সতীশচন্দ্র মিত্র
যোদ্ধার পক্ষে সৈন্য গঠনের মত কঠিন কার্য্য আর নাই। এই কার্য্যের পূর্ব্বে রাজ্যের অবস্থান ও প্রাকৃতিক অবস্থা বিবেচনা করিতে হয়, শত্রুর বল ও যুদ্ধ-প্রকৃতি বিচার করিতে হয়। সকল বিচার করিয়া এমন ব্যবস্থা করিতে হয় যে, সৈন্য গঠনে বা পরিচালনে কষ্ট না হয়; শত্রুর সৰ্ব্ববিধ আক্রমণ ব্যর্থ করা যায় এবং নূতন প্রণালীতে অধিকতর বলশালী সৈন্য-সমাবেশ-দ্বারা বিপক্ষকে অকস্মাৎ চমকিত ও পরাভূত করা যায়। প্রতাপাদিত্যের ব্যবস্থা পর্যালোচনা করিলে বুঝা যাইবে যে, তিনি সর্ব্বদিকে দৃষ্টি রাখিয়া কার্য্য করিয়াছিলেন। প্রতাপাদিত্যের যে ৯ প্রকার সৈন্য ছিল, তাহার নামোল্লেখ আমরা পূর্ব্বে করিয়াছি। পরাক্রমশালী বড় রাজাদিগের সব রকমের সৈন্য অল্পবিস্তর থাকে, কিন্তু সব সৈন্যদলের উপর তাঁহাদের সমান নির্ভর চলে না। অবস্থাভেদে নানা জাতীয় সৈন্য সংখ্যার তারতম্য করিয়া প্রয়োজন সিদ্ধ করিতে হয়। তাহা হইতেই যোদ্ধার সৈন্য- গঠন প্রণালীর বিশেষত্ব বুঝা যায়।
অর্থের দায়ে যাহারা যুদ্ধ করে, তাহারা প্রকৃত যুদ্ধ করে না। যাহারা প্রাণের দায়ে, ধর্ম্মের রক্ষার্থ বা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে, তাহারাই প্রকৃত যোদ্ধা; সৌভাগ্যক্রমে এ সময়ের বঙ্গে প্রাণের দায়ে যুদ্ধ করিবার সুযোগ আসিয়াছিল। পাঠান-শক্তি পরাজিত, নবাগত মোগলের প্রতাপে দেশ বিকম্পিত। পাঠান সৈনিকেরা পলায়ন করিয়া অনেকে যশোর-রাজ্যে আশ্রয় লইয়াছে; পয়সা পায় না পায়, যেখানে মোগলের বিপক্ষে কেহ যুদ্ধ করে, সেখানেই তাহারা প্রাণপণে যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত। কারণ আর কিছু লাভ হউক বা না হউক, প্রতিহিংসা চরিতার্থ হইবে। বাঙ্গালী হিন্দুরাও কেহ অর্থের লোভে, কেহ বা মোগলের অত্যাচার ভয়ে, আর কেহ বা প্রতাপের শাসন-কৌশলে প্রাণপণে যুদ্ধ করিত। সুতরাং পাঠান ও হিন্দু উভয় সম্প্রদায় হইতে প্রতাপের পক্ষে সৈন্য-সংগ্রহে অসুবিধা ছিল না। তিনি আবশ্যক মত পৰ্য্যাপ্ত সৈন্য সংগ্রহ করিয়াছিলেন।
উত্তর-ভারতে পাৰ্ব্বত্যদেশে যে ভাবে যুদ্ধ করা যায়, দক্ষিণবঙ্গে, সুন্দরবনের প্রান্তে, নদীবহুল, লবণাক্ত ও কদমিত ভাটি অঞ্চলে সে ভাবে যুদ্ধ করা চলে না। সুতরাং স্থানের অবস্থানুসারে প্রতাপকে যুদ্ধ-প্রণালীরও পরিবর্ত্তন করিতে হইয়াছিল। বঙ্গদেশে ভাল অশ্ব পাওয়া যায় না, দক্ষিণবঙ্গের পথঘাট, নদীনালা অশ্বপরিচালন পক্ষে সুবিধাজনক নহে। এজন্য অশ্বারোহী সৈন্য অপেক্ষা পদাতিক সৈন্যের দিকে তাহার অধিকতর মনোযোগ আকৃষ্ট হইল। পুরুষানুক্রমে যাহারা সুন্দরবনে যাতায়াতে চিরাভ্যস্ত, এমন অসংখ্য সবলকায় নিম্নশ্রেণীর লোক লইয়া তিনি তাঁহার বিখ্যাত ‘ঢালী’ সৈন্য গঠন করিলেন। তাঁহার হস্তি-সৈন্য অতি কম ছিল, ষোলটি হল্কা বা দল মাত্র। এক দলে ১০/১৫টির অধিক হস্তী না থাকিতেও পারে।[১] প্রতাপের অশ্বারোহী সৈন্যের সংখ্যা সে সময়ের পক্ষে নিতান্ত কম ছিল না; তাঁহার অযুত বা দশ সহস্র অশ্বসাদী বা অশ্বারোহী সৈন্য ছিল বলিয়া কথিত হয়। কিন্তু সর্ব্বত্র এবং সর্ব্বাবস্থায় প্রযোজ্য তীরন্দাজ ও ঢালী সৈন্যের সংখ্যাই সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক ছিল; ক্ষিতীশবংশাবলীর মতে তাঁহার ৫১ হাজার তীরন্দাজ ছিল এবং প্রবাদ চলিয়া আসিতেছে ও ভারতচন্দ্রের কবিতায় আছে :
‘ষোড়শ হল্কা হাতি, অযুত তুরঙ্গ সাতি, বায়ান্ন হাজার যার ঢালী।’[২]
‘অন্নদামঙ্গলে’র অন্যত্র আছে :
‘সিন্দুর সুন্দর, মণ্ডিত মুদগর, ষোড়শ হল্কা হাতি।
পতাকা নিশান, রবিচন্দ্রবাণ, অযুতেক ঘোড়া সাতি।।
সুন্দর সুন্দর নৌকা বহুতর, বায়ান্ন হাজার যার ঢালী।’ ইত্যাদি
দেখা যাইতেছে, ভারতচন্দ্র সর্ব্বত্র ঢালী সৈন্যের বেলায় বায়ান্ন হাজার সংখ্যা স্থির রাখিয়াছেন। সম্ভবতঃ প্রবাদই ইহার ভিত্তি; আবদুল লতীফের ভ্রমণ কাহিনী হইতে জানিতে পারি, প্রতাপের রাজত্বের শেষাংশেও তাঁহার বিশ হাজার পাইক বা পদাতিক সৈন্য ছিল।[৩] তাহাতে রাজত্বের প্রথম বা প্রতাপান্বিত অবস্থায় তাঁহার পদাতিক সৈন্য সংখ্যা বায়ান্ন হাজার পর্য্যন্ত হইয়াছিল, ইহা বিচিত্র নহে। তাঁহার ৫১ হাজার তীরন্দাজ ও পৃথকভাবে ৫২ হাজার ঢালী ছিল, হয়ত এ কথা ‘ঠিক’ নহে; সম্ভবতঃ ঢালী সৈন্যেরই কতক আবশ্যক মত তীর ধনু লইয়া যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইত। তবে এই পদাতিক বা ঢালী সৈন্য যে তাঁহার প্রধান সম্বল ছিল, তৎপক্ষে কোন সন্দেহ নাই।
ঢাল এবং সড়কী বা বর্শাই ঢালীদিগের প্রধান সজ্জা ছিল। সুন্দরবনে তখন বহুসংখ্যক গণ্ডার ছিল; উহাদের চর্ম্ম হইতে যথেষ্ট উৎকৃষ্ট ঢাল প্রস্তুত হইত। গণ্ডার চর্ম্মের ঢালের তুলনা নাই; এমন ঢাল আর কিছুতেই হয় না। এ দেশে সড়কী বা বর্শাও অতি সহজ এবং সুলভভাবে প্রস্তুত হইত। সরু দীর্ঘ বাঁশের অগ্রভাগে, সুন্দরীগাছের সরু ছিটের শীর্ষে, বা সুপারির চটা বা বাখারির মাথায় সূক্ষ্মাগ্র লৌহ-ফলক লাগাইয়া সড়কী হইত। লৌহ-ফলক না হইলেও শুধু সুপারির চটা সরু করিয়া লইলেই বর্শার কাজ চলিত। মালকোঁচা দিয়া কাপড় পরিয়া, কটিবন্ধ আঁটিয়া এই ঢাল সড়কী লইয়া ঢালী সৈন্য ডাক ছাড়িয়া যুদ্ধক্ষেত্রে লাফাইয়া পড়িত। এই তীব্র চীৎকারে লোকের মনে আতঙ্ক হইত এবং বহুদূরে যুদ্ধধ্বনি ঘোষিত হইত। এই সকল ঢালী সৈন্য কোন বাধা বিপত্তি মানিত না, প্রাণপাত করিয়াও যুদ্ধ করিত। খাঁ জাহানালির পদাতিক সৈন্যের মত ইহাদেরও কোদাল বা কুঠার অস্ত্রমধ্যে গণ্য হইত। উহারা জঙ্গল কাটিত, গড় কাটিত এবং খাল নালা বাঁধিয়া পুল প্রস্তুত করিয়া চলিত। ইহারা যুদ্ধক্ষেত্রে যেমন অদম্য যোদ্ধা, তেমনি জঙ্গলে কাঠুরিয়া, জলে নৌকার দাঁড়ী এবং পথে কোড়াদারের কাজ করিত। প্রতাপের পতনের পর এই সকল সৈন্য ও তাহাদের কার্য-প্রণালী দেশমধ্যে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল।[৪] এই ঢালী সৈন্য প্রতাপাদিত্যের এক প্রধান অবলম্বন এবং তাঁহার সৈন্যগঠন-প্রণালীর প্রথম ও প্রধান বিশেষত্ব।
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ হইতে পর্তুগীজ প্রভৃতি ইয়োরোপীয় জাতি ভারতের সর্ব্বত্র বিস্তৃত হইয়া পড়ে। তাহাদের অনেকে দেশীয় রাজন্যবর্গের সেনাবিভাগে প্রবেশ করে। প্রতাপের রাজত্বকালে উহারা বঙ্গোপসাগরে ও পার্শ্ববর্তী দক্ষিণবঙ্গে আসিত; বাণিজ্য, দস্যুতা, ধর্মপ্রচার বা চাকরী প্রভৃতি নানা উদ্দেশ্যে উহারা দেশের মধ্যে প্রবেশ করিত। কেহ বা যুদ্ধক্ষেত্রে বন্দী হইয়া যশোর আসিত, কেহ বা আত্ম-কলহ জন্য প্রতাপাদিত্যের আশ্রয় ভিক্ষা করিত। প্রতাপ তাহাদিগকে পরীক্ষা করিয়া তাহাদিগের দ্বারা কোন কার্য্য করাইয়া লইবার চেষ্টা করিতেন। কেহ তাঁহার সৈন্যদলভুক্ত হইত, কেহ তাঁহার শরীর-রক্ষী সাজিত, কেহ জাহাজ নির্মাণে, গুলিগোলা প্রস্তুত করিবার কৌশলে বা গোলন্দাজের কার্য্যে নিজের ক্ষমতা দেখাইয়া চাকরী পাইত। প্রধানতঃ তাহাদের দ্বারা দুইটি কাজ হইত; কেহ জাহাজ নির্ম্মাণ ও সংস্কার করিয়া নাব-বিভাগে নায়ক হইত; আর কেহ গুলিগোলা প্রস্তুত করিয়া কামান লইয়া যুদ্ধ করিত। উভয়ই গুরুতর কার্য্য। প্রতাপ যে তাহাদিগকে বিশ্বাস করিতেন, তাহাতে সুফল ফলিয়াছিল। দেশের লোক বিশ্বাসঘাতকতা করিতে পারে, কিন্তু রুডা, পেড্রো বা ডুডুলি বিশ্বাসঘাতকতা করেন নাই। পর্তুগীজ জাতির মধ্য হইতে এই গোলন্দাজ ও নৌ-সৈনিক সংগ্রহ করা প্রতাপাদিত্যের সৈন্য-নির্ব্বাচন প্রণালীর দ্বিতীয় বিশেষত্ব।
পূর্বাঞ্চলের সহিত প্রতাপাদিত্যের বিশেষ সংস্রব ঘটিয়াছিল। তাঁহার সেনাপতিগণের মধ্যে রঘু, সুখা এবং পুর্ববিভাগীয় কর্ম্মচারীর মধ্যে জগৎ সহায় দত্ত প্রভৃতি অনেকে শ্রীহট্ট ও ত্রিপুরা হইতে আসেন। শুনা যায়, রঘুর অধীন প্রতাপের এক দল পার্বত্য কুকী সৈন্য ছিল। ইঁহারা মুখে চিত্র বিচিত্র করিতেন, হাতে পায়ে গায়ে নানা অদ্ভুত আদিম-যুগীয় অলঙ্কার পরিতেন এবং তীর ধনুক, বর্শা ও টাঙ্গি লইয়া যুদ্ধ করিতেন। যুদ্ধে ইঁহারা সহজে ক্লান্ত হইতেন না; আহারের ক্লেশে চঞ্চল হইতেন না এবং ক্রুদ্ধ হইলে প্রাণপণে যুদ্ধ করিতেন। শত্রুগণ ইঁহাদের অদ্ভুত যুদ্ধ-প্রণালী জানিত না; সুতরাং তাহারা ইঁহাদের অব্যবস্থিত কঠোর যুদ্ধে বিপর্যস্ত হইত। বঙ্গোপসাগরের কূলে বা দ্বীপে যাহারা বাস করিত, তাহারা সকলেই অল্প বিস্তর নৌ-বিদ্যায় পারদর্শী হইত। প্রতাপ জাতিধৰ্ম্ম নির্বিশেষে ইহাদের দ্বারা নৌ-সেনা পরিপুষ্ট করিয়াছিলেন। সুন্দরবনের জঙ্গলে বা নিকটবৰ্ত্তী গ্রামে যে সব কৈবর্ত্ত, বাগদী, নমঃশূদ্র, পোদ (পৌণ্ড্রক) ও বেদিয়া প্রভৃতি জাতি ছিলেন, তাঁহারাও দলে দলে আসিয়া সৈন্যদলভুক্ত হইতেন। এই ভাবে পাৰ্ব্বত্য জাতি, দ্বীপবাসী ও আদিবাসী সৈন্য দ্বারা সামরিক বিভাগের বল সঞ্চয় করা তাঁহার সৈন্য-গঠন প্রণালীর তৃতীয় বিশেষত্ব।
প্রতাপাদিত্য গুলিগোলা ও অস্ত্রশস্ত্রের যথেষ্ট সংস্থান করিয়াছিলেন। বিশেষতঃ যে মোগলদিগের সহিত তাঁহার সংঘর্ষ চলিয়াছিল, তাহারা কামানের ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত; যথেষ্ট কামানের প্রয়োগই তাহাদের যুদ্ধ জয়ের গুপ্ত মন্ত্র। আকবর স্বহস্তে বন্দুক চালনা করিতেন; তাঁহারই হাতের গুলিতে রাজপুত বীর জয়মল্লের বিনাশ হয়। প্রতাপ এসব জানিতেন এবং তজ্জন্য তিনি কামান বন্দুকের বিশেষ ব্যবস্থা না করিয়া মোগল-যুদ্ধে অবতীর্ণ হন নাই। এজন্য পৰ্য্যাপ্ত লৌহের প্রয়োজন; কিন্তু উহা বঙ্গদেশে সহজে পাওয়া যায় না। প্রতাপের যে ছোট বড় বহুসংখ্যক কামান ছিল, তাহার প্রমাণ আছে। এখনও ধুমঘাট রাজধানীতে দুর্গের গায়ে প্রকাণ্ড বুরুজ খানা ও ইছামতীর পার্শ্বে সারি সারি বুরুজ বা অসংখ্য কামান রাখিবার ঢিপি বৰ্ত্তমান আছে। কালীগঞ্জের নিকটবর্ত্তী মহব্বৎপুর গড়ের উপর যে কয়েকটি প্রকাণ্ড কামান ছিল তাহা স্বচক্ষে দেখিবার লোক এখনও জীবিত আছেন। এখনও একটি বড় কামান ত্রিমোহিনীতে পড়িয়া আছে, প্রবাদ আছে উহা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী হইতে গৃহীত।[৫] প্রতাপাদিত্যের প্রত্যেক দুর্গে এবং অনেক স্থানের গড়ের মাঝে মাঝে কামান প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সকল কামানের অধিকাংশ যশোহর রাজধানীতে বিখ্যাত শিল্পীর দ্বারা নির্ম্মিত হইয়াছিল। দেশীয় শিল্পীর নির্ম্মিত বড় কামান এখনও ঢাকা, বরিশাল ও মুর্শিদাবাদে দেখিতে পাওয়া যায়। হয়ত প্রতাপের কামানের দুই চারিটি পর্তুগীজ বা পাঠানদিগের নিকট হইতে ক্রীত বা গৃহীত হইতে পারে। কামান ও গোলা প্রস্তুত করিবার জন্য যে যথেষ্ট লৌহ রাজধানীতে আনীত হইত, তাহাতে সন্দেহ নাই। অপরিষ্কৃত লৌহ মণ্ডূর আনিয়া তাহা হইতে উৎকৃষ্ট লৌহ বাহির করিয়া লইয়া কামান ও গোলার জন্য ব্যবহৃত হইত। অব্যবহার্য্য মণ্ডূর বা লৌহের গু কারখানার পার্শ্বে পরিত্যক্ত হইত। এখনও ধুমঘাট দুর্গের বাহিরে ও অন্যান্য স্থানে রাশি রাশি লৌহ-মঞ্জুর দেখিতে পাওয়া যায়। সম্ভবতঃ ছোটনাগপুর প্রভৃতি স্থান হইতে এই মিশ্ৰিত লৌহ-পিণ্ড সংগৃহীত হইত এবং বিষ্ণুপুর বা সেনপাহাড়ীর হিন্দু ভুঞাগণ প্রতাপের সহিত সখ্যসূত্রে এতদ্বিষয়ে তাঁহাকে সাহায্য করিতেন। তাঁহার নানা জাতীয় গোলা ছিল, তন্মধ্যে বড় গোলা সকল্ চারি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। (১) সম্পূর্ণ লৌহদ্বারা নির্মিত গোলা। রায়পুরের অধিকারী মহাশয়ের নিকট হইতে আমি উহার একটি সংগ্রহ করিয়া পরীক্ষার্থ কলিকাতায় পাঠাইয়াছিলাম। এই গোলাটির পরিধি এক ফুট; লৌহ অপেক্ষাও উহার আপেক্ষিক গুরুত্ব বেশী। সম্ভবতঃ লৌহের সহিত অন্য কোন ধাতুর মিশ্রণে এই অত্যন্ত ভারী গোলা প্রস্তুত হইয়াছিল। (২) লৌহের আবরণ বিশিষ্ট পাথরের গোলা। পর্যাপ্ত লৌহের অভাবে প্রতাপ এই নূতন উপায় অবলম্বন করেন। পাথরের গোলকের উপর পুরু লৌহের আবরণ দিয়া তাহাই কামানে ব্যবহৃত হইত। (৩) সেরূপ আবরণ না দিয়া শুধু প্রস্তর গোলকই কামানে পুরিয়া গোলার মত প্রযুক্ত হইত। এখনও রাজধানীর সন্নিকটে নানা স্থানে এইরূপ পাথরের গোলা পাওয়া যায়। উহার কতকগুলি শ্রীশচন্দ্র অধিকারী মহাশয়ের প্রযত্নে ঈশ্বরীপুরে, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ মন্দিরে এবং আমার নিকট সংগৃহীত আছে। চুঁচুড়া সাহিত্য-সম্মিলনে অধ্যাপক হেমচন্দ্র দাশ গুপ্ত মহোদয় পরিষদের তিনটি গোলকের তত্ত্বানুসন্ধান করিয়া একটি ক্ষুদ্র প্রবন্ধ পাঠ করেন।[৬] তাহা হইতে মোটামুটি জানা যায়, উহার মধ্যে দুই প্রকার গোলা ছিল, তাহাদের পরিধি সাড়ে ৯ ইঞ্চি হইতে এক ফুট পর্য্যন্ত। এক প্রকার গোলা অত্যন্ত দৃঢ় প্রস্তর দ্বারা নির্মিত এবং অন্য প্রকার গোলা ‘নদী সৈকতস্থিত বালুকণা একত্র করিয়া চুনা প্রভৃতি দিয়া’ প্রস্তুত। প্রস্তরের প্রকৃতি পরীক্ষা করিয়া হেমচন্দ্র অনুমান করিয়াছেন যে, উহা রাজমহল হইতে আনীত। নদীপথে রাজমহল বা অন্যস্থান হইতে যে রাশি রাশি পাথর আনা হইত, তাহার অন্য পরিচয় আছে। ধুমঘাট দুর্গের সন্নিকটে যমুনার কূলে স্থানে স্থানে প্রস্তররাশি পাওয়া যায়, স্বচক্ষে দেখিয়াছে। ঐ সকল পাথর দেখিলে তাহা রাজমহলের পাথর বলিয়া অনুমিত হয়। এইরূপ ভাবে আনীত পাথর যে শুধু গোলা প্রস্তুত করিতেই শেষ হইত, তাহা নহে। ইহার মধ্যে যে সব কষ্টিপাথর পাওয়া যাইত, তদ্বারা দেববিগ্রহ এবং মন্দিরের স্তম্ভাদি গঠিত হইত। কয়েকটি প্রস্তরস্তম্ভ ও পাদপীঠাদি এখনও বেদকাশীতে পড়িয়া রহিয়াছে। সব সময়ে এই প্রস্তর যথেষ্ট পরিমাণে সংগ্রহ করিতে পারা যাইত না; বিশেষতঃ মোগল সংঘর্ষকালে গঙ্গাপথে কোন দ্রব্যাদি আনিবার পথ রুদ্ধ হইয়াছিল। এজন্য প্রতাপাদিত্য এক নূতন উপায় উদ্ভাবন করিয়া লইয়াছিলেন। (৪) তিনি মাটির গোলক তৈয়ার করাইয়া পোড়াইয়া লইতেন এবং উহার উপর লোহার আবরণ দিয়া গোলারূপে ব্যবহার করিতেন। বেদকাশীতে ‘পাথরখালি’ নামক খালের কূলে স্থানে স্থানে পাথর, লৌহমণূর এবং এই প্রকার পোড়ামাটীর গোলা এখনও যথেষ্ট পাওয়া যায়। হেমচন্দ্র লিখিয়াছেন, ‘পাথরের গোলা কামানের গোলারূপে অনেক দেশে ব্যবহৃত হইয়াছে’; কিন্তু পোড়ামাটির গোলাকে লৌহমণ্ডিত করিয়া বোধ হয় একমাত্র প্রতাপাদিত্যই ব্যবহার করিয়াছিলেন।
শুধু কামান ও গোলা নহে, যশোহরের কারখানায় নানাবিধ বন্দুক প্রস্তুত হইত। এখনও অনেক পুরাতন বন্দুকের ভগ্নাবশেষ পাওয়া যায়। খোড়গাছি রাজবাটীতে তিনটি পুরাতন বন্দুকের নল আছে। দুইটিতে কিছু কিছু কাঠ আছে; কুন্দা কোনটিতে নাই। ছোট নল দুইটির প্রত্যেকটি ৫’-৪” ইঞ্চি দীর্ঘ এবং বড়টি ৭ ফুট দীর্ঘ। বড়টির ছিদ্র পূর্ণ এক ইঞ্চি বিস্তৃত। সাত ফুট নলযুক্ত বন্দুক বড় ভারী, ঐরূপ বন্দুকের নাম ছিল, জৰ্দ্দাল বন্দুক; এখনকার লোকের নলটি হাতে তুলিয়া লওয়াই কষ্টকর ব্যাপার। যশোহরের কর্ম্মকারগণ নানাবিধ সুতীক্ষ্ণ তরবারি, খাণ্ডা, গুপ্তি, টাঙ্গি, বর্ম্ম ও বর্শার ফলক প্রভৃতি প্রস্তুত করিতেন; তাঁহাদের শিল্পগৌরবে যশোহর খ্যাতি লাভ করিয়াছিল। প্রতাপের পতনের পর ইহাদের ব্যবসায় নষ্ট হইলেও, এখনও কালীগঞ্জের কামারগণ যেমন খাঁড়া, কাটারি ও অন্যান্য ব্যবহার্য্য অস্ত্রাদি নির্ম্মাণ করেন, তেমন সুন্দর জিনিষ অন্য সহজলভ্য নহে। প্রতাপাদিত্য যে নিজ সৈন্যদলকে এবম্বিধ নানারকম অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ও সুশিক্ষিত করিয়াছিলেন, ইহাই তাঁহার সৈন্য-গঠন প্রণালীর চতুর্থ বিশেষত্ব।
এতক্ষণ আমরা প্রতাপাদিত্যের যুদ্ধায়োজনের পরিচয় দিলাম। তিনি কি ভাবে দুর্গ নির্ম্মাণ ও নৌ-বাহিনী গঠন করিয়াছিলেন, কি ভাবে সৈন্য গঠন ও তাহাদের পরিচালনার জন্য লোক নির্ব্বাচন ও রসদ সংগ্রহের সুব্যবস্থা করিয়াছিলেন, তাহাই দেখাইলাম। এখন আমরা তাঁহার কার্য্যকলাপ ও যুদ্ধবিগ্রহের বিবরণ দিতে চেষ্টা করিব। এতক্ষণ যাহার আয়োজন করিয়াছি, এখন তাহার প্রয়োজনীয়তা দেখাইতে হইবে।
পাদটীকা :
১. ‘ষোড়শ হল্কা হাতি’ (ভারতচন্দ্র)। হস্তীর দল বা যুথকে আরবীতে হল্কা বলে। এখনও আমরা মাছের ‘হালি’ বলিয়া থাকি। কিন্তু এক হল্কায় কত হাতী থাকিতে পারে, তাহার স্থিরতা নাই। বিশ্বকোষে ‘ষোল শ হল্কা হাতী’ এইরূপ পাঠান্তর নির্দ্দেশ করিয়া হস্তীর সংখ্যা ১৬ শত ছিল, ইহাই বলিতে চান। অন্নদামঙ্গলের প্রথম সংস্করণের পুস্তকেও এ পাঠান্তর নাই, থাকিলেও হল্কা কথার অর্থ হয় না। এ মত আমরা যুক্তিসঙ্গত মনে করি না।—‘বিশ্বকোষ’, ২২শ খণ্ড, ৫৩৫ পৃ।
২. সাতি, সাথী শব্দ সাদি বা সাদী শব্দের অপভ্রংশ। অশ্ব গজ বা রথারোহীকে সাদী বলে।
৩. প্রবাসী ১৩২৬ আশ্বিন, ৫৫২ পৃ। [পরিশিষ্ট দ্র.-শি মি]
৪. এখনও যশোহর এবং খুলনা এই উভয় জেলার পাড়াগাঁয়ে যেখানে সেখানে ‘ঢালী’ উপাধি-ধারী মুসলমান ও নমঃশূদ্র বংশ বাস করিতেছেন। এই উপাধি তাঁহাদের বংশগৌরব সূচনা করে। এখনও জমিদারে জমিদারে দৈবাৎ কোন দাঙ্গা হাঙ্গামা হইলে, উভয় পক্ষের ‘লাঠিয়াল” দিগের ঢাল সড়কীই প্রধান অস্ত্র হয়। এখনও বিবাহে ও পর্ব্বদিনে ঢালীপাক খেলা হয়। বরযাত্রীর মিছিলে বা সুন্দরবনের জঙ্গলে ঢালী সৈন্যের মত উচ্চ চীৎকার করিবার প্রথা আছে; ‘ঢাল ও তরবারি না লইলে যে সেকালে যুদ্ধ বা সর্দ্দারী করা চলিত না’ প্রবাদ-কথায় তাহার প্রমাণ আছে। উপযুক্ত সরঞ্জাম না লইয়া কোন কাৰ্য্যে উদ্যোগী হইলে, লোকে বলে, ‘ঢাল নাই, তরোয়াল নাই, নিধিরাম সর্দ্দার।’ প্রতাপের ঢালী সৈন্যের নায়ক বা ঢালী সর্দ্দারের বংশীয়গণ এখনও এদেশে সম্মানিত। খুলনা জেলায় ‘ঢাল’-সংযোগে বহুস্থানের নাম হইয়াছে। হরি নামক কোন্ ঢালী, হরিঢালী গ্রামের প্রতিষ্ঠাতা, ইতিহাস তাহা ভুলিয়া গিয়াছে। চকশ্রীর সন্নিকটে এক চকেরই নাম হইয়াছে ঢালঢাকা। সুন্দরবনের নিকটে ঢালঢাকার হাট বিখ্যাত। কালীগঞ্জের সন্নিকটে যে স্থানকে এক্ষণে ধলবাড়িয়া বলে, হয়ত তাহার আদিম নাম ছিল ঢাল-বাড়ী। ইহা ভিন্ন ঢালী, ঢালনগর, ঢালীর চক প্রভৃতি আরও কত গ্রাম আছে।
৫. ঈশ্বরীপুরের সন্নিকটবর্ত্তী চণ্ডীপুরের বাঁধের কাছে যে একটি লৌহময় জিনিষ পাওয়া যায়, তাহা সরকারী ব্যবস্থায় সাতক্ষীরায় আনীত হইয়া বহুকাল কাছারীর নিকট পড়িয়াছিল। রাজা গিরীন্দ্রনাথ রায় উহা চাহিয়া লইয়া নিজের খোঁড়গাছির বাড়ীতে রাখিয়াছেন। তিনি বলেন সেটি কামান; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাহা নহে, উহা কোন নিমজ্জিত জাহাজের ভগ্নাংশ হইতে পারে।
৬. এই প্রবন্ধ হইতে জানা যায়, যশোহরের গোলার প্রস্তরে ‘বক্রভঙ্গ ফেলস্কর, অপিট ও অয়স্কান্ত’ ব্যতীত গালাগনিট নামক এক পদার্থ আছে। এই প্রস্তর ক্ষার শ্রেণীর অন্তর্গত। তেমন প্রস্তর রাজমহলে ও দাক্ষিণাত্যে পাওয়া যায়। প্রতাপের পক্ষে দাক্ষিণাত্য হইতে পাথর আনিবার সম্ভাবনা নাই। এজন্য অনুমান হয়, তিনি এই সব পাথর রাজমহল হইতে আনেন।—সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা, ১৯ ভাগ, ১ম সংখ্যা, ৫৯-৬০ পৃ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন