সতীশচন্দ্র মিত্র
১৩২৫ সালে দিল্লীভ্রমণের সময় আমার বন্ধু অধ্যাপক আবদুর রহমানের সাহায্যে একখান পুরাতন ফার্সী হস্তলিপি পাই। ইহাতে বঙ্গের নূতন দেওয়ানের অনুচর ও সঙ্গী আবদুল লতীফ্ গুজরাটের আহমদাবাদ শহর হইতে বঙ্গের ঘোড়াঘাট পর্যন্ত নিজ ভ্রমণ কাহিনী লিখিয়াছেন। যতদূর জানা যায় এই পুস্তক পৃথিবীতে আর কোথাও নাই।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বের প্রথমে, শেখ আলাউদ্দীন চিশতী, ওরফে ইসলাম খাঁ (আকবরের পীর শেখ সলীম চিন্তীর পৌত্র), বাংরার সুবাদার নিযুক্ত হইলেন। আবদুল লতীফু, আবদুল্লা আব্বাসীর পুত্র ও আহমদাবাদের অধিবাসী। তাঁহার প্রভু আবুল হসন্ (পরে আসফ খাঁ উপাধিতে ভূষিত, এবং শাহজাহানের শ্বশুর ও সাম্রাজ্যের উজীর) ১৬০৮ খৃষ্টাব্দে বঙ্গের দেওয়ান নিযুক্ত হইয়া, আগ্রা হইতে বঙ্গদেশে আসেন। লতীফ্ তাঁহার অনুচর ও সঙ্গী ছিলেন।
নওয়ারায় (বাদশাহী যুদ্ধ-নৌকায়) চড়িয়া আমরা গঙ্গা বহিয়া আকবরনগর (-রাজমহল) হইতে নৌরাঙ্গাবাদ জেলার অন্তর্গত গোয়াশ্ পরগণা পর্যন্ত গেলাম। [মুর্শীদাবাদ ও জলঙ্গী এই দুটি শহরের মাঝামাঝি গোয়াশ্ এক্ষণে পদ্মা হইতে ৮ মাইল দক্ষিণে। কিন্তু ১৭৮১ খৃঃ প্রকাশিত রেনেলের ‘বেঙ্গল অ্যাটলাস্’ গ্রন্থের ১০ নং ম্যাপে দেখা যায় যে, গঙ্গার প্রাচীন পথ গোয়াশের অতি অল্প উত্তরে ছিল।] গৌড়, তাঁড়া, মালদা ও পাণ্ডুয়া শহর বামে রহিল; আমরা তথায় নামিলাম না।
২রা জানুয়ারি ১৬০৯ খৃঃ নবাব ইসলাম খাঁর দূত মির্জা আলীর সহিত উমান্ আ্যানের দূত আসিয়া সুবাদারের সাক্ষাৎ করিল। উসমান্ বশ্যতা স্বীকার ও রাজভক্তি প্রকাশ করিয়া এবং নিজ ভ্রাতার সহিত বাদশাহের জন্য উপহার পাঠাইবেন এরূপ প্রতিজ্ঞা করিয়া পত্র লিখিয়াছেন।
[স্থানীয়] কর্মচারীদের সহিত পরামর্শ করিয়া এইরূপ স্থির হইল যে, নবাব গোয়াশের কাছে গঙ্গানদীর তীরে নামিবেন এবং তাহার পর হয় ভাটী প্রদেশের দিকে, না হয় উমান আফ্ফানের দেশে যাইবার পথের আরম্ভ ঘোড়াঘাটে-মন্ত্রীরা যেদিকে ভাল মনে করেন,—সৈন্য সহ রওনা হইবেন। নদী পার হইবার সময়, মহমুদাবাদ জেলার অন্তর্গত ভূষণার জমিদার রাজা শত্রুজিৎ ওরফে শাহজাদা রায়ের ভ্রাতা, কয়েকটি হাতী লইয়া আসিয়া নবাবের সহিত দেখা করিলেন, এবং যশোহরের রাজা প্রতাপাদিত্যের দরখাস্তও পেশ করিলেন। এই প্রতাপাদিত্যের মত সৈন্য ও অর্থবলে বলী রাজা আর বঙ্গদেশে নাই। তাঁহার যুদ্ধ-সামগ্রীতে পূর্ণ প্রায় সাত শত নৌকা, বিশ হাজার পাইক (পদাতিক সৈন্য) এবং ১৫ লক্ষ টাকা আয়ের রাজ্য আছে। তাঁহার পুত্র কয়েকটি হাতী ও অন্যান্য উপহার লইয়া রাজমহলে নবাবের সহিত দেখা করিয়াছিল এবং তাঁহার নিকট হইতে অভয়বাণী পাইয়া [দেশে] ফিরিয়া যায়। প্রতাপাদিত্য জিজ্ঞাসা করিয়া পাঠান, ‘আমি কি নিজে আসিব?’
মুহম্মদ ইয়ার নামক দূত কোঁচ-রাজা মুকুটনারায়ণের পক্ষ হইতে ৩টি হাতী ও ৮০টি টাঙ্গন ঘোড়া উপহার লইয়া আসিয়া নবাবের সহিত দেখা করিল। এই টাঙ্গনগুলি পার্বত্য টাটু, মহিষের মত রঙের, জঙ্গল ও জনহীন স্থানে চলে, কিন্তু বড় শক্ত, পরিশ্রম সহিষ্ণু এবং সুন্দর পথ চলে।
শাহজাদা রায় এবং রাজা প্রতাপাদিত্যের আগমনের অপেক্ষায় আমরা দুই এক মাস নৌরঙ্গাবাদ জেলার আলাইপুর গ্রামে রহিলাম। [পদ্মার তীরে রাজশাহী জেলার শরদহের অপর পারে আলাইপুর নামক একটি গ্রামে এখন স্টীমার থামে। কিন্তু পদ্মার গতি তিন শত বৎসরে এত বদলাইয়াছে যে ঠিক এইখানে নবাব বাস করিয়াছিলেন অথবা পদ্মার পাড় ভাঙিয়া যাওয়ায় নিকটের কোন গ্রামকে আলাইপুর নাম দেওয়া হইয়াছে কি না, তাহা বলা কঠিন।]
আলাইপুরের এক যোজন (ফসখ=৩ মাইল) দূরে দুই গ্রাম আছে, –তাহার একটির নাম বাঘা, ইহা পরগণা চন্দনাবাজুর অন্তর্গত; অপরটির নাম মূল্ক [? বা বল্ক], আলাইপুর পরগণার অন্তর্গত।[২]
হাওয়াদ্হা (?) মিয়া নামক একজন জ্ঞানী বৃদ্ধ বাঘাতে বাস করিতেছেন। তাঁহার বয়স প্রায় একশত বৎসর। এই গ্রামের মধ্যে একটি সুমিষ্ট জলের পুষ্করিণী আছে। তাহার চারিপাড়ে ইঁহার পুত্র ও অনুচরগণ চক্রবন্দী করিয়া গৃহ নির্মাণ করিয়াছে। ৯৩০ হিজরীতে সুলতান হুসেন শাহ কর্তৃক নির্মিত একটি মসজিদ্ এই গ্রামে আছে।[৩] হাওয়াদ্হা মিয়ার বাড়িতে একটি মাদরাসার মত আছে; চালগুলি খড়ের, দেওয়াল মাটি দিয়া লেপা [অর্থাৎ চেরা বাঁশের বা চাটাইয়ের]। তাঁহার অনেক অনুচর (? প্রজা) ও অন্য বিদ্যার্থী এখানে শিক্ষালাভে নিযুক্ত। পুকুরের পাড়ে আম- কাঁঠালের গাছ, সবুজ সজল ও ছায়াপ্রদ। গ্রামের চতুঃপার্শ্বের জমি ইঁহাকে ব্রহ্মোত্র (মদদ্-ই-মাশ) স্বরূপ দেওয়া হইয়াছে—সব সবুজ ও মনোরঞ্জক। বঙ্গদেশে এই গ্রাম ভিন্ন এমন একটি স্থান দেখিলাম না, যেখানে ইসলামের গন্ধ নাকে পৌঁছে। আহা! এই নিরিবিলি কোণের অধিবাসীদের কি সুখেই দিন কাটে! ইহারা পৃথিবীর অন্য লোকের খবর রাখে না। আর অন্য কোন লোকও ইহাদের সহিত কোন সম্বন্ধ করে না। আশা করি সকল পরমসত্যানুসন্ধানীরই কপালে যেন এইরূপ নির্জন আরামের কুঞ্জ জুটে!
আলাইপুরে নবাব বঙ্গদেশস্থ বাদশাহী নওয়ারা ও তোপখানার মহলা (review) দর্শন করিলেন। ২রা মার্চ ১৬০৯ খৃঃ আলাইপুর ছাড়িয়া নাজিরপুরের দিকে কুচ আরম্ভ হইল। পথে ফতেপুরে থামিয়া ইদ্-ই-কুর্বান ও নৌরোজ উৎসব নির্বাহ করা হইল। এখানে ভূষণার রাজা শত্রুজিৎ আসিয়া দেখা করিলেন; ১৮ টা হাতী উপহার দিলেন। আমরা প্রায় এক মাস ফতেপুরে কাটাইলাম।
ফতেপুর হইতে ৩০এ মার্চ কুচ করিয়া রাণা তাণ্ডাপুর পৌঁছিলাম। এখানে উড়িষ্যার অন্তর্গত হিজলীর জমিদার সলীম খাঁ, পাচেটের রাজা ইন্দ্রনারায়ণের ভ্রাতা, মন্দারণের রাজার পিতৃব্যপুত্র, [একুনে] ১০৯টি ছোট বড় হাতী লইয়া আসিয়া নবাবের সহিত দেখা করিলেন। নবাবের বিশ্বাসী প্রিয় কর্মচারী শেখ কমাল্ তাঁহাদিগকে উপস্থিত করিল।
‘বাজু-ই-রাস্ত’ এর অন্তর্গত বজ্রপুর নামক গ্রামে, ২৬এ এপ্রিল রাজা প্রতাপাদিত্য আসিয়া নবাবের সহিত সাক্ষাৎ করিলেন। [নাটোর শহরের ১৫ মাইল উত্তরে এবং শুটিগাছার ৪ মাইল দক্ষিণে বজ্রপুর; রেনেল ৬নং ম্যাপ। জ্যারেটের আইন-ই-আকবরী, ২-১৩২ পৃ একটা বাজু-ই- রাস্ত আছে; কিন্তু তাহা এ স্থান নহে।] তিনি ৬টা হাতী, মূল্যবান দ্রব্য, কর্পূর, অগুরু, প্রায় পঞ্চাশ হাজার নগদ টাকা ও অন্যান্য উপঢৌকন দিলেন। কয়েকদিন নবাবের দরবারে উপস্থিত থাকিবার পর বিদায় লইলেন।
৩০এ এপ্রিল বজ্রপুর হইতে কুচ করিয়া শাহপুর পৌঁছা গেল। যমুনার ধারে বাস হইল। নবাব তথায় সৈন্যনিবাস রাখিয়া নাজিরপুরে গিয়া নয় দিন তথাকার জঙ্গলে থাকিয়া ৩২টা হাতী ধরিলেন। তাহার পর যমুনার উপর পুল বাঁধিয়া পার হইয়া ঘোড়াঘাটে ২রা জুন উপস্থিত হইলাম। তথায় চালা (ছাপর) বাঁধিয়া সকলে বর্ষা-যাপন করিল। [শাহপুর, ঘোড়াঘাটের ৩৫ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে, ইহার পাশের নদীর নাম জবুনা = যমুনা, রেনেলের ৫নং ম্যাপ।]
যশোহরের জমিদার প্রতাপাদিত্যের পিতা রাজা শ্রীহরি কাশীতে একটি অতি উচ্চ মন্দির নির্মাণ করেন, তাহা মানসিংহের মন্দির অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট। জাহাঙ্গীর যুবরাজ অবস্থায় উহা ভাঙ্গিয়া ফেলিতে হুকুম দেন, কিন্তু মানসিংহের মিনতিতে মন্দিরটি রক্ষা পায়।
শ্রীযদুনাথ সরকার।
.
পাদটীকা :
১. [স্যর যদুনাথ সরকারের এই প্রবন্ধ প্রথমে ‘প্রবাসী’, ১৩২৬, আশ্বিন সংখ্যায় এবং কিছু সংস্কারান্তে পুনরায় ‘শনিবারের চিঠি’, ১৩৫৫, আষাঢ় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।—শি মি]
২. বাঘা—এই স্থানটি রাজশাহী জেলার মধ্যভাগের দক্ষিণ সীমায়, সরদহ হইতে সাত মাইল সোজা দক্ষিণে। ১৮৩৬ খৃিঃ প্রকাশিত এডাম সাহেব-এর Second Report on Education in Bengal (pp. 37-42)- তে ইহার মাদ্রাসার বর্ণনা আছে। সে সময়কার মালিক এক বাদশাহী সনদ দেখান, যাহাতে ‘মৌলানা…..’ কে আট হাজার টাকা বার্ষিক আয়ের জমি ‘মদদ্-ই-মাশ (লাখরাজ) দেওয়া হইয়াছে (বোধ হয় শাহজাহান কর্তৃক); ঐ জমি ১৮৩৫ খৃিঃ পর্যন্ত মাদ্রাসার কর্তার দখলে ছিল, এবং ইংরেজ সরকার ঐ স্বত্ব মানিয়া লইয়াছেন। এডাম সাহেবের মন্তব্য— ‘The institution has no organisation or discipline, and the course of instruction is exceedingly meagre… The students leave [the Madrasal sooner or later according to their own caprice. Their attendance from day to day is equally uncontrolled and unregulated.’
৩. ৯৩০ লিপিকরের ভ্রম; ঠিক তারিখ ৯০৩ অথবা ৯২০ হইবে, কারণ হুসেন শাহের ৯২৫ এ মৃত্যু হয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন