সতীশচন্দ্র মিত্র
পাঠান রাজত্বের অবসানে সমরবিজয়ী মোগলেরা বঙ্গের স্বামিত্ব লাভ করিলেন বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ২৫ বৎসরের মধ্যে এদেশকে শাসনতলে আনিতে পারেন নাই। ১৫৮০ খৃষ্টাব্দে যখন দেশময় তুমুল বিদ্রোহ উপস্থিত হয়, তখন সুদক্ষ সেনানী টোডরমল্ল বিদ্রোহী জমিদারবর্গের কতককে নির্জ্জিত ও কতককে বশীভূত করিয়া বঙ্গীয় রাজস্বের এক হিসাব প্রস্তুত করেন; কিন্তু হিসাব শুধু কাগজেই থাকিল, আগ্রা হইতে অর্থ আসিয়া বঙ্গের যুদ্ধব্যয় চালাইতে লাগিল বটে, কিন্তু বিংশ বৎসরের মধ্যে এদেশ হইতে কপদকমাত্রও রাজকোষে প্রেরিত হইয়াছিল কিনা সন্দেহস্থল। খাঁ আজম বা শাহাবাজ খাঁ আসিয়া অবস্থার বিশেষ কোন পরিবর্তন করিতে পারিলেন না। তখন আসিলেন বাদশাহ্ আকবরের সর্ব্বপ্রধান সেনাপতি রাজা মানসিংহ। তিনি ১৫৮৯ খৃঃ অব্দ হইতে ১৬০৪ অব্দ পর্যন্ত বঙ্গের সুবাদার ছিলেন। ইহার মধ্যে ১৫৯৮-৯ অব্দে তিনি বাদশাহের আদেশে একবার মাত্র দাক্ষিণাত্য জয় করিতে গিয়া বঙ্গে অনুপস্থিত ছিলেন। ১৬০০ অব্দে তিনি পুনরায় এদেশে আসিয়া চারি বৎসর কাল প্রবল প্রতাপে কাৰ্য্য চালাইয়া[১] ১৬০৪ খ্রিঃ অব্দে স্ব-ইচ্ছায় কাৰ্য্য ত্যাগ করিয়া চলিয়া যান। ১৬০৫ অব্দে আকবরের মৃত্যুর পর যখন তৎপুত্র জাহাঙ্গীর বাদশাহ হন, তখন তিনি মানসিংহকে রাজধানীর চক্রান্ত হইতে দূরে রাখিবার জন্য পুনরায় তাঁহাকে বঙ্গের শাসন-কার্য্যে প্রেরণ করেন। কিন্তু এবার মানসিংহ ৮ মাস কাল মাত্ৰ আগ্রা হইতে দূরে ছিলেন, সে সময় তিনি রাজমহল ছাড়িয়া পূর্ব্বদিকে কোথায়ও অগ্রসর হইয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না; তিনি বঙ্গের স্বাস্থ্যকে বড় ভয় করিতেন,[২] বিহার ছাড়িয়া সহজে বঙ্গে আসিতে চাহিতেন না; বিশেষতঃ উক্ত ৮ মাসের কতকাংশ যাতায়াতে গিয়াছিল, অবশিষ্ট স্বল্প সময়ের মধ্যে দুঃসাহসিক অভিযানে যোগ দেওয়া যায় না। সুতরাং ১৬০৪ খৃষ্টাব্দই প্রকৃতপক্ষে তাঁহার বঙ্গ শাসনের শেষ বৎসর; উহারই মধ্যে তাঁহার সহিত প্রতাপাদিত্যের ভীষণ সংঘর্ষ উপস্থিত হয়।
মানসিংহ ১৫৯২ খৃঃ অব্দে কিরূপে উড়িষ্যা জয় করেন, তাহা আমরা দেখিয়াছি। তৎপরে ১৫৯৫ অব্দে তিনি রাজমহলে রাজধানী স্থাপন করেন।[৩] ঐ বৎসরই তিনি ভূষণার বিদ্রোহ দমন জন্য স্বীয় পুত্র দুর্জ্জন সিংহের অধীনে একদল সৈন্য পাঠান। এই সময়ে ভুঞারাজগণ পাঠানের সহিত যোগ দিয়া মোগলের বিপক্ষে দণ্ডায়মান হইয়াছিলেন। উড়িষ্যার ঈশা খাঁর পুত্র পাঠান সদার সুলেমান এবং শ্রীপুরের কেদার রায় উভয়ে আসিয়া যুদ্ধ করেন। সুলমান নিহত ও কেদার রায় পরাজিত হইলে ভুষণা অধিকৃত হয়। সুলেমানের মৃত্যুর পর তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ওসমান পাঠান বিদ্রোহের প্রধান নেতা হন। কুচবেহারের রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ, জ্ঞাতি ভ্রাতা রঘুরায়ের সহিত বিরোধ করিয়া মানসিংহের বশ্যতা স্বীকার করেন। রঘুরায় কত্রাভুর ঈশা খাঁ ও মাশুম খাঁ কাবুলীর সহিত যোগ দিয়া প্রবল হইলে পুনরায় দুর্জন সিংহ প্রেরিত হন। বিক্রমপুরের ৬ ক্রোশ দূরে ঈশা ও মাশুম বহুসংখ্যক রণতরী লইয়া যে যুদ্ধ করেন, তাহাতে দুর্জন সিংহ প্রাণত্যাগ করেন।[৪] কিছুদিন পরে মাশুম খাঁ রোগাক্রান্ত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং ঈশা খাঁ বশ্যতা স্বীকার করেন। লক্ষ্মীনারায়ণ মানসিংহকে কন্যাদান করতঃ সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হইয়াছিলেন।[৫]
এইরূপে উত্তরবঙ্গ কতকটা শাসনাধীন করিয়া মানসিংহ দাক্ষিণাত্য বিজয়ের জন্য চলিয়া যাইতে বাধ্য হন। তখন তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র জগৎ সিংহ বঙ্গের সুবাদার হন। কিন্তু কয়েকদিন মধ্যে অকস্মাৎ আগ্রায় তাঁহার মৃত্যু ঘটিলে, জগতের ১৫/১৬ বৎসর বয়স্ক পুত্র মহাসিংহ পিতৃপদ পাইলেন।[৬] কিন্তু বঙ্গের মসনদ বালকের জন্য নহে। শাসনের শিথিলতা দেখিবামাত্র বঙ্গীয় ভুঞাগণ পুনরায় ঘোর বিদ্রোহী হইয়া উঠিলেন। ওসমানের অধীন দুর্দান্ত আফগানেরা ভদ্রকে বাদশাহী সৈন্যকে ভীষণভাবে পরাজিত করিয়া পুনরায় উড়িষ্যা দখল করিয়া লইলেন। শ্রীপুরের কেদার পরাক্রান্ত নৃপতির মত শাসন করিতেছিলেন; ভূষণার মুকুন্দরাম পুনরায় মাথা তুলিলেন, বালার রামচন্দ্র তখনও নাবালক, প্রতাপাদিত্যের তত্ত্বাবধানে তাঁহার রাজ্য নিরাপদ ছিল। সকলের মধ্যে প্রতপাদিত্যই সৰ্ব্বাপেক্ষা প্রবল হইয়া শিরোত্তোলন করিলেন। এইবার তিনি সত্যসত্যই প্রকাশ্যভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করিলেন। মহারাজ প্রতাপাদিত্য এইবার মহাসমারোহে নূতন করিয়া রাজতক্তে বসিলেন। রাজসূয় যজ্ঞের মত এক বিরাট ব্যাপার অনুষ্ঠিত হইল, কত সমধর্মী রাজন্য ও জমিদার, কত সহৃদয় আত্মীয় স্বজন আসিয়া আন্দোৎসবে ও পরামর্শ-সভায় যোগ দিলেন। বহুদিন ধরিয়া যশোহরপুরী আনন্দলহরীতে আত্মহারা হইয়া রহিল। স্বাধীনতা ঘোষণা করা কত বিপদ-সঙ্কুল এবং মোগল শত্রু কত সমর-নিপুণ, প্রতাপ সকলকে তাহা বুঝাইয়া দিলেন; সকলে সমবেত না হইলে দেশমাতৃকার সমুদ্ধার হইবে না, প্রতাপের পরাজয়ে প্রতাপের কি হইবে? হইবে দেশের সর্ব্বনাশ, ইহাই যেন সকলে বুঝিয়া যান। আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি, এই সময়ে প্রতাপ কল্পতরু হইয়া অপরিমিত অর্থ লুটাইয়া দিয়াছিলেন (১৫শ পরিচ্ছেদ) এবং দানের স্রোতে সকলের ভক্তিপ্রীতি সমাকর্ষণ করিয়া ধন্য হইয়াছিলেন।
কথিত আছে, প্রতাপাদিত্য এই সময়ে নিজ নামে মুদ্রা প্রচারিত করেন। কোনও রাজার পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণার এমন নিদর্শন আর নাই। কিন্তু একান্ত দুঃখের বিষয় আমি বহু বৎসর ঐকান্তিক চেষ্টার ফলেও এই মুদ্রার একটিও দেখিতে পাই নাই, সে কথা পূৰ্ব্বে বলিয়াছি (৪র্থ পরিচ্ছেদ)। এজন্য কোন প্রকার চেষ্টা, অনুসন্ধান, অর্থব্যয় বা সময়ক্ষেপে কাতর হাই নাই। লোকমুখে শুনি, প্রতাপাদিত্যের ত্রিকোণ মুদ্রা ছিল। চতুষ্কোণ, অষ্টকোণ, গোলাকার বা ডিম্বাকার প্রভৃতি নানা আকারের মুদ্রার কথা জানি, কিন্তু অন্য কেহ ত্রিকোণ মুদ্রা প্রচার করিয়াছিলেন বলিয়া শুনি নাই। তবে প্রতাপাদিত্যের ত্রিকোণ মুদ্রা থাকা বিচিত্র নহে; তিনি ত্রিকোণ মন্দির, ত্রিকোণ পুকুর বা পুষ্পাধার রচনা করিয়াছিলেন (১৫শ পরিচ্ছেদ); বিশেষত্বের জন্য বা তান্ত্রিকতার খাতিরে তিনি ত্রিকোণ মুদ্রাও প্রস্তুত করাইতে পারেন। তাঁহার পতনের পর এদেশে মোগলেরা এরূপভাবে তাঁহার কীর্ত্তিস্মৃতি বা স্বাধীনতার চিহ্ন বিলুপ্ত করিয়াছিল যে, সে সময়ে হয়ত বিশুদ্ধ রৌপ্যের মুদ্রাগুলি কতক লুণ্ঠিত হইয়া নষ্ট হইয়াছিল, কতক লোকে ভয়ে বাহির করিতে না পারিয়া গলাইয়া গহনা গড়িয়াছিল বা মাটির গর্ভে পুতিয়া রাখিয়াছিল। হয়ত কোনদিন দৈবাৎ এরূপ মুদ্রা বাহির হইয়া পড়িতে পারে। কিন্তু তবুও যতদিন তাহা চক্ষে না দেখিব, ততদিন তাহার অস্তিত্বে আস্থা করিতে বা অন্যকে বিশ্বাস করিবার জন্য বলিতে পারি না।
সত্যচরণ শাস্ত্রী মহাশয় প্রথমে এই মুদ্রার কথা প্রচার করেন। তিনিও মুদ্রা দেখেন নাই; তিনি যে খোঁড়গাছির রাজা রাজেন্দ্রনাথের মুখে উহার কথা শুনিয়াছিলেন, তিনিও নিজে মুদ্ৰা দেখেন নাই। রাজা মহাশয় রামনগর নিবাসী বাণী সরকার নামক জনৈক কায়স্থ মহাশয়ের নিকট এই মুদ্রার কথা শুনেন। বাণী সরকার নুরনগরে যে-মুদ্রা স্বচক্ষে দেখেন, তাহা সম্মুখ পৃষ্ঠে ‘শ্রীশ্রীকালী প্রসাদেন ভবতি শ্রীমন্মহারাজ প্রতাপাদিত্য রায়স্য’ এবং পরপৃষ্ঠে ‘বজৎ সিক্কা বছিমো জরবে বাঙ্গাল মহারাজা প্রতাপাদিত্য জৰ্দ্দাল।’ —এইরূপ লেখা ছিল। যদি ইহা সত্য হয়,[৭] তাহা হইলে সম্ভবতঃ প্রথম পৃষ্ঠা বাঙ্গলা অক্ষরে এবং পর পৃষ্ঠা ফার্সী অক্ষরে সেই ভাষায় লিখিত ছিল। ‘জরবে’ (টাকশাল) শব্দের পর নিশ্চয়ই স্থানের নাম লেখা ছিল, কিন্তু উহার পাঠোদ্ধার হয় নাই। এই টঙ্কশালা বা টাঁকশাল কোথায়, তৎসম্বন্ধেও বহু অনুসন্ধান করিয়াছি। সম্ভবতঃ সুন্দরবনের আধুনিক ১৪৬ নং লাটে রায়মঙ্গল দুর্গের মধ্যে এই টাঁকশাল ছিল, সে কথা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি (১৯শ পরিচ্ছেদ)। ধুমঘাটে বহু অনুসন্ধান করিয়াও টাঁকশালের নিদর্শন পাই নাই। হয়ত মোগলের ভাবী আক্রমণের আশঙ্কায় রাজধানী হইতে দূরে দুর্ভেদ্য গুপ্ত স্থানে মুদ্রা প্রস্তুত হইত। প্রতাপাদিত্যের রাজত্বের শেষভাগে তাঁহার নিজ নামাঙ্কিত মুদ্রা প্রচলিত হইয়া থাকিলেও তাঁহার পিতা ও তাঁহার নিজ রাজত্বকালে সুলেমান কররাণীর পুত্র দায়ূদের নামাঙ্কিত পাঠান মুদ্ৰাই অধিক চলিত। আমি ঈশ্বরীপুর অঞ্চলে মুদ্রার অনুসন্ধান করিতে গিয়া কয়েক স্থলে দায়ুদের মুদ্রাই পাইয়াছি; এমন কি যশোহরের উত্তর ভাগে বারবাজার প্রভৃতি স্থানেও এই মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। উহাতে দিল্লীর সুরবংশীয় পাঠান বাদশাহগণের অনুকরণে দেবনাগর অক্ষরে ‘শ্রীদাউদসাহী’ বলিয়া লিখিত আছে[৮] দায়ুদ শাহ স্বাধীনতা অবলম্বন করিয়াই এই মুদ্রা প্রচলন করেন, প্রতাপাদিত্য উহার অনুকরণ করিবেন, বিচিত্র কি?
শুধু রৌপ্যাদি ধাতুনির্ম্মিত মুদ্রাকেই যে মুদ্রা বলে, তাহা নহে, প্রাচীনকালে রাজা স্বীয় নামাঙ্কিত পোড়া মাটির (terracotta) মুদ্রার ব্যবহার করিতেন। তবে উহা অর্থরূপে বিনিময়ের জন্য ব্যবহৃত হইত না। মাটির মুদ্রা রাজকীয় পত্রাদির সঙ্গে সংযোজিত হইয়া অন্যত্র প্রেরিত হইত। ঐ মুদ্রায় একটি ছিদ্র থাকিত, তন্মধ্য দিয়া লৌহ-দ্বারা পত্রাদি বাঁধিয়া গালা দ্বারা আঁটিয়া দেওয়া হইত। এইরূপ মুদ্রা সঙ্গে থাকিলে, পত্রের উপর বিশ্বাস বাড়িত। অতি প্রাচীনকাল হইতে ভারতবর্ষে এইরূপ পোড়া মাটির মুদ্রার প্রচলন ছিল। শ্রীহর্ষের গ্রন্থে এবং মুদ্রারাক্ষস প্রভৃতি নাটকে এই মুদ্রার উল্লেখ আছে। কিছুদিন হইল বিহারের অন্তর্গত প্রাচীন নালন্দার খনন কালে এইরূপ বহু মুদ্ৰা আবিষ্কৃত হইয়াছে। কামরূপাধিপতি নালন্দার সর্ব্বাধ্যক্ষ শীলভদ্রকে এইরূপ মুদ্রাযুক্ত পত্র লিখিতেন। সম্প্রতি প্রতাপের ধুমঘাট দুর্গের পরিখাপার্শ্বে এইরূপ একটি পোড়া মাটির মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে, উহা আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি।[৯] মুদ্রাটি চেপ্টা, ডিম্বাকার; পরিমাণ ২ ́ × ১ ৩/৪ ́ ́ ইঞ্চি; আধ ইঞ্চির কিছু বেশী পুরু। এক কোণে একটু সরু হইয়া গিয়াছে, সেখানে তার দিয়া বাঁধিবার ছিদ্র আছে। উহার দুই পৃষ্ঠাতেই কিছু কিছু লেখা আছে, তাহা সম্পূর্ণ পড়া যায় না। একপার্শ্বে ‘সং ১৬ মাঘ দিনে গুহস্য প্রতাপাদিত্য’ এইরূপ কিছু অস্পষ্ট লেখা আছে। উহা হইতে মনে হয়, প্রতাপাদিত্যের রাজত্বের ১৬শ বর্ষে ৬ই মাঘ তারিখে এই মুদ্রা ব্যবহৃত হইতেছিল। বোধ হয় এই জাতীয় মুদ্রাগুলি পূর্ব্বে প্রস্তুত থাকিত না, আবশ্যক মত কাঁচা অবস্থায় উহার উপর যথেচ্ছ তারিখ ও স্বাক্ষরাদি লিখিয়া তৎক্ষণাৎ পুড়াইয়া লইয়া পত্রের সহিত সংলগ্ন করিয়া দেওয়া হইত। স্বাধীন এবং পরাক্রান্ত নৃপতিগণ এইরূপ মুদ্রা নিয়ত ব্যবহার করিতেন; প্রতাপাদিত্য ভারতের সেই চিরন্তন রীতির অনুবর্তন করিয়াছিলেন।
স্বাধীনতা ঘোষণার সময়ে এবং পরবর্ত্তী দুই এক বৎসরের মধ্যে প্রতাপাদিত্যের নিজ শাসিত রাজ্যও বহুবিস্তৃত হইয়া পড়িয়াছিল। দক্ষিণ দিকের ত কথাই নাই; প্রতাপাদিত্য ‘সুন্দরবনের বাঘ’ বলিয়া খ্যাত; সমস্ত সুন্দরবন তাঁহার করায়ত্ত এবং তাঁহার রাজত্ব সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। ঘটকেরা তাহাকে ‘আসমুদ্রকরগ্রাহী’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। পূর্ব্ব দিকে বলেশ্বর নদ তাঁহার রাজ্যের সীমা ছিল, কিন্তু উহা পার হইয়াও তিনি কয়েকটি পরগণা হস্তগত করিয়াছিলেন। বসন্ত রায়ের মৃত্যুর পর চকশ্রী বা চাকশিরি তাঁহার দখলে আসে এবং চাকশিরিতে তিনি একটি প্রধান নৌ-দুর্গ স্থাপন করেন। উহার বিশেষ বিবরণ যথাস্থানে দিয়াছি (১৯শ পরিচ্ছেদ)। চাকশিরির পূর্ব্ববর্ত্তী পরগণাগুলি এই সময়ে দ্বিগঙ্গা সেনবংশীয় মদনমোহনের অধিকারভুক্ত ছিল। তিনি দূরবর্তী স্থানে থাকিয়া পৈতৃক সম্পত্তিভুক্ত ১৪টি পরগণার বৃত্তি ভোগ করিতেন।[১০] সুতরাং প্রতাপাদিত্যের মত পরাক্রান্ত ব্যক্তির সে সব পরগণা দখল করিয়া লইতে বিশেষ কষ্ট হয় নাই। উক্ত ১৪ পরগণার নাম- কাশেমপুর, শিবপুর, তপে রুদ্রপুর, বনগ্রাম, মধুদিয়া, সুলতানপুর, সোন্ধারকুল,[১১] আবদুল্লাপুর, ইব্রাহিমপুর, রাজোর, সেলিমাবাদ, নাজিরপুর, হাবেলী ও চিরুলিয়া। ইহার মধ্যে চিরুলিয়া ব্যতীত আর ১৩টি পরগণা প্রতাপাদিত্যের অধিকারে আসিয়াছিল। উহার মধ্যে হইতে তিনি বনগ্রাম পরগণা স্বীয় প্রিয়তম ভাগিনেয় লক্ষ্মণ ঘোষকে প্রদান করেন[১২] এবং হাবেলী পরগণা বসন্ত রায়ের ভগিনী ভবানী দেবীকে প্রদত্ত হয়। তদবধি ভবানী ও তাঁহার স্বামী পরমানন্দ রায় এই পরগণায় অর্থাৎ বর্ত্তমান বাগেরহাটে বাস করেন।[১৩] কিছুদিন পরে যখন স্বাধীনতা ঘোষণার সময়ে প্রতাপাদিত্য ‘কল্পতরু যজ্ঞ’ করেন, তখন জানকীবল্লভ সরকার নামক জনৈক বৈদ্যবংশীয় কর্ম্মচারী বিশেষ দক্ষতা ও সুশৃংঙ্খলার সহিত কতকগুলি গুরুতর কার্য সুসম্পন্ন করেন বলিয়া প্রতাপের নিকট হইতে পুরস্কার স্বরূপ সুলতানপুর-খড়রিয়া ও বেলফুলিয়া পরগণার জমিদারী সনন্দ পাইয়াছিলেন।[১৪]
পশ্চিমদিকে ভাগীরথী নদীই প্রতাপাদিত্যের বিস্তীর্ণ রাজ্যের নির্দ্দিষ্ট সীমা ছিল, তবে দক্ষিণাংশে তিনি হিজলী জয় করিয়া লওয়ায় সমুদ্রের নিকট দিয়া তাঁহার রাজ্য উড়িষ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল। বর্তমান কলিকাতার অপরপারস্থ সালখিয়া প্রভৃতি দুই একটি স্থান তাঁহার ভাগীরথী-বাণিজ্যের শুল্ক আদায়ের কেন্দ্র হইয়াছিল। বসন্ত রায়ের হত্যার পর যশোর রাজ্যের পশ্চিমভাগে তিনি দোৰ্দ্দান্ত প্রতাপে শাসনদণ্ড পরিচালনা করিতেছিলেন। ত্রিবেণী পর্যন্ত যমুনা নদীর দক্ষিণস্থ বর্ত্তমান ২৪-পরগণা জেলার সমস্ত অংশ তাঁহার করতলগত ছিল। তিনি হালিসহর কাঁচড়াপাড়া, জগদ্দল প্রভৃতি স্থান হুগলীর মোগল ফৌজদারের কবল হইতে সবলে দখল করিয়া লইয়াছিলেন। জগদ্দলে তাঁহার যে দুর্গ ছিল, উহার বিবরণ পূর্ব্বে দিয়াছি (১৯শ পরিচ্ছেদ)। কথিত আছে, যমুনার উত্তরে বর্ত্তমান নদীয়া জেলার কতক স্থানও প্রতাপাদিত্যের অধীনতা স্বীকার করিয়াছিল। এই সময়ে কুশদ্বীপ বা কুশদহ পরগণা পাণ্ডিত্যগৌরবে নবদ্বীপের সহিত সমকক্ষতা করিত। এই পরগণা তখন বর্তমান গোবরডাঙ্গা অঞ্চল হইতে রাণাঘাট প্রভৃতি স্থান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল; কুশদহ পরগণা এক্ষণে যশোহর, নদীয়া ও ২৪-পরগণার মধ্যে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছে। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে এই পরগণার অধীশ্বর ছিলেন কায়স্থ কুলভূষণ কাশীনাথ রায়। কথিত আছে, দায়ুদ খাঁর সহিত মোগলের সংঘর্ষকালে কাশীনাথ মোগল পক্ষে যোগ দিয়া সৈন্যাধ্যক্ষরূপে অসাধারণ শৌর্য্য প্রদর্শন করেন। বাদশাহ আকবর তাঁহার প্রতি সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে ‘রাজা সমরসিংহ’ এই গৌরবান্বিত উপাধিতে ভূষিত করেন। তখন তিনি জলেশ্বরের সন্নিকটবর্তী যমুনাবেষ্টিত চতুৰ্ব্বেষ্টিত দুর্গ বা চৌবেড়িয়ার দুর্গ ও প্রাসাদ নির্ম্মাণ করিয়া বাস করেন। কিন্তু অল্পদিন মধ্যে তদীয় মন্ত্রী রাজা সতীশের চক্রান্তে কুলি খাঁ যখন বঙ্গের মোগল শাসনকৰ্ত্তা (১৫৭৭-৭৮) তখন তাঁহার প্রাণদণ্ড হয়।[১৫] তখন তাঁহার রাজ্য ইছাপুরের চৌধুরী বংশের কৃতী পুরুষ রাঘব সিদ্ধান্তবাগীশের হস্তগত হয়।[১৬] মহারাজ প্রতাপাদিত্য কুশদ্বীপের রাজস্ব দাবি করিয়া কিরূপে সসৈন্যে আক্রমণ করেন ও সিদ্ধান্তবাগীশ তাঁহার বশ্যতা স্বীকার করিলে প্রতাপপুর প্রতিষ্ঠা করিয়া প্রতিনিবৃত্ত হন, তাহা আমরা পূর্ব্বে বর্ণনা করিয়াছি (১৫শ পরিচ্ছেদ)।
প্রতাপাদিত্য যখন এইরূপ বিস্তৃত রাজ্য শাসন করিতেছিলেন, তখনই তাঁহার সহিত সপ্তগ্রামের ফৌজদারের বিবাদ বাধে। কিন্তু তখন তাঁহার নৌ-বাহিনী এরূপ সুব্যবস্থিত ও শক্তিশালী হইয়া উঠে যে, ফৌজদার চেষ্টা করিয়াও তাহার কিছুই করিতে পারেন নাই। ত্রিবেণী হইতে যমুনাপথে যশোহরের দিকে অগ্রসর হওয়াই তাঁহার পক্ষে অসম্ভব হইয়া পড়ে। প্রতাপ রাজ্যজয়ের সঙ্গে সঙ্গে সৰ্ব্বত্র শাসন বিষয়ক শৃঙ্খলা স্থাপন জন্য তাঁহার সুযোগ্য কর্মচারীদিগকে প্রেরণ করেন। বঙ্গীয় রাজন্য ও জমিদারবর্গ যাহাতে তাঁহার নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতার জন্য একমত হইয়া কার্য্য করেন, তাঁহাদের হৃদয়ে যাহাতে দেশ-মাতৃকার প্রতি ভক্তি-প্রীতির সমুদ্রেক হয়, তজ্জন্য তিনি সর্ব্বত্র উপযুক্ত দূত প্রেরণ করিয়াছিলেন। কথিত আছে, এই দৌত্যকার্য্যের অগ্রগণ্য ছিলেন তাঁহার পরমবন্ধু শঙ্কর চক্রবর্ত্তী। তিনি যেমন মিষ্টভাষী ও সুবক্তা, তেমনই সাহসী, অক্লান্তকর্মী ও কূটনীতি-বিশারদ। যখন যেভাবে কোন গুরুতর কার্যভার তাঁহার স্কন্ধে সমর্পিত হইত, তখন তিনি প্রাণপণে উহা সম্পন্ন না করিয়া নিশ্চিন্ত হইতেন না। ১৫৯৯ খৃঃ অব্দে যখন প্রতাপাদিত্য স্বাধীনতা বিজ্ঞাপিত করিয়া রাজতক্তে বসেন, তাহারই প্রাক্কালে প্রতাপের অনুচরগণ দেশীয় রাজন্যবর্গের সহিত দেখা সাক্ষাৎ করিয়া, অভিষেক উপলক্ষ্যে যশোহরে পদার্পণ করিবার জন্য তাঁহাদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া আসেন। শুধু রাজা বা জমিদারবর্গ নহেন, জন- সংঘকে উদ্বুদ্ধ করাই দূতগণের প্রধান কার্য্য ছিল। শঙ্কর চক্রবর্ত্তী বক্তৃতার প্রভাবে সকলের হৃদয়ে আঘাত করিতে পারিতেন। তিনি নানাস্থান ঘুরিয়া অবশেষে রাজমহলে উপনীত হন। মোগলেরা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিবার জন্য কিরূপ আয়োজন করিতেছিলেন, তৎপক্ষে তাঁহাদের শক্তি বা অভিসন্ধি পরীক্ষা করাই তাঁহার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল।
সম্ভবতঃ এই সময়ে মানসিংহ দাক্ষিণাত্য বিজয়ের জন্য রাজমহল ত্যাগ করিয়াছিলেন। শুনা যায়, তখন শের খাঁ নামক এক ব্যক্তি কোন এক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী ছিলেন।[১৭[ তিনি শঙ্করের প্রচেষ্টায় বৃত্তান্ত জানিয়া ঘটনাক্রমে তাঁহাকে বন্দী করিয়া রাখেন। ‘শের’ শব্দে ব্যাঘ্র বুঝায়, এই জন্য তখন এক প্রবাদ উঠিল :
‘শঙ্কর চক্রবর্ত্তীকে খেলো বাঘে
অন্য লোক আর কোথায় লাগে?’
যাহা হউক, শঙ্কর কিন্তু বাঘের কবল হইতে রক্ষা পাইয়াছিলেন। তিনি অচিরে কারারক্ষিগণকে বশীভূত করিয়া রাজমহল হইতে পলায়ন করেন। তজ্জন্য শীঘ্রই ক্রোধান্ধ শের খাঁর সহিত প্রতাপের সেনাদলের সংঘর্ষ হয়। উহার ফলে মোগল পক্ষ পরাজিত হইল, প্রতাপের দুর্দ্ধর্ষ রণতরী সমূহ শত্রুদিগকে রাজমহল পর্যন্ত বিতাড়িত করিয়া দেয়। ইহারই জন্য জনশ্রুতি আছে, প্রতাপাদিত্য রাজমহল পর্যন্ত রাজ্য জয় করেন। যাহা হউক, ১৬০০ খৃঃ অব্দে তাঁহার ক্ষমতা এবং বীরত্বখ্যাতি যে শেষ সীমায় পৌঁছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। তাঁহার সেই অসীম ক্ষমতার বার্তা প্রায় দেড় শত বৎসর পরেও কবির লেখনীমুখে ফুটিয়া উঠিয়াছিল। ভাগ্যবান কবির ভাষার মাহাত্ম্যে তাহা এখনও বঙ্গের ঘরে ঘরে অনুরণিত হইতেছে। কবিবর ভারতচন্দ্র লিখিয়া গিয়াছেন :
‘যশোর নগর ধাম প্রতাপ আদিত্য নাম,
মহারাজা বঙ্গজ কায়স্থ।
নাহি মানে পাতশায়, কেহ নাহি আটে তায়,
ভয়ে যত ভূপতি দ্বারস্থ।
বরপুত্র ভবানীর প্রিয়তম পৃথিবীর
বায়ান্ন হাজার যার ঢালী।
ষোড়শ হল্কা হাতী, অযুত তুরঙ্গ সাতি
যুদ্ধকালে সেনাপতি কালী।’
দৈববল ব্যতীত কেহই সেরূপ অসাধারণ বলশালী হইতে পারে না, ইহাই লোকের ধারণা ছিল এবং দৈববল হারাইয়াই প্রতাপের পতন হইয়াছিল, ইহাই পরিণামে সপ্রমাণ করিবার জন্য কত প্রবাদের সৃষ্টি হইয়াছিল। যাহা হউক তাঁহাকে দমন করা যে একান্ত আবশ্যক, তাহা মোগল বৃত্তিভোগীরা সকলেই বুঝিয়াছিলেন; এই জন্য তাঁহার দৌর্জ্জন্যের সংবাদ নানা মুখে নানা ভাবে বাদশাহের রাজধানীতে পৌঁছিতেছিল।
কিছুকাল পূর্ব্ব হইতে রূপরাম বসু কচু রায়কে লইয়া আগ্রায় ছিলেন। কিন্তু যশোহরের আরজী ভাল ভাবে বাদশাহের গোচরীভূত করিবার সুযোগ ঘটে নাই। কথিত আছে, এই সময়ে কচু রায় উপযুক্ত শিক্ষক রাখিয়া সুন্দর ভাবে ফারসী শিক্ষা করিয়াছিলেন।[১৯] যখন বঙ্গ হইতে প্রতাপের দৌর্জ্জন্যের কাহিনী আসিতেছিল,[১৯] তখন তাঁহার সাক্ষ্য সেই কাহিনীর প্রধান সমর্থক হইল। ‘ক্ষিতিশ-বংশাবলী-চরিতে’ আছে : ‘অনন্তরমিন্দ্রপ্রস্থ পুরেশ্বরো লিপিতঃ প্রতাপাদিত্যস্য দৌর্জন্যং সমধিগচ্ছন্ কচুরায়েণাপি ইন্দ্রপ্রস্থপুরগতেন সাক্ষিণেব তদানীমেব তদ্দৌজন্য গোচরীকৃতং। অথ ইন্দ্রপ্রস্থপুরেশ্বরো রোষাৎ প্রস্ফুরিতাধরো দ্বাবিংশত্যা সেনাপতিভিঃ সহ মানসিংহনামানং কঞ্চিৎ প্রধানামাত্যমাদিদেশ যথা মানসিংহ ভবান মহতা সৈন্যেন পরিবারিতঃ প্রতাপাদিত্যং দুরাত্মনং ঝটিতি বদ্ধা সমানয়তু।’ এই আদেশ পাইয়া মানসিংহ বহু সৈন্যসামন্ত লইয়া মহাড়ম্বরে বঙ্গাভিমুখে যাত্রা করিলেন।
ঘটকেরা বলিয়াছেন যে, মানসিংহের আক্রমণের পূর্ব্বে বাদশাহ বঙ্গাধিপ প্রতাপের বিনাস জন্য ‘দ্বাবিংশতিতমখানান্ প্রেষয়ামাস সত্বরং’ অর্থাৎ ২২ জন আমীরকে সসৈন্যে প্রেরণ করেন। কয়েকটি কারণে একথা সত্য বলিয়া মানিতে পারি না।[২০] প্রথমতঃ ১৫৮৯ খৃঃ অব্দ পর্যন্ত যখন মানসিংহ উড়িষ্যা ও উত্তরবঙ্গে বিদ্রোহ নিবারণ জন্য ব্যাপৃত ছিলেন, তখন প্রতাপ অনুগতভাবে কিছুদিন তাঁহার সাহায্যই করিয়াছিলেন, কোন অসদ্ভাব করেন নাই। শেষ দুই তিন বৎসর প্রতাপ রাজ্য বিস্তার করিবার সময়ে প্রকাশ্যভাবে মোগলের সহিত বিবাদ করেন নাই। সুতরাং এ সময়ে আমীরগণের আসিবার কারণ হয় নাই। দ্বিতীয়তঃ, ১৫৯৯ অব্দে মানসিংহ দাক্ষিণাত্য বিজয় জন্য বঙ্গ ত্যাগ করিলে প্রতাপ স্বাধীনতা অবলম্বন করেন, ওসমান উড়িষ্যা দখল করেন এবং দেশময় তুমুল বিদ্রোহ হয়। ঐ সময়ে মানসিংহের পুত্র ও প্রতিনিধি জগৎসিংহের মৃত্যু হওয়াতে, বৎসরের মধ্যে মানসিংহকে ফিরিয়া আসিয়া সেরপুরের যুদ্ধে পাঠানদিগকে পরাজিত করিতে হয়। এই বৎসর মধ্যে বাদশাহ যদি ২২ জন আমীরকে ভার দিয়া পাঠাইতেন, তাহা হইলে একক মানসিংহের তত ব্যস্ত হইয়া ফিরিবার আবশ্যক হইত না। তৃতীয়তঃ কোন এক জনকে বিশেষ ভার না দিয়া ২২ জনকে এক সঙ্গে বা আগে ভাগে পাঠাইবার কোন যুদ্ধরীতি দেখিতে পাওয়া যায় না। ভারপ্রাপ্ত কেহ আসিলে ২২শ জনের নাম হইত না। চতুর্থতঃ, ধুমঘাটে টেঙ্গা মসজিদের কাছে ১২ জন ওমরাহের কবর আছে। অথচ যুদ্ধ সেখানে হয় নাই। পরাজিত আমীরদিগের শবদেহ দূরবর্ত্তী যুদ্ধক্ষেত্র হইতে আনিয়া সযত্নে নিজ রাজধানীতে এবং প্রধান মসজিদের পার্শ্বে কবর দিবার উদ্যোগ বা প্রবৃত্তি প্রতাপাদিত্যের হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না। অপর পক্ষে আমীরগণ মানসিংহের নেতৃত্বে তাঁহারই সহচর হইয়া আসিয়াছিলেন এবং তিনি যুদ্ধান্তে যখন রাজধানী দখল করেন, তখন উঁহাদের শবদেহ আনিয়া সমাধিস্থ করিয়া যান। সুতরাং ‘ক্ষিতিশবংশাবলীতে’ এবং ‘অন্নদামঙ্গলে’ যেমন আছে, তাহাই সত্য :
“বাইশী লঙ্কর সঙ্গে, কচুরায় লয়ে রঙ্গে
মানসিংহ বাঙ্গালা আইল।”
১৫৯৯ অব্দের শেষ ভাগে সেরপুর আতাই যুদ্ধে ওসমানকে পরাজিত করিবার পর মানসিংহ রাজধানীতে গিয়া বাদশাহের সহিত সাক্ষাৎ করেন। তখন আকবর তাঁহাকে সাত হাজারী মনসবদারী প্রদান করিয়া সমস্ত ওমরাহের শীর্ষদেশে স্থান দেন।[২১] এইবার প্রতাপাদিত্যের বিবরণ পৌঁছিল, এবং মানসিংহ বিংশ সহস্র রাজপুত সৈন্যের অধীশ্বর হইয়া বঙ্গদেশ শাসন করিতে আসিলেন। কথিত আছে, আসিবার কালে তিনি বারাণসীধামে কিছুদিন বাস করিয়াছিলেন। ঐ সময়ে তিনি কামদেব ব্রহ্মচারী নামক একজন তেজস্বী সন্ন্যাসীর জ্ঞানবৈরাগ্যে মুগ্ধ হইয়া তাঁহার নিকট শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত হন। সন্ন্যাসী বাঙ্গালী ব্রাহ্মণ, তাঁহার পূর্ব্ব নাম কামদেব গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁহার পুত্র লক্ষ্মীকান্ত প্রতাপাদিত্যের সরকারে রাজস্ব বিভাগের প্রধান কর্মচারী ছিলেন (২১শ পরিচ্ছেদ)। মানসিংহ গুরুর নিকট লক্ষ্মীকান্তের কথা শুনিয়া বঙ্গে আসিয়া তাঁহার অনুসন্ধান করিয়াছিলেন এবং প্রবাদ আছে, লক্ষ্মীকান্ত তাঁহাকে গুপ্তভাবে সংবাদ দিয়া সাহায্যও করিয়াছিলেন, নতুবা মানসিংহ তাঁহাকে বহু পরগণার মালিক করিয়া যাইতেন না। লক্ষ্মীকান্তের জীবনী ও বংশকথা পরে আলোচনা করিব।
১৬০০ খৃঃ অব্দে মানসিংহ কাশী হইতে রাজমহলে পৌঁছিলেন এবং এবার বঙ্গদেশকে প্রকৃতভাবে শাসন-তলে আনিবার জন্য সর্ব্ববিধ আয়োজনে প্রবৃত্ত হইলেন। প্রায় ২৫ বৎসর হইল পাঠানেরা পরাজিত হইয়াছে, কিন্তু বঙ্গে মোগল-শাসন প্রবর্তিত হয় নাই। মোগলেরা রক্ততর্পণ করিয়া যে রাজ্য জয় করিয়াছে, প্রতাপাদিত্য প্রভৃতি ভুঞাগণের পরাক্রমে সে নূতন রাজ্য বুঝি অঙ্গুলির অন্তরাল হইতে হস্তচ্যুত হয়। তাই আকবর তাঁহার সর্ব্বপ্রধান সেনাপতিকে সৰ্ব্ববিধ ভারার্পণ করিয়া পুনরায় বঙ্গে প্রেরণ করিলেন। রাজ্যলাভ বা রাজস্ব সংগ্রহ হউক বা না হউক, পরাজিত হইয়া যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করা কখনও আকবরের স্বভাবগত ছিল না। অজস্র অর্থবৃষ্টি করিয়া তিনি রাজপুতনার রাজ্য চাহেন নাই, রাজপুতের বশ্যতা মাত্র চাহিয়াছিলেন। বঙ্গজয় হউক বা না হউক, সে কথা পরে দেখা যাইবে; বঙ্গীয় ভুঞাগণ বিদ্রোহী হইয়া যাহাতে উত্তোলিত মস্তক অবনত করিতে বাধ্য হয়, যে কোন প্রকারে তাহাই করিতে হইবে। আর সেই সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় মানসিংহই একমাত্র সমর্থ কর্ণধার। তিনি তাঁহার গুরুতর দায়িত্ব বুঝিয়াছিলেন; সাতহাজারী মসবদারের উচ্চ সম্মান যাহাতে রক্ষিত হয়, তজ্জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। পূর্ণ দুই বৎসর ধরিয়া এই চেষ্টা চলিল। বিহারের সর্ব্বত্র এবং বঙ্গের যতদূর পর্য্যন্ত সম্ভব, শাসনশৃঙ্খলা ও রজাস্ব সংগ্রহের ব্যবস্থা করা হইল। সুখ-বিলাসে সমভ্যস্ত সিংহরাজ নিম্নবঙ্গের আবহাওয়াকে বড়ই ভয় করিতেন, কিন্তু তবুও সেখানে যাইতে হাইবে। নৌ-সেনাপতি মুণ্ডা রায় কেদার রায়ের সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইলে মানসিংহ জলপথে কেদার রায়ের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন। কিন্তু কেদার রায় সে সন্ধিমত কার্য্য না করায় পুনরায় তিনি কি মক্ নামক আর এক সেনানী প্রেরণ করিলেন এবং স্বয়ং সর্ব্বপ্রথমে প্রতাপাদিত্যকে পর্যুদস্ত করিয়া আবশ্যক হইলে কেদারের রাজ্য আক্রমণ করিবেন, কিছুতেই ব্যর্থ মনোরথ হইয়া ফিরিবেন না, এই ভাবে প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। অবশেষে ১৬০৩ খৃষ্টাব্দের প্রারম্ভে তিনি বিরাট সৈন্য-বাহিনী লইয়া যশোরাভিমুখে অগ্রসর হইলেন। কচুরায় ও রূপরাম তাঁহার সঙ্গে সঙ্গেই ছিলেন।
রাজমহল হইতে মানসিংহ কোন পথে বঙ্গে আসিয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে মতভেদ আছে। পথও দুইটি; এক পথ মুর্শিদাবাদের মধ্যে দিয়া সোজা দক্ষিণমুখে, অন্য পথ বর্দ্ধমান ঘুরিয়া। যে পথেই তিনি আসুন, জলঙ্গীর তীরবর্ত্তী চাপড়া নামক স্থানে তিনি ভবানন্দ মজুমদার কর্তৃক সৎকৃত হইয়াছিলেন, এরূপ বর্ণনা আছে।[২২] বর্দ্ধমানের পথে চাপড়ার দূরত্ব দুইশত মাইলের অধিক; মুর্শিদাবাদের পথে ঐ দূরত্ব ১২৫ মাইলের বেশী হইবে না। সুতরাং প্রথম কথা এই যে, মুর্শিদাবাদের পথই সোজা এবং সেই পথে সৈন্য চলাচলের মত রাজবর্স্ক ছিল। দ্বিতীয় কথা ছাপঘাটির মোহানার কাছে ভাগীরথী পার হওয়া যত সোজা, নিম্ন দিকে হুগলীর কাছে তত সোজা নহে। প্রতাপাদিত্যের সুদক্ষ রণবাহিনী যে ত্রিবেণীর নিকটে তাঁহার পারের পথে বাধা দিতে পারে, সে আশঙ্কা অবশ্য মানসিংহের ছিল। সুতরাং নিম্নদিকে আসিয়া তিনি ভাগীরথী পার হাইবার মতলব করেন নাই। তৃতীয়তঃ, তিনি যদি বৰ্দ্ধমানেই আসিবেন, তাহা হইলে উল্টা দিকে পূর্ব্বস্থলী ও নবদ্বীপের মাঝে গঙ্গা পার হইয়া[২৩] চাপড়ার অপর পারে যাইবেন কেন? ভবানন্দের সঙ্গে দেখা করিবার খাতিরেই কি বিরাট বাহিনী লইয়া অতদূরে যাওয়া যায়?[২৪] বিশেষতঃ নবদ্বীপের নিকট জলঙ্গী ভাগীরথীতে মিশিয়াছে; উহার দক্ষিণে কালনার নিকট পার হইলে একবার পার হইলেই চলে; বর্দ্ধমান হইতে বৈকুণ্ঠপুর, সাঁতগাছি প্রভৃতি প্রাচীন স্থান দিয়া কাল্না পর্যন্ত পুরাতন রাস্তা ছিল। কিন্তু সে পথে না আসিয়া মানসিংহ একবার ভাগীরথী ও একবার জলঙ্গী এই দুই নদী পার হইবার জন্য চাপড়ায় গেলেন কেন? যাহা হউক, যেদিক হইতে দেখা যায়, মানসিংহ বর্দ্ধমানের পথে আসিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয় না। ভারতচন্দ্র শুধু বিদ্যাসুন্দর গল্পের অবতারণা করিবার জন্য তাঁহাকে সেই পথে আনিয়াছিলেন।[২৫]
রাজমহল হইতে গঙ্গার ধার দিয়া যে প্রশস্ত রাজপথ সূতীর নিকট ভাগীরথী শাখা পার হইয়া জঙ্গীপুরের মধ্যে দিয়া সোজা দক্ষিণ দিকে গিয়াছিল, ঐ পথ দিয়া মানসিংহ সসৈন্য আসিলেন। মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে ঐ রাস্তাকে এখনও ‘বাদশাহী সড়ক’ বলে[২৬] এবং উহাই প্রকৃত ‘গৌড়বঙ্গের রাস্তা’। ভাগীরথীর পূর্ব্বপার দিয়া এই পথ নদীয়ার মধ্যে জলঙ্গীর কূলে আসিয়াছিল। জলঙ্গী তখন প্রবলা নদী; সে অঞ্চলে ভাগীরথী ভিন্ন অন্য কোন নদী তেমন প্রশস্ত, গভীর বা বাণিজ্যবহুল ছিল না। মানসিংহকে সৈন্যসহ এই নদী পার হইতে হইবে। তিনি চাপড়ার পরপারে পৌঁছিয়া উহারই আয়োজন করিতে ছিলেন। এ পর্যন্ত তিনি যে সব স্থানের মধ্যে দিয়া আসিয়াছেন, তথা হইতে সকল লোকজন ও রাজারা ভয়ে দেশ ছাড়িয়া পলাইয়াছেন।[২৭] সুতরাং স্থানীয় লোকের নিকট হইতে পার হইবার পক্ষে কোন সাহায্যের প্রত্যাশা ছিল না। তিনি হাতী ও উটের গাড়ীতে চড়াইয়া কতগুলি নৌকা সঙ্গে আনিয়াছিলেন বটে, কিন্তু বিরাট বাহিনীর পক্ষে তাহা পর্যাপ্ত নহে।
এমন সময়ে ভবানন্দ সমাদ্দার নামক এক ব্রাহ্মণ আসিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিলেন তাঁহার প্রতিভাসম্পন্ন সুকুমার মূর্ত্তি দেখিয়া মানসিংহ মুগ্ধ হইলেন। বিশেষতঃ যখন কোন জমিদার তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসেন নাই, তখন সাহস করিয়া ভবানন্দ আসিলে, এবং যে কোন ভাবে হউক বাদশাহী সৈন্যদলের সাহায্য করিতে চাহিলে মানসিংহ পরিতুষ্ট হইলেন। ভবানন্দ তখন হুগলীতে কানুনগো দপ্তরে মুহুরীগিরি চাকরী করিতেন, তখনও তিনি কানুনগো হয় নাই।[২৮] চাকরী হিসাবে মুহুরীগিরি বিশেষ কিছু না হইলেও তখনকার দিনে উহাতে পয়সা ছিল এবং পৈতৃক সম্পত্তি ও পূৰ্ব্বতন আয় হইতেও ভবানন্দ সঙ্গতিসম্পন্ন ছিলেন। বাগোয়ানে তাহার বাড়ী ছিল, উহা বেশী দূরবর্ত্তী নহে; দেশের মধ্যে তাঁহার প্রতিপত্তি ছিল, সে কথা পরে বলিতেছি। ভবানন্দ বিশেষ চেষ্টা করিয়া বহুসংখ্যক নৌকা সংগ্রহ করিয়া দিলেন। বাদশাহী সৈন্য নিরুদ্বেগে পার হইল। কিন্তু এই সময় চৈত্রমাস; অকস্মাৎ এক দৈব বিপদ ঘটিল। সৈন্য-সামন্ত পার হইয়া চাপড়ায় আসিতে না আসিতে ভীষণ ঝড়বৃষ্টি আরম্ভ হইল এবং সাতদিন ধরিয়া অবিশ্রান্ত চলিল। উহাতে কত নৌকা ডুবিল, হাতী ঘোড়া ভাসিয়া গেল, সাজসরঞ্জাম ও রসদাদি নষ্ট হইল, আশ্রয়হীন সৈন্যদলের অপরিসীম কষ্ট হইল। তাহারা জোর করিয়া আশ্রয় জুটাইল, ভবানন্দও যতটুকু সাধ্য, তাহাদিগকে সাহায্য করিলেন। কিন্তু তাহাদের প্রধান অভাব হইল খাদ্যের; সেপক্ষেও ভবানন্দ তাহাদের প্রধান ভরসাস্থল হইয়াছিলেন। তিনি নিজ গৃহে গোবিন্দদেব বিগ্রহের সহিত রাধিকা প্রতিমার বিবাহ দিবার উৎসব করিবেন বলিয়া যথেষ্ট খাদ্য-সম্ভার সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলেন। তাহাই দিয়া মানসিংহের সৈন্যদিগের উদর-তৃপ্তি করিলেন। ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও অবিরত ভারে ভারে সেই সকল খাদ্য নৌকাযোগে আনিয়া লুটাইয়া দেওয়া হইল। যে নৈবেদ্য গোবিন্দদেবের পূজায় লাগিল না, তাহাই মানসিংহের পূজায় দিয়া ভবানন্দ স্বীয় ভাগ্যলক্ষ্মীকে সুপ্রসন্ন করিলেন। মানসিংহ তাঁহাকে ভবিষ্যতে বহু পুরস্কার দিবেন বলিয়া কত আশ্বাস দিলেন; এবং তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া যশোহরাভিমুখে যাত্ৰা করিলেন। সত্বরতার সহিত সৈন্য-চালনাই জয়লাভের মূলমন্ত্র।
এইবার আমরা ভবানন্দের পরিচয় দিয়া লইব। শাণ্ডিল্য গোত্রীয় ভট্টনারায়ণের অষ্টাদশ পুরুষ কাশীনাথ নদীয়ার অন্তর্গত কাক্দি পরগণার জমিদার ছিলেন এবং বাগোয়ানের অন্তর্গত আন্দুলবাড়িয়ায় তাঁহার নিবাস ছিল। দৈবদোষে তিনি রাজকোপে পতিত হইয়া মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁহার বিষয় বাজেয়াপ্ত হয়। তখন তাঁহার গর্ভবতী স্ত্রী নিরাশ্রয় অবস্থায় পড়িয়া জাতিমানের ভয়ে নিকটবর্ত্তী হরেকৃষ্ণ সমাদ্দার নামক এক বৈষয়িক ব্রাহ্মণের আশ্রয় লন। যথাকালে তিনি একটি পুত্র প্রসব করেন। হরেকৃষ্ণ নিঃসন্তান ছিলেন বলিয়া কালে ঐ পুত্রটিকে নিজের উত্তরাধিকারী নির্ব্বাচিত করেন। পুত্রের নাম রামচন্দ্র; তিনি সমাদ্দারের উত্তরাধিকারী বলিয়া লোকে তাহাকে রাম সমাদ্দার বলিয়া ডাকিত। কালে রামচন্দ্রের চারিটি পুত্র হয়, তন্মধ্যে দুর্গাদাস জ্যেষ্ঠ। এই দুর্গাদাস পরে ভবানন্দ নাম পান এবং হুগলীর কানুনগো দপ্তরের মুহুরী পদ হইতে ১৬১৩ খৃঃ অব্দে কানুনগো পদে উন্নীত হন; তখন তাঁহার উপাধি হয়—মজুমদার। এইরূপে দুর্গাদাস সমাদ্দার ভবানন্দ মজুমদার বলিয়া পরিচিত। সুবিধাবোধে আমরা সৰ্ব্বত্র তাঁহাকে সেই ভবানন্দ নামেই অভিহিত করিব। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, তখন ভবানন্দ অপর তিন ভ্রাতাকে ফতেপুর, কুড়ুলগাছি ও পাকাবাড়ী এই তিনটি বিষয় বিভাগ করিয়া দিয়া, নিজে বাগোয়ানের অধিকারী হইয়া তদন্তর্গত বল্লভপুরে সৌধনির্ম্মাণ করিয়া বাস করিতেছিলেন।
ভবানন্দের বাল্যজীবন ঐতিহাসিকের নিকট তমসাচ্ছন্ন। কেহ কেহ বলেন, হুগলীর ফৌজদার এক সময়ে জলঙ্গীপথে যাইবার সময় তাঁহার নিকট হুগলীর পথ জিজ্ঞাসা করেন এবং সেই উদীয়মান বালকের উত্তরে তাঁহার তীক্ষ্ণ বুদ্ধির পরিচয় পাইয়া, তাঁহাকে হুগলী লইয়া গিয়া সংস্কৃত ও ফারসী এই উভয় ভাষায় উত্তমরূপে শিক্ষিত করেন। আবার এমনও শুনা যায়, রাম সমাদ্দার স্বয়ং বালক পুত্রটিকে লইয়া গিয়া প্রতাপাদিত্যের পিতার রাজসরকারে প্রবেশ করেন এবং তথায় ভবানন্দ রাজানুগ্রহে উত্তমরূপে শিক্ষালাভ করেন। যশোহর-রাজবংশের কুলগত প্ৰবাদ হইতে জানা যায়, দুর্গাদাস বালককালে যশোহরে যান এবং প্রথমতঃ দেবসেবার পুষ্পচয়ন ও তত্ত্বাবধানের কার্য্যে ব্রতী হন। ক্রমে তিনি রাজপরিবারভুক্ত সকলের প্রিয়পাত্র হইয়া পড়েন। বিশেষতঃ বসন্ত রায় ও তাঁহার পত্নীগণ তাঁহাকে অত্যন্ত স্নেহ করিতেন। দেবসেবার তত্ত্বাবধান কার্য্যে ও নিজ চরিত্রমাধুর্য্যে তিনি রাণীদিগের নিকট হইতে ‘রাণীয়ান বৃত্তি’ লাভ করেন। যশোহরের নিকটবর্ত্তী দেবনগর, দুধলী প্রভৃতি এখনও রাণীবৃত্তি বলিয়া খ্যাত।[২৯] ঐ সম্পত্তি ভবানন্দের অধস্তন কৃষ্ণনগরের রাজবংশীয়েরা ভোগ করিতেন বলিয়া কথিত হয়। তবে প্রতাপের পতনের পর অনেকগুলি জমিদারী উঁহারা ক্রমে লাভ করেন; তন্মধ্যে উক্ত সম্পত্তি কি ভাবে অর্জিত হয়, তাহার কোন লিখিত বিবরণী পাই নাই। যশোহরে থাকিতে বোধ হয় দুর্গাদাসের নাম পরিবর্তিত হইয়া ভবানন্দ হয়। সম্ভবতঃ বসন্ত রায়ের হত্যাকালে তিনি ঘটনাক্রমে প্রতাপাদিত্যের বিরক্তিভাজন হন ও পরে যশোহর ত্যাগ করিয়া হুগলীর কানুনগো দপ্তরে মুহুরী হন। এই সময়ে মানসিংহ আসেন ও তাঁহার ভাগ্য প্রসন্ন হয়।
ভবানন্দের প্রথম জীবন যে যশোহরে অতিবাহিত হয়, কয়েকটি কারণে উহা সম্ভবপর বলিয়া বোধ হয়। আমরা এখানে ধীরভাবে উহার আলোচনা করিতেছি। প্রথমতঃ, প্রবাদ এমনভাবে শতমুখে তাঁহাকে কলঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছে যে, ভবানন্দের নাম করিবামাত্র বঙ্গবাসীর মনে এক স্বদেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতকের চিত্র প্রকটিত হয়। পাঠান রাজত্বের প্রাক্কালে যেমন উত্তরভারতে কনৌজাধিপতি জয়চন্দ্র, মোগল আমলের প্রারম্ভে তেমনই বঙ্গদেশে এই ভবানন্দ শত্রুকে ডাকিয়া আনিয়া দেশের পায়ে দাসত্ব-শৃঙ্খল পরাইয়া দিয়াছেন। এই প্রবাদ বা সৰ্ব্বজনজ্ঞাত অপবাদের হেতু কি? কেহ কেহ বলিতে পারেন, যশোহর রাজসরকারে চাকরী না করিয়াও কেহ তখন দেশের শত্রু বলিয়া গণ্য মোগলদিগকে সাহায্য করিলে স্বদেশদ্রোহী বলিয়া কলঙ্কিত হইতে পারেন। তদুত্তরে বলা যায়, মানসিংহকে এমন সাহায্য ত কত লোকেই করিয়াছিলেন; চাঁচড়ার পূর্ব্বপুরুষ ভবেশ্বর রায়ের পুত্র মহতাপ চাঁদ রায় এইরূপ একজন সাহায্যকারী; অপবাদটা ভবানন্দের স্কন্ধে এত অধিক চাপিল কেন? তাঁহার গল্পই বা এত সৰ্ব্বত্ৰ ছড়াইয়া পড়িল কেন?[৩০] কোন অকাট্য প্রমাণ না থাকিলেও ভবানন্দের সর্বত্র প্রচারিত অপবাদ তাঁহার যশোহর-বাসের অনুকূল সাক্ষ্য দিতেছে। দ্বিতীয়তঃ, পূর্ব্বোক্ত ‘রাণীয়ান্ বৃত্তি’ একটি প্রধান সন্দেহের বিষয়। তৃতীয়তঃ, সামান্য মুহুরীগিরি চাকরীতে যতই পয়সা থাকুক এবং পৈতৃক সম্পত্তির চতুর্থাংশ পাইয়া তাঁহার অবস্থা যতই সচ্ছল হউক, উহা হইতে তাঁহার এমন সঙ্গতি পরিকল্পনা করা যায় না, যাহাতে তিনি ৭ দিন ধরিয়া মানসিংহের বিরাট বাহিনীর আহার যোগাইতে পারেন। নিশ্চয়ই মুহুরীগিরির পূর্ব্বে তাঁহার অন্য আয় ছিল। চতুর্থতঃ, ‘ক্ষিতীশবংশাবলী-চরিতে’ উল্লিখিত আছে যে, মজুমদার কিছু পূর্ব্বে ‘লক্ষ্মীপ্রতিময়া সহ গোবিন্দপ্রতিমায়া বিবাহমহোৎসবং কারয়িতুং’ বহুবিধ ভক্ষ্য সংগ্রহ করিয়াছিলেন, উহা দ্বারা মানসিংহের সৈন্যদলের আতিথ্য রক্ষা করেন। এই ব্যাপারে একটি সন্দেহ হয়। পূর্ব্বে বলিয়াছি, উড়িষ্যা হইতে আনীত গোবিন্দ বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা জন্য ক্রমে ক্রমে কতকগুলি লক্ষ্মী বা রাধিকা প্রতিমা প্রস্তুত করান হয় (২৪শ পরিচ্ছেদ), তন্মধ্যে কয়েকটি বসন্ত রায়ের অপছন্দ হওয়াতে রাজ সরকারের কর্মচারীরা উহা লইয়া যান; সম্ভবতঃ ভবানন্দ ঐরূপ একটি বিগ্রহ পাইয়া যশোহরের অনুকরণে গোবিন্দদেব, বিগ্রহ প্রস্তুত করিয়া উহার প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হন। শঙ্কর চক্রবর্ত্তী এইরূপ একটি রাধিকা মূর্ত্তি লইয়া গিয়া বারাসতে প্রতিষ্ঠিত করেন। এই সকল বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার জন্য বসন্ত রায় যথেষ্ট সাহায্য করেন; যদি ঘটনা সত্য হয়, সে সাহায্যে ভবানন্দ বঞ্চিত হন নাই। পঞ্চমতঃ, মানসিংহ চাপড়ায় পৌঁছিয়া ভবানন্দকে যশোহরে যাইবার পথঘাটের মানচিত্র ও বিবরণী লিখিয়া দিতে বলেন; তদনুসারে ‘মজুমদারঃ সবিশেষ সৰ্ব্বং লিখিত্বা সমর্পয়ামাস’[৩১]–অর্থাৎ সমস্ত লিখিয়া দিয়াছিলেন; উহা হইতে সিংহরাজা নিজের গতিবিধি ও সেনা নিবেশের ব্যবস্থা স্থির করিয়া লন। যখন মোগল সৈন্যের কুচ আরম্ভ হয়, তখন অশ্বারোহী ভবাবনন্দ সেনাপতির পাশে পাশে পথের পরিচয় দিতে দিতে যাইতেছিলেন :
“আগে পাছে দুই পাশে দু’সারি লস্কর।
চলিলেন মানসিংহ যশোহর-নগর।।
মজুন্দারে সঙ্গে নিলা ঘোড়া চড়াইয়া।
কাছে কাছে অশেষ বিশেষ জিজ্ঞাসিয়া॥”—ভারতচন্দ্র
যশোহর সম্বন্ধে এইরূপ বিশিষ্ট লিখিত বিবরণী দেওয়া একজন অপরিচিত লোকের পক্ষে সম্ভব হয় না। মানসিংহ যাঁহার নিকট ‘অশেষ বিশেষ জিজ্ঞাসিয়া’ সদুত্তর পাইতে পারেন, যশোহর সহরের সকল বিষয়ের সহিত তাঁহার যথেষ্ট পরিচয় ছিল। ভবানন্দের যশোহরে চাকরী করা অস্বীকার করিলেও, সে স্থানে তাঁহার বারংবার যাওয়া অস্বীকার করা যায় না। রাজসরকারের সহিত ঘনিষ্ঠ সংস্রব ব্যতীত তখন কেহ বারংবার সেই সুদূর সুন্দরবনের রাজধানীতে যাইত বলিয়াও মনে হয় না। যাহা হউক, সংক্ষেপতঃ আমাদের বিশ্বাস এই, সপ্তগ্রামে কানুনগো দপ্তরে চাকরি করার পূর্ব্বে তিনি যশোহরে ছিলেন এবং হয়ত বসন্ত রায়ের মৃত্যুর পর প্রতাপের সহিত অসদ্ভাব বশতঃ বা রূপবসুর চক্রান্তে যশোহর ত্যাগ করেন। এমনও কথিত আছে, তিনি কচু রায়ের সঙ্গে আগ্রা বা রাজমহলেও গিয়াছিলেন, কিন্তু ততদূর আমরা বিশ্বাস করি না।
বর্ষা থামিবামাত্র মানসিংহ চাপড়া হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। এই ঝড়ে প্রতাপাদিত্যের নৌ-বিভাগেরও যথেষ্ট ক্ষতি হইয়াছিল। ফিরিঙ্গি রডা প্রভৃতি সেনানীর অধীন কয়েকখানি জাহাজ যমুনার মুখে গঙ্গায় ছিল; মানসিংহের পথরোধ উহাদের উদ্দেশ্য। উক্ত ঝড়ে উহার কতগুলি জাহাজ মগ্ন হয় এবং সৈন্যগণ বিপন্ন হইয়া পড়ে। যাহারা আত্মরক্ষা করিতে পারিয়াছিল তাহারা রায়গড়ের দিকে প্রস্থান করিল। কচু রায় যখন বঙ্গে ছিলেন, তখন মানসিংহ সৰ্ব্বপ্রথমে রায়গড় অধিকার করিবার জন্যও যাইতে পারেন, এরূপ আশঙ্কা ছিল। সুতরাং নৌ-বাহিনীদ্বারা সে দিক সংরক্ষিত হইল।
মানসিংহ দ্রুতগতিতে রাণাঘাটের সন্নিকটে চূর্ণী পার হইয়া চাকদহে পৌঁছিলেন। এ পর্যন্ত তিনি বাদশাহী সড়ক বা ‘গৌড়বঙ্গের’ পুরাতন রাস্তায় আসিতেছিলেন। অতি পূৰ্ব্বকাল হইতে এই রাস্তায় সৈন্য চলাচল করিত। চাকদহ হইতে সেই রাস্তায় ঘোড়াগাছা, সুবর্ণপুর, লাউপালা ও ফতেপুর দিয়া জাগুলিয়ায় পৌঁছিলেন। জাগুলিয়া একটি প্রধান পল্লী, তথা হইতে বাদশাহী সড়ক সোজা দক্ষিণে বারাসত পর্য্যন্ত গিয়াছিল। কিন্তু মানসিংহ সম্ভবতঃ সে রাস্তায় না গিয়া আর যে একটি ক্ষুদ্র পথ দক্ষিণ-পূর্ব্বমুখে হাবড়ার দিকে গিয়াছিল, বিলের মধ্য দিয়া সেই রাস্তা উচ্চ করিয়া বাঁধিতে বাঁধিতে অগ্রসর হইলেন। সৈন্যদল শ্রীকৃষ্ণপুরের মধ্য দিয়া হাবড়া ডান দিকে রাখিয়া বর্তমান মছলন্দপুর ষ্টেশন বা রাজবল্লভপুরের নিকট পৌঁছিল; হ’রে শুঁড়ির যে রাস্তা চারঘাটে গিয়াছিল, এই রাস্তা তাহার সহিত মিশিয়াছিল। মাঠের মধ্য দিয়া উভয় রাস্তার চিহ্ন আছে এবং সাধারণ লোকে এখনও উহা চিনাইয়া দিয়া থাকে। এখন ডিষ্ট্রীক্ট বোর্ডের যে সুন্দর সরল পথ মছলন্দপুর হইতে বাদুড়িয়া পর্য্যন্ত গিয়াছে, উহার অধিকাংশই মানসিংহের নবগঠিত ‘গৌড়বঙ্গের রাস্তা’র উপর দিয়া গিয়াছে। অজানা অচেনা নিম্ন-বঙ্গে ত্বরিত গতিতে পথ রচনা করিতে করিতে বিরাট মোগলবাহিনী কেমন করিয়া সন্তর্পণে অগ্রসর হইতেছিল, সেই সব পুরাতন কাহিনীর চিন্তা লইয়া আমি মানসিংহের এই রাস্তায় বহু মাইল পর্য্যন্ত পদব্রজে ভ্রমণ করিয়াছি।
মানসিংহ কোথায়ও থামেন নাই বা কোথায়ও তাঁহাকে বাধা দেওয়া হয় নাই। যমুনার মুখে, ত্রিবেণীতে বা চারঘাটে, যমুনা-ইচ্ছামতীর সঙ্গমস্থলে তাঁহাকে নৌপথে বাধা দিবার স্থান ছিল। কিন্তু তাঁহার সৈন্যদল যখন পদব্রজে চলিতেছে সংবাদ পাওয়া গেল, তখন রণতরী সমূহ সরিয়া গিয়া বসন্তপুরের সন্নিকটে যমুনার মধ্যে অবস্থিতি করিল। পূর্ব্বেই বলিয়াছি, মোগল সৈন্যদলে অশ্বারোহী প্রধান সম্বল এবং পদাতিক সংখ্যা কম। সে পদাতিকগণ সিক্তবাত নিম্নবঙ্গে, সুন্দরবনের জল কদমের মধ্যে অধিক দিন তিষ্ঠিতে পারে না। এইজন্য, মানসিংহ যখন নৌপথে আসিতেছেন না, তখন তাহাকে পথে বাধা দেওয়া হইল না, রাজ্যমধ্যে নিরুদ্বেগ প্রবেশ করিতে দেওয়া হইল। যুদ্ধের ফল যাহাই হউক, সে প্রদেশে মোগল-সৈন্য বেশী দিন আত্মরক্ষা করিতে পারিবে না। সুখবিলাসী মানসিংহ ক্রমেই প্রমাদ গণিলেন। কিন্তু অগ্রসর না হইয়া উপায় নাই। মছলন্দপুর ছাড়িয়া তাঁহাকে কোলসূর ও সিমুলিয়ার মাঝে পদ্মানদী পার হইতে হইয়াছিল বটে, কিন্তু সেখানেও কোন বিঘ্ন ঘটে নাই। পার্শ্ববর্তী স্থানের লোকজন শত্রুভয়ে দেশ ছাড়িয়া পলাইয়া ইছামতীর পূর্ব্বপারে আশ্রয় লইতেছিল।
মানসিংহ যখন চাকদহ হইতে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হইতেছিলেন, তখন প্রধান প্রধান জমিদার ও প্রতাপাদিত্যের কিল্লাদারদিগের নিকট দূত প্রেরণ করিয়া তাঁহাদিগকে ভীতি প্রদর্শন পূৰ্ব্বক স্বপক্ষভুক্ত করিতেছিলেন। এই সময়ে যাঁহারা বশ্যতা স্বীকার করিয়া বাদশাহী ফৌজের সাহায্য করিয়াছিলেন, তন্মধ্যে চাঁচড়া রাজবংশের পূর্ব্বপুরুষ, ভবেশ্বর রায়ের পুত্র মহতাবরাম বা মুকুট রায় সর্ব্বপ্রধান (২৪শ পরিচ্ছেদ)।[৩২] তিনি যশোর রাজ্যের উত্তর সীমান্তে প্রধান কিল্লাদার। তিনি সৈন্য ও রসদ পাঠাইয়াছিলেন এবং তাহার ফলে তাঁহার পূর্ব্বগৃহীত চার পরগণা বহাল রহিল। অন্যান্য রাজন্যবর্গের মধ্যে নলডাঙ্গা রাজবংশের পূর্ব্বপুরুষ রণবীর খাঁ৩৩ এবং কুশদহের জমিদার সম্মানিত হইয়াছিলেন, সে কথা আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি (১৫শ পরিচ্ছেদ)। কিন্তু সে ঘটনা মানসিংহের যশোহর যাওয়ার সময়ে, কি প্রত্যাগমনকালে ঘটিয়াছিল, তাহা বলিতে পারি না।
মানসিংহ এ সময়ে কোন প্রকার কূটনীতি বাদ দেন নাই। প্রতাপের পক্ষীয় যাহাকে যাহাকে তিনি পক্ষচ্যুত করিয়া আনিতে পারেন বা যাহার নিকট হইতে প্রতাপের গূঢ় মন্ত্রণার সন্ধান লইতে পারেন, তাহার বিশেষ চেষ্টা করিয়াছিলেন। পূর্বেই বলিয়াছি, তিনি কামদেব ব্রহ্মচারীর পুত্র লক্ষ্মীকান্তের সন্ধান করিয়াছিলেন;[৩৪] কেহ কেহ বলেন, তিনি রূপরাম বসুর কৌশলে গুপ্তভাবে তাঁহার নিকট কামদেবের লিখিত পত্র প্রেরণ করেন এবং তিনি যশোহরের সমীপবর্ত্তী হইলে, লক্ষ্মীকান্ত গোপনে আসিয়া তাহার সহিত যোগ দেন।[৩৫] শুধু যোগ দেওয়া নহে, যুদ্ধের প্রাক্কাল পর্যন্ত প্রতাপ কি ভাবে কি আয়োজনাদি করিয়াছিলেন, লক্ষ্মীকান্ত যে সকল গুপ্ত সন্ধান ব্যক্ত করিয়া দেন। তদ্দারা মোগল সৈন্যের জীবন রক্ষা হয়। এইরূপে বিশ্বাসঘাতকদিগের অনুগ্রহে চারচক্ষু মানসিংহ সম্মুখীন কার্যক্ষেত্র নখদর্পণে দেখিতে দেখিতে সদর্পে অগ্রসর হন। সমুদ্রগামিনী নদী যেমন পার্শ্ববর্ত্তী শাখা সমূহ হইতে জলধারা পাইয়া ক্রমে প্রশস্ত হইতে হইতে অগ্রসর হয়, সামন্ত রাজন্যবর্গের সেনাদ্বারা পরিপুষ্ট হইয়া সেইরূপ মানসিংহের সৈন্যসংখ্যা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইতেছিল। বিরাট মোগল-বাহিনী বাস্তবিকই যেন অজগর সর্পের মত যশোর রাজ্যে প্রবেশ করিল।
দ্রুতবেগে কুচ করিয়া মোগল-সৈন্য বাদুড়িয়া হইতে ক্রমে বসিরহাট ও টাকী অতিক্রম করিয়া হাসনাবাদে আসিয়া পৌঁছিল। উহারই সম্মুখে বুড়নহাটি দুর্গ। বুড়নহাটির নাম এখন বিলুপ্তপ্রায়, তখন নদীর বাঁকে উহা সুন্দর স্থান ছিল। সেখানে একটি সাময়িক দুর্গও প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। সম্ভবতঃ হাসনাবাদের সন্নিকটে মোগল সৈন্যের গতিরোধের জন্য সামান্য সংঘর্ষ হয় ও তাহাতে বহু সৈন্য হতাহত হইয়াছিল। যেখানে ঐ সংঘর্ষ হয়, তাহারই বর্ত্তমান নাম লস্করপুর। মানসিংহের সঙ্গে যে ২২ জন সেনানীর অধীন ২২টি লস্কর বা সৈন্যের দল আসিয়াছিল, তাহাদের সহিত যুদ্ধের স্মরণার্থ লস্করপুর নাম হওয়া বিচিত্রি নহে। ঐ স্থানে কিছুদিন পূর্ব্বে একটি পুষ্করিণী খনন কালে রাশি রাশি মনুষ্যাস্থি আবিষ্কৃত হইয়াছিল। যুদ্ধ-মৃত সৈন্য ব্যতীত সাধারণ লোককে তেমন রাশীকৃত করিয়া একস্থানে কবর দেওয়া হয় না। বুড়নহাটি ছাড়িয়া একটু দক্ষিণে গিয়া মোগল সৈন্য কালিন্দী পার হইয়াছিল। বসন্তপুরের পশ্চিম দিয়া এখন যে বিশালকায়া তরঙ্গবিক্ষুব্ধ কালিন্দী নদী প্রবাহিত হইতেছে, তখন তাহার সে মূর্ত্তি ছিল না। তখন কালিন্দী বিশীর্ণা ক্ষুদ্র স্রোতস্বতী মাত্র। মানসিংহ অনতিবিলম্বে এই কালিন্দী খাল পার হইয়া বসন্তপুরে ছাউনী করিলেন। একটু দূরে দক্ষিণ দিকে সরিয়া কালিন্দী পার হইলে, ইচ্ছামতীর বক্ষ হইতে রণতরী সমূহের কামানশ্রেণী কোন বাধা দিতে পারে না। এখন যে স্থানটিকে বাগ বসন্তপুর বলে, সেই স্থানে প্রায় দুই মাইল জুড়িয়া মোগল শিবির স্থাপিত হইয়াছিল।
পাদটীকা :
১. ‘He is reported to have ruled extensive dominions in which he was practically almost indepen- dent with great prudence and justice.’ Smith, Akbar. p. 245.
২. Stewart, History of Bengal. p. 205.
৩. কালে এই সমৃদ্ধ সহর আকবরনগর নামে অভিহিত হইত। রাজমহলে এখন জঙ্গল মধ্যে মানসিংহের রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষ আছে।
৪. Akbarnama (Beveridge), vol. III. p. 1093-4. রামনাথ বারেট প্রণীত ‘ইতিহাস-রাজস্থান’ হইতে নিখিলনাথের পুস্তকে এক অংশ উদ্ধৃত করিয়া দেখান হইয়াছে যে, প্রতাপাদিত্যের সহিত যুদ্ধ করিতে গিয়া দুৰ্জ্জয় সিংহ মারা পড়েন, সে কথা ঠিক নহে। আবুল ফজলের গ্রন্থ অধিকতর প্রমাণিক।
৫. Akbarnama (Beveridge), Vol. III. P. 1130.
৬. Ibid, III. p. 1151.
৭. উক্ত ব্যক্তির মুখের উক্তি বিশ্বাসযোগ্য কিনা তদ্বিষয়ে স্বয়ং রাজা রাজেন্দ্রনাথও সন্দিহান ছিলেন। তিনি যেমন শুনিয়াছিলেন, তেমনি কথাগুলি নিজ লাইব্রেরীর ‘বঙ্গাধিপ পরাজয়’ নামক পুস্তকের একটি পৃষ্ঠায় অবিকল টুকিয়া রাখিয়াছিলেন। সে লেখাটি ২৯/১২/১৯১৮ তারিখে আমি তাঁহারই সম্মুখে পড়িয়া লইয়াছিলাম। উহাই প্রতাপের মুদ্রা সম্বন্ধে এখনকার মত প্রথম ও শেষ প্রমাণ। রাজা রাজেন্দ্রনাথ এক্ষণে পরলোকগত। শাস্ত্রী মহাশয় ঐ অংশ নকল করিয়া স্বীয় পুস্তকে (৭১পৃ) প্রকাশ করেন, উহা হইতে নিখিলনাথের গ্রন্থে (১৫৫ পৃ) ও অন্যান্য নানাস্থানে প্রচারিত হইয়াছে।
৮. এইরূপ যে দুইটি মুদ্রা আমার নিকট আছে, তাহার দুইটিরই ফটো প্রকাশ করিলাম।
৯. এই মাটির মুদ্রাটি Archaeological Department-এর সুপারিন্টেণ্ডেণ্ট সুপণ্ডিত কাশীনাথ নারায়ণ দীক্ষিত মহোদয় ধুমঘাট হইতে লইয়া গিয়াছেন I
১০. দ্বিগঙ্গা-নিবাসী বাসুকি-গোত্রীয় কায়স্থকুলতিলক কিঙ্কর সেন পাঠান আমলের শেষভাগে একজন পরাক্রান্ত জমিদার ছিলেন। তিনি সাধারণতঃ ভুঞা কিঙ্কর বলিয়া খ্যাত। ইনি দক্ষিণ রাঢ়ীয় ১৮ পর্যায়ভুক্ত কুলীনদিগের একজাই করিয়া সমাজে অশেষ সম্মানিত হন। তিনি নবাব সরকার হইতে যে ১৪ পরগণার সনন্দ পান, উহাই তাঁহার পুত্র মদনমোহন ভোগ করিতেছিলেন। মদনমোহন প্রতাপাদিত্যের সমসাময়িক। প্রতাপের পতনের পর ঢাকার নবাব ইসলাম খাঁ মদনের পুত্র শ্রীনাথের সহিত কতকগুলি পরগণার বন্দোবস্ত করেন। শ্রীনাথের পৌত্র রুদ্রনারায়ণ রায়েরকাটিতে আসিয়া রাজধানী স্থাপন করিয়া বাস করেন। ১৬৫৯ খৃঃ অব্দে তৎকর্তৃক সিদ্ধেশ্বরীর মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং যে কিঙ্কর সেনকে মুর্শিদ কুলি খাঁ নির্যাতিত করেন বা সম্ভবতঃ যাঁহার গড়কাটা বাড়ীর চিহ্ন চন্দনগরের সন্নিকটে এখনও আছে, সে কিঙ্কর সেন এই ভুঞা কিঙ্কর হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যক্তি। –’বালা’, ২৩ পৃ: ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ (কালীপ্রসন্ন), ৪৮ পৃ: ‘বাসুকি-কুলগাথা’, ৮-১৩ পৃ। রুদ্রনারায়ণের অধস্তন রাজবংশীয়েরা বরিশাল হইতে খুলনার কয়েক স্থানে আসিয়া বাস করেন। তদ্বংশের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পরে দিব। ১১. বর্তমান বরিশাল জেলার হাবেলী সেলিমাবাদ পরগণার অন্তর্গত শ্যামরাইল, পোণাবালিয়া প্রভৃতি স্থান লইয়া প্রাচীন সোন্ধারকূল পরগণা গঠিত হইয়াছিল।—’বাক্লা’, ২৭০ পৃ।
১২. ইনি প্রতাপের ভগিনীপতি গোবিন্দ ঘোষ লস্করের পুত্র। (১১শ পরিচ্ছেদ)!
১৩. গাভ বসুবংশীয় পরমানন্দ বসন্ত রায়ের ভগিনী ভবানী দেবীকে বিবাহ করেন ও পরে প্রতাপ কর্তৃক অর্জিত হাবেলী পরগণার জমিদারী যৌতুক পাইয়া বাগেরহাটের নিকটবর্ত্তী কাড়াপাড়ায় আসিয়া বাস করেন এবং তখন হইতে ‘রায়’ উপাধি হয়। তৎপূর্ব্বে তিনি যশোহর রাজধানীর নিকট পরমানন্দকাটিতে বাস করিতেন।
১৪. ‘সাহিত্য-পরিষৎ পত্রিকা,’ ১৩২৩, ২৩০ পৃ।
১৫. এই ঘটনা অবলম্বন করিয়া সাহিত্য-রথী রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁহার সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘বঙ্গবিজেতা’ প্রণয়ন করেন। এখন চৌবেড়িয়ার সে দুর্গ বা রাজপ্রসাদের কিছু নাই। নীলকরদিগের সময়ে অনেক প্রাচীনকীর্তির ভগ্নাবশেষের মালমসলা পর্যন্ত স্থানান্তরিত হইয়াছিল। এখন চৌবেড়িয়ার রাজার বাগান, ফুলবাড়ী, সেহালা পাড়া প্রভৃতি কয়েকখানি ক্ষুদ্র গ্রাম মাত্র প্রাচীন নিদর্শন রহিয়াছে। এখন চৌবেড়িয়া বঙ্গভাষার কৃতী লেখক ও নাট্যকার রায় বাহাদুর দীনবন্ধু মিত্রের জন্মস্থান বলিয়া প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। দীনবন্ধুর সংক্ষিপ্ত জীবনী যথাস্থানে প্রদত্ত হইবে। কাশীনাথের প্রসঙ্গে ‘নদীয়া-কাহিনী’, ২২-২৩ পৃ, ও ‘কুশদ্বীপ-কাহিনী’, ৭-৮ পৃ দ্রষ্টব্য।
১৬. এডুমিশ্রের কারিকায় উল্লেখ আছে, ইছাপুরের হড়চৌধুরীগণ কুশদ্বীপের অধিকার লক্ষ্মণ সেনের নিকট হইতে পান।
১৭. আমরা ‘আকবরনামা’ বা অন্য কোন বিবরণী হইতে শের খাঁ কে বা তিনি কি করিতেন, সেরূপ কোন তথ্য সংগ্রহ করিতে পারি নাই। এমন কি, তিনি হুগলীর ফৌজদার, বা রাজমহলের কোন উচ্চকৰ্ম্মচারী, তাহাই জানিতে পারি নাই। সুতরাং এই শের খাঁর ঐতিহাসিকতা স্থাপন করিতে পারিতেছি না।
১৮. রামরাম বসু, ‘প্রতাপাদিত্য চরিত’ (১৮০১), ১৪৪ পৃ।
১৯. ‘ক্ষিতীশবংশাবলী’, ৪র্থ পরিচ্ছেদ (নিখিলনাথ, ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ২৯২ পৃ)।
২০. নিখিলনাথ, ‘প্রতাপাদিত্য’, ১৫৮-৯ পৃ।
২১. Ain. (Blochmann). p. 341; Stewart, History of Bengali, pp. 213-4.
২২. ‘চাপড়াখ্যগ্রামসমীপবৰ্ত্তিনদীতটে তৎসৈন্যং সমাজগাম।’—’ক্ষিতীশবংশাবলী’।
২৩. ‘উত্তরিলা পূর্বস্থলী নদে সন্নিধান আনন্দে গঙ্গার জলে স্নান দান কৈলা। কনক অঞ্জলি দিয়া গঙ্গা পার হৈলা। পরম আনন্দে উত্তরিলা নবদ্বীপ।’— ‘অন্নদামঙ্গল’। ‘এই সময়ে ভাগীরথী নবদ্বীপের পশ্চিম দিয়া প্রবাহিত হইতেন।’— ‘নদীয়া-কাহিনী’, ৯, ৩৬৬ পৃ। এইজন্য পূৰ্ব্বস্থলী হইতে ভাগীরথী পার হইয়া নবদ্বীপে আসিতে হইত।
২৪. ‘মজুমদার সঙ্গে রঙ্গে খড়ে পার হয়ে, বাগোয়ানে মানসিংহ যান সৈন্য লয়ে।’— ভারতচন্দ্র।
২৫. নিখিলনাথ লিখিয়াছেন— ‘ভারতচন্দ্র তাহাকে বৰ্দ্ধমানে উপস্থিত হওয়ার যে উল্লেখ করিয়াছেন, তাহা প্রকৃত নহে। উহা কেবল বিদ্যাসুন্দর প্রসঙ্গের অবতারণার জন্য।’— ‘প্রতাপাদিত্য’ ১৫৯ পৃ।
২৬. Hunter, Statistical Accounts, Vol. IX, p. 143.
২৭. ‘যত্র যত্রোবাস তস্মাত্তস্মাৎ লোকঃ পলায়ঞ্চক্রিরে রাজানশ্চ প্রায়ো ন সাক্ষাদ্বভুবুঃ’– অর্থাৎ মানসিংহ যেখানে যেখানে আসিলেন, সেখান হইতে সকল লোক পলাইল, রাজারা কেহ সাক্ষাৎ করিলেন না। ‘ক্ষিতীশবংশাবলীচরিতং’; ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ২৯২ পৃ।- শি মি।
২৮। ‘Bhoveaund a Bramm, was a Mohirer in the Hughly Canongoe Duptar and got himself appointed to the Zemindary of Pergunnah Bugwan. Nuddea & c. 14 Mehals in room of Hurryhoo and Cassinaut Chowdry. ‘ – Rouse. Boughton. Landed property of Bengal. প্রতাপাদিত্য’, ১৬১ পৃ.; এই Hurryhoo অন্নদামঙ্গলের হরি হড় নয়ত? কাশীনাথ ভবানন্দের পিতামহ।
২৯. সতীশচন্দ্র রায়, ‘বঙ্গীয় সমাজ’, ১৫১ পৃ।
৩০. শাস্ত্রী, ‘প্রতাপাদিত্য’ ১৩৯ পৃ; ‘For a time pratapaditya defied the great Akbar and the conquest of his kingdom was ultimately effected by Raja Man Singh Chiefly through the treachery of Bhovanda Majumdar. who had been in the service of Pratapaditya as a pet Brahmin boy.’ Vidyabhushan. Dr. Jogendranath, Hindu Castes and sects. p. 183.
৩১. ‘ক্ষিতীশবংশাবলী চরিতম’, (বার্লিন-সংস্করণ): নিখিলনাথ, ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ২৯৩ পৃ।
৩২. Westland. Jessore. p. 45.
৩৩. Mukherji. A. C… Naladanga Raj Family. p. 51.
৩৪. কেহ কেহ বলেন, পাটুলির জমিদার শুদ্রমণির সহায়তায় লক্ষ্মীকান্তকে সন্ধান করিয়া বাহির করা হয়, উহার পুরস্কার স্বরূপ শূদ্রমণি রাজা উপাধি ও জমিদারী প্রাপ্ত হন।— “কলিকাতা, সেকালের ও একালের’, ৬৬-৮ পৃ।
৩৫. ‘বিশ্বকোষ’, ১২শ খণ্ড, ২৭৩ পৃ–’প্রতাপাদিত্য’ প্রবন্ধ (চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায়)।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন