, ষ্টুডেন্টস্ লাইব্রেরী, ১৯০৩
অষ্টম (শেষ) সংস্করণ; ১৯২২
শিশুরঞ্জন ভারতবর্ষের ইতিহাস॥ *কলিকাতা, ষ্টুডেন্টস্ লাইব্রেরী, ১৯১৬
চতুর্থ (শেষ) সংস্করণ; ১৯১৯
প্রাথমিক ভারতবর্ষের ইতিহাস॥ কলিকাতা, ষ্টুডেন্টস্ লাইব্রেরী, ১৯২২
ঐতিহাসিক পাঠ, ১ম ও ২য়। কলিকাতা, ষ্টুডেন্টস্ লাইব্রেরী, ১৯৩০
প্ৰবন্ধাদি
‘আর কি সেদিন আসিবে?’ ১৫ই পৌষ, ১৩০১ [গ্রন্থকারের প্রথম প্রকাশিত প্রবন্ধ]; ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের এ অবস্থা কেন’, ২৮শে মাঘ, ১৩০১
‘পল্লীগ্রামের লাইব্রেরী’, ১৪ই বৈশাখ, ১৩০৩
‘নির্ঝরণী’, (কবিতা), ২৫শে আষাঢ়, ১৩০৩
Maharani Swarnamayee, Sept. 1, 1897 ‘ভারতে দুর্গোৎসব’,* ১৩০৪ [‘বংশ-মঙ্গলে’ উল্লেখিত কিন্তু নির্দ্দিষ্ট করা যায় নাই]
‘ওপার ও এপার’ (কবিতা), ১লা মাঘ, ১৩০৫
‘সেনাপতি কালী’, পৌষ, ১৩১০; ‘প্রাচীন ভারতের বাণিজ্য’, ফাল্গুন ১৩১০ [প্রতিবাদ প্রবন্ধ— ‘দুমুখো’, ‘নবনূর’ পত্রিকা, ‘ঐতিহাসিক চিত্র’. কলিকাতা আষাঢ়, ১৩১১]; ‘ভারতে য়ুরোপীয়’, চৈত্র, ১৩১০; ‘ঐতিহাসিক গোলাম হোসেন’, শ্রাবণ, ১৩১১, ‘কালিকট্ট’ বৈশাখ, ১৩১২
‘ভাস্কো ডা গামা’, ভাদ্র, ১৩১১;
‘সীতারামের ধর্ম্মপ্রাণতা’, কাৰ্ত্তিক, ১৩১১, ‘মুতাক্ষরীণ ও মুস্তাফা’, ফাল্গুন, ১৩১১; ‘সমসাময়িক ইতিবৃত্তে ‘শিবাজী’, চৈত্র, ১৩১১; ‘হাফেজ’, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ, ১৩১৪
‘নবাবপুত্র’, চৈত্র, ১৩১০ [নবাব সুজাউদ্দৌল্লা সম্পর্কে ছোট গল্প]; ‘শিল্প ও সাহিত্য’, (কবিতা), বৈশাখ, ১৩১১; ‘রাজা সীতারাম রায়’, জ্যৈষ্ঠ, ১৩১১; ‘পৃথ্বীরাজের পত্র’, (পদ্যানুবাদ), আষাঢ়, ১৩১১; “নূতন ও পুরাতন’ বৈশাখ, ১৩২২; ‘মানব জীবন’, (কবিতা), জ্যৈষ্ঠ ১৩১২; যমুনাকূলে’, (কবিতা), আষাঢ় ১৩১২; ‘স্বদেশী আন্দোলন’, ভাদ্র, ১৩১২; ‘বন্দে মাতরম্’, আশ্বিন, ১৩১২; ‘রাখী বন্ধন’, কাৰ্ত্তিক, ১৩১২; ‘জননীর চিত্রদর্শনে’, (পদ্যানুবাদ, উইলিয়াম কাউপার), পৌষ, ১৩১২; ‘স্বর্গীয় রমাকান্ত রায়’, বৈশাখ, ১৩১৩ [স্বদেশী আন্দোলনের সময়ে ছাত্রনেতা]; ‘মা! তুমি কোথায়?’ শ্রাবণ, ১৩১৩ [‘উচ্ছ্বাস’ পুস্তকে সন্নিবিষ্ট]; ‘মা!’ [গান], মাঘ, ১৩১৩ [“বংশ-মঙ্গলে’র পাণ্ডুলিপিতে নিজস্ব রচনা সম্পর্কিত অধ্যায়ে সতীশচন্দ্র লিখিয়াছেন : “১৩১২ সালের অধ্যায়ে সতীশচন্দ্র পূর্ব্বের ‘শিল্প ও সাহিত্যে’, ‘স্বত্বের মোকদ্দামা’, ‘মানহানির মোকদ্দমা’, ‘আমি অন্ধ!’ প্রভৃতি প্রবন্ধ বাহির হইয়াছিল।” —পত্রিকার অভাবে এইগুলি নির্দ্দিষ্ট করা সম্ভব হয় নাই।—শি মি] ‘বঙ্কিমচন্দ্রের চরিত্রসৃষ্টি’, আশ্বিন, ১৩১৩; ‘কবিবর কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার’, আষাঢ়, ১৩১৪; ‘নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়’* [?] Pratapaditya, the cause he fought for, *Sept., 1915
Bengal School of Arts, p. 76, 1925 ‘গুণানন্দের মন্দির’, বৈশাখ, ১৩৩৩ [বৃন্দাবনের শ্রীকৃষ্ণের মন্দির]; ‘গ্রন্থ-সমালোচনা’—ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণীত ‘মোগল যুগে স্ত্রী-শিক্ষা’; ভাদ্র, ১৩২৬
‘হরিদাসের জন্মস্থান’, ১৯২৫ (?); ‘নৈমিষারণ্য’ অক্টোবর, ১৯৩০; ‘দেবর্ষি নারদ’, জানুয়ারি, ১৯৩১
‘সমতটে প্রাচীনত্বের নিদর্শন’, আশ্বিন, ১৩৩০
[বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মিলনে চতুৰ্দ্দশ অধিবেশনে ইতিহাস শাখায় পঠিত এই প্রবন্ধ সংস্কারান্তে প্রকাশিত হয়। —শি মি]
[ইহা ব্যতীত বঙ্গীয় সাহিত্য-সম্মিলনের নবম অধিবেশনে (যশোহর, বৈশাখ, ১৩২৩) পঠিত প্ৰবন্ধ ‘যশোহরের পরিচয়’ নামে এবং সেখহাটিতে পুরাতন মেলা উদ্বোধন উপলক্ষে ‘ভুবনেশ্বরী দেবী’ (১৯২৫-৬?) নামে গ্রন্থকার কর্তৃক লিখিত পুস্তিকা প্রকাশিত হয়।—শি মি]
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন