সতীশচন্দ্র মিত্র
চিনির পর নীলই যশোহরের প্রধান বাণিজ্য দ্রব্য ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীকেই যশোহরের নীলের যুগ ধরা যায়, তন্মধ্যে ১৮১০ হইতে ১৮৬০ পর্য্যন্ত উহার ক্রমোন্নতির কাল। ১৮৫৮ অব্দে যে বিদ্রোহ উপস্থিত হয়, তাহাতে উহার সর্বনাশের সূত্রপাত হয়, এবং শতাব্দী শেষ হইবার পূর্ব্বেই নীলের চাষ একেবারে বন্ধ হয়। নীলের নূতন রকম বাণিজ্য-প্রণালী বিলাতী লোকে এদেশে আনেন বটে, কিন্তু নীল জিনিসটি এদেশে নূতন নহে। অতি প্রাচীনকাল হইতে নীলরঙ্গের কথা ভারতবাসীদের জানা ছিল এবং তাঁহারা উহা প্রস্তুত করিতে জানিতেন। ধ্যানস্থ আৰ্য্যঋষিগণ আকাশের রঙ হইতে পালনকর্তা বিষ্ণুর বর্ণ-নির্ণয় করিয়াছিলেন এবং পটে বা প্রতীকে সেই নীলবর্ণ প্রতিফলিত করিতেন। প্লীনি প্রভৃতি প্রাচীন রোমক পণ্ডিতগণ ইণ্ডিকাম্ (Indicum) বলিয়া উহার বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। ইংরাজী ইণ্ডিগো (Indigo) কথা, বা যে গাছ হইতে নীল হয়, সেই গাছের বৈজ্ঞানিক (Indigofera Tinctoria) নামের সঙ্গে ইন্দ বা হিন্দুস্থানের সম্বন্ধ চিরগ্রথিত রহিয়াছে।
আবুল-ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’তে দেখিতে পাই, গুজরাটের অন্তর্গত আহমদাবাদে এবং আগ্রার নিকটবর্ত্তী বায়নাতে উৎকৃষ্ট নীলরঙ্গ প্রস্তুত হইয়া কনষ্টাণ্টিনোপলে যাইত; কিন্তু তখন সেই উৎকৃষ্ট দ্রব্যের মণকরা মূল্য ১০/১২ টাকার অধিক ছিল না।[১] ১৬৩১ খৃষ্টাব্দে ইংরাজ বণিকেরা আগ্রায় যথেষ্ট নীল সংগ্রহ করেন; কিন্তু সে সময়ে পারস্যে ও ইংলণ্ডে উহার বিক্রয় কমিয়া যাওয়ায় ইংরাজদিগের যথেষ্ট লোকসান সহ্য করিতে হয়।[২] বার্ণিয়ারের ভ্রমণকাহিনী হইতে জানি, বায়না প্রভৃতি স্থানে নীল সংগ্রহ করিবার জন্য ওলন্দাজ (Dutch) বণিকেরা তথায় বাসা করিয়া থাকিতেন।[৩] ভারতবর্ষে তখন কি প্রণালীতে নীল প্রস্তুত হইত, তাহা জানিতে পারা যায় নাই, এবং বৈদেশিক বণিকেরাও উহা শিখিতে পারেন নাই।
ইংরাজ আমলের প্রথম ভাগে আমেরিকা হইতে নীল উৎপাদনের নূতন প্রণালী এদেশে আসে এবং উহার প্রথম প্রবর্ত্তক হইয়াছিলেন একজন ফরাসী বণিক লুই বোনড (Louis Bonnaud)। তিনি ১৭৩৭ অব্দে ফ্রান্সের অন্তর্গত মার্সেল সহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং অল্প বয়সে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে গিয়া দৈবক্রমে নীলের ব্যবসায় শিক্ষা করেন। তিনি ১৭৭৭ অব্দে বঙ্গদেশে আসিয়া চন্দন নগরে অধিষ্ঠান করতঃ নিকটবর্ত্তী তালডাঙ্গা ও গোন্দলপাড়ায় দুইটি নীলকুঠি খুলেন; উহার চিহ্ন এখনও বিদ্যমান আছে। বোনড্ একজন অদ্ভুতকর্ম্মা লোক; তিনি কয়েক বৎসর পরে মালদহে গিয়া আর একটি নীলকুঠি নির্মাণ করেন; সেদেশে চুণের অভাব দেখিয়া তিনি একটি মুসলমান কবরখানা হইতে মনুষ্যাস্থি উঠাইয়া উহাই পোড়াইয়া চুণ প্রস্তুত করিয়া লইয়াছিলেন। ১৮১৪ অব্দে তিনি বাঁকীপুরের নীল ব্যবসায়ে যোগ দেন এবং পরে কিছুদিনের জন্য যশোহরের অন্তর্গত নহাটা কারবারের মালিক ছিলেন। সর্ব্বশেষে তিনি কাল্না নীলকুঠি হইতে এক বৎসরে ১৪০০ মণ নীল রপ্তানি করেন। ১৮২১ অব্দে তাঁহার মৃত্যু হয়। তিনিই ভারতবর্ষের মধ্যে সর্ব্ব প্রথম ইয়োরোপীয় নীলকর।[৪] বঙ্গদেশে নীলের চাষের সংবাদ ১৭৮৯ অব্দের ২৯শে অক্টোবরের সরকারী ঘোষণা পত্র হইতে প্রথম জানা যায়।[৫]
যশোহরের কথা বলিতে গেলে, তথায় ১৭৯১ খৃষ্টাব্দের পূর্ব্বে কোন বৈদেশিক নীলকরের কুঠি স্থাপিত হইবার প্রমাণ নাই।[৬] ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ডিরেক্টরগণে অনুমতি বতীত কোন পাশ্চাত্য বণিক কারখানার জন্য এদেশে কোন জমি লইতে পারিতেন না। ১৭৯৫ খৃষ্টাব্দে বণ্ড (Bond) সাহেব নামক এক ব্যক্তি উক্ত ডিরেক্টর সভার অনুমতি লইয়া যশোহরের অন্তর্গত রূপদিয়াতে এই জেলার সৰ্ব্ব প্রথম কুঠি নিৰ্ম্মাণ করেন। ভৈরবের কূলে এখনও তাহার ভগ্নাবশেষ রহিয়াছে। পর বৎসর টাট্ (Tuft) সাহেব মহম্মদশাহীতে কুঠি খুলিবার আদেশ পান। ১৮০০ অব্দে টেলার (Taylor) সাহেব কয়েকটি কুঠি খুলেন এবং পর বৎসর এণ্ডারসন যশোহরের কাছে বারান্দী ও নীলগঞ্জে এবং খুলনার কাছে দৌলতপুরে কুঠি করেন। এগুলির ভগ্নাবশেষ এখন একপ্রকার বিলুপ্ত হইতেছে। এই সময়ে প্রতি বৎসর বৈদেশিকদিগের নামের লিষ্ট দাখিল করিতে হইত। ১৮০৫ অব্দে নিম্নলিখিত কুঠিয়াল সাহেবদিগের নাম পাওয়া যায় : [কুঠির নাম বাঙ্গালায় এবং মালিকের নাম ইংরাজীতে প্রদত্ত হইল] Deverell—ঝিনাইদহের নিকটবর্ত্তী হাজরাপুর, Brisbane — কোটচাঁদপুরের কাছে দাঁতিয়ারকাটি; Taylor and knudson—মীরপুর; Reeves – সিন্দূরিয়া; Razet—নহাটা; ইত্যাদি। এইরূপে ১৮১১ অব্দে যশোহর ও ঢাকা জেলা নীল কুঠিতে পূর্ণ হইয়া গিয়াছিল।
সঙ্গে সঙ্গে কুঠিয়াল সাহেবেরা নিজ নিজ এলকার সীমা ও প্রজাবিলি লইয়া বিবাদ আরম্ভ করিয়াছিলেন। ঝিঙ্গারগাছার কুঠির Jennings সাহেব এবং রূপদিয়ার Bond সাহেব যশোহরে অভিযোগ করিলেন। কালেক্টর (Thmaos Powney) তৎক্ষণাৎ এক সাময়িক ইস্তাহার জারী করিয়া দিলেন যে, এক কুঠির ১০ মাইলের মধ্যে অন্য কুঠি বসিতে পারিবে না। এজন্য আইন প্রণয়নের আবশ্যকতা বিষয়ে তিনি গবর্ণর জেনারালকে লিখিলেন। কিন্তু লর্ড মিন্টো কালেক্টরের কথায় সম্মত হইলেন না। তিনি লিখিলেন, এরূপ আইন হইলে ২০ মাইল বা লক্ষাধিক বিঘা জমির উপর একজন নীলকরের প্রাধান্য স্থাপিত হইবে, তখন জমিদারদিগের ন্যায্য অধিকারের উপর হস্তার্পণ করা হইবে এবং প্রতিযোগিতার অভাবে প্রজার লভ্যাংশ কম হইয়া পড়িবে। সুতরাং আইন হইল না; তবে ঐ সময়ে নীলকরদিগের অত্যাচার নিবারণের জন্য কতকগুলি নিয়ম প্রচারিত হইয়াছিল। সে অত্যাচারের কথা পরে বলিতেছি।
কালেক্টরের ইস্তাহার উঠিয়া গেলে নীলকরগণ দ্বিগুণ উৎসাহে সৰ্ব্বত্র নীলকুঠি স্থাপন করিতে লাগিলেন। উহার ফলে প্রতি বৎসর যথেষ্ট নীল প্রস্তুত হইত এবং বিলাতে ও বিদেশের সকল বিপণিতে বঙ্গীয় নীলের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। এমন কি, কথিত আছে, ১৮১৫-১৬ অব্দে বঙ্গদেশ হইতে সমগ্র পৃথিবীর লোকের প্রয়োজনীয় নীল সরবরাহ করা হইয়াছিল। আর এই নীলই সৰ্ব্বোৎকৃষ্ট ছিল, বিশেষতঃ নদীয়া ও যশোহর জেলার নীল জগতের মধ্যে অতুলনীয়।
প্রথমতঃ জমিদারের অধীন অল্প অল্প জমি লইয়া সাহেবেরা প্রধানতঃ স্থানীয় রাইয়তের সাহায্যে নীলের চাষ করাইতেছিলেন। পরে ১৮১৯ অব্দের অষ্টম আইনে১০ জমিদরদিগকে পত্তনী তালুক বন্দোবস্ত করিবার অধিকার দেওয়ায় এক এক পরগণার মধ্যে অসংখ্য তালুকের সৃষ্টি হইল এবং জমিদারগণ নবাগত নীলকরদিগের নিকট হইতে উচ্চহারে সেলামী লইয়া তাঁহাদিগকে বড় বড় পত্তনী দিতে লাগিলেন। এ দেশীয় সম্পত্তিশালী ব্যক্তিরাও নিজের অথবা পরের জমিদারী মধ্যে পৃথকভাবে পত্তনী লইয়া নীলের ব্যবসায়ে যোগ দিলেন। উঁহাদের মধ্যে নড়াইলের জমিদারেরা অগ্রণী। সাহেবদিগের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়া কাজ চালাইবার জন্য উঁহারা সাহেব ম্যানেজার রাখিয়াছিলেন। এখনও নড়াইলের নিকটবর্ত্তী ঘোড়াখালিতে নীলকুঠির পার্শ্বে সেই আমলের সাহেব ম্যানেজারের বাড়ী আছে। উহা এখন উঁহাদের জমিদারীর প্রধান ম্যানেজারের আবাস বাটিকা।
নদীয়া-যশোহরের নীলের খ্যাতি বিলাতে পৌঁছিলে, বহু ধনীর পুত্র এই ব্যবসায়ে বড়লোক হইবার আশায় এদেশে আসিতে লাগিলেন। কেহ নিজে স্বত্বাধিকারী থাকিয়া, কেহ কেহ বা কয়েকজনে মিলিয়া যৌথ কোম্পানি স্থাপন পূৰ্ব্বক এক একটি বিস্তৃত Concerns বা কারবার খুলিতেন, উহাকে সাধারণ লোকে হৌস্ বা কান্সরণ বলিত। কথাটা চলিত হইয়া গিয়াছে বলিয়া আমরা কারবার বা কান্সরণ উভয় কথাই ব্যবহার করিব। এক একটি কানসরণের মধ্যে নানাস্থানে কতকগুলি করিয়া কুঠি (factory) থাকিত, সকলগুলির কার্য্যব্যবস্থা একই কর্তৃপক্ষের দ্বারা হইত। সর্ব্বোপরি যিনি কর্তা বা ম্যানেজার তাঁহাকে ‘বড় সাহেব’ এবং তাঁহার সহকারীকে ‘ছোট সাহেব’ বলা হইত। কানসরণের মধ্যে প্রধান কুঠির নাম ছিল সদর কুঠি। কারবারের পরিমাণ বড় না হইলে, একজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষই যাবতীয় কর্ত্তব্য সম্পাদন করিতেন। কার্য্যকারিতা শক্তিই বৃটিশকে রাজার জাতি করিয়াছে
ম্যানেজারের অধীন কয়েকজন দেশীয় কর্ম্মচারী থাকিতেন, তন্মধ্যে প্রধান ছিলেন নায়েব বা দেওয়ান। উঁহার বেতন ৫০ টাকা, সে আমলে তাহাই উচ্চ হার। নায়েবের অধীন থাকিতেন গোমস্তা। রাইয়তদিগের হিসাবপত্রের সহিত উহাদেরই ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল; এজন্য তাঁহারা প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্যভাবে দস্তরী বা উৎকোচ গ্রহণ করিয়া বেশ দু’পয়সা আয় করিতেন। সাহেবদিগের অবোধ্য অশ্লীল গালাগালি এবং সময়মত বুটের আঘাত উঁহারা বেশ হজম করিতে জানিতেন এবং কোন প্রকার মিথ্যা প্রবঞ্চনা বা চক্রান্তে পশ্চাৎপদ না হইয়া ইঁহারাই অনেক স্থলে দেশীয় প্রজার সৰ্ব্বনাশ বা মর্মান্তিক যাতনার হেতু হইয়া দাঁড়াইতেন। ভাল লোক কেহ থাকিতেন না, তাহা বলিতেছি না; তবে সাধারণতঃ ভাল থাকা যাইত না। সত্যের অনুরোধে বলিতে হয়, দেশীয় লোকে দেশ ও স্বজাতির পানে চাহিয়া আত্মসম্মান বজায় রাখিয়া চলিলে, নিশ্চয়ই নীলের ব্যবসায় এত কলঙ্কিত হইত না। গোমস্তা ব্যতীত, জমি মাপের জন্য আমীন, নীল মাপের জন্য ওজনদার, কুলি খাটাইবার জন্য জমাদার বা সর্দ্দার, খবর প্রেরণ ও সময়মত রাইয়তদিগকে কাজের তাগিদ করিবার জন্য কয়েকজন করিয়া তাগিদগীর বা তাইদীর থাকিত।
বনগ্রাম মহকুমা তখন নদীয়ার মধ্যে ছিল, এখন উহাকে যশোহরের মধ্যে টানিয়া আনিতে হইতেছে। কতকগুলি কানসরণের অধীন কুঠি, উভয় জেলায় ভাগাভাগি ছিল; উহাদিগকে ঠিক পৃথক্ করিয়া এখন আর হিসাব দিবার উপায় নাই। বনগ্রাম, মাগুরা ও ঝিনাইদহ এই তিনটি মহকুমায় প্রধান প্রধান নীলের কারবার ছিল; সাতক্ষীরায় বেশী কারবার ছিল না; লবণাক্ত জলে ভাল নীল হইত না; কারবার যাহা ছিল, তাহারও বিশেষ খবর আমরা রাখি না। খুলনাকে যশোহরের অন্তর্ভুক্ত করিয়াই আমরা কানুসরণগুলির তালিকা দিতেছি। নীলকুঠিগুলির সর্ব্বাপেক্ষা উন্নত অবস্থা ১৮৫০ হইতে ১৮৬০ অব্দ পর্য্যন্ত ছিল; আমরা যেখানে পারি ঐ সময়েরই উৎপন্নের হিসাব দিব I
বেঙ্গল ইণ্ডিগো কোম্পানিই নদীয়া-যশোহরের সর্ব্বাপেক্ষা বড় কারবার ছিল। উহার অধীন চারিটি প্রধান কানসরণ; তন্মধ্যে মোল্লাহাটি ও কাঠগড়া এক্ষণে যশোহরে পড়িয়াছে, খালবলিয়া নদীয়ার মধ্যেই আছে এবং রুদ্রপুর (চান্দুড়িয়ার সন্নিকটে) ২৪-পরগণার অন্তর্নিবিষ্ট
১. মোল্লা হাটি কানসরণ ॥ বর্তমান বনগ্রাম হইতে ৫/৬ মাইল দূরে ইচ্ছামতীর তীরে মোল্লাহাটিতে বেঙ্গল ইণ্ডিগো কোম্পানির সদর কুঠি ছিল। সাহেবদিগের ভাষায় ইহার নাম ছিল ‘Mulnath’। ইহার মধ্যে মোল্লাহাটি, বাঘডাঙ্গা, পিপুলবাড়িয়া, পিপড়াগাছি, ভবানীপুর, বেনাপোল, দুর্গাপুর, গাইঘাটা, হুগলী, মীর্জাপুর প্রভৃতি ১৭টি কুঠি ছিল। মোট অধিবাসীর সংখ্যা ২,০০,০৯২ জন। বেঙ্গল ইণ্ডিগো কোম্পানির ম্যানেজার প্রবল প্রতাপান্বিত লারমোর (R. T. Larmour) সাহেব মোল্লাহাটিতে বাস করিতেন। ১৮৬০ অব্দের প্রাক্কালে জেমস্ ফরলঙ (J. Forlong) সাহেব মোল্লাহাটি কানসরণের কর্তা ছিলেন। এই কুঠির অত্যাচার কাহিনীর উপর লক্ষ্য রাখিয়া দীনবন্ধুর ‘নীল-দর্পণ’ প্রণীত হয়, সে কথা পরে বলিতেছি।
২. কাঠগড়া কানসরণ ॥ মোল্লাহাটির উত্তরাংশে কপোতাক্ষীর পশ্চিম পারে অবস্থিত। ইহার মধ্যে কাঠগড়া, খালিসপুর, চৌগাছা, গুয়াতলী, কাঁদবিলা, ইলশামারি প্রভৃতি ৬টি কুঠি ছিল। লোকসংখ্যা ৭৩,৮৩৯ জন। চৌগাছা, খালিসপুর ও কাঠগড়ার এখন কুঠি বাড়ীগুলি খাড়া আছে। এই কানসরণে প্রথম নীল-বিদ্রোহ আরব্ধ হয়।
৩. হাজ্রাপুর ॥ মাগুরা ও ঝিনাইদহের মধ্যস্থলে। হাজ্রাপুরেরই নাম পরে পোড়াহাটি কানসরণ হইয়াছিল। ইহার মধ্যে হাজ্রাপুর, লোহাজঙ্গ, নারায়ণপুর, বরীশাট, পোড়াহাটি, পবহাটি, রাজারামপুর, জিতোড়, ফলুয়া প্রভৃতি ১৪টি কুঠি ছিল। পূর্ব্বে হাজ্রাপুর ও পোড়াহাটি দুইটি পৃথক কারবার ছিল, পোড়াহাটি ছিল হেরী রাসেল ( Henry Russel) সাহেবের; তিনি হাজ্রাপুরের মালিক টুইডী (Dr. Thomas Tweedie) সাহেবকে নিজ কানসরণ বিক্রয় করিলে উভয় সম্মিলিত হয়। তৎপুত্র টুইডী (C. Tweedie) সাহেব এখনও জীবিত আছেন; তাঁহার কুঠি নাই, সম্পত্তি আছে। তবে তিনি হাজ্রাপুরের কুঠি বাড়ী ব্যারিষ্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্ত্তী মহাশয়কে বিক্রয় করিয়াছেন। এই সম্মিলিত কারবারে ১৬,০০০ বিঘা জমিতে বৎসরে ১০০০ মণ নীল উৎপন্ন হইত।
৪. সিন্দুরিয়া। ইহা নদীয়া জেলার চুয়াডাঙ্গা মহকুমার অন্তর্গত। তবে এই কানসরণে অনেকগুলি কুঠি ঝিনাইদহের মধ্যে পড়িয়াছিল। তন্মধ্যে বিজলিয়া প্রধান। ১৮৮৯-৯০ অব্দে বিজলিয়া কুঠির অধীন ৪৮ গ্রামের লোক বিদ্রোহী হয়। বিজলিয়া ব্যতীত ঝিনাইদহের মধ্যে বিষ্ণুদিয়া, ভূঁঞাডাঙ্গা, কালামারি, দুর্গাপুর প্রভৃতি ১৪টি কুঠি ছিল। উহাতে ১০,৬০০ বিঘা নীলের চাষে বাৎসরিক ৭০০ মণ উৎপন্ন হইত। ইহা একটি যৌথ কোম্পানির অধীন ছিলেন। তিনি উন্নতমনা ও বদান্য ব্যক্তি।
৫. জোড়াদহ কানসরণ ॥ ইহার অধীন জোড়াদহ, ভবানীপুর, সোহাগপুর, হরিশপুর, ঘোলদাড়ী প্রভৃতি কতকগুলি কুঠি ছিল। ইহাও এক সেরিফ (J. Sheriff) সাহেবের নিজস্ব ছিল। ১৮৫৭-৫৮ অব্দে জর্জ ম্যানেয়ার জোড়াদহ ও সিন্দূরিয়ার কার্য্যাধ্যক্ষ ছিলেন। অত্যাচারী বলিয়া তাঁহার দুর্নাম ছিল। জোড়াদহে ৯,৪৫৮ বিঘায় বৎসরে গড়ে ৬০০ মণ নীল পাওয়া যাইত।
৬. খড়গড়া কানসরণ ॥ ইহাতে খড়গড়া, আলে, ত্রিবেণী প্রভৃতি কুঠিতে ৪,০৬৪ বিঘার চাষে ১৬৬ মন ৩২ সের নীল উৎপন্ন হইত। ইহারও কর্তা ছিলেন উইলিয়ম সেরিফ।
৭. মহিষাকুণ্ড কারবার। ইহার মালিক নড়াইলের জমিদারগণ। কুঠিগুলি ঝিনাইদহ মহকুমার অধীন; উহাদের নাম মহিষাকুণ্ড, তালনিয়া, গোপালপুর, শৈলকুপা, দুধসর, গোপীনাথপুর, মকরমপুর প্রভৃতি। উৎপন্ন ৫,১৭৪ বিঘায় ১৯৯ মণ।
৮. নহাটা কানুসরণ॥ প্রথমে সেবী (Savi)১১ সাহেব নন্দীর অধীন নহাটা পত্তনী লইয়া এই কারবার আরম্ভ করেন। কিছু কাল পরে তিনি উহা টমাস ও থরবার্ণ কোম্পানীর নিকট বিক্রয় করেন (৩৭শ পরিচ্ছেদ)। পরে উহা সেলবী (Selby) সাহেবের হাতে যায়। নহাট্টা, পলিতা, চাঁদপুর, চাউলিয়া, সত্রাজিৎপুর, রাজাপুর, আড়পাড়া, চরখালি প্রভৃতি স্থানে এই কোম্পানীর কুঠি ছিল। ১৮৭২ অব্দে ওটস্ (H. Oatts) সাহেব ইহার অধ্যক্ষ ছিলেন। ১০,০৬৪ বিঘায় ৫০০ মণ নীল জন্মিত।
৯. বাবুখালি কানসরণ ॥ ইহার মধ্যে বাবুখালি হাটবাড়িয়া ও শ্যামগঞ্জ কুঠি ছিল। ৪,১৮৫ বিঘায় ২৩৪ মণ নীল পাওয়া যাইত। বিদ্রোহের কিছু দিন পরে ইহা বন্ধ হয়। সপিয়ান (Saupian) ও পরে ব্রে (W. Brae) সাহেব কৰ্ত্তা ছিলেন। ব্রে সাহেব বড় অত্যাচারী, মাগুরায় তাঁহার পুত্রের সমাধি আছে। বাবুখালিতে মধুমতীকূলে সাহেবদিগের যে সুন্দর বাড়ী ছিল, তেমন জাঁকজমকের বাড়ী তখন আর যশোহরে ছিল না।[১২]
১০. শ্রীকোল-নহাটা কানসরণ ॥ এই কানসরণেরও মালিক ছিলেন সপিয়ান সাহেব। নহাটা, আমলসার প্রভৃতি কুঠি ছিল।
১১. শ্রীখণ্ডী, হরিপুর ও নিশ্চিন্তপুর কানসরণ ॥ এ কয়েকটি কারবারের মালিক ছিলেন নড়াইলের বাবুরা। তিন স্থানেই কুঠি ছিল। সৰ্ব্বসমেত ২,৭১০ বিঘায় ১১৫ মণ নীল হইত।
১২. রামনগর কানসরণ। ইহার মধ্যে রামনগর (কৃষ্ণপুর), মাগুরা, ধনেখালিতে কুঠ ছিল। ৫,৪৮৫ বিঘায় ১৪০ মণ নীল উৎপন্ন হইত। টমাস্ ওমান (T. Oman) সাহেব ইহার মালিক। এখনও বরই ও রামনগরে কুঠিবাড়ির ভগ্নাবশেষ আছে। বরই কুঠি আবাইপুরের শীকদারদিগের নিকট বিক্রীত হয়।
১৩. মদনধারী কানসরণ॥ এই কারবারের মালিক পাউরাণ (J. E. and R.S. Powran) সাহেবগণ। ৩,০০০ বিঘা নীলের চাষে ১৮৭ মণ ২০ সের উৎপন্ন। ইহা পরে ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট কালীপ্রসন্ন সরকার খরিদ করিয়াছিলেন।
এই সকল প্রধান কারবার ব্যতীত দেশীয় জমিদার তালুকদারগণ নানাস্থানে বহু কুঠি স্থাপন করিয়া নীলের ব্যবসায়ে মন দিয়াছিলেন। অনেক চতুর লোক সাহেবদের কতকগুলি কুঠির মুৎসুদ্ধি বা প্রধান কার্য্যকারক হইয়া বহু টাকা উপার্জ্জন করিতেন। ঝিনাইদহের মধ্যে মথুরাপুরের বক্সী, পবহাটির মজুমদার, ভগবান নগরের রায়, নলডাঙ্গার রাজা, সাধুহাটির আচার্য্য ও মাগুরার মধ্যে তালখড়ির ভট্টাচার্য্য ও নড়াইলের বাবুদিগের কুঠি ছিল। মাগুরায় নান্দোয়ালী, শিবরামপুর, ছাঁদড়া, সুরসেনা (সরশুণা), কাশীনাথপুর, সিংহেশ্বর ও বামনখালি প্রভৃতি স্থানে কুঠির পরিচয় পাওয়া যায়। নড়াইলে লক্ষ্মীপাশা, কালীগঞ্জ, সিঙ্গা গোবরা, দিঘলিয়া, শালনগর প্রভৃতি স্থানে কুঠি ছিল। নড়াইল ও হাটবাড়িয়ার জমিদারগণ অনেক কুঠির মালিক ছিলেন। ভৈরব কূলে মধ্যপুরে ও দেয়াপাড়ায় নলডাঙ্গা রাজগণের, খালকুলায় তথাকার মিত্রগণের, নারিকেলবাড়িয়ার সাধুখাঁদিগের এবং তেলকুপি জগন্নাথপুর প্রভৃতি আরও অনেক স্থানে কুঠি ছিল। খুলনার মধ্যে সিকিরহাট, দৌলতপুর ও খালিসপুরে সাহেবদিগের এবং নেহালপুরে ও বিরাটে শ্রীরামপুরের ঘোষদিগের নীলকুঠি বহুকাল চলিয়াছিল।[১৩]
সমগ্র যশোহর জেলার উৎপন্ন নীলের হিসাব হইতে দেখা যায, ১৮৪৯-৫০ অব্দেই সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক নীল উৎপন্ন হয়, উহার পরিমাণ ১৬,৮১৮ মণ। আকস্মিক বন্যাদির জন্য ১৮৫৫-৫৬ অব্দে নীলের পরিমাণ কমিয়া ৬,৫৮৫ মণ মাত্র হয়। ১৮৪৯ হইতে ১৮৫৯ পৰ্য্যন্ত দশ বৎসরের গড় ধরিলে প্রতিবৎসর ১০,৭৯১ মণ উৎপন্ন হইত। ১৮৫০ অব্দকেই বঙ্গীয় নীল ব্যবসায়ের উচ্চ সীমা বলা যায়। ১৮৬০ অব্দের পর হইতে উহার ক্রমে অবনতি হইতে হইতে ৩০ বৎসর মধ্যে সম্পূর্ণ পতন হয়। সে পতনের কারণ অনুসন্ধানের পূর্ব্বে আমরা নীলের চাষের ও প্রস্তুত প্রণালীর সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়া লইব।
নীলের চাষের ‘নিজ’ ও ‘রাইয়তী’ নামে দুইটি প্রণালী ছিল; প্রথম, কোন ব্যক্তি বা কোম্পানির নিজ জমিতে নিজের তত্ত্বাবধানে ভৃত্য বা মজুর দ্বারা যে চাষ, তাহার নাম ‘নিজ আবাদি’ বা খামার; আর দ্বিতীয়, অগ্রিম টাকা দাদন বা গছানি দিয়া রাইয়তদিগের দ্বারা তাঁহাদের জমিতে নীল উৎপাদন করাইয়া লওয়া হইত, ইহার নাম রাইয়তী বা দাদন-পদ্ধতি। রাইয়তদিগকে খাতার হিসাব ভুক্ত হইতে হইত বলিয়া ইহাকে ‘খাতা-পদ্ধতি’ও বলে। রাইয়তেরা দাদন লইয়া নীল বুনিতে চুক্তি করিতেন। রাইয়তী চাষও দুইপ্রকার ছিল; নীলকরের নিজ জমিতে চাষ হইলে ইহাকে এলেকা কহিত এবং অপরের জমিতে হইলে উহার নাম ছিল বে-এলেকা চাষ। চুক্তি পত্র প্রায়ই এক বৎসরের জন্য হইত। কোন কোন স্থলে তিন, পাঁচ বা দশ বৎসরের জন্য ও হইতে দেখা গিয়াছে। রাইয়তী চাষে রাইয়তেরা নিজ ব্যয়ে গাছ কাটিয়া বান্ধিয়া গাড়ী বা নৌকাযোগে কুঠিতে পাঠাইতেন। কুঠি হইতে পৌঁছাইবার খরচটা দেওয়া হইত। কুঠির যে অংশে নীল গাছ জমা হইত, উহার নাম নীলখোলা। তথায় পৌঁছিলে ‘নিজ’ আবাদী নীলের মাপ হইত না। ওজনদারেরা রাইয়তের নীল ছয় ফুট দীর্ঘ শিকল দ্বারা মাপ করিয়া কয় বোঝা বা বাণ্ডিল হইল, তাহা সেই রাইয়তের নামে হিসাব ভুক্ত করিয়া দিতেন।
প্রত্যেক কারখানায় উচ্চ ও নিম্ন দুই থাকে দুইসারি কুণ্ড বা চৌবাচ্চা (Vat বা হৌজ) থাকিত এত্যেক হৌজ বা চৌবাচ্চার পরিমাণ ২১×২১ ×১-১/২ ফুট : এক এক সারিতে ১২টি হইতে ১৫টি থাকিত। নীলগাছ হইতে রঙ্গ প্রস্তুত করা কার্য্য দুই প্রকারে হইতে পারিত; কাঁচা গাছ কাটিবামা পচাইয়া, অথবা উহার শুষ্কপাতা জলে ভিজাইয়া।[১৪] গাছ শুকাইয়া রাখিতে পারিলে সময়মত কাৰ্য্য করিবার অধিকতর সুবিধা হয়। কিন্তু যশোহরে যখন জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় মাসে গাছ কাটা হইত, তখন রাশি রাশি গাছ শুকাইয়া রাখা যাইত না। এজন্য কাঁচা গাছ হইতেই কাজ হইত; এখানে উহারই বর্ণনা করিতেছি। কাঁচা নীলও অন্য শস্যের মত গাদা করিয়া রাখিলে পচিয়া নষ্ট হইত, এজন্য ব্যস্ততার সঙ্গে কার্য্য চালাইবার জন্য চৌবাচ্চার সংখ্যা বেশী লাগিত। নীল খোলা হৌজের দিকে ক্রমোচ্চ; ওজন হইবামাত্র সাধারণতঃ মেয়ে কুলিরা নীলের বোঝা মাথায় করিয়া উপরের থাকের হৌজে ফেলিয়া দিতেন। সাধারণতঃ ১০০ বাণ্ডিলে একটি হৌজ পূর্ণ হইত। তদন্তর উহার উপর এক ফুট অন্তর এড়োভাবে বাঁশ পাতিয়া তাহার উপর দুই পার্শ্বে দুইখানি ভারী কাঠ বিছাইয়া কতকগুলি লোকে উহার উপর উঠিয়া চাপ দিতেন, তাহাতে নীল বসিয়া যাইত।
নীল পচাইবার জন্য পরিষ্কার জলের প্রয়োজন। এজন্য নীলকুঠিগুলি প্রায়ই সুপেয়-সলিলা নদীর তীরে অবস্থিত হইত। নদী হইতে ‘চীনা’ কলে জল তুলিবার ব্যবস্থা থাকিত। এই প্রণালীতে অল্প সময়ে অধিক জল উত্তোলন করিয়া নদীর ধারে একটি উচ্চ বৃহৎ চৌবাচ্চায় সঞ্চিত হইত। সেখান হইতে একটি পয়ঃপ্রণালী দ্বারা হৌজের মধ্যে জল আসিত। হৌজ ছাপাইয়া জল দিলে ১০/১২ ঘণ্টায় নীল পচিয়া যাইত; তখন প্রত্যেক হৌজের নলের মুখ খুলিয়া দিলে দুর্গন্ধ হরিদ্রাভ জল নিম্নবৰ্ত্তী চৌবাচ্চাগুলিতে আসিত। তখন উপরের হৌজের ‘সিটি’ অর্থাৎ গাছগুলি মেয়ে কুলিরা তুলিয়া লইয়া গাদা করিয়া রাখিতেন এবং তিনমাস পরে উহা শুকাইলে জ্বাল-ঘরের জ্বালানি বা ক্ষেত্রের সার হইত। নীলজলপূর্ণ নিম্ন হৌজের প্রত্যেকটিতে ১০ জন কুলি দুই সারিতে দাঁড়াইয়া পাঁচফুট দীর্ঘ এক একখানি বাঁশের বৈঠা দিয়া দুই ঘণ্টাকাল চীৎকার বা গান করিতে করিতে নীলজলে অবিরত সরিয়া সরিয়া পিটাপিটি করিতেন। রঙ্গের উপাদান জল হইতে পৃথক্ করিবার জন্য এই প্রণালী অবলম্বিত হইত। রঙ্গ-মিস্ত্রী পরীক্ষা করিয়া বলিলে পিটাপিটি বন্ধ হইত, তখন দুইঘণ্টাকাল নীল জল থিতাইতে দেওয়া হইত। পরে ঐ সকল হৌজের নিম্নাসারির নলগুলি খুলিয়া দিলে ঈষৎ রঙ্গিন জল একটি পয়ঃপ্রণালী দিয়া নদীতে গিয়া পড়িত এবং হৌজের নিম্নভাগে ৪ অঙ্গুলি প্রমাণ গাঢ় নীলরঙ্ সঞ্চিত হইত। ইঁহা একটি নল দিয়া পার্শ্ববর্তী জ্বাল-ঘরে গিয়া দুইঘণ্টা কাল উত্তপ্ত হইত। পরে নলের মুখে বস্ত্রদ্বারা ছাঁকিয়া একটি প্রশস্ত পাটাতনের উপর সমস্তদিন ধরিয়া বস্ত্রাবৃত অবস্থায় চাপ-যন্ত্রের নিম্নে দিয়া চাপিয়া লওয়া হইত; পরে একটি খোপ-ওয়ালা বাক্সের মধ্যে চাপিয়া খণ্ড খণ্ড চৌকা প্রস্তুত হইত, সেই চৌকাগুলিকে লম্বা ও এড়োভাবে কাটিয়া ক্ষুদ্র খণ্ডে পরিণত করা হয়। উহারই উপর কুঠির নামের ছাপ দিয়া লইলেই বিদেশে রপ্তানি করার মত নীল প্রস্তুত হইল।[১৫]
বৎসরের মধ্যে দুইবার নীলের চাষ হইত। প্রথম, হৈমন্তিক চাষ; বর্ষান্তে বন্যার জল সরিয়া গেলে পলিযুক্ত নদীর চরে বিনাচাষে, অথবা ডাঙ্গা জমি ও ভিট্টাবাড়ীতে চাষ করিয়া, নীলের বীজ বুনিয়া দেওয়া হইত; পরবর্ত্তী জ্যৈষ্ঠমাসে অর্থাৎ বন্যায় চরভূমি ডুবিয়া যাইবার পূর্ব্বে নীলগাছ কাটিয়া লওয়া হইত। দ্বিতীয়, বাসন্তী চাষ, অর্থাৎ ফাল্গুন চৈত্র মাসে বর্ষা হইয়া জমিতে ‘যো’ হইলে, যে সময় আউস ধানের চাষ হয়, সেই সময় জমি উত্তমরূপে চাষ করিয়া মই দিয়া নীলের বীজ বপন করা হইত; এবং গাছ ৪/৫ ফুট লম্বা হইলে, আষাঢ় শ্রাবণ মাসে গাছ কাটিয়া লইত। যশোহর জেলায় উচ্চ জমিই বেশী, চর-ভাগ অধিক নহে বলিয়া দ্বিতীয় প্রকারেই অধিক নীল উৎপন্ন হইত। কিন্তু কৃষকেরা আউস ধান ফেলিয়া এই চাষ সহজে করিতে চাহিতেন না বলিয়া কুঠির লোকদিগকে এজন্য যথেষ্ট আয়াস স্বীকার করিতে হইত।[১৬]
‘নিজ আবাদী’ চাষ ও কারখানার যাবতীয় কার্য্যের জন্য বহুসংখ্যক দৈনিক মজুর বা কুলির দরকার হইত। ছোট কারখানায় হয়ত স্থানীয় লোকের মজুরীতে কার্য্য নির্ব্বাহ হইতে পারে; কিন্তু বড় বড় কুঠিতে তাহাতে চলিত না। মোল্লাহাটিতে ৬০০ কুলিতে কাজ করিতেন। এজন্য নীলকর সাহেবেরা মেদিনীপুর অঞ্চল হইতে নিম্নশ্রেণীর হিন্দুকুলি, অথবা বাঁকুড়া, বীরভূম, মানভূম ও সিংহভূম প্রভৃতি স্থান হইতে সাঁওতাল জাতীয় ‘জঙ্গলী’ বা ‘বুনা কুলি’ সংগ্রহ করিতেন। সকলকেই বাড়ীতে কিছু কিছু টাকা দাদন দিয়া আনিতে হইত; এদেশে আসিয়া মেদিনীপুরের কুলিরা ৪ টাকা, বুনা কুলিরা ৩ টাকা, স্ত্রীলোক ও বালকেরা ২ টাকা হিসাবে বেতন পাইতেন। এই সকল বুনা কুলি অধিকাংশই স্ত্রীপরিবার সঙ্গে আনিয়া কুঠির পাশে অল্পকরের জমি পাইয়া বাস করিতেন। তদবধি তাঁহারা নিজেদের সমাজ গঠন করিয়া এদেশের বাসিন্দা হইয়া গিয়াছেন। যশোহর-খুলনার যেখানে যেখানে বড় কুঠি ছিল, সেখানেই তাঁহাদের বাস হইয়াছিল। এখন কুঠি নাই বটে, কিন্তু বুনাদের বাস দেখিয়া তৎসান্নিধ্যে কুঠির অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। এখন বুনাগণ দিন মজুরী ও মুটিয়ার কাজে জীবিকা অর্জ্জন করেন। তাঁহারা রাস্তা নির্ম্মাণ প্রভৃতি যাবতীয় মাটির কার্য্যে বড় মজবুত।
প্রতি বিঘায় নীলচাষের জন্য খরচ ছিল : খাজনা ১০ আনা, বীজ ৪ আনা, চাষ ১ টাকা, বুনন ৪ আনা, নিংড়ান বা পরিষ্কার করা ৮ আনা, গাছকাটা ৪ আনা, দাদনের একরারনামার জন্য ষ্ট্যাম্প ২ আনা— সমষ্টি ৩ টাকা; প্রতি বিঘায় ৮ হইতে ১২ বাণ্ডিল নীল হইত, উৎপন্ন ৮ বাণ্ডিল ধরিয়া এবং উচ্চ দর টাকায় ৪ বাণ্ডিল হিসাবে ধরিলে, ১৭ নীলের আয় ২ টাকা, উৎপন্ন একমণ বীজের মূল্য ৪ টাকা— মোট ৬ টাকা। ইহা হইতে চাষের খরচ ৩ টাকা ও দাদন ২ টাকা বাদ দিলে কৃষকের প্রাপ্য হইত মাত্র ১ টাকা।[১৮] আর উৎপন্ন নীল ১২ বাণ্ডিল ধরিলে আয় ২ টাকা দাঁড়াইত। কিন্তু দৈব কারণে ভাল নীল না জন্মিলে হয়ত দাদনের টাকাও শোধ হইত না। গ্যাষ্ট্রেল সাহেব প্রজার নীলের আয় মাত্র চারি আনা ধরিয়াছেন।[১৯] সাধারণতঃ যে কৃষক শুধু নীলের উপন নির্ভর করিতেন, তাঁহার লোকসানই হইত।[২০] রাইয়াতের ভাগ্যে পাওয়া প্রায়ই ঘটিত না এবং বকেয়া বাকী উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতে থাকিত। এই জন্যই কুঠির তাগিদ্গীর বলিয়াছিল, ‘নীলের দাদন ধোপার ভ্যালা, একবার লাগলে আর ওঠে না’।[২১] লারমুর সাহেবের সাক্ষ্য হইতে জানা যায়, ১৮৫৮-৫৯ অব্দে তাঁহার অধীন বেঙ্গল ইণ্ডিগো কোম্পানির কুঠিসকলে ৩৩,২০০ লোক চাষ করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে ২,৪৪৮ জন মাত্র দাদনের অতিরিক্ত কিছু কিছু পাইয়াছিলেন, বাকী ৩০,৭৫২ জনের দাদনের হিসাবই শোধ হয় নাই। সব কুঠিরই প্রায় একদশা।
কাজেই নীলের চাষ প্রজার পক্ষে লাভজনক ছিল না। তাহারা প্রারম্ভে ইহা বুঝেন নাই। প্রথমতঃ, দেশীয় প্রজারা স্বল্পায়াসলভ্য শস্যবাহুল্যে স্বচ্ছন্দে জীবিকা নির্ব্বাহ করিতেন। তাঁহারা তখনও পয়সার মুখ চোখে দেখেন নাই। এজন্য নীল-দাদনের নগদ পয়সা তাঁহাদের চোখ ধাঁধিয়া দিয়াছিল। তাঁহারা ভালমন্দ বিচার না করিয়া নীলের চাষ করিতে গিয়াছিলেন। দ্বিতীয়তঃ, আধুনিক খুলনায় যেমন পতিত জমি কম এবং অধিকাংশ চাষের জমিতে প্রচুর ধান্য জন্মে, যশোহরের অবস্থা তাহা নহে। তথাকার অপেক্ষাকৃত উচ্চ জমিতে ধান্য কম হয়, সরিষা কলাই প্রভৃতি প্রচুর ফলিলেও পতিত জমি যথেষ্ট ছিল। উহাতে নীলের চাষ দ্বারা দু’পয়সা পাইয়া একটু হাল চা’ল বদলাইবার আশা অনেকেই করিয়াছিলেন। হাল চা’ল যে কিছু বদলাইয়াছিল, তাহাও সত্য। প্রথম আমলে অধিকাংশ নীলকর সাহেবই নিজের মঙ্গল বুঝিতেন, প্রজার সহিত সম্প্রীতি ব্যতীত যে ব্যবসায়ের উন্নতি নাই, তাহা বুঝিয়া প্রজার মঙ্গলের দিকে চাহিতেন। তখনও দুইচারিজন অত্যাচারী থাকিতে পারেন, কিন্তু অধিকাংশের সদ্ব্যবহারে কুঠির সন্নিকটস্থ প্রজার সুখস্বাচ্ছন্দ্য কিছু বাড়িয়াছিল বলিয়াই ধরিতে পারি। রাজা রামমোহন রায় লর্ড বেন্টিঙ্কের ইচ্ছাক্রমে যখন পাশ্চাত্যদিগের ভারতীয় উপনিবেশ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করেন, তখন তাঁহার নীলকর সম্বন্ধীয় মন্তব্য হইতে ইহার প্রমাণ পাওয়া যায়।[২২] ঝিঙ্গারগাছার মেকেঞ্জি ও সিন্দুরিয়ার সেরিফ সাহেবের সদাশযতার গল্প শুনা যায়।
নীলকরের নিকট গবর্ণমেন্টেরও কিছু আশা করিবার ছিল। দস্যুর অত্যাচার ও প্রজা বিদ্রোহ হইতে শান্তিরক্ষা করিতে তাঁহারা পারিতেন; অনভিজ্ঞ রাজকর্মচারীর অবিচার, অকর্ম্মণ্যতা ও চরিত্রদোষের সন্ধান তাঁহারা দিতেন।[২৩] কিন্তু ব্যবসায়ের অতিরিক্ত লাভে তাঁহাদের মস্তক বিঘূর্ণিত হইয়াছিল। তাঁহারা রাজার হালে বাস করিতেন।[২৪] নিজেকে রাজার জাতি মনে করিয়া প্রজাকে ঘৃণা করিতেন। হাতে হাতে উহার পরিচয়-ছিল। ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্টে নীলকরের সঙ্গে মোকদ্দমা উপস্থিত হইলে, কুঠিয়াল সাহেব বিচারকের পার্শ্বের চেয়ার পাইতেন, দেশীয় জমিদার বা প্ৰজা কাঠগড়ায় খাড়া থাকিতেন। সাহেব বিচারক কুঠিয়ালের সঙ্গে হাসিয়া হাসিয়া কথা কহিতেন এবং আফিসান্তে কুঠিতে কুঠিতে নিমন্ত্রণের আদান প্রদান হইত। সুতরাং বিজিত দেশের জমিদার বা রাইয়ত উভয়ই নিজ অবস্থা বুঝিতেন। জমিদার নিজের তালুক মলুক নীলকরকে ইজারা পত্তনী দিয়া সম্ভ্রম রক্ষা করিতেন, রাইয়তেরা লোকসানের সম্ভাবনা জানিয়াও নীলের দাদন লইতেন। নীলকুঠি অপেক্ষা ম্যাজিষ্ট্রেটের বিচার-গৃহ দূরে অবস্থিত, অর্থের শ্রাদ্ধ করিয়া সেখানে পৌঁছিতে পারিলেও বিচারের দুর্গতি আশঙ্কার বিষয় ছিল। ক্রমে অবস্থাটা যখন সকলে হৃদয়ঙ্গম করিতেছিলেন, তখন গর্ব্বস্ফীত নীলকরেরা অত্যাচারী হইয়া দাঁড়াইলেন।
১৮১০ হইতে নীলকরদিগের অত্যাচারের বার্তা শুনা যায়। ঐ বৎসর ৪ জন নীলকরের লাইসেন্স কাড়িয়া লওয়া হয় এবং অন্য সকলে যাহাতে রাইয়তের উপর কোন মারপিট বা অত্যাচার না করে তজ্জন্য হুকুম জারি হয়। কিন্তু তবুও অত্যাচার থামে না। প্রজাকে জোর করিয়া দাদন দিবার যে অভ্যাস ১৮১০ অব্দে ছিল, তাহা ১৮৫৯ অব্দেও যায় নাই।[২৫] প্রথমে নীলকরেরা আত্মকলহ করিতেন, শেষে কলিকাতায় তাঁহাদের সমিতি (Indigo Planters’ Association) গঠিত হইলে সে বিবাদ থামিল, কিন্তু উঁহারা তালুকাদির মালিক হওয়ার পর রাইয়তের উপর অত্যাচার বাড়িল। তাহার ফলে খৃষ্টধর্ম্মে জাতি যাওয়ার ভয়ের মত, নীলকেও প্রজারা শত্রু মনে করিল। কথা উঠিল ‘জমির শত্রু নীল, কাজের শত্রু ঢিল (আলস্য), আর জাতির শত্রু পাদ্রী হীল।[২৬]
তখন হইতে প্রজারা নীলকরের বিরুদ্ধে অত্যাচারের অভিযোগ আনিতেন, সাহেবেরা চুক্তিভঙ্গের আপত্তি করিতেন। কিন্তু গবর্ণমেণ্ট গোলমাল মিটাইবার জন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থা করিলেন না। ১৮৩০ অব্দে এক আইন (Regulation V of 1830 ) পাশ হইল, তদ্বারা চুক্তিভঙ্গের জন্য ফৌজদারী মোকদ্দমা হইত; পাঁচ বৎসর পরে বেন্টিঙ্ক এ আইন তুলিয়া দিলেন। লর্ড মেকলের মতে দেওয়ানী আদালতেই চুক্তিভঙ্গ মামলা হওয়া স্থির হইল। মহামান্য হ্যালিডে যখন বাঙ্গালার প্রথম ছেট লাট হন, তখন তিনি এ সব বিষয়ে কিছুই মনোযোগ করিতেন না; এমন কি, তিনি নীল- প্রধান জেলায় নীলকর সাহেবকে সহকারী অবৈতনিক ম্যাজিষ্ট্রেট নিযুক্ত করিতে লাগিলেন (১৮৫৯)। সাধারণ লোকে ভাবিল বুঝি গবর্ণমেণ্টই নীলের অংশীদার। নীলকরেরা এই সুযোগ ধরিয়া অত্যাচারের মাত্রা বাড়াইলেন। উহা হইতে কিরূপে নীল-বিদ্রোহ উপস্থিত হইল, তাহাই এখন বলিব।
নীলের চাষে লাভ নাই, তাহা প্রজারা বুঝিলেন। তখন হইতে তাঁহারা নীল চাষ না করিয়া কাটাইবার চেষ্টা করিতেন। কুঠিয়াল সাহেবেরা নানাভাবে ভয় দেখাইয়া মারিয়া ধরিয়া অত্যাচার করিয়া তাঁহাদিগকে নীলবুননে বাধ্য করিতেন। এবং সাদা কাগজে একরার-নামা লেখাইয়া লইতেন।[২৭] সব সাহেব একরূপ ছিলেন না। তাঁহাদের মধ্যে আদর্শ ইংরাজ-চরিত্রের লোকও ছিলেন। আমরা এখানে শুধু অত্যাচারীর কথাই বলিতেছি। এই অত্যাচার যে কত প্রকারের ছিল, তাহা বলিবার নহে। রাইয়তের খেজুর বন কাটিয়া উপড়াইয়া তাহাতে নীলের ক্ষেত করা হইত; পলায়িত প্রজার ঘর ভাঙ্গিয়া ভিট্টার উপর নীলের চাষ করা হইত; এমন কি ঘর জ্বালাইয়া দিয়া উৎপাত করিয়া অবাধ্য রাইয়তকে তাড়াইয়া দেওয়া হইত। অনেক সময়ে কুঠির লোকেরা বিদ্রোহী প্রজার ঘটিবাটি গরুবাছুর ধরিয়া আনিত; -একবার বারাসাতের ম্যাজিষ্ট্রেট মহামান্য ইডেন সাহেব একটি কুঠি হইতে ২/৩ শত আবদ্ধ গরু খালাস করিয়া আনিয়াছিলেন,[২৮] কিন্তু নীলকরের ভয় এত বেশী ছিল যে, কয়েকদিনের মধ্যে লোকে নিজের গরু লইতে আসিতেও সাহসী হইতেছিলেন না। কুঠিতে কুঠিতে কয়েদ ঘর ছিল; চুক্তি ভঙ্গ করিলে রাইয়তদিগকে কুঠিতে ধরিয়া লইয়া নানা নবোদ্ভাবিত কৌশলে পীড়ন করিবার পর, কয়েদ করিয়া রাখা হইত। যশোহরের এক কুঠিতে গিয়া এক জয়েন্ট ম্যাজিষ্ট্রেট স্বয়ং কয়েদ হইতে কতকগুলি লোককে খালাস করিয়া দিয়া কুঠির লোকদিগকে শাস্তি দিয়াছিলেন।[২৯] কয়েদকরা লোকদিগের যাহাতে সন্ধান না মিলে, তজ্জন্য তাঁহাদিগকে নানা কুঠিতে ঘুরাইয়া লইত। এজন্য নীলকরেরা ‘চৌদ্দ কুঠির জল খাওয়াইবার’ ভয় দেখাইত।[৩০] কোন কোন হতভাগ্য আবদ্ধের যে একেবারেই সন্ধান হইত না, তাহাও ছোটলাট সাহেব বিশ্বাস করিয়াছিলেন।[৩১] মোল্লাহাটির ‘লালমোন’ (Larmour) সাহেবের আরও এক নূতন কীর্ত্তি ছিল; তাঁহার কুঠিতে রাইয়তদিগকে প্রহার করিবার জন্য আরও যে এক প্রকার নূতন লগুড় তৈয়ার করা হইয়াছিল, তাহার নাম ‘রামকান্ত’ বা ‘শ্যামচাঁদ’। এই শ্যামচাঁদের আঘাতে রাইয়তেরা জর্জরিত হইতেন। কুঠির লোকেরা প্রচার করিয়া দিয়াছিল যে, চুক্তিভঙ্গের শাস্তির জন্য সরকার হইতে এক ‘মুগুরের আইন’ পাশ হইতেছে, চুক্তিমত নীল না বুনিলে মুগুরের ঘা সহ্য করিতে হইবে।[৩২] এই মুগুরের আইন ও শ্যামচাঁদের ভয়ে অশিক্ষিত দরিদ্র রাইয়তেরা থরহরি কম্পবান হইতেন। নীল বুনিতে না চাহিলে ক্রোধান্ধ কুঠিয়ালেরা গুলি করিয়া খুন করিত, গ্রামকে গ্রাম উজাড় উৎসন্ন করিয়া দিত। এই জন্যই কথা উঠিয়াছিল : ‘মনুষ্যরক্তে কলঙ্কিত না হইয়া কোন নীলের বাক্স ইংল্যণ্ডে যাইত না।[৩৩] ইহার উপর আরও ছিল; ভারতীয় প্রজা সব সহ্য করেন, স্ত্রীকন্যার সম্ভ্রমহানি সহ্য করেন না। নীলকর সাহেবদিগের মধ্যে এমনও দুর্বৃত্ত ছিল, যাহারা জোর করিয়া কৃষককন্যাদিগকে ধরিয়া লইয়া কুঠিতে আনিয়া অপমান করিত।[৩৪] এই সব অত্যাচারের ফলে অবশেষে আগুন জ্বলিয়া উঠিল। বিশ বৎসর ধরিয়া অসহায় প্রজাকুল নীলের চাষ করিবে না বলিয়া নানা চেষ্টা করিতেছিলেন, কিন্তু নীলকরদিগের ছল বল হইতে নিষ্কৃতি পান নাই। এইবার যখন লারমুর প্রভৃতির অত্যাচার চরমে পৌঁছিল, সহৃদয় ইডেন সাহেবের পরওয়ানায় যখন তাঁহাদিগকে বুঝাইয়া দিল যে, নীলের চাষ করা না করা রাইয়তের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন, তখন তাঁহারা দলবদ্ধ হইয়া প্রতিজ্ঞা করিয়া বলিলেন, ‘প্রাণ থাকিতে তাহারা আর নীল বপন করিবে না’।[৩৫] সম্মিলিত প্রজাশক্তির এই কঠোর প্রতিজ্ঞা কেহ ভঙ্গ করিতে পারিল না। ১৮৫৮ অব্দে দেশময় নীল- বিদ্রোহ দেখা দিল।
এই সময়ে মান্যবর ইডেন সাহেব (The Hon’ble Ashley Eden) বারাসাতের ম্যাজিষ্ট্রেট ছিলেন। তিনি একজন সহৃদয়, স্বাধীনচেতা ও উচ্চমনা কর্মচারী; এই গুণেই তিনি পরে বঙ্গেশ্বর হইয়াছিলেন। প্রজাদের সঙ্গে নীলকর সাহেবদিগের গোলমালের সূচনা দেখিয়াই স্পষ্টই লিখিয়াছিলেন, প্রজাই জমির মালিক, নীলকরেরা নহে। প্রজার জমি জোর দখল করিবার তাহাদের কোন অধিকার নাই। নীলকরেরা যেখানে আইন অমান্য করিয়া সেরূপ করিবে, ম্যাজিষ্ট্রেটেরা সেখানে প্রজার স্বত্ব রক্ষা করিতে বাধ্য। ছোটলাটও এই মতের পরিপোষক হইলেন। সৌভাগ্যবতী মহারাণী ভিক্টোরিয়ার রাজ্য গ্রহণের সঙ্গে এদেশীয় শাসন-বিভাগে এক নবযুগের অবতারণা হইয়াছিল। বাংলার সৌভাগ্যফলে প্রসিদ্ধ গ্রান্ট মহোদয় (Sir J. P. Grant) তখন বঙ্গের মসনদে উপবিষ্ট এবং দয়ার সাগর লর্ড ক্যানিং ভারতের রাজপ্রতিনিধি। কমিশনার সাহেব ইডেনের মত-বিরুদ্ধে দাঁড়াইলে কি হয়, ছোটলাট গ্রান্ট সে মতের অনুমোদন করিলেন এবং ক্যানিং গ্রান্টের সহিত একমত হইলেন। বাস্তবিকই এই ক্যানিং-গ্রাণ্ট-ইডেনের আবির্ভাবের ফলে নীলকরের উৎপাত বন্ধ হইয়াছিল। এজন্য বঙ্গবাসীরা এই ত্রিমূর্ত্তির নিকট চিরকৃতজ্ঞ।
১৮৫৯, ২০শে ফেব্রুয়ারী তারিখ ইডেন সাহেব বাঙ্গালা ভাষায় এক রোবকারী রচনা করিয়া সাধারণকে জানাইয়া দিলেন যে, ‘নীলের জন্য চুক্তি করা বা না করা প্রজাদিগের সম্পূর্ণ ইচ্ছাধীন।’ নদীয়ার ম্যাজিষ্ট্রেট সহৃদয় হর্শেল (W. J. Herschel) সাহেব তাঁহার পন্থানুসরণ করিলেন। গবর্ণমেণ্টের সম্মতি মত প্রজাদিগকে এই রোবকারীর নকল দিবার ব্যবস্থা হইল। প্রজারা উহাই চাহিতেছিলেন; এখন শত শত লোকে নকল লইয়া উহার প্রকৃত মর্ম্ম সর্ব্বত্র রাষ্ট্র করিয়া দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁহাদিগকে বলভরসা দিয়া উদ্রিক্ত করিবার লোকের অভাব হইল না। তখন প্রজারা ‘যোট’ বান্ধিয়া নীলের চাষ বন্ধ করিয়া দিলেন। যশোহরের অন্তর্গত কাঠগড়া কানসরণের মধ্যেই এই চাষ বন্ধ করিবার ব্যাপার প্রথম আরম্ভ হয়। এই সঙ্গে নীল-বিদ্রোহের প্রকৃত কারণগুলি গণনা করিতে পারা যায় :
১. নীলের চাষ লাভজনক নহে বলিয়া প্রজার অনিচ্ছা।
২. ডালহৌসির শাসনকালে খাদ্যদ্রব্যের অত্যন্ত মূল্যবৃদ্ধি হইলেও নীলকরেরা প্রজাদিগের নীলের লভ্য বাড়াইলেন না, এজন্য প্রজাদিগের অসন্তুষ্টি।
৩. বাধ্য করিয়া দাদন দেওয়ার পদ্ধতিতে প্রজার বিরক্তি
৪. নীলকরের অত্যাচার ও অবিচারের জন্য নীলচাষের প্রতি ঘৃণা ও ভয়।
৫. ইডেনের ইস্তাহার হইতে প্রজারা জানিলেন যে, নীলের চাষ করা না করা তাঁহাদের ইচ্ছাধীন।
৬. গ্রান্ট মহোদয় প্রজার পক্ষে মত প্রচার করিলে গুজব রটিল যে, গবর্ণমেণ্ট নীলচাষের বিরোধী ।
৭. নায়কদিগের উত্তেজনা ও আশ্বাস বাণী।
এই সকল কারণ সমবেত হইয়া নীলবিদ্রোহের সৃষ্টি করিয়াছিল।
যশোহরের অন্তর্গত চৌগাছা গ্রামে বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস বাস করিতেন। তাঁহারা পূর্ব্বে নীলকুঠির দেওয়ান ছিলেন। কিন্তু কুঠিয়ালদিগের অত্যাচার দেখিয়া তাঁহাদের হৃদয় কাঁদিয়া উঠিল; তাঁহারা কার্য্যে ইস্তাফা দিয়া প্রজার পক্ষে দণ্ডায়মান হইলেন, গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া প্রকৃত অবস্থা বুঝাইয়া দিয়া প্রজাদিগকে উদ্ভিক্ত করিয়া তুলিলেন। বহ্নি অনেকদিন হইতে ধুমায়িত হইতেছিল, কিন্তু এই চৌগাছা হইতে উহা সৰ্ব্বপ্রথম জ্বলিল। (চৌগাছা কাঠগড়া কানসরণের অন্তর্গত)।[৩৬] দুই বৎসর মধ্যে এই বহ্নি সমস্ত দেশ জ্বালাইয়া দিল। বিশ্বাসদিগের কিছু সঙ্গতি ছিল; যাহা ছিল সব এই পাছে ব্যয় করিলেন। প্রজার ‘যোট’ ভাঙ্গিবার জন্য নীলকরেরা ক্ষেপিয়া গেল; বিশ্বাসেরা বরিশাল হইতে লাঠিয়াল আনিলেন, দেশের লোককে লাঠি ধরাইলেন; বঙ্গের মানসম্ভ্রম রক্ষার উপাদানরূপে লাঠি আবার উঠিল। নীলকরের হাজার লোক আসিয়া বিষ্ণুচরণের বিদ্রোহী গ্রাম সহসা আক্রমণ করিল, কত রক্তপাত হইল, কিন্তু বিশ্বাসদিগকে ধরিতে পারিল না। তাঁহারা রাত্রির অন্ধকারে গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে ঘুরিতেন, গ্রামের পর গ্রাম জাগাইতে লাগিলেন। রাইয়তেরা কোন নীল বুনিলেন না, দেড় বৎসর মধ্যে কাঠগড়া কারবার বন্ধ হইয়া গেল, আর খুলিল না। নিঃস্ব প্রজার নামে নালিশ হইলে উঁহারা দুইজনে তাঁহার জরিমানা বা দাদনের টাকা এবং মোকদ্দমার খরচা দিতেন, কেহ জেলে গেলে তাঁহার পরিবার পালন করিতেন। এইরূপে তাঁহারা সর্ব্বস্বান্ত হইলেন। হিসাব করিয়া দেখিলেন, তাঁহাদের সর্ব্বস্ব ১৭ হাজার টাকা। টাকা সামান্য বটে, কিন্তু টাকার অনুপাতে অনুষ্ঠিত কাজের মূল্য অনেক বেশী।[৩৭]
শুধু চৌগাছার বিশ্বাসেরা নহেন, দেশমধ্যে এমন অনেক লোকের আবির্ভাব হইয়াছিল। এই বিদ্রোহ স্থানিক বা সাময়িক নহে; যেখানে যতকাল ধরিয়া বিদ্রোহের কারণ বর্ত্তমান ছিল, সেখানে ততকাল ধরিয়া গোলমাল চলিয়াছিল। উহার নিমিত্ত যে কত্ব গ্রাম্যবীর ও নেতার উদয় হইয়াছিল, ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তাঁহাদের নাম নাই। কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে অনেকে অবস্থানুসারে যে বীরত্ব, স্বার্থত্যাগ ও মহাপ্রাণতার পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহার কাহিনী শুনিবার ও শুনাইবার জিনিস যাঁহারা তাহার চাক্ষুষ বিবরণ দিতে পারিতেন, আজ ৬৪ বৎসর পরে তাঁহাদের অধিকাংশই কাল- কবলিত। এখনও গল্পগুজবে যাহা আছে, শীঘ্রই তাহা লুপ্ত হইবে। প্রাচীন যশোহরের মানচিত্রে কতশত গ্রামে নীলকুঠির চিত্র আছে; এখন উহার অনেক ভগ্নস্তূপ ইমারতের গায়ে বা রাস্তার খোয়ায় আত্মগোপন করে নাই। ঐ সকল কুঠির তিরোভাবের সঙ্গে কিছু ঐতিহাসিকতা বিজড়িত আছে। হয়ত উহাদের পার্শ্ববর্ত্তী ক্ষেত্র সকল একদিন যোদ্ধৃ-রক্তে রঞ্জিত হইয়াছিল। কিন্তু কে আজ সেই যুদ্ধক্ষেত্রের তালিকা নির্ণয় করিবে? লড়াই ত অনেক হইয়াছিল, আজ কয়জনে তাহার খবর রাখে? যাহা কিছু সংগ্রহ করা যায়, আমার এই ইতিহাসে তাহারই বা স্থান কোথায়? এখনও কৃষকের মুখে গ্রাম্য সুরে শুনিতে পাওয়া যায় :
“মোল্লাহাটির লম্বালাঠি, রইল সব হুদোর আঁটি,
কলকাতার বাবু ভেয়ে, এল সব বজরা চেপে, লড়াই দেখবে ব’লে।”—
ইত্যাদি লড়াই হইয়াছিল, কত লোক কত স্থানে হত বা আহত হইয়াছিল, তাহার খবর নাই। খবর এইটুকু আছে, তাঁহাদের যন্ত্রণা ও মৃত্যু সফল হইয়াছিল, জেদ্ বজায় ছিল। মোল্লাহাটির যে লম্বা লাঠির বলে নীলকরেরা বাঘের মত দেশ-শাসন করিতেন, প্রজারা চাষ বন্ধ করিলে সে লাঠির আঁটি পড়িয়া রহিল, উহা ধরিবার লোক জুটিল না। নীলকরের উৎপাত বন্ধ হইয়া আসিল। এই সময়ে বিষ্ণুচরণের মত দেশ-মাতৃকার আরও কত সুসন্তান জাগরিত হইয়া দেশময় তুমুল আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছিলেন। উঁহাদের সকলের কথা জানি না; যাহাদের কথা জানি, তন্মধ্যে পলুয়া- মাগুরার শিশিরকুমার ঘোষ, সাধুহাটির জমিদার মথুরানাথ আচার্য্য, চণ্ডীপুরের জমিদার শ্রীহরি রায় প্রভৃতির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। যাঁহারা কার্যক্ষেত্র হইতে দূরে থাকিয়া লেখনীর সাহায্যে দীনহীন প্রজাবর্গের বন্ধু হইয়াছিলেন, তন্মধ্যে চৌবেড়িয়ার ‘নীল-দর্পণ’ প্রণেতা দীনবন্ধু মিত্র এবং কলিকাতার ‘হিন্দু-পেট্রিয়ট’-সম্পাদক হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাম চিরস্মরণীয় হইয়াছে।
১৮৫৮ অব্দে শিশিরকুমারের বয়স ১৮ বৎসর মাত্র। প্রজা নীল বুনিবে না বলিয়া ‘যোট’ করিয়াছে শুনিয়া, তিনি আনন্দে আটখানা হইয়াছিলেন। সেই অজাতশ্মশ্রু যুবক ‘পেট্রিয়ট’ পত্রের জন্য জ্বালাময়ী ভাষায় নীলকরের অত্যাচার প্রসঙ্গ লইয়া যে সব ইংরাজী প্রবন্ধ লিখিতেন, তাহাতে কর্তৃপক্ষের তাক্ লাগিয়াছিল।[৩৮] যশোহরের ম্যাজিষ্ট্রেট মোলনী (Molony) ও স্কীনার (Skinner) সাহেব তাঁহাকে কারাভয় দেখাইলেন, কিন্তু লেখা ছাড়াইতে পারিলেন না।[৩৯] তিনি প্রজাদিগকে লইয়া গ্রামে গ্রামে ঘুরিতেন, নীলের চাষ যে কত অপকারী উহা বন্ধ করা যে আইনবিরুদ্ধ অপরাধ নহে, তাহা বুঝাইয়া দিতেন। ১৮৫৯ হইতে রাইয়তী নীলের চাষ অনেক স্থলে বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। বিদ্রোহী প্রজারা শত নির্যাতনের লক্ষ্যস্থল হইয়াও অটল রহিলেন। গ্রামের সীমায় একস্থানে একটি ঢাক থাকিত; নীলকরের লোকে অত্যাচার করিতে গ্রামে আসিলে, কেহ সেই ঢাক বাজাইয়া দিতেন, অমনি শত শত গ্রাম্য কৃষক লাটিসোটা লইয়া দৌড়িয়া আসিতেন। নীলকরের লোকেরা প্রায়ই অক্ষত দেহে পলাইতে পারিত না। সম্মিলিত প্রজাশক্তির বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হওয়া সহজ ব্যাপার নহে। প্রজাদের নামে অসংখ্য মোকদ্দমা হইত, তাঁহারা জেলে যাইতেন। বিচারালয়ে তাঁহাদিগকে সমর্থন করিবার জন্য লোক জুটিত না। বৃটিশ ইণ্ডিয়ান সভা হইতে ২/৩ জন মাত্র মোক্তার পাঠান হইয়াছিল, তাঁহারা সর্ব মোকদ্দমার কার্য্য করিতে পারিতেন না। এই সময়ে শিশিরকুমার তাঁহার অঞ্চলে প্রজার একমাত্র বন্ধু ছিলেন; তিনি নানাভাবে উঁহাদিগকে সাহায্য করিতেন। তিনিই প্রজাদিগকে সত্যাগ্রহ শিখাইয়াছিলেন; কষ্ট পাইলে, নিরন্ন থাকিলে, সৰ্ব্বস্বান্ত হইলেও তাঁহারা জেদ্ ছাড়িতেন না। তাঁহারা হাসির সঙ্গে কারাবরণ করিয়া লইতেন, ভগবানের নাম করিয়া সকল দুঃখ নীরবে সহ্য করিতেন। “নীলকরের অত্যাচারের হস্ত হইতে প্রজাগণকে রক্ষা করিবার জন্যই যেন শিশিরকুমার ভগবান কর্তৃক প্রেরিত হইয়াছেন, এই মনে করিয়া কৃষকগণ তাঁহাকে দেবতার ন্যায় ভক্তি করিত; তাহারা তাঁহাকে সিদ্ধপুরুষ মনে করিয়া ‘সিন্নিবাবু’ নামে অভিহিত করিয়াছিল।”[৪০] গবর্ণমেণ্ট হইতে শিশিরকুমারকে ধরিবার চেষ্টা চলিয়াছিল। কিন্তু তাঁহার বিরুদ্ধে প্রবল অভিযোগ স্থাপিত হইতে পারিতেছিল না। পুলিস ইনস্পেক্টর প্রসন্নচন্দ্র রায়ের উপর তদন্তের ভার পড়িল; তিনি রিপোর্ট করিলেন, শিশিরকুমার নীল বুনিতে নিষেধ করিতেছেন, ম্যাজিষ্ট্রেটও তাঁহাকে ফৌজদারী সোপর্দ করিবার জন্য গবর্ণমেন্টের হুকুম চাহিলেন; কিন্তু কৌশলী যশু’রে বীরকে গ্রেপ্তার করার সুযোগ পাওয়া গেল না, কারণ তিনি কখনও আইন-বিগর্হিত কার্য্য করিতে প্রজাদিগকে পরামর্শ দেন নাই। সিপাহীবিদ্রোহের অব্যবহিত পরে নানাসাহেব ও তাঁতিয়া তোপীর নাম দেশময় ছড়াইয়া পড়িয়াছিল; নীল-বিদ্রোহী কৃষকেরাও তাঁহাদিগের নেতাদিগকে এইসব নামে অভিহিত করিতেন।
হরিশ্চন্দ্র দেশহিতৈষী ‘পেট্রিয়ট’-পত্রে যে বহ্নি জ্বালাইয়াছিলেন, শিশিরকুমার প্রভৃতি কয়েকজনে মফস্বল হইতে উহার ইন্ধন যোগাইতেন।[৪১] হরিশচন্দ্র সামান্য বেতনের সরকারী কর্ম্মচারী মাত্র ছিলেন, কিন্তু তাঁহার স্বয়ংসিদ্ধ কলমের মুখে যে জ্বলন্ত ভাষা উদগীরিত হইত এবং বিপ্লবের যুগে তিনি যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহাতেই গবর্ণমেণ্ট মুগ্ধ হইয়াছিলেন। তাঁহার চেষ্টায় বৃটিশ ইণ্ডিয়ান এসোসিয়েসন প্রজার পক্ষ অবলম্বন করেন। তিনি শুধু সম্পাদকতা করিতেন না, রোমান ট্রিবিউনের মত তাঁহার গৃহদ্বার সর্ব্বদা অনর্গল থাকিত, সে গৃহ-প্রাঙ্গণ নিত্য অসংখ্য নীলকর-পীড়িত রাইয়তের অশ্রুজলে অভিষিক্ত হইত। তিনি উঁহাদিগকে আশ্রয় দিতেন, অন্নদান করিতেন। অবশেষে অনিয়মিত গুরুপরিশ্রমে তাঁহার স্বাস্থ্য ভাঙ্গিয়া পড়িল, তিনি ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হইয়া অকালে কালগ্রাসে পতিত হইলেন। কিন্তু তৎপূর্ব্বেই তাঁহার স্বপ্ন সফল হইয়াছিল।
পূর্ব্বোক্ত সিন্দুরিয়া ও জোড়াদহের কার্য্যাধ্যক্ষ জর্জ ম্যানেয়ার সাহেবের অপব্যবহারে বিরক্ত হইয়া সাধুহাটির জমিদার মথুরানাথ আচার্য্য এবং তাঁহার অন্যতম সরিক দিক্পতিবাবু উত্তেজিত কৃষকদিগের পক্ষাবলম্বন করেন, তাঁহাদিগকে উদ্রিক্ত করিয়া দলবদ্ধ করেন। কথিত আছে, সেই বিদ্রোহকালে একস্থানে প্রায় ৩০ হাজার লোক সমবেত হইয়াছিলেন। কুঠিয়ালের লোকেরা কিছুতেই তাঁহাদিগকে হটাইতে পারে নাই। নীলকরের অত্যাচারের ফলে বিদ্রোহ হয় বটে, কিন্তু বিদ্রোহের সময়ে উদ্রিক্ত প্রজারা নীলকরের উপর কম অত্যাচার করেন নাই। মথুরানাথের প্রজারা অনেক নীল-কর্মচারীর বাড়ীঘর লুঠ-তরাজ ও তাঁহাদিগকে যথেষ্ট লাঞ্ছনা দিয়াছিলেন। অবশেষে ম্যানেয়ার মথুরানাথের বাড়ীতে গিয়া তাঁহার শরণাপন্ন হইয়া অতিকষ্টে রাইয়তদিগকে উপশান্ত করেন। নদীয়ার অন্তর্গত চুয়াডাঙ্গা মহকুমায় যে বিদ্রোহ হয়, তাহার প্রধান নেতা ছিলেন চণ্ডীপুরের জমিদার শ্রীহরি রায়। তিনি কমিশনে সাক্ষ্য দেন।
১৮৬০ অব্দের প্রারম্ভ হইতে বিদ্রোহের অবস্থা গুরুতর হইয়া দাঁড়াইল। লর্ড ক্যানিং সে সংবাদে অত্যন্ত ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। কোন নির্বোধ নীলকরের বন্দুকের মুখে আগুন জ্বলিলে তদ্বারা বঙ্গের সমস্ত নীলকুঠি ভস্মমাৎ হইবে, ইহাই তাঁহার আশঙ্কা হইল।[৪২] এই বৎসর মহামতি গ্রান্ট যশোহরের উত্তরভাগে কুমার ও কালীগঙ্গা নদীপথে ৬০/৭০ মাইল ভ্রমণ করিবার সময়ে ১৪ ঘণ্টাকাল উভয়কূলের শ্রেণিবদ্ধ, সুবিচারপ্রার্থী অত্যাচারিত প্রজাপুঞ্জের আকুল আর্তনাদে ব্যাকুলিত হইয়া দুরবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করিয়াছিলেন।[৪৩]
উহার পূর্ব্বেই বঙ্গীয় গবর্ণমেণ্ট ৩১শে মার্চ তারিখের ১১শ আইন (Act XI of 1860) অনুসারে নীলকরের অত্যাচার বিষয় তদন্ত করাইবার জন্য পাঁচজন সদস্য লইয়া এক ‘ইণ্ডিগো কমিশন’ গঠিত করেন। যশোহরের ভূতপূর্ব্ব জজ-ম্যাজিষ্ট্রেট সীটন-কার ( W. S. Seton-Karr) সাহেব উহার সভাপতি হন। সরকার পক্ষ হইতে তিনি এবং টেম্পল (R. Temple) সাহেব, প্ৰজা ও মিশনরী পক্ষ হইতে রেভারেণ্ড সেল (Rev. J. Sale) সাহেব, নীলকর সভার পক্ষ হইতে ফার্গুসন (W. T. Fergusson) সাহেব এবং বৃটিশ ইণ্ডিয়ান সভা হইতে জমিদারদিগের প্রতিনিধি স্বরূপ চন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায় মহাশয় এই ‘কমিশনের’ সদস্য ছিলেন। এই কমিশন ১৮ই মে হইতে ১৪ই আগষ্ট পর্যন্ত ১৩৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করিয়া ২৭শে আগষ্ট রিপোর্ট দাখিল করেন। সাক্ষীদিগের মধ্যে ১৫ জন সরকারী কর্মচারী, ২১ জন নীলকর, ৮ জন পাদরী, ১৩ জন জমিদার বা তালুকদার এবং ৭৭ জন রাইয়ত ছিলেন। উঁহাদের জবানবন্দী হইতে ধীর গম্ভীর নিরপেক্ষ সমালোচনা দ্বারা কমিশনের মন্তব্যগুলি লিপিবদ্ধ হইয়াছিল।[৪৪] ফার্গুসন সাহেব কোন কোন বিষয়ে একটু ভিন্ন মতাবলম্বী হইলেও নীলকরের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ ছিল, কমিশন তাহার অধিকাংশই মোটামুটি স্বীকার করেন এবং স্পষ্টভাবে নির্দ্দেশ করেন যে, “নীলকরদিগের ব্যবসায়-পদ্ধতি উদ্দেশ্যতঃ পাপজনক, কাৰ্য্যতঃ ক্ষতিকারক এবং মূলতঃ ভ্রমসঙ্কুল।’[৪৫] পরবর্ত্তী ডিসেম্বর মাসে গ্রান্ট মহোদয় এই রিপোর্ট সম্বন্ধে স্বকীয় সুদীর্ঘ মন্তব্য সঙ্কলিত করেন। উহাতে নীলকরদিগের অপকর্ম্মের ধারাবাহিক বিবরণ পাওয়া যায়। ছোটলাট স্পষ্টতঃ স্বীকার করেন, ‘বাঙ্গালার প্রজা কৃতদাস নহে, পরন্তু প্রকৃতপক্ষে জমির স্বত্ত্বাধিকারী। তাহাদের পক্ষে এরূপ ক্ষতির বিরোধী হওয়া বিস্ময়কর নহে। যাহা ক্ষতিজনক তাহা করাইতে গেলে অত্যাচার অবশ্যম্ভাবী; এই অত্যাচারের আতিশয্যই নীলবপনে প্রজার আপত্তির মুখ্য কারণ।
কমিশন বা ছোটলাট কোন নূতন আইন প্রণয়ন করিবার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন নাই। তবে প্রচলিত আইন যাহাতে চলে, অত্যাচার অবিচার ও ভুল ধারণা যাহাতে দূরীভূত হয়, তজ্জন্য কয়েকটি ইস্তাহার প্রচার করা হয়। তদ্বারা সাধারণকে জানাইয়া দেওয়া হয় যে, (১) গবর্ণমেণ্ট নীল চাষের পক্ষে বা বিপক্ষে নহেন, (২) অন্য শস্যের মত নীলচাষ করা বা না করা সম্পূর্ণরূপে প্রজার ইচ্ছাধীন, এবং (৩) আইন অমান্য করিয়া অত্যাচার বা অশান্তির কারণ হইলে নীলকর বা বিদ্রোহী প্রজা কেহই কঠোর শাস্তির হস্তে নিস্তার পাইবেন না। ইহার পর নূতন আইনানুযায়ী (Act XLII of 1860) বিচারের সুবিধার জন্য স্থানে স্থানে মহকুমা স্থাপিত হইল এবং সবর্বত্র পুলিসের শক্তিবৃদ্ধি করা হইল। প্রজারা দলবদ্ধ হইয়া ঐ বৎসর নীলের হৈমন্তিক চাষ জোর করিয়া বন্ধ করিবেন শুনিয়া যশোহর ও নদীয়ায় দুইদল পদাতিক সৈন্য পাঠান হইল এবং দুইখানি রণতরী দুই জেলার নদীপথে ভ্রমণ করিতে থাকিল। প্রজাদিগের ক্রোধ তখনও যায় নাই, তাঁহারা দলবদ্ধ হইয়া নীলকর- তালুকদারদিগের খাজানা বন্ধ করিয়া দিলেন; তজ্জন্য গবর্ণমেণ্ট ২/১ জন নীলকরকে লাটের খাজনা দাখিল করিবার জন্য কিছু কিছু সময় দিতে বাধ্য হন। পরবৎসর দেশের অবস্থা ক্রমশঃ শান্তভাব ধারণ করিল; নীলকরেরা ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া ক্রমশঃ অনেকে ব্যবসায়ান্তর গ্রহণে ব্রতী হইলেন।
কমিশনের রিপোর্ট বাহির হইতে না হইতে ঐ বৎসর (১৮৬০ খৃঃ, ১২৬৭ সাল) আশ্বিনমাসে ‘নীলদর্পণ’ নাটক ঢাকা হইতে প্রকাশিত হয়। উহাতে গ্রন্থকার দীনবন্ধু মিত্রের নাম ছিল না, কিন্তু শীঘ্রই সে নাম প্রকাশিত হইয়া পড়িল। এই নাটকে দীনবন্ধুর তুলিকাপাতে নীলকর-পীড়িত বাঙ্গালা দেশের এক জীবন্ত চিত্র প্রকটিত হইয়াছে। মোল্লাহাটির কছে চৌবেড়িয়া গ্রামে দীনবন্ধুর বাড়ী, নিৰ্যাতিত প্রজাবৃন্দ তাঁহার প্রতিবেশী, ডাকবিভাগের চাকরীর জন্য নদীয়া যশোহরের সর্ব্ববিধ সংবাদ সংগ্রহ করা তাঁহার পক্ষে সহজ, তিনি নিজে নাট্যকলায় সিদ্ধহস্ত সুরসিক লেখক। নাটকীয় চরিত্রগুলির ভাষা ও ভাবভঙ্গি এত স্বাভাবিক ও মর্ম্মস্পর্শী হইয়াছিল, যে তাহার সন্ধান অব্যর্থ হইল। কয়েক মাস মধ্যে যখন এই পুস্তক পাদরী লঙ্ (Rev. James Long) সাহেবের তত্ত্বাবধানে কবিবর মাইকেল মধুসূদন দত্তের নিপুণ লেখনীর সাহায্যে ইংরাজীতে ভাষান্তরিত হইল, তখন নীলকর মহলে হুলস্থুল পড়িয়া গিয়াছিল। তখন ক্ষিপ্ত নীলকর সম্প্রদায় অচিরে লঙ্ সাহেবের বিরুদ্ধে ভীষণ মোকদ্দমা আনিয়াছিলেন; সুপ্রীম কোর্টের বিচারে লর একমাস কারাদণ্ড ও সহস্র টাকা অর্থদণ্ড হইল। জরিমানার টাকা স্বনামধন্য কালীপ্রসন্ন সিংহ তৎক্ষণাৎ কোর্টে দাখিল করিলেন। পথে ঘাটে শস্যক্ষেতে মর্ম্মব্যথিত কৃতজ্ঞ কৃষকের করুণ কণ্ঠে স্বভাব কবির গ্রাম্য সুরে গান শুনা গিয়াছিল :
‘নীল-বাঁদরে সোনার বাঙ্গালা করলো এবার ছারেখার!
অসময়ে হরিশ ম’লো, লংএর হল কারাগার—
প্রজার আর প্রাণ বাঁচানো ভার।’
নীলদর্পণ যতই পঠিত ও প্রচারিত হইল, নীলকরের অত্যাচার বৃত্তান্ত ততই দেশের সকল স্তরে রাষ্ট্র হইয়া পড়িতে লাগিল। শীঘ্রই ‘নীলদর্পণ’ বহু ইয়োরোপীয় ভাষায় অনূদিত হইয়া গেল। তখন পর্যন্ত (বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় বলিতে গেলে,) ‘এই সৌভাগ্য বাঙ্গালার আর কোন গ্রন্থেরই ঘটে নাই। গ্রন্থের সৌভাগ্য যতই হউক, কিন্তু যে যে ব্যক্তি ইহাতে লিপ্ত ছিলেন, প্রায় তাঁহারা সকলেই কিছু কিছু বিপদগ্রস্ত হইয়াছিলেন। ইহার প্রচার করিয়া লঙ্ সাহেব কারাবদ্ধ হইয়াছিলেন, সীটনকার অপদস্থ হইয়াছিলেন।[৪৭] ইহার ইংরাজী অনুবাদ করিয়া মাইকেল মধুসূদন দত্ত গোপনে তিরস্কৃত ও অবমানিত হইয়াছিলেন, এবং শুনিয়াছি, শেষে তাঁহার জীবননির্ব্বাহের উপায় সুপ্রীম কোর্টের চাকুরী পর্য্যন্ত ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। গ্রন্থকর্তা নিজে কারাবদ্ধ বা কৰ্ম্মচ্যুত হয়েন নাই বটে, কিন্তু তিনি ততোধিক বিপদগ্রস্ত হইয়াছিলেন।’[৪৮] নীলদর্পণ রচনা কালে একদা মেঘনা পার হইবার সময় দীনবন্ধুর নৌকা জলমগ্ন হয়, তিনি কোনক্রমে উহার পাণ্ডুলিপিখানি মাত্র সঙ্গে লইয়া দৈবানুগ্রহে সে যাত্রা রক্ষা পান।
নীলকারদিগের প্রতিপত্তিও কম ছিল না, তাহারা প্রতিহিংসাও কম লন নাই। গ্রান্টের শাসনকালে তাহাদের চরিত্র-কলঙ্ক প্রকাশিত হইয়া পড়ায় তাহারা হাড়ে চটিয়া যান। উহারা ‘ইংলিশম্যান’ ও ‘হরকরা’ প্রভৃতি সংবাদপত্রের সাহায্যে নানা ছদ্মনামে গ্রাণ্ট হইতে ইডেন পর্যন্ত বহুজনের উপর অজস্র গালিবর্ষণ করিয়া গায়ের জ্বালা মিটাইয়াছিলেন। এই সময়ে সরকারী কাগজপত্রের মধ্যে ম্যাকআর্থার নামক একজন যশোহর জেলার নীলকরের কুচরিত্র সম্বন্ধীয় চিঠি প্রকাশিত হয় বলিয়া নীলকরগণ মহামান্য গ্রান্টের নামে ১০ হাজার টাকার দাবিতে এক মানহানির মোকদ্দমা রুজু করেন। তখন এদেশীয় আদালতে লাট সাহেবদেরও বিচার হইত। স্যর বার্ণিস পিককের (চিফ্-জজ্) বিচারে ঐ মোকদ্দমায় লাটসাহেবের নামমাত্র একটাকা অর্থদণ্ড হইয়াছিল। কাচিকাটা কুঠির আর্চিবল্ড হিলস্ সাহেবের কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি; তৎকর্তৃক স্ত্রীলোকের উপর অত্যাচার কাহিনী ‘পেট্রিয়টে’ প্রকাশিত হয় বলিয়া হিলস্ সাহেব হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নামে মানহানির মোকদ্দমা উপস্থিত করেন; অকস্মাৎ অকালে হরিশ্চন্দ্রের মৃত্যু হইলেও উদ্ধার নাই, তাঁহার স্ত্রীর নামে মোকদ্দমা চলিয়াছিল।
এইরূপ বহুবৎসর ধরিয়া বিলাতে ও এদেশে নীলকরগণ নানাভাবে তাহাদের ব্যবসায়ের শত্রুদিগের উপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করিতেছিলেন। কিন্তু নীলের ব্যবসায়ে আর উন্নতি হইল না। কমিশনের নির্দেশমত নীলগাছের দর টাকায় ৪ বাণ্ডিল রহিয়া গেল। বিদ্রোহের দুই বৎসর যশোহরের কোথায়ও নীলের চাষ হয় নাই; বিদ্রোহ থামিলে আবার সকলে নীল বুনিল। যে সব কুঠির সাহেবেরা উগ্রমূর্তি ধরিয়াছিলেন, তথায় নীলের চাষে আর সুবিধা হইল না। মোল্লাহাটির প্রধান কার্য্যকারক বংশীবদন সরকার পুরাতন বীজ বপন করিবার ব্যবস্থা করায় নীলের গাছ উঠিল না। বংশীবদনের ত চাকরী গেলেই, অধিকন্তু ঐ কানসরণের সাহেবেরা শীঘ্রই কারবার বন্ধ করিলেন। কাঠগড়া কানসরণ মোটেই খুলিল না। যে সব কুঠির সাহেবেরা আবার প্রজার সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া চলিতে লাগিলেন, সেখানে রাইয়তেরা অন্ততঃ কতক জমিতে আবার নীলের চাষ করিলেন। হাজরাপুরের টুইডী সাহেবের প্রজাগণ বিদ্রোহের দুই বৎসর নীলের চাষ না করিলেও বিদ্রোহী হন নাই। নীলের কুঠি চলিতে লাগিল বটে, কিন্তু জোর করিলে চাষ বৃদ্ধি হইত না। উৎপন্নের পরিমাণ হ্রাস হওয়ায় কারবারে লোকসান হইতেছিল, তাই ক্রমে অনেক কুঠি বন্ধ হইতে লাগিল।
আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি, ১৮৪৯ হইতে ১৮৫৯ পর্য্যন্ত দশবৎসর মধ্যে গড়ে প্রতিবর্ষে যশোহর হইতে ১০,৭৯১ মণ নীল উৎপন্ন হইত। তখনকার হিসাবে উহার জন্য ১০৩ বর্গমাইল জমির চাষ লাগিয়াছিল।[৪৯] বিদ্রোহের ১০ বৎসর পরে অর্থাৎ ১৮৭০ অব্দে ওয়েষ্টল্যাণ্ড সাহেবের হিসাবে ঐ চাষ পৌঁছে পঁচাআশি বর্গমাইল দাঁড়াইয়াছিল, এবং ১৮৭২-৭৩ অব্দে রামশঙ্কর সেনের রির্পোটানুসারে উহা ৪৯ বর্গমাইলে আসিয়াছিল। এইরূপে চাষের পরিমাণ আস্তে আস্তে কমিতেছিল। এমন সময়ে ১৮৮৯ অব্দে পুনরায় নীল-বিদ্রোহ উপস্থিত হইল।
এই দ্বিতীয় বিদ্রোহ সৰ্ব্বত্র হয় নাই; ইহা প্রধাতনঃ যশোহরের উত্তরভাগে বিজলিয়া ডিভিসনে সীমাবদ্ধ ছিল। বিজলিয়া কুঠির অধ্যক্ষ ডম্বল (Durup De Dambal) সাহেবের অত্যাচারই ইহার প্রধান কারণ। ঐ কুঠির অধীন ৪৮ গ্রামের লোকে দলবদ্ধ হইয়া নীল বপন বন্ধ করিলেন। কৃষক ও জোতদারেরা একত্র হইয়া ষষ্টীবরের জমিদার বঙ্কবিহারী ও তৎকনিষ্ঠ বসন্তকুমার মিত্র মহাশয়কে নেতৃত্ব গ্রহণ করাইলেন। ক্ষিপ্ত কৃষকেরা সাহেবকে আক্রমণ ও নির্যাতন না করিয়া তৃপ্ত হইলেন না, আরও কত উপদ্রব ঘটাইলেন, তাহা বলিবার স্থান নাই। ডম্বল সাহেব রামনগর ও বাবুখালি কানসরণের অংশীদার এবং চাউলিয়া কুঠির অধ্যক্ষ ছিলেন। এজন্য বিনোদপুর অঞ্চলেও এই দ্বিতীয় বিদ্রোহ বিস্তারিত হইয়াছিল। তখন যাঁহারা প্রজার পক্ষে দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে উডুবার কেদারনাথ ঘোষ, ঘুল্লিয়ার আশুতোষ গাঙ্গুলী, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় ও উকীল পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং নারায়ণপুরের বিশ্বেশ্বর মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি কয়েকজনের নাম উল্লেখ করিতে পারি।[৫০]
এই বিদ্রোহের কয়েকটি কারণ নির্দ্দেশ করা যায় :
১. এই সময়ে পাট প্রভৃতির মূল্যবৃদ্ধি হওয়ায় উহার চাষ লোভনীয় হয়; প্রজাগণ অনিচ্ছাসত্ত্বে নীল চাষ করিয়া যাহা আয় করিতেন, তদ্বারা জীবিকার সংস্থান হইত না।
২. ডম্বল সাহেবের অপব্যবহারে মাগুরা-ঝিনাইদহের লোক বিরক্ত ও উদ্ভিক্ত হইয়াছিলেন।
৩. ত্রিশবৎসর পূর্ব্বে যে মূল্যে নীলগাছ বিক্রয় করিলে কিছু মজুরী থাকিত, এ সময় তাহা থাকিত না।
৪. ত্রিশবৎসরের আন্দোলনের ফলে এই জাতীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইবার মত একটা লোকমত দেশমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হইতেছিল।
এই দ্বিতীয় বিদ্রোহের সময়ে যাঁহারা রাজদ্বারে প্রজার পক্ষে দণ্ডায়মান হন, তন্মধ্যে বিখ্যাত লাহোর ‘ট্রিবিউন’ পত্রের ভূতপূর্ব্ব সম্পাদক যদুনাথ মজুমদার এম, এ, বি, এল, সৰ্ব্বপ্রধান।[৫১] যশোহর-লোহাগড়ার এক সমৃদ্ধ পরিবারে তাঁহার জন্ম, সুন্দর ও কমনীয় তাঁহার মূর্তি, যেমন তিনি সুলেখক, তেমনই সুবক্তা। এই উদীয়মান যুবক ওকালতী পাশ করিয়া পূর্ব্ববৎসর (১৮৮৮) আসেন; তাঁহার অনন্যসাধারণ প্রতিভা উপযুক্ত কার্যক্ষেত্রের সন্ধান করিতেছিল। নীলবিদ্রোহে তাহা জুটিল। তিনি প্রথম হইতেই ঐকান্তিকভাবে প্রজার পক্ষে দণ্ডায়মান হইলেন। এই বৎসর ষ্টিভেন্সন্ মুর (Stevenson Moore) সাহেব জয়েন্ট ম্যাজিষ্ট্রেট হইয়া ঝিনাইদহে আসিলেন; প্রজার নামে অসংখ্য মোকদ্দমা হইল, আর তাঁহারা শাস্তি পাইতে লাগিলেন। আবার শত শত প্রজা জেলে গেলেন কিন্তু নীল চাষ করিলেন না। এই সকল মামলায় প্রজাপক্ষে উকীল হইতেন অক্লান্তকর্মী যদুনাথ এবং নীলকরের পক্ষ সমর্তন করিতেন বর্তমান ঝিনাইদহের বৃদ্ধ উকীল কেদারনাথ বক্সী। কিছুদিন পরে লুসন (Luson) সাহেব নীল ব্যাপারে বিশেষ বিচারক হইয়া আসিয়া ঝিনাইদহ ও মাগুরায় কোর্ট করিতে লাগিলেন। শুধু প্রজার পক্ষে স্বল্প বা বিনাস্বার্থে ওকালতী করা নহে, সংবাদপত্রে লেখা, উচ্চ গবর্ণমেণ্টে দরখাস্ত করা প্রভৃতি প্রায় সকল কাৰ্য্যই যদুনাথ করিতেন। তিনি ও মাগুরার উকীল পূর্ণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি কয়েকজনে উদ্যোগী হইয়া মাননীয় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহায্যে বিলাতে আবেদন পাঠাইলেন, তথায় মহামতি ব্রাড্ল বিদ্রোহ-বাৰ্ত্তা পার্লিয়ামেন্টে তুলিলেন। উহার ফলে বঙ্গীয় গবর্ণমেন্টের নিকট কৈফিয়ৎ তলব হয়। তখন ছোটলাট সাহেব যদুনাথকে ডাকেন এবং তাঁহার সহিত অনেক তর্কবিতর্ক হয়। অবশেষে একটি সালিশী কমিটি (Arbitration Committee) স্থাপন করা স্থির হয়। ইহাতে প্রজার পক্ষে যদুনাথ, নীলকরের পক্ষে জোড়াহাটি কানসরণের টুইডী সাহেব এবং সরকার পক্ষে প্রেসিডেন্সী বিভাগের কমিশনার স্মিথ (Alexander Smith) সাহেব সদস্য হন।
এই কমিটি প্রজাবর্গের অসন্তোষের কারণ নিৰ্দ্দেশ পূৰ্ব্বক সমস্ত গোলমালের মীমাংসা করেন। কমিটির প্রস্তাবে একটা কাৰ্য্য এই হয় যে, প্রতি বাণ্ডিল নীলের মূল্য ৪ আনা স্থলে। ৬ আনা নির্দ্ধারিত হয়। এইরূপ দেড়গুণ মূল্য দিয়া নীলের ব্যবসায় চালান দুষ্কর হইয়া পড়ে। এজন্য ক্রমে নীলকরগণ নিজ নিজ কানসরণ বিক্রয় করিতে থাকেন। এই সময়ে বাবুখালি, মদনধারি ও নহাটা বিক্রয় হইয়া যায়। ১৮৯৫ অব্দে দেখা গেল, মাত্র ১৭টি কুঠিতে ১,৪১৬ মণ নীল উৎপন্ন হইল। কিন্তু ইহারই কিছুদিন পরে জাম্মানী হইতে কৃত্রিম কৌশলে প্রস্তুত সস্তা নীল প্রচুর পরিমাণে দেশে দেশে আমদানী হওয়ায়, স্বভাবজাত দুর্মূল্য নীলের ব্যবসায় একেবারে উঠিয়া গেল। কত আন্দোলন ও প্রাণপণ চেষ্টায় যাহা হয় নাই, বৈজ্ঞানিক কৌশলে তাহা সহজে সংসাধিত হইল। যশোহরে ১৭৯৫ হইতে ১৮৯৫ পৰ্য্যন্ত একশত বৎসর নীলের ব্যবসায় ছিল।
পাদটীকা :
১. Ain (Jarrett ). Vol. II, pp. 181.241.
২. J. A. S. B., 1836, Appendix, p. 156.
৩. Bernier, Travels (Bangabasi). p. 275.
৪. Asian, March 18, 1879 – Biographical Sketch of the First Indigo Planter in India, by H. J. Rainey.
৫. ‘কলিকাতা, সেকালের ও একালের,’ ৬৭৬ পৃ।
৬. Westland, Jessore, p. 135.
৭. Ibid, p. 136
৮. The Dawn Magazine, July, 1905 Fifty years ago. [‘নীলদর্পণ’, কর-মজুমদার, ১৩২৮, ১৪৯ পৃ 5.―শি মি]
৯. ‘The Indigo manufactured in this side of India is of prime quality and that of lower Bengal, especially which is produced in the districts of Nuddea and Jessore, is probably the very finest in the whole world.’-Indigo Commission Report, para 72. p. 21.
‘The finest indigo that the world producess is, I believe generally admitted to be that of Bengal, and second to none is the indigo of Jessore and Furreedpore. ‘ – Gastrell, Statistical Reports, 1868, p. 11. The Nadia and Jessore Indigo is still the finest in India.’-Grant. Minute, para 54. (Vide Buckland-Bengal under the Lieutenant Governors, Vol. I, p. 258. –শি মি]
১০. Regulation VIII of 1819.
১১. Westland, Jessore, p. 148; John and Robert Savi ভ্রাতা ছিলেন।
১২. ‘The house still standing on the bank of the Madhumati is the most magnificent house in the District’. Ibid., p. 211. ব্রে সাহেবের নিকট হইতে এই বাড়ী উকীল প্যারীমোহন গুহ খরিদ করেন। কয়েক বৎসর হইল (১৯০৬) মহম্মদ হাদিক্ নামক একজন সম্ভ্রান্ত মুসলমান ভদ্রলোক ঐ বাটী ও সংলগ্ন ১৬৪ বিঘা জমি ক্রয় করিয়া সপরিবারে বাস করিতেছেন।
১৩. তখনকার যশোহরে মাগুরা ও ঝিনাইদহে অধিক নীলের চাষ ছিল, তাহা বলিয়াছি। ঐ দুই মহকুমার ৬৭ কুঠিতে ৭৬,০০০ বিঘা চাষে ৪,১০০ মণ নীল উৎপন্ন হইত। নড়াইল মহকুমায় বার্ষিক ১৯,৮৭৬ বিঘায় ৪৯৩ মণ যশোহর ও খুলনা মহকুমায় ৫,৩৭৫ বিঘায় ৮৭ মণ ৪ সের নীল হইত। বাগেরহাটে ৯৫২ বিঘার চাষ ছিল বটে, কিন্তু উহার গাছগুলি ফরিদপুরে নীত হইত।—Sen, Ram Sanker, Report p. 16.
১৪. Ure, Dictionary of Arts and Manufactuures; Hunter, Nadiya, p. 98.
১৫. Summarised from Rural Life in Bengal’. 1860 Letter No viii, pp. 114-36.
১৬. Hunter, Jessore, p. 252.
১৭. ১৮৪০ অব্দে হিলস্ সাহেবই সৰ্ব্ব প্রথম নীলের দর টাকায় ১০ বাণ্ডিল স্থলে ৪ বাণ্ডিল করেন। এই হিলস্ (Hills) সাহেব Hills White & Co. এর প্রধান অংশীদার।—Indigo Com. Report, p. 23.
১৮. Sbr. Deposition of R.P. Page. Manager of Katgorah & Khalbolia Concerns.-Ibid., p.
১৯. Gastrell, Statistical Report, p. 13.
২০. কৃষকের লোকসান হইত বটে, কিন্তু কুঠির যথেষ্ট লাভ ছিল। ১০০০ বাণ্ডিল নীলের গাছে ৬ মণ নীল হইত; বিঘায় ৯ বাণ্ডিল গাছ ধরিলে নীলের পরিমাণ হয় দুইসের। সাহেবদিগের কারখানার উৎকৃষ্ট নীলের প্রতিমণের মূল্য ছিল ২৩০ টাকা এবং দেশীয় কারখানার সর্ব্ব নিম্ন শ্রেণীর নীল প্রতিমণ ১০৯ টাকা করিয়া বিক্রয় হইত। উচ্চ দর ধরিলে প্রতি বিঘায় সাড়ে এগার টাকার নীল জন্মিত; উহার জন্য ৩ টাকা খরচ এবং বিনা সুদে টাকা দাদন দিতে হইত। সুতরাং সরঞ্জাম খরচ বাদেও কুঠিয়াল সাহেবদের লভ্যাংশ যথেষ্ট থাকিত।
২১. ‘নীলদর্পণ’, কর-মজুমদার, ৪৮-৯ পৃ।
২২. ‘I found the native residing in the neighbourhood of Indigo plantations evidently better colthed and better conditioned than those who lived at a distance from such stations. There may be more partial injury done by the Indigo planters, but on the whole they have performed more good to the generations of natives of this country than any other class of Europeans . ‘ Cal. Rev., 1860, p. 24. 23. Indigo Com Report, p. 21.
২৪. মোল্লাহাটিতে ফরলং ও লারমুর সাহেবের সময় রাজার মত বাড়ী ছিল, উহার ছবি দিলাম। জনৈক চিত্র- শিল্পী গ্রান্ট সাহেব ‘Rural Life in Bengal’ গ্রন্থে মোল্লাহাটির বিশেষ বিবরণ দিয়াছেন। প্রাচীর বেষ্টিত হাতার (কমপাউণ্ড) মধ্যে প্রকাণ্ড বাবুর্চিখানা, আস্তাবল, পক্ষিশালা, স্কুল, হাসপাতাল, ফলের বাগান, লোকজনের বাড়ী ছিল। হাতার বাহিরে বাওড়ের ধারে আবদ্ধ উদ্যানে হরিণ চরিত। এখনও কিছু কিছু ভগ্নাবশেষ আছে। তন্মধ্যে ফরলং-পত্নীর সমাধিস্তম্ভটি উল্লেখ-যোগ্য। বাবুখালি কুঠির কথা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি। নহাটা কুঠিবাড়ি নলডাঙ্গার রাজার রাজপ্রাসাদ হইয়াছে; হাজ্রাপুরের বাড়ী ব্যারিষ্টার সাহেবের আবাস বাটী হইয়াছে। নিশ্চিন্তপুরের কুঠীতে ৭০টি ঘোড়ার আস্তাবল ছিল। চৌগাছার দোতলায় এখনও বাস করা যায়। অনেকে গ্রাম্য রাস্তা পাকা করিয়া ঘোড়ার গাড়ী চালাইতেন। মরেল সাহেবেরা চারিঘোড়ার গাড়ীতে পরিভ্রমণ করিতেন। কৃষকের গানে আছে : ‘বজরা চলে এলো মেলো ডিঙ্গা চলে সাথে, দেবী (Davies) সাহেবের নীল ঘোড়া চলে ভাঙ্গা পথে।’
২৫. Buckland, Bengal under Lieutenant Governors, Vol. I. p. 241 – Minute of Sir J. P. Grant.
২৬. Rev. Hill নিজের সাক্ষ্যেই এই প্রবচনের কথা উল্লেখ করেন। — Ind. Com. Report, 1860 – Answer No. 1893.
২৭. একজন সহৃদয় ইংরাজ এই প্রসঙ্গে বলিয়াছেন : ‘The cold, hard and sordid, who can plough up grain-fields, kidnap recusant ryots, confine them in dark holes, beat and starve them into submis- sion, which things have sometimes been done, can give no moral guarantee of his incapability of filling up a blank bond and turning it to his pecuniary profit.’ –Cal. Rev., Vol. 36. p. 40.
২৮. ইহাও লারমুর সাহেবের কীর্ত্তি। Answer No. 3576 – Indigo Com. Report. 1860.
২৯. Buckland, Bengal under Lieutenant Governors, Vol. I. a pp. 245-6.
৩০. ‘এ কানসরণে আর কত কুঠী আছে না জানি, দেড় মাসের মধ্যে চৌদ্দকুঠীর জল খেলেন’……ইত্যাদি। ‘নীলদর্পণ’, কর-মজুমদার, ৩৬ পৃ।
৩১. Buckland, Vol. I, p. 253 – Sir P. Grant’s Minute. para 43.
৩২. ‘নীলদর্পণ’, কর-মজুমদার, ২৬৯ পৃ—ললিতচন্দ্র মিত্র লিখিত প্রবন্ধ ‘পূৰ্ব্বকথা’।
৩৩. Indigo Com. Report, Answer 3918. Evidence of Mr. E. De Latour, Magistrate of Faridpur, Chakladar. (article) ‘Fifty years ago’ [‘নীলদর্পণ’, কর-মজুমদার, ১৩২৮, ১৪৯ পৃ দ্র.–শি মি
৩৪. বিশিষ্ট প্রমাণাভাবে কমিশন এ অভিযোগ বিশ্বাস করেন নাই, কিন্তু এ দেশীয় প্রজা মান ইজ্জতের ভয়ে ব্যাকুল হইয়াছিলেন। চরিত্রহীন কুঠীয়ালেরা নিম্নতম শ্রেণী হইতে যে স্ত্রীলোক সংগ্রহ করিত, তাহার প্রমাণাভাব ছিল না। যেখানে গৃহস্থ-রমণীর উপর বলপ্রয়োগ করিত, সেখানেই গোলযোগ ঘটিত। জাতিপাতের ভয়ে প্রজারা কেহ প্রকাশ্য অভিযোগ বা সাক্ষ্য দিতেন না, কিন্তু তাঁহাদের মর্ম্মব্যথা হইতে বিদ্রোহ-বহ্নির সৃষ্টি করিয়াছিল। Rev. J. Long সাহেব ‘Harkaru’ পত্রে লিখিয়াছিলেন, ‘The violation of their daughters will teach ryots how they complain of the Indigo Shaheb.’ কাচিকাটা কুঠির হিলস্ (Archibald Hills) সাহেব হরমণি নামে এক সুন্দরী কৃষক কন্যাকে বলপূর্ব্বক কুঠিতে আনিয়া দ্বিপ্রহর রাত্রি পর্যন্ত আটকাইয়া রাখিয়াছিল। ‘হিন্দু পেট্রিয়টে’ ইহা প্রকাশিত হয়। “The story was told by Rev. C. Bomwetsch before the Indigo Commission. The Magistrate (Herschel) said in his reply that the abduction seemed very clearly proved.’ এই ঘটনা অবলম্বন করিয়া দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণে’ রোগ্ সাহেবের পাশবিক অত্যাচার কল্পিত হইয়াছিল।
৩৫. রাইয়তের কঠোর প্রতিজ্ঞার আভাস কমিশনের বহু কৃষক সাক্ষীর মুখে শুনা যায়।
৩৬. ১৮৬০ অব্দে বনগাঁর জয়েন্ট ম্যাজিষ্ট্রেটের সাক্ষ্যে প্রকাশ পায় যে, কাটগড়া কানসরণের অন্তর্গত ইলিশমারি (মহেশপুরের সন্নিকটে) কুঠির পার্শ্ববর্তী নারায়ণপুর, বড়খানপুর প্রভৃতি গ্রামে প্রথম গোলমাল আরম্ভ হয়। নীল বুনিবেন না বলিয়া রাইয়তেরা আপত্তি করেন এবং বাগ্দা থানার লোকের উপর আক্রমণ করেন। See Indigo Com. Report p. 83 – Evidence of D. J. MeNeile. কিন্তু স্বৰ্গীয় শিশিরকুমার ঘোষ ১৮৮০ অব্দে স্বীয় অমৃতবাজার পত্রিকায় লিখেন যে, চৌগাছাতেই প্রথম বিদ্রোহের সূচনা হয়। চৌগাছা বা নারায়ণপুর উভয়ই কাঠগড়া কানসরণের মধ্যবর্ত্তী।
৩৭. Pictures of Indian Life, Ganesh & Co., pp. 72-80 A Story of Patriotism in Bengal’, by Sisirkumar Ghosh.
৩৮. ‘Some of these articles of Babu Sisirkumar found their way into the Indigo Commission’s Report and they display his remarkable sagacity, strong common sense, power of expression and clear scathing style and mastery over the English language even in those days when he was a mere stripling’ – Pictures of Indian Life, p. 6.
৩৯. শিশিরকুমারের অন্য নাম ছিল মন্মথলাল ঘোষ। এজন্য তিনি ‘M. L.G.’ এই সংক্ষিপ্ত নামে প্ৰবন্ধ লিখিতেন। মুদ্রাকর-প্রমাদ বশতঃ উহা ‘M. L. L. হইয়া গেল; শিশিরকুমার সে ভুল আর সংশোধন করিলেন না।
৪০. অনাথনাথ বসু, ‘মহাত্মা শিশিরকুমার ঘোষ’, ৩৫ পৃ।
৪১. যশোহর হইতে গিরিশচন্দ্র বসু নামক একজন পুলিশ ইনস্পেক্টরও ‘পেট্রিয়টে’ নীলকরের কাহিনী লইয়া প্রবন্ধ লিখিতেন। সে দোষে অবশ্য তাঁহাকে চাকরী ইস্তাফা দিতে হইয়াছিল।
৪২. Lord Canning wrote ‘I assure you that for about a week it caused me more anxiety than I have had since the days of Delhi and from that day I felt that a shot fired in anger or fear by one foolish planter might put every factory in Lower Bengal in flames’–Buckland, Bengal under the Lieutenant Governors. Vol. I, pp. 191-2.
৪৩. Ibid., p. 192.
৪৪. ‘At a moment of passionate excitement the careful impartiality with which the Commission conducted their enqueries was admitted on all sides. The cautious, temperate and kindly man- ner in which they have framed their Report will, I am sure, be cordially acknowledged by every one.’— Grant’s Minute, para 49; Buckland. p. 271.
৪৫. ‘The whole system is vicious in theory, injurious in practice and radically unsound.’ –Indigo Com. Report. p. 5.
৪৬. হেমেন্দ্ৰপ্ৰসাদ ঘোষ লিখিত ‘নীলদর্পণের’ ভূমিকা, কর-মজুমদার সং, ১ পৃ।
৪৭. সীটনকার অভিযোগের ফলে বঙ্গীয় গবর্ণমেন্টের সেক্রেটারীর পদ ত্যাগ করেন। পরে ভারত সরকার হইতে তাঁহাকে হাইকোর্টের জজ্ ও পররাষ্ট্র-সচিবের পদে পুনর্নিযুক্ত করা হইয়াছিল।
৪৮. বঙ্কিমচন্দ্র, ‘দীনবন্ধু-জীবনী’। [‘নীলদর্পণ’, ১৩২৮, ২১৩-৪ পৃ–শি মি]
৪৯. Hunter, Jessore, p. 300.
৫০. কেদারনাথ ঘোষ পরে সন্ন্যাসী হইয়া কেশবানন্দ ভারতী নাম ধারণ করেন। বিশ্বেশ্বর মুখোপাধ্যায় বহু বৎসর যাবৎ ‘কল্যাণী’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ঐ পত্রে নীলবিদ্রোহের সম্বন্ধে বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছিল। এখন ‘কল্যাণী’ সাপ্তাহিক পত্র নড়াইল হইতে প্রকাশিত হয়।
৫১. ইনিই এক্ষণে রায়বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার বেদান্তবাচস্পতি, C.L.E., M.L.A. ‘হিন্দুপত্রিকার সম্পাদক ও বহুগ্রন্থ-লেখক।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন