সতীশচন্দ্র মিত্র
নদীধারা যেরূপ ক্রমশঃ বিস্তৃতি লাভ করিয়া সমুদ্রগামী হয়, আমাদের আলোচ্য ইতিহাসের ধারাও তেমনি ভারতেতিহাসের অঙ্গীভূত হইতে চলিয়াছে। অতি প্রাচীনকালে এতদঞ্চল সমুদ্রগর্ভে ছিল; হিন্দু-বৌদ্ধযুগে নবোত্থিত ভূভাগে যাহা কিছু কীৰ্ত্তি-কাহিনী জাগিয়াছিল, সুন্দরবনের সাধারণ প্রকৃতিবশে, উত্থান- পতনের বিচিত্র নিয়মে, তাহার অধিকাংশ বিলুপ্ত হইয়াছিল এবং ঐতিহাসিকের অধ্যবসায় শুধু বিফলতায় পরিণত করিতেছিল। এমন সময়ে পাঠান জাতি আসিল; মুসলমানের ধর্ম্মমন্ত্র প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যজয় চলিল; সে রাজশক্তির পতাকা ধরিয়া হিন্দুরা আবার আসিয়া কিরূপে এই প্রদেশে উপনিবেশ স্থাপন করিল, তাহা আমার পূর্ব্বখণ্ডে দেখাইয়াছি। হিন্দুদিগের সাধারণ জাতীয় প্রকৃতিই এই যে, যতক্ষণ তাহাদের ধর্ম্ম বা গার্হস্থ্যজীবন অক্ষুণ্ণ থাকে, ততক্ষণ তাহারা রাজশক্তি বিশেষ বিচার করে না; যতক্ষণ কেহ ধৰ্ম্ম বা সমাজে হাত না দেয়, ততক্ষণ তাহারা কাহারও বিরুদ্ধাচরণ করে না। ইসলাম মন্ত্র প্রচারের জন্য যাঁহারা প্রথম এদেশে আসিয়াছিলেন, তাহারা বাস্তবিকই সাধু, পীর পয়গম্বর বা আউলিয়া, ত্যাগী সন্ন্যাসী বা ফকির। ধর্ম্মের যথার্থ প্রকৃতি দেখিলে, চরিত্র-মাধুর্য্য দেখিলে, হিন্দুরা যেমন গলিয়া গিয়াছে, “দু’বাহু পসারিয়া” জাতিধর্ম-নির্বিশেষে সকল জাতিকে প্রীতির পুষ্পে পূজা করিয়াছে, এমন বুঝি কোন জাতি করে না। আমরা আজিও যেমন গ্রামে গ্রামে সরসীকূলে বা বৃক্ষতলে অসংখ্য পীরদরবেশের পূজা করিয়া থাকি, এমন কি অত্যাচারী প্রচারকের উদ্দেশেও সির্ণী মানসা করিয়া থাকি, এমন কোন্ জাতি করিয়াছে? বিশেষতঃ ঐ সকল সাধুর ধর্ম প্রচারের জন্য একাগ্র সাধনা যতই থাকুক, জাতিনিৰ্ব্বিশেষে তাঁহাদের একটা পরহিতরতি ছিল; দানধর্ম্মে বা জনহিতকর নানাকর্মে তাঁহারা অর্থের সদ্ব্যবহার করিতেন বলিয়া হৃদয়গুণে সকলের বরণীয় হইতেন। তাঁহারা যে কোনও সময়ে হিন্দুর ধর্ম্মে বা সমাজের মর্ম্মে আঘাত করিতেন না, তাহা নহে; কোন্ বিজিগীষু পরজাতিই বা সে বিষয়ে সুযোগ পরিত্যাগ করিয়া থাকেন? কিন্তু মুসলমান প্রচারকের বেলায় ত্যাগীর আচরণ, ফকিরের বেশ এবং দাতার মূর্ত্তি দেখিয়া লোকে সকল কথা ভুলিত এবং ফকিরের পশ্চাতে রাজশক্তির সহায়তার পরিচয় পাইয়া সকলে নত হইয়া থাকিত। পীরের জীবদ্দশায় হয়ত কোন বাদ প্রতিবাদ বা বিসম্বাদের সম্ভাবনা হইত; কিন্তু তাঁহার তিরোভাবের পর দোষের লেশমাত্রও বিলুপ্ত বা বিস্মৃত হইয়া যাইত; তখন সাধুর সাধুত্বটুকু জাগিয়া উঠিয়া লোকসমাজে তাঁহার কর্ম্ম বা সমাধি- ক্ষেত্রকে পবিত্র করিয়া রাখিত। এখনও তাঁহাদের স্মৃতি এবং সাধুত্বের কাহিনীটুকু জাগ্রত রহিয়াছে। হিন্দু-মুসলমানে ভ্রাতায় ভ্রাতায় বিবাদ হইতে পারে, কিন্তু পীর-পয়গম্বরের সহিত বিবাদ নাই; মুসলমান পীরের আস্তানায় সির্ণী মানিয়া হিন্দুরা মুসলমানের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা করিতেছে। মুসলমানের মসজিদে পাদুকা লইয়া প্রবেশ করিতে শুধু সেবাইত বা রক্ষকের তিরস্কারের ভয় আছে, তাহা নহে; ধর্মপ্রাণ হিন্দুর তাহাতে একটা প্রাণের ভয় উপস্থিত হয়। রোগ বা বিপত্তি উপস্থিত হইলে, মুসলমানও প্রাণের ভয়ে দেবীর মন্দিরে পূজা মানসিক করিয়া থাকেন। এখনও মাতা যশোরেশ্বরীর মন্দিরে প্রায় এক-চতুর্থাংশ পূজা মুসলমানের নিকট হইতে পাওয়া যায়।
এইভাবে পাঠান আমলে কত কাল ধরিয়া হিন্দু-মুসলমান কলহ মিটিয়া সম্প্রীতি সংস্থাপিত হইয়াছিল। নূতন আবাদ করা নূতন রাজ্যে হিন্দু ও পাঠান এই দুই জাতি সম্প্রীতির সহিত বসতি করিয়াছিল। এই ভাবে পঞ্চদশ শতাব্দী অতিবাহিত হইল। ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে দেখা গেল, হুসেন শাহ গৌড়ের বাদশাহ। সমগ্র বঙ্গে সে এক সুবর্ণযুগ; শুধু যে গৌড়ের লোকে তখন স্বর্ণপাত্রে পানভোজন করিত, তাহা নহে; সমগ্র বঙ্গের লোক তখন সমৃদ্ধি শান্তির মুখ দেখিয়াছিল; প্রজাবর্গ সুখে বাস করিত। সে সুখের অনুভূতি তখন যত হউক না হউক, যখন সুলতান হুসেন শাহের মৃত্যুর পর রাজ্যমধ্যে নানা বিপর্য্যয় ও অশান্তি আরব্ধ হইয়াছিল, তখন লোকের পূর্ব্বস্মৃতি জাগিত এবং ‘সে হুসেন শাহের আমল আর নাই’ বলিয়া সকলে দুঃখ-প্রকাশ করিত।
কয়েকটি ঘটনায় হুসেনী যুগ বিখ্যাত করিয়া রাখিয়াছে। তিনি জাতিধর্ম নির্বিশেষে গুণের মর্য্যাদা রাখিতেন, শিল্পসাহিত্যের উৎসাহ দিতেন; বিশেষতঃ তখন মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে যে নবীন ধৰ্ম্মজীবন জাগিয়াছিল, দেশময় এক তীব্র আন্দোলন উঠিয়াছিল, ভক্তির ধারায় ধর্ম্মের ঔদাসীন্য ও জীবনের শুষ্কতা বিলীন হইয়া যাইতেছিল, হুসেন শাহ প্রকৃতপক্ষে সে স্রোতের বিপক্ষে দণ্ডায়মান হন নাই। সে স্রোতে তাঁহার প্রধান অমাত্য ও প্রবীণ কৰ্ম্মসচিব রূপ- সনাতনকে ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছিল, আরও কত লোককে যে বৈষয়িকতাকে বিষবৎ পরিত্যাগ করাইয়া ঘরের বাহির করিয়াছিল, তাহার ইয়ত্তা নাই। হুসেন শাহ প্রথম প্রথম স্রোতের গতি না বুঝিয়া বাধা দিবার উপক্রম করিলেও, অবশেষে তাহাতে নিবৃত্ত হইয়া নূতন বন্যার দর্শকমাত্র হইয়াছিলেন; তবে তাঁহার সুশাসনের শান্তি এবং দেশময় লোকের সুখসমৃদ্ধি যে ধর্ম্মবৃদ্ধির পরিপোষকই হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ মাত্ৰ নাই।
যশোহর-খুলনা হইতে রাজধানী গৌড় অনেক দূর। গৌড়ে কোন রাজনৈতিক কলহ উপস্থিত হইলে, এ দূরবর্ত্তী দেশের কোণে তাহার কোন সংবাদ পৌঁছিত না। এই জন্যই হুসেনের পুত্র নসরৎ পিতার জীবদ্দশায় বিদ্রোহী হইয়া এই যশোহর-খুলনার একপ্রান্তে, বর্তমান বাগেরহাট অঞ্চলে আসিয়া কিছুদিন রাজার মত বাস করিয়াছিলেন এবং এমন কি বাগেরহাট (খালিফাতাবাদ) ও মহম্মদপুর (মহম্মদাবাদ) হইতে নিজ নামে মুদ্রা প্রচলন করিয়া প্রজাশাসন করিয়াছিলেন।[১] সে সব কথা বিস্তৃতভাবে প্রথম খণ্ডে আলোচিত হইয়াছে।[২] রাজা সুশাসক বা প্রতাপশালী হইলেই হইল, তিনি হুসেন বা নসরৎ যিনিই হন, প্রজাবর্গ তাহার বিশেষ কোন ইতর-বিশেষ করিত না। মোগল বাদশাহ বাবর তুর্কীভাষায় লিখিত আত্মজীবনীতে লিখিয়া গিয়াছেন যে, বঙ্গদেশে ‘যে কেহ সিংহাসন অধিকার করিতে পারে, সেই সর্ব্বত্র রাজা বলিয়া সম্মানিত হইয়া থাকে।’[৩] বিশেষতঃ নানাগুণে হুসেন ও নসরৎ প্রজারঞ্জক হওয়ায় তাঁহাদের সময়ে শান্তি অব্যাহত ছিল। নসরৎ শাহের সময়েই কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও ছুটিখাঁর মহাভারত রচিত হয়। এ সময়ে দেশের লোকে রাজ্য বা রাজনীতির বিশেষ ধার ধারিত না, তাহারা যদি কিছু বাহিরের কথা ভাবিত, সে সেই গৌরাঙ্গদেবের নূতন ধর্মের নূতন কথা।
পাঠানদিগের প্রতি হিন্দুদের যাহা কিছু বিরক্তি বা বিদ্বেষ ছিল, তাহা ক্রমে হ্রাস পাইতেছিল। হুসেন ও নসরতের যুগে দেশের শান্তি, প্রজার ধনবৃদ্ধি, গুণের পুরস্কার ও হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সৌহৃর্দ্যের জন্য বিদ্বেষভাব একপ্রকার নিঃশেষ হইল। প্রথমতঃ, বহুকালের শাসনের ফলে রাজনৈতিক অবস্থা ও জাতিগত সামান্য পার্থক্যভাব একপ্রকার অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল। দ্বিতীয়তঃ, যুদ্ধবিদ্যা ও শরীর চালনা হিন্দুদের একপ্রকার অনভ্যস্ত হইয়া পড়িতেছিল। সুতরাং থাকিবার মধ্যে ছিল সামাজিক ও ধর্ম্ম সম্বন্ধীয় বিবাদ, চৈতন্যদেব ইহারও মীমাংসা করিয়াছিলেন।
নবদ্বীপের সন্নিকটে পীরাল্যাগ্রামের মুসলমানেরা যে ভাবে নবদ্বীপের ব্রাহ্মণদিগকে উৎসন্ন করিয়াছিলেন, তাহার প্রমাণ বৈষ্ণব-গ্রন্থে ও ঘটকের পুঁথিতে আছে।[৪] ঐ উৎপাতে কত ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিত বঙ্গদেশ ত্যাগ করিয়া চিরনির্ব্বাসিত হইতেছিলেন। সুতরাং সমাজে যে সমস্যা উপস্থিত হইয়াছিল তাহার মীমাংসা আবশ্যক। ভক্তের আবির্ভাব ব্যতীত ধর্ম্মের গ্লানি বিদূরিত হয় না। তাই চৈতন্য মহাপ্রভু অবতীর্ণ হইলেন। তিনি আত্মজীবনে এক মহান ত্যাগের জীবন্ত দৃষ্টান্ত দেখাইয়া, মানুষের মনের ধন্ধ ঘুচাইয়া দিলেন, গতিমতি ফিরাইয়া দিলেন, তর্কজাল ছিন্নভিন্ন করিয়া ভেদনীতির মূলে কুঠারাঘাত করিলেন। তখন লোকের চমক ভাঙ্গিল; লোকে চাহিয়া দেখিল—এক নূতন প্রেমের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, তাহাতে জাতি-বিদ্বেষ নাই, ভোগাসক্তি শক্তিহীন হইতেছে, ভক্তির পথে মুক্তির পথ সোজা হইয়া গিয়াছে।
মানুষে মানুষে বিদ্বেষের মূলে ধর্ম্মগত পার্থক্যই প্রধান। একটি ধর্ম্ম পাইবামাত্র মানুষ অন্ধের মত ভাবে, তাহার নিজের ধর্মই সর্ব্বশ্রেষ্ঠ, অন্য ধৰ্ম্ম নিকৃষ্ট; সে এককই শুধু বুদ্ধিমান ও ভাগ্যবান, অন্যলোকে ভুল বুঝিয়া নরকস্থ হইবে। ধৰ্ম্ম উপলক্ষ্য মাত্র, অহঙ্কারই এই বিদ্বেষের মূল। এই অহঙ্কারের জন্য মানুষ অন্যকে ঘৃণা করে— শত্রুতার সৃষ্টি করে। দীনতাই এই অহঙ্কার নাশের উপায়—তাই দীনতাই চৈতন্য-ধর্ম্মের মূল ভিত্তি। দীনতা আসিলে তুমি পরকে ঘৃণাবিদ্বেষ করিবে না; উহা হইতে সহিষ্ণুতা আসিবে, তখন তুমি পরের ঘৃণাবিদ্বেষ সহ্য করিবে; ইহা হইতে আসিবে— প্রেম; যখন বিদ্বেষ নাই, পরের বিদ্বেষে বিরক্তি নাই, তখন পরের প্রতি ভালবাসা বা অনুরক্তি আসিবে। দীনতা, সহিষ্ণুতা ও প্রেম— এই ত্রিতন্ত্রীতে বৈষ্ণব মন্ত্র বাজিবে, উহাতে বিশ্ব বিজিত হইবে। যতক্ষণ তুমি দীন, ততক্ষণ তুমি নিষ্ক্রিয়; যতক্ষণ তুমি সহিষ্ণু, ততক্ষণও তুমি একপ্রকার নিষ্ক্রিয়; কিন্তু যখন তুমি প্রেমিক, তখন তোমার কার্যক্ষেত্র সুদূর বিস্তৃত। সে কার্য্যের বিরাম নাই, পাৰ্ব্বত্য স্রোতস্বিনীর মত প্রেমের ধারা দেশ প্লাবিত করিয়া ছুটিতে থাকে। চৈতন্যের ধর্ম্মস্রোতেও এইরূপ শুধু বঙ্গ কেন, ভারতবর্ষের প্রতি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ভাসাইয়া লইয়া গিয়াছিল।
বিদ্রোহে দেশকে ছিন্নভিন্ন ও শান্তিশূন্য করে; বিপ্লবে দেশকে ভাঙ্গিয়া চুরিয়া নূতন করিয়া গড়ে। হিন্দু পাঠানে অনেককাল ধরিয়া বিদ্রোহ চলিতেছিল, সে কলহে শান্তি দেশান্তরিত হইয়াছিল। কিন্তু চৈতন্য-যুগের ধর্ম্ম-বিপ্লবে যখন জাতিভেদ ও বিদ্বেষের মূলে কুঠারাঘাত করিল, তখন দেশের অবস্থা ফিরিয়া দাঁড়াইল। প্রকৃত ভক্তের ধর্ম্ম ও ভক্তির পদার্থ দেখিলে সকলকেই শ্রদ্ধাবান হইতে হয়, তখন বিদ্বেষ-বুদ্ধি বিলুপ্ত হয়। এইভাবে মুসলমানও হিন্দুর গুণগ্রাহী হইল, দেশের অবস্থা ফিরিয়া গেল।
এমন সময়ে গৌড়ের তক্তে বসিলেন আলাউদ্দীন হুসেন শাহ। বাল্যজীবনে তিনি হিন্দুর গৃহে প্রতিপালিত হইয়াছিলেন বলিয়াই হউক বা ধর্ম-বিপ্লবের আবর্তনে পড়িয়াই হউক, তিনি হিন্দু- মুসলমানে শান্তি, প্রীতি ও সাম্যভাব প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন বলিয়া তাঁহার শাসনকাল বঙ্গের একটি স্মরণীয় যুগ। বঙ্গ তখন স্বাধীন; লোদীদিগের দুর্ব্বল শাসন তখন দিল্লী আগ্রা হইতে বহুদূরে বিস্তৃত হইতে পারে নাই। বঙ্গে তখন শান্তি সুখ বিরাজিত; হুসেন শাহ যেমন সতর্ক ও বলশালী, তেমন বহিঃশত্রুর আক্রমণের সম্ভাবনাও বড় কম। শান্তি ও স্বাধীনতার স্নিগ্ধচ্ছায়ায় প্রজার সমৃদ্ধি ক্রমেই বৃদ্ধি পাইতেছিল। নির্বাণের পূর্ব্বে দীপশিখা যেমন জ্বলিয়া উঠে, রাজধানী গৌড়ের ধনৈশ্বর্য্যও তেমনি হঠাৎ বিবৰ্দ্ধিত হইয়া পড়িয়াছিল। সেই গৌড়ের পতনের পর কিরূপে যশোহরের সমুত্থান হইয়াছিল, তাহাই এই গ্রন্থে বিবৃত হইবে।
নসরৎ বিলাসী হইলেও সুশাসক ছিলেন। তাঁহারই সময়ে মোগল-কুলতিলক বাবর লোদীদিগকে বিতাড়িত করিয়া পাঠান রাজত্ব করায়ত্ত করেন এবং আগ্রার রাজতক্ত অধিকার করিয়া লন। তিনি বঙ্গের দিকেও তাঁহার প্রবল বাহিনী পরিচালিত করিয়াছিলেন, কিন্তু সুচতুর নসরৎ সামান্য উপঢৌকনে তাঁহাকে পরিতৃপ্ত করিয়া প্রতিনিবৃত্ত করিয়াছিলেন। অচিরে বাবর ও তৎপরে নসরৎ মৃত্যুমুখে পতিত হন। তখন বাবরের পুত্র হুমায়ুন দিল্লীতে এবং নসরতের ভ্রাতা মাহমুদ গৌড়ে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
আদিমকাল হইতে ভারতবর্ষের একটি প্রকৃতি দেখা গিয়াছে যে, যখনই উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রম করিয়া কোনও বহিঃশত্রু এই দেশে প্রবেশ করিয়াছে, সে-ই পূৰ্ব্বতন শাসন বিপৰ্য্যস্ত করিয়া আত্মপ্রতিষ্ঠা করিতে সমর্থ হইয়াছে।[৫] আর্য্যদিগের প্রথম আগমন হইতে মোগল আক্রমণ পৰ্য্যন্ত এই একই ব্যবস্থা চলিয়াছে। মোগল আসিবামাত্র পাঠানের পতন আরম্ভ হইল। তবে উভয় জাতির সংঘর্ষ মিটিতে শতাব্দী পার হইয়া গিয়াছিল। লোদীগণ আগ্রার সীমা হইতে বিতাড়িত হইবার পরদিন ভারতের সমস্ত পাঠান সম্প্রদায় এক হইয়া গেল এবং পাঠান প্রতিপত্তি পুনঃ প্রতিষ্ঠার জন্য সৈন্যবল সংগ্রহ করিতে লাগিল। অবিরত চতুর্দিক হইতে দিল্লী আগ্রার উপর আক্রমণ চলিতেছিল; নবাগত মোগলরাজকে তরঙ্গের পর তরঙ্গের মত এই পাঠান বাহিনীর বিরুদ্ধে দণ্ডায়মান হইতে হইয়াছিল। লোদী, লোহানী, সুর প্রভৃতি আফগান জাতিরা মোগলবংশ নির্মূল করিবার জন্য সর্ব্বত্র বিপুল ষড়যন্ত্রের আয়োজন করিতেছিল। কিন্তু বীরত্বে মোগলেরা অতুল, বিপদসঙ্কুল প্রদেশে সহিষ্ণুতায় অজেয়; তাই আফগানেরা তাহাদের নিকট ক্রমান্বয়ে পরাজিত হইয়া দেশ ত্যাগ করিতে বাধ্য হইতেছিল। বিপৰ্য্যস্ত পাঠানের দল তরঙ্গের পর তরঙ্গের মত আগ্রা অঞ্চল হইতে বিতাড়িত হইয়া, মগধ প্রদেশে আশ্রয় লইতেছিল এবং নানাজাতীয় পাঠান-সংঘর্ষে সেখানে এক ভীষণ আবর্ত্তের সৃষ্টি হইয়াছিল।
এই আবর্তের মধ্যে বহুজনেই আত্মরক্ষায় অসমর্থ হইলেন; কেবল একজন মাত্র মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন— তিনি সের খাঁ। মগধে বহু পাঠানদলের একত্র সমাবেশ হইয়াছিল এবং মোগল যে সকলের শত্রু তাহাও সত্য কথা। কিন্তু মোগল যদি পরাজিত হয়, তখন পাঠানদিগের মধ্যে কে অগ্রণী হইয়া প্রাধান্য স্থাপন করিবে, ইহাই বিষম সমস্যা। যাহাদের মধ্যে পূর্ব্ব হইতে পরস্পর কোন মিল নাই, মোগলের সহিত শত্রুতাসূত্রে একদিনে বিভিন্ন পাঠানদলের ঐক্য সাধিত হইতে পারে না। বহুজনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সমন্বয় সাধন করা সহজ নহে। একমাত্র সের খাঁ ছলে বলে কুটকৌশলে সকলকে কখনও হস্তগত কখনও পর্যুদস্ত করিয়া, ক্রমে বিহার ও বঙ্গদেশ হস্তগত করিয়া লইলেন। অবশেষে তিনি সত্যসম্পর্কবিরহিত হইয়া হুমায়ুনকে আকস্মিক আক্রমণে পরাজিত ও বিতাড়িত করিলেন এবং সবলে দিল্লীর সিংহাসন কাড়িয়া লইয়া সেরশাহ বাদশাহ হইয়া বসিলেন।
সেরশাহের রাজ্যাধিকারের প্রণালী যাহাই হউক, তাঁহার রাজ্যশাসনের প্রণালী সুন্দর ও প্রজারঞ্জনশীল ছিল। সামান্য ছয় বৎসর রাজত্বকালের মধ্যে তিনি দেশে শান্তি, সুন্দর রাজস্ব- ব্যবস্থা ও নানা জনহিতকর কার্য্যের সদনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, এমন কি, এ সব বিষয়ে বিংশ শতাব্দীর সভ্যশাসনও তাহার নিকট পরাজিত বলিয়া বোধ হয়। সেরশাহ অসামান্য প্রতিভাবলে দুর্দ্ধর্ষ আফগান সদারগণকে করতলে রাখিয়াছিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার নির্জ্জীব বংশধরগণ তাঁহার মর্য্যাদা রক্ষা করিতে পারেন নাই। তাহাদের সময়ে বঙ্গদেশ পুনরায় স্বাধীনতা অবলম্বন করিয়াছিল। এমন কি, হুমায়ুনের পুত্র আকবর দিল্লীশ্বর হইলেও সহজে বঙ্গদেশ অধিকৃত করিতে পারেন নাই। ত্রিশ বৎসর ধরিয়া বঙ্গবিজয়ের জন্য মোগলের রণরঙ্গ চলিয়াছিল; প্রধান প্রধান সেনাদল সেই উদ্দেশ্যে পূৰ্ব্বমুখে প্রেরিত হইয়া মৃত্যুমুখে পতিত হইতেছিল। সৰ্ব্বপ্রধান সেনাপতিগণ পাঠানের সহিত কঠোর যুদ্ধে বা অনভ্যস্ত বঙ্গের ব্যাধির উৎপীড়নে জীবনাহুতি দিতেছিলেন। এই সংঘর্ষকালে দক্ষিণবঙ্গের যশোররাজ্যের নবাভ্যুদয় হইয়াছিল। এখন আমরা সেই অভ্যুদয় কেন এবং কেমন করিয়া হইল, তাহাই দেখাইব।
পাদটীকা :
১. Wright, H. N. – – Catalogue of Coins in the Indian Museum. Calcutta. Vol. II. Part II, pp. 177-8. Nos. 211-12. 116 – 19.
২. প্রথম খণ্ড, ২৩৫-২৪০ পৃ।
৩. রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়— ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’, ২য় খণ্ড (১৩২৪), ২৯৯ পৃ।
৪. প্রথম খণ্ড, ২০৭-২১৬ পৃ।
৫. Hunter. W. W. – Orissa Vol. II, p. 14.
৬. ‘It is impossible to avoid the observation, that on Government not even the British – has shown so much wisdom as this pathan.’-Keen, Turks in India, p. 42.
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন