২৬. সন্ধি-বিগ্রহ

সতীশচন্দ্র মিত্র

ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ – সন্ধি-বিগ্রহ

প্রতাপাদিত্যের জীবনের উদ্যোগ-আয়োজনের কথাই এতক্ষণ আমরা বলিয়াছি। এইবার আমরা প্রকৃতপক্ষে তাঁহার কর্ম্মময় জীবন ও সর্ব্বতোমুখী প্রতিভার পরিচয় দিব। এখন হইতে প্রায় দশ বৎসর কাল তাহার প্রকৃত যোদ্ধৃ-জীবন— সে জীবন অতি বড় কার্য্য-তৎপরতা এবং ঘটনা- বহুলতায় পরিপূর্ণ। জ্ঞাতি-বিরোধ এবং আত্মকলহই আমাদের দেশের প্রকৃত ব্যাধি। প্রতাপ যদি এই ব্যাধির প্রকোপে প্রপীড়িত না হইতেন, তাহা হইলে বঙ্গের ইতিহাস হয়ত নতুন করিয়া লিখিত হইত। বাল্য হইতে বসন্ত রায় যে তাঁহার পিতা অপেক্ষাও তাঁহার প্রতি অধিকতর স্নেহশীল ছিলেন, তাহা সত্য; তিনিও যে সেই অযাচিত অপরিমিত স্নেহের মূল্য কিছুই বুঝিতেন না, তাহা নহে। অনেক ক্ষেত্রে তিনি বসন্ত রায়ের আদেশ ও উপদেশ গুরু-বাক্যের মত পালন করিতেন। কিন্তু গোবিন্দ রায় প্রভৃতি বসন্তের পুত্রগণ সর্ব্বনাশের হেতু হইয়াছিলেন; আর তাঁহাদের কয়েকজন আত্মীয় ও অমাত্য উভয় পক্ষের বিরোধ ঘটাইবার জন্য সর্ব্ববিধ নীচতা ও কূটমন্ত্রের অবতারণা করিতে কুণ্ঠা বোধ করিতেন না। উহাদের মধ্যে রূপরাম বা রামরূপ বসু সকলের অগ্রণী; সাধারণতঃ সকলে তাহাকে রূপবসু বলিয়া জানিত। তিনি বসন্ত রায়ের ভ্রাতা বাসুদেব রায়ের জামাতা;[১] কিন্তু সকলে ইহাকে বসন্ত রায়ের নিজের জামাতা বলিয়াই মনে করিত। ইনি পৃথ্বিধর বসুবংশীয় প্রসিদ্ধ কুলীন যদুনন্দনের পুত্র। যদুনন্দন মালখানগর হইতে আসিয়া আঁধারমাণিকের সন্নিকটবর্ত্তী মালঙ্গ পাড়ায় বাস করেন। তথা হইতে তৎপুত্র রূপরাম বসু ঠাকুর ‘যশোরের রাজবংশের আশ্রয়ে লক্ষণকাটি গ্রাম বৃত্তি পাইয়া যশোহরবাসী হইয়াছিলেন।’ ধুমঘাট দুর্গের দক্ষিণ পার্শ্বে রূপরামের দীঘি এখনও আছে। রূপবসু তীক্ষ্ণবুদ্ধি, শক্তিধর পুরুষ ছিলেন। তবে তিনি গোবিন্দ প্রভৃতিকে সৰ্ব্বদা কুপরামর্শ দিয়া উদ্রিক্ত করিতেন এবং প্রতাপের প্রত্যেক কার্য্যের দোষ ধরিয়া তাঁহার কু-অভিসন্ধি বুঝাইতেন। গোবিন্দ একে কিছু স্থূলবুদ্ধি হঠকারী লোক, তাহাতে আবার রূপবসুর কুমন্ত্রণা। উহার পরিণাম বিষময় হইয়াছিল এবং জ্ঞাতি-বিদ্বেষ একেবারে শেষসীমায় দাঁড়াইয়াছিল। ইহারই ফলে উভয় পক্ষের ভুল ধারণার জন্য প্রতাপ কর্তৃক সপুত্রক বসন্ত রায়ের হত্যার মত একটা গুরুতর কাণ্ড হইয়া গেল। খুল্লতাতের হত্যার পর প্রতাপাদিত্য তাঁহার পরিবারবর্গের প্রতি আর কোনও অত্যাচার করেন নাই। কিন্তু রূপবসু সেখানেই যবনিকার পতন হইতে না দিয়া, দেশের সর্ব্বনাশ করিয়া দিয়াছিলেন। অনুতপ্ত প্রতাপ হয়ত জ্ঞাতি ভ্রাতাদিগের উপর অত্যধিক অনুগ্রহই দেখাইতেন, কিন্তু রূপবসু তাহা করিতে দিলেন না। তাঁহার চক্রান্ত যে কেবল প্রতাপ-চরিত্রকে লোক-সমাজে কলঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছে, তাহা নহে; উহা দ্বারা প্রতাপের সকল আয়োজন ব্যর্থ করিয়া দেশের স্বাধীনতার সম্ভাবনা সমূলে বিনাশ করিয়া দিয়াছিল।

রূপবসু কচু রায়কে লইয়া রায়গড় দুর্গ হইতে পলায়ন করতঃ উড়িষ্যায় ঈশা খাঁর দরবারে উপস্থিত হইলেন এবং বসন্ত রায়ের পুত্রগণের জীবন ও রাজ্য রক্ষা করাইবার জন্য পাঠানদিগকে প্ররোচিত করিয়া তুলিলেন। বসন্ত রায়ের হত্যাকালে তাঁহার পুত্রগণের মধ্যে চাঁদ রায় অন্য কেহ কেহ সম্ভবতঃ মাতুলালয়ে ছিলেন। কচু রায়ের সহিত কে কে রায়গড়ে প্রহরিবেষ্টিত হইয়াছিলেন তাহা জানিবার উপায় নাই। এই প্রসঙ্গে রামরাম বসুর গ্রন্থে একটি গল্প আছে, শাস্ত্রী মহাশয় স্বীয় ভাষার সচ্ছলতায় উহা অযথা সম্বর্দ্ধিত করিয়া দিয়াছেন। গল্পটি এই- প্রতাপাদিত্য বসন্তের পুত্রগণকে বন্দী করিয়া নিজ রাজধানীতে আনেন; রূপবসু সেই সংবাদ ঈশা খাঁর নিকট দিলে, তাঁহার সেনাপতি বলবন্ত পুত্রগণের উদ্ধার সাধনের জন্য ধুমঘাটে আসেন। প্রতাপের সহিত নিভৃতে গুপ্ত মন্ত্রণা করিবার ছলে বলবন্ত নির্জ্জন গৃহে নিরস্ত্র প্রতাপকে হঠাৎ আক্রমণ করেন। বলবন্ত প্রকৃতই বলশালী, তিনি বসন্তের পুত্রগণের জীবন দান করিবার অঙ্গীকারে প্রতাপকে ছাড়িয়া দেন। প্রতাপ সত্য পালন করিয়াছিলেন। এ গল্প আমরা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি না, বলবন্তের উল্লেখও কোথায় পাওয়া যায় না। তবে এই ঘটনায় বলবন্তের বল পরীক্ষা অপেক্ষা মহারাজ প্রতাপাদিত্যের সত্যবাদিতা অধিক পরীক্ষিত হইয়াছিল, ইহাই আনন্দের বিষয়।

যাহা হউক, বসন্ত রায়ের সব পুত্রই যে প্রতাপের হস্তচ্যুত হইয়াছিলেন, তাহা নহে। শুনা যায়, তাঁহার কয়েক পুত্র মাতুলালয়ে ছিলেন এবং চন্দ্র রায় প্রভৃতি প্রতাপের অনুগ্রহ-ভাজন হইয়া উচ্চ রাজকার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন। কেবল মাত্র কচু রায়ই দেখিতে পাই, প্রথমতঃ হিজলীতে ও পরে আগ্রাতে উপনীত হন। বলবন্তের দৌত্যের ফলেই হউক, অথবা রূপবসুর প্ররোচনায় পাঠানেরা শক্তি সংগ্রহ করিতেছেন এই সংবাদ শুনিয়াই হউক, প্রতাপাদিত্য ঈশা খাঁর রাজ্য আক্রমণ করিয়া তাঁহাকে কিছু শিক্ষা দিবার জন্য উদ্যোগী হইলেন। হিজলীর নব প্রতিষ্ঠিত পাঠান-রাজ্য বসন্ত রায়ের রাজ্যাংশের ঠিক অপর পারে। এ সময়ে পাঠানদিগকে পর্যুদস্ত করিতে না পারিলে, তাঁহারা যে সুযোগ বুঝিয়া পশ্চিমভাগ আক্রমণ করিবেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। একটু স্বপদে দাঁড়াইতে গেলেই চারিদিক হইতে কিরূপ শত্রু-বৃদ্ধি হয়, প্রতাপ তাহা বুঝিতে লাগিলেন। শুধু পাঠান শত্রু নহে, এই সময়ে মগ ও পর্তুগীজ প্রভৃতি দস্যুরাও ভাগীরথী, সরস্বতী ও রূপনারায়ণ প্রভৃতি নদী- পথে দেশের মধ্যে প্রবেশ করিয়া অত্যাচার করিতেছিল; তাহাদিগকে দমন করিবার জন্য ভাগীরথীর মোহানায় সমুদ্র-কূলে অর্থাৎ সগরদ্বীপে একটি প্রধান সৈন্যাবাস স্থাপন করা প্রয়োজনীয়, ইহাও বুঝিতে বাকী রহিল না। এই সগরদ্বীপের পরপারে হিজলী রাজ্য; মোগল কর্তৃক উড়িষ্যা বিজয়ের পর, অল্পদিন হইল পাঠানগণ তথায় আসিয়া দলবদ্ধ হইতেছিলেন। সুতরাং এই হিজলী রাজ্য করতলগত করিতে না পারিলে, সগরদ্বীপের আড্ডা কখনও নিরাপদ হইবে না। পাঠানেরা সুযোগ পাইবামাত্র সে আড্ডা কাড়িয়া লইতে চেষ্টা করিবেন। এ জন্য শুধু ঈশা খাঁর উপর প্রতিশোধ লওয়া নহে, মগ বা ফিরিঙ্গি দস্যুর হস্ত হইতে দেশ রক্ষা করিবার নিমিত্তও, সগরদ্বীপে একটি প্রধান নৌ-বাহিনীর কেন্দ্র খুলিতে হইবে।

সেজন্য প্রতাপাদিত্য প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। মহোৎসাহে আয়োজন চলিতে লাগিল। নানাস্থানে সৈন্য-সংগ্রহ করিয়া রায়গড় দুর্গে পাঠান হইতেছিল। অতি অল্পদিন মধ্যে নূতন নূতন রণতরী নির্ম্মিত বা পূৰ্ব্ববঙ্গ হইতে সংগৃহীত হইয়া আসিতেছিল। যথাসম্ভব সত্বরতার সহিত সে সব সুসজ্জিত করিয়া বজ্‌জ্‌ প্রভৃতি স্থানে প্রেরণ করা হইল। রায়গড় হইতে বজবজ পর্য্যন্ত প্রশস্ত রাজবর্ম্ম নিৰ্ম্মিত হইল, তাহা এখনও আছে। এই সময়ে হাতিয়াগড় ও মেদন্মলে সেনা নিবাস হয়।[২] ধুমঘাট হইতে বাহিরের পথে অসংখ্য রণতরী আসিয়া হলদি নদীর অপর পারে সমবেত হইতে লাগিল। ইহার পূর্ব্বে ফিরিঙ্গি দলপতি কাপ্তেন রডা একটি যুদ্ধে বন্দী হইয়া প্রতাপের শরণাপন্ন হইয়াছিলেন। প্রতাপ তাঁহাকে কোন প্রকার শাস্তিপ্রদান না করিয়া নিজের কর্মচারী নিযুক্ত করিলেন। ইহার ফলে, রডা চিরজীবন বিশ্বস্ত ভৃত্যের মত প্রতাপের এক প্রধান সহায় হইয়াছিলেন। নৌ যুদ্ধে রণ-তরীতে কামান সজ্জিত করিয়া কেমন করিয়া যুদ্ধ করিতে হয়, তদ্বিষয়ে রডা প্রতাপসৈন্যের শিক্ষাগুরু হইলেন। আয়োজন স্থির হইলে, হিজলীর যুদ্ধে প্রতাপাদিত্য স্বয়ং আসিলেন, তাঁহার সঙ্গে ফিরিঙ্গি রডা, সূর্য্যকান্ত, সুন্দর প্রভৃতি প্রসিদ্ধ সেনাপতিবর্গ যোগদান করিয়াছিলেন।

প্রতাপাদিত্য তিন দিক হইতে হিজলী রাজ্য আক্রমণ করেন; পূর্ব্বদিকে আদাবাড়িয়ার দিক হইতে, উত্তরে হলদি নদীর মোহানা দিয়া ভিতরে প্রবেশ করিয়া এবং দক্ষিণে উন্মুক্ত সাগরের দিক হইতে হিজলী আক্রমণ করা হইল। শুনা যায়, এই যুদ্ধ ১৮ দিন ধরিয়া চলিয়াছিল। রণতরী হইতে তীরে নামিয়া দুর্দান্ত বাঙ্গালী-সৈন্য দিনের পর দিন ভীষণ অনল-ক্রীড়া করিয়াছিল। অবশেষে প্রতাপের জয় হইল। প্রবাদ এই, যুদ্ধকালে ঈশা খাঁর পায়ে এক গোলার আঘাত লাগে, সেই আঘাতেই তাঁহার মৃত্যু হয়। তাঁহার প্রধান সেনাপতিও মৃত্যুমুখে পতিত হন। তখন প্রতাপ যুদ্ধ জয় করিয়া শত্রু সৈন্য বিতাড়িত করিয়া দেন এবং কথিত আছে, তিনি ছয়মাস কাল সেখানে থাকিয়া রাজ্যরক্ষণ ও রাজস্ব-সংগ্রহের বিশেষ ব্যবস্থা করেন। হিজলী রাজ্যে পূর্ব্ব হইতে অনেকগুলি সামন্ত রাজা ছিলেন; অল্পদিনে পাঠানেরা তাঁহাদিগকে করতলগত করিতে পারেন নাই। কথিত আছে, বাসুদেবপুর ও মাদ্‌না ষ্টেটের প্রথম সনন্দ প্রতাপাদিত্য কর্তৃক প্রদত্ত হয়।

হিজলীর প্রাচীন ইতিহাস এখনও প্রচ্ছন্ন। উহার উদ্ধারের জন্য আমি বহু চেষ্টা করিয়াছি। যাহা পাইয়াছি, তাহা সামান্য এবং তাহার মধ্যে প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে কোন রাজনৈতিক সম্পর্কের স্পষ্ট প্রমাণ নাই। হিজলীতে পাঠান আমলের একটি প্রাচীন মসজিদ আছে। উহারই সন্নিকটে এক প্রাচীন মুসলমান গৃহে একখানি অতি জীর্ণ পারসীক পুঁথি পাওয়া যায়। কাঁথির সুযোগ্য মহকুমা- ম্যাজিষ্ট্রেট রায়সাহেব রামপদ চট্টোপাধ্যায়ের চেষ্টায় উহা কিছুকালের জন্য আমার হস্তগত হয়। উহার অতিরঞ্জিত গল্পপুঞ্জের মধ্যে হইতে সংক্ষিপ্ত সার গ্রহণ করিয়া হিজলীর উৎপত্তির একটি বিরবণী পাইয়াছি। বহুমার পুত্র রহমৎ নামক এক সাহসী সর্দ্দার ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সমুদ্রকূলে হিজল-বৃক্ষ-সমাকীর্ণ এক প্রদেশে হিজলী নামক স্থান প্রতিষ্ঠা করেন। পাতশাহের সেনাপতি খাঁ-খানানের নিকট হইতে তিনি জমিদারী সনন্দ পান এবং বহুদিন পরে পুত্রদাউদ খাঁর হস্তে জমিদারীর ভার দিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হন। দাউদের তাজ খাঁ ও সেকন্দর পালোয়ান নামক দুই পুত্র হয়। তাজ খাঁর অন্য নাম এক্তিয়ার খাঁ, তিনি সিংহাসনের উপর উপবিষ্ট হন এবং সম্মানিত বলিয়া তাঁহার মসনদ-আলি বা মসন্দরী এই সাধারণ খেতাব ছিল। ভীমসিংহ মহাপাত্ৰ প্রভৃতি কয়েকজন কর্ম্মচারীর চক্রান্তে সেকন্দর মৃত্যুমুখে পতিত হন (১৫৫৪ খৃঃ অঃ)। তাজ খাঁ সাধু পুরুষ, তিনি যোদ্ধা ছিলেন না, তাঁহার অনুরক্ত ভ্রাতা সেকন্দরের বলগৌরবেই তাঁহার জমিদারীর বহুল বৃদ্ধি হইয়াছিল। এখন সেই বীর ভ্রাতার মৃত্যুর পর, তিনি যখন শুনিলেন, তাঁহার বিরুদ্ধে সৈন্য প্রেরিত হইতেছে, তখন তিনি নিজে কবরে প্রবেশ করিয়া প্রাণত্যাগ করেন। হিজলীতে যে বিরাট পুরাতন মসজিদ আছে বলিয়াছি, উহার ফটো আমি পাইয়াছি এবং তাহার শিলালিপিরও পাঠোদ্ধার করিয়াছি। শিলালিপি হইতে জানা যায়, দাউদ খাঁর পুত্র এক্তিয়ার খাঁ কর্তৃক এই মসজিদ নির্মিত। সুতরাং ঈশা খাঁ কর্তৃক এই মসজিদ গঠিত হয় বলিয়া আধুনিক সময়ে যে প্রবাদ চলিতেছে, তাহা সত্য নহে। ভীমসিংহ মহাপাত্র তাজ খাঁ বা এক্তিয়ার খাঁর দেওয়ান ছিলেন। দেউল বাড় বা বাহিরিয়ামুটায় উক্ত ভীমসিংহের বংশীয়গণের প্রকাণ্ড অট্টালিকা ও মন্দির আছে। ভীমসিংহের উদ্যোগে তাজ খাঁর পুত্র বাহাদুর খাঁ রাজতক্তে বসেন। সরকারী রিপোর্ট হইতে জানা যায়৩ ভীমসিংহের মৃত্যুর পর কৃষ্ণ পাণ্ডা ও ঈশ্বরী পট্টনায়ক তাজ খাঁর জামাতা জৈলখার সহিত ষড়যন্ত্র করিয়া বাহাদূরকে দূরীভূত করেন। জৈলখাঁ ১৫৭৩ খৃঃ অঃ পৰ্য্যন্ত ও পরে বাহাদুর পুনরায় ১৫৮৩ পর্য্যন্ত শাসন করেন। সেই সময়ে উক্ত কৃষ্ণ পাণ্ডা ও ঈশ্বরী পট্টনায়ক হিজলী রাজ্য প্রধানতঃ জালামুটা ও মাজনামুটা এই দুই সম্পত্তিতে বিভক্ত করিয়া নিজেদের নামে বন্দোবস্ত করিয়া লন। ইহার পর আর হিজলীর বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাস জানা যায় না।

তবে কতলু খাঁর সময়ে যে হিজলী পর্য্যন্ত পাঠান প্রভুত্ব বিস্তৃত হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। ১৫৯২ খৃঃ অব্দের পর যখন পাঠানগণ মানসিংহের সহিত সন্ধিসূত্রে সুবর্ণরেখা পার হইতে বাধ্য হন, তখনই তাঁহারা হিজলী অঞ্চল স্বাধিকৃত করিয়া বাস করেন।[৪] হিজলী একটি ক্ষুদ্র পরগণা, পাঠান রাজত্ব তদপেক্ষা অনেক বিস্তৃত। বৃদ্ধ ঈশা খাঁ জীবনের অবশিষ্ট দুই এক বর্ষ কাল এই স্থানে বাস করেন, কিন্তু তখন হইতে তৎপুত্র ওসমান প্রভৃতি পূর্ব্ববঙ্গের শেষ সীমা পর্যন্ত নানা প্রদেশে ঘোর বিগ্রহ-বহ্নি প্রজ্বলিত করেন। ঈশা খাঁকে হিজলীর ঈশা খাঁ বলা সঙ্গত নহে, তিনি প্রকৃতপক্ষে উড়িষ্যার অধিপতি কতলু খাঁ লোহানীর ভ্রাতা এবং তাঁহার প্রকৃত নাম খাজা ঈশা খাঁ লোহানী। হিজলীর মসনদ আলী বংশীয় বলিলে তাজ খাঁর বংশীয়দিগকেই বুঝায় উড়িষ্যার ঈশা খাঁ যে উক্ত তাজ খাঁর সহিত কোন প্রকারে সম্বন্ধযুক্ত নহেন, তাহা পূৰ্ব্বে দেখাইয়াছি। ঈশা খাঁ লোহানীর অবস্থানকালে হিজলী অঞ্চলে কোথায় তাঁহার রাজপাট ছিল, তাহা জানা যায় না। সম্ভবতঃ প্রতাপাদিত্যের বিজয় লাভের পর হিজলীতে একটি বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়; মগ ফিরিঙ্গির বিরুদ্ধাচরণ করিবার জন্য সেখানে প্রতাপাদিত্যের নৌ-বাহিনী থাকিত এইজন্য বন্দরটি প্রস্তর প্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত হইয়াছিল, উহার কোন কোন চিহ্ন এখনও আছে।

এই সময়ে প্রতাপ হিজলীতে রণতরী রাখিবার ব্যবস্থা করিলেন এবং সগর দ্বীপে নৌ সেনার একটি প্রধান কেন্দ্র স্থাপিত হইল। তথায় জাহাজ নির্ম্মাণ ও মেরামতের ব্যবস্থা হইল; ফিরিঙ্গি কর্মচারীরা উহার ভার লইল। ক্রমে সগরদ্বীপ দ্বিতীয় রাজধানীর মত সমৃদ্ধ হইয়া দাঁড়াইল। উত্তর দিকে বহুদূর পর্য্যন্ত লোকের বসতি হইয়া গেল; মোহানার কাছে পৌষ-সংক্রান্তিতে যে মেলা বসিত, তাহাতে বহুদূর হইতে হাজার হাজার লোক আসিয়া সমবেত হইত এবং সে তীর্থক্ষেত্রের খ্যাতির সর্ব্বত্র বিস্তৃত হইয়া পড়িল। প্রতাপের শাসনকৌশলে দস্যুদিগের সর্ব্ববিধ অত্যাচার হইতে ঐ স্থান রক্ষা পাইল। সগরদ্বীপ হইতে আরম্ভ করিয়া ধুমঘাট পর্যন্ত সর্ব্বত্র রণতরী দ্বারা পাহারা বসিয়া গেল। তখন হইতে ঐ দীর্ঘ জল-পথের নাম হইয়াছিল— ‘ফিরিঙ্গি ফাঁড়ি’, কারণ ঐ ফাঁড়ি ফিরিঙ্গি জাতীয় প্রধান কর্মচারী দ্বারা সুরক্ষিত হইয়াছিল। সে কথা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি; একটি পৃথক পরিচ্ছেদে এই ফিরিঙ্গি ফাঁড়ির শাসন শৃঙ্খলা ও উপকারিতার পরিচয় দিয়াছি। এখানে তাহার পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। নানা ক্ষুদ্র বৃহৎ নদীপথে ঢুকিয়া বম্বেটে, ফিরিঙ্গি ও মগ প্রভৃতি দস্যুরা যখন তখন ফাঁড়ি অতিক্রম করিতে চেষ্টা করিত, তাহার ফলে কত স্থানে কত খণ্ডযুদ্ধ বাধিত, তাহা নির্ণয় করিবার কোন পন্থা নাই। মালঞ্চ হইতে যমুনা পর্যন্ত বিস্তৃত এক দোয়ানিয়া খাল দিয়া দস্যুদল একবার ধুমঘাটের দিকে অনেকদূর অগ্রসর হইয়াছিল, শেষে পরাজিত হইয়া পলায়ন করিতে বাধ্য হইল। ঐ দোয়ানিয়া তদবধি ফিরিঙ্গির দোয়ানিয়া নামে চিহ্নিত হইয়া রহিল। আমরা পূর্ব্ববর্ত্তী একটি পরিচ্ছেদে এই সকল দস্যুদের পাশবিক অত্যাচার কাহিনী বর্ণনা করিয়াছি। তাহাদের ভয়ে দেশের লোক কম্পিত হইত। প্রতাপাদিত্য সুকৌশলে সগরদ্বীপ হইতে শিবসার মোহানা পর্য্যন্ত নানা স্থানে দুর্গ সংস্থাপন করিয়া, অসংখ্য রণতরী দ্বারা এই অত্যাচার হইতে নিজের রাজ্য রক্ষা করিয়াছিলেন। তিনি নিজ রাজ্য রক্ষার জন্য উত্তর দিকে যাওয়ার পথ বন্ধ করিয়া অন্য রাজ্য-রক্ষারও হেতু হইয়াছিলেন। প্রতাপের বলবীর্য্যে দেশের যদি অন্য কোন উপকার না হইয়া থাকে, তবু এই দস্যুদের দমন করিয়া তিনি দেশবাসীর আশীর্ব্বাদ সঞ্চয় করিয়াছিলেন। যশোর রাজ্যের পূর্ব্বসীমা পার হইয়া বরিশাল অঞ্চলে, এবং এমন কি, যশোহর জেলার উত্তরাংশেও অনেক স্থানে সমাজের গাত্রে দস্যুদিগের অত্যাচারের কলঙ্করেখা এখনও আছে, কিন্তু তাঁহার নিজ রাজ্যে সুন্দরবনের উত্তরাংশে কোথায়ও তেমন কোন পরিবাদ নাই। ইহা একটি লক্ষ্য করিবার বিষয়।

বাস্তবিকই বরিশাল প্রদেশে এই সময় এই সকল দুস্যর উৎপাত কিছু বেশী হইয়াছিল। এই সময়ে বসুবংশীয় কন্দর্পনারায়ণ রায় চন্দ্রদ্বীপ বা বাকলার রাজা; তিনি প্রসিদ্ধ বারভুঞার অন্যতম এবং মহাপরাক্রান্ত নৃপতি। ঘটকেরা তাঁহাকে ‘মহাধনুর্ধরো মানী মহারথ মহাশূর :’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। বর্ত্তমান বরিশালের নিকটবর্ত্তী কচুয়ায় তাঁহার রাজধানী ছিল; ঐ স্থান প্রবল নদীর কূলবর্তী বলিয়া অবিরত মগ ও ফিরিঙ্গিরা রাজধানীর উপর আক্রমণ করিত; এজন্য কন্দর্পনারায়ণ তথা হইতে রাজধানী স্থানান্তরিত করিয়া, নানা পরিবর্তনের পর লোকালয় মধ্যবর্ত্তী মাধবপাশায় স্থাপন করেন এবং বহুসংখ্যক যুদ্ধতরী ও কামান প্রস্তুত করিয়া নদীমুখে সর্ব্বদা যুদ্ধার্থ প্রস্তুত থাকিতেন। সকলের সমবেত চেষ্টা ব্যতীত দেশের শান্তি রক্ষার উপায়ান্তর নাই, ভুঞা রাজগণ এক্ষণে তাহা বুঝিলেন। এজন্য সাধারণ স্বার্থের খাতিরে পরস্পরের মত-পার্থক্য বা দ্বেষ-হিংসা বিলুপ্ত রাখিয়া, পত্র-বিনিময় দ্বারা সন্ধি-সম্বন্ধ স্থাপনের জন্য উদ্যোগী হইলেন। ‘কন্দর্প ও প্রতাপ উভয়েই বীর ও সমধর্মী; ত্বরায় উভয়ের মধ্যে সৌহার্দ স্থাপিত হইল।’[৬] উভয়ই বঙ্গজ কায়স্থ এবং উভয় বংশের মধ্যে পূর্ব্ব হইতে রক্ত-সম্বন্ধও ছিল। যশোহর-সমাজ প্রতিষ্ঠার পূর্ব্বে বালা সমাজই বঙ্গজ কায়স্থকুলের সর্ব্বপ্রধান সমাজ ছিল এবং তাহার সমাজপতি ছিলেন কন্দৰ্প ও তাঁহার পিতা। অচিরে উভয় বীরের মধ্যে কথাবার্তা স্থির হইয়া গেল। শত্রুনাশের জন্য পরস্পর সাহায্য করিবেন, স্থির হইল। উভয়ের বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী করিবার জন্য কন্দর্পের পুত্রের সহিত প্রতাপাদিত্যের কন্যার বিবাহ স্থিরীকৃত হইয়া রহিল, শুধু পুত্র কন্যা উভয়ে শিশু বলিয়া বিবাহ কয়েক বৎসর স্থগিত রাখার পরামর্শ হইল।

এমন সময়ে পূৰ্ব্ববঙ্গ হইতে প্রত্যাগত পাঠান দল বালা আক্রমণ করিয়া বসিল। কন্দর্পনারায়ণ নামে মাত্র মোগলের সামন্তরাজ ছিলেন, ইহাও তাঁহাদের আক্রোশের বিষয় হইল। ঘটককারিকায় এই প্রসঙ্গে জনৈক গাজীর সহিত যুদ্ধের কথা আছে : মাধবপাশা রাজধানীর কাছে ‘গাজীর দীঘি’ নামে একটি জলাশয় এখনও দেখিতে পাওয়া যায়। শত্রুনাশকারী পাঠান সর্দ্দারেরা ‘গাজী’ উপাধি লইতেন। এখানে কোন পাঠান সর্দ্দার আসিয়াছিলেন, তাহা জানা যায় না। যিনি বা যাঁহারাই আসুন, হোসেনপুর নামক স্থানে তাঁহাদের সহিত কন্দর্পনারায়ণের এক ভীষণ যুদ্ধ হইল। এ সময় প্রদাপাদিত্য সৈন্য দিয়া কন্দৰ্পকে সাহায্য করিয়ছিলেন। যুদ্ধে পাঠানেরা সম্পূর্ণ পরাজিত হইয়া দেশত্যাগ করিলেন (১৫৯৬)।

শুধু পাঠান নহে, এই সময়ে আরাকাণী মগেরা রাজ্যজয় করিতে করিতে অসংখ্য যুদ্ধ-জাহাজ লইয়া বালা রাজ্যে উপনীত হইল। প্রতাপও সংবাদ প্রাপ্তিমাত্র সৈন্যদল সাজাইয়া যুদ্ধার্থ অগ্রসর হইলেন। কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধের পর মগগণ রণে ভঙ্গ দিয়া প্রতাপ ও কন্দর্পের সহিত সন্ধি করিল। কারণ, এই সময়ে মগদিগের সহিত ফিরিঙ্গি দলের বিষম বিবাদ চলিয়াছিল। প্রতাপও এ সুযোগ পরিত্যাগ করিলেন না। মগ ও ফিরিঙ্গি উভয় শত্রু দলবদ্ধ থাকিলে তাহাদের সহিত আঁটিয়া উঠা দুস্কর। ভেদ-নীতি ব্যতীত এ ক্ষেত্রে সফলতার প্রতাশ্যা নাই; এইজন্য মগরাজের সহিত সন্ধি সূত্রে বন্ধুত্ব করিয়া ফিরিঙ্গি দস্যুদিগকে দমন করাই ভুঞা রাজদ্বয়ের উদ্দেশ্য হইল। তখন পর্তুগীজ ফিরিঙ্গিগণের বিরুদ্ধে উভয় পক্ষে পরস্পর সাহায্য করিবেন, এইরূপ পরামর্শ স্থির হইয়া গেল। মগরাজ সন্ধির পর স্বদেশে প্রত্যাবর্ত্তন করিলে, প্রতাপও রাজধানীতে ফিরিলেন। এই সময়ে তিনি বাসুকিগোত্রীয় সেন নরপতিগণের হস্ত হইতে কয়েকটি পরগণা অধিকার করিয়া লন, সে কথা আমরা পরে বলিতেছি। এই সময়ে চাকশিরিতে সত্বরতার সহিত দুর্গ নির্ম্মিত হইতেছিল। রাজ্য রক্ষাকল্পে সে দুর্গ তাঁহার হস্তগত থাকা যে কত প্রয়োজনীয়, প্রতাপাদিত্য তাহা বিশেষরূপে বুঝিলেন, তাঁহার খুল্লতাত পুত্রগণের প্ররোচনায় এই স্থান তাঁহাকে না দিবার কল্পনা করিয়া প্রতাপাদিত্যের ভবিষ্যৎ কি ভাবে ব্যর্থ করিয়া দিবার আয়োজন করিয়াছিলেন, তাহাও বুঝিয়া লইলেন। যিনি বঙ্গের স্বাধীনতালাভের পথে অন্তরায়, যিনিই হউন না কেন, তিনি যে প্রতাপের পরমশত্রু, তাহা বুঝিয়া তিনি আশ্বস্ত হইলেন।

এই সময়ে (১৫৯৬) হঠাৎ কন্দর্পনারায়ণের মৃত্যু ঘটিল। তাঁহার পুত্র রামচন্দ্র তখন মাত্র ৬ বৎসর বয়স্ক। রাণী পুত্রের অভিভাবিকাস্বরূপ বালা শাসন করিতে লাগিলেন। তবে গুরুতর বিষয়ে তিনি প্রতাপাদিত্যের পরামর্শ লইতেন। রামচন্দ্রের বিবাহ হয় নাই বটে, কিন্তু তখন হইতে উভয় পক্ষের আত্মীয়তা ও সৌজন্যের বিনিময় হইতেছিল। বালা রাজ্য স্বাধিকারভুক্ত করিবার কল্পনা প্রতাপাদিত্যের ছিল, এমন কলঙ্কও তাঁহার নামে আছে। তাহা হইলে এ সময়ে স্ববলে বালা জয় করা বোধ হয় তাঁহার পক্ষে কঠিন হইত না; কন্যার বিবাহের পর জামাতাকে চোরের মত হত্যা করিয়া রাজ্যাধিকারের পিপাসা প্রতাপের মত বীরের থাকিতে পারে না। আর রামচন্দ্রকে হত্যা করিলেই যে বালা করতলস্থ হইবে, ইহারই বা নিশ্চয়তা কি? পার্শ্ববৰ্ত্তী বিক্রমপুরের কেদার রায় তখন প্রবল পরাক্রান্ত ভুঞা; তাঁহাকে প্রতাপাদিত্যের ঠিক সমকক্ষ না ধরিলেও কোনক্রমে তদপেক্ষা হীনবল বা নিম্নপদস্থ বলা যায় না। রামচন্দ্রের মাতা কেদার রায়ের শরণাপন্ন হইলে, বাকলার সৈন্য কেদারের বাহিনীতে যোগ দিলে, প্রতাপের পক্ষে কলঙ্কের ডালি মাথায় করিয়া, সে রাজ্য অধিকার করা যে সহজ নহে বরং বড়ই কঠিন, তাহা অন্য কেহ না বুঝিলেও যশোরেশ্বর বুঝিতেন।

কন্দর্প রায়ের মৃত্যুর পর, বালার তত্ত্বাবধান প্রসঙ্গে শ্রীপুরের প্রসিদ্ধ ভুঞা মহাবীর কেদার রায়ের সহিত প্রতাপাদিত্যের সন্ধিবন্ধন হইয়াছিল। এই সময়ে আরাকাণী মগদিগের সহিত ফিরিঙ্গিদলের বিবাদ চলিতেছিল; সে বিবাদের কথা আমরা পরে বলিতেছি। বালাতে যখন প্রতাপ ও কন্দর্পের সহিত মগরাজের সন্ধি হয়, তখন কেদার রায় প্রবল পরাক্রান্ত। তাঁহার অধীন অনেক ফিরিঙ্গি গোলন্দাজ ও সেনাপতি ছিল। ডোমিঙ্গ কার্ভালো উহার অন্যতম।[৭] উহার উৎপাতে মগেরা অনেক স্থলে বিড়ম্বিত হইত। এজন্য কেদার রায়ের সহিত সন্ধি স্থাপন করা মগরাজের ও প্রয়োজনীয় ছিল। অপর পক্ষে, মগেরা তখন খুব শক্তিশালী, সন্ধি হইলে তাহারা আর বঙ্গদেশ আক্রমণ করিবে না এবং বালা, শ্রীপুর ও যশোহর এই তিন রাজ্যের প্রধান হিন্দু ভুঞা একত্র সম্মিলিত হইয়া আরাকাণের পক্ষভুক্ত থাকিলে, দুর্দ্ধর্ষ ফিরিঙ্গি দস্যুরাও দেশমধ্যে কোন উৎপাত করিতে সাহসী হইবে না। এই প্রকার ভেদনীতির সাহায্যে যে উভয় দলকে দমিত রাখিয়া স্ব স্ব রাজ্যে শান্তি স্থাপন করা যাইতে পারে, প্রতাপ সবিস্তর ভাবে তাহা কেদার রায়কে বুঝাইয়া দিয়া, তাঁহার সহিত সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হইলেন। কেদার রায়ের মৃত্যু পর্যন্ত এই সন্ধি অক্ষুণ্ণ ছিল বলিয়া বোধ হয়।

শাস্ত্রী মহাশয় বলেন, অত্যল্প কাল পরে এই সন্ধি ভঙ্গ হইয়াছিল, তখন প্রতাপাদিত্য বিপুল বাহিনী সাজাইয়া লইয়া স্বয়ং কেদার রায়ের রাজ্য আক্রমণ করেন এবং কেদার পরাজিত হইয়া প্রতাপের ‘চরণতলে অস্ত্র সমর্পণ করেন।[৮] এ কথার কোন প্রমাণ পাই নাই। প্রতাপ ও কেদার উভয়ই তখন বঙ্গের প্রধান বীর, তাঁহাদের মধ্যে কোন প্রবল যুদ্ধ হইয়া থাকিলে প্রবাদে, গল্পে বা অন্ততঃ ঘটকের পুঁথিতে তাহার খবর থাকিত। সেরূপ কিছু নাই। ঘটকেরা লিখিয়াছেন বটে :

‘জিত্বা বঙ্গাধিপান্ বীরান রাঢ়াধিপান মহাবলান্।
আসমুদ্র-করগ্রাহী বভুব নৃপ-শার্দুলঃ।।’

প্রতাপের যশোর-রাজ্য সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, সুতরাং তাঁহার পক্ষে ‘আসমুদ্রকরগ্রাহী’ হওয়া বিশেষ কথা ছিল না; তিনি বাস্তবিকই দক্ষিণ দেশীয় দস্যু-দুৰ্ব্বত্ত দমন করিয়া সমুদ্র বক্ষে বা নদীপথে বৈদেশিক ব্যবসায়ীর নিকট হইতে শুল্ক আদায় করিতেন। তিনি অনেক ক্ষুদ্রবৃহৎ ভূপতিগণকে নির্জিত করিয়াছিলেন, তাহাও সত্য কথা। কিন্তু তন্মধ্যে কেদার রায় ছিলেন না; থাকিলে সে কথা গল্পগুজবে বা গ্রাম্য কবিতায়ও আত্মরক্ষা করিত। সুতরাং শাস্ত্রী মহোদয়ের এই যুদ্ধাভিযান সম্বন্ধীয় কাল্পনিক বর্ণনা সমর্থন করিতে পারিলাম না। ‘বাঙ্গালা বেহার সমস্তই প্রতাপাদিত্যের অধিকার’— রামরাম বসু মহাশয়ের এই অতিশয়োক্তির কোন ঐতিহাসিক প্ৰমাণ নাই।

পাদটীকা :

১ . কৃষ্ণদাস বা বিদ্যাধর ব্যতীত বসন্ত রায়ের আরও দুই ভ্রাতার কথা দেহেরগাঁতির ঘটককারিকায় উল্লিখিত আছে। ঐ দুইজনের নাম যদুনাথ ও বাসুদেব রায়। পূর্বে কাড়াপাড়ার কারিকা হইতে যে অংশ উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহাতে এ অংশ অস্পষ্ট বলিয়া বাদ দিয়াছি। তবে বিশেষ মনোযোগ করিলে সেখানেও বাসুদেব রায়ের নাম পড়া যায়। পৃথ্বীধর বসু হইতে রূপরাম পর্য্যন্ত ধারা এইরূপ : ১১ পৃথ্বীধর-১২ দেবীবর—১৩ গঙ্গাধর—১৪ যদুনন্দন—১৫ গোপীনাথ ও রূপরাম; রূপরামের বংশধরেরা এখনও টাকীর নিকটবর্ত্তী সৈয়দপুর প্রভৃতি স্থানে বাস করিতেছেন। ‘বঙ্গীয় সমাজ’, ১৯৯-২০০ পৃ।

২. রামগোপাল রায় লিখিয়া গিয়াছেন :

‘হাতিয়া গড়েতে রাজ হস্তীর মকাম
সেই হৈতে হইল হাতিয়াগড় নাম।
জগদ্দলে মেদন্মলে আদি পাট মহলে
আছিল সৈন্যের ঠাট সিন্ধু সম বলে।।’

মেদন্মল বর্ত্তমান ২৪-পরগণার অন্তর্গত বারুইপুর প্রভৃতি স্থান লইয়া গঠিত প্রাচীন পরগণা।

৩. মেদিনীপুর কালেক্টরী হইতে আমি জ্বালামুটা ও মাজনামুটার Settlement Report এর নকল আনিয়াছিলাম। তাহাতে সেকন্দর পালোয়ান ও তাজ খাঁর বিবরণ আছে।- বর্ত্তমান খণ্ড, ১ম অংশ, ৩য় পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য। মজিদের শিলালিপি হইতে জানা গিয়াছে যে, উহা তাজ খাঁ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং খাজা ঈশা খাঁ লোহানি যে ঐ মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা নহেন, তাহা নিঃসন্দেহে। প্রতাপাদিত্য ঐ মসজিদের সংস্কার করিয়াছিলেন বলিয়া প্রবাদ আছে; কারণ হিজলী বন্দরের নৌসেনাগণের উহা ধর্ম্ম উপাসনার স্থান হইয়াছিল।— নিখিলনাথ, ‘প্রতাপাদিত্য’, ১২৬ পৃ।

৪. তখনও কৃষ্ণ পাণ্ডে ও ঈশ্বরী পট্টনায়ক পাঠানের সামন্তরাজ রূপে থাকিতে পারেন। হয়ত ইঁহারা প্রতাপাদিত্যের আক্রমণ কালে পাঠানের বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছিলেন, এজন্য প্রতাপ পুরস্কৃত করিবার জন্য তাঁহাদেরই সঙ্গে রাজ্যের বন্দোবস্ত করিতে পারেন। শাস্ত্রী মহাশয় যে দুইজন প্রধান হিন্দু রাজকর্মচারীর উপর রাজভার ন্যস্ত করার কথা বলিয়াছেন, তাঁহারা এই দুইজন।— শাস্ত্রী, ৮৯ পৃ।

৫. কাঁথির সৰ্ব্বজনপ্রিয় জমিদার সুরেন্দ্রনাথ শামসল মহাশয় বলেন, হিজলী বন্দরে পাথরের গাঁথুনি ছিল। এখনও উহার অনেক পাথর আছে। ঐ পাথরের একখানি তিনি নিজে তাঁহার এক আবাদে আনিয়াছিলেন। উহা এক্ষণে বুড়াঠাকুর বলিয়া স্থানীয় লোক দ্বারা পূজিত হইতেছে। হিন্দুর মত পাথর পূজক জাতি আর নাই।

৬. রোহিণীকুমার সেন, ‘বাকলা’, ১৭০ পৃ।

৭. Du Jarric mentions that Carvalho was born in Montargil (Portugal) and was previously in the service of kedar Rai.- Campos. Portuguese in Bengal. p. 68.

৮. ‘প্রতাপাদিত্যের জীবনচরিত’, ৯১ পৃ।

সকল অধ্যায়

১. ১. উপক্রমণিকা
২. ২. পাঠান রাজত্বের শেষ
৩. ৩. বঙ্গে বারভুঞা
৪. ৪. প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের উপাদান
৫. ৫. পিতৃ-পরিচয়
৬. ৬. পাঠান রাজত্বের পরিণাম ও যশোর-রাজ্যের অভ্যুদয়
৭. ৭. যশোর-রাজ্য
৮. ৮. বসন্ত রায়
৯. ৯. যশোহর-সমাজ
১০. ১০. গোবিন্দদাস
১১. ১১. বংশ-কথা
১২. ১২. প্রতাপাদিত্যের বাল্যজীবন
১৩. ১৩. আগ্রার রাজনীতি ক্ষেত্ৰ
১৪. ১৪. প্রতাপের রাজ্যলাভ
১৫. ১৫. যশোরেশ্বরী
১৬. ১৬. প্রতাপাদিত্যের রাজধানী
১৭. ১৭. প্রতাপের আয়োজন
১৮. ১৮. মগ ও ফিরিঙ্গি
১৯. ১৯. প্রতাপের দুর্গ-সংস্থান
২০. ২০. নৌ-বাহিনীর ব্যবস্থা
২১. ২১. লোক-নির্বাচন
২২. ২২. সৈন্যগঠন
২৩. ২৩. প্রতাপের রাজত্ব
২৪. ২৪. উড়িষ্যাভিযান ও বিগ্ৰহ-প্ৰতিষ্ঠা
২৫. ২৫. বসন্ত রায়ের হত্যা
২৬. ২৬. সন্ধি-বিগ্রহ
২৭. ২৭. খৃষ্টান পাদরীগণ
২৮. ২৮. কার্ভালো ও পাদ্রীগণের পরিণাম
২৯. ২৯. রামচন্দ্রের বিবাহ
৩০. ৩০. প্রথম মোগল-সংঘর্ষ : মানসিংহ
৩১. ৩১. মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ ও সন্ধি
৩২. ৩২. দ্বিতীয় মোগল-সংঘর্ষ : ইসলাম খাঁ
৩৩. ৩৩. শেষ যুদ্ধ ও পতন
৩৪. ৩৪. প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৩৫. ৩৫. যশোহর-রাজবংশ
৩৬. ৩৬. যশোহরের ফৌজদারগণ
৩৭. ৩৭. নলডাঙ্গা রাজবংশ
৩৮. ৩৮. চাঁচড়া রাজবংশ
৩৯. ৩৯. সৈয়দপুর জমিদারী
৪০. ৪০. রাজা সীতারাম রায়
৪১. ৪১. সীতারাম : বাল্যজীবন ও জমিদারী
৪২. ৪২. সীতারাম : রাজ্য ও রাজধানী
৪৩. ৪৩. সীতারাম : রাজত্ব ও ধৰ্ম্মপ্রাণতা
৪৪. ৪৪. সীতারাম : মোগল সংঘর্ষ ও পতন
৪৫. ৪৫. সীতারাম : বংশ, রাজ্য ও কীর্ত্তির পরিণাম
৪৬. ৪৬. সীতারাম সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৪৭. ৪৭. প্রাক্-ইংরাজ আমলে রাজন্য-বংশ
৪৮. ১. বৃটিশ-শাসন ও হেঙ্কেলের কীৰ্ত্তি
৪৯. ২. যশোহর-খুলনা : গঠন ও বিস্তৃতি
৫০. ৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
৫১. ৪. ভূসম্পত্তির স্বত্ব-বিভাগ
৫২. ৫. নড়াইল জমিদার-বংশ
৫৩. ৬. নব্য জমিদারগণ
৫৪. ৭. বাণিজ্য-তুলা, চিনি ও নীল
৫৫. ৮. নীলের চাষ ও নীল-বিদ্রোহ
৫৬. ৯. রেণী ও মরেল-কাহিনী
৫৭. ১০. সমাজ ও আভিজাত্য
৫৮. ১১. শিল্প ও স্থাপত্য
৫৯. ১২. সাহিত্য
৬০. এক – প্রতাপাদিত্যের পতন
৬১. দুই – প্রতাপাদিত্যের সভায় খ্রীষ্টান পাদরী
৬২. তিন – প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে কিছু নূতন সংবাদ
৬৩. সতীশচন্দ্র মিত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন