সতীশচন্দ্র মিত্র
সীতারাম রাজার মত রাজা হইয়াছেন। চারিদিকে তাঁহার রাজ্য দূর বিস্তৃত হইয়াছে। সুশাসনগুলে যেমন তাঁহার প্রজাবৃদ্ধি হইতেছিল, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার রাজ্যমধ্যে শিল্পবাণিজ্য, শিক্ষাদীক্ষা ও সমাজধর্ম্মের শ্রীবৃদ্ধি হওয়ায় প্রজাবর্গ সমৃদ্ধি ও শান্তিসুখে বাস করিতেছিল। তাঁহার রাজধানী সুরক্ষিত হইয়াছে, সৈন্য সংখ্যা যথেষ্ট বৰ্দ্ধিত হইয়াছে, অস্ত্রশস্ত্রাদি সমর-সজ্জার পর্যাপ্ত আয়োজন হইয়াছে। সময় বুঝিয়া তিনি স্বাধীনতা লাভের প্রয়াসী হইলেন। লোকমত তাঁহার সে প্রয়াসের অনুকূল ছিল, কারণ মোগলের কঠোর শাসন সকলেরই নিকট অত্যন্ত অপ্রিয় হইয়া উঠিয়াছিল।
তবে কথা এই, সীতারাম ত মোগলের অধীন নগণ্য সামন্ত নৃপতি মাত্র। তিনি এতদূর পরাক্রান্ত হইবার অবসর পাইলেন কিরূপে? তিনি যখন অবাধে চারিপাশে রাজ্য বিস্তার করিতেছিলেন, তখন মোগলের পক্ষ হইতে বাধা দেওয়া হইল না কেন? এই কথার প্রকৃত উত্তর নির্ণয় করিতে হইলে, আমাদিগকে বঙ্গদেশের তদানীন্তন রাজনৈতিক অবস্থা একটু সংক্ষেপে পর্যালোচনা করিয়া লইতে হইবে। ১৬৮৯ খৃষ্টাব্দে সায়েস্তা খাঁ ঢাকা ত্যাগ করিয়া যাইবার পর হইতে ১৭১৩ অব্দে মুর্শিদকুলি খাঁ সুবাদার হইয়া বসিবার পূর্ব্ব পর্য্যন্ত, ২৪ বৎসর কাল বঙ্গদেশের সর্ব্বত্র শাসন-শৃঙ্খলা ছিল না। ঠিক এই সময় মধ্যে সীতারাম রায়ের উত্থান ও প্রতিপত্তি স্থাপন সম্ভাবিত হইয়াছিল। প্রকৃত শাসন প্রবর্ত্তিত হইবামাত্র অচিরে তাঁহার পতন ঘটিয়াছিল,
সায়েস্তা খাঁর পরবর্ত্তী নবাব ইব্রাহিম খাঁর সময়ে পশ্চিমবঙ্গে সভা সিংহ ও রহিম খাঁর বিদ্রোহ-বহ্নি জ্বলিয়া উঠে; বৃদ্ধ নবাব বা তাঁহার অকর্ম্মা ফৌজদারগণ সে বহ্নি নির্ব্বাপিত করিতে পারেন নাই। তখন বাদশাহ আওরঙ্গজেব নিজ পৌত্র আজিম্ উশ্বানকে বঙ্গ বিহার উড়িষ্যার নাজিম বা সুবাদার নিযুক্ত করিয়া পাঠান। পূর্ব্ব হইতেই নাজিম্ ও দেওয়ানের পদে পৃথক্ ব্যক্তি নিযুক্ত হইয়া আসিতেছিলেন। ১৭০১ খৃষ্টাব্দে মুর্শিদকুলি খাঁ দেওয়ান হইয়া ঢাকায় আসেন।[১] কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই আজিম্ উশ্বানের সহিত তাঁহার অসদ্ভাব উপস্থিত হয়। বাদশাহেরও তাহাই অভিপ্রেত ছিল; তিনি কখনও একমতের দুইজনকে একস্থানে উচ্চপদে নিযুক্ত রাখিতেন না। ১৭০৩ খৃষ্টাব্দে যখন ঢাকায় মুর্শিদকুলির প্রাণ বিনাশের চেষ্টা হয়, তখন তিনি দেওয়ানী সেরেস্তা মুত্সুদাবাদে স্থানান্তরিত করেন এবং তথা হইতে রীতিমত রাজস্ব সরবরাহ করিয়া বাদশাহের প্রিয়পাত্র হন। এই সময় নায়েব নাজিম পদের সৃষ্টি হয়; ১৭০৪ অব্দে মুর্শিদকুলি দেওয়ানী পদের সঙ্গে বঙ্গ ও উড়িষ্যার নায়েব নাজিম হন। উভয় পদের বলে তিনি ক্ৰমে প্রবল পরাক্রান্ত হইয়া উঠেন। ঢাকায় থাকিয়া আজিম্ উশ্বান ইচ্ছা করিলেও তাঁহার কিছুই করিতে পারিতেন না। এই সময়ে মুসুদাবাদের নাম পরিবর্তিত হইয়া দেওয়ানের নামে মুর্শিদাবাদ হয়। প্রায় ৭০ বৎসর কাল উহা বঙ্গের রাজধানী ছিল।
ঢাকায় মুর্শিদকুলির জীবনাশঙ্কার বার্তা শুনিয়া বাদশাহ আজিম্ উশ্বানের প্রতি অত্যন্ত রুষ্ট হন এবং তাঁহার রাজধানী বিহারে স্থানান্তরিত করিবার আজ্ঞা দেন। তদনুসারে তিনি কিছু কাল রাজমহলে বাস করিবার পর যখন দেখিলেন যে স্বাস্থ্যে আর কুলায় না, তখন পাটনায় আসিয়া রাজধানী স্থাপন করিলেন এবং ঐ স্থানের নাম রাখিলেন আজিমাবাদ।
১৭০৭ খৃষ্টাব্দে দাক্ষিণাত্যে বাদশাহ আওরঙ্গজেব মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন। সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ রাজত্বের সকল কুটিল নীতি সমাধিস্থ হইল; যে মোগল সাম্রাজ্যকে তিনি উন্নতির শীর্ষস্থানে তুলিয়াছিলেন, তাহা বালির বাঁধের মত ভাঙ্গিয়া পড়িতে লাগিল, তাঁহার চিরনিদ্রার সঙ্গে বিরাট সাম্রাজ্যের পতন আরব্ধ হইল। মোগল শক্তির প্রথম উন্মেষের যুগে যেমন যশোহর প্রদেশে প্রতাপাদিত্যের উদ্ভব, সে শক্তির পতনের প্রাককালেও তেমনি সেই প্রদেশে সীতারামের আবির্ভাব হইয়াছিল। বাদশাহের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভ্রাতৃঘাতী সমর চলিল, অবশেষে জ্যেষ্ঠ পুত্র বাহাদুর শাহ সম্রাট হইলেন। তিনি আজিম্ উশ্বানের পিতা; সুতরাং তাঁহার পাঁচ বৎসরব্যাপী রাজত্বকালের মধ্যে আজিম্ উশ্বান পূর্ব্ববৎ বঙ্গ বিহার উড়িষ্যার শাসনকর্তা রহিলেন। দক্ষতাগুণে মুর্শিদকুলি খাঁরও পদগৌরবের ব্যতিক্রম হইল না, কারণ তিনি দেশ নিংড়াইয়া কর-সংগ্রহ করিতেন এবং যিনি যখন ভুজবলে দিল্লীর তক্তে বসিতেন, তিনি বেওজর তাঁহারই নিকট বশ্যতা স্বীকার করিয়া রাজস্ব বা পেশকস্ পাঠাইতেন। অর্থের মত মুনিবকে খুসী রাখার আর কিছুই নাই। ১৭১২ খৃষ্টাব্দে বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর আবার তাঁহার পুত্রগণের মধ্যে বিবাদ বাধিল, বহু রক্তপাতের পর আজিম্ উশ্বান নিহত হইলেন এবং তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা জেহান্দর শাহ এক বৎসর মাত্র রাজত্ব করিলেন। আজিম্ উশ্বান বঙ্গ হইতে আসিবার সময় স্বীয় পুত্র ফরশিয়রকে প্রতিনিধি রাখিয়া আসেন; জেহান্দরের হত্যার পর নানা চক্রান্তের ফলে তিনিই আসিয়া দিল্লীশ্বর হইলেন। ফরখশিয়রের সঙ্গে কুলি খাঁর বিরোধ এবং এমন কি, যুদ্ধবিগ্রহ পৰ্য্যন্ত হইয়া গেলেও, সম্রাট হইবামাত্র দেওয়ান তাঁহার নিকট বশ্যতার প্রমাণ দিলেন। সম্রাটও তাঁহাকে বঙ্গ বিহার উড়িষ্যার নাজিম নিযুক্ত করিয়া নানাবিধ খেলাত পাঠাইলেন (১৭১৩)। দেওয়ান ও নাজিমের পদের আবার শুভ-সংযোগ হইল। মুর্শিদাবাদেই রাজধানী রহিল।
দেওয়ানী আমল হইতে মুর্শিদকুলি কঠোরভাবে কর সংগ্রহ করিতেন; এজন্য রাজা বা জমিদারদিগকে পীড়ন করিতে দ্বিধা করিতেন না। রাজস্ব বাকী ফেলিলে তাঁহাদিগকে সাধারণ লোকের মত ধরিয়া আনিয়া কারাগারে নিক্ষেপ করা হইত; সেখানে তাঁহাদের কারাযন্ত্রণা ভোগ ত ছিলই, অধিকন্তু উপযুক্ত খাদ্য পানীয়ও তাঁহাদিগকে দেওয়া হইত না। ইহাতেও কর আদায় না হইলে, জমিদারী খাস হইত বা অন্যের সহিত বন্দোবস্ত করিয়া অর্থাগমের পথ হইত। নবাবের আজ্ঞামত বা তাঁহার জ্ঞাতসারে হয়ত এই পৰ্য্যন্ত হইত। কিন্তু তিনি কর সংগ্রহের জন্য যে সব প্রধান কর্মচারী নিযুক্ত করিয়াছিলেন, ‘তাঁহাদের অত্যাচার সম্বন্ধে ঐতিহাসিকগণের বিবরণী পাঠ করিলে শরীর কণ্টকিত হইয়া উঠে।’[২] এই জাতীয় কর্মচারীর মধ্যে সর্ব্বপ্রধান ছিলেন— নাজির আহম্মদ ও সৈয়দ রেজা খাঁ। নাজির আহম্মদ জমিদারদিগকে ধরিয়া আনিয়া, কখনও উহাদিগকে পা বাঁধিয়া ঝুলাইয়া, কখনও বা কোড়া প্রহারে নির্যাতন করিতেন। গ্রীষ্মকালে রৌদ্রে খাড়া করিয়া রাখা এবং শীতকালে শীতল জলে নিমজ্জন প্রভৃতি শাস্তির কথাও শুনা যায়। রেজা খাঁ নাজির অপেক্ষাও আপনাকে অধিক জাহির করিয়াছিলেন। তিনি সৈয়দবংশীয় মুসলমান, তাহাতে আবার নবাবের দৌহিত্রীপতি, সুতরাং জাত্যভিমান ও আস্পর্দ্ধা খুব বেশী ছিল বলিয়া হিন্দুদের উপর অত্যন্ত কঠোর হইতেন। পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি (৩৭শ পরিচ্ছেদ), তিনি পূরীষাদিপূর্ণ এক খাতের নাম রাখিয়াছিলেন ‘বৈকুণ্ঠ’ এবং উহাতে জমিদারদিগকে নিমজ্জিত করা হইত; সে ভয়ে তাঁহারা কম্পান্বিত হইতেন। ইহা ভিন্ন কখনও বা হতভাগ্যদিগের ঢিলা ইজারের মধ্যে বিড়াল প্রবেশ করাইয়া দেওয়া হইত, কখনও বা তাঁহারা বাধ্য হইয়া লবণমিশ্রিত মেষ বা মহিষ দুগ্ধ খাইয়া উদরাময়ে কষ্ট পাইতেন। মুসলমান ঐতিহাসিকের বর্ণনা হইতে এমন আরও কত গল্প শুনা যায়, সবগুলি বিশ্বাসযোগ্য নহে। তবে টাকা আদায়ে যে কাহারও কোন মান-সম্ভ্রম বা স্বত্ব-স্বামিত্বের দিকে লক্ষ্য করা হইত না, তাহা সত্য কথা। মুর্শিদকুলি যতই কাৰ্য্যদক্ষ বা ন্যায়নিষ্ঠ হউন, বাদশাহ-দরবারে তাঁহার যতই সুনাম থাকুক না কেন, জমিদারদিগের প্রতি কঠোরতার জন্য দেশময় তাঁহার কলঙ্ক রটিয়াছিল। বহু জমিদার এইজন্য তাঁহার বিরুদ্ধাচারী হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, কিন্তু সকলের সামর্থ্য বা বুকের পাটা সমান ছিল না। তন্মধ্যে দুইজনের নাম সৰ্ব্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। একজন মহম্মদপুরের কায়স্থ জমিদার রাজা সীতারাম রায় এবং অন্যজন রাজসাহীর ব্রাহ্মণ জমিদার উদয়নারায়ণ রায়। ইঁহাদের মধ্যে সীতারামের বিদ্রোহ অগ্রে ঘটে এবং এ গ্রন্থে তাহাই আমাদের আলোচ্য।
আজিম্ উশ্বান বঙ্গেশ্বর হইয়া ঢাকায় আসিবার পর তাঁহার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় মীর আবু তোরাকে ভূষণার ফৌজদার করিয়া পাঠান। পরাক্রান্ত জমিদার সীতারামের প্রতি তীব্র দৃষ্টি রাখাই তাঁহার এক প্রধান কাৰ্য্য ছিল। কিন্তু কয়েকটি কারণে মুর্শিদকুলি খাঁর সহিত তাঁহার সদ্ভাব না থাকায় সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয় নাই। প্রথমতঃ, মীর সাহেব বাদশাহের কুটুম্ব, উচ্চ সম্মানিত সৈয়দবংশে তাঁহার জন্ম এবং নিজেও সমসাময়িক বা সমধর্মীদিগের মধ্যে বিদ্যাবত্তা ও কাৰ্যদক্ষতায় বিশেষ খ্যাতিসম্পন্ন।[৩] এজন্য তিনি বড় গৰ্ব্বিত ছিলেন; সহজে কাহারও নিকট বশ্যতা স্বীকার করিতেন না। দ্বিতীয়তঃ, তিনি জানিতেন আজিম্ উশ্বানই তাঁহার নিয়োগকৰ্ত্তা; এজন্য তিনি মনে করিতেন দেওয়ান বা নায়েব নাজিমের কোন ধার ধারিবার তাঁহার প্রয়োজন ছিল না। তৃতীয়তঃ, মুর্শিদকুলি আজিমের নিন্দাবাদ বাদশাহের কর্ণে তুলিয়া শাহজাদার পরম শত্রু হইয়া দাঁড়াইয়াছিলেন; সুতরাং আবু তোরাও মুর্শিদকুলিকে শত্রুর মত মনে করিতেন। চতুর্থতঃ, মুর্শিদকুলি পূৰ্ব্বে হিন্দু-ব্রাহ্মণ ছিলেন, পরে মুসলমান ধর্ম্মে দীক্ষিত হন; এজন্য জাত্যভিমানী আবু তোরাপ্ তাঁহাকে অত্যন্ত ঘৃণা করিতেন। ইহার ফল এই দাঁড়াইয়াছিল যে, আবু তোরাপ্ মুর্শিদাবাদের সহিত বিশেষ সম্বন্ধ রাখিতেন না; আজিম্ উশ্বানের সঙ্গে তাঁহার পত্র ব্যবহার চলিত। তবে নিজামৎ সেরেস্তা পাটনায় চলিয়া গেলে, সকল খবর সেখানে পৌঁছিত না।
অন্যপক্ষে দেওয়ান ভূষণার বিশেষ খবর রাখিতেন না, শুনিয়াও শুনিতেন না; বরং সীতারাম প্রথম আমলে পাঠান বিদ্রোহীদিগকে দমন করায় মুর্শিদকুলি তাঁহার উপর খুসী ছিলেন এবং তাঁহার কথাই অধিক বিশ্বাস করিতেন। সীতারামের উকীল মুনিরাম রায় মুর্শিদাবাদে থাকিয়া আবু তোরাপের অত্যাচার ও কলঙ্ককাহিনী বুঝাইয়া দিতেন। দেওয়ান অবশ্য আবু তোরাপের গোস্তাকি মাপ করিতে রাজী ছিলেন না, কিন্তু নানা রাজনৈতিক সমস্যার মধ্যে এদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিবার তাঁহার সময় ছিল না। তাই সময় বুঝিয়া আবু তোরাপ সেই নিভৃত এবং দুর্গম মহলে সৰ্ব্বেসর্ব্বা হইয়া বসিলেন। লোকে তাঁহাকে নবাব বলিত এবং তিনিও নবাবী কায়দায় কঠোরভাবে শাসনদণ্ড চালনা করিতেন। দেশীয় প্রবাদ হইতে জানা যায়, তিনি বড় অত্যাচারী ছিলেন এবং প্রজার জাতিধর্ম্মে হস্তক্ষেপ করিতেন। সে সব কথা শতমুখে সীতারামের কর্ণগোচর হইত। তিনি সেই অত্যাচারী ফৌজদারকে মানিতেন না।
ফৌজদারকে অন্য কোন ভাবে মানিবার কোন প্রয়োজন ছিল না, শুধু কর দিলেই তিনি সন্তুষ্ট থাকিতেন। কিন্তু সীতারাম তাহাতেও সম্মত হইলেন না। ফৌজদার তর্জ্জন গর্জ্জন করিয়া পত্র লিখিলেন, অবশেষে সীতারামের রাজসভায় লোক পাঠাইয়া বাকী রাজস্বের জন্য সর্ব্বজনসমক্ষে তাঁহাকে তিরস্কৃত করিলেন। সীতারামের ক্রোধের পরিসীমা রহিল না; তিনি প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিলেন, অত্যাচারী মোগলকে কর দান করিবেন না। অনেক জমিদারী আপনিই তাঁহার হাতে আসিয়া পড়িয়াছে, কতক তিনি বাহুবলে জয় করিয়াছেন, সুতরাং মোগল ফৌজদার তাঁহার নিকট রাজস্ব দাবি করিবার কে? ফৌজদারের অবস্থা বা শক্তি কি, তাহা সীতারাম জানিতেন। অন্যত্র হইতে সাহায্য না পাইলে, ফৌজদার যে তাঁহার কিছুই করিতে পারিবেন না, তাহা তিনি বুঝিতেন। বঙ্গেশ্বর আজিম্ উশ্বান তখন দিল্লীতে, তাঁহার পুত্র ফরশিয়র প্রতিনিধিরূপে ঢাকায় ও পরে পাটনায় ছিলেন বটে, কিন্তু তিনিও দিল্লীর সিংহাসন লইয়া যে বিরোধ চলিতেছিল, তাহার চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত, কারণ তাঁহার নিজের পরিণাম তাঁহার পিতার জয়পরাজয়ের উপর নির্ভর করিত। কোথায় কোন্ ফৌজদারের ফৌজ কম ছিল বা কোন্ ক্ষুদ্র রাজ্য শাসনভ্রষ্ট হইল, সে খোঁজ লইবার তাঁহার সময় ছিল না। সুতরাং আবু তোরাকে একাকীই সীতারামের বিরুদ্ধাচার নিবারণের জন্য দাঁড়াইতে হইল। কিন্তু সীতারাম বীর ও কৌশলী যোদ্ধা, আবু তোরাপ্ তাঁহার কি করিবেন?
অজ্ঞাতনামা মুসলমান ঐতিহাসিকের তারিখ্-বাঙ্গালা’ নামক পারসীক গ্রন্থের অনুবাদ হইতে দেখিতে পাই : ‘জঙ্গল, খাল, বিল প্রভৃতির আশ্রয়ে থাকিয়া সীতারাম বাদশাহের কর্মকর্তৃগণকে গ্রাহ্য করিতেন না, এবং নিজ জমিদারীর সীমার মধ্যে তাঁহাদিগকে প্রবেশ করিতে দিতেন না। তাঁহার অনেক তীরন্দাজ ও বর্ষাধারী রায়বংশী সিপাহী থাকায় ফৌজদার ও থানাদারের লোকজনের সঙ্গে সৰ্ব্বদাই হাঙ্গামা বাধিত। তিনি উহাদিগকে দখল দিতেন না, অন্যান্য পার্শ্ববর্ত্তী তালুকদারের সম্পত্তিও লুণ্ঠন করিতেন। সৈন্যসংখ্যা অল্প হওয়ায় মীর আবু তোরাপ এই দুৰ্দ্দান্ত জমিদারকে দমন করিতে অক্ষম হইলেন।’[৪] এইভাবে কয়েক বৎসর গিয়াছিল। অবশেষে ১৭১৩ খৃষ্টাব্দে যখন মুর্শিদকুলি খাঁ নাজিম হইলেন, তখন আবু তোরাপের পক্ষে শরণাপন্ন হওয়া ভিন্ন উপায়ান্তর ছিল না; তখন তিনি গর্বিত ফৌজদারকে হাতে পাইয়া তাঁহাকে কিছু শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিয়াছিলেন। ‘তারিখ বাঙ্গালা’য় আছে : ‘(আবু তোরাপ্) পরিশেষে সাহায্যের জন্য অগত্যা নবাব মুর্শিদকুলির নিকট প্রার্থনা করিলেন; কিন্তু নবাব এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়াছিলেন। মীরসাহেব সীতারামকে ধৃত করিবার জন্য সৈন্য পাঠাইয়াছেন, তিনি শৃগাল-বৃত্তি অবলম্বন করিয়া জঙ্গল ভূমির আশ্রয় লইতেন, তীর তরবার যোগে যুদ্ধ করিয়া ফৌজদারী সৈন্যগণকে হয়রান্ করিতেন। প্রকাশ্য স্থানে সম্মুখ যুদ্ধ দিতেন না, ফৌজদারী সৈন্যবল বেশী দেখিলে, গভীর বনভূমি ও নদীমধ্যে আশ্রয় লইতেন। সৈন্যগণ উহা অতিক্রম করিতে অসমর্থ হইয়া ফিরিয়া আসিত। তিনি পরক্ষণেই বাহির হইয়া লুণ্ঠনে ক্ষিপ্রহস্ততা প্রদর্শন করিতেন। কেহই তাঁহাকে আয়ত্ত করিতে সমর্থ হয় নাই, তিনি কখনও কাহারও হস্তে পড়িতেন না।’[৫] অজ্ঞাতনামা লেখক যাঁহাই লিখুন, সীতারাম সময় বুঝিয়া উপযুক্ত যুদ্ধনীতি অবলম্বন করিয়াছিলেন, উহাকে শৃগাল-বৃত্তি বলা উচিত নহে। সীতারামের বাল্যকালে মহারাষ্ট্রদেশে শিবাজী ঐ একই নীতি অবলম্বন করিয়াছিলেন। ইতিহাস পাঠক জানেন বুয়র যুদ্ধের সময় দুৰ্দ্দমনীয় ডিওয়েটের এই কঠোর নীতি প্রবল পরাক্রান্ত শত্রুর কি বিষম দুর্গতিই করিয়াছিল। বাঙ্গলার রাজনৈতিক গগন তখন কুয়াসাচ্ছন্ন; দিল্লীর উত্তরাধিকারঘটিত বিরোধের ফলে কে বঙ্গেশ্বর হইবেন এবং তিনি কি ভাবে আবু তোরাপ্কে সাহায্য করিবেন, সবিশেষ না জানিয়া ফৌজদারের সঙ্গে প্রকাশ্য যুদ্ধ করা সীতারামের নিকট সঙ্গত বলিয়া মনে হয় নাই। এই জন্য তিনি অব্যবস্থিত রণনীতি অবলম্বন করিয়া সময় কর্ত্তন করিতেছিলেন মাত্র। ফৌজদারকে রাজস্ব দেওয়া হইবে না; কিন্তু সে কথা তখনও তিনি মুর্শিদাবাদে রটিতে দেন নাই। সম্ভবতঃ তখন পর্য্যন্ত তাঁহার উকিল মুনিরাম যথাভাবে তাঁহার পক্ষসমর্থন করিতেছিলেন।
মীর আবু তোরাপ সীতারামকে দমন করিবার ভার নিজ সেনাপতি, আফগানবীর পীর খাঁর উপর ন্যস্ত করিলেন। ‘তারিখ্-বাঙ্গালা’য় দেখি তাঁহার অধীন দুই শত মাত্র অশ্বারোহী ছিল; হয়ত সে গণনা ঠিক নহে। সীতারামের সৈন্যবল যথেষ্ট বেশী ছিল, দুই শত সেনা লইয়া তাঁহাকে যে পরাস্ত করা যায় না, তাহা অবশ্য ফৌজদার বুঝিতেন। ফৌজদারের সৈন্য যাহাতে মধুমতী পার হইতে না পারে, তাহাই সীতারামের উদ্দেশ্য ছিল। পারঘাটায় তিনি কামান পাতিয়াছিলেন, তাহা বঙ্কিমচন্দ্ৰ ও বলিয়া গিয়াছেন। সীতারামের অগ্রগামী সৈন্য মধুমতী ও বারাসিয়া নদীর মধ্যবর্তী ভূভাগে জঙ্গলের মধ্যে লুক্কায়িত থাকিত এবং হরিহরনগরের দিকে যাহাতে পীর খাঁ ধাবিত হইতে না পারেন, তদ্দিকে দৃষ্টি রাখিত। মধ্যে মধ্যে দুই একটি ক্ষুদ্র খণ্ড-যুদ্ধ যে না হইত, তাহা নহে; তবে তাহার কোন ইতিবৃত্ত বা বিশেষত্ব নাই। অবশেষে একদিন বারাসিয়ার কূলে অকস্মাৎ উভয় সৈন্য সম্মুখীন হইল, নদীর উচ্চ পাহাড় রক্তাক্ত করিয়া ভীষণ যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে আবু তোরাপ স্বয়ং নিহত হন। ‘তারিখ্ বাঙ্গালা’ বা ‘রিয়াজে’র অনুকরণ করিয়া ষ্টুয়ার্ট বলেন, আবু তোরা যুদ্ধ করিতে আসেন নাই, মৃগয়ায় আসিয়াছিলেন, সীতারামের লোকেরা তাহাকে পীর খাঁ মনে করিয়া ভ্রমক্রমে নিহত করিয়া ফেলিয়াছিল।[৬] একথা বিশ্বাস করি না; বারাসিয়ার তীরভূমি এমন কিছু মৃগয়ার জায়গা নহে এবং যেখানে মাঝে মাঝে বিরোধ ঘটিতেছিল, সেখানে বেশী লোকজন সঙ্গে না লইয়া আবু তোরাপ্ যে বাহির হইয়াছিলেন, এমন বোধ হয় না। রীতিমতই যুদ্ধ হইয়াছিল; সে যুদ্ধে তিনি একাকী নহেন, উভয় পক্ষের ৫/৬ শত লোক মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিল। এই যুদ্ধের ফলে সীতারাম ভূষণা দখল করিয়া লইয়াছিলেন। ফৌজদারের নিতান্ত মৃগয়ায় যাওয়ার ব্যাপার হইলে, এত সহজে সুরক্ষিত ভূষণা দুর্গ অধিকৃত হইত না। আবু তোরাকে প্রাণে মারা সীতারামের অভিপ্রেত না হইতে পারে, কিন্তু যখন সেনাপতি রামরূপ তাঁহাকে নিহত করেন, তখন সীতারাম পদস্থ বীরের প্রকৃত সম্মান রক্ষা করিয়াছিলেন; যুদ্ধান্তে তাঁহারই ব্যবস্থায় আবু তোরাপের মৃতদেহ ভূষণায় লইয়া যথোচিত সমাদরে সমাহিত করা হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে যে বহুসংখ্যক মুসলমান হত হন, তাঁহাদিগেরও সমাধির ব্যবস্থা সেই স্থানে হইয়াছিল। বারাসিয়ার তীরে এখনও যুদ্ধক্ষেত্রের স্থান প্রদর্শিত হয়।[৭]
বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়া গিয়াছেন, ‘ভূষণা দখল হইল। যুদ্ধে সীতারামের জয় হইল। তোরাহ্ খাঁ মারা পড়িলেন। সে সকল ঐতিহাসিক কথা। কাজেই আমাদের কাছে ছোট কথা।[৮] ঔপন্যাসিকের কাছে উহা ছোট কথা হইতে পারে, কিন্তু ঐতিহাসিকের নিকট উহা বড় কথা; আর ঐ ছোট কথার অস্থিমজ্জা না হইলে উপন্যাসের বিপুল বপুঃ গড়িয়া উঠিতে পারিত না। স্থানে স্থানে ঐ অস্থিমজ্জাকে বিকৃত করিয়া ঔপন্যাসিক নিজের হাতের গড়া মানুষটিকে যে বদলাইয়া ফেলিয়াছেন, তজ্জন্য সনাক্তদারগণ আপত্তি উত্থাপন করিবার অধিকার রাখে। সীতারাম ভূষণা দুর্গ দখল করিয়া স্বয়ং তথায় অবস্থান করিলেন, মহম্মদপুরের ভার প্রধান সেনাপতি রামরূপের উপর প্রদত্ত হইল। অন্যান্য সেনানীরা বিভক্ত হইয়া উভয় স্থানে এবং মধুমতী নদীর পাহারায় রহিলেন। আবু তোরাপের হত্যা বা ভূষণা বেদখল হইয়া যাওয়া মোগল সুবাদার কিছুতেই সহ্য করিবেন না; সুতরাং এইবার মোগলের সঙ্গে প্রকাশ্য সমর বাধিবে, তাহা সকলে জানিতেন। এইজন্য সীতারাম ও তাঁহার সেনানীবৃন্দ নানাভাবে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি ও গুলি বারুদ প্রভৃতি সরঞ্জাম সংগ্রহের বিপুল ব্যবস্থা করিতে লাগিলেন।[৯] এই সময়ে “মুসলমান ইতিহাস লেখক তাঁহাকে (সীতারামকে যেরূপ ভীত ও আতঙ্কযুক্ত বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, তিনি সেরূপ ভীত হইলে অবশ্যই সন্ধি-স্থাপনের আয়োজন করিতেন। মুসলমানকে কর প্রদান করিতে সম্মত হইলে সকল বিবাদ মিটিয়া যাইত; রাজ্য থাকিত, রাজদুর্গ থাকিত, রাজশক্তি অব্যাহত ভাবে সীতারামের গৌরব ঘোষণা করিত; এবং হয়ত আজিও মহম্মদপুরের রাজপ্রাসাদে প্রভাতে সায়াহ্নে সশস্ত্র দ্বাররক্ষিগণ সীতারামের বংশধরদিগকে মহারাজ, রাজা বা নিতান্ত পক্ষে রায় বাহাদুর বলিয়া অভিবাদন করিবার অবসর পাইত। একটু পদানত হইলে, একটু ক্ষমা ভিক্ষা করিলে, একটু অধীনতা স্বীকার করিলে হাস্যময়ী পুরী এমন শ্মশান-ভূমিতে পরিণত হইত না। যিনি স্বহস্তে বিস্তৃত রাজ্য গঠন করিয়া বাহুবলে সেই রাজ্য শাসন করিতেন, তিনি যে এতটুকু বুঝিতেন না, তাহা কে বিশ্বাস করিবে? তথাপি এতটুকু করিতেও সীতারাম সম্মত হইলেন না কেন? এইজন্যই মনে হয় যে, আত্মবংশ বা আত্মপরিবারকে ধন-গৌরবে গৌরবান্বিত করিবার জন্য সীতারাম ব্যাকুল হন নাই; বাহুবলে স্বাধীন রাজ্য গঠন করিবার জন্যই অগ্রসর হইয়াছিলেন। এই অনুমান নিতান্ত কাল্পনিক নহে; সীতারামের ইতিহাস পড়িতে বসিলে, ইহা ভিন্ন অন্য কোন অনুমান সম্ভব বলিয়া স্বীকার করা যায় না।”—অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়-প্রণীত ‘সীতারাম’, ৬৯-৭০ পৃ। আমরা এ পর্য্যন্ত সীতারামের কার্যাবলীর যে পরিচয় দিয়াছি, তাহা পর্য্যালোচনা করিলে পাঠক মাত্রই প্রবীণ ঐতিহাসিকের এই সিদ্ধান্তকে সমীচীন বলিয়া গ্রহণ করিবেন।
এদিকে মুর্শিদাবাদে আবু তোরাপের মৃত্যুর সংবাদ পৌঁছিল। অল্পদিন হইল ফরখশিয়র দিল্লীশ্বর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুর্শিদকুলি খাঁ বঙ্গের মসনদে সমাসীন হইবার আদেশ পাইয়াছেন। ব্যক্তিগতভাবে আবু তোরাপের উপর তাঁহার বিরক্তি থাকিতে পারে, কিন্তু আজ মোগল ফৌজদার নিহত হওয়ায় তাঁহার অবস্থা সমস্যা-সঙ্কুল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আবু তোরাপ বাদশাহের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় এবং দিল্লীর দরবারে অনেক বড় বড় আমীর তাঁহার আত্মীয়বন্ধু ছিলেন। এতদিন কুলি খাঁ ভূষণার ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন, ফৌজদারের প্রার্থনামত কোন সৈন্য সাহায্য পাঠান নাই, একজন নগণ্য জমিদার মোগলের হাত হইতে ভূষণার দুর্গ কাড়িয়া লইয়াছে, এ সকল কথা দরবারে উঠিলে, মুর্শিদকুলি নিশ্চয়ই তাঁহার অমনোযোগিতার জন্য তিরস্কৃত হইবেন; আর বাদশাহের কুটুম্বের প্রতি তাঁহার মানসিক আক্রোশের কথা প্রকাশ পাইলে, অনর্থের উৎপত্তি হইতে পারে। সুতরাং অতিরিক্ত কর্মতৎপরতার দ্বারা ব্যাপারটাকে একেবারেই চাপা দিবার জন্য দৃঢ়চিত্ত কুলি খাঁ উঠিয়া পড়িয়া লাগিলেন। তিনি অবিলম্বে স্বীয় শ্যালীপতি বক্স আলি খাঁকে ভূষণায় ফৌজদার নিযুক্ত করিয়া সৈন্যসহ পাঠাইলেন।[১০] মহম্মদপুরের নিকটবর্ত্তী সমস্ত জমিদারের উপর কঠোর পরওয়ানা জারি হইয়া গেল যে, সকলেই যেন মোগল ফৌজদারকে সাহায্য করিবার জন্য প্রস্তুত থাকেন, কেহ যেন সীতারামকে কোন প্রকার রসদ বা সৈন্য দিয়া সাহায্য না করেন, কাহারও জমিদারীর মধ্য দিয়া যেন সেই মোগলশত্রু পলায়ন করিতে না পারে, কেহ তাঁহাকে পলায়ন করিতে দিলে তাঁহার জমিদারী বাজেয়াপ্ত ও তাঁহাকে সর্ব্বস্বান্ত করা হইবে।[১১] জমিদার পীড়নকারী মুর্শিদকুলিকে সকলে চিনিতেন, তাঁহার কড়া হুকুম পাইয়া সকল জমিদার কম্পান্বিত হইলেন। হিন্দুরাজত্বের কল্পনা নিমেষে উড়িয়া গেল।
বিশেষতঃ নলডাঙ্গার রাজা রামদেব সীতারামের সঙ্গে সন্ধি করিয়াছিলেন বলিয়া নবাব-আরক্ত- নয়ন হইলেন। রামদেব এবার ফাঁফরে পড়িলেন; তিনি উচ্চবাচ্য না করিয়া আত্মরক্ষার জন্য যথাশক্তি বল সঞ্চয় করিয়া অপক্ষপাত ভাবে প্রস্তুত থাকিলেন। এমন কত জমিদার যে মোগলের ভয়ে সীতারামের বিরুদ্ধাচারী, অগত্যা নিষ্ক্রিয় হইয়া বসিলেন, তাহা বলিবার নহে। বাঙ্গালী জাতির পতন এইভাবে হইয়াছে। বাঙ্গালীতে শত্রুপক্ষে সাহায্য না করিলে কোন যুগেই বাঙ্গালার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা দুঃসাধ্য হইত না। কৰ্ত্তিত বৃক্ষ সত্যই কুঠারকে সম্বোধন করিয়া বলিতে পারে যে তাহার স্বজাতীয় ভ্রাতা অর্থাৎ কাষ্ঠখণ্ড কুঠারের পশ্চাতে সংলগ্ন না হইলে, কুঠার কখনও বৃক্ষছেদন করিতে পারিত না। কুলি খাঁর কড়া হুকুম শুনিয়া অনেক জমিদার তদুত্তরে কাকুতি মিনতি জানাইলেন। সীতারাম তাহাতে বিচলিত হইলেন না। তিনি অগ্রসর হইয়া যেখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছেন, আত্মসম্ভ্রম লইয়া আর পিছাইবার উপায় নাই। সুতরাং পরিণাম চিন্তা করিয়া, সর্ব্বস্ব পণ করিয়া, যুদ্ধের জন্য এ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হইলেন। হয়ত তিনি যখন সহজে নানামতে রাজ্যজয় করিতেছিলেন, তখন তাঁহার এতদূর কঠোর প্রতিজ্ঞা ছিল না। অবস্থার গতিকে তেজস্বী ব্যক্তিকে উগ্রতপস্বী করিয়া তুলে।
বঙ্কিমচন্দ্রের নভেল হইতে দেখি, এই সঙ্কট-সময়ে সীতারাম চিত্ত-বিশ্রামের প্রেম-বিলাসে মত্ত থাকায়, তাঁহার সৈন্যসামন্ত লোকজন সময় বুঝিয়া সব সরিয়া পড়িল, অবশেষে মোগলেরা আসিয়া অনায়াসে তাঁহার গ্রাস-কবলিত রাজ্য লুটিয়া লইল। ব্যাপার এত সোজা নহে। সকল যুদ্ধের খাঁটি খবর ৫০/৬০ বৎসর পরে লিখিত মুসলমানী ইতিহাসে না থাকিতে পারে, কিন্তু হিন্দু-মুসলমানের সংঘর্ষ যে ভূষণা ও মহম্মদপুরের বহু ক্ষেত্রে হইয়াছিল, স্থানিক অনুসন্ধানে এখনও তাহার পরিচয় পাওয়া যায়। প্রচলিত প্রবচনে পাড়াগাঁয়ের কবিতায় এখনও অনেক খবর আছে। বিলাসে অনেক রাজ্যের ক্ষয় হইয়াছে, তাহা মানি; সীতারামও যে বিলাসী ছিলেন, সে কথা একেবারে অস্বীকার করিতেছি না। কিন্তু বিলাসীর পক্ষে বশ্যতা স্বীকারই ত স্বাভাবিক হইত! সীতারাম তাহা করিলেন না কেন? নানাস্থানে যুদ্ধ হইল, সেনানীরা একে একে মরিল, রাজধানী রক্তরঞ্জিত হইয়া গেল, দুর্গ অবরুদ্ধ হওয়ার পরও যুদ্ধ চলিল, ইহার কেন্দ্রে কোন নেতা নাই, ইহা কি বিশ্বাসযোগ্য? যাঁহার মর্ম্মরুধিরের জন্য মুর্শিদাবাদের শূল শাণিত হইতেছিল, যাঁহার প্রধান সেনানীকেও গুপ্তহত্যা করা হইয়াছিল, তিনি কিনা সুরক্ষিত দুর্গের অনতিদূরে অরক্ষিত চিত্তবিশ্রামের পর্ণকুটীরে বিশ্রম্ভালাপে আত্মবিশ্যত হইয়া রহিলেন, ইহাও কি বিশ্বাস করিতে হইবে? চিত্তবিশ্রামে এখন কোন রাজবাটীর শেষ চিহ্নস্বরূপ কোন ইষ্টকখণ্ড খুঁজিয়া পাওয়াও পণ্ডশ্রম হয়। সাহিত্যসম্রাট তা তাঁহার নভেলের ঐতিহাসিকতা বিশ্বাস করিতে নিষেধ করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু আত্মবিস্মৃত বাঙ্গালী পাঠক কি সে নিষেধ শুনেন? না, নভেলী গল্পকে ইতিহাসের উপর স্থান দিয়া সীতারামের মুখে কালিমা মাখিয়া দিতেছেন? উপন্যাস ইতিহাসের সর্ব্বনাশ সাধন করিতেছে বলিয়াই এত কথা বলিতে হইল।
বক্স আলি খাঁ যখন ফৌজদার হইয়া আসেন, তখন তাঁহার সহকারী হইয়া আসিয়াছিলেন দুইজন সেনানী, – একজন মুর্শিদাবাদের সুবাদারী সৈন্যের অধিনায়ক সংগ্রাম সিংহ, অন্যজন জমিদারী ফৌজের কর্তা দয়ারাম রায়। এই সংগ্রাম সিংহের বিশেষ পরিচয় আমরা জানি না।[১২] তবে যে সংগ্রাম সাহার কথা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি (৪০শ পরিচ্ছেদ), ইনি যে সেই সংগ্ৰাম নহেন, তাহা নিশ্চিত। সংগ্রাম সাহা এত দিন পর্য্যন্ত জীবিত থাকিতে পারেন না। সুপ্রসিদ্ধ দয়ারাম রায় বর্ত্তমান দিঘাপাতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি নাটোরের আদি পুরুষ রঘুনন্দনের রাজ্য প্রতিষ্ঠা বিষয়ে দক্ষিণ হস্তস্বরূপ ছিলেন। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ বংশীয় রঘুনন্দন বাল্যে পুটিয়া-রাজ- সরকারে প্রতিপালিত, তথা হইতে সামান্য চাকরী লইয়া অল্প বয়সে মুর্শিদাবাদে আসেন (৩য় পরিচ্ছেদ)। সেখানে স্বকীয় অসাধারণ প্রতিভাবলে ক্রমে অত্যধিক উন্নতি লাভ করেন। উহা হইতেই “রঘুনন্দনী বা’ড়” কথার সৃষ্টি হইয়াছে। জমিদারী বন্দোবস্ত প্রভৃতি ব্যাপারে তিনি মুর্শিদকুলি খাঁর সাহায্য করিয়া তাঁহার অত্যন্ত প্রিয় পাত্র হন এবং বহু জমিদারের করচ্যুত সম্পত্তি নিজ ভ্রাতার নামে লিখাইয়া লন। সাহসে, বীরত্বে, বুদ্ধিমত্তা ও কার্য্যদক্ষতায় দয়ারাম তাঁহার প্রধান সহায় ছিলেন। নবাব যখন জমিদারদিগের নিকট হইতে ফৌজ সংগ্রহ করিয়া সীতারামের বিরুদ্ধে পাঠাইবার জন্য রঘুনন্দনের উপর আদেশ করিলেন, তখন নিজের অসুস্থতা বশতঃ রঘুনন্দন এই কার্য্যে তাঁহার প্রধান কর্মচারী দয়ারাম রায়কে পাঠাইয়া দেন। বক্স আলি ও সংগ্রাম সিংহ পূর্ব্বে রওনা হইয়াছিলেন, দয়ারামের আসিতে কিছু বিলম্ব ঘটিয়াছিল।
বক্স আলি খাঁ নিজ সহকারী সংগ্রাম সিংহের সঙ্গে সর্ব্বাগ্রে ভূষণা দখল করিবার উদ্দেশ্যে পদ্মা দিয়া জলপথে যাত্রা করেন; উহারা সম্ভবতঃ বর্ত্তমান ফরিদপুর প্রভৃতি কোন স্থানে অবতরণ করিয়া স্থলপথে ভূষণার উত্তর দিকে উপনীত হন। তখন সীতারাম সসৈন্যে অগ্রসর হইয়া গতিরোধ করেন; যে যুদ্ধ হয়, তাহাতেও সীতারাম জয়লাভ করেন। দুর্গ দখল করিতে না পারিয়া ফৌজদারী সেনা ক্রমে ভূষণার চারিদিক ঘিরিয়া অবরোধ করে এবং পার্শ্ববর্তী জমিদারদিগকে লোকজন লইয়া অগ্রসর হইবার জন্য উত্ত্যক্ত করিয়া তুলে। সীতারাম বিপন্ন হইয়া দেখিলেন, ভূষণা ও মহম্মদপুর এই উভয় স্থান দখলে রাখা দুষ্কর। কিন্তু কোন উপায় স্থির হইল না।
এদিকে দয়ারাম রায় মহম্মদপুর আক্রমণের জন্য জমিদারী ফৌজ লইয়া অগ্রসর হন। যত দূর বুঝা যায়, তিনি পদ্মা হইতে গৌরী নদীতে পড়িয়া লাঙ্গলবাঁধ দিয়া কুমার নদের তীরে বরীশাটে (বীরসাত) পৌঁছেন।[১৩] বরীশাট নলডাঙ্গার রাজার মামুদশাহী পরগণার উত্তরাংশে কুমার ও বারাসিয়া নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত একটি প্রধান স্থান। এখান হইতে উত্তরবাহী কুমার হনু নাম ধারণ করিয়া মধুমতীতে পড়িয়াছে এবং বারাসিয়া দক্ষিণবাহিনী হইয়া মাগুরার নিকট নবগঙ্গায় মিশিয়াছে। এখন কুমারের প্রাচীন খাত শুষ্কপ্রায় হওয়ায় লোকে বারাসিয়াকেই কুমার বলে। বরীশাট হইতে দয়ারাম কোন পথে আসেন, ঠিক জানান যায় না। বারাসিয়া দিয়া নব গঙ্গায় পড়িয়া বিনোদপুরের অপর পারে ছাউনী করিতে পারেন; অথবা কুমার ও মধুমতী দিয়া ঘুরিয়া মহম্মদপুরের পূর্ব্ব সীমায় পৌঁছিতে পারেন। শেষোক্ত পথে আসাই অধিকতর সম্ভবপর, কারণ সেই দিকেই ফৌজদারী সেনার সহিত মিলিত হওয়ার কথা। প্রবাদ আছে, মধুমতী তীরে গন্ধখালিতে যে সব ক্ষত্রিয় বাসিন্দা ছিলেন, তাঁহাদের নিকট হইতে দয়ারাম মহম্মদপুর দুর্গ সম্বন্ধীয় অনেক খবর সংগ্রহ করেন, কারণ উঁহাদের সহিত মহম্মদপুরবাসী বহু ক্ষত্রিয় সৈনিক বা ব্যবসায়ীর কুটুম্বিতা ছিল।[১৪] গন্ধখালি ছাড়িয়া একটু দক্ষিণে মধুমতীর পূর্ব্বকূলে দয়ারামপুর গ্রাম সম্ভবতঃ দয়ারামের ছাউনী করিয়া থাকিবার স্থান নির্দ্দেশ করিতেছে।
মহম্মদপুরের দুর্গাধক্ষ্য ছিলেন সেনাপতি রামরূপ বা মেনাহাতী। তাঁহার ভীষণ মূর্ত্তি ও বীর বিক্রমের জন্য সব লোকে তাঁহাকে ভয় করিত; তাঁহার নির্মূল চরিত্র ও বীরোচিত সদাশয়তার জন্য সব লোক তাঁহার বাধ্য ছিল; তিনি আজীবন অকৃতদার, সংসারে অনাসক্ত, দেবদ্বিজভক্ত ও ধর্মপ্রাণ— এজন্য সকলে তাঁহাকে ভক্তি করিত। তিনি নিজেও যেমন সুনিপুণ যোদ্ধা, সৈন্যসামন্ত তেমনি তাঁহার একান্ত বাধ্য, এজন্য কামান দ্বারা সুরক্ষিত দুর্গ তাঁহার নিকট হইতে দখল করিয়া লওয়া সহজ ব্যাপার নহে। সকল অবস্থা বুঝিয়া দয়ারাম গুপ্তঘাতক দ্বারা সর্ব্বাগ্রে রামরূপের প্রাণবিনাশ করিবার কল্পনা স্থির করিলেন। হতভাগ্য দেশে এই অপকর্ম্ম করিবার জন্য লোকের অভাব হইল না। সেনাপতি সাধারণতঃ দুর্গদ্বারবর্ত্তী গৃহে রাত্রিতে শয়ন করিতেন; প্রাতে বীরের মত সশস্ত্র হইয়া নগর পরিভ্রমণ করিতেন, সে সময়ে তিনি কোন লোকজন সঙ্গে লইতেন না। কিন্তু তিনি একক হইলেও সম্মুখ হইতে যুদ্ধ করিয়া তাঁহাকে আঘাত করা এক প্রকার অসম্ভব ছিল। তিনি প্রত্যুষে উঠিয়া শৌচান্তে সন্ধ্যাহ্নিক করিতেন। একদিন কুটিকাময় প্রভাতে যেমন তিনি উঠিয়া সম্ভবতঃ শৌচের জন্য দোলমঞ্চের পার্শ্ব দিয়া যাইতেছিলেন, এমন সময় গুপ্তঘাতকেরা পশ্চাৎদিক দিয়া আসিয়া তাঁহাকে শূলবিদ্ধ করিয়া ফেলিল; মহাবীর যখন মৃত্যু- যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করিতে লাগিলেন তখন দুর্বৃত্তরা তাঁহার ছিন্নমুণ্ড লইয়া প্রস্থান করিল।[১৫] দয়ারাম রায় বাহাদুরী লইবার জন্য এই ছিন্ন মুণ্ড নবাবের নিকট প্রেরণ করেন। নবাব সে প্রকাণ্ড মুণ্ড দেখিয়া শিহরিয়া উঠিয়াছিলেন এবং তেমন মহাবীরকে সশরীরে কারারুদ্ধ করিবার চেষ্টা না করিয়া গুপ্তভাবে কেন নিহত করা হইল, এইরূপ অনুযোগ করিয়াছিলেন।[১৬] নবাব সসম্মানে সে বীরমুণ্ড মহম্মদপুরে ফেরত পাঠাইয়াছিলেন। এদিকে পূর্ব্বেই বীরের কবন্ধ দেহের সৎকার করিয়া তাঁহার অস্থিখণ্ডসমূহ সমাধিতলে রক্ষা করা হইয়াছিল, ছিন্ন মুণ্ডও সেই স্থানে সমাহিত হয়। সীতারাম নির্ম্মিত এক উচ্চ ইষ্টক-স্তম্ভ ঐ সমাধিস্থান বিজ্ঞাপিত করিত। মহম্মদপুরের বাজার হইতে উত্তরদিকে যাইয়া কাষ্ঠঘর পাড়া হইতে যে রাস্তা পূর্ব্বমুখে ভূষণার দিকে গিয়াছে, উহারই পার্শ্বে মেনাহাতীর সমাধিস্তম্ভ ছিল। ৩০/৪০ বৎসর পূর্ব্বেও উহা সিক্তনেত্র দর্শকের মনে কত পুরাতন কাহিনী জাগাইয়া দিত। এখন সে স্তম্ভের চিহ্ন মাত্রও নাই।[১৭] কতবার বলিয়াছি, আমরা বড় ইতিহাস-বিমুখ আত্মবিস্মৃত জাতি! নতুবা রামরূপের মত মহাবীরের স্মৃতিচিহ্নটি পর্য্যন্ত বিলুপ্ত হইত না। আমাদের দেশের কত ধনীর কত অর্থ অপকর্ম্মের ধ্বজারোপণে ব্যয়িত হয়; এই প্ৰকৃত বীরের জন্য একটি স্মারকলিপি প্রতিষ্ঠা করিবার মত প্রাণ কি কাহারও নাই?
ভূষণায় থাকিয়া সীতারাম যখন রামরূপের হত্যার খবর পাইলেন, তখন তাঁহার মস্তকে যেন বজ্রাঘাত হইল। ভ্রাতা লক্ষ্মণের মত তিনি অকলঙ্ক-চরিত্র রামরূপের প্রতি স্নেহশীল ছিলেন, তাঁহার উপর সম্পূর্ণ নির্ভর ও বিশ্বাস করিতেন। সেনাপতির আকস্মিক মৃত্যুতে সীতারামের দক্ষিণ হস্ত ভাঙ্গিয়া গেল, রাজ্যরক্ষার আশা উড়িয়া গেল, তিনি অত্যন্ত বিপন্ন ও কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িলেন। ভূষণা ও মহম্মদপুর এই উভয় দুর্গ রক্ষা করিবার কল্পনা তাঁহাকে ত্যাগ করিতে হইল। কোন প্রকারে ভূষণা-দুর্গে অল্প পরিমাণ সৈন্য জনৈক সেনানীর হস্তে রাখিয়া, নিতান্ত বিপদে তাঁহাদের আত্মরক্ষার পরামর্শ দিয়া, তিনি তথাকার অবশিষ্ট সৈন্যসামন্তদিগকে রাত্রিযোগে পলায়ন করিয়া মহম্মদপুর যাইবার পথ বলিয়া দিলেন। নিজেও পরে ছদ্মবেশে অতিকষ্টে মধুমতী নদী পার হইয়া রাজধানীতে আসিয়া পৌঁছিলেন। সে দেশের সমস্ত পথঘাট তাঁহার নখদর্পণে ছিল।
সীতারাম যখন মহম্মদপুরে আসিলেন, তখন চারিদিকে দয়ারামের ফৌজ হল্লা করিতেছিল, ফৌজদারী সৈন্যদল ভূষণার জঙ্গলভূমি পরিত্যাগ করিয়া মহম্মদপুরের দিকে ধাবিত হইতেছিল। রামরূপের জন্য চক্ষুজল ফেলিতে ফেলিতে, তাঁহার সৎকার ও সমাধির জন্য রাজোচিত হুকুম দিয়া, বীরাগ্রগণ্য সীতারাম দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিলেন। রাজাগমনে পুরীর লোক আশ্বস্ত হইল। তখনও রাজধানীর উপর আক্রমণ হয় নাই। রামরূপের সহকারী সেনানীরা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়া দুর্গরক্ষার জন্য যথাসম্ভব আয়োজন করিতেছিলেন। সীতারাম বুঝিলেন, জয়ের আর আশা নাই, এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। শেষ পর্য্যন্ত বীরের মত আত্মসম্মান রক্ষা করিতে হইবে। কর্ম্মেই মানুষের অধিকার, ফলে নহে। মোগলের কবল হইতে স্বদেশ রক্ষার জন্য তাঁহার ক্ষুদ্রশক্তি লইয়া যাহা সাধ্য, তিনি তাহা করিয়াছেন। পার্শ্ববর্ত্তী কাপুরুষ জমিদারদিগের ভরসায় ছিলেন বলিয়া তাঁহার সকল চেষ্টা বিফল হইতে চলিল। এখন কি তিনি সেই কাপুরুষতার সাগরের ভাসিয়া সকলের সঙ্গে এক হইয়া যাইবেন, মোগলের পায়ে শিরঃ নোয়াইয়া অসার রাজগী বজায় রাখিবেন? না, শেষ পর্য্যন্ত যুদ্ধ করিয়া বীরপদবীর অনুসরণ করিবেন? ইহাই এখন একমাত্ৰ প্ৰশ্ন। সকল প্রশ্নের সমাধান হইলেও, রামরূপের নৃশংস হত্যার প্রশ্নের সমাধান হয় না। রামরূপের প্রাণ যে পথে গিয়াছে, তদ্ভিন্ন সীতারামের অন্য পন্থা নাই। যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী; সে যুদ্ধে নিস্তার নাই, তাহাও নিশ্চিত। সুতরাং দুর্গমধ্যস্থ আত্মীয় স্বজন, স্ত্রীপুরুষ, বালকবালিকা যাহাদের প্রাণে ভয় উপস্থিত হইয়াছিল, পলায়ন করিয়া যাওয়ার ইচ্ছা বা কোন সুবিধা যাহাদের ছিল, তাহাদিগকে অবিলম্বে রাত্রিযোগে সাধ্যমত যান-বাহন ও রক্ষিসহ দুর্গের গুপ্তদ্বার দিয়া বাহিরে পাঠান হইল। কে কে গিয়াছিল বা কে কে ছিল, হিসাব দিবার উপায় নাই। তবে তাঁহার কতক স্ত্রীপুত্র ও নিকট আত্মীয়েরা যে নৌকাযোগে কলিকাতা অভিমুখে প্রস্থান করিয়াছিলেন, তাহার প্রমাণ পরে দিতেছি। রাজমহিষীদিগের মধ্যে কে শেষ পর্য্যন্ত দুর্গপুরীতে ছিলেন, জানা যায় নাই। তবে প্রবাদ এই, একজন ছিলেন এবং তিনি শেষ চেষ্টায় সীতারামকে উদ্বোধিত করিয়াছিলেন।
মধুমতীর কূলে কামান পাতিয়া শত্রুর পথে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করা হইয়াছিল, কিন্তু তাহাতে কুলায় নাই। সীতারামের যুদ্ধায়োজনের একটা প্রধান অভাব ছিল, তাঁহার কোন রণতরী ছিল না। দ্রুতগমনের জন্য ‘বলিয়া’ বা সিপ্ এবং ভারবহনের জন্য পলওয়ার বা পাসী ছিল, কিন্তু যুদ্ধের জন্য কামানযুক্ত উপযুক্ত কোশা বা অন্যবিধ রণতরী ছিল না। সুতরাং শত্রুকে জলপথে মহম্মদপুরে পৌঁছিবার পূর্ব্বে বা মধুমতী পার হইবার সময়ে কোন বাধা দিবার সুব্যবস্থা হয় নাই। দয়ারামের সৈন্য একটু উত্তরদিকে দিয়া এবং বক্স আলির ফৌজ অনেকদূর দক্ষিণে গিয়া নদীপার হইল। নবাবের পরওয়ানা অনুসারে জমিদারেরা নৌকা দিয়া সাহায্য করিয়াছিলেন। সকল সৈন্য পূর্ব্ব ও দক্ষিণ দিক হইতে এক সময়ে মহম্মদপুর আক্রমণ করিল; কয়দিন ধরিয়া- কিভাবে যুদ্ধ চলিয়াছিল, তাহার কোন চাক্ষুষ সাক্ষী নাই। সুতরাং আমি সে যুদ্ধের কোন বিবরণ দিতে পারিতেছি না। পাঠককে তাহা অনুমান করিয়া লইতে হইবে; কাল্পনিক বর্ণনার জন্য ঐতিহাসিকের আবশ্যক নাই। বঙ্কিমচন্দ্র সীতারামের বীরজীবনের শেষ নাট্যাভিনয়ের অতীব সুন্দর চিত্র দিয়া গিয়াছেন। উহার মধ্যে ভাবিবার কথা আছে।
মহম্মদপুরের দুর্গের বাহিরের যে সকল অধিবাসী বা ব্যবসায়ী ছিল, সকলেই পলায়ন করিয়া স্থানত্যাগ করিয়াছিল; মোগল সৈন্য তাহাদের ঘরবাড়ী শূন্যপুরী অগ্নিমুখে দিতে দিতে দুর্গদ্বারে উপনীত হইল। রামসাগরের কূল হইতে দুর্গের পূর্ব্বতোরণ পর্য্যন্ত ভীষণ যুদ্ধ চলিয়াছিল। সীতারামের গুলি বারুদের বিশেষ আয়োজন থাকিলেও মোগলেরা কামানগুলি একে একে জিতিয়া লইল, সেনানীবৃন্দ একে একে যুদ্ধক্ষেত্রে ধরাশায়ী হইল। তখন সীতারাম স্বল্পাশিষ্ট সৈন্যদল লইয়া দুর্গদ্বার উন্মোচন পূর্ব্বক বাহির হন এবং কতকক্ষণ পর্য্যন্ত দুৰ্দ্ধৰ্ষভাবে যুদ্ধ করিবার পর আহত হইয়া ধৃত হন। প্রচলিত প্রবাদ হইতে জানা যায়, রাণীদিগের মধ্যে একজন শেষ পর্য্যন্ত দুর্গমধ্যে ছিলেন। সীতারাম ধৃত হইবার পর যখন মোগল সৈন্য বিজয় দুন্দুভি বাজাইয়া সাগর তরঙ্গের মত দুর্গমধ্যে প্রবেশ করিয়া লুঠপাট করিতে লাগিল, তখন নাকি দয়ারাম রায় উহাদিগকে দেবমন্দির ও অন্দর মহলের দিকে যাইতে দেন নাই। তবে তিনি নিজে কৃষ্ণজী বিগ্রহের অপূর্ব্ব মূর্ত্তি দেখিয়া লোভ সম্বরণ করিতে পারিলেন না। লুণ্ঠনের কোন অংশভাগীই তিনি হন নাই, ইহা সত্য কথা; একমাত্র সুন্দর কৃষ্ণজী বিগ্রহটি তিনি বস্ত্রাভ্যন্তরে করিয়া লইয়া প্রস্থান করেন। এখনও দিঘাপাতিয়া রাজবাটীতে এই সুন্দরর বিগ্রহের সেবা চলিতেছে। ‘ঐতিহাসিক ঘটনার স্মারক চিহ্ন কিছুই বৰ্ত্তমান নাই, কেবল কৃষ্ণজীর পাদপদ্মে ক্ষোদিত আছে— দয়ারাম বাহাদুর।[১৮]
মুসলমান ঐতিহাসিকদিগের গল্প নকল করিয়া ষ্টুয়ার্ট সাহেব সীতারামের শেষফল অতি সংক্ষেপে লিখিয়াছেন। তিনি বলেন, বক্স আলি সীতারামকে সপরিবারে ও অনুচরবর্গ সহিত শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া মুর্শিদাবাদে চালান দিলেন। সেখানে সীতারাম ও দুস্যুগণকে জীবন্ত অবস্থায় শূলবিদ্ধ করিয়া মারা হইল এবং তাঁহার স্ত্রীপুত্রদিগকে দাসরূপে বিক্রয় করিয়া ফেলা হইল।[১৯] ‘রিয়াজে’ আছে, নবাব গোচর্ম্মে সীতারামের মুখ বাঁধিয়া তাঁহাকে মুর্শিদাবাদের পূর্ব্বাংশে ঢাকায় যাইবার রাস্তার পার্শ্বে শূলে চড়াইয়া দেন এবং তাঁহার পরিবারবর্গকে যাবজ্জীবন কারাগারে নিক্ষিপ্ত করেন।[২০] ‘তারিখ্-বাঙ্গালা’য় আর একটু আছে, ‘নবাব সীতারামকে শূলে চড়াইবার পর সেই মৃতদেহ নিকটস্থ বৃক্ষে লঙ্কান হইল এবং অপরাধীর রক্ত ভূমিতে না পড়ে, এজন্য নিম্নে একটি পাত্র স্থাপিত হইল। সীতারামের পরিবারবর্গকে যাবজ্জীবন মহম্মদাবাদে কারারুদ্ধ করা হইল।[২১] এই তিনখানি পুস্তকই ঘটনার অন্যূন ৫০/৬০ বৎসর পরে লিখিত।[২২] তন্মধ্যে ‘তারিখ্-বাঙ্গালা’ সর্ব্বাগ্রে, ‘রিয়াজ’ তৎপরে এবং ষ্টুয়ার্টের পুস্তক সর্বশেষে সঙ্কলিত হয়। অজ্ঞাতনামা লেখক গল্প শুনিয়া অনেক কথা লিখিয়াছেন, অন্য দুইজন কিছু অতিরঞ্জন করিয়া তাহা নকল করিয়াছেন। তিন জনেরই সার কথা এই যে, নবাবের আদেশে সীতারামের প্রাণদণ্ড হয় এবং তাঁহার পরিবারবর্গ যাবজ্জীবন কারাযন্ত্রণা ভোগ করেন। ‘তারিখ-বাঙ্গালা’য় স্পষ্টতঃ আছে, উঁহা মামুদাবাদেই ছিলেন, ‘রিয়াজ’ তাঁহাদিগকে মুর্শিদাবাদে রাখিয়াছেন, ষ্টুয়ার্ট গোলমাল চুকাইবার জন্য তাঁহাদিগকে দাসরূপে বিক্রয় করিয়াছেন। ওয়েষ্টল্যাণ্ড সাহেব ষ্টুয়ার্টের এই উক্তি বিশ্বাস করেন নাই। নবাব মুর্শিদকুলি জমিদারদিগের প্রতি কঠোর হইলেও সাধারণতঃ তাঁহাদিগকে শূলদণ্ড দিতেন বলিয়া শুনা যায় নাই। সম্ভবতঃ বাদশাহ-দরবারে নবাব সুবিধামত আত্মপক্ষ সমর্থন করিয়া যে বিবরণ দাখিল করেন, উহারই উক্তি হইতে সীতারামের পরিণাম নির্ণীত হইয়াছে।[২৩]
দয়ারাম রায়ই সীতারামকে বন্দী করিয়া নিজের সঙ্গে আনিয়াছিলেন। তিনি মুর্শিদাবাদে পৌঁছিবার পূর্ব্বে নিজবাটী ঘুরিয়া আসিয়াছিলেন। কৃষ্ণজী বিগ্রহ লইয়া দিঘাপাতিয়ায় যাইবার পথে তিনি বন্দী সীতারামকে নাটোর রাজবাটীর কারাগারে রাখিয়া যান। কোন্ কক্ষে তাঁহাকে আবদ্ধ রাখা হয়, তাহা এখনও লোকে দেখাইয়া দিয়া থাকে এবং জনরব এতদূরই রটিয়াছিল যে, সীতারাম সেই কারাগারে মৃত্যুমুখে পতিত হন। প্রকৃত কথা তাহা নহে; মুর্শিদাবাদে সীতারামের মৃত্যু হইয়াছিল, তাহার প্রমাণ আছে। দয়ারাম শীঘ্রই তাঁহাকে মুর্শিদাবাদে হাজির করিয়া দিয়াছিলেন। দয়ারাম যে সীতরামের পরিবারবর্গকে বন্দী করিয়া আনেন নাই, উহা সত্য কথা; তাহা হইলে উঁহারাও নাটোরে আসিতেন এবং রাজসাহীর জনশ্রুতি উহার সাক্ষ্য দিত। কৃষ্ণভক্ত দয়ারাম হিন্দুর স্ত্রী পরিবারের প্রতি কোন অত্যাচার করিতে পারেন না। শেষ মুহূর্ত্তে সীতারামের বন্দী হওয়ার পূর্ব্বে পরিবারবর্গ সকলে পলায়ন করিতে পারিয়াছিলেন, ইহা সম্ভবপর। দয়ারাম মাত্র বীরবর সীতারামকে বন্দী করিয়া নবাব দরবারে পৌঁছাইয়া দিয়াছিলেন এবং স্বীয় অসাধারণ বীরত্বের জন্য ‘রায় রায়ান’ উপাধি এবং রঘুনন্দনের কৃপায় কতকগুলি জমিদারী লাভ করেন।[২৪]
সীতারাম নাটোর হইতে মুর্শিদাবাদে নীত হইবার পর কয়েক মাস কাল সেখানে কারাগারে ছিলেন।[২৫] মুর্শিদাবাদেই তাঁহার মৃত্যু হয়। সে মৃত্যু কি ভাবে হইয়াছিল, তৎসম্বন্ধে অনেক মতামত আছে, তন্মধ্যে তিনটি উল্লেখযোগ্য মনে করি। (১) নবাব কর্তৃক সীতারামের মৃত্যুদণ্ড হয়; (২) কারাগারে বিষপান করিয়া সীতারাম আত্মঘাতী হন। (৩) যদুনাথ লিখিয়া গিয়াছেন : ‘কোন শালবিক্রেতাদিগের সহিত যুদ্ধ করিয়া গঙ্গাতীরে মৃত্যুর কথাই সীতারামের গুরুকুলপঞ্জিকায় লিখিত আছে।’[২৬] কিম্বদন্তী হইলেও তিনি ইহা ‘বিশ্বাসযোগ্য’ বলিয়া মনে করিয়াছেন। আমি গুরুকুলপঞ্জী দেখি নাই এবং এক্ষণে উহা খুঁজিয়া বাহির করিতেও পারিলাম না। তবে উহাও গল্প শুনিয়া লেখা, তাহা যদুনাথ নিজেই স্বীকার করিতেছেন; সে গল্পও কেমন অস্বাভাবিক বলিয়া বোধ হয়, সুতরাং এ মতের উপর আমাদের কোন আস্থা নাই। দেশীয় প্রবাদানুসারে অক্ষয়কুমার প্রভৃতি দ্বিতীয় মতের পরিপোষক। কিন্তু কয়েকটি কারণে উহার সত্যতায় সন্দেহ হয় : (১) বিষাঙ্গুরীয় চুষিয়া সীতারামের মৃত্যু হইলে, পথিমধ্যে সে মৃত্যু হইতে পারিত; মুর্শিদাবাদে আসিবামাত্র তাঁহার মৃত্যুদণ্ডের গুজব সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত হইয়াছিল, মৃত্যুর উপায় তাঁহার হাতে থাকিলে, তিনি দীর্ঘকাল কারাযন্ত্রণা ভোগ করিতেন না। (২) ধাৰ্ম্মিক হিন্দু নৃপতি আত্মহত্যারূপ পাপকার্য্য ইচ্ছাপূর্ব্বক করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না। (৩) স্মাৰ্ত্ত ভট্টাচাৰ্য্য রঘুনন্দনের মতে আত্মঘাতীর শ্রাদ্ধ নাই; কিন্তু মুর্শিদাবাদে গঙ্গাতীরে যথাবিধি তাঁহার শ্রাদ্ধ হইয়াছিল, তাহার প্রমাণ আছে।[২৭] সুতরাং তাঁহার মৃত্যুদণ্ড বা স্বাভাবিক মৃত্যু হইয়াছিল, ইহাই সিদ্ধান্ত। মৃত্যুদণ্ড হইয়া থাকিলে, তাঁহার যে শূলদণ্ড হয় নাই ইহা ধরিয়া লওয়া যায়, সম্ভবতঃ মুর্শিদকুলি খাঁ সে নিষ্ঠুরতা দেখান নাই। তবে গুপ্তহত্যা হওয়া বিচিত্র নহে; সে যুগে ঘাতকের অভাব হইত না, গুরুকুলপঞ্জিকায় শালবিক্রেতার গল্প উহারই ইঙ্গিত করে। আবার অন্যপক্ষে সুখবিলাসী সীতারামের পক্ষে বর্ষাকালে অস্বাস্থ্যকর কারাগৃহে রোগাক্রান্ত হইয়া মৃত্যু হওয়াও অস্বাভাবিক নহে। যে ভাবেই মৃত্যু হউক, গঙ্গাতীরে তাঁহার শবদাহ ও রীতিমত শ্রাদ্ধক্রিয়া সম্পন্ন হইয়াছিল। ঐ শ্রাদ্ধোপলক্ষে সীতারামের পুত্র গুরুদেবকে যে ভূমিদান করিয়াছিলেন, তাহার সনন্দ পাওয়া গিয়াছে।[২৮] উহা হইতে জানা যায় সীতারামের জ্যেষ্ঠ পুত্র সীতারামের গুরুপৌত্র আনন্দচন্দ্র ও গৌরচরণ গোস্বামীকে এবং সীতারামের পিতৃগুরুবংশীয় শ্রীরাম বাচস্পতিকে ১১২১ সালের কার্তিকমাসে (১৭১৪, নভেম্বর) শ্রাদ্ধজন্য ভূমিদান করিয়াছিলেন। সুতরাং ১১২১ সালের আশ্বিনে (১৭১৪ অক্টোবর) বা তাহার কিছু পূর্ব্বে সীতারাম রায়ের মৃত্যু হইয়াছিল, বলিতে পারি
বঙ্গে হিন্দু রাজন্যের পক্ষ হইতে স্বাধীনতা লাভের শেষ চেষ্টা সীতারাম দ্বারা হইয়াছিল। পরবর্ত্তী দ্বিশতবর্ষ মধ্যে সে চেষ্টা আর হয় নাই। জীবনের প্রথম হইতে সীতারামের সে উদ্দেশ্য ছিল কি না জানা যায় না। তবে জমিদারী ও শক্তিবৃদ্ধির সঙ্গে স্বাধীনতার কল্পনা যে জাগিয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। সীতারাম জাগিতে পারেন, কিন্তু দেশ জাগে নাই। লোকে তাঁহার বশীভূত হইত স্বার্থের খাতিরে বা দস্যু-দুর্বৃত্তের অত্যাচার হইতে নিস্তার পাইবার জন্য, দেশের জন্য নহে। শতবর্ষ পূর্ব্বে প্রতাপাদিত্যের সময়ে দেশ যতটুকু সাড়া দিয়াছিল, সীতারামের সময়ে তাহাও দেয় নাই। শতবর্ষব্যাপী মোগল-শাসনের কঠোর নিষ্পেষণে দেশের স্পন্দনের শক্তি বিলুপ্ত হইয়াছিল। সীতারাম একক দাঁড়াইয়াছিলেন, নিজের বৈদ্যুতিক শক্তিতে লোক সংগ্রহ করিয়াছিলেন মাত্র; সুতরাং নবাবের একবারের চেষ্টায় তাঁহার পতন হইল, পতনের সঙ্গে সঙ্গে অগ্নি নিভিয়া গেল, প্রতিবেশিগণ সুষুপ্তির ক্রোড়ে অবসন্ন হইয়া পড়িল; সে অবসাদ এত বিঘোর যে, অর্দ্ধশতাদ্বীর মধ্যে যখন বঙ্গের শাসনদণ্ড জাত্যন্তরে হস্তান্তরিত হইল, তখন দেশমধ্যে পূর্ব্বশাসনের বিশেষ ব্যত্যয় হইল না।
সীতারাম নাই। তাঁহার বংশ একপ্রকার নিৰ্ব্বংশ হইয়াছে। কীৰ্ত্তি-চিহ্নও বিলুপ্ত হইতে বসিয়াছে। গল্প-রসিকের মস্তিষ্কের ফলে তাঁহার ইতিহাসের উপর ‘রচা কথা’ স্তূপীকৃত হইতেছে। কতক অন্তর্হিত করিবার চেষ্টা হইতেছে মাত্র। তবে সকল কথার অন্তরাল হইতে সীতারামের একটি চরিত্র-চিত্র দেখা যায়; তিনি ধর্ম্মপ্রাণ, স্বদেশ-প্রেমিক হিন্দু নৃপতি; তিনি শাসকের সহাস্য বদন বা মোগলের খেলাতের লোভে আত্মগোপন করেন নাই; নবাব বা ফৌজদারের বক্রদৃষ্টি বা রণসজ্জা তাঁহাকে দমিত বা নমিত করিতে পারে নাই; তিনি দেশের জন্য শেষ পর্য্যন্ত বীর-ধর্ম্মের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত দেখাইয়া নিজে যশস্বী হইয়া নিজের দেশ যশোহরকে ধন্য করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার জলদান পুণ্য ও ধর্মানুষ্ঠানের কীর্তিকাহিনী চিরদিন তাঁহাকে অমর করিয়া রাখিবে
.
পাদটীকা :
১. এই ব্রাহ্মণ যুবক যখন এক মুসলমান বণিক কর্তৃক ক্রীত হইয়া ইস্পাহানে গিয়া মুসলমান হন, তখন তাঁহার নাম ছিল মহম্মদ হাদি। যখন তিনি দাক্ষিণাত্যে আসিয়া বেরাবের হিসাব দপ্তরে কাজ করেন, তখন নাম হইয়াছিল জাফর খাঁ। যখন তিনি বাদশাহ আওরঙ্গজেবের কৃপাপাত্র হইয়া হায়দ্রাবাদের দেওয়ান হন, তখন উপাধি পাইয়াছিলেন, করতলব খাঁ। বঙ্গের দেওয়ান হইবার সময় তিনি মুর্শিদকুলি- খাঁ উপাধি প্রাপ্ত হন। এই নামেই তিনি বিশেষ পরিচিত।
২. নিখিলনাথ রায়, ‘মুর্শিদাবাদের ইতিহাস’, ১ম খণ্ড, ৩৭৫ পৃ।
৩. ‘Mir Abu Turab. Faujdar of the Chaklah of Bhushnah, who was the scion of a leading Syed clan and was closely related to Prince Aziumu-contemporaries and peers, was renowned for his learning and ability, looked down upon Nawab Jafar Khan . ‘ – Riyaz, ( Salam ),
৪. 266. ‘তারিখ-বাঙ্গালা’ বঙ্গীয় গবর্ণর ভান্সিটার্টের আদেশে (১৭৬০-৪) রচিত হয়। গ্রন্থকারের নাম নাই। ১৭৮৮ অব্দে গ্লাড্উইন্ সাহেব উহার ইংরাজী অনুবাদ করেন, পরবর্ত্তী লেখকেরা উহারই সাহায্য লন। ‘রিয়াজে’র গ্রন্থকারও অনেক স্থলে ‘তারিখ-বাঙ্গালা’ পুঁথির সাহায্য লইয়াছেন। তবে এ গ্রন্থের উক্তি অন্য বিবরণীর সহিত মিলাইয়া সাবধানে ব্যবহার করিতে হয়, সব কথা প্রামাণিক নহে। আমি এস্থলে কালীপ্রসন্নের অনুবাদ গ্রহণ করিলাম।— ‘নবাবী আমল’, ৭৮ পৃ। এই ঘটনা রিয়াজে এইরূপ আছে : ‘Sitarm…being sheltered by forests and rivers had placed the hat of revolt on the head of vani- ty. Not submitting to the Viceroy, he declined to meet the Imperial offices, and closed against the latter all the avenues of access to his tract.’-Riyaz., PP. 265-6.
৫. ‘নবাবী আমলের বাঙ্গালার ইতিহাস’, ৭৮-৯ পৃ।
৬. Riyaz, P. 266; Stewart. History of Bengal, Bangabasi edition, P. 433.
৭. যদুনাথ লিখিয়া গিয়াছেন : ‘এই যুদ্ধে ৬০০ শত মুসলমান নিহত হইয়াছিল, তাহাদিগকে এক সমাধিতে সমাধিস্থ করা হয়। তাহাদের সমাধি-স্তম্ভের ভগ্নাবশেষ অদ্যাপি বারাসিয়া নদীতীরে বিদ্যমান আছে।’—’সীতারাম’, ৫ম সং, ১৬৭ পৃ।
৮. বঙ্কিমচন্দ্র, ‘সীতারাম’, ৩য় খণ্ড, ১ম পরিচ্ছেদ।
৯. এই সময়ে সীতারাম বাণকানা নদীর তীরে দিঘলিয়া গ্রামে নিজের পরিবারবর্গের নিরাপদ-বাসের জন্য একটি গুপ্ত বাটী নির্ম্মাণ করিতেছিলেন। একটি দীঘি ও ভূপ্রোথিত কয়েকটি ইট টালির পাঁজা এখনও সে চেষ্টার নিদর্শন রাখিয়াছে। স্থানীয় লোকে সীতারামের বাটীর দ্রব্যাদি স্পর্শ করিতে এখনও ভয় করে।
১০. ‘রিয়াজে’ এই নামটি হাসান আলি খাঁ বলিয়া আছে। ষ্টুয়ার্ট প্রভৃতি সকলেই বক্স আলি ধরিয়াছেন।
১১. ‘The Nawab issued mandates to the Zamindars of the environs insisting on their not suffering Sitaram to escape across their frontiers, and also threatening that should the latter effect his escape across the frontiers of any one, not only he would be ousted from his Zamindari, but be punished.’-Riyaz., P. 266.
১২. যদুনাথ সংগ্রাম সিংহ না বলিয়া ওয়েষ্টল্যাণ্ডের অনুকরণে ইহাকে সিংহরাম বলিয়াছেন। ‘বিশ্বকোষে’র সীতারাম প্রবন্ধেও সিংহরাম নাম দেখি। সীতারামকে পরাজয় করিতে দয়ারাম প্রভৃতি যিনিই আসুন, তাহারই যে রাম-যুক্ত নাম থাকিতে হয়, ইহা স্বীকার করি না। অক্ষয়কুমার, নিখিলনাথ বা কালীপ্রসন্ন প্রভৃতি প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিকগণ সংগ্ৰাম নামই দিয়াছেন, সিংহরাম দেন নাই।
১৩. বরিশাটের অনতিদূরে আমতৈল-নহাটায় যদুনাথের জন্মস্থান। তিনি বলেন, বরিশাটের পূৰ্ব্বতন নাম ‘বীরসাদ’; দয়ারাম বহু বীর সাথে করিয়া ঐস্থানে আড্ডা করেন বলিয়া ঐস্থানের নাম বীরসাত হইয়াছিল। কথাটা অসম্ভব নহে। এখনও দয়ারামের বংশের সহিত বীরশাটের সম্বন্ধ আছে। সেখানে দীঘাপাতিয়ার একটি কাছারী আছে।
১৪. যদুনাথ, ‘সীতারাম’, ১৮৭ পৃ
১৫. মেনাহাতীর গুপ্তহত্যা সম্বন্ধে কয়েকটি কিম্বদন্তী আছে। ঘাতকেরা দোলমঞ্চে চন্দ্রাতপ কাটিয়া দিয়া তদ্দ্বারা তাহাকে চাপিয়া ধরিয়া পরে অস্ত্রাঘাতে তাঁহাকে হত্যা করে। কঠিন আঘাতেও নাকি তাঁহার মৃত্যু হয় না; তাঁহার দক্ষিণ বাহুতে মৃত্যু নিবারক কবচ ছিল। অবশেষে যখন অস্ত্রাঘাতে বা শূলাঘাতে অনর্গল রক্তস্রাব হইতে থাকে, তখন বীরপুরুষ তাঁহার কবচ খুলিয়া ফেলিয়া মৃত্যুর সন্ধান বলিয়া দেন।— যদুনাথ, ‘সীতারাম’, ১৭৮-৯ পৃ; অক্ষয়কুমার, ‘সীতারাম’, ৭৫ পৃ।
১৬. ‘….the nawab, seeing the huge head, said – ‘A man like that you should have brought alive and not killed.’ He directed the head to be taken back to Muhammadpur and it was there buried and ageat tomb taised over it.” Westland, Jessore, 1871, P. 35.
১৭. আমি যখন প্রথম বার (১৯০৩ খৃঃ) মহম্মদপুর দর্শন করিতে যাই, তখনও বাজারের উত্তরে কেঁয়েপটীতে ২/৩ ঘর ক্ষত্রিয়ের বসতি ছিল। চৌহান বংশীয় বৃদ্ধ কমলাকান্ত রায়ের বয়স তখন ৮৪ বৎসর; তিনি আমাকের লইয়া গিয়া তাঁহার বাটীর অনতিদূরে পূৰ্ব্বতন উদয়গঞ্জের বাজারে কালীগঙ্গার খাতের উত্তরকূলে মেনাহাতীর সমাধি স্থান ও তাহার ইষ্টকচিহ্ন দেখাইয়া দেন। সমাধি স্থানের ভগ্ন ইষ্টকস্তূপ অনেক কাল ছিল। ওয়েষ্টল্যাণ্ড সাহেবও তাহা স্বচক্ষে দেখিয়াছিলেন। উহা পরে ভাঙ্গিয়া পড়ে এবং লোকাল বোর্ডের রাস্তা নির্ম্মাণ করিবার সময় রাস্তাটি প্রায় উহার উপর দিয়া চলিয়া যায়। কমলাকান্ত তাঁহার যৌবনকালে ঐ ভগ্ন সমাধি হইতে যে ইট আনিয়া নিজ বাটীতে বাহিরের প্রাচীরের কতকাংশ গাঁথিয়াছিলেন, তাহা আমাদিগকে দেখাইয়া দিয়েছিলেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে আক্রমণের আশঙ্কা, লইয়া সীতারামের লোকে তাড়াতাড়ি করিয়া এই সমাধিস্তম্ভ গাঁথিয়াছিল বলিয়া উহা দীর্ঘস্থায়ী হয় নাই।
১৮. অক্ষয়কুমার, ‘সীতারাম’, ৭৮ পৃ।
১৯. ‘Buksh Aly … seized Sittaram, his women, children, and accomplices, and sent them in irons to Moorsheedabad, where Sitraram and the robbers were impaled alive and the women and children sold as slaves.’—Stewart. P. 434. [1813 ed., P. 383 –শি মি]
২০. “The Nawab enclosing Sitaram’s face in cow hide had him drawn to the gallows in the eastern suburbs of Murshidabad on the high way leading to Jahangirnagar and Mahmudabad, and imprisoned for life Sitaram’s women and children and companions. “ — Riyaz. ( Salam ). P. 267.
২১. ‘নবাবী আমলের বাঙ্গালার ইতিহাস’, ৮০ পৃ।
২২. ‘তারিখ্-বাঙ্গালা’ (১৭৬০-৬৪), ‘রিয়াজ’ (১৭৮৬-৮৮), Stewart, History, (1813).
২৩. “The governor wrote a particular representation of all the favourable point of vies.’ – Stewart. P. 434. ‘As for the impaling, admitting even its truth still it was more than the punishment whichg that particular Nawab ordinarily inflicted on zemindars who had fallen in arrear with their rents.’— Westland, P. 387.
২৪. Calcutta Review. ‘The Rajas of Rajshahi.’ Vol, LVI. 1873, P. 38.
২৫. সম্ভবতঃ ১১২০ সালের মাঘ ফাল্গুন মাসে (১৭১৪, ফেব্রুয়ারী) সীতারাম বন্দী হন। মার্চ মাসের প্রথমে তাঁহার পরিবারবর্গ কলিকাতায় ধরা পড়িয়া মুর্শিদাবাদে প্রেরিত হন, সে কথা পরে বলিব। ১১২১ সালের আশ্বিন মাসে মুর্শিদাবাদে সীতারামের মৃত্যু হয়। তাহা হইলে ১৭১৪, ফেব্রুয়ারী হইতে অক্টোবর পৰ্য্যন্ত কয়েক মাস তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন, ধরিতে পারি।
২৬. যদুনাথ, ‘সীতারাম’, ৫ম সং, ১৯১ পৃ।
২৭. সীতারামের শ্রাদ্ধোপলক্ষে তাঁহার পিতৃগুরুবংশীয় শ্রীরাম বাচস্পতিকে ভূমিদানের সনন্দ এই : ‘পরমারাধ্যতম শ্রীযুক্ত শ্রীরাম বাচস্পতি ঠাকুর শ্রীচরণেষু—পরগণে নন্দীর জয়রামপুর ও আঠারবাঁকা গ্রামে আমার জমিদারী তাহাতে “পিতা মহাশয় মুকঃসুদাবাদে গঙ্গা প্রাপ্ত হন। তৎশ্রাদ্ধে ঐ দুই গ্রামের মধ্যে প্রভুরামের মুদাফতের আট আনা ১২ বিঘা শ্রী শ্রী চরণে উৎসর্গীকৃত হইল। দাস ভূম্যধিকারীকে আশীৰ্ব্বাদ করিয়া পুরুষানুক্রমে ভোগ করিতে রহুন। ১১২২ সাল, ২৩শে কার্তিক।’-যদুনাথ; ২৪৪ পৃ। শ্ৰাদ্ধস্থলে ভূমির পরিমাণ মাত্র উল্লিখিত হইয়াছিল, পরে বাটী আসিয়া উহার স্থান নির্দ্দেশ করিয়া সনন্দ দিতে বিলম্ব হয়। সীতারাম আত্মঘাতী হইলে ‘গঙ্গা প্রাপ্ত হন’, সনন্দে একথা থাকিত না। আত্মঘাতীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নাই। বাচস্পতিকে ভূমিদানের যে অন্য সনন্দ আছে, তাহার তারিখ ১১২১, ২৬শে কার্তিক।
২৮. গুরুদেবকে ভূমিদানের সনন্দ এই : ‘আনন্দচন্দ্র গোস্বামী শ্রীচরণেষু প্রণামা আগে মুকঃসুদাবাদ মোকামে ‘পিতামহাশয়ের শ্রাদ্ধে উৎসর্গ ভূমিদানে পং নলদীর কানুটীয়া গ্রামে ৪ পাখী ঘুল্লিয়া গ্রামে। ১০ পাখী বিনোদপুর গ্রামে। ৬ পাখী ও নারায়ণপুর গ্রামে। ৫ পাখী ভূমি দান করিলাম। পিতাঠাকুরের স্বগার্থে পুত্র পৌত্রাদিক্রমে ভূমিদান জমিতে দখল করিতে থাকুন। ইতি ১১২১ তারিখ ২২শে কার্তিক।’ আনন্দচন্দ্রের ভ্রাতা গৌরচরণকেও একই তারিখে উক্ত একই স্থানে সমপরিমাণ অর্থাৎ মোট ২৫ পাখী জমি দান করা হইয়াছিল। এই সকল সনন্দে শ্রীসহি, বলরামদাস’ এইরূপে মুন্সীর স্বাক্ষর আছে। মোহর ও মুন্সীর স্বাক্ষরেই কার্য্য হইত। শ্রাদ্ধকালে গুরুভ্রাতৃদ্বয়ের প্রত্যেককে ২৫ পাখী জমি দান করা হয়, পরে শ্রাদ্ধান্তে বাটী আসিয়া সনন্দ লিখিয়া দেওয়া হয়। সুতরাং মৃত্যুর সময় আশ্বিন মাসে না হইয়া উহার কিছু দিন পূর্ব্বেও হইতে পারে। যদুনাথ শ্রাদ্ধের সনন্দগুলি প্রকাশিত করিয়া সকলের ধন্যবাদভাজন হইয়াছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় কোথায় কোনখানে কিভাবে পাইয়াছেন, তাহা উল্লেখ করেন নাই।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন