এক – প্রতাপাদিত্যের পতন

সতীশচন্দ্র মিত্র

পরিশিষ্ট। ক। এক – প্রতাপাদিত্যের পতন[১]

১. নুতন ঐতিহাসিক উপকরণ আবিষ্কার 

আমাদের দেশের প্রচলিত প্রবাদ যে, মুঘল রাজপ্রতিনিধি রাজা মানসিংহ যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্যকে বন্দী করিয়া লোহার খাঁচায় পুরিয়া দিল্লী লইয়া যান, পথে কাশীতে প্রতাপাদিত্যের মৃত্যু হয়। (Westland’s Jessore, 2nd ed., p. 24 ) 

মানসিংহ আকবরের রাজত্বকালে ১৫৯৪ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন এবং ১৬০৫ খ্রীষ্টাব্দে আকবরের মৃত্যু পর্যন্ত ওই পদে থাকেন। জাহাঙ্গীর সম্রাট হইবার পর তাঁহাকে (১৪ অক্টোবর, ১৬০৫) ওই কর্মে বহাল রাখিয়া রাজধানী হইতে বাঙ্গলায় প্রেরণ করেন। কিন্তু কয়েকমাস পরেই (১৬০৬ খ্রীষ্টাব্দের আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে) তাঁহাকে সরাইয়া নুরজাহানকে হস্তগত করিবার জন্য কুতবুদ্দীন খাঁকে তাঁহার স্থানে নিযুক্ত করেন। (ইবলনামা, ২ ও ১৯ পৃ)। সুতরাং মানসিংহ প্রতাপকে বিনাশ করিলে তাহা ১৬০৬ এর মধ্যেই ঘটিত। একখানা ‘অদ্বিতীয়’ পুরাতন ফার্সী হস্তলিপি হইতে গত ১৩২৬ সালের আশ্বিনের ‘প্রাবসী’তে দেখাইয়াছি যে এই প্রচলিত কথ্য সত্য নহে, এবং প্রতাপাদিত্য সশরীরে ১৬০৯ খ্রীষ্টাব্দের ২৬এ এপ্রিল বাঙ্গলার নূতন সুবাদার ইসলাম খাঁর সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং কয়েক দিন পরে নিজ দেশে ফিরিয়া যাইবার অনুমতি পান। 

তাহা হইলে প্রতাপাদিত্যের শেষ পরাভব ও মৃত্যু কোন্ বৎসরে এবং কোন্ সুবাদারের হাতে ঘটে? তিনি মানসিংহ হইতে পারেন না। তবে কে? সুখের বিষয়, এই প্রশ্নের ঠিক উত্তর দেওয়া যায়। বিলাতে একখানা ফার্সী হস্তলিপি আছে, যাহার দ্বিতীয় পুঁথি পৃথিবীর অন্য কোথায়ও নাই। ইহার নাম বহারি-স্তান-ই-ঘাইবী; রচয়িতার নাম আলাউদ্দীন ইস্ফাহানী শিতাব খাঁ (ছদ্মনাম ঘাইবী, ডাকনাম মির্জা নথন্)। এই সুদীর্ঘ গ্রন্থের পৃষ্ঠাসংখ্যা ৬৫৬, প্রতি পৃষ্ঠায় ২০ লাইন। ইহার একমাত্র বিষয় ১৬০৮ খ্রীষ্টাব্দ হইতে ১৬২৪ পর্যন্ত বাঙ্গলার অতি বিস্তৃত ইতিহাস। ইতিহাস বলিতে অবশ্য বুঝায় শুধু সুবাদারের দরবারের ঘটনা, যুদ্ধবিগ্রহ, সন্ধি, ওমাগণের কার্যকলাপ, এবং বাদশাহের সভার সংবাদ। দেশের কথা, প্রজার অবস্থা, ইচ্ছা করিয়া বর্ণিত হয় নাই; তবে স্থানে স্থানে কিছু আভাস পাওয়া যায়। 

এই পুঁথিখানি গ্রন্থকারের স্বহস্তে অথবা জবানীতে লিখিত, কারণ দুই পাশে সমালোচনা ও টিপ্পনী আছে, এবং মোহরগুলি হইতে ১৬৪১ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ইহার অধিকারীগণের নাম পাওয়া যায়। সর্বপ্রথম যাঁহাকে গ্রন্থকার পুঁথিখানি উপহার দেন তাঁহার নামও আছে। বাঙ্গলার ইতিহাসের পক্ষে ইহা অমূল্য। আমি ইহার ফটো আনিয়াছি। গৌহাটী হইতে ইহার ইংরেজী অনুবাদ, অধ্যাপক Borah কৃত, ১৯৩৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়, দুই খণ্ডে। 

এই ফার্সী গ্রন্থে তৎকালীন বাঙ্গলার সমস্ত জমিদারদের সহিত মুঘলরাজের সংঘর্ষের এবং আমাদের ‘বঙ্গাধিপ পরাজয়ের’ বিস্তৃত, সঠিক ও প্রাচীনতম সমসাময়িক বিবরণ আছে—অবশ্য বিজেতার পক্ষ হইতে লেখা। প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে যে নূতন সংবাদ পাওয়া যায় তাহা নীচে ফারসী হইতে অনুবাদ করিয়া দিতেছি। 

২. প্রতাপাদিত্যের সহিত বিবাদ 

এই প্রতাপাদিত্যের মত সৈন্য ও অর্থবলে বলী রাজা বঙ্গদেশে আর নাই। তাঁহার যুদ্ধসামগ্রীতে পূর্ণ প্রায় সাতশত নৌকা, বিশ হাজার পাইক এবং ১৫ লক্ষ টাকা আয়ের রাজ্য আছে। (আবদুল লতীফের ভ্রমণ)। 

প্রতাপাদিত্যের দূত শেখ বদী ঐ রাজার কনিষ্ঠপুত্র সংগ্রাম-আদিত্যকে সঙ্গে করিয়া আনিয়া [রাজমহলে] নবাব ইসলাম খাঁর সহিত সাক্ষাৎ করাইল (১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষাংশ)। কিছুদিন পরে বালককে বাড়িতে ফিরিয়া যাইবার অনুমতি দেওয়া গেল। 

যখন ইস্‌লাম খাঁ নৌযানে চড়িয়া রাজমহল হইতে গোয়াশ এবং গোয়াশ হইতে রাজশাহী জেলার অন্তর্গত শাহপুর থানার সামনে আত্রেয়ী নদীর পারে পৌঁছিলেন, তখন শেখ বদীর সঙ্গে প্রতাপাদিত্য আসিয়া তাঁহার সাক্ষাৎ লাভ করিলেন। [এই সাক্ষাতের স্থান বজ্রপুর, নাটোর শহর হইতে ১৫ মাইল উত্তরে।] প্রতাপ ৬টা হাতী, নানা মূল্যবান দ্রব্য, কর্পূর, অগুরু এবং নগদ প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা উপঢৌকন দিলেন। ২৬ এপ্রিল ১৬০৯। (আবদুল লতীফের ভ্রমণ)। 

ইস্লাম খাঁ তাঁহাকে অত্যন্ত সম্মানের সহিত অভ্যর্থনা করিলেন এবং মিষ্ট কথাবার্তা করিতে থাকিলেন। তাহার পর এই শর্তে তাঁহাকে বিদায় দিলেন যে, দেশে ফিরিয়া তাঁহার পুত্র ও যুদ্ধনৌকাগুলি বাদশাহী নওয়ারার সহিত যোগদান করিতে পাঠাইবেন, এবং যখন বর্ষার শেষে নবাব স্বয়ং ভাটা প্রদেশের জমিদারদিগের বিরুদ্ধে যাত্রা করিবেন তখন প্রতাপ সসৈন্যে বাদশাহী সেনাপতিদের সহিত মিলিত হইয়া যুদ্ধ করিবেন। প্রথমতঃ প্রতাপ কনিষ্ঠ পুত্র সংগ্রাম-আদিত্যের সহিত ৪০০ রণপোত পাঠাইবেন, এবং বর্ষা শেষে স্বয়ং আরও একশত নৌকা (একুনে পাঁচ শত), এক হাজার অশ্বারোহী এবং বিশ হাজার পদাতিক সৈন্য লইয়া আন্দল খাঁ নদীর পথে গিয়া শ্রীপুর ও বিক্রমপুর আক্রমণ করিয়া ভাটীর জমিদার মুসা খাঁ মসনদ-ই-আলাকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিবেন; এইরূপ প্রতিজ্ঞা করিলেন। 

অতএব ইস্লাম খাঁ প্রতাপের পূর্ব সম্পত্তি বহাল রাখিয়া তাঁহাকে শ্রীপুর ও বিক্রমপুর ইনাম দান করিলেন। (এ দুটি পরগণা তখনও জয় করা হয় নাই! প্রতাপ এবং বারো ভুঁইয়াদের মধ্যে যুদ্ধ বাধাইবার ইহা একটি মহা সুযোগ (divide and rule)। সুবাদার যাইবার সময় প্রতাপকে খেলাৎ, রত্ন-খচিত ছোরা, তিনটি হাতী, কয়েকটি ঘোড়া এবং বাদশাহের পক্ষ হইতে নক্কাড়া উপহার দিলেন। 

তাহার পর ভাটীর মুসা খাঁ ও বারো ভুঁইয়ারা বাধ্য হইয়া বশ্যতা স্বীকার করিল; উমান পরাস্ত হইয়া বকাইনগর দুর্গ ছাড়িয়া শ্রীহট্টের জঙ্গলে পলাইয়া গেল। ভূষণার রাজা শত্রুজিৎ তো আগেই মুঘল পক্ষে আসিয়া জুটিয়াছিলেন। কিন্তু প্রতাপ নিজ প্রতিজ্ঞা পালন করেন নাই, এই সব যুদ্ধে সুবাদারকে সাহায্য করেন নাই। [তিনি নিশ্চয় জানিতেন যে বারো ভূঁইয়া ও উমানকে জয় করিবার পর মুঘল সৈন্য তাঁহার উপর পড়িবে, সুতরাং উহাদের ধ্বংসে সাহায্য করা তাঁহার পক্ষে আত্মহত্যা হইবে।] ইসলাম খাঁর এই-সব বিজয়ের পর প্রতাপের চৈতন্য হইল। তিনি পূর্ব অপকর্মের জন্য অনুতাপ করিয়া নিজ পুত্র সংগ্রাম-আদিত্যকে ৮০ খানা রণপোত সহ নবাবের নিকট পাঠাইলেন এবং ক্ষমা চাহিলেন। ইস্লাম খাঁ রাগে আজ্ঞা দিলেন যে, মীর ইমারত (গৃহনির্মাণের অধ্যক্ষ) ওই ৮০ খানা নৌকায় কাঠ, খড়, ইঁট, পাথর বহিয়া বহিয়া ওইগুলি ভাঙ্গিয়া ফেলুক। তাহার পর ইনাএৎ খাঁর অধীনে এক প্রকাণ্ড সৈন্যদল, অগণিত অশ্বারোহী ও পদাতিক ৫০০০ বক্-আন্দাজ, ৩০০ রণপোত এবং অনেকগুলি তোপ দিয়া তাঁহাকে যশোহর প্রদেশ জয় করিতে পাঠাইলেন। মুসা খাঁ ও অন্যান্য বাধ্য জমিদারগণ নিজ নিজ নৌকা ও সৈন্য সহ বাদশাহী অভিযানে যোগ দিল। ঠিক সেই সময়ে অপর একদল বাদশাহী সৈন্য বগ্‌লার জমিদার (কন্দর্পের পুত্র) রামচন্দ্রকে জয় করিবার জন্য সৈয়দ হকীমের অধীনে প্রেরিত হইল। আর ২০০ বর্ক-আন্দাজ ও ৪০০ নৌকা অনেকগুলি ওম্রা সহ উমান খাঁর গতিবিধি লক্ষ্য করিবার জন্য বার সিন্দুর’ নামক স্থানে বসিয়া রহিল। প্রতাপ যেন কোন দিক হইতে সাহায্য না পান। ইস্লাম খাঁ স্বয়ং ঘোড়াঘাট হইতে ঢাকা গেলেন। 

৩. যশোহর অভিযান 

প্রথমে ইনাএৎ খাঁ কুচ করিয়া অগ্রসর হইলেন। তাহার কিছুদিন পরে মির্জা নথন্ [অর্থাৎ এই ফারসী গ্রন্থের লেখক] তোপ লইয়া পিছু পিছু রওনা হইলেন। মির্জা ভাতুড়িয়া-বাজু পরগণার চীলা-জোয়ার নামক স্থানে পৌঁছিয়া কিছুদিন বিশ্রাম করিতে চাহিলেন। উক্ত জোয়ারের জমিদার পীতাম্বর ও অনন্ত বিদ্রোহী হইয়া মুঘল শিকদারগণকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করিয়াছিল। এখন বাদশাহী সৈন্য নিকটে আসায় তাহারা ভয়ে পলাইয়া আলাইপুরের জমিদার বর্র্দারের পুত্র আলাবখ্শের নিকট গিয়া আশ্রয় লইল। মির্জা নথ তখন সৈন্য লইয়া গিয়া আলাবখ্শের দুর্গগুলি দখল করিলেন। 

এদিকে ইনাএৎ খাঁ মহদপুর বাঘোয়ান্[২] পৌঁছিয়া দেরি করিতে বাধ্য হইলেন, কারণ তখন ও তাঁহার অধীনস্থ কয়েকজন ওম্রা আসিয়া যোগদান করেন নাই। তাঁহার প্রেরিত একদল সৈন্য- ১৫০০ অশ্বারোহী ও ২০০০ পদাতিক-গিয়া বাঘা[৩] গ্রাম লুট করিয়া পুড়াইয়া দিল এবং তথায় দুর্গ নির্মাণ করিয়া থানা স্থাপন করিল। এখানে ৪০০ অশ্বারোহী রহিল। বিজয়ী মুঘল সেনাপতি এই স্থান হইতে অনেকগুলি সুন্দরী স্ত্রীলোককে ধরিয়া আনিয়া বাঁদীতে পরিণত করিল। 

মহদপুর বাঘোয়ানে মির্জা নথন্ তোপ ও নৌকা সহ আসিয়া ইনাএৎ খাঁর সহিত যোগ দিলেন। তাহার পর প্রতাপাদিত্যের রাজ্যের দিকে সকলে অগ্রসর হইলেন। আর পথে শিকার চলিতে লাগিল। [মুঘলেরা ভৈরব হইতে ইচ্ছামতী নদীতে পড়িয়া ক্রমাগত দক্ষিণে সুন্দরবনের দিকে যাইতে লাগিল।] 

মুঘল সৈন্য যশোহর-রাজ্যের সীমানায় পৌঁছিয়া দেখিল যে প্রতাপাদিত্য সালকাধ নামক স্থানে তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র উদয়-আদিত্যকে খোজা কমলের অধীনে ৫০০ রণপোত এবং কলু খাঁর পুত্র জমাল খাঁর অধীনে এক হাজার অশ্বারোহী ও ৪০টা হাতী দিয়া দাঁড় করাইয়া রাখিয়াছেন। এখানে উদয় একটি উঁচু দুর্গ নির্মাণ করিয়া তাহার চারিদিকে জল দিয়া ঘিরিয়া রাখিয়াছিল;-এক পাশে নদী, অপর পাশে একটি নালা, আর দুই পাশে গভীর পরিখা কাটিয়া তাহা ওই নদী ও খালের সঙ্গে যোগ করিয়া জলে পূর্ণ করা হইয়াছে। প্রতাপের সৈন্য দুর্গে ও নৌকাগুলি নদীতে আশ্রয় লইয়াছিল। 

৪. প্রথম যুদ্ধ 

এইরূপ স্থির হইল যে, মুঘল সৈন্য নদীর দুই পাড় দিয়া কুচ করিয়া শত্রুদুর্গের দিকে অগ্রসর হইবে, মধ্যে নদী বহিয়া নওয়ারা চলিবে, এবং তীরের বন্দুক ও তোপ হইতে সাহায্য পাইবে। প্রথম দল এই পাড়ে প্রধান সেনাপতি ইনাএৎ খাঁর অধীনে রহিল। দ্বিতীয় দল মির্জা নথনের অধীনে রাতারাতি অপর পাড়ে (অর্থাৎ দুর্গের দিকে) পার হইয়া গেল। প্রত্যেক দলের সহিত- অর্থাৎ তাহার নিকটবর্ত্তী পাড় ঘেঁষিয়া—নওয়ারার এক এক অংশও চলিতে থাকিবে। 

পরদিন কুচ আরম্ভ হইল। কিন্তু উদয়-আদিত্য যুদ্ধ করিতে অগ্রসর হইলেন না। মুঘল সেনাপতিদ্বয় প্রত্যেকে দশখানা নৌকা পাহারার জন্যে অগ্রে রাখিয়া, অপর নৌকাগুলির মাল্লাদিগকে হুকুম দিলেন যে, তাহারা নামিয়া শত্রুদুর্গের পাশে দুটি দুর্গ নির্মাণ করুক। 

এই কাজ অর্ধেক হইয়াছে এমন সময় উদয়াদিত্য হঠাৎ নৌ-বল লইয়া বাহির হইয়া আসিয়া আক্রমণ করিলেন। খোজা কমল তাঁহার অগ্রবর্তী বিভাগের সেনাপতি, এবং ওই খোজার সঙ্গে অনেক বেপারি, কোসা, ভলিয়া, পাল, ঘুরাব্ (floating battery, gun-boat), মাচোয়া, পশ্তা ও জলিয়া (galliot) জাতীয় নৌকা ছিল। অপর নৌকাগুলি কেন্দ্রে উদয়ের অধীনে চলিল। জমাল খাঁ পদাতিক ও হাতী লইয়া দুর্গ রক্ষা করিতে থাকিল। মহাশব্দে যুদ্ধ আরম্ভ হইল। অপর মুঘল নৌকাগুলি সাজিতে ও আসিতে দেরি হইল। ইতিমধ্যে সমস্ত শত্রু-আক্রমণের চাপ ওই বিশখানি বাদশাহী নৌকার উপর পড়িল, কিন্তু তাহারা জীবন তুচ্ছ করিয়া যুঝিল, মুখ ফিরাইল না। 

খোজা কমলের ঘুরাগুলি এবং ২ খানা ‘পিয়ারা’ নৌকা মিলিয়া দশখানা বাদশাহী নৌকাকে ঘিরিয়া ইনাএৎ খাঁর দিকে যে দুর্গ তৈয়ারি হইতেছিল তাহার পাড়ের নীচে তাড়াইয়া লইয়া গেল। তীরস্থ মুঘল সৈন্য ঘোড়া হইতে নামিয়া তীর মারিয়া শত্রুকে দুর্বল করিয়া একখানা ঘুরাব্ ও একখানা ‘পিয়ারা’ কাড়িয়া লইল। 

যুবরাজের সৈন্য ও মাল্লাগণ নিজ ঘুরাগুলি নঙ্গর করিয়াছিল; এজন্য তাহাদের লইয়া পলাইতে পারিল না। এখন মুঘল তীরন্দাজগণের ভীষণ আক্রমণ সহ্য করিতে না পারিয়া তাহারা নৌকা ছাড়িয়া জলে ঝাঁপ দিয়া প্রাণ বাঁচাইল। (অর্থাৎ এই জলযুদ্ধ স্থলসৈন্যের দ্বারাই নিষ্পত্তি হইল। ) 

নদীর অপর পাশে মির্জা নথনের দশখানি অগ্রগামী নৌকাও শত্রুরা ঘিরিয়া ফেলিয়াছিল; কিন্তু তীর হইতে মির্জা, লক্ষ্মী রাজপুত, শাহ বেগ এবং অপর নেতারা নিজ নিজ অনুচর সহ তীর চালাইয়া শত্ৰু মাল্লাদিগকে বাধা দিতে এবং পশ্চাদ্ধাবন করিতে লাগিলেন। 

এইরূপে অগ্রসর হইয়া মির্জা নথ এরূপ স্থলে আসিয়া পৌঁছিলেন যে খোজা কমলের নৌ- বল তাঁহার পিছনে এবং উদয়াদিত্যের নৌ-বল তাঁহার অগ্রে এবং পাশে রহিল; সুতরাং অল্পক্ষণ যুদ্ধের পরই যশোহরের নওয়ারা বিশৃঙ্খল এবং মাল্লাগণ হতভম্ব হইয়া পড়িল। 

[অর্থাৎ সালামিসের যুদ্ধে পারসীক নৌ-বলের মত যশোহরের নৌবাহিনীর অত্যধিক সংখ্যাই তাহার বিশৃঙ্খলা এবং পরাজয়ের কারণ হইল। দ্বিতীয়ত, এই ছোট নদীর মধ্যে নৌকাগুলির লোক তীরবর্তী সবল দ্রুতগামী ও স্থলযুদ্ধে পরিপক্ক মুঘল সৈন্যের তীর ও বন্দুকের আক্রমণ নানা দিক হইতে পাইয়া একেবারে অসহায় ভাবে হতাহত হইতে লাগিল। তীরভূমি উঁচু, সেখান হইতে দু পাশ দিয়া যে তীর ও গুলি আসিতে লাগিল, তাহা হইতে যশোহরের মাল্লা ও সৈন্যগণের না ছিল রক্ষার স্থান, না ছিল পলাইবার পথ। অর্থাৎ স্থলসৈন্য জলসৈন্যকে পরাজিত করিল। অর্থাৎ নথন্ তীর বহিয়া দ্রুত অগ্রসর হওয়ায় নদীস্থ যশোহরের নৌকার লম্বা শ্রেণী মাঝে কাটা পড়িল; পশ্চাৎও বন্ধ, শুধু সর্ব-সম্মুখের কয়েকখানি নৌকার পলাইবার পথ খোলা রহিল। অপর সব নৌকা এত ভিড় করিল যে তাহাদের গতিরোধ হইয়া গেল, এবং তীর হইতে মুঘল সৈন্যগণ তাহাদের উপর অব্যর্থ সন্ধান করিতে লাগিল।] 

যখন উদয়াদিত্যের নৌবাহিনীতে এই বিশৃঙ্খলা, শত্রুকে আক্রমণ করিবার এমন কি আত্মরক্ষা করিবারও শক্তি নাই, তখন এক বন্দুকের গুলিতে খোজা মারা গেল। আর যুদ্ধ করিবার সাহস কাহারও রহিল না। জমাল খাঁ তীর হইতে নিকটবর্ত্তী মুঘলদের উপর তীর ও কামান চালাইতে লাগিল বটে, কিন্তু উদয় পলাইল। 

৫. উদয়াদিত্যের পলায়ন 

শত্রু-নৌবলের পরাজয়ের পর সমস্ত বাদশাহী এবং বাধ্য জমিদারদের নওয়ারা যশোহর নওয়ারা লুট করিতে লাগিয়া গেল। আর কোন দিকে দৃষ্টি নাই; সেনাপতির কথা কেহ শুনে না। 

শুধু চারিখানি কোসা ও দুখানি অপর জাতীয় নৌকা উদয়ের পিছনে তাড়া করিল। উদয়ের নৌকার সঙ্গে সঙ্গে পলাইয়া যাইতেছিল এমন একখানা ‘পিয়ারা’ নৌকা, চারিখানা ঘুরাব্ এবং ফিরিঙ্গী-পূর্ণ একখানা মাচোয়া,–এই ছয়খানি নৌকা প্রভুভক্তি দেখাইয়া নঙ্গর ফেলিল এবং বাদশাহী নৌকার পথ বন্ধ করিয়া দাঁড়াইল। এইরূপে কিছু সময় পাওয়া গেল। পরে যখন পাড় দিয়া মির্জা নথন ও অন্যান্য সৈন্য নিকটে আসিয়া পৌঁছিল এবং এই শত্রু-নৌকাগুলিকে তীর চালাইয়া পরাস্ত করিল, তখন বাদশাহী পশ্চাদ্ধাবনকারী নৌকার মধ্যে চারিখানি উহাদের লুট করিতে ব্যস্ত হইল। দুইখানি মাত্র কোসা—(মির্জা নথনের নিজস্ব নৌকা, তাহার একখানিতে মহমুদ খাঁ পানী, অপরখানিতে মির মুহম্মদ লোদী মির বহর নেতা)—মির্জাকে দেখিয়া লজ্জারখাতিরে উদয়ের নৌকার পিছু পিছু চলিতে লাগিল। নদীকূল দিয়া মির্জা ও তাঁহার অশ্বারোহী সৈন্য উদয়কে ধরিবার আশায় দৌড়াইতে লাগিলেন। শত্রু-নৌকা সকলও পিছনে গুলি চালাইতে চালাইতে পলাইতে লাগিল। 

ক্রমে তাহারা নদীর এক অতি সংকীর্ণ অংশে আসিয়া উপস্থিত হইল। সামনে নৌকার ভিড়ে পথ বন্ধ। মুঘল কোসা-দুখানি উদয়াদিত্য যে ‘মহলগিরি’[৫] শ্রেণীর নৌকায় চড়িয়াছিলেন, তাহার দুপাশে আসিয়া পৌঁছিল। তীরে মির্জা আসিলেই উদয় বন্দী হন আর কি 

এ মহাবিপদে উদয়ের অগ্রবর্তী দ্রুত পলায়মান কোসার মাল্লারা পলায়ন বন্ধ করিয়া দাঁড় ছাড়িয়া বৈঠা হাতে লইয়া কোসাকে দ্রুত পিছাইয়া আনিয়া উহার পশ্চাৎভাগ উদয়ের মহলগিরির সামনের গলুই-এর সঙ্গে ভিড়াইয়া দিল। এ সময় মির্জার কোসা দুটির মাথা উদয়ের মহলগিরি হাল ছুঁইয়াছিল এবং মুঘলেরা ওই মহলগিরিতে চড়িতে চেষ্টা করিতেছিল এবং উহার মাল্লা ও সৈন্যগণ কেহ তীরে কেহ জলে লাফাইয়া পড়িল। মহা সঙ্কট! এইবার উদয়াদিত্যের রক্ষা নাই। 

কিন্তু এক মুহূর্তের মধ্যে উদয় দুই স্ত্রীর হাত ধরিয়া মহলগিরি হইতে নিজ কোসার উপর লাফাইয়া পড়িলেন, আর তৎক্ষণাৎ প্রভুভক্ত কোসার মাল্লাগণ প্রাণপণে দাঁড় টানিয়া এই নৌকাকে অপর সমস্ত পলাতক নৌকার আগে পৌঁছাইয়া দিয়া বায়ুবেগে চলিতে লাগিল। যুবরাজের সম্পত্তি-ভরা ‘মহলগিরি’ লুট করিবার লোভ কেহই সম্বরণ করিতে পারিল না, মুঘল কোসা সেখানেই থামিয়া গেল। উদয় বাঁচিলেন। 

মির্জা নথন্ দুঃখে নিজ হাত চাপড়াইতে চাপড়াইতে পাড় বহিয়া আরও কিছু দূর ছুটিলেন, কিন্তু সঙ্গে তাঁহার কোসা নাই, কোনই ফল হইল না। 

যশোহরের নৌ-বলের মধ্যে ৪২ খানি নৌকামাত্র পলাইয়া গেল, অপর সবগুলি (তোপ সহ) ধরা পড়িল। 

উদয়ের পরাজয় দেখিয়া জমাল খাঁ হাতীগুলি সঙ্গে লইয়া দুর্গ হইতে পলাইয়া গেল। মির্জা নথন্ পরিখা পার হইয়া দুর্গে ঢুকিয়া বিজয়ের ভেরী বাজাইলেন। মুঘলগণ সেখানেই রাত কাটাইল। 

৬. মুঘলদের কার্যকলাপ 

যুদ্ধের পরদনি ইনাএৎ খাঁ কুচ করিয়া বুঢ়ন[৬] দুর্গে পৌঁছাইয়া থামিলেন। মির্জা নথ রণশ্রমের জন্য নৌকায়ই শুইয়া রহিলেন। এই অবসরে তাঁহার স্থলসৈন্যগণ বুঢ়নে গিয়া পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি আক্রমণ করিয়া সেখান হইতে চারি হাজার কৃষক-স্ত্রী ধরিয়া আনিয়া তাহাদের দাসী করিল। 

মির্জা সেখানে পৌঁছিয়া এ কথা জানিতে পারিয়া এই হতভাগিনীদিগকে নিজ সেনানিবাস হইতে খুঁজিয়া বাহির করিয়া মুক্তি দিলেন, এবং যথাসাধ্য অর্থ ও বস্ত্রের সাহায্য করিয়া নিজ নিজ গ্রামে পাঠাইয়া দিলেন। 

ইতিমধ্যে সৈয়দ হকিম কন্দর্পপুত্র রামচন্দ্র[৭] রাজার দেশ বগ্‌লা আক্রমণ করিয়াছিল। তাঁহার সীমান্তের দুর্গ মুঘলেরা জয় করিয়া যখন দেশমধ্যে প্রবেশ করিল, তখন রাজমাতা পুত্রকে বলিলেন, ‘যদি তুই সন্ধি না করিস, আমি বিষ খাইয়া মরিব।’ তখন রামচন্দ্র মুঘল সেনানীর সহিত দেখা করিয়া বশ্যতা স্বীকার করিলেন। ইস্লাম খাঁ এই জয়সংবাদ পাইয়া রামচন্দ্রকে ঢাকা লইয়া গিয়া নজরবন্দ করিয়া রাখিলেন এবং সৈয়দ হকিয়কে হুকুম দিলেন যে, দক্ষিণ হইতে যশোহর আক্রমণ করিয়া ইনাএৎ খাঁর সাহায্য করুক। শত্রুজিৎ[৮] রামচন্দ্রকে ঢাকা পৌঁছাইয়া দিয়া ফিরিয়া আসিয়া যশোহর-অভিযানে যোগ দিলেন 

৭. দ্বিতীয় যুদ্ধ 

জ্যেষ্ঠপুত্রের পরাজয়ে এবং দুই দিক হইতে দুই মুঘল সৈন্য কর্তৃক নিজদেশ আক্রমণের সংবাদ পাইয়া প্রতাপাদিত্য মহা বিপদে পড়িলেন। তাঁহার নৌ-বল অর্ধেকের অধিক নষ্ট হইয়াছে। তিনি ঠিক করিলেন যে, মুঘল সেনানীকে মিথ্যা সন্ধির কথাবার্তায় ভুলাইয়া কিছু সময় লাভ করিয়া যশোহর হইতে দূরে একটি নূতন দুর্গ নির্মাণ করিয়া সেখানে আশ্রয় লইবেন। যশোহরের নদী হইতে একটি খাল দিয়া বাহির হইয়া তিনি বুঢ়নে পৌঁছিলেন এবং মির্জা নথনের কাছে দূত পাঠাইয়া জানাইলেন, ‘আপনর পিতা (ইমাম খাঁ) আমাকে পুত্র বলিয়া সম্বোধন করিতেন; আপনি আমার ভাই। অতএব আমার মধ্যস্থ হইয়া আমাকে ইনাএৎ খাঁর নিকট লইয়া যান।’ এই সংবাদ পাইয়া ইনাএৎ খাঁ ডিনজ দূত পাঠাইয়া উত্তর দিলেন, ‘যদি তোমার সত্য সত্যই এইরূপ মনের ইচ্ছা হয়, তবে কল্যই আসিয়া আমার সহিত দেখা কর। নচেৎ পরশু দিন আমি কুচ আরম্ভ করিয়া যশোহরে যাইব এবং তোমার অতিথি হইব। সেখানে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইবে। 

পরদিন খাঁর দূত ফিরিয়া আসিয়া জানাইল যে, প্রতাপের কথা মিথ্যা ও তাঁহার অভিসন্ধি কপটতা মাত্র। অতএব তৃতীয় দিবসে মুঘল সৈন্য অগ্রসর হইল এবং তাহার তিন দিন পরে খরাওঘাট পৌঁছিল। 

প্রতাপের দুর্গের এক পাশ দিয়া কাগরঘাটা[৯] খাল এবং অপর পাশ দিয়া ভাগীরথী নদী বহিতেছিল। নদীতে তাঁহার অসংখ্য নৌকা; দুর্গমধ্যে হাতী, পদাতিক সৈন্য ও বড় বড় তোপ। এই সুদৃঢ় স্থানে আশ্রয় লইয়া তিনি শত্রুর অপেক্ষা করিতেছিলেন। 

ইনাএৎ খাঁ নদীর পাড়ে রহিলেন, আর মির্জা নথন্ রাত্রে ঝড় বৃষ্টি ও শিলাপতন অগ্রাহ্য করিয়া নদী পার হইয়া দক্ষিণ কূলে পৌঁছিলেন। পরদিন প্রাতে দুই দল শত্রু দুর্গের দিকে অগ্রসর হইল, মধ্যে বাদশাহী নওয়ারা চলিতে লাগিল। ভাগীরথীর যে শাখা যশোহরের পাশ দিয়া যায় তাহার মোহানায় প্রতাপের নৌ-বল খাড়া ছিল, তাহারা বাদশাহী নওয়ারা এবং ডাঙ্গার সৈন্যদলের গোলাগুলি সহ্য করিতে না পারিয়া দুর্গের পাশে গিয়া আশ্রয় লইল। বাদশাহী নওয়ারা মোহানা পর্যন্ত পৌঁছিয়া আর আগাইতে পারিল না, কারণ দুর্গ হইতে অজস্র অগ্নিবর্ষণ হইতেছিল। বাম দিকে, নদী সম্মুখে পড়ায় ইনায়েৎ খাঁ আর অগ্রসর হইতে পারিলেন না; কিন্তু মির্জা নথ, লক্ষ্মী রাজপুত এবং অন্যান্য সেনানী দক্ষিণ পাড় বহিয়া কাগরঘাটার খালের ধার পর্যন্ত পৌঁছিয়া ঘোর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। সঙ্গে শুধু ৪০ জন অশ্বারোহী এং দশটি হাতী। দুর্গ হইতে গোলাবর্ষণ হইতে লাগিল, অনেক মুঘল সৈন্য মরিল। কিন্তু মির্জা নথন্ জনকতক অতি সাহসী ও ভক্ত অনুচর সহ হাতীকে খালের মধ্যে নামাইয়া দিলেন। দুর্গরক্ষকগণ তাঁহার দিকে কামান ফিরাইল, আর সেই অবসরে, মির্জা সহনের (Sic, নথ হইবে–শি মি) পূৰ্ব্ব আদেশ মত, বাদশাহী নওয়ারাও অবাধে বা অল্প বাধায় জোর করিয়া মোহানা পার হইয়া নদীতে ঢুকিল এবং দুর্গের নওয়ারা ও বাদশাহী নৌকাগুলির কাছে পরাস্ত হইল, এবং মির্জা নথও খাল পার হইয়া শক্ত জমিতে পৌঁছিয়া হাতী ছুটাইয়া দুর্গদ্বারের দিকে গেলেন। বাদশাহী নৌ-বলের মধ্যভাগও সেখানে আসিয়া পৌঁছিল। মহাযুদ্ধ চলিল; হতাহতে স্তূপ গঠিত হইতে লাগিল। 

অবশেষে প্রতাপ রণভঙ্গ দিয়া পলাইলেন। মির্জা নথন্ দুর্গ জয় করিয়া নাকাড়া ও ভেরী বাজাইলেন। 

৮. প্রতাপাদিত্যের শেষ দশা 

যশোহরে পৌঁছিয়া পরাজিত পিতাপুত্র মিলিত হইলেন। দুঃসময় বুঝিয়া জমাল খাঁ প্রতাপকে ছাড়িয়া কাগরঘাটায় মুঘলদলে যোগ দিলেন; এদিকে বগ্‌লা হইতে অপর মুঘল সৈন্যদলও কাছে আসিয়া পৌঁছিল। তখন প্রতাপ আত্মসমর্পণ করাই স্থির করিলেন, নচেৎ বৃথা সৈন্যবধ হইবে এবং সমস্ত রাজ্য লুট, হত্যা এবং অত্যাচারে ছারখার হইবে। 

যেদিন বাদশাহী সৈন্য কাগরঘাটায় প্রথম শিবির করিল, প্রতাপ একা একখানি কোসায় চড়িয়া তথায় পৌঁছিলেন, সঙ্গে দুই জন মন্ত্রী। তিনি বিনীতভাবে ইনাএৎ খাঁর তাম্বুর বাহিরে দাঁড়াইয়া সাক্ষাৎ প্রার্থনা করিলেন। খাঁ তাঁহাকে মান্য করিয়া ভিতরে লইয়া গেলেন এবং যথাসম্ভব ভদ্রতা করিলেন। 

স্থির হইল যে, বাদশাহী সৈন্য কাগরঘাটায় থাকিবে, এবং ইনাএৎ প্রতাপকে ঢাকায় সুবাদারের নিকট লইয়া যাইবেন, পরে তাঁহার যেরূপ আজ্ঞা তাহাই করা যাইবে। চতুর্থ দিবসে ৪০ খানা নৌকা লইয়া ইনাএৎ ও প্রতাপ ঢাকা রওনা হইলেন। মুঘল সেনাপতিগণ কাগরঘাটায় সুন্দর সুন্দর কাঁচা ঘর (বাঙ্গলা) নির্ম্মাণ করিয়া কয়েক মাস বাস করিতে লাগিল। এক-একখানার খরচ দেড় হাজার টাকা। বাঙ্কুড়া[১০] গ্রামে প্রতাপের ব্রাহ্মণ কটকী (দূত) বা মন্ত্রগুরুর অতি মনোরম বাঙ্গলা ছিল। 

ইসলাম খাঁ প্রতাপকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়া রাখিলেন এবং যশোহর প্রদেশ বাদশাহী রাজ্যভুক্ত করিয়া লইলেন। ইনাএৎ খাঁ ইহার প্রথম শাসনকর্তা হইলেন, এবং বাদশাহী দেওয়ান পাঠাইয়া অনুসন্ধান করা হইল যে, প্রজাদের কষ্ট না দিয়া যশোহর হইতে কত খাজনা আদায় করা যাইতে পারে। 

[প্রতাপকে কি লোহার খাঁচায় বন্ধ করিয়া রাখা হইয়াছিল? অসম্ভব নয়, কারণ ঠিক এই সময় ঢাকা দুর্গের দুইজন বন্দী পাঠান জমিদার রক্ষীকে ধুতুরামিশ্রিত রুটি ও হালুয়া খাওয়াইয়া অজ্ঞান করিয়া, কারাদ্বার খুলিয়া রাত্রে বাহির হইয়া, নদীতে প্রস্তুত নৌকায় চড়িয়া পলাইয়া যায়। তাহার পর ইস্লাম খাঁ নিশ্চয়ই কারাগারের বন্ধন কঠিনতর করেন। 

এইসব ঘটনার চারি বৎসর পরে ইস্লাম খাঁর পুত্র হুশঙ্গ পরাজিত আগান (উমান খাঁ), বঙ্গীয় জমিদারগণ ও মগরাজা হইতে গৃহীত মূল্যবান লুটের সামগ্রী, হাতী এবং কয়েকজন মগ সঙ্গে লইয়া আগ্রা গিয়া (১৬১৩ মার্চ মাসে) পিতার এইসব বিজয় উপঢৌকন বাদশাহ জাহাঙ্গীরের সম্মুখে স্থাপন করেন। প্রতাপ তাহাদের মধ্যে ছিলেন না (ইকবলনামা, ৬৯ পৃ)। সুতরাং তিনি আগ্রার সাথে বন্দী দশায় কাশীতে পৌঁছিয়া যে মারা যান, এ প্রবাদ সত্য হইতেও পারে। বাঙ্গলায় তাঁহার স্থান ছিল না।[১১] 

৯. প্রতাপাদিত্য কি হত্যাকারী? 

জেসুইট্ পাদ্রীগণের বিবরণ অবলম্বনে লিখিত দ্যু জারিকের ইতিহাসে লেখা আছে যে, ফিরিঙ্গী নৌ-সেনাপতি ডোমিঙ্গো কার্ভালোকে চণ্ডিকানের রাজা বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া হত্যা করেন। বেজি সাহেব তাঁহার বাখরগঞ্জ গ্রন্থে বলেন যে, এই রাজা প্রতাপাদিত্য। কিন্তু বহারিস্তানের পুঁথির ১৬৮ খ পৃষ্ঠা স্পষ্টই প্রমাণ করিতেছে যে, এই অপবাদ মিথ্যা। ওই স্থলে লেখা আছে যে, ইস্‌লাম খাঁ প্রতাপকে ঢাকায় বন্দী করার অনেক পরে কাসিম খাঁর সুবাদারির প্রায় শেষাংশে মুঘলেরা যখন চাটগাঁয়ের মগরাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিতে ভালুয়া হইতে অগ্রসর হয়, তখন ওই মগরাজা সমস্ত ফিরিঙ্গীদিগকে বন্দী ও হত করিতে চেষ্টা করেন, এবং কাপ্তান ডোর-ম-শ কার্ভালোর অধীনে ফিরিঙ্গীগণ মগপক্ষ ত্যাগ করিয়া মুঘলদের সঙ্গে যোগ দেয়। ডোরমশ শব্দকে[১২] ডো-আমোশ পড়া যাইতে পারে, ইহা কি ডোমিঙ্গো (Portuguese, Domingos) শব্দের ফার্সী অপভ্রংশ? 

১০. উদয়াদিত্যের কথা 

যখন ইনাএৎ খাঁ পরাজিত প্রতাপকে সঙ্গে লইয়া ঢাকা চলিলেন এবং মুঘল সৈন্য কাগরঘাটায় ছাউনী করিয়া রহিল, সেই সময় উদয়াদিত্যের দূতগণ সন্ধি করিবার জন্য মির্জা নথনের নিকট যাতায়াত করিত। একদিন মির্জা নথন্ তাহাদিগকে বলিলেন, তোমরা মির্জা মকীকে থলিয়া থলিয়া টাকা মোহর এবং রত্ন ও বহুমূল্য দ্রব্য উপহার দিতেছ, আর আমাকে আম ও কাঁঠালের ডালি দিয়াও পুছ না! আমি কি কেহ নই? তোমাদের দেখাইতেছি আমি কে। সেই দিনই দুপুর রাতে মির্জা সহ [Sic, নথন্ হইবে—শি মি] নিজ সৈন্য লইয়া বাহির হইলেন এবং আশপাশের গ্রামগুলিতে এরূপ লুট ও স্ত্রীলোকদের উপর অত্যাচার করিলেন যে যশোহর আক্রমণের প্রথম হইতে এ পর্যন্ত ইহার সমান কিছুই হয় নাই। (বহারিস্তান, ৫৭ ক।)

সম্ভবতঃ, এই ভীষণ অত্যাচারের ফলে উদয়াদিত্য নিজের ও প্রজাদিগের প্রাণ ও মান বাঁচাইবার জন্য আবার অস্ত্র ধরিয়াছিলেন। 

শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র মিত্র লিখিতেছেন, ‘তৃতীয় দিবসে ইনাএৎ কুচ আরম্ভ করেন। পথে তাঁহাকে কুশলীক্ষেত্রের মধ্যে দিয়া যাইতে হয়। [প্রতাপের রাজধানী-দুর্গ হইতে ৮/১০ মাইল উত্তরে এবং যমুনা নদীর পূর্ব্ব দিকে কুশলীক্ষেত্র।] এ দেশে প্রবাদ আছে যে এই কুশলীক্ষেত্রে মুঘল সৈন্যের সহিত প্রতাপ-পক্ষীয় যোদ্ধাদিগের কয়েকদিবসব্যাপী ভীষণ যুদ্ধ হইয়াছিল এবং সেই যুদ্ধে উদয়াদিত্য কুশলীক্ষেত্রে প্রাণত্যাগ করেন। রাজবংশীয় কেহ কেহ উক্ত কুশলীক্ষেত্রে উদয়াদিত্যের নামে একটি স্মারকস্তম্ভ নির্মাণ করিবার জন্য একান্ত ইচ্ছুক আছেন।’ 

.

পাদটীকা : 

১. [বহারিস্তানের প্রথম পাঠোদ্ধারান্তে অধ্যাপক স্যর যদুনাথ সরকার প্রথম এই প্রবন্ধ ‘প্রবাসী’, ১৩২৭ কাৰ্ত্তিক সংখ্যায় প্রকাশ করেন। নূতন পাঠোদ্ধারান্তে উক্ত প্রবন্ধ সংশোধিত করিয়া পুনরায় ‘শনিবারের চিঠি ১৩৫৫, জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় প্রকাশ করেন। স্যর যদুনাথের উপদেশানুযায়ী এবং ‘শনিবারের চিঠি’র সদয় অনুমতি লাভান্তে উক্ত সংশোধিত প্রবন্ধ এবং পরবর্ত্তী দুইটি প্রবন্ধ পরিশিষ্টে সংযোজিত হইল। —শি মি]

২ . বর্তমান কৃষ্ণনগর শহরের ২০ মাইল উত্তরে, ভৈরব নদীর তীরে বাঘোয়ান বলিয়া একটি স্থান আছে। মহদপুর কৃষ্ণনগরের ৬ মাইল উত্তরে Mohatpur। (রেনেল ১নং ম্যাপ। ) 

৩. বাঘা একটি স্নিগ্ধ সমৃদ্ধ মুসলমান কেন্দ্র ছিল। (১৩২৬ আশ্বিনের ‘প্রবাসী’ দেখুন।) 

৪. বাঘোয়ানের ১৭ মাইল পূর্বে সোলোগা নামক একটি স্থান আছে। ফার্সী পুঁথির এক স্থানে নামটা ‘সোলকপা’ পড়া যাইতে পারে; কিন্তু বিখ্যাত ‘শৈলকুপা’ এই স্থান হওয়া সম্ভব নহে। যশোহর জেলার মধ্যভাগে ‘সালকিয়া’ আছে, কিন্তু তাহা মুঘলদের পথের অনেকটা পূর্বদিকে পড়ে। 

৫. যে নৌকায় ‘মহল’ অর্থাৎ রাণীরা চড়েন। আবৃত বড় নৌকা। 

৬. ইহা ‘বুঢ়ান’ হইবে। ‘এখনও সাতক্ষীরা শহরের উত্তর-পশ্চিমাংশে যমুনা ইচ্ছামতী হইতে কপোতাক্ষী পর্যন্ত বিস্তৃত প্রকাণ্ড বুঢ়ান পরগণা।’ (সতীশ মিত্র, যশোহর-খুলনার ইতিহাস, ১ম খণ্ড, ৮৬ পৃ ও ৮৯- ৯০ পৃ—শি মি)। এই দুর্গ সাতক্ষীরা সব্‌ডিভিসনের পশ্চিম প্রান্তে ইচ্ছামতী নদীর তীরে ছিল; রেনেল ১নং ম্যাপে Burronhutty আছে, কলিকাতার ফোর্ট উইলিয়মের ৩৮ মাইল পূবে স্থিত। ইহার পূর্ব দিক দিয়া ইচ্ছামতী প্রবাহিত; নিকটে মোক্তারপুর, টাকী প্রভৃতি স্থান। এই বুঢ়ন-হাটীর একটু দক্ষিণে ইচ্ছামতী তিন চারি শাখায় বিভক্ত হইয়াছে, সুতরাং এটা যুদ্ধের পক্ষে কাজের স্থান ( strategic point )।

৭. ইনি প্রতাপাদিত্যের জামাতা, রাজধানী মাধবপাশায়। (সতীশ মিত্রের ইতিহাস, ২য় খণ্ড, ৪২ পৃ [২য় সং, 

৪৪ ও ৩২১ পৃ—শি মি])। 

৮. এই শত্রুজিৎ কি যশোহরের শত্রুজিৎ-নগরের প্রতিষ্ঠাতা? (Westland, map.) 

৯. রেনেলের ১নং ম্যাপে Cogregot এবং ২০ নং ম্যাপে Cogreeghat; যশোহর জেলার মির্জানগর হইতে ৪০ মাইল দক্ষিণে। ইহার নিকটে নদী তিন শাখায় বিভক্ত হইয়াছে; একটি দিয়া উত্তর-পূর্বে প্রতাপনগর ও গড়কমলপুর যাওয়া যায়; অপরটি দিয়া দক্ষিণ-পশ্চিম প্রতাপের রাজধানী ‘প্রাচীন দুর্গ’ ও ধুমঘাট অতি নিকট। আর, মধ্যে কদমতলীর প্রবাহ। 

১০. ‘কালীগঞ্জের নিকট, কালিন্দী নদীর পশ্চিম পারে, বাঁকড়া নামক স্থানে মৃত্তিকার নিম্নে শিবলিঙ্গ ও মন্দিরের ভগ্নাবশেষ পাওয়া গিয়াছে। বাঁকড়ার পূর্বপারে ডামরেলীর বিখ্যাত নবরত্ন মন্দির দণ্ডায়মান আছে।’ (সতীশ মিত্র, ইতিহাস, ৭০, ও ৭১ পৃ [১ম খণ্ড, ৩য় সং, ৭৫ পৃ—শি মি]। 

মির্জানগরের ৭ মাইল উত্তর-পূর্বে, কপোতাক্ষীর পশ্চিম পারে স্থিত বাঁকড়া গ্রাম (Rennell, map) এ স্থান নহে। 

১১. Baharistan, Sa, 9a and b, 49a57b. 61b. 

১২. আমার এখন ১৯৪৮ খৃষ্টাব্দে মনে হইতেছে যে, ডোরমশ শব্দটা Rodrigues শব্দের ভুল। এই প্রবন্ধে ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’-রচয়িতা অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মিত্র নিম্নলিখিত টীকা সংযোগ করিয়া দিয়াছেন :

(১) রামরাম বসুর ‘প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ (১৮০১ খৃঃ প্রকাশিত) অনেক স্থলে বহারিস্তানের বৃত্তান্তের অনুগামী; যথা, “কতক কাল পরে [মান] সিংহ রাজা পুনরায় হেন্দোস্থানে গতি করিলে–আপনে ওজির এছলাম খাঁ চিস্তি প্রতাপাদিত্যের বিপরীতে বাঙ্গলায় সাজনি করিয়া হেন্দোস্থানের তিন হিসা ফৌজ সাথে লইয়া থানাবথানা মারিপিট করিয়া সর-বসর আসিয়া সালিখার থানায় পৌঁছিলে রাজার (অর্থাৎ প্রতাপের) প্রধান সেনাপতি কমল খোজা মুহমেল দিয়া সাত দিন পর্য্যন্ত অনাহারে দিবারাত্রি লড়াই করিতেছিল। ইতিমধ্যে একদিন কমল খোজার মরণের খবর পৌঁছিয়াছে, ইহাতে রাজা ব্যস্ত ছিলেন।***” “এককালিন সসৈন্য যাইয়া ওজির (অর্থাৎ ইসলাম খাঁর) সহিত দেখা করিলে ওজির তাহাকে সম্মান করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘এখন কি তোমার কৰ্ত্তব্য, লড়াই কি কয়েদ?’ রাজা কহিলেন, ‘না আমরা আর লড়াই করিব না। আমার আসন্নকাল এই। অতএব আমি কয়েদ হইব।’ এই মত তাহাকে পিঞ্জিরায় কয়েদ করিয়া” ইত্যাদি।

(২) ইনাএৎপুর–বর্তমান যশোহর শহর হইতে ৫/৬ মাইল দূরে এই নামের একটি ক্ষুদ্র গ্রাম আছে। উহা নদীর নিকট নহে এবং তথায় মুঘল সৈন্যের যাইবার কোন কারণ পাওয়া যায় না। সুতরাং উহা সেনাপতি ইনাএৎ খাঁর নামানুসারে হইতে পারে না। কাকশিয়ালী খালের দক্ষিণে এবং প্রতাপের দুর্গের ৯ মাইল উত্তরে অপর এক ইনাএৎপুর আছে। 

(৩) পীতাম্বর— পুঁটিয়া রাজবংশের আদিপুরুষ। ভাতুড়িয়ার অধিকাংশ তাঁহার হস্তগত ছিল।

(৪) বাঘাগ্রাম— এই বাঘাগ্রাম বাঘোয়ানের সন্নিকটে নহে। হুগলী জেলায় ত্রিবেণীর অপর পারে যমুনার মোহানায় একটি দ্বীপ ছিল, উহা এক্ষণে একটি গ্রাম হইয়াছে, এই গ্রামকে বাঘার গ্রাম বা বাঘের গ্রাম বলে। ‘নদীয়া-কাহিনী’ ৩৫১ পৃ দেখুন। প্রকৃতপক্ষে এই স্থানই যশোহরের সীমান্ত এবং প্রতাপাদিত্যের রাজ্যে প্রবেশ করিতে হইলে গঙ্গা হইতে তাহার পথও এই বাঘার পার্শ্ব দিয়া। সুতরাং ইনাএৎ খাঁর সৈন্যদল যে এইরূপ স্থলে পথের মুখে থানা স্থাপন করিবে, তাহাতে বিচিত্র কি? 

[কিন্তু আবদুল লতীফের ভ্রমণ-কাহিনীতে যে বাঘার বর্ণনা আছে তাহা এই হুগলী জেলার কাঁচড়াপাড়ার নিকটবর্তী বাঘের গ্রাম হইতে পারে না।—যদুনাথ সরকার।] 

(৫) সাল্‌কা-সাকার স্থান নির্দেশ করা কঠিন। প্রতাপাদিত্যের অধস্তন রাজবংশীয়দিগের বংশগত প্রবাদ হইতে জানা যায়, সালখিয়া নামক স্থানে প্রতাপের একটি দুর্গ ছিল। রাজা যতীন্দ্রমোহন রায় বলেন, কলিকাতার অপর পারে হাওড়ায় যে সালখিয়া আছে, সেখানেই প্রতাপের দুর্গ ছিল। অর্থাৎ শত্রু যমুনার মোহানা হইতে দক্ষিণ দিকে আসিলে, প্রথমে জগদ্দল দুর্গ, পরে সালখিয়া দুর্গে তাহাদিগকে বাধা দিত। প্রাচীন ম্যাপে সালখিয়া ( Salica বা Salkhia) খুব বড় করিয়া লেখা আছে। কিন্তু মোগল সৈন্য উক্ত সালখিয়ার দিকে গিয়াছিল কি না সন্দেহ হয়। 

ইচ্ছামতী-কালিন্দীর মোহানায় দমদমার নিকট শালিখা দুর্গ ছিল, ইহাই আমার নিকট বিশেষ বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া মনে হয়। যুদ্ধের বর্ণনা হইতেও তাহাই অনুমিত হয়। 

(৬) খরাওন ঘাট—যশোহর দুর্গের উত্তর-পূর্ব কোণে ইচ্ছামতীর কূলে কোন তাৎকালিক ঘাটের নাম ‘খরাওন ঘাট’ হইতে পারে; এখন তাহার কোন চিহ্ন বা সে নামে কোন গ্রাম নাই। 

(৭) কাগরঘাটা-পুরাতন যশোহর নগরীর পূর্বদিকে ইচ্ছামতী নদীর পরপারে খাগড়াঘাট বলিয়া একটি স্থান আছে। সম্ভবতঃ ঐখানে আসিয়া মোগল সৈন্য নদী পার হইয়া পূর্ব দিক হইতে দুর্গ আক্রমণ করিয়াছিল। এই খাগড়াঘাটকেই রেনেল সাহেব Cogregot করিয়াছেন। পুরাতন যশোহর দুর্গের পশ্চিমদিকে যমুনাকূলে কুকড়াঘাটা আছে বটে, কিন্তু আমার মনে হয় এটি যুদ্ধের স্থান নহে। 

(৮) ভাগীরথী—এখানে যশোহর দুর্গের পশ্চিমবাহিনী যমুনা নদীকেই ভাগীরথী বলা হইয়াছে কারণ উহা ভাগীরথীরই একাংশ। যশোহরের সন্নিকটে যমুনাও তীর্থনদীর মত ব্যবহৃত হয়। 

(৯) বাঙ্কুড়া বা বাঁকড়া একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম। উহা অনেক দূরে অর্থাৎ কালিন্দী নদীর পশ্চিম পারে অবস্থিত। উহার উত্তরে বাঙ্গালপাড়া নামক একটি স্থান আছে, সেখানে অনেক বাঙ্গলা গৃহ প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে। হয়তঃ মোগল সৈন্য সেইস্থানে শিবির সন্নিবেশ করিয়া বহুদিন বাস করিয়াছিল। 

প্রতাপাদিত্য কটক হইতে গোবিন্দদেব বিগ্রহ আনিয়া যমুনাকূলে গোপালপুরের মন্দিরে স্থাপিত করেন। ওই বিগ্রহের সেবার জন্য তিনি কটকী ব্রাহ্মণ আনিয়াছিলেন। তাঁহারা দুধলীর উত্তরাংশে রায়পুর বাস করিতেছেন। উঁহাদের নিকট চাঁদরায়ের প্রদত্ত ১৬১০ খৃষ্টাব্দের একটি সনন্দ আছে। 

জয়পুর রাজ্যের আম্বের দুর্গে মানসিংহ বাঙ্গলা হইতে যে দেবীমূর্তি লইয়া গিয়া স্থাপন করেন তাঁহার নাম ‘শিলাদেবী’—এটি ‘যশোরেশ্বরী কালী’ নহে। 

শ্রীযদুনাথ সরকার 

সকল অধ্যায়

১. ১. উপক্রমণিকা
২. ২. পাঠান রাজত্বের শেষ
৩. ৩. বঙ্গে বারভুঞা
৪. ৪. প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের উপাদান
৫. ৫. পিতৃ-পরিচয়
৬. ৬. পাঠান রাজত্বের পরিণাম ও যশোর-রাজ্যের অভ্যুদয়
৭. ৭. যশোর-রাজ্য
৮. ৮. বসন্ত রায়
৯. ৯. যশোহর-সমাজ
১০. ১০. গোবিন্দদাস
১১. ১১. বংশ-কথা
১২. ১২. প্রতাপাদিত্যের বাল্যজীবন
১৩. ১৩. আগ্রার রাজনীতি ক্ষেত্ৰ
১৪. ১৪. প্রতাপের রাজ্যলাভ
১৫. ১৫. যশোরেশ্বরী
১৬. ১৬. প্রতাপাদিত্যের রাজধানী
১৭. ১৭. প্রতাপের আয়োজন
১৮. ১৮. মগ ও ফিরিঙ্গি
১৯. ১৯. প্রতাপের দুর্গ-সংস্থান
২০. ২০. নৌ-বাহিনীর ব্যবস্থা
২১. ২১. লোক-নির্বাচন
২২. ২২. সৈন্যগঠন
২৩. ২৩. প্রতাপের রাজত্ব
২৪. ২৪. উড়িষ্যাভিযান ও বিগ্ৰহ-প্ৰতিষ্ঠা
২৫. ২৫. বসন্ত রায়ের হত্যা
২৬. ২৬. সন্ধি-বিগ্রহ
২৭. ২৭. খৃষ্টান পাদরীগণ
২৮. ২৮. কার্ভালো ও পাদ্রীগণের পরিণাম
২৯. ২৯. রামচন্দ্রের বিবাহ
৩০. ৩০. প্রথম মোগল-সংঘর্ষ : মানসিংহ
৩১. ৩১. মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ ও সন্ধি
৩২. ৩২. দ্বিতীয় মোগল-সংঘর্ষ : ইসলাম খাঁ
৩৩. ৩৩. শেষ যুদ্ধ ও পতন
৩৪. ৩৪. প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৩৫. ৩৫. যশোহর-রাজবংশ
৩৬. ৩৬. যশোহরের ফৌজদারগণ
৩৭. ৩৭. নলডাঙ্গা রাজবংশ
৩৮. ৩৮. চাঁচড়া রাজবংশ
৩৯. ৩৯. সৈয়দপুর জমিদারী
৪০. ৪০. রাজা সীতারাম রায়
৪১. ৪১. সীতারাম : বাল্যজীবন ও জমিদারী
৪২. ৪২. সীতারাম : রাজ্য ও রাজধানী
৪৩. ৪৩. সীতারাম : রাজত্ব ও ধৰ্ম্মপ্রাণতা
৪৪. ৪৪. সীতারাম : মোগল সংঘর্ষ ও পতন
৪৫. ৪৫. সীতারাম : বংশ, রাজ্য ও কীর্ত্তির পরিণাম
৪৬. ৪৬. সীতারাম সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৪৭. ৪৭. প্রাক্-ইংরাজ আমলে রাজন্য-বংশ
৪৮. ১. বৃটিশ-শাসন ও হেঙ্কেলের কীৰ্ত্তি
৪৯. ২. যশোহর-খুলনা : গঠন ও বিস্তৃতি
৫০. ৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
৫১. ৪. ভূসম্পত্তির স্বত্ব-বিভাগ
৫২. ৫. নড়াইল জমিদার-বংশ
৫৩. ৬. নব্য জমিদারগণ
৫৪. ৭. বাণিজ্য-তুলা, চিনি ও নীল
৫৫. ৮. নীলের চাষ ও নীল-বিদ্রোহ
৫৬. ৯. রেণী ও মরেল-কাহিনী
৫৭. ১০. সমাজ ও আভিজাত্য
৫৮. ১১. শিল্প ও স্থাপত্য
৫৯. ১২. সাহিত্য
৬০. এক – প্রতাপাদিত্যের পতন
৬১. দুই – প্রতাপাদিত্যের সভায় খ্রীষ্টান পাদরী
৬২. তিন – প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে কিছু নূতন সংবাদ
৬৩. সতীশচন্দ্র মিত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন