সতীশচন্দ্র মিত্র
১. ভূমিকা
এশিয়া খণ্ডে, বিশেষত চীন ও ভারতবর্ষে, প্রথম প্রথম কাথলিক পাদ্রীগণ তাঁহাদের উপরিতন কর্মচারীদিগকে যে-সব পত্র লিখিতেন তাহা অবলম্বন করিয়া ফাদার পিয়ার্ দ্যু জারিক নামক দক্ষিণ-ফ্রান্সবাসী একজন জেসুইট্ পাদ্রী এশিয়ায় খ্রীষ্টধর্মের একখানি প্রকাণ্ড ইতিহাস লেখেন। ইহার তৃতীয় খণ্ড ১৬১৪ খৃষ্টাব্দে বর্দো নগরে প্রকাশিত হয়; নাম L’ Histoire des Choses plus memorables advenues tant ez Indes Orientales &c. ইহাতে ১৬০০ হইতে ১৬১০ পর্যন্ত ঘটনা বিবৃত হইয়াছে। পৃষ্ঠা-সংখ্যা ১০৬৮+৪৮। এই গ্রন্থে প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে যাহা কিছু বলা হইয়াছে, তাহা নীচে দেওয়া গেল। অবশ্য প্রতাপাদিত্যের নাম নাই, তাঁহাকে চাঁদেকানের রাজা বলিয়া নির্দেশ করা হইয়াছে; কিন্তু এই রাজা যে প্রতাপ সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই, কারণ বালার রাজা [রামচন্দ্র] ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে আট বৎসরের শিশু এবং চাঁদেকানের রাজার জামাতা বলিয়া বর্ণিত, এবং বালা হইতে চাঁদেকান আসিবার পথের যে বিবরণ দেওয়া হইয়াছে তাহাতে শেষোক্ত রাজ্য সুন্দরবন ভিন্ন আর কিছু হইতে পারে না।
গ্রন্থকার বলিতেছেন (২য় অংশ, ১০ম পরিচ্ছেদ), সমস্ত পাঠান ও দেশের আদিমবাসী বাঙ্গালীগণ বারো ভূঁইয়াদিগকে মানিয়া চলে; ইহাদের মধ্যে তিন জন হিন্দু, যথা চাঁদেকান, শ্রীপুর এবং বাক্লার রাজা, অপর নয় জন মুসলমান। আরাকানের রাজা ‘মগ-রাজ’ নামে পরিচিত, ইনি ভিন্ন, অপর এক পক্ষ।
ভারতে জেসুইট্ ধর্মসম্প্রদায়ের পরিদর্শক (Visiteur) নিকোলস্ পিমেণ্টা ১৫৯৮ খৃষ্টাব্দে ফ্রাঁসোয়া ফার্নাদেজ্ এবং ডোমিনিক্ সোসা নামক দুইজন পাদ্রীকে, এবং তাহার পর-বৎসর মেলকিয়র দি ফনসেকা ও জাঁ আঁদ্রে বুএজ্ নামক অপর দুজন ফাদারকে পাঠাইলেন এবং আজ্ঞা দিলেন যে, তাহারা প্রথমে [বঙ্গে] যেখানে উপযুক্ত বোধ হয় এরূপ কোন নির্দিষ্ট স্থানে নিজদিগকে স্থাপিত করিতে চেষ্টা করিবে এবং দুইজন সেই আড্ডায় স্থায়িভাবে বাস করিবে, আর তখন অপর দুইজন ভ্রমণ করিয়া খৃষ্টধর্ম প্রচার করিতে থাকিবে। (২য় অংশ, ১০ম পরিচ্ছেদ)।
২. প্রথম পাদ্রীগণের আগমন
২২শে ডিসেম্বর ১৫৯৯ খৃষ্টাব্দে ফাদার ফ্রাঁসোয়া ফার্নাদেজ্ চাটগাঁর নিকটবর্তী ডিয়াঙ্গা বন্দর হইতে পরিদর্শককে এই পত্র লেখেন :
চাটগাঁ হইতে শ্রীপুর গিয়া আমি প্রতি রবি ও শুক্রবার ধর্মপ্রচার করিতাম। মে মাসে (১৫৯৯?) ফাদার ডোমিনিক্ সোসা হুগলী যাইবার জন্য [আমার সঙ্গ] ছাড়িলেন।*** অক্টোবর মাসে ফাদার ডোমিনিক্ আমাকে লিখিলেন যে, আমাদের সমস্ত কার্য সম্বন্ধে রাজার সহিত একটা বন্দোবস্ত স্থির করিবার জন্য আমার চাঁদেকান যাওয়া আবশ্যক, কারণ রাজার (মত) পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমি তাহাই করিলাম। যখন রাজা জানিলেন যে, আমি পৌঁছিয়াছি, তিনি তাঁহার একজন প্রধান ব্রাহ্মণ পাঠাইয়া আমাকে অভ্যর্থনা করিলেন এবং বলিলেন যে, আমার আগমনে তিনি অত্যন্ত খুশি হইয়াছেন এবং আমাকে দেখিবার জন্য অত্যন্ত ব্যগ্র হইয়াছেন। পরদিন ফাদার সোসাকে সঙ্গে লইয়া আমি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে গেলাম। তিনি আমাকে অত্যন্ত আদর করিলেন (fit beaucoup de caresses) এবং নিজ পরিত্রাণ (salut) সম্বন্ধীয় বিষয়গুলি লইয়া আমাদের সহিত কথাবার্তা কহিলেন।*** তথা হইতে আমি শ্রীপুরে ফিরিলাম। (২য় অংশ, ১০ম পরিচ্ছেদ)।
৩. পাদরীগণের দ্বিতীয় আগমন
২০এ জানুয়ারি ১৬০০, ফাদার মেলকিয়র দি ফনসেকা চাঁদেকান হইতে পরিদর্শককে এই পত্ৰ লেখেন :
গত নভেম্বর মাসে চাটগাঁ হইতে রওনা হইয়া, স্থানীয় পোর্তুগীজদের অনুরোধে বাক্লা রাজ্যে প্রবেশ করিয়া রাজার সহিত দেখা করিলাম এবং তাঁহার রাজ্যে গীর্জা নির্মাণ করিতে, খৃষ্টধর্ম প্রচার করিতে এবং লোকের স্বেচ্ছাক্রমে তাহাদিগকে খৃষ্টধর্মে দীক্ষিত করিতে অনুমতিসম্বলিত এক ফর্মান তাঁহার নিকট হইতে পাইলাম। [এই ফর্মান ২য় অংশ, ১০ম পরিচ্ছেদে দেওয়া হইয়াছে।] তাহার পর বিদায় লইয়া আমি চাঁদেকানের দিকে চলিলাম।
বাক্লা হইতে চাঁদেকানের পথের মত সুন্দর ও সুখকর পথ আমি আর কখন দেখি নাই। অনেক বড় এবং মিষ্টজলযুক্ত নদী—যাহাকে এ দেশে গঙ্গা বলে—তাহার মধ্য দিয়া নৌকা করিয়া চলিতে লাগিলাম। তীরগুলি সুন্দর সবুজ গাছে আচ্ছন্ন; এক পারে হরিণের বড় বড় দল এবং গরুর পাল ঘাস খাইতেছে; অপর পারে অতি বিস্তৃত ধান্যক্ষেত্র। অসংখ্য খাল; তাহাতে ঢুকিলে দেখা যায় দুদিকে গাছ এমন করিয়া ঢাকিয়াছে যে, সূর্যের আলো মধ্যে প্রবেশ করিতে পারে না। কোথায়ও বা গাছ হইতে মৌমাছির ঝাঁক ঝুলিতেছে, কোথায়ও বা বাঁদর এক ডাল হইতে অপর ডালে লাফাইতেছে। জমি অনেক স্থলে সুন্দর উর্বরা। কোথায়ও বা ইক্ষুদণ্ডের ঝোপ। এই বনে অনেক গণ্ডার ও অন্যান্য বন্য জন্তু থাকে।
২০-এ নভেম্বর ১৫৯৯ চাঁদেকান পৌঁছিলাম এবং ফাদার সোসাকে দর্শন করিয়া পরস্পর অত্যন্ত সুখী হইলাম। স্থানীয় পোর্তুগীজেরাও আমাকে খুব অভ্যর্থনা করিল। পরদিন আমি রাজাকে সম্মান করিতে গেলাম এবং তাঁহাকে বেরিঙ্গান্ জাতীয় কমলালেবু [oranges de la race de Beringan] উপহার দিলাম। এগুলি অতি সুন্দর এবং এ দেশে পাওয়া যায় না। তিনি ইহা পাইয়া খুব সন্তুষ্ট হইলেন এবং আমাকে সম্মানের সহিত গ্রহণ করিলেন।
তিনি আমাদিগকে এত মান্য করিলেন যে, আমাদের দেখিবামাত্র নিজ সিংহাসন [siege, চেয়ার] ছাড়িয়া দাঁড়াইয়া মাথা নত করিলেন [nous fait une grand reverence]। ইহার কারণ এই যে, এ দেশের লোকেরা ব্রহ্মচর্যকে [chastete] অত্যন্ত ভক্তি করে, এবং আমরা পূৰ্ণ ব্ৰহ্মচর্য রক্ষা করি শুনিয়া ইনি আমাদের সম্বন্ধে অত্যন্ত উচ্চমত পোষণ করিয়াছেন।
আমাদের বাসার কাছে একটা বড় জায়গা আছে। আমরা রাজার কাছে সেটি চাহিলাম, যে, যাহাদিগকে আমরা খৃষ্টান করিব তাহাদিগকে সেখানে বাস করাইলে তাহাদিগকে অতি সহজে সাহায্য করিতে এবং ধর্মপথে রাখিতে পারিব। তিনি তৎক্ষণাৎ এ প্রার্থনা মঞ্জুর করিয়া এ সম্বন্ধে একখান ফর্মান শীঘ্র প্রস্তুত করিতে বলিলেন, এবং আজ্ঞা দিলেন যে, ওই বাড়িতে যে-সব হিন্দু [অর্থাৎ নূতন খৃষ্টানেরা] বাস করিবে তাহারা তাঁহাকে যে [কর] দিত তাহা আমাদিগকে দিবে। পরে আমরা বিদায় লইলাম।**
বঙ্গদেশে জেসুইটদের সর্বপ্রথম গীর্জা এইখানে প্রস্তুত হয় এবং ইহাকে যীশুর গীর্জা নাম দেওয়া হইল।*** পোর্তুগীজদের সাহায্যে এই গীর্জা খুব জাঁকজমক সহকারে সাজানো হইল এবং ১লা জানুয়ারিতে খুব ধুমধামের সহিত উপাসনা করা হইল। চারিদিকে ইহার নাম পড়িয়া গেল।*** এই গীর্জা দেখিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিয়া রাজা সভাসদদের এক প্রকাণ্ড দল লইয়া আমাদের নিকট আসিলেন এবং গীর্জার সাজসজ্জা দেখিয়া অত্যন্ত সন্তোষ প্রকাশ করিলেন। খুব ভক্তির সহিত গীর্জা-ঘরে প্রবেশ করিলেন এবং যখন প্রধান চ্যাপেলটির নিকট আসিলেন, তখন জুতা খুলিয়া ফেলিলেন। তাঁহার জন্য একখান চেয়ার আগে হইতে প্রস্তুত রাখা ছিল। কিন্তু আমরা কিছুতেই তাঁহাকে তাহাতে বসাইতে পারিলাম না, এমন কি কার্পেটেও নহে। তিনি শুধু সিঁড়ির উপর একখান ছোট মাদুরে বসিলেন এবং সেখানে অনেকক্ষণ ধরিয়া কথাবার্তা বলিতে লাগিলেন। গীর্জার বেদীর উপর যে-সব দুর্লভ দ্রব্য ছিল এবং অন্যান্য জিনিস যাহা দেখিলেন তাহার সম্বন্ধে আমাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলেন। আর আমাদিগকে একটি পাথরের গীর্জা নির্মাণ করিতে অনুমতি দিলেন, যাহা বঙ্গদেশের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুন্দর হইবে। [এই গীর্জা প্রস্তুত হয় নাই।]
পরদিন রাজপুত্র গীর্জার সাজসজ্জা দেখিতে আসিলেন। ইহার নিকটবর্তী স্থানে যত হিন্দু, ছোট হউক বড় হউক, গীর্জা দেখিয়া গেল, কারণ ইহার জাঁকজমকের খ্যাতি সর্বত্র প্রচার হইয়াছিল। প্রত্যহ হাজার হাজার দর্শক উপস্থিত হইত। পনের দিনেরও বেশি ধরিয়া এইরূপ হইতে লাগিল। (২য় অংশ, ১০ পরিচ্ছেদ)।
৪. যশোর-রাজ-দরবারে পাদ্রীদের প্রতিপত্তি
যীশুর জীবনের একটি ঘটনার তিথিতে ওই গীর্জা খুব জাঁকজমকের সঙ্গে সাজান হইল (১৬০১ খৃিঃ?), কারণ প্রথম বৎসরে ওই তিথিতেই গীর্জাটি উৎসর্গ করা হয়। রাজার আজ্ঞায় জ্যেষ্ঠ কুমার, যিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী এবং তাঁহার এক ছোট ভাই [এ দুজন বোধ হয় উদয়াদিত্য এবং সংগ্রামাদিত্য] গীর্জা দেখিতে আসিলেন। রাজাও নিজে অনেক সম্ভ্রান্ত পুরুষ সঙ্গে লইয়া এটি দর্শন করিলেন এবং এই সুন্দর দৃশ্য দেখিয়া অতি সন্তুষ্ট হইয়া, পাথরের গীর্জা নির্মাণ করিবার জন্য আমাদের যে অনুমতি দিয়াছিলেন তাহা দৃঢ়তর করিয়া দিলেন। ফলত রাজা পাদ্রীদের প্রতি এত স্নেহ দেখাইতে লাগিলেন যে, তাহাদের যে-কোন প্রার্থনা পূরণে তাঁহার অতিমাত্র সুখ হইবে এরূপ বোধ হইতে লাগিল।
পাদ্রীরা তাঁহার কাছে অন্য কিছুই চাহিল না। শুধু একজন পোর্তুগীজের জালিয়া (galiot) নৌকা দেনার জন্য তিনি আটক করিয়াছিলেন, এবং অন্য সভাসদের অনুরোধে তাহা ছাড়িয়া দেন নাই, কিন্তু এখন পাদ্রীদের প্রার্থনায় তাহা মালিককে ফেরত দিলেন। আর রাজার নিকট একজন হিন্দু অনেক টাকা ধারিত, ফাদারদের অনুরোধে রাজা তাহাকেও দেনা হইতে অব্যাহতি দিলেন (২য় অংশ, ১০ম পরিচ্ছেদ)।
৫. কার্ভালো-হত্যা (?) ও পাদ্রীদের দেশত্যাগ
ইহার পর সোনদ্বীপ লইয়া কি একটা বিষম গোলমাল বাধিল। মগের রাজা এই দ্বীপ অধিকার করিয়া উহাকে দক্ষিণ বঙ্গ বিজয়ের আড্ডা (base of operations) স্বরূপ ব্যবহার করিবার ফন্দী করিলেন। পোর্তুগীজ ফিরিঙ্গীরা ভাবিল যে, মগদেশে ও বাংলায় রাজার অধীনে বাস করা তাহাদের পক্ষে সব সময় নিরাপদ ও সুবিধাজনক নহে, কিন্তু যদি তাহারা সোনদ্বীপ অধিকার করিয়া তথায় নিজ উপনিবেশ স্থাপন করে তবে স্বাধীন ও নিরাপদ হইবে। আর, মুঘলেরাও বঙ্গ বিজয় করিয়া সোনদ্বীপের উপর হাত দিল।
সোনদ্বীপ শ্রীপুরের সামনাসামনি, এবং বঙ্গদেশ হইতে ৬ লীগ্ অর্থাৎ সাড়ে ১৩ ক্রোশ দূরে। ইহার উৎপন্ন লবণে সমস্ত বঙ্গদেশের অভাব পূরণ হইত, এবং রাজার প্রচুর রাজস্ব লাভ হইত। শ্রীপুরের রাজা কেদার রায় ইহার ন্যায়সঙ্গত অধিকারী, কিন্তু ইহার পূর্বে অনেক বৎসর ধরিয়া তিনি উহা ভোগ করেন নাই, কারণ মুঘলেরা এই দ্বীপ জোরে দখল করিয়াছিল। এখন পোর্তুগীজেরা ওই দ্বীপ কাড়িয়া লওয়ায় তিনি তাঁহার সমস্ত স্বত্ব উহাদিগকে দান করিলেন। ১৬০২ খৃষ্টাব্দে ডোমিনিক কার্ভালো নামক একজন প্রসিদ্ধ বীর কাপ্তেন, কেদার রায়ের চাকরি করিবার সময় কেদার রায়ের সাহায্যে, ওই দ্বীপ মুঘলদের হাত হইতে দখল করে। তারপর মগরাজা তাহাদিগকে আক্রমণ করায়, যদিও পোর্তুগীজেরা জয়লাভ করে, কিন্তু তাহাদের এত সৈন্য ও নৌকা ধ্বংস হয় যে, তাহারা নিজ হইতেই ওই দ্বীপ ছাড়িয়া দেয়। কার্ভালো জাহাজ মেরামত ও নূতন সৈন্য ভর্তি করিবার জন্য প্রথমে শ্রীপুরে, পরে হুগলী বন্দরে যায়। (২য় অংশ, ১০-১১শ পরিচ্ছেদ)।
এদিকে মগরাজা সোনদ্বীপ অধিকার করিবার পর বালা রাজ্যের কিছু [বোধ হয় বাখরগঞ্জের তীরবর্তী স্থানগুলি] দখল করিয়া, চাঁদেকান রাজ্য জয় করিবার জন্য আয়োজন করিতে লাগিলেন। চাঁদেকানের রাজা [অর্থাৎ প্রতাপাদিত্য] দেখিলেন যে এত প্রবল শত্রুকে তিনি একলা বাধা দিতে পারিবেন না, এবং তজ্জন্য কুটিল নীতি দ্বারা নিজ বন্ধুদের (অর্থাৎ পোর্তুগীজ) ধ্বংস করিয়া এই বিপদ হইতে রক্ষা পাইবার পথ বাহির করিলেন। তিনি জানিতেন যে, আরাকানের রাজা কার্ভালোর প্রতি অসন্তুষ্ট এবং তিনি (অর্থাৎ প্রতাপ) নিজেও তাহাকে ভয় করিতেন, সুতরাং কার্ভালোকে বন্দী করিয়া তাহার মস্তক পাঠাইয়া মগরাজাকে তুষ্ট করার এবং এই উপায়ে নিজরাজ্য রক্ষা করিবার ফন্দী করিতে লাগিলেন। তিনি কার্ভালোর নিকট দূত পাঠাইয়া জানাইলেন যে, তাঁহার নিকট আসিয়া মগরাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্যে করিলে তিনি তাহার অনেক সুবিধা করিয়া দিবেন।
কার্ভালো চাঁদেকানের রাজার কথায় বিশ্বাস করিয়া ভাবিল যে, এইরূপে তাঁহাকে সাহায্য করিলে কৃতজ্ঞ রাজা তাহাকে সৈন্যবল দিয়া সোনদ্বীপ উদ্ধারে সহায়তা করিবেন। রণসজ্জায় পূর্ণ তিনখান বড় জাহাজ, ছয়খানা কাটার এবং ৫০ খান জালিয়া এবং একদল সাহসী সৈন্য সঙ্গে লইয়া সে চাঁদেকানে আসিল।
রাজা তাহাকে সসম্মানে অভ্যর্থনা করিয়া, একটা জরির পোশাক ও বহুমূল্য ঘোড়া উপহার দিলেন এবং প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, তিন দিনের মধ্যে মগরাজ্যের বিরুদ্ধে যাত্রা করিবার জন্য আবশ্যক সব [দ্রব্য, সৈন্য ও নৌকা] দিবেন। কিন্তু ১৫ দিন পর্যন্ত ইহার কিছুই করিলেন না, অথচ গোপনে মগরাজের সহিত সন্ধি করিলেন যে, তিনি কার্ভালোর মাথা পাঠাইয়া দিবেন আর মগরাজ চাঁদেকান আক্রমণ হইতে বিরত হইবেন।
অপর পোর্তুগীজগণ, বিশেষত পাদ্রীগণ রাজার বিশ্বাসঘাতকতা সন্দেহ করিয়া কার্ভালোকে কোন নিরাপদ স্থানে চলিয়া যাইতে উপদেশ দিল, যেখান হইতে সে রাজার প্রকৃত অভিপ্ৰায় বুঝিতে পারিবে, এবং তৃতীয় ব্যক্তি দ্বারা রাজার সহিত কথা চালাইতে পারিবে। স্থানীয় হিন্দুদের মধ্যেও প্রবল জনরব উঠিল যে রাজা কার্ভালোকে হত্যা করিবেন। কিন্তু কার্ভালো এরূপ করিতে সম্মত না হইয়া, নিজের কয়েকজন কাপ্তেনকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য রাজাকে দেখিবার জন্য৩ গেল। তথায় তিন দিন পর্যন্ত রাজদর্শনের উপায় হইল না, এবং নানারূপ বিশ্বাসের অযোগ্য ওজর শুনিতে পাইল। তিন দিন পরে, রাজার চক্রান্ত কার্যে পরিণত করিবার সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ হইলে, কার্ভালোকে কয়েকজন পোর্তুগীজ সহ রাজবাড়িতে আসিতে দেওয়া হইল। যেই সে শেষ দরজা দিয়া ঢুকিয়াছে, অমনি সেই দরজা বন্ধ করিয়া তাহার অনুবর্তী লোকদিগকে বাহিরে রাখা হইল। তাহাদের বন্দী করিয়া অস্ত্র ও পরিচ্ছদ কাড়িয়া লইয়া, অত্যন্ত নিষ্ঠুরতা ও অপমানের সহিত তাহাদের ঘুষি মারিয়া, পায়ে লোহার বেড়ি পরানো হইল। তাহার পর রাজার আদেশে, কার্ভালোকে হাতীর পিঠে চড়াইয়া অন্য স্থানে লইয়া যাওয়া হইল; সঙ্গে রাজার একজন সেনানী ও চার জন রক্ষী সৈন্য। তাহারা উচ্চ চীৎকার ও ব্যঙ্গ করিতে করিতে কার্ভালো ও অপর কয়েকজন পোর্তুগীজকে লইয়া চলিয়া গেল। এই বন্দীগণ মৃত্যুর পূর্বে কি কি [অত্যাচার ও যন্ত্রণা] সহ্য করিতে বাধ্য হইয়াছিল, এবং কতদিন বন্দীভাবে কাটাইয়াছিল তাহা নিশ্চিত জানা যায় না। এই মাত্র নিশ্চয় যে তাহাদের হত্যা করা হয় [It est asseure qu’its furent tuez]। (২য় অংশ, ১১শ পরিচ্ছেদ)।
তাহার পর, চাঁদেকানের অপর পোর্তুগীজগণ এই সংবাদ পাইয়া কি প্রতিকার করিবে স্থির করিতে পারিল না; ভাবিল, রাজা কার্ভালোর উপর চটিয়া আছে, আমরা তো নির্দোষ, তিনি আমাদের কোন অনিষ্ট করিবেন না। কিন্তু স্থানীয় পোর্তুগীজ উপনিবেশের [সাধারণ নাম ‘বান্দে ‘ অর্থাৎ বন্দর] নিকটবাসী মুসলমানগণ ফিরিঙ্গীগণের মহাশত্রু ছিল; তাহারা ওই সংবাদ আসিবার রাত্রেই পোর্তুগীজদিগের বাড়ি ও সম্পত্তি লুঠ ও দগ্ধ করিতে লাগিল। *** পরদিন রাজা কার্ভালো এবং অন্যান্য পোর্তুগীজদের জাহাজগুলি অধিকার করিলেন, এবং তাহাদের কারাগারে ফেলিলেন, সেখানে তাহারা অশেষ দারিদ্র্য ও কষ্ট ভোগ করিল। তাহাদের ধরিবার পরই দুজনের মাথা কাটিয়া ফেলা হইল এবং আর দুজনকে বর্শার আঘাতে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হইল
ফাদারদিগকে বন্দী করা হইল না বটে, কিন্তু তাঁহারাও কষ্ট ভোগ করিলেন। রাজা সন্দেহ করিলেন যে, কনফেকশনের সময় তাঁহারা বন্দী পোর্তুগীজদিগকে গোপনে উপদেশ দিতেন যে তাহারা যেন রাজাকে তাহাদের খালাস্ কবিরার জন্য অর্থ (ransom) না দেয়। এজন্য গুপ্ত ধন ও অস্ত্র অন্বেষণ করিতে আসিয়া পাদ্রীদের বাড়ি উলটপালট করা হইল। অবশেষে রাজা রাগে বলিলেন যে, পাদ্রীরা সকলে [তখন চাঁদেকানে চারজন ফাদার ছিলেন] তাঁহার রাজ্য ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাউক, এবং ভবিষ্যতে তাহাদের কেহ যেন সেখানে না আসে।
এইরূপে এক মাস কাটিল। অবশেষে বন্দী পোর্তুগীজগণ তিন সহস্র পার্দো (এগার হাজার টাকা) দণ্ড দিয়া খালাস পাইল। ফাদারেরা একেবারে বাংলা ত্যাগ করিয়া[৪] চীন-জাপানে গেলেন, এবং এখানে খৃষ্টধর্ম প্রায় লোপ পাইল।
শ্রীযদুনাথ সরকার
.
পাদটীকা :
১. [স্যর যদুনাথ সরকারের এই প্রবন্ধ প্রথমে ‘প্রবাসী’, ১৩২৮, আষাঢ় সংখ্যায় এবং পুনরায় ‘শনিবারের চিঠি’, ১৩৫৫, আষাঢ় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।—শি মি]
২. La maistresse Chappelle, এটা কি Holy of holies?
৩. এখানে মূলগ্রন্থে আছে a lasor. ইহার অর্থ কি a Jasor (অর্থাৎ যশোহরে) না a loisor (অবসরক্রমে)?
৪. সুতরাং তাঁহারা কার্ভালোর শেষ দশা সম্বন্ধে কোনই সাক্ষ্য দিতে পারেন না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন