১১. বংশ-কথা

সতীশচন্দ্র মিত্র

একাদশ পরিচ্ছেদ – বংশ-কথা

প্রতাপাদিত্যের ইতিহাস আরম্ভ করিবার পূর্ব্বে যশোহর-রাজগণের বংশকথা জানিয়া লওয়া আবশ্যক। কারণ বংশধরগণের নাম ও তাহাদের সম্বন্ধ-সূত্র না জানিলে পরবর্ত্তী ঘটনাবলী সহজে বুঝা যাইবে না। এজন্য আমরা ঘটকদিগের প্রাচীন পুঁথিতে আশগুহ বংশীয় গজপতি হইতে প্রতাপাদিত্যের সন্ততি পর্য্যন্ত এই বংশের বিবরণী যতটুকু আছে, তাহা এই স্থানে প্রকাশ করিতেছি; পরবর্ত্তী অংশের বংশতালিকা প্রয়োজন মত স্থানান্তরে প্রদত্ত হইবে। প্রতাপাদিত্যের বাল্যকথা বলিবার পূর্ব্বে তাঁহার পুত্রপৌত্রের প্রসঙ্গ তুলিতে যাওয়া প্রচলিত প্রণালীর অনুমত না হইতে পারে কিন্তু ঐতিহাসিকের পক্ষে ঔপন্যাসিকতার প্রতি দৃষ্টি রাখিবার কোনও প্রয়োজন আছে বলিয়া মনে করি না। সরল সত্য পূর্ব্বক্ষণে বলিয়া রাখাই ভাল, কারণ তাহা হইতে পরে অনেক দ্বিরুক্তি বা কৈফিয়তের হাত হইতে নিস্তার পাওয়া যায়। আমার নিকট যে সকল বঙ্গজ কায়স্থ-কারিকা আছে, তন্মধ্যে একখানি অতিজীর্ণ পুরাতন পুঁথিতে আশগুহের বংশশাখা পাইয়াছি; উহার যে অংশে যশোহররাজগণের প্রসঙ্গ আছে, অতিকষ্টে পাঠোদ্ধার করিয়া সেইটুকুমাত্র এখানে প্রকাশ করিলাম। অন্যান্য ঘটককারিকার সহিত যে ইহার সামঞ্জস্য আছে, তাহা ভাল ভাবে মিলাইয়া দেখিয়াছি। এজন্য এই পুঁথিখানি প্রমাণিক বলিয়া সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। এই বিবরণীতে দান গ্রহণ স্পষ্টতঃ উল্লিখিত আছে; যে সকল বংশের সহিত বিক্রমাদিত্য প্রভৃতি বৈবাহিক সম্বন্ধ হইয়াছিল, পৃথক পৃথক ভাবে সে সব বংশের প্রসঙ্গেও এই রাজবংশীয়দিগের নাম যথোপযুক্ত ভাবে পাইয়াছি। এই বংশাবলী অতি সংক্ষিপ্ত, ইহাতে অনর্থক কথা নাই। কিন্তু দান গ্রহণের প্রকৃতি সম্বন্ধে যেরূপ সূক্ষ্ম বিচার আছে, তাহা দেখিলে সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ হয় না। পূৰ্ব্বেই বলা হইয়াছে, গাভ-বসুবংশীয় পরমানন্দ রায় বসন্ত রায়ের ভগিনীপতি ছিলেন; তিনি যশোহর-রাজ্যের পতনের পর বর্তমান বাগেরহাটের নিকটবর্ত্তী হাবেলী কাড়াপাড়ায় বাস করেন। সমাজে তিনি উচ্চকুলীন বলিয়া বিখ্যাত; এখনও তাহার বংশধরগণ সগৌরবে তথায় বাস করিতেছেন। তাহাদেরই আশ্রিত ঘটকদিগের নিকট হইতে আমি কতকগুলি প্রাচীন কারিকা সংগ্রহ করিয়াছি। কারিকায় বর্ণাশুদ্ধি অনেক আছে, কিন্তু তাহা সংশোধন না করিয়াই অবিকল প্রকাশ করিলাম। এই কারিকায় কতকগুলি সাঙ্কেতিক শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে, যথা— বিবাহস্থলে ‘বিং’ কন্যাদানের বেলায় ‘দানাং’ এবং সম্বন্ধের প্রকৃতি প্রসঙ্গে ‘সৎ’, সমান ঘরে কার্য্য করিলে ‘উচিতং”, তন্নিম্নে অন্যান্য সঙ্কেত। ‘অপ’ ও ‘অত্যপ’ অত্যন্ত হীন সম্বন্ধ বুঝাইয়া দেয়। ‘দৌ’ বলিতে দৌহিত্র বুঝিতে হইবে, যেখানে ‘বসুদৌ’ আছে, সেখানে বুঝিতে হইবে, বসুকন্যার গর্ভজাত সন্তান।

‘গজপতি গুহ বিং সৎ লক্ষ্মণ ঘোষ উপগণপতি ঘোষ। দানং উপকামঘোষ উপ— ঘোষ। সুতা ছকড়ি গুহ জগন্নাথগুহ চতুর্ভুজ গুহ*। ছকড়ি গুহ বিং সৎ জনাৰ্দ্দন বসু উপ রাম ঘোষ। দানং সৎ গোপিনাথ বসু উপ জিতামিত্র বসু গন্ধর্ব্ব মল্লিক। সুত রামচন্দ্র গুহ বিং উচিতং সষ্টিবর বসু উচিতং শ্রীকান্ত ঘোষ। দানং সৎ জগদানন্দ বসু উপ ভবানন্দ ঘোষ। সুতা বসুদৌ ভবানন্দ গুহ গুণানন্দ গুহ সিবানন্দগুহাঃ। ভবানন্দ গুহ বিং সৎ পরাশর ঘোষ উপ শ্রীনিবাস ঘোষ। দানং সৎ জগদানন্দ রায় সৎ শ্রীনিধি বসু উপ চতুর্ভুজ ঘোষ উপকড়িচাঁদ বসু। সুতা শ্রীহরি গুহ রাজা বিক্রমাদিত্য চন্দ্রশিখর গুহৌ। বিক্রমাদিত্য বিং সৎ বিষ্ণুঘোষ সৎ উগ্রকণ্ঠ বসু। দানং সৎ গোবিন্দ ঘোষ লস্কর উচিতং নয়নানন্দ বসু অত্যপ চাঁদরায় দেব। সুতৌ বসুদৌ রাজা প্রতাপাদিত্য ঘোষদৌ ভূপতি রায় লক্ষ্মীনাথ রায়াঃ। প্রতাপাদিত্য বিং সৎ জগদানন্দ রায় সৎ গোপাল ঘোষ— কবিশ্চন্দ্ৰ খাঁ নাগ। দানং উচিতং রাজবল্লভ রায় উপগ্রহ রাজা রামচন্দ্র পণং বিনা। সুতা নাগদৌ উদয়াদিত্য অন্তরায় সংগ্রাম রায় ঘোষ দৌ রামভদ্র রায় রাজীব লোচন রায় জগদ্বল্লভ রায়া। উদয়াদিত্য বিং সৎ কন্দর্প রায়। অনন্ত রায় বিংসৎ গোপালদাস বসু সুত বিজয়াদিত্য বিংসৎ রমাবল্লভ রায় বসু। সংগ্রাম রায় বিংসৎ চাঁদ বসু। রাম ভদ্ররায় বিংসৎ জগন্নাথ—। রাজীব লোচন বংশ নাস্তি। জগত বল্লভ রায় বিংসৎ গোবিন্দ লস্কর।*** চন্দ্রসিখর গুহ বিং সৎ শ্রীচন্দ্র বসু গুণানন্দ গুহ বিংসৎ জগদানন্দ বসু অত্যপ অনন্তদত্ত ইটনা। * দানং* উপকড়ি পৃথ্বীধর বসু সৎ পরমানন্দ বসু। সুতা কৃষ্ণদাস গুহ বিদ্যাধর রায় জানকীবল্লভ গুহ বসন্ত রায় *** বসন্ত রায় বিংসৎ জয়ন্ত ঘোষ সৎ মনোহর বসু অত্যপ কৃষ্ণদত্ত ইটনা (কন্যাদ্বয়ং)। দাং উপকড়ি রাজিব বসু উপ কন্দর্প রায় উচিত সুবানন্দ বসু। সুতা চণ্ডিদাস গুহ জগদানন্দ রায় নারায়ণ দাস রায় দত্ত দৌ রাজা জশহরজিত চাঁদ রায় রূপরায় বসুদৌ শ্রীরাম রায় গোবিন্দ রায় কমোল রায় পরমানন্দ রায় মধুসূদন রায় রমাকান্ত রায়াঃ। জগদানন্দ রায় বিংসৎ শ্রীবিষ্ণু বসু বংশ নাস্তি। *** রাজা জশহরজিত বিংসৎ চাঁদ বসু বংশ নাস্তি॥ *** শিবানন্দ মজুমদার বিংসৎ হয়গ্রিব ঘোষ উপকড়ি শ্রীকৃষ্ণ বসু। সুতা মুকুট রায় গোবিন্দ রায় বিষ্ণুদাস রায়াঃ॥’

কাড়াপাড়ার কারিকা,১ আশগুহ বংশ, ৯৯-১০০ পত্র

বিরাট গুহরে ৯ম পর্যায়ে আশ বা অশ্বপতি গুহ। তৎপুত্র গজপতি হইতে বংশাবলী উদ্ধৃত হইল। ইহা হইতে কতকগুলি নূতন তথ্য পাওয়া যাইতেছে। আমরা ক্রমান্বয়ে তাহার উল্লেখ করিতেছি :

১. সপ্তগ্রামে গিয়া রামচন্দ্র শ্রীকান্ত ঘোষের কন্যা বিবাহ করেন। সে স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্রগণের বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া সরকারী কার্য্যারম্ভ করিতে অন্ততঃ ২৫ বৎসর লাগে; কনিষ্ঠ শিবানন্দের কার্যারম্ভের পরও কয়েক বৎসর তাহারা সপ্তগ্রামে ছিলেন। এত দীর্ঘকাল রামচন্দ্র সপ্তগ্রামে ছিলেন বলিয়া মনে হয় না। বর্ত্তমান কারিকা হইতে পাওয়া যাইতেছে, ভবানন্দ প্রভৃতি তাহার প্রথম পক্ষের অর্থাৎ ষষ্ঠীবর বসুর কন্যার গর্ভজাত সন্তান। রামচন্দ্র রাজসরকারে প্রবেশ করিবার পর তাহারা পূর্ব্ববঙ্গ হইতে সপ্তগ্রামে আসেন।

২. এখানে দেখা গেল, বিক্রমাদিত্যের অন্য একটি ভ্রাতা ছিলেন–চন্দ্রশেখর গুহ এবং তিনি বিবাহিতও হইয়াছিলেন। কিন্তু তাহার কোন বংশবৃদ্ধির উল্লেখ নাই। সম্ভবতঃ তিনি বিক্রমাদিত্যের রাজা হইবার পূর্ব্বে মৃত্যুমুখে পড়েন; কারণ বিক্রমাদিত্যের রাজা হওয়ার পর তদ্বংশীয় সকলেরই উপাধি হইয়াছিল ‘রায়’, কিন্তু চন্দ্রশেখরের সে উপাধি নাই।

৩. বিক্রমাদিত্যের দুই বিবাহ; তন্মধ্যে উগ্রকণ্ঠ বসুর কন্যার গর্ভে প্রতাপাদিত্যের জন্ম হয়। অন্য অর্থাৎ ঘোষ দুহিতার গর্ভে ভূপতি রায় ও লক্ষ্মীনাথ রায় নামক অন্য দুই পুত্র ছিলেন। তন্মধ্যে লক্ষ্মীনাথের সন্ধান নাই; ভূপতি রায়ের বংশ ছিল; তাহার পুত্রের নাম মুকুটমণি। শাস্ত্রী মহাশয় ও নিখিলনাথ রায় যে কারিকা প্রকাশিত করিয়াছেন তাহা সম্ভবতঃ আধুনিক অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত। তাহাতে আছে, মুকুটমণি প্রতাপের পুত্র; কিন্তু সেকথা ঠিক নহে। ইদিলপুর, দেহেরগাতি ও কাড়াপাড়ার কারিকা হইতে প্রতাপের পুত্রগণের নাম পাওয়া গিয়াছে, কিন্তু তাহাতে মুকুটমণি নাই।

৪. প্রতাপাদিত্য গোপাল ঘোষের কন্যা বিবাহ করেন; তিনি গোপালদাস বসুর কন্যা বিবাহ করেন নাই, সে কন্যার সহিত তাহার পুত্র অনন্ত রায়ের বিবাহ হয়। মাল্‌খা নগরের কুরচিনামায় আছে :

‘দানং গোপাল বসুনা কৃতিনা জগতীতলে
বিক্রমাদিত্য তনয়ে প্রতাপাদিত্য সংজ্ঞকে।’[৩]

সে কথা ঠিক নহে। একাধিক কারিকা হইতে পাওয়া গিয়াছে যে, প্রতাপ গোপাল ঘোষের কন্যা বিবাহ করেন। নিখিলনাথও ইহাই স্থির করিয়াছেন।[৪] গোপালদাস বসু বিখ্যাত কুলীন ও বিশেষ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। যশোহর সমাজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গোপালদাস বসু বাক্‌লা চন্দ্রদ্বীপের রাজা পরমানন্দ বসু রায়ের সহিত কুল মৰ্য্যাদা বিষয়ে বিবাদ করিয়া যশোহরে আসেন।[৫] তাহার আবাসস্থান এখনও বসুর হাট বা বসির হাট বলিয়া খ্যাত;[৬] বসিরহাট ২৪-পরগণা জেলার একটি সবডিভিসন। এই কারিকা হইতে দেখিতেছি, তাহার কন্যার সহিত প্রতাপ-পুত্র অনন্ত রায়ের বিবাহ হইয়াছিল। সম্ভবতঃ প্রতাপাদিত্যের পতনের পর গোপালদাস বসু বসুর হাট হইতে চলিয়া গিয়া প্রথমে ঢাকায় ও পরে মাল্খা নগরে বাসস্থান নির্ণয় করেন। তাহারই নামানুসারে ঢাকা সহরের একটি অংশ বসুর বাজার বলিয়া আখ্যাত হয়। আওরঙ্গজেবের সময় গোপালদাসের পৌত্র দেবিদাস নওয়ারা মহল বা নাব বিভাগের কানুনগো ছিলেন। মাখা নগরে দেবিদাসের নির্ম্মিত ‘সেঘরা’ নামক সৌধে যে ইষ্টকলিপি আছে, উহা হইতে ১০৮৭ সন বা ১৬৮১ খৃষ্টব্দে পাই।[৭]

৫. প্রতাপের অন্য বিবাহ কবিশ্চন্দ্র খাঁ নাগের কন্যার সহিত হইয়াছিল, দেখিতে পাই। সম্ভবতঃ কবিশ্চন্দ্র খাঁ একটি উপাধি মাত্র, উহার প্রকৃত নাম জিতামিত্র নাগ। অন্যান্য কারিকায় জিতামিত্র নাগের কথাই আছে। রামরাম বসুর গ্রন্থে ‘নাগ-ঝি’র কথা আছে।[৮] নাগকন্যাই প্রতাপাদিত্যের পাটরাণী এবং তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র উদয়াদিত্যের মাতা।

৬. এই কারিকা হইতে দেখিতে পাইতেছি, প্রতাপের, দুই কন্যা ছিল। প্রথমটি রাজবল্লভ রায়ের সহিত বিবাহিত হয়। সে জামাতা রাজবাটিতে বাস করিতেন বলিয়া ঘটকেরা তাহাকে ‘উপগ্রহ’ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। অন্য কন্যার সহিত বালার অধিপতি রাজা রামচন্দ্রের সহিত বিবাহ হয়। সে কন্যার নাম বিন্দুমতী। বিন্দুমতী রাজা কীর্তিনারায়ণের জননী। তিনি রামচন্দ্র কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হইয়াছিলেন, এ উক্তি মিথ্যা।[৯]

৭. এতদিন উদয়াদিত্য ভিন্ন প্রতাপের অন্য পুত্রগণের নাম পাওয়া যায় নাই; এই কারিকায় সকল নাম স্পষ্টতঃ উল্লিখিত আছে। কেহ বলেন প্রতাপের একাদশ পুত্র ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বসন্ত রায়ের পুত্র সংখ্যা ১১ এবং প্রতাপের পুত্র সংখ্যা ৬। সম্ভবতঃ বসন্ত রায়ের একাদশ সংখ্যা ভুলক্রমে প্রতাপের স্কন্ধে অর্পিত হইয়াছে।[১০] প্রতাপের পুত্রগণ কেহই শিশু ছিলেন না; সকলেরই বিবাহ প্রতাপের জীবদ্দশায় হইয়াছিল। তাঁহার পতনের পর পুত্র কেহই জীবিত ছিলেন না; সুতরাং তাহাদের বিবাহ তাঁহার জীবদ্দশায় না হইয়া পারে না। শুধু তাহাই নহে; দ্বিতীয় পুত্র অনন্ত রায়ের একটি পুত্র সন্তান বিজয়াদিত্যও প্রতাপের জীবদ্দশায় ভূমিষ্ঠ হন। তাহারও বিবাহের উল্লেখ ঘটককারিকায় আছে। সম্ভবতঃ শেষ যুদ্ধের পর বিজয়াদিত্য-জীবিত ছিলেন এবং তাহার বিবাহ পরে হইয়াছিল। আমরা পরে এই বিষয়ে বিশেষ আলোচনা করিব I

৮. অধ্যাপক যদুনাথ সরকার মহোদয় ‘বহারিস্তান’ নামক ফার্সী গ্রন্থের অনুবাদ করিয়া সম্প্রতি প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে যে নূতন সংবাদ প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা হইতে জানিতে পারি ‘১৬০৮ খৃষ্টাব্দের শেষভাগে প্রতাপাদিত্যের দূত সেখ বদী ঐ রাজার কনিষ্ঠপুত্র সংগ্রাম আদিত্যকে সঙ্গে করিয়া আনিয়া রাজমহলে নবাব ইসলাম খাঁর সহিত সাক্ষাৎ করাইল।’[১১] সংগ্রামাদিত্য যে প্রতাপের কনিষ্ঠপুত্র তাহা এই কারিকা হইতে জানা গেল। পূৰ্ব্বে ইহা জানা ছিল না।

৯. গাভবসু বংশীয় পরমানন্দ রায় গুণানন্দের কন্যা ভবানী দেবীকে বিবাহ করেন এবং তদবধি তিনি কুলগ্রন্থ নিচয়ে ‘ভবানীপরমানন্দরায়’ এরূপ জোড়ানামে পরিচিত হইয়াছেন। ভবানী দেবী বসন্ত রায়ের কন্যা নহেন।[১২] কারিকায়ও তাহা দেখিতে পাই না। পরমানন্দ ও বসন্ত রায় উভয়ে ১৪ পৰ্য্যায়ভুক্ত। পরমানন্দের সহিত ১৫ পর্যায়ের কন্যার বিবাহ হয় নাই।

১০. রামচন্দ্রগুহের সরকারী কার্য্যে নিয়োগের পর হইতে তাঁহার ‘নিয়োগী’ উপাধি হয়। ক্রমে তদ্বংশীয়দিগের প্রতিপত্তি বাড়িতে থাকে, নিয়োগীর পুত্রগণ ‘মজুমদার’ উপাধি পান এবং মজুমদারের পুত্রগণ রাজা হন এবং ‘রায়’ উপাধি ধারণ করেন। উপাধির সঙ্গে সঙ্গে অনেকের আদি বা রাশিনামও বদলাইতে থাকে। শ্রীহরি ও জানকীবল্লভের নামের পরিবর্তন আমরা জানি। বসন্ত রায়ের একটি ভ্রাতা ছিলেন কৃষ্ণদাস গুহ; তাহার নাম পরিবর্তন হইয়া বিদ্যাধর রায় হইয়াছিল। এইরূপে বসন্ত রায়ের পুত্র চণ্ডীদাস গুহের নাম হয়— জগদানন্দ রায়। বরিশাল- দেহেরগাতির প্রসিদ্ধ ঘটকগণের কুলগ্রন্থ হইতে আমি যে বিবরণ গ্রহণ করিয়াছি, তাহা হইতে দেখা যায়; প্রতাপ ও তাঁহার পুত্রগণের সকলেরই নামের পরিবর্তন হইয়াছিল। সে কারিকা অনুসারেও প্রতাপের পুত্র সংখ্যা ৬ এবং তাহাদের নামের সহিত বর্ত্তমান কারিকার সম্পূর্ণ মিল আছে। প্রতাপাদিত্যের নিজের পূর্ব্বনাম গোপীনাথ এবং তাঁহার পুত্র উদয়াদিত্যের পূর্ব্ব নাম জগন্নাথ। দ্বিতীয় পুত্র অনন্ত রায়ের নাম হইয়াছিল প্রতাপ-নরেন্দ্র, সংগ্রাম রায় বা সংগ্রামাদিত্যের অন্য নাম প্রতাপ-কর্ণ, রামভদ্রের নাম প্রতাপ-ভীম, রাজীবলোচনের পরবর্তী নাম প্রতাপ-অৰ্জ্জুন এবং জগদ্বল্লভের নাম হইয়াছিল প্রতাপচন্দ্র; পঞ্চপুত্রের কেহই কিন্তু প্রতাপ বৰ্জ্জিত নহেন। প্রতাপের পুত্রগণের নূতন নামগুলি বর্তমান রাজবংশীয়দিগের মধ্যে কেহ কেহ জানেন। কিন্তু এ সম্বন্ধে ভুল ধারণা চলিয়া আসিতেছে। আশা করি, বর্তমান কারিকাগুলি হইতে সে সন্দেহের নিরসন হইবে।

১১. শিবানন্দের পুত্রগণের নাম সম্বন্ধে অন্য কারিকার সহিত কিছু অমিল হইতেছে। শিবানন্দ ভ্রাতৃগণের সহিত মনোমালিন্য-সূত্রে যশোহরে আসেন নাই; কথিত আছে, তিনি পূর্ব্ববঙ্গে চাঁদপ্রতাপের অন্তর্গত রোয়াইলে বাস করেন; নিখিলনাথ ‘কায়স্থ-বংশাবলী’ নামক গ্রন্থ হইতে দেখাইয়াছেন, বিষ্ণুদাস পরে পূর্ব্ববঙ্গ হইতে যশোহরে আসিয়াছিলেন। তাহার নাম লইয়া বৰ্ত্তমান কারিকার কোন অমিল নাই। কেবল মাত্র হরিদাস ও গোপালদাস স্থলে মুকুট রায় ও গোবিন্দ রায় পাই। গোপাল ও গোবিন্দ ভুল হওয়া অসম্ভব নয় এবং হরিদাসের অন্য নাম মুকুট রায় হইতে ও পারে। মুকুট রায় নামটি অনেকস্থলে উপাধিস্বরূপই লক্ষ্য করিয়াছি। যাহা হউক, তিন পুত্রের মধ্যে অন্য কোন বংশ খ্যাতিলাভ না করুন, হরিদাসের বংশ পুনরায় সমুজ্জ্বল হইয়াছিল। তাহার পৌত্র রাজনারায়ণ মুর্শিদাবাদের নবাব-সরকারে কানুনগো দপ্তরের সর্বোচ্চ পদ লাভ করিয়া মজুমদার হন; তাঁহার ভ্রাতা গোপীকান্তের বৃদ্ধপ্রপৌত্র উদয়চন্দ্র প্রথমতঃ সামান্য বেতনে উক্ত নবাব-সরকারে প্রবিষ্ট হইয়া স্বীয় প্রতিভাবলে নায়েব দেওয়ানের পদ পান এবং দেওয়ান রাজা পরেশনাথের মৃত্যুর পর কিছুদিন কার্য্যতঃ দেওয়ানের কার্য্য করিয়া ‘রায়রাইয়া’ খেতাব ও অশেষ সম্মানভাজন হন।[১৩] কিন্তু পদের গৌরব অপেক্ষাও তিনি চরিত্র, ধর্মপ্রাণতা ও দানশীলতার গৌরবে দেশে বিদেশে খ্যাতি মণ্ডিত হইয়াছিলেন।[১৪]

পাদটীকা :

১. এই কারিকা সম্ভবতঃ পূৰ্ব্ববঙ্গীয় প্রামাণিক ও অতি পুরাতন কারিকা। কাড়াপাড়া নিবাসী সারদাচরণ কাঞ্জারী মহোদয়ের নিকট হইতে এই কারিকা সংগ্রহ করি।

২. ‘প্রতাপস্যাপরঃ সুতো মুকুটমণিসংজ্ঞকঃ।’ —নিখিলনাথ রায়, ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ৩৪২ ও ৪৮১ পৃ। ইদিলপুরের ঘটককারিকায় মুকুটমণি ভূপতি রায়ের পুত্র বলিয়া উল্লিখিত। শাস্ত্রীমহাশয়ের কারিকা যে আধুনিক তৎসম্বন্ধে নিখিলনাথ রায়, ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ৩৬৩-৪ পৃ দ্রষ্টব্য।

৩. ‘ঢাকা রিভিউ ও সম্মিলন’, ১৩১৯, ৪র্থ সংখ্যা, ১৭১ পৃ।

৫. ‘প্রতাপাদিত্য’, ৯১ পৃ; ‘বঙ্গীয় সমাজ’, ১৫২ পৃ।

৫. রোহিণীকুমার সেন, ‘বাক্‌লা’, ১৬৫ পৃ।

৬. ‘ঢাকা রিভিউ’ ২য় খণ্ড, ১৩১৯, ১৭১ পৃ।

৭. ‘ঢাকা রিভিউ’, উক্ত সংখ্যা, ১৭২ পৃ।

৮. ‘প্রতাপাদিত্য’, ৯১ পৃ; রামরাম বসুর গ্রন্থ (মূল সংস্করণ), ১৫১ পৃ [‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ৬৩ পৃ— শি মি

৯. নিখিলনাথ রায় ‘প্রতাপাদিত্যে’র ১৪৮ পৃষ্ঠায় যাহা বলিয়াছেন, তাহার ভিত্তি নাই। এ বিষয় আমরা পরে আলোচনা করিব।

১০. নিখিলনাথ রায়, ‘প্রতাপাদিত্য’, মূল ৪৮১ পৃ।

১১. ‘প্রবাসী’, ১৩২৭, কার্তিক, ২ পৃ [শনিবারের চিঠি’, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৫৫,— পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য—শি মি]।

১২. ‘বঙ্গীয় সমাজ’, ২০৫ পৃ।

১৩. রাজা পরেশনাথ যশোহরের অন্তর্গত পাজিয়ার বসুবংশের একজন কৃতী পুরুষ। ১৮৩৯ খৃষ্টাব্দে তিনি মুর্শিদাবাদের দেওয়ান ছিলেন। তাঁহার বংশধরগণ এখনও পাঁজিয়ায় বাস করিতেছেন। এই প্রসিদ্ধ কায়স্থ প্রধান গ্রাম যশোহর হইতে দক্ষিণ পূর্ব্বকোণে ২৬ মাইল দূরে অবস্থিত।

১৪. Mazumdar, Purnachandra-musnad of Murshidabad, pp. 166-8.

সকল অধ্যায়

১. ১. উপক্রমণিকা
২. ২. পাঠান রাজত্বের শেষ
৩. ৩. বঙ্গে বারভুঞা
৪. ৪. প্রতাপাদিত্যের ইতিহাসের উপাদান
৫. ৫. পিতৃ-পরিচয়
৬. ৬. পাঠান রাজত্বের পরিণাম ও যশোর-রাজ্যের অভ্যুদয়
৭. ৭. যশোর-রাজ্য
৮. ৮. বসন্ত রায়
৯. ৯. যশোহর-সমাজ
১০. ১০. গোবিন্দদাস
১১. ১১. বংশ-কথা
১২. ১২. প্রতাপাদিত্যের বাল্যজীবন
১৩. ১৩. আগ্রার রাজনীতি ক্ষেত্ৰ
১৪. ১৪. প্রতাপের রাজ্যলাভ
১৫. ১৫. যশোরেশ্বরী
১৬. ১৬. প্রতাপাদিত্যের রাজধানী
১৭. ১৭. প্রতাপের আয়োজন
১৮. ১৮. মগ ও ফিরিঙ্গি
১৯. ১৯. প্রতাপের দুর্গ-সংস্থান
২০. ২০. নৌ-বাহিনীর ব্যবস্থা
২১. ২১. লোক-নির্বাচন
২২. ২২. সৈন্যগঠন
২৩. ২৩. প্রতাপের রাজত্ব
২৪. ২৪. উড়িষ্যাভিযান ও বিগ্ৰহ-প্ৰতিষ্ঠা
২৫. ২৫. বসন্ত রায়ের হত্যা
২৬. ২৬. সন্ধি-বিগ্রহ
২৭. ২৭. খৃষ্টান পাদরীগণ
২৮. ২৮. কার্ভালো ও পাদ্রীগণের পরিণাম
২৯. ২৯. রামচন্দ্রের বিবাহ
৩০. ৩০. প্রথম মোগল-সংঘর্ষ : মানসিংহ
৩১. ৩১. মানসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ ও সন্ধি
৩২. ৩২. দ্বিতীয় মোগল-সংঘর্ষ : ইসলাম খাঁ
৩৩. ৩৩. শেষ যুদ্ধ ও পতন
৩৪. ৩৪. প্রতাপাদিত্য সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৩৫. ৩৫. যশোহর-রাজবংশ
৩৬. ৩৬. যশোহরের ফৌজদারগণ
৩৭. ৩৭. নলডাঙ্গা রাজবংশ
৩৮. ৩৮. চাঁচড়া রাজবংশ
৩৯. ৩৯. সৈয়দপুর জমিদারী
৪০. ৪০. রাজা সীতারাম রায়
৪১. ৪১. সীতারাম : বাল্যজীবন ও জমিদারী
৪২. ৪২. সীতারাম : রাজ্য ও রাজধানী
৪৩. ৪৩. সীতারাম : রাজত্ব ও ধৰ্ম্মপ্রাণতা
৪৪. ৪৪. সীতারাম : মোগল সংঘর্ষ ও পতন
৪৫. ৪৫. সীতারাম : বংশ, রাজ্য ও কীর্ত্তির পরিণাম
৪৬. ৪৬. সীতারাম সম্পর্কিত কয়েকটি বংশ
৪৭. ৪৭. প্রাক্-ইংরাজ আমলে রাজন্য-বংশ
৪৮. ১. বৃটিশ-শাসন ও হেঙ্কেলের কীৰ্ত্তি
৪৯. ২. যশোহর-খুলনা : গঠন ও বিস্তৃতি
৫০. ৩. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
৫১. ৪. ভূসম্পত্তির স্বত্ব-বিভাগ
৫২. ৫. নড়াইল জমিদার-বংশ
৫৩. ৬. নব্য জমিদারগণ
৫৪. ৭. বাণিজ্য-তুলা, চিনি ও নীল
৫৫. ৮. নীলের চাষ ও নীল-বিদ্রোহ
৫৬. ৯. রেণী ও মরেল-কাহিনী
৫৭. ১০. সমাজ ও আভিজাত্য
৫৮. ১১. শিল্প ও স্থাপত্য
৫৯. ১২. সাহিত্য
৬০. এক – প্রতাপাদিত্যের পতন
৬১. দুই – প্রতাপাদিত্যের সভায় খ্রীষ্টান পাদরী
৬২. তিন – প্রতাপাদিত্য সম্বন্ধে কিছু নূতন সংবাদ
৬৩. সতীশচন্দ্র মিত্র

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন