সতীশচন্দ্র মিত্র
এদিকে রাজকুমারের প্রত্যাবর্তনে যশোহর পুরী উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছিল। তাঁহার পিতা ও খুল্লতাত আশীর্মাল্য লইয়া অপেক্ষা করিতেছিলেন। যশোহরের মহারাণী যশস্বী পুত্রের আগমনবার্ত্তা শুনিয়া আনন্দে আত্মহারা হইলেন। কিন্তু যখন রাজকুমারের বিদ্রোহ-সংবাদ প্রচারিত হইল, তখন সকলেই যেমন বিস্মিত, তেমনই ক্ষুণ্ণ হইলেন। সকলেই আশঙ্কা করিল, প্রতাপের কোষ্ঠীর ফল বুঝি এইবার ফলিয়া যায়। সকলেই বিচলিত হইল— বিচলিত হইলেন না শুধু রাজা বসন্ত রায়। তিনি স্বীয় বুদ্ধিবলে প্রতাপের সকল অভিসন্ধি ব্যর্থ করিয়া দিলেন। তিনি অগ্রজের সহিত পরামর্শ করিয়া কর্তব্য স্থির করিয়া লইলেন; অসন্তুষ্টি বা সন্দেহের রেখামাত্র কোথায়ও প্রকাশ না পায়, সর্ব্বাগ্রে তাহা করিলেন; পরে বিক্রমাদিত্যকে লইয়া সাহসে ভর করিয়া প্রতাপের শিবিরে গিয়া সকল গণ্ডগোলের মীমাংসা করিয়া আসিলেন। প্রতাপকে বুঝাইলেন যে, তাঁহার কার্য্যে তাঁহারা উভয় ভ্রাতায় কিছুমাত্র অসন্তুষ্ট হন নাই, বরং সন্তুষ্ট হইয়াছেন, কারণ তাঁহাদের জরাজীর্ণ দেহে রাজত্ব করিবার বয়স আর নাই। প্রতাপ বাদশাহী সনন্দ আনিয়াছেন, সে ভাল হইয়াছে; বিক্রমাদিত্যের মৃত্যুর পর পুনরায় আর আনিতে হইবে না; সনন্দ না আনিলেও তিনি অচিরে যুবরাজ পদে বরিত হইতেন। বাদশাহ যে তাঁহার প্রতি অনুকম্পা দেখাইয়াছেন, তজ্জন্য পৌরজন সকলে ধন্য হইয়াছে। প্রতাপও দেখিলেন, তাঁহার অনুপস্থিতি সময়ে অল্পদিনে বিক্রমাদিত্যের শরীর একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে; সুন্দরবনের নূতন আবহাওয়ায় তাঁহার স্বাস্থ্য যেন আর রক্ষিত হইবে না। অন্য দিকে বসন্ত রায় তাঁহার কথাগুলি এমন প্রাণের সঙ্গে বলিলেন যে তাঁহার ভাষা হইতে যেন স্নেহ উছলিয়া পড়িতেছিল। সে স্নেহের স্রোতে বিদ্রোহের বহ্নি ভাসিয়া গেল; প্রতাপের ব্যাঘ্রমূর্ত্তি শান্ত হইল।
তখন প্রতাপ হাসিমুখে আবার রাজপুরীতে প্রবেশ করিলেন; অমনি সৰ্ব্বত্র আনন্দ স্রোত বহিল। প্রতাপ যেখনে যান, সেখানেই সমাদর অভ্যর্থনা; তিনি দেখিলেন, তাঁহার সকল কল্পনা বিফল হইয়াছে। নগরের আনন্দকোলাহল, তোরণের দুন্দুভিরব ও অন্তঃপুরের হুলুধ্বনির মধ্যে সকল গৰ্ব্ব বিসর্জন দিয়া দৃপ্ত যুবককে পুনরায় রাজকুমার সাজিতে হইল। তখন বসন্ত রায় উদ্যোগী হইয়া বহুকার্য্যের কর্তৃত্ব তাঁহার হস্তে দিলেন; বৃদ্ধ নৃপতি নামে মাত্র রাজা থাকিয়া অনেক কার্য্য হইতে অবসর গ্রহণ করিলেন। প্রতাপ যাহা করিতেন, কেহই বাধা দিত না। প্রতিভার পথে কেই বা অন্তরায় হইতে পারে?
বসন্ত রায়ের পুত্রগণের মধ্যে সম্ভবতঃ চণ্ডীদাসগুহ বা জগদানন্দ রায় সর্ব্বজ্যেষ্ঠ ছিলেন। ঘটকদিগের কারিকায় তাঁহার পুত্রগণের নামের পৌর্ব্বাপর্য্য রক্ষিত হয় নাই। বিভিন্ন স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্রগণের পৃথক্ তালিকা দিতে গিয়াও এরূপ হইয়াছে। সুতরাং পুত্রগণের মধ্যে কে বড়, কে ছোট জানা যায় না। জগদানন্দের বংশ নাই; সম্ভবতঃ তাঁহার অকাল মৃত্যু হইয়াছিল। অপর ১০টি পুত্রের মধ্যে আমরা মাত্র চারিজনের বিশেষ সংবাদ পাই; এবং তাঁহাদের দুইজনের বংশ এখনও আছে। উঁহাদের নাম— গোবিন্দ, রাঘব, চন্দ্র বা চাঁদরায় ও রমাকান্ত। ইহাদের মধ্যে গোবিন্দ জ্যেষ্ঠ এবং রাঘব মধ্যম। প্রতাপ ও গোবিন্দ প্রায় সমবয়স্ক ছিলেন, গোবিন্দ কিছু ছোট। রাঘব তৎকনিষ্ঠ; এই রাঘবেরই অন্য নাম কচু রায়। বসন্ত রায়ের হত্যার সময় রাঘব কচু বনে লুকাইতে পারেন, কিন্তু তখন তিনি শিশু ছিলেন না, তিনি প্রাপ্তবয়স্ক যুবক।[১] ঐ ঘটনার কয়েক বৎসর পরে মানসিংহ আসিয়া কচু রায়কে রাজা করিয়া যান। যাহা হউক, সে কথার বিশেষ আলোচনা পরে করিব। এখন গোবিন্দ রায়ের কথা বলিতেছি; তাঁহার সহিত প্রতাপের সদ্ভাব ছিল না, বরং জ্ঞাতি- বিরোধই ছিল। চাঁদ রায়কে প্রতাপ ভালবাসিতেন ও বিশ্বাস করিতেন; কিন্তু গোবিন্দের প্রতি তিনি অত্যন্ত বিরক্ত ছিলেন। গোবিন্দ অতিরিক্ত ঈর্ষাপরবশ এবং অল্পবুদ্ধি ছিলেন। প্রতাপ ও তাঁহার সঙ্গিগণ সর্ব্বদা তাঁহার প্রতি বিদ্রূপ ও কটুক্তি প্রয়োগ করিতেন। গোবিন্দ রায় অবিরত প্রতাপের বিরুদ্ধে নানা কথা মাতার নিকট জানাইতেন এবং পরে তাঁহার ঈর্ষা-প্রণোদিত বর্ণনায় উহা বসন্ত রায়ের কর্ণগোচর হইত। তিনি শুনিতেন, বুঝিতেন, কিন্তু সহজে বিচলিত হইতেন না। হয়ত নির্ব্বোধ পরিবারবর্গকে তিনি কোন কথা বলিলে, তাহা অতিরঞ্জিত হইয়া প্রতাপের কর্ণে পৌঁছিত। প্রতাপ একে খুল্লতাতের প্রতি সন্দিগ্ধ, তাহাতে পরের মুখে নানা কথা শুনিয়া উদ্ৰিক্ত হইয়া পড়িলেন। বসন্ত রায় প্রতাপের ঔদ্ধত্যে মনে মনে যে বিরক্ত ছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই; তবে তিনি বয়সে প্রবীণ এবং উদার-হৃদয়; সুতরাং সব দিকে সামঞ্জস্য করিয়া হৃদয়ের গুণে সকলকে সন্তুষ্ট রাখিয়া চলিতেন।
কিন্তু অসদ্ভাব ক্রমেই একটু গুরুতর হইয়া দাঁড়াইতেছিল। ইহা আর কেহ না বুঝেন, বৃদ্ধ নৃপতি বিক্রমাদিত্য বুঝিয়াছিলেন। তিনি অনেক ভাবিয়া-চিন্তিয়া স্থির করিলেন, উভয় পরিবারের সদ্ভাব কখনও থাকিবে না। সুতরাং তাঁহার জীবদ্দশায় সমস্ত গোলযোগ মীমাংসা করিবার উপায় উদ্ভাবন করিলেন। তিনি রাজ্যকে দুইভাগে বিভক্ত করিয়া উহার দশ আনা অংশ প্রতাপকে এবং ছয় আনা অংশ কনিষ্ঠ ভ্রাতা বসন্ত রায়কে দিলেন। ভ্রাতৃভক্ত বসন্ত রায় ইহাতে কিছুমাত্র আপত্তি করিলেন না। রাজ্যের রাজা বিক্রমাদিত্য হইলেও, উহার সংস্থাপক ও ব্যবস্থাপক তিনিই ছিলেন; তাঁহার পক্ষে তুল্যাংশ দাবি করা অসঙ্গত হইত না এবং সেরূপ দাবি করিবার জন্য তিনি পুত্রদিগের দ্বারা বিশেষভাবে প্ররোচিতও হইয়াছিলেন। কিন্তু তাহা করিলে পাছে প্রতাপের বিরক্তি এবং সঙ্গে সঙ্গে অশান্তির সৃষ্টি হয়, এজন্য তিনি জ্যেষ্ঠের কথায় সম্পূর্ণ সম্মতি দিলেন। তখন বিক্রমাদিত্য রাজ্যটিকে চিহ্নিত মত ভাগ করিয়া দিলেন। কালিন্দী হইতে ভাগীরথী পর্য্যন্ত পশ্চিমাংশ পাইলেন বসন্ত রায়; উহা এক্ষণে সম্পূর্ণ ভাবে ২৪-পরগণা জেলার অন্তর্গত; আর কালিন্দী হইতে মধুমতী পর্য্যন্ত বিস্তৃত পূর্ব্বরাজ্য পড়িল প্রতাপের অংশে; উহা এখন সম্পূর্ণ খুলনা জেলার অন্তর্গত; আপাততঃ উভয় রাজ্যাংশের রাজধানী যশোহরেই রহিল। সমগ্র রাজ্যের পরিরক্ষণ জন্য আবশ্যকমত উপযুক্ত স্থানে নির্ব্বিবাদে সৈন্য রক্ষা ও দুর্গনির্মাণ করা যাইবে, ইহাই স্থির হইল।
প্রতাপ একস্থানে উভয় অংশের রাজধানী রাখিতেই ইচ্ছুক ছিলেন না। এ সময়ে যশোহর নগরের অনেক দূর দক্ষিণ পর্য্যন্ত সুন্দরবন পরিষ্কৃত হইয়াছিল। দক্ষিণ দিকে যেখানে যমুনা পুনরায় দ্বিধা বিভক্ত হইয়াছিল, এবং পূৰ্ব্বমুখে ইচ্ছামতী বা কদমতলী শাখা এবং পশ্চিম দিকে যমুনা প্রবাহিত হইতেছিল, সেই স্থান পৰ্য্যন্ত প্রায় ৮/১০ মাইল স্থান পরিষ্কৃত হইয়াছিল।[২] সেই স্থানে যমুনা ও ইচ্ছামতীর দক্ষিণ পারে ভীষণ জঙ্গল ছিল। প্রতাপাদিত্য ঐ জঙ্গল পরিষ্কার করিয়া নূতন রাজধানী স্থাপন করিবার কল্পনা করিলেন। তিনি যমুনা গর্ভ হইতে উত্থিত আগ্রা দুর্গ এবং গঙ্গা যমুনার সঙ্গমস্থলে প্রয়াগে ইল্লাহাবাদ দুর্গ দেখিয়া আসিয়াছেন। এইবার তিনি তদনুকরণে যমুনা ও ইচ্ছামতীর সঙ্গমস্থলে ধুমঘাটে নূতন দুর্গ স্থাপনের জন্য উদ্যোগী হইলেন। বৰ্ত্তমান মুকুন্দপুরে যে যশোহর নগরীর প্রথম দুর্গ স্থাপিত হয়, তাহাতে উত্তর দিক হইতে শত্রু আসিবার সম্ভাবনা ছিল বলিয়া, সেই দিকেই বাধা দিবার বিশেষ ব্যবস্থা হইয়াছিল। কিন্তু এখন দক্ষিণ দিক হইতেও শত্রুর আগমন অসম্ভব ছিল না। আরাকাণ ও সন্দ্বীপ হইতে মগেরা পররাষ্ট্রজয় ও দেশ লুণ্ঠনে অসাধারণ শক্তিশালিতার পরিচয় দিতেছিল, পর্তুগীজ ফিরিঙ্গিরাও তাহাদের সহিত যোগ দিয়া দস্যুবৃত্তি করিতেছিল। সুতরাং চতুর্দিক হইতে দুরধিগম্য ও দুর্ভেদ্য দুর্গের প্রয়োজন। প্রতাপ এবার তাহারই আয়োজন করিলেন। বসন্ত রায় তাঁহার প্রস্তাব প্রতিভাসম্পন্ন ভ্রাতুষ্পুত্রের উপযোগী বলিয়া গ্রাহ্য করিলেন এবং তিনি নিজে উদ্যোগী হইয়া, নূতন রাজধানীর পত্তন আরম্ভ করিয়া দিলেন। এ বিষয়ে তাঁহার যে অভিজ্ঞতা ছিল, প্রতাপ তাহার সাহায্য লইতে কুণ্ঠিত হইলেন না।
ধুমঘাটে রাজধানী নির্ম্মিত হইতে থাকিল। বসন্ত রায় স্বয়ং তাহার তত্ত্বাবধান করিতে লাগিলেন। এমন সময়ে বিক্রমাদিত্য রোগাক্রান্ত হইয়া হঠাৎ দেহত্যাগ করিলেন (১৫৮৩)। মহাসমারোহে যশোহর রাজধানীতে তাঁহার শ্রাদ্ধক্রিয়া সমাহিত হইল। এই শ্রাদ্ধকালে যশোহর ও বালা উভয় স্থানের প্রধান প্রধান পণ্ডিতবর্গ নিমন্ত্রিত হইয়া আসিয়া রাজোপচারে অভ্যর্থিত হইলেন। এই সময়ে ডামরেলীর সমাজমন্দিরের নির্মাণকার্য শেষ হইয়া উহাতে ইষ্টকলিপি সংলগ্ন করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। সম্ভবতঃ সেই স্থানেই পণ্ডিতবর্গ ও সামাজিকগণের সমাগম ও সম্বৰ্দ্ধনা হইল। এই শ্রাদ্ধকার্য্যে রাজবংশের ইষ্টদেব কমলনয়ন তর্কপঞ্চানন অধ্যক্ষতা করিলেন। বৃদ্ধ বসন্ত রায়ের সুব্যবস্থা ও সামাজিকতায় সমবেত ব্যক্তিবর্গ সকলেই সমধিক পরিতুষ্টি লাভ করিলেন।
স্বর্গগত নৃপতির যাবতীয় ঔর্দ্ধদেহিক ক্রিয়া সুসম্পন্ন হওয়ার পর, বসন্ত রায় উদ্যোগী হইয়া পরবর্ত্তী বৈশাখী পূর্ণিমায় প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেক ক্রিয়া সম্পাদন করিলেন।[৩] এতদুপলক্ষে বঙ্গদেশের অধিকাংশ ভুঞা নৃপতি ও অন্যান্য ছোট বড় রাজন্যবর্গ সকলেই নিমন্ত্রিত হইয়া যশোহরের শোভাবর্দ্ধন করিয়াছিলেন। প্রতাপাদিত্যের অসামান্য চেষ্টার ফলে এবং তাঁহার অনুচর বর্গের প্রাণপণ পরিশ্রমে ইঁহাদের অভ্যর্থনার কিছুমাত্র ত্রুটি হয় নাই। এ সময়ে কে কে আসিয়াছিলেন, তাহা জানা যায় না। তবে দুই একজন আসিয়াছিলেন, তাহা বলা যায়; ভূষণার মুকুন্দরাম ও তৎপুত্র সত্রাজিৎ এবং উড়িষ্যার ঈশা খাঁ মছন্দরী এই উৎসবে যোগ দিয়াছিলেন। ঈশা খাঁ যখন কতলু খাঁর উকীল স্বরূপ গৌড়ে অবস্থান করিতেন, তখন বসন্ত রায়ের সহিত তাঁহার বন্ধুত্ব হয়। তাঁহারা উভয়ে পাগড়ী বদল করিয়া প্রকাশ্য মিত্রতা স্থাপন করেন।[৪] এইজন্য ঈশা খাঁকে বসন্ত রায়ের ‘পাগড়ী বদল ভাই’ বলিত। সত্রাজিৎ রায়ের সহিত এই সময়ে প্রতাপের যে বন্ধুত্ব হয়, তাহা বহুদিন স্থায়ী হইয়াছিল। রাজন্যবর্গ লইয়া আমোদে প্রমোদের অভিষেক উৎসবের সমারোহ বৃদ্ধি করা ব্যতীত এ ব্যাপারে প্রতাপের আরও নিগূঢ় উদ্দেশ্য ছিল। সুযোগমত তাঁহাদের প্রকৃতি ও শক্তি পরীক্ষা করা এবং মোগলের প্রতি তাঁহাদের আসক্তি বা বিরক্তি কিরূপ ছিল, তাহাও বুঝিয়া লওয়া এই অভ্যর্থনার অন্যতম উদ্দেশ্য হইয়াছিল। শুধু তাহাই নহে, যাঁহাদের সহিত তাঁহার মতের মিল হইয়াছিল, মোগলের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করিবার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে তিনি তাঁহাদের সহিত অনেক পরামর্শ করিয়া লইলেন। অন্যত্র হইতে সময়কালে সাহায্য পাওয়া যে অসম্ভব নহে, প্রতাপের তাহা বুঝিতে বাকী রহিল না। সঙ্গে সঙ্গে ক্রমেই তাঁহার উৎসাহ উদ্যম আরও বাড়িতে লাগিল।
ভাগ্যবানের পথ ভগবানই পরিষ্কার করিয়া দেন। প্রতাপের জীবনে ইহা বিশিষ্টভাবে পরীক্ষিত হইয়াছে। যখন কেবলমাত্র জাগতিক চেষ্টায় কাৰ্য্য হয় না, তখন সহসা দৈবশক্তি আবির্ভূত হইয়া প্রকৃত উদ্বোধন করিয়া দেয়। মোগলের বিপক্ষে দাঁড়াইয়া বঙ্গের স্বাধীনতা ঘোষণা করিবার উদ্দেশ্য মনে মনে স্থির হইয়াছিল; আত্মবল বৃদ্ধির জন্য অবিশ্রান্ত চেষ্টা চলিতেছিল; কিন্তু এখনও লোকের বিশ্বাস উদ্বুদ্ধ হয় নাই। বিশ্বাস না হইলে প্রাণে বল আসিবে কেন? প্রাণ দিয়া পরের বা দেশের কাজে আত্মোৎসর্গ করিবার প্রবৃত্তি জাগিবে কেন? প্রতাপ শক্তিশালী, প্রতাপ উদ্যমশীল, প্রতাপ সাহসী ও অদ্ভুতকর্ম্মা; কিন্তু তবুও লোকের বিশ্বাস জাগে নাই। হঠাৎ একটি দৈব ঘটনায় যশোরেশ্বরী দেবীর আবির্ভাবে তাঁহার প্রতি লোকমাত্রের অটল বিশ্বাস স্থাপিত হইল।
পাদটীকা :
১. বিপদে পড়িলে প্রাপ্তবয়স্ক যুবকেরও কচু বনে পলায়ন করা অসম্ভব নহে। মানসিংহের সহিত যুদ্ধকালে রাঘবের বয়স ২৫ বৎসর ধরিলে প্রতাপের আগ্রা হইতে প্রত্যাগমনকালে তাহার বয়স ৪/৫ বৎসর। তখন কোনদিন প্রতাপের ঔদ্ধত্য জন্য রাঘবকে লুকাইয়া রাখা বিচিত্র নহে। ‘বঙ্গাধিপপরাজয়ে’ এইরূপ কথাই আছে। সে পুস্তকও প্রবাদের ভিত্তিতে লিখিত। তবে তাহাতে অনেক অত্যদ্ভুত ঘটনা আছে।—৪৯৪ পৃ।
২. প্রথম সংস্থাপিত যশোহর-নগরী উত্তর দক্ষিণে ৮/১০ মাইল বিস্তৃত ছিল। রামরাম বসুও ইহাকে পঞ্চক্রোশী বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। কোন একটি ক্ষুদ্র স্থানকে যশোহর বলিত না। উপকণ্ঠ লইয়া ১০ মাইলব্যাপী সমস্ত স্থানের সাধারণ নাম ছিল যশোহর।
৩. যতদূর বুঝা যায় তাহাতে ১৫৮৩ অব্দের শেষভাগে বিক্রমাদিত্যের মৃত্যু হয়। এবং ১৫৮৪ অব্দের এপ্রিল মাসে বা ১৫০৬ শাকের বৈশাখী পূর্ণিমায় প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেক হয়। ইহা তাঁহার যশোহর ভুঞা-রাজ্যের দশ আনা অংশ প্রাপ্তির প্রথম অভিষেক। তিনি যখন স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, তখন ধুমঘাটে তাঁহার পুনরভিষেক হইয়াছিল।
৪. সত্যচরণ শাস্ত্রী, ‘প্রতাপাদিত্যের জীবন চরিত’, ৮১ পৃ; Ain. (Blochmann), p. 342. Note.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন