সতীশচন্দ্র মিত্র
মানসিংহ কালিন্দী পার হইয়া বসন্তপুরে ছাউনী করিলেন, কারণ তাঁহার আর অগ্রসর হইবার উপায় ছিল না। সেই স্থানে তিনি আসিয়া দেখিলেন, চারিধারে প্রতাপাদিত্যের বিভিন্ন প্রকারের সৈন্যসমূহ ঘনীভূত মেঘমালার মত সমবেত হইতেছে। মোগল শিবিরের দক্ষিণ দিকে মুকুন্দপুরের গড়-বেষ্টিত দুর্গ। ইহাই যে যশোর-রাজ্যের প্রথম ও প্রাচীন রাজধানী, তাহা আমরা পূর্ব্বে স্থির করিয়াছি (১৬শ পরিচ্ছেদ)। রাজধানীর সে পরিখাবেষ্টিত দুর্গ প্রাকারের উপর সারি সারি কামানশ্রেণী সুসজ্জিত। পার্শ্ববর্তী বারকপুর ও পরবাজপুর প্রভৃতি স্থানে অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যসমূহ সমবেত হইতেছিল। বসন্তপুরের উত্তর কোণ হইতে যমুনা নদী ৩/৪ মাইল মাত্ৰ পূর্ব্বদিকে গিয়া পরে দক্ষিণ-বাহিনী হইয়া একেবারে ধুমঘাট দুর্গের পাদদেশে পৌঁছিয়াছিল। আজকাল যমুনা একটি শীর্ণকায়া খালের মত হইলেও উহার উভয় পার্শ্বে প্রায় একক্রোশ বিস্তৃত খাত এখনও পূর্ব্বাবস্থার পরিচয় দিতেছে। সেই যমুনা তখন মোগল শিবির হইতে একটু দূরে সমকোণ করিয়া উত্তর ও পূর্ব্ব দিক জুড়িয়া ছিল এবং উহার মধ্যে প্রতাপাদিত্যের ঘন-সন্নিবিষ্ট রণতরী সমূহের অনলবর্ষী তোপ-শ্রেণী তীর লক্ষ্য করিয়া শ্রেণীবদ্ধ ছিল; মাস্তুলে মাস্তুলে মধ্যাহ্ন- সূৰ্য্য চিহ্নিত পতাকা উড়িতেছিল।
সুতরাং এই স্থানেই যে যুদ্ধ হইবে, তাহা মানসিংহের বুঝিতে বাকী রহিল না। তিনি বুঝিলেন, তাঁহাকে আর অগ্রসর হইতে দেওয়া হইবে না। মোগল-সৈন্য যে পথ দিয়া আসিয়াছে, তাহার দুই পার্শ্ব লুণ্ঠনাদি দ্বারা উৎসন্ন হইয়াছে। বসন্তপুরের দক্ষিণ হইতে ধুমঘাট পর্যন্ত প্রতাপাদিত্যের বিস্তীর্ণ রাজধানীর পঞ্চক্রোশী সহর বলিলে চলে। মোগল সৈন্যকে সেখানে প্রবেশ করিতে দিলে, প্রজাকুল ব্যাকুল হইবে। মোগলদিগের কালিন্দী পার হইবার সংবাদ পাইবামাত্ৰ বহু প্রজা শত্রুভয়ে যথাসৰ্ব্বস্ব সঙ্গে লইয়া মুকুন্দপুর ও ধুমঘাটের দুর্গমধ্যে গিয়া আশ্রয় লইয়াছে। এই জন্য মানসিংহ আসিতে না আসিতে প্রতাপের সৈন্যজাল তাঁহাকে তিন দিক হইতে বেড়িয়া ধরিল। মানসিংহ সহসা যুদ্ধার্থ আক্রমণ করা সঙ্গত বোধ করিলেন না। তিনি শত্রু সম্বন্ধে অনেক সংবাদ রাখিলেও কার্যক্ষেত্রে তাহা পরীক্ষা করিয়া লইতে এবং বনোদ্যানের অন্তরালে লুক্কায়িত শত্রু-সেনার একটা পরিমাণ ঠিক করিয়া লইতে চেষ্টা করিলেন। কোথায় বারুদপূর্ণ সুড়ঙ্গ খনিত হইয়াছে এবং কি কি প্রকার কূট যুদ্ধে বঙ্গীয় সৈন্যগণ সুদক্ষ, তাহার সংবাদ সংগ্রহ করিতে একটু বিলম্ব হইল। মোগলের সমগ্র বাহিনী আসিয়া পৌঁছিতেও কয়েক দিন লাগিয়াছিল। বিরাট মোগল বাহিনীতে না থাকিত এমন ব্যবস্থা নাই। হাটবাজার বা হাসপাতাল ত সঙ্গে চলিতই, এমন কি আমোদ প্রমোদ বা ক্রীড়া কৌতুকের ব্যবস্থাও বাদ পড়িত না। বিশেষতঃ মানসিংহ নিজে মোগল সংস্পর্শে থাকিতে থাকিতে বিলাসিতার চরম সীমায় উঠিয়াছিলেন। কথিত আছে, তাঁহার মরণকালে ১৫০০ স্ত্রীর মধ্যে ৬০ জন চিতারোহণ করিয়াছিলেন।[১] যুদ্ধাভিযানে যাইয়াও তিনি স্ত্রী সংগ্রহ ব্যাপার ভুলিতেন না; এ সব বিষয়ে তিনি বিলাসী বাদশাহের উপযুক্ত সহচর ছিলেন। সেনাপতি ও আমীরগণের জেনানা-মহল সঙ্গে চলিত এবং সুযোগ মত লুণ্ঠন জুটিলে অনেকেই সে মহলের স্ত্রী-সংখ্যা বৃদ্ধি করিতেন। যানবাহন ও রসদাদি সম্বলিত সমগ্র সৈন্যদলের শিবির সন্নিবেশ করিতে একটু বিলম্ব হওয়ারই কথা। তন্মধ্যে মানসিংহ প্রাচীন রীতি অনুসারে প্রতাপাদিত্যের নিকট দূত প্রেরণ করিলেন।
মোগল-দূত একগাছি শৃঙ্খল ও একখানি তরবারি লইয়া প্রতাপাদিত্যের দরবারে উপস্থিত হইল এবং রাজার যাহা ইচ্ছা তাহাই গ্রহণ করিতে পারেন বলিয়া সদর্প-প্রশ্ন করিল। প্রতাপের আদেশে নকীব কেশব ভট্ট[২] দম্ভভরে তরবারি গ্রহণ করিলেন এবং শৃঙ্খল ফিরাইয়া দিয়া বলিলেন, উহা যেন রাজপুতবীর তাঁহার প্রভুর শ্রীচরণে পরাইয়া দেন। আর মানসিংহ যে মোগলের সহিত বৈবাহিক সম্বন্ধ করিয়া পতিত ও কলঙ্কিত হইয়াছেন, সে কথাও বাদ পড়িল না। দূত যথাসময়ে এই সংবাদ আনিয়া দিল। সঙ্গে সঙ্গে উভয় পক্ষে যুদ্ধসম্বন্ধীয় সাজ সরঞ্জাম আরদ্ধ হইল। মানসিংহ চৈত্র মাসে রাজমহল হইতে নিষ্ক্রান্ত হন বলিয়া বোধ হয়। যশোহরে আসিতে প্রায় জ্যৈষ্ঠ মাস শেষ হইয়া গিয়াছিল সুতরাং সম্মুখে বর্ষাকাল। বর্ষা আসিলে সুন্দরবন অঞ্চল জলোচ্ছ্বাসে ভাসিয়া যাইবে; শুষ্কদেশবাসী মোগল-সৈন্যের পক্ষে তখন নিম্নবঙ্গে বাস করা অসম্ভব হইয়া পড়িবে। সিক্তস্থানে বাস ও আবিল জল পান করিয়া শুধু যে রোগ পীড়া হইবে, তাহা নহে; সর্পভয় এবং মশক ও জলৌকার উৎপাতই তাহাদিগকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিবে। অতএব যত সত্বর সম্ভব যুদ্ধ শেষ করিয়া প্রস্থান করিতে হইবে।
বসন্তপুর ও শীতলপুরের পূর্ব্বভাগস্থ প্রান্তরমধ্যে যুদ্ধের আয়োজন হইল। হাবসি ও তুর্কীসৈন্য উভয় পার্শ্বে রাখিয়া মহাবীর মানসিংহ স্বীয় ২০ হাজার রাজপুতসৈন্য সহ মধ্যস্থলে রহিলেন; সামন্তরাজগণের প্রেরিত ও অন্যভাবে সংগৃহীত সৈন্যসমূহ তাহার পৃষ্ঠ রক্ষা করিল প্রতাপের পক্ষে যমুনার তীর দিয়া সামন্ত ও সেনানীবর্গ ছাউনী করিয়াছিলেন। ইহার মধ্যে উড়িষ্যার গণপতি নরেন্দ্র, কতলু খাঁর পুত্র জমাল খাঁ, খোজা কমল, ঢালী সর্দ্দার মদন মল্ল ও কালিদাস রায়, কুকীসৈন্য সহ রঘু এবং দক্ষিণদিকে বারকপুরের কাছে অশ্বসেনাপতি প্রতাপসিংহ দত্ত প্রভৃতির নাম করা যায়। পশ্চাতে নদীর কূলে প্রতাপ, তাঁহার প্রধান সেনাপতি সূর্য্যকান্ত এবং শঙ্কর চক্রবর্ত্তী ও অন্যান্য যোদ্ধৃগণের পটমণ্ডপ সজ্জীভূত হইয়াছিল। উভয়পক্ষের কামান সকল সম্মুখ ভাগে আসিয়া পড়িয়াছিল এবং তাহারই ধ্বনির সহিত যুদ্ধারম্ভ হইল।
ঘটকেরা বলেন তিন দিন ধরিয়া এই যুদ্ধ হয়, প্রথম দুই দিনে মানসিংহ পরাজিত ও তৃতীয় দিনে তিনি বিজয়ী হইয়া প্রতাপাদিত্যকে বন্দী করেন। এই ঘটকের পুঁথির ভিত্তির উপর ‘ক্ষিতীশ- বংশাবলীচরিত’ ও ভারতচন্দ্রের কবিতা রচিত হইয়াছিল; পুঁথির কথা প্রবাদে বিজড়িত হইয়া দেশময় রাষ্ট্র হইয়াছিল; আধুনিক গ্রন্থকারগণ সকলেই পুঁথির মতের অনুসরণ করিয়া যুদ্ধ বর্ণনা করিয়াছেন। ঘটকের যে পুঁথি শাস্ত্রী মহাশয় প্রথম প্রকাশিত করেন, তাহাও ঘটনার বহু পরে লিখিত। ঐ পুঁথিতে অনেকস্থলে অম্বররাজ মানসিংহকে ‘জয়পুরাধীশ’ বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। কিন্তু এই যুদ্ধ ১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে হয় এবং জয়পুর শহর মানসিংহের বংশধর জয়সিংহ কর্তৃক ১৭২৮ খ্রিষ্টাব্দে নিৰ্ম্মিত হয়।[৩] সুতরাং পুঁথিখানি ঘটনার প্রায় ১৫০ বৎসর পরে লিখিত বলিয়া ধরা যায়। ঘটকেরা কেহ যুদ্ধের দর্শক-সাক্ষী নহেন বা চাক্ষুষ প্রমাণের উপর পুস্তক লিখিয়াছেন বলিয়া বোধ হয় না। অন্য কোন সমসাময়িক বিবরণী দেখিয়া যদি তাঁহারা লিখিতেন, তাহা হইলে মানসিংহ প্রতাপাদিত্যকে বন্দী করিয়া লইয়া যান, এমন কথা গ্রন্থিত হইত না। আমরা ‘বহারিস্তানের’ লেখকের চাক্ষুষ প্রমাণ হইতে দেখিতে পাইতেছি যে, মানসিংহ প্রতাপাদিত্যকে বন্দী করেন নাই, বন্দী করিয়াছিলেন ইসলাম খাঁ এবং সেও ৫/৬ বৎসর পরে। পর পরিচ্ছেদে সে কাহিনী বিবৃত হইবে। এই অবস্থায় ঘটকের কাহিনী বিশ্বাস করিয়া প্রতাপাদিত্যের সহিত মানসিংহের যুদ্ধ সম্বন্ধে কোন খুঁটিনাটি বর্ণনা বা সজীব চিত্র দেওয়া চলে না। পূর্ব্বের আয়োজন ও শেষফল হইতে যুদ্ধের অবস্থা সম্বন্ধে যাহা কল্পনা করিয়া লওয়া যায়, আমরা তাহাই দিব এবং পাঠকগণ তাহাতে আপাততঃ তৃপ্তিলাভ করিবেন।
এইমাত্র বলিতে পারি, মানসিংহের সহিত প্রতাপ-সৈন্যের ভীষণ যুদ্ধ হইয়াছিল। এ যুদ্ধ একদিনে শেষ হয় নাই বা এক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ ছিল না। যুদ্ধ কয়েকদিন ধরিয়া চলিয়াছিল এবং বসন্তপুর হইতে ধুমঘাট পর্যন্ত নানাস্থানে বিষম সংঘর্ষ বাধিয়াছিল। অগ্নিযুদ্ধে মোগল সেনাপতি প্রতাপাদিত্যের সমকক্ষ ছিলেন বলিয়া বোধ হয় না; পর্তুগীজ কর্মচারীদিগের অধীন গোলন্দাজেরা সুকৌশলী ও অসমসাহসী ছিল। বঙ্গীয় ঢালী সৈন্যগণ সাহসের বলে অদ্ভুত রণ-ক্রীড়া দেখাইত; বিশেষতঃ আদিম পার্বত্য জাতিদিগের দ্বারা প্রতাপ যে কুকীসৈন্য গঠন করিয়াছিলেন, তাহারা জল-কদমে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কোন ক্লেশ বোধ না করিয়া, অসাধারণ সহিষ্ণুতার জন্য অসম্ভবকে সম্ভব করিয়া তুলিত। প্রতাপের হস্তিসৈন্য অনেক বেশী ছিল; মুক্ত প্রান্তরে মোগল অশ্বারোহী অদ্বিতীয় যোদ্ধা হইলেও তাহারা বনে জঙ্গলে কদমাক্ত স্থলে হস্তিসৈন্যের আক্রমণের বিপক্ষে কিছুই করিতে পারিত না। অপর পক্ষে মোগলের সৈন্যসংখ্যা খুব বেশী। কাব্য বা প্রবাদের অতিরঞ্জন মানিয়া লইলে, প্রতাপের ৫২ হাজার ঢালী, ৫১ হাজার ধানুকী, ১০ হাজার অশ্বারোহী এবং ১৬০০ হস্তী ছিল। ইহা ব্যতীত ‘মুদ্গর প্রাস-হস্ত’ অর্থাৎ দণ্ডধারী শড়কীওয়ালা অনিয়মিত সৈন্যও ছিল। কিন্তু ইহার মধ্যে ৫২ হাজার ঢালী ও ৫১ হাজার ধানুকী, ইহারা পৃথক্ পৃথক্ লোক কিম্বা একজাতীয় কতক অন্যদলের অন্তর্ভুক্ত হইয়া গিয়াছিল, তাহা স্থির করা যায় না। পৃথক পৃথক ধরিলে প্রতাপাদিত্যের পদাতিক সংখ্যাই লক্ষাধিক বলিতে হয়। কিন্তু তত বিশ্বাস হয় না, কারণ ৪/৫ বৎসরের মধ্যে ঐ সংখ্যা কমিয়া ২০ হাজার মাত্র হইতে পারে না।[৪] যাহা হউক, প্রতাপের সৈন্য যাহা ছিল, মানসিংহের সংখ্যা তদপেক্ষা অধিক। রূপরাম, কচু রায় প্রভৃতির চেষ্টায় সে সংখ্যা আরও বাড়িতেছিল, অনেকে প্রতাপের দল ছাড়িয়া কচু রায়ের দলে মিশিতেছিল। যতদূর জানা যায়, ভৃত্য ও বাহকের হিসাব ধরিলে, মানসিংহ সৰ্ব্বসমেত প্রায় তিনলক্ষ লোক লইয়া যশোহরাক্রমণ করিয়াছিলেন।
প্রতাপাদিত্য স্বদেশ সেবার এক নূতন ব্রত গ্রহণ করিয়াছিলেন, উদ্যাপন করিতে পারেন নাই। অবশ্য তাঁহার সেই ব্রতের সঙ্গে আত্মপ্রাধান্য লাভের প্রচেষ্টা যোগ দেওয়াতে তাঁহার সাধনাকে স্বার্থ বিমুক্ত পবিত্র দেশ-হিতৈষণা বলা যায় না। কিন্তু তবুও তাঁহার প্রাণপণ চেষ্টা ছিল, এবং সে চেষ্টা সফল হয় নাই। উহার প্রধান কারণ, তাঁহার রাজত্বের ইতিহাস আদ্যেপান্ত বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনীতে পূর্ণ। এই যুদ্ধের সময়ও প্রতিদিন তাঁহার পক্ষীয়েরা মোগল শিবিরে আশ্রয় লইতেছিল। ইহার মধ্যে একজনের নাম গণপতি নরেন্দ্র, ইনি উড়িষ্যার একজন সামন্ত নৃপতি। তিনি যেখানে ছাউনী করিয়াছিলেন, তাহারই নাম রাখা হয়—গণপতি। শীতলপুরের পার্শ্বে এখনও গণপতি গ্রাম আছে। দিনের পর দিন যুদ্ধ চলিল, তাহাতে উভয় পক্ষের অসংখ্য লোকক্ষয় হইতেছিল। মানসিংহের সৈন্য অধিক এবং তাহা নানা মতে বাড়িতেছিল; প্রতাপের সৈন্য কম এবং যুদ্ধ ব্যতীত বিশ্বাসঘাতকতার জন্যও তাহা কমিতেছিল। প্রতাপ জিতিয়া জিতিয়া হারিতেছিলেন, মানসিংহ প্রথমতঃ হারিলেও নিত্য নূতন স্থান দখল করিয়া অগ্রসর হইতেছিলেন।
মানসিংহ প্রতাপকে চিনিতেন এবং অত্যন্ত ভালবাসিতেন। উড়িষ্যাভিযানে প্রতাপের বীরত্বের কথা তাঁহার মনে ছিল। তিনি যশোহরের যুদ্ধে বঙ্গীয় বীরের অসাধারণ সমর-কৌশল দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলেন। তিনি নিজে মহাবীর, বীরের মহত্ত্ব বুঝিতেন। যুদ্ধান্তে তিনি জয়লাভ করিলেও বীরত্বের সম্মান রাখিবার জন্য প্রতাপাদিত্যের সহিত সন্ধি করিলেন। তিনি মিবারাধিপতি প্রতাপসিংহের সহিত সন্ধি স্থাপনের জন্য কত চেষ্টাই করিয়াছিলেন কিন্তু চেষ্টা সফল হয় নাই। স্বদেশসেবাব্রত প্রতাপাদিত্যকে তিনি খাঁচায় পুরিয়া লইয়া গেলে, বাস্তবিকই রাজপুত-চরিত্রের অবমাননা করা হইত। তাহা তিনি করেন নাই; কিন্তু তবুও কলঙ্কের ডালি কেন তাঁহার স্কন্ধে চাপিল, তাহা কিছুতেই খোঁজ করিয়া বাহির করিতে পারিলাম না।
সকল তথ্যের সার সংগ্রহ করিয়া আমরা এই যুদ্ধের ফলাফল সম্বন্ধে নিম্নলিখিত সংক্ষিপ্ত বিবরণী দিতে পারি। কয়েক দিন ধরিয়া নানা স্থানে কয়েকটি যুদ্ধ হয় বটে, কিন্তু তন্মধ্যে আমরা তিন দিনের যুদ্ধ উল্লেখ করিতে পারি। প্রথম যুদ্ধ বসন্তপুরের সন্নিকটে হয়, উহাতে জয় পরাজয় স্থির হয় না। উভয় পক্ষের বহু সৈন্য ধ্বংস হয়। দ্বিতীয় দিনও উহারই সন্নিকটে ভীষণ যুদ্ধ। এই যুদ্ধই সৰ্ব্বপ্রধান; ইহাতে সম্ভবতঃ সূর্য্যকান্ত ও মদন মল্ল প্রভৃতি নিহত এবং শঙ্কর আহত অবস্থায় ধৃত হন। এই যুদ্ধে মানসিংহ জয়লাভ করিয়া পরদিন মুকুন্দপুরের দুর্গ অধিকার করিয়া লন। তখন সন্ধির প্রস্তাব করিলেও প্রতাপাদিত্য স্বীকৃত হন নাই, এজন্য মোগল সৈন্য দ্রুতবেগে কুচ করিয়া ধুমঘাটের অপর পারে উপস্থিত হয়। সেখানে তৃতীয় যুদ্ধ হয়। এযুদ্ধে মোগলদিগের বহু ওমরাহ নিহত হন, তন্মধ্যে মামুদ অন্যতম। সম্ভবতঃ তাঁহারই নামানুসারে স্থানটির নাম মামুদপুর রাখা হয়। প্রতাপ-পক্ষেও ফিরিঙ্গি রডা প্রভৃতি বিখ্যাত যোদ্ধা এই যুদ্ধে কালগ্রাসে পতিত হন। প্রতাপ এই যুদ্ধে পরাজিত হইয়া, মানসিংহের সহিত সন্ধি করেন। তখন ওমরাহদিগের শবদেহ টেঙ্গা মসজিদের পার্শ্বে লইয়া সমাহিত করা হয়। সন্ধি হওয়ার পর ‘সিংহ রাজার সহিত প্রতাপাদিত্যের অধিক অন্তরঙ্গতা হইল।[৫] রামরাম বসু এইরূপ ভাবে অন্তরঙ্গতার কথা বলিয়াছেন, প্রতাপাদিত্যকে বন্দী করিয়া লওয়ার কথা বলেন নাই। তবে সে কথা রচিল কে?
উভয় পক্ষেরই সন্ধি করার প্রয়োজন হইয়াছিল। মানসিংহ দেখিলেন, বর্ষাকাল সমাগতপ্ৰায়; তৎপূর্ব্বে সৈন্যদিগকে সুন্দরবন হইতে স্থানান্তরিত না করিলে ব্যাধির প্রকোপেই তাহার অধিকাংশ মৃতু-মুখে পতিত হইবে। বিশেষতঃ তিনি সংবাদ পাইয়াছিলেন যে, তিনি যে সেনাপতি কিমকে শ্রীপুরের কেদার রায়ের বিরুদ্ধে প্রেরণ করিয়াছিলেন। তিনি সৈন্যসহ শ্রীপুরে অবরুদ্ধ অবস্থায় আছেন।[৬] অচিরে সৈন্যসহ গিয়া তাঁহাকে উদ্ধার করিতে হইবে। এজন্য প্রতাপাদিত্যের সহিত সত্বর সন্ধি করিতে হইল। এদিকে প্রতাপও তাঁহার প্রধান প্রধান সেনাপতিগণের মৃত্যু এবং বন্ধুবান্ধবের কৃতঘ্নতার জন্য নিতান্ত বিপন্ন ও মনঃক্ষুণ্ণ হইয়া পড়িয়াছিলেন। দুদিন দেখিয়া অনেকেই তাঁহার প্রতি সহানুভূতিশূন্য হইয়াছিল। বসন্ত রায়ের মধুর চরিত্র তখনও লোকের স্মৃতিপথে ছিল এবং তাহার নৃশংস হত্যার বার্তা তখনও কেহ ভুলিতে পারে নাই। সেই বসন্ত রায়ের প্রাপ্ত-বয়স্ক পুত্র কচু রায়কে মোগলসৈন্যর সঙ্গে আসিতে দেখিয়া, অনেকেরই সহানুভূতি তাঁহার দিকে গিয়াছিল। কচু রায় যাহাতে পৈতৃক রাজ্য পান, শত্রুমিত্র সকলেরই তাহাই অভীপ্সিত ছিল। জ্ঞাতি-বিরোধই প্রতাপাদিত্যের পতনের কারণ হইয়াছিল। আরও দুই-একটি ঘটনায় প্রতাপের প্রতি তাঁহার প্রজারা শ্রদ্ধাহীন হইয়াছিল। ঘটকেরা বলিয়াছেন, মানসিংহের সঙ্গে যখন যুদ্ধ চলিতেছিল তখন একদিন প্রতাপাদিত্য সুরামত্ত অবস্থায় দ্যূতক্রীড়া করিতেছিলেন; এমন সময় এক বৃদ্ধা ভিখারিণী বারংবার ভিক্ষা চাহিয়া তাঁহাকে বিরক্ত করিয়া তুলিল; তখন তিনি ক্রোধে আত্মহারা হইয়া বৃদ্ধার স্তনদ্বয় কর্ত্তন করিবার হুকুম দিলেন, সে আজ্ঞা তৎক্ষণাৎ প্রতিপালিত হইল। আবার কেহ বলেন, প্রতাপাদিত্য একদিন প্রত্যুষে যখন সুরামত্ত অবস্থায় দরবারে আসিতেছিলেন, তখন এক মেথরাণী অনাবৃতবক্ষে সম্মার্জ্জনী হস্তে তাঁহার সম্মুখে পড়িল, তিনি সেই অপদৃশ্য দেখিয়া উহার স্তনদ্বয় কাটিয়া ফেলিতে আদেশ দেন। নানা ভাবে রূপান্তর হইলেও মূল ঘটনাটি অসত্য বলিয়া বোধ হয় না। মোটকথা এই, তিনি লঘু পাপে একজন অসহায়া বৃদ্ধা স্ত্রীলোকের স্তনদ্বয় কর্ত্তন করিতে হুকুম দিয়াছিলেন। মোগলদিগের বড় বড় বাদশাহের আমলে তাঁহাদের এইরূপ নৃশংসতার কত শত সহস্র গল্প আছে, কত পাঠক ভিন্সেন্ট স্মিথ প্রভৃতি ঐতিহাসিকের গ্রন্থ পড়িতে গিয়া রোমাঞ্চিত হইয়া থাকেন। কিন্তু তাই বলিয়া হিন্দুরাজা প্রতাপের পাপকে কোন মতে লঘু বলিয়া মনে করা যায় না। হিন্দু শাস্ত্রে স্ত্রীলোকের অবমাননা বা তৎপ্রতি নৃশংসতার মত পাপ আর নাই। হিন্দুর নিকট স্ত্রীলোকমাত্রেই বিশ্বজননীর অংশভূত; উহার প্রতি অত্যাচার হইলেই প্রকৃত ধর্মগ্লানি হয়, উহার জন্য ভগবতী কখনও ক্ষমা করেন না। তিনি সেরূপ অত্যাচারীকে যুগে যুগে ভীষণ শাস্তি দিবার জন্য স্বয়ং আবির্ভূত হইয়াছেন। রাবণ বা শুম্ভনিশুম্ভ ইহার দৃষ্টান্তস্থল। সুতরাং হিন্দুর চক্ষে প্রতাপ ক্ষমার্হ নহেন।
পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, প্রতাপ সুরাপানের দোষে পিতৃব্য হত্যাদি কয়েকটি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছিলেন; তাহার পাপরাশি সঞ্চিত হইয়াছিল। লোকের বিশ্বাস ছিল, দেবতার অনুগ্রহে তাঁহার উন্নতি হয়; সুতরাং যখন তিনি নৃশংস ও অত্যাচারী হইয়া দাঁড়াইয়াছেন, তখন তাঁহার সে দেবানুগ্রহ থাকিতে পারে না। লোকের এই বিশ্বাস হইতেই এক গল্পের সৃষ্টি হইল। একদিন প্রতাপ দরবার গৃহে রাজকার্য্যে ব্যস্ত, এমন সময়ে ভগবতী প্রতাপের ষোড়শী কন্যার রূপ ধারণ করিয়া তথায় উপস্থিত হইলেন, তিনি কন্যাকে প্রকাশ্য দরবারে আসিতে দেখিয়া অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া ‘দূর হও’ বলিয়া তাহাকে তাড়াইয়া দিলেন; মাতাও ‘তথাস্তু’ বলিয়া প্রতাপের প্রতি বিমুখী হইয়া অন্তর্হিত হইলেন।[৭] তাই কবির লেখনী-মুখে ফুটিল-বিমুখী অভয়া, কে করিবে দয়া, প্রতাপাদিত্য হারে’। বিমুখী হওয়া শুধু কথার কথা নহে, মাতা যশোরেশ্বরী সত্য সত্যই মুখ ফিরাইয়া বসিলেন। ‘পাপেতে ফিরিয়া, বসিলা রূষিয়া, তাঁহারে অকৃপা করি।’
এইজন্য প্রবাদ আছে, মাতা যশোরেশ্বরী প্রতাপাদিত্যের প্রতি বিরক্ত হইয়া মন্দির সমেত পশ্চিমবাহিনী হইয়াছিলেন। একথা আমরা একেবারেই বিশ্বাস করি না। সে বিষয় আমরা পূৰ্ব্বে আলোচনা করিয়াছি (১৫শ পরিচ্ছেদ)। মাতা যেরূপ ভাবে আবির্ভূত হইয়াছিলেন, তেমনই আছেন। তবে প্রতাপের ঔদ্ধত্য ও নৃশংস চরিত্রে ভগবতীর অকৃপা হইয়াছিল, সে কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি।
প্রতাপাদিত্য যুদ্ধে পরাজিত হইয়া অবশেষে বাধ্য হইয়া মানসিংহের সহিত সন্ধি করিলেন। লিখিত কোন বিবরণী না থাকিলেও সে সন্ধির মর্ম্ম এইরূপ বলিয়া বোধ হয় :
১. রাঘব বা কচু রায় পৈতৃক সম্পত্তি অর্থাৎ যশোর রাজ্যের ছয় আনা অংশ পাইয়া যশোহরের প্রাচীন রাজধানীতে অধিষ্ঠান করিলেন এবং তাঁহার উপাধি হইল, ‘যশোহরজিত’।[৮] রায়গড় দুর্গ পূর্ব্ববৎ তাঁহার অধিকারে আসিল।
২. প্রতাপাদিত্য যশোর রাজ্যের ১০ আনা অংশ এবং স্বোপার্জিত অন্যান্য বহু পরগণার মালিক হইয়া, মোগল বাদশাহের সামন্তরাজ বলিয়া পরিচিত হইতে স্বীকৃত হইলেন। তাঁহার সৈন্যসামন্ত দুর্গ বা রণতরী সমস্তই রহিল; কেবলমাত্র স্বাধীনতার চিহ্ন-পতাকা ও স্বনামাঙ্কিত মুদ্ৰা বিলুপ্ত করিয়া ফেলিবার আদেশ হইল।
৩. উভয় পক্ষের বন্দীদিগকে বিনাপণে ফেরত দেওয়া হইল। কথিত আছে, মানসিংহ পণ্ডিতবীর মহাপ্রাণ শঙ্করের ব্যবহারে মুগ্ধ হইয়া তাঁহাকে ‘বাদশার বিরুদ্ধে কখন যুদ্ধ করিব না’, এইরূপ প্রতিজ্ঞা করাইয়া মুক্ত করিয়া দেন।[৯]
এই সন্ধি প্রসঙ্গে আর একটি কথা আলোচ্য। আকবরের শাসনকালে তাঁহার সামন্ত রাজগণকে বাদশাহের সন্তোষ বিধানের জন্য তাঁহাকে কন্যা বা ভগিনী সম্প্রদান করিতে হইত। এইভাবে উপহারপ্রাপ্ত মহিলাদিগকে ডোলার কন্যা বলিত। মানসিংহের পিতৃস্বসাকে আকবর গ্রহণ করেন এবং তাঁহার ভগিনীর সহিত জাহাঙ্গীরের বিবাহ হয়। মানসিংহ ধৰ্ম্মে হিন্দু থাকিলেও বিলাসপ্রিয়তা ও হাবভাবে মোগলদিগের ঘূর্ণিত অনুকরণ করিয়াছিলেন। এইরূপে তিনি আকবরের এত প্রিয়পাত্র হন যে, বাদশাহ তাহাকে ফর্জাণ্ড (Farzand) বা পুত্র বলিয়া অভিহিত করিতেন।[১০] তিনিও বাদশাহের অনুকরণে অনেক দেশের বহু জাতির মধ্যে হইতে স্ত্রী গ্রহণ করিয়াছিলেন, মৃত্যুকালে তাঁহার ১৫০০ স্ত্রী জীবিত ছিল। কুচবিহারের রাজা লক্ষ্মীনারায়ণ বশ্যতা স্বীকার করিলে মানসিংহ তাঁহার ভগিনীকে (পদ্মেশ্বরী) বিবাহ করেন।[১১] কথিত আছে এই পদ্মেশ্বরীর গর্ভজাত সন্তানের বংশধরই এখন জয়পুরের রাজা।[১২] এইরূপ ভাবে প্রবাদ আছে, মানসিংহ প্রথমবার শ্রীপুরের রাজা কেদার রায়ের সহিত সন্ধি করিবার সময় তাঁহার কন্যা বিবাহ করেন। অম্বরের শিলাদেবীর বাঙ্গালী পুরোহিতগণের বংশাবলীতে ইহার উল্লেখ আছে।[১৩] প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধেও এইরূপ একটি গল্প আছে। কিন্তু উক্ত বংশাবলীতে বা ঘটকারিকাদি গ্রন্থে প্রতাপের কোন কন্যা সম্প্রদান করিয়া সন্ধি করিবার কথা পাওয়া যায় না। প্রতাপের দুইটি মাত্র কন্যা; স্বশ্রেণীভুক্ত কায়স্থ-বংশেই তাহাদের বিবাহের কথা স্পষ্টতঃ উল্লিখিত আছে (১১শ পরিচ্ছেদ)। কিন্তু রামরাম বসু লিখিয়া গিয়াছেন : ‘প্রতাপাদিত্য তাঁহার ডোলার এক সুন্দরী কন্যা আপন কন্যা প্রচার করিয়া বিবাহ দিলেন সিংহরাজার পুত্রের সহিত।[১৪] এ উক্তির কোন মূল আছে বলিয়া মনে হয় না, থাকিলেও, সম্প্রদত্ত কন্যাটি প্রতাপাদিত্যের নিজের কন্যা নহে। যশোহরে আসিবার সময়ে সিংহরাজার সহিত তাঁহার কোন পুত্র আসিয়াছিল বলিয়া জানা যায় নাই। তাঁহার পুত্র হিম্মত সিং, দুৰ্জ্জন সিংহ ও জগৎ সিংহ ইতোপূৰ্ব্বেই (১৫৯৭-৯৯) মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছিলেন।[১৫]
সন্ধিপত্র সম্পাদিত হইবার পর, মানসিংহ সর্ব্ববিধ কার্য্য মিটাইয়া রাঘব রায়কে উপযুক্ত সংখ্যক রক্ষী-সৈন্য ও শিরোপা দিয়া যশোহর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। তিনি তান্ত্রিক মন্ত্রে দীক্ষিত শাক্ত। যুদ্ধান্তে সন্ধি হইবামাত্র তিনি মাতা যশোরেশ্বরীর মন্দিরে গিয়া মহাসমারোহে পূজা করিলেন এবং তাঁহার আশীর্ম্মাল্য লইয়া যশোহর ত্যাগ করিলেন। এ দেশের সর্বত্র সৰ্ব্বজাতীয় লোকের নিকট একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে যে, মানসিংহ যশোহর হইতে যাইবার সময় যশোরেশ্বরী দেবী প্রতিমা লইয়া গিয়াছিলেন। এ কথা যে সত্য নহে, তাহা নিঃসন্দেহরূপে প্রতিপন্ন হইতে পারে।[১৬] তবে এ কথা সত্য যে, মানসিংহ বঙ্গদেশ হইতে যাইবার সময় একটি দেবী প্রতিমা সঙ্গে লইয়া যান এবং উহা স্বীয় রাজধানী অম্বরনগরীতে প্রতিষ্ঠিত করেন। সে প্রতিমা সেখানে আছে এবং বঙ্গীয় পদ্ধতি অনুসারে পূজা করাইবার জন্য মানসিংহ যে বাঙ্গালী ব্রাহ্মণদিগকে সঙ্গে লইয়া গিয়াছিলেন, তাঁহাদেরই বংশধরগণ এখনও অম্বরে পূজারি আছেন। এক্ষণে বিচার্য্য এই, উক্ত প্রতিমাখানি তিনি কোথা হইতে লইয়া গিয়াছিলেন?
প্রথমতঃ যশোহর হইতে যশোরেশ্বরীকে লইয়া যাওয়ার কথা, ঘটককারিকায় নাই, ‘ক্ষিতীশ- বংশাবলী’তে নাই, এমন কি ‘অন্নদামঙ্গল’ বা রামরাম বসুর গ্রন্থেও নাই। তবে এ প্রবাদের উৎপত্তি কোথায়? বরং রামরাম বসু যশোরেশ্বরীর আবির্ভাব প্রসঙ্গে লিখিয়া গিয়াছেন : ‘লোকে বলে যশোরেশ্বরী ঠাকুরাণী। তিনি অদ্যাপিও আছেন।’[১৭] এ হইল ১৮০১ খৃঃ অব্দের কথা এবং স্বশ্রেণীর কায়স্থ পণ্ডিতের লেখা। বাস্তবিকই যশোরেশ্বরী দেবী এখনও আছেন, এবং ঈশ্বরীপুরে নিত্য পূজিত হইতেছেন। ক্রমে তাঁহার প্রসিদ্ধি বিস্তৃত হইতেছে। প্রবাদের সহিত এই কথার সামঞ্জস্য করিবার জন্য লোকে বলে, মানসিংহ যশোরেশ্বরীকে লইয়া গেলে, কচু রায় তৎপরিবর্ত্তে অন্য প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করেন। সে কথা টিকিত, যদি মানসিংহ প্রতাপকে বন্দী করিয়া লইতেন এবং পথে অন্ততঃ ১৬০৬ অব্দের পূর্ব্বে প্রতাপের মৃত্যু ঘটিত। কিন্তু আমরা দেখিতেছি, ১৬০৯ খৃঃ অব্দ পর্যন্ত প্রতাপাদিত্য সদর্পে রাজত্ব করিয়াছিলেন এবং প্রতাপের মৃত্যুর ৪ বৎসর পূর্ব্বে অর্থাৎ ১৬০৬ অব্দে কচু রায় নিজ অংশের রাজ্যভার কনিষ্ঠ ভ্রাতা চাঁদ রায়কে দিয়া অবসর গ্রহণ করেন। প্রতাপের মত ভক্ত শাক্তবীর জীবদ্দশায় কখনও স্বীয় উপাস্য দেবতা দিয়া সন্ধি করিতেন না এবং মানসিংহ বলপ্রয়োগে লইতে গেলে, প্রতাপের মরণ না হইলে দেবীকে লওয়া যাইত না। মানসিংহ ১৬০৪ অব্দে বঙ্গে কার্য্যত্যাগ করিয়া আগ্রায় চলিয়া গিয়াছেন, পরে ১৬০৬ অব্দে তিনি ৮ মাসের জন্য বঙ্গে যাতায়াত করিলেও যশোহরে আর আসেন নাই। সুতরাং মানসিংহ যে যশোহর হইতে দেবী-প্রতিমা লইয়া যান নাই, ইহা নিশ্চিত
দ্বিতীয়তঃ, অম্বরে যে দেবীমূৰ্ত্তি আছেন, তাঁহাকে লোকে সল্লাদেবী বা শিলাদেবী বলে। ভারতচন্দ্র লিখিতেছেন : ‘শিলাময়ী নামে, ছিল তাঁর ধামে অভয়া যশোরেশ্বরী।’ অর্থাৎ শিলাময়ী এবং যশোরেশ্বরী যেন অভিন্ন। উত্তরে বলা যায়, যশোরেশ্বরী যে শিলাময়ী বা প্রস্তরময়ী মূর্তি, তাহাতে সন্দেহ নাই; তাঁহার নামও শিলাময়ী হইতে পারে; কিন্তু তাই বলিয়া তিনি যে শিলাদেবী বা সল্লাদেবী হইবেন, এমন কথা নাই।
তৃতীয়তঃ, প্রতাপাদিত্যের উপাস্য দেবতা কালিকামূর্তি। ভারতচন্দ্রেও আছে, ‘যুদ্ধকালে সেনাপতি কালী’, যশোরেশ্বরী মায়ের রৌপ্য কোশায় লিখিত আছে ‘শ্রীকালী’ (১৫শ পরিচ্ছেদ)। যশোরেশ্বরী মূর্ত্তি মুখমাত্রাবশিষ্টা লোল রসনা কালীমূর্তি। অথচ অম্বরের সল্লাদেবী অষ্টভুজা মহিষমৰ্দ্দিনী দুর্গামূর্তি। দেবী প্রতিমা সমস্তই বিশ্বমাতার বিভিন্ন মূৰ্ত্তি হইলেও, শাক্ত উপাসকের ইষ্ট মন্ত্র ও ইষ্ট দেবতা একমাত্র হন, সময়ে বিভিন্ন মূর্ত্তি হন না। সুতরাং অম্বরের সল্লাদেবী প্রতাপাদিত্যের উপাস্য দেবী নহেন।
চতুর্থতঃ, প্রতাপাদিত্যের উপাস্য যশোরেশ্বরীর মুখখানি মাত্র আছে, তদ্ভিন্ন হস্তপদ কিছুই নাই। তাহার নিম্নাংশ প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড পাষাণখণ্ডে গঠিত পিন্ডমাত্র। পীঠমূর্ত্তি অনেক স্থলেই এইরূপ দেখিতে পাওয়া যায়। যিনি ঈশ্বরীপুরে গিয়া একবার সে ভয়ঙ্করী মূর্তি নয়ন ভরিয়া অবলোকন করিয়াছেন, তিনিই বলিবেন, তেমন মূৰ্ত্তি কেহ স্থানান্তরে লইতে চায় না বা লইয়া যায় না। অপর পক্ষে শিলাদেবী ক্ষুদ্রকায়া সুন্দর দুর্গামূর্তি; ভক্তিমান মানসিংহ উহা দেখিয়া মুগ্ধ হইয়াছিলেন এবং সাধ করিয়া লইয়া গিয়া অম্বরে স্থাপিত করিয়াছিলেন।
পঞ্চমতঃ, সল্লাদেবীকে যে মানসিংহ লইয়া গিয়াছিলেন, তাহা সত্য। জয়পুর অঞ্চলে এখনও প্রবাদ আছে ‘আমেরকা সল্লাদেবী লিয়া রাজা মান।’ বাঙ্গালী পদ্ধতিতে তাঁহার পূজা হয়; যে পুরোহিতেরা পূজা করেন, তাঁহাদের পূর্ব্ব-পুরুষ বাঙ্গালা দেশ হইতে গিয়াছিলেন। তাঁহার নাম কমলাকান্ত ভট্টাচাৰ্য্য। সম্ভবতঃ তিনি বিক্রমপুরবাসী এবং পাশ্চাত্য বৈদিক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। এখন তাঁহার বংশধরগণ রাজপুত ব্রাহ্মণের সহিত আদান প্রদান করিয়া তদ্দেশীয় সমাজের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছেন। জয়পুরী ভাষায় লিখিত উহাদের একটি বংশাবলী আছে।[১৮] তাহার একস্থলে দেখিতে পাই। ‘পাছে উঠীনে কেদার কায়ত কো রাজ ছো। সো রাজা বাজৈ ছো। সো উকৈ সিলামাতা ছী। সো মাতাকা প্রতাপ সে উনে কোই ভী জীৎ তো নহী।… অর মাতা নেঁলে আয়া। আর বংগাল্যা নেঁ পূজন সোঁপো অর উঠা সূঁ কুঁচ করি আয়া।’ অর্থাৎ ‘অনন্তর ঐ দিকে কেদার কায়েতের রাজ্য ছিল। তিনি রাজা নামে অভিহিত হইতেন। তাঁহার নিকট শিলামাতা ছিলেন। সেই শিলামাতার প্রভাবে তাঁহাকে (কেদারকে) কেহই জয় করিতে পারিত না।…. মাতাকে লইয়া আসিলেন। এবং বাঙ্গালীদিগকে ইহার পূজার ভার সমর্পণ করিলেন। অনন্তর, তথা হইতে কুচ করিয়া যাত্রা করিলেন।’[১৯] আবার জয়পুর রাজস্কুলের ভূতপূর্ব্ব হেডমাষ্টার রামনাথ বারেট মহাশয় ‘ইতিহাস’-রাজস্থান’ নামক এক হিন্দী পুস্তক প্রণয়ন করিয়াছেন। উহার একস্থলে আছে :
‘প্রতাপাদিত্যকো জীতকর রাজা কেদারকে রাজ্য চড়াই কী। বহু জাতি কা কায়স্থা থা, ঔর সাল্লামাতা নামী দেবী কা উকে ইষ্ট থা; মানসিংহজী কী লঢ়াইকে সমাচার সুনকর কেদার নৌকামে বৈঠকর সমুদ্র কী ঔর ভগ্ গয়া। ঔর মন্ত্রীসে কহ গয়া যদি হো সকে তো মেরী পুত্রী মানসিংহজীকো দে কর সন্ধি কর লেনা; মন্ত্রীনে ঐসা হী কিয়া। মানসিংহজীনে প্রসন্ন হৌ কর কেদার কো বাদসাহ কা পাদসেবী বনা কর উস্কা রাজ্য পীছা দে দিয়া, ঔর সল্লাদেবীকো আম্বের লে আয়ে।’[২০]
ইহার বঙ্গানুবাদ এই : প্রতাপাদিত্যকে জয় করিয়া মানসিংহ কেদারের রাজ্য আক্রমণ করেন। ইনি জাতিতে কায়স্থ ছিলেন, শিলামাতা নামে তাঁহার ইষ্টদেবী ছিলেন। মানসিংহের যুদ্ধের কথা শুনিয়া নৌকায় সমুদ্রাভিমুখে পলায়ন করেন এবং মন্ত্রীকে বলিয়া যান যে যদি সম্ভবপর হয়, তবে আমার কন্যা মানসিংহকে দিয়া যেন সন্ধি করিয়া লন। মন্ত্রী তাহাই করিলেন। মানসিংহ প্রসন্ন হইয়া কেদারকে বাদশাহের পাদসেবী (সামন্তরাজ) করিয়া রাজ্য প্রত্যার্পণ করেন। এবং সল্লাদেবীকে আম্বেরে লইয়া যান।
বংশাবলী ও ‘ইতিহাস-রাজস্থান’ ইহার কোনখানিকে আমরা অপ্রমাণিক বলিতে পারি না। পূর্ব্বোক্ত সবগুলি কারণ একত্র সমালোচনা করিয়া আমরা অসন্দিগ্ধ চিত্তে বলিতে পারি, মানসিংহ প্রতাপাদিত্যের সহিত সন্ধি করার পর কেদারের রাজ্য আক্রমণ করেন এবং যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর তাঁহার দেহান্ত ঘটিলে, মানসিংহ শ্রীপুর হইতে শিলাদেবীকে অম্বরে লইয়া গিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি প্রতাপাদিত্যের যশোরেশ্বরীকে লইয়া যান নাই। যশোরেশ্বরীর যে দেবী- প্রতিমা এক্ষণে ঈশ্বরীপুরে নিত্য পূজিত হইতেছেন, তিনি প্রামাণিক প্রাচীন পীঠ মূৰ্ত্তি।
মানসিংহ যশোহর হইতে পুনরায় স্থল-পথেই রাজমহল ফিরিয়া আসেন এবং তথা হইতে রণতরী সজ্জিত করিয়া শ্রীপুরের কেদার রায়ের রাজ্য আক্রমণ করেন। শ্রীনগরের যুদ্ধে[২১] কেদার রায় পরাজিত ও নিহত হইলে, তিনি তথা হইতে কেদারের ইষ্টদেবতা শিলাদেবীকে লইয়া স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন (১৬০৪)। এই সময়ে আকবরের রাজ্যের উত্তরাধিকারী নির্ব্বাচন লইয়া যে বিষম গোলযোগ উপস্থিত হয়, তাহাতে স্বীয় ভাগিনেয় সেলিম-পুত্র খসরুর পক্ষ সমর্থন করিবার জন্য মানসিংহ ব্যস্ততার সহিত আগ্রা যাত্রা করেন। যাইবার পূর্ব্বে তিনি ভবানন্দকে বাগোয়ান, মহৎপুর, নদীয়া, মারূপদহ, লেপা, সুলতানপুর, কাশিমপুর, বয়সা ও মশুণ্ডা প্রভৃতি ১৪ খানি পরগণা এবং গুরুপুত্র লক্ষ্মীকান্তকে মাগুরা, খাসপুর, কলিকাতা, পাইকান ও আনোয়ারপুর, এই ৫ খানি পরগণা ও হাতিয়াগড়ের কতকাংশের জমিদারী প্রদান করেন। ভবানন্দ তাঁহার সঙ্গেই আগ্রায় যান, এবং আকবরের মৃত্যু জন্য বৎসরাধিক কাল অপেক্ষা করিয়া উক্ত ১৪ পরগণার জমিদারীর ফরমাণ বা সনন্দ এবং নহবৎ, ডঙ্কা, নিশানাদি সম্মানসূচক দ্রব্যসহ স্বদেশে আসে (১৬০৬)। কৃষ্ণনগরের রাজবাটীতে এখনও অতি জীর্ণ অবস্থায় উক্ত সনন্দ বৰ্ত্তমান আছে। ঐ একই বৎসরে লক্ষ্মীকান্তেরও জমিদারী সনন্দ প্রদত্ত হয়। ইঁহারা উভয়েই পরে কানুনগো প্রভৃতি কাৰ্য্যে দক্ষতা দেখাইয়া মজুমদার উপাধি পান। তখন এইরূপ আর একজন মজুমদার ছিলেন- জয়ানন্দ; ইনি বাঁশবেড়িয়া রাজবংশের পূর্ব্বপুরুষ এবং মানসিংহের অনুগৃহীত। বাঙ্গালার অধিকাংশ তখন এই তিন মজুমদারের হস্তে পড়িয়াছিল, এই জন্য ‘তিন মজুমদারের বাঙ্গালা ভাগ’ করিবার একটি প্রবাদ চলিয়া আসিতেছে।[২২] মানসিংহের সঙ্গে যে সব হিন্দুস্থানী সৈন্যসামন্ত আসিয়াছিলেন, প্রত্যাবর্তন কালে তাঁহাদের কেহ কেহ সুন্দর স্থান ও স্বচ্ছন্দ জীবিকার ভরসায় বর্তমান যশোহর-খুলনার স্থানে স্থানে বাস করেন। এখনও সামটা, চন্দনপুর প্রভৃতি স্থানে পাঁড়ে, মিশ্র ও ত্রিবেদী বংশীয় হিন্দুস্থানী ব্রাহ্মণেরা বাস করিতেছেন। সুবিখ্যাত পণ্ডিত ও সুলেখক বীরেশ্বর পাঁড়ে এই বংশীয়। সবিশেষ বিবরণ পরে দিব।
পাদটীকা :
১. Ain. (Blochmann). p. 341.
২. নকীব কেশব ভট্টের যে স্থানে বাসস্থান ছিল, ঈশ্বরীপুরের সন্নিকটবর্ত্তী সেই স্থানকে এখন লোকে নকীবপুর বা নকীপুর বলে।
৩. ইঁহার নাম সেবাই জয়সিংহ, ইনি অম্বর-রাজবংশের কৃতীপুরুষ। ১৬৮৬ খৃঃ অব্দে জন্ম এবং ১৭৪৩ অব্দে মৃত্যু হয়। তিনিই জয়পুরের প্রতিষ্ঠাতা, এবং দিল্লী, জয়পুর ও কাশীর মানমন্দির প্রতিষ্ঠা করিয়া ও জ্যোতিষ শাস্ত্রের আলোচনায় খ্যাতি লাভ করেন।
৪. ইসলাম খাঁর শাসনকালে আব্দুল লতীফ্ নামক এক ব্যক্তি দেওয়ানের সঙ্গে বঙ্গে আসেন। তাঁহার ভ্রমণ- বৃত্তান্ত হইতে জানিতে পারি, ১৬০৮ খৃষ্টাব্দে প্রতাপাদিত্যের ‘যুদ্ধ সামগ্রীতে পূর্ণ সাত শত নৌকা বিশহাজার পাইক (পদাতিক সৈন্য) এবং ১৫ লক্ষ টাকা আয়ের রাজ্য’ ছিল।— ‘প্রবাসী’, আশ্বিন, ১৩২৬, ৫৫২ পৃ। [পরিশিষ্ট দ্র.- শি মি]
৫. রামরাম বসু, ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’, ১ম সং, (১৮০১), ১৪৮ পৃ; [নিখিলনাথ, মূল ৬২ পৃ.শি. মি]
৬. Akbarnama (Takmilla), Elliot. Vo!. VI. p. III.
৭. এই গল্পটিও ঘটক-কারিকায় অন্যভাবে বর্ণিত আছে। যুদ্ধকালে রাত্রিতে যখন ‘মধুপানানুরাধীশঃ হতচিত্তোঽতিবিহ্বলঃ’ হইয়া অন্দরে কেলীমন্দিরে ছিলেন, তখন এক ষোড়শী সুন্দরী তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া ভিক্ষান্ন প্রার্থনা করিলেন। প্রতাপ তাঁহাকে ভ্রষ্টা স্ত্রী মনে করিয়া রুষ্ট ভাষায় গালি দিয়া তাড়াইয়া দেন।
৮. ঘটকের পুঁথিতে অনেকস্থলে রাঘব রায়ের নামোল্লেখ না করিয়া ‘রাজা যশোহরজিৎ’ বলিয়া লিখিত দেখিতে পাওয়া যায়।
৯. শঙ্করের বংশধর শাস্ত্রী মহাশয় ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকা হইতে উদ্ধৃত করিয়াছেন : “তিনি (শঙ্কর) সমস্ত সম্পত্তি ব্রাহ্মণগণকে প্রদান করিয়া সর্ব্বশান্ত হইয়া গঙ্গাবাস উপলক্ষে গঙ্গার নিকটবর্ত্তী বারাশাত গ্রামে সপুত্রে আসিয়া বাস করেন।’— ‘প্রতাপাদিত্য চরিত,’ ১৬১-২ পৃ। যশোহর-ঈশ্বরীপুরের উত্তর-পূর্ব্ব কোণে শঙ্করহাটি গ্রামে শঙ্কর চক্রবর্তীর আবাস ছিল, এখন তাহার কোন চিহ্ন নাই। শঙ্করহাটির হাট প্রসিদ্ধ ছিল।
১০. Ain. (Blochmann ), p. 339.
১১. Akbarnama, Vol. III, P. 1068.
১২. “বাঙ্গলার সামাজিক ইতিহাস’, ১৩৯ পৃ।
১৩. “যদি রাজা মানসিংহজী উঁকী বেটা মাগী। যদি রাজা কেদার দেণী করী। অর মিলাপ হুবো। জদি নীজর করী।’ অর্থাৎ ‘মানসিংহ রাজা কেদারের কন্যা প্রার্থনা করিলেন। রাজা দিতে অঙ্গীকার করায় উভয়ের মিলন হইয়া গেল, এবং কেদার রাজা মানসিংহকে নজর করিলেন।’— নিখিলনাথ, ‘প্রতাপাদিত্য’ মূল ৫০৮-১০ পৃ। যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত মহাশয় কোন বিশেষ কারণ না দর্শাইয়া এই ঘটনা ‘সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য’, এইরূপ মত প্রকাশ করিয়াছেন।— ‘কেদার রায়’, ৫৭ পৃ। ‘বঙ্গের বাহিরে বাঙ্গালী’ প্রভৃতি গ্রন্থে এই বিবাহ স্বীকৃত হইয়াছে। —৪৪৭ পৃ।
১৪. রামরাম বসু, ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’, ১ম সং, ১৪৪ পৃ; নিখিলনাথ, মূল ৬২ পৃ।
১৫. Akbarnama (Beveridge), Vol. III. pp. 1093-4, 1151. 1597 অব্দে হিম্মৎ উদরাময়ে ও দুৰ্জ্জন যুদ্ধে মারা যান। ১৫৯৯ অব্দে বঙ্গে আসিবার পথে আগ্রায় জগৎ সিংহের মৃত্যু ঘটে।
১৬. মদীয় শ্রদ্ধেয় বন্ধু এবং প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায় মহোদয় যেরূপ প্রমাণ প্রয়োগ দ্বারা এই বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন এবং তদ্দ্বারা বঙ্গবাসী মাত্রেরই ধন্যবাদ ভাজন হইয়াছেন, তাহা অনুসন্ধিৎসু পাঠক মাত্রেই জানেন। আমরা অন্যান্য যুক্তির সহিত সংক্ষেপে তাহারই সারমর্ম এখানে প্রকটিত করিব। যিনি জয়পুর হইতে এই বিষয়ে নিখিলনাথকে প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া দিয়াছিলেন, তিনি জয়পুর মহারাজার কলেজের অধ্যাপক এবং বসন্ত রায়ের বংশধর নবকৃষ্ণ রায় মহাশয়। উভয়ের নিকট আমার ঋণ অপরিশোধ্য।
১৭. নিখিলনাথ, ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ৪৬ পৃ।
১৮. কমলাকান্ত হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত ১০ পুরুষ হইয়াছে। (১) কমলাকান্তের পুত্র (২) রত্নগর্ভ সার্ব্বভৌমের পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁহার এক কন্যা বঙ্গদেশ হইতে আনীত রাজেন্দ্র চক্রবর্ত্তী বিবাহ করেন। এই কন্যার গর্ভজাত সন্তান (৪) সন্তোষরাম। সন্তোষের পুত্র (৫) বিদ্যাধর, সওয়াই জয়সিংহের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি অশেষ শাস্ত্রে অগাধ পণ্ডিত। তাঁহারই নক্সা অনুযায়ী জয়পুর নগরী নিৰ্ম্মিত হয়। বিদ্যাধর হইতে একটি বংশধারা এইরূপ : ৫ বিদ্যাধর— ৬ মুরলীধর— ৭ লছমীধর— ৮ বংশীধর — ৯ শিওবক্স— ১০ সূরজ বক্স (জীবিত)। জয়পুর মহারাজার কলেজের ভূতপূর্ব্ব ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল মেঘনাদ ভট্টাচাৰ্য্য মহোদয় বিদ্যাধরের জীবনী লিখিয়া প্রথমে ‘এডুকেশন গেজেটে’ ও পরে ১৩১১ সালের ‘সাহিত্য-পরিষদ পত্রিকা’য় প্রকাশ করেন। ‘বঙ্গের বাহিরে বাঙ্গালী’, ২৪৬-৫৫ পৃ।
১৯. নিখিলনাথ, ‘প্রতাপাদিত্য (নবকৃষ্ণ রায় মহাশয়ের পত্র), মূল ৫০৭-১০ পৃ।
২০. নিখিলনাথ, ‘প্রতাপাদিত্য’ (নবকৃষ্ণ রায় মহাশয়ের পত্র), ৫০৩-০৪ পৃ; ‘ইতিহাস রাজস্থান’, ১০৩-০৪ পৃ।
২১. যুদ্ধজয়ের পর মানসিংহ এই শ্রীনগরের নাম রাখিয়াছিলেন, ফতেজঙ্গপুর। উহার একাংশ এখনও নগর বলিয়া কথিত হয়। ‘নগরের কেবল শ্রীটুকু নাই।’ আনন্দনাথ রায়, ‘বারভুঞা’,-৯৯ পৃ।
২২. ‘কলিকাতা, সেকালের ও একালের’, ৫৬ পৃ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন