কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ চলছে। সূর্যাস্তের পর যুদ্ধ বন্ধ থাকে। যুদ্ধ শেষে উভয় পক্ষ আপন আপন শিবিরে বসে আগামী দিনের যুদ্ধের পরিকল্পনা রচনা করে। কখনও বা উভয়পক্ষের যোদ্ধারা উভয় পক্ষের শিবিরে গমন করে সৌজন্য বিনিময় করে।
যেদিনের কথা বলছি, সেদিন সবে দিবাবসানে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষিত হয়েছে। ক্লান্ত, ক্ষত-বিক্ষত যোদ্ধারা বিশ্রামার্থে শিবির অভ্যন্তরে গমনোদ্যত—এমন সময়ে দেখা গেল, শ্বেত অশ্বযুক্ত একখানি রথ কুরুক্ষেত্রের অদূরে যমুনা নদীর দিকে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে। রথ যখন যমুনাতটে পৌঁছলো তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ-রাত্রির গাঢ় অন্ধকার যমুনার বুকে নেমে এলেও যমুনার জলকে সেই অন্ধকারের ঘনত্ব আচ্ছন্ন করতে পারেনি। আঁধারের মাঝেই খদ্যোত মালা শোভিত নীলাকাশ তার বুকে প্রতিবিম্বিত—আঁধারের বক্ষ বিদীর্ণ করে রূপালি আলোর তরঙ্গে কলকল নাদে বয়ে চলেছে আপন লক্ষ্যের দিকে।
শ্বেতাশ্ব যুক্ত রথ থেকে নামলেন সারথি—তাঁর শ্রীপাদস্পর্শে যমুনার তট পুলকিত—তাঁর দৃষ্টিপাতে যমুনার অশান্ত বীচিমালা রোমাঞ্চিত। সারথি যমুনার তটে অবতরণপূর্বক অশ্বগুলিকে রথের রশি হতে মুক্ত করলেন—তারপর তাদের সারা গায়ে শ্রীকরকমল স্পর্শ করে—তাদের প্রত্যেকের মুখ ও শিরদেশ চুম্বন করে তাদের নিয়েই যমুনার জলে অবতরণ করলেন। অশ্বগুলি যমুনার জল পান করছে। তিনি অঞ্জলি দ্বারা জল সিঞ্চন করে প্রাণীগুলির গাত্রমার্জনে মনোনিবেশ করলেন, গাত্রমার্জন সমাপন হলে প্রাণীগুলিকে যমুনার তটে কোমল তৃণভোজনে নিযুক্ত করলেন। অশ্বগুলি তৃণ খায় আর মাঝে মাঝে সারথির দিকে তাকায়। সারাদিন আরোহীসহ যুদ্ধের রথ টেনে বহন করা বড় কষ্টকর—ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় শরীরে বড় ক্লেশ অনুভূত হয় তাদের। তাই সারথি প্রতিদিন যুদ্ধের শেষে যমুনায় এসে তাদের অঙ্গ মার্জনা করে ক্লান্তি দূর করেন—কচি তৃণ খাইয়ে তাদের ক্ষুধা নিবৃত্তি করেন। এমন দরজী প্রভুকে তাই তারা নয়নের ভাষা দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানায়। কখনও তাঁর দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে দূরে বিচরণ করতে যায় না। অশ্বগুলি তৃণ খেতে শুরু করেছে দেখে—সারথি পুনরায় রথের কাছে এসে রথটিকে টানতে টানতে রথসহ যমুনার জলে অবতরণ করলেন। রথখানিকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে নিরীক্ষণ পূর্বক ধৌত করতে থাকেন। রথগাত্র হতে ধূলি-ময়লা-রক্তচিহ্ন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হলে পুনঃ রথখানিকে যমুনার তটে স্থাপন করেন এবং স্বয়ং আপনি যমুনা-সলিলে অবগাহনার্থে অবতরণ করলেন—তাঁর কোমলাঙ্গের জায়গায় জায়গায় ক্ষতচিহ্ন ফুটে উঠেছে বিপক্ষ যোদ্ধাদের শরাঘাতে। কোথাও রক্ত ঝরতে ঝরতে একসময় জমাট হয়ে জমে উঠেছে—কোথাও বা রক্ত তখনও ঝরে চলেছে। যমুনার জলস্পর্শে ক্ষতস্থানগুলিতে দহনজ্বালা শুরু হল। যন্ত্রণায় সারথির শ্রীমুখ হতে নির্গত হল ‘ব্যথাকাতর ধ্বনি-‘আঃ!’ অদূরে বিচরণগত অশ্বগুলি সে ধ্বনি শুনে ছুটে আসে তাদের প্রিয় প্রভুর কাছে। সারথি স্বীয় অঙ্গ ধৌত করে বসনাঞ্চল দ্বারা সিক্ত কলেবর আলতোভাবে মর্দন করেন—তারপর জল থেকে উঠে এসে অশ্বগুলিকে বললেন,—”কিরে তোরা তৃণভক্ষণ না করে চলে এলি যে?” যাকে কেন্দ্র করে সকল বাক স্ফুরিত হয়, সেই পরমপ্রিয় প্রভুর দিকে চেয়ে নির্বাক অশ্বগুলি বাকমুখর হয়ে উঠল—তারা সমস্বরে বলে ওঠে—”প্রভু, তোমার অঙ্গের যন্ত্রণায় আমাদের বুক ফেটে যাচ্ছে—সারাদিন তুমি কিছু খাওনি, শরীরের উপর দিয়ে কত ধকল গেছে—তার উপর এই ক্ষতস্থানের যন্ত্রণা—তোমার এই কষ্ট দেখে আমরা কোন মুখে তৃণ আহার করবো প্রভু’? অশ্বদের কথায় সারথির অধঃপুটে মৃদু হাসির ঝিলিক যমুনাতটের গাঢ় অন্ধকারকে ম্লান করে আলোয় ভরিয়ে দিল। তিনি অশ্বগুলিকে আদর করে বলতে থাকেন,—”না রে! আমার তেমন কষ্ট হচ্ছে না। তোরা আমার জন্য না ভেবে তৃণ ভক্ষণ করগে যা, রাত্রি প্রভাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তোদের আবার রথ টানতে হবে। অদূরে ঐ যে গুল্মের ঝোপ রয়েছে আমি ওখান থেকে কিছু ওষধিলতা সংগ্রহ করে, তার রস ক্ষতস্থানে প্রলেপ দিলেই সব নিরাময় হয়ে যাবে। আমার জন্য ভাবিস না,”—এই বলে সারথি গুল্ম ঝোপের দিকে অগ্রসর হলেন। অশ্বগুলি প্রভুর দিকে চেয়ে থাকে নির্নিমেষ নয়নে। সারথি কিয়ৎক্ষণ পর ক্ষতস্থানে ভেষজ রসের প্রলেপ দিয়ে প্রত্যাবর্তন করলেন রথের কাছে। অশ্বগুলি বিচরণ করতে করতে একসময় নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ল। সারথি রথের অভ্যন্তরে স্থিত বসন নিয়ে বস্ত্র পরিবর্তন করলেন। তারপর যমুনার তটে উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে সবুজ তৃণের উপর একখানি উত্তরীয় বিছিয়ে তার উপর উপবেশন করে ধ্যানে ডুবে গেলেন।
মধ্যযাম! অশ্বগুলি নিদ্রান্তে পুনঃবিচরণরত। যমুনার দুই তটে প্রচুর বৃক্ষরাজি ও ছোট ছোট তৃণগুল্মের জঙ্গল। সেখান থেকে কখনও কখনও দু-একটা নিশাচর পাখির ডাক ভেসে আসে। এমন সময় একজন দিব্যাঙ্গী তরুণী যমুনার গর্ভ হতে উত্থিত হয়ে সারথি যেখানে ধ্যানাসীন সেখানে মৃদু পদ সঞ্চালনে উপনীতা হলেন। অপলক নয়নে দেখতে থাকেন ধ্যানাবিষ্ট সারথির রূপমাধুরী। সারথির ধ্যানমগ্ন রপ দেখতে দেখতে তন্বীর মানসপটে ভেসে ওঠে অতীতের স্মৃতি—সে স্মৃতি আঁকা আছে বৃন্দাবনের যমুনার হৃদয় পটে। বৃন্দাবনে যমুনার কালীদহে বাস করতো কালিয় নাগ। তার নিঃশ্বাসে কালীদহের জল ছিল বিষাক্ত অপেয়। সেই জল পান করে বৃন্দাবনের গোপ রাজের ছোটলালার খেলার সঙ্গীরা অচৈতন্য হয়ে পড়ে। সংবাদ পেয়ে ছোটলালা ছুটে যায় সেখানে—দাদা বলরাম সেদিন সঙ্গে ছিল না—তাই বিনা বাধায় সেখানে উপনীত হয়ে কালীদহের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে নন্দরাজের ছোটলালা। শব্দ শুনে ছুটে আসে কালীনাগ। বিষাক্ত ছোবল বসায় ছোটলালার কোমল অঙ্গে। বিষের যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে ছোটলালা—চোখে নেমে আসে ঘন অন্ধকার—এমন সময় সেখানে এই দিব্যাঙ্গী তরুণী আবির্ভূতা হয়ে লালাকে করস্পর্শে সুস্থ করে তোলে, তারপর লালাকে দাঁড় করিয়ে দেয় কালীনাগের ফণার মাথায়। সেখানে লালা নৃত্য করে। যমুনার তট হতে ব্রজবাসীরা সবাই দেখে সে দৃশ্য। কালীনাগের পতন হয় ; সে কালীদহ ত্যাগ করে। দিব্যাঙ্গী তরুণীর অঙ্গলাবণ্য মাধুরী মিশ্রিত জল লালা ছিটিয়ে দেয় মৃত সাথীদের মুখে—তারা বেঁচে ওঠে। আজ ধ্যানাবিষ্ট সারথির দিকে চেয়ে দিব্যাঙ্গী তরুণীর সেই লালার মুখটি মনে পড়ে—যে ছিল ব্রজের প্রাণ। সবার নয়নের মণি। ইতিমধ্যে সারথির ধ্যান সমাপন হয়। তিনি আঁখিপদ্ম উন্মীলন করতেই দেখতে পান এক সুবেশা ও সুকেশা দিব্যাঙ্গী তরুণীকে। দিব্যাঙ্গী তরুণী সারথির দিকে চেয়ে বলে,—”আমাকে চিনতে পারছো প্রিয়তম?” ‘প্রিয়তম’ ডাকে চমকে উঠেন সারথি—সারা অঙ্গে এক অপূর্ব শিহরণ খেলে যায়। সারথি শিহরিত ভাব গোপন করে দিব্যাঙ্গীর দিকে চেয়ে বলে—”চিনেছি, তুমি যমুনা, আমার প্রিয়া। তুমি এসেছ আমাকে তোমার লাবণ্য মাধুরী পান করিয়ে—আমার তৃষ্ণা দূর করতে।”
সারথির কথায় দিব্যাঙ্গীর পরিচয় পেলাম,—তিনি যমুনা। যমুনা সারথির কাছে এসে তাঁর সর্বাঙ্গে হাত বুলিয়ে দেন এবং বলেন,—”প্রিয়, এখনও রাত শেষ হতে দেরী আছে। আমার কোলে মাথা রেখে একটু ঘুমিয়ে নাও। সকাল হলেই আবার তোমাকে রথের লাগাম ধরতে হবে। কত অস্ত্রের আঘাতের যন্ত্রণা এই অঙ্গে সহ্য করতে হবে—ভাবতেও বুকটা বেদনায় মোচড় দিয়ে ওঠে। একদা যশোদা মা যে মুখে ননী দিত—যে অঙ্গ নন্দমহারাজের গৃহে কুসুম কোমল শয্যায় শয়ন করত এবং বালুকঙ্করের আঘাতে পদতল রক্তাভ হয়ে উঠবে বলে ব্রজবাসীরা ব্রজের পথঘাট বালুকঙ্কর মুক্ত করে রাখতো—আজ সেই পদতলে দারুনির্মিত কঠিন রথবেদী, না জানি প্রিয় তোমার কত কষ্ট হচ্ছে!” সারথি যমুনার কোলে মাথা রেখে বলেন—”ও কথা বল না যমুনে, রথ শুনলে কষ্ট পাবে।” একি কথা বলছো প্রিয়—রথ কষ্ট পাবে কি করে? রথের কি তোমার মত প্রাণ আছে?—”আছে গো, রথেরও আমার মত প্রাণ আছে, অনুভূতি আছে, সব আছে। তাই তো নির্জনে এসে রথের গা ধুয়ে দিই, রথকে পরিষ্কার করি—ওযে আমার জন্য কত পরিশ্রম করে, কষ্ট করে—ওকে না দেখলে হয়?”—”তুমি জানো না শুধু রথ কেন—এ বিশ্বে যা কিছু আছে, সে তুমি জড়ই বল, আর চেতন বল সবার প্রাণ আছে। আমার গুরু সন্দীপনী মহারাজ আমাকে ও দাদাকে নিজের মুখে কতবার বলেছেন—”ইদং সর্বম চেতনাবৃতম”—এই জগতের সমস্ত কিছু চেতনা দ্বারা আবৃত। প্রাণের দ্বারা ধৃত।”
তাই বুঝি? যমুনার সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা।—প্রিয়া আমার চুলে একটু বিলি কেটে দাও না। ওঃ কতদিন হল মা যশোদার কাছে যখন শুতাম—তখন মা চুলে বিলি কাটতো, গান শোনাতো—আর সেই গান শুনতে শুনতে মাকে জড়িয়ে ধরে একসময় ঘুমিয়ে যেতাম। সারথির কথায় যমুনার আঁখিদ্বয় অশ্রুতে ভরে ওঠে। সারথির কুঞ্চিত কেশদাম শোভিত মস্তকখানিতে যমুনা করাঙ্গুলি মৃদু সঞ্চালিত করে বিলি কাটতে থাকে। সারথি যমুনার মুখকমলে আপনার মুখকোমল নিবদ্ধ করে গাঢ় তন্দ্রায় ঢলে পড়ে। যমুনা সারথির মাথা হতে সারা অঙ্গে হাত বুলায়—ক্লান্তি দূর করে। অশ্বগুলি পেট ভরে তৃণ খেয়ে এসে যমুনা ও সারথিকে মণ্ডলাকারে বেষ্টন করে দাঁড়িয়ে থাকে। যমুনা অশ্বগুলির দিকে চেয়ে বলে—তোদের স্কন্ধেই আমার প্রিয় সারাদিন থাকে। দেখিস তাঁর যেন কষ্ট না হয়। অশ্বগুলি বলে—মা, তোমার প্রিয়তমের কথা কী বলবো। উনি নিজের কষ্টের দিকে লক্ষ্যই রাখেন না। এই দেখ না—প্রতিদিনের যুদ্ধ শেষে আমাদের এখানে নিয়ে এসে স্নান করানো, তৃণ খাওয়ানো না হওয়া অবধি তোমার প্রিয়ের শান্তি নাই—এমনকি রথটিকেও আপনার মতো করে ভালোবাসে, আদর করে, কত কথা বলে। যমুনা আবার অবাক হয়, জিজ্ঞাসা করে—”প্রিয় রথের সঙ্গে কথা বলে? কি বলছিস তোরা?’ হ্যাঁগো-একদিন রথ পরিষ্কার করতে গিয়ে তোমার প্রিয়র হাতের আঙুল কেটে যায়-রক্ত ঝরতে থাকে—তা দেখে রথ বলে—প্রভু আমার জন্যে আর কত কষ্ট করবে—তোমার আঙুল থেকে রক্ত ঝরছে আর আমি এমনই অসহায় যে তোমার একটু সেবা করতে পারছি না।—আমরা অশ্বরা তবুও বিশ্রাম পাই প্রভুর কৃপায়—কিন্তু আমাদের সেবা করতে গিয়ে প্রভু একটুও বিশ্রাম পায় না। বহুদিন পর তোমার কোলে মাথা রেখে প্রভু আমাদের একটু বিশ্রাম পেল। তুমি মা, তাই সবার ব্যথা বোঝ—বলতে বলতে অশ্বগুলির চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে।
ইতিমধ্যে সারথির ঘুম ভেঙে যায়। আস্তে আস্তে আঁখিপল্লব বিস্তার করেন—যমুনারকোল থেকে উত্থিত হয়ে অশ্বগুলিকে আদর করে বলেন—ওরে, তোরা আছিস বলেই না আমার কাজ কত সহজ হয়ে যায় যুদ্ধক্ষেত্রে। তোরা মনপ্রাণ দিয়ে সেবা করিস বলেই না আমার যোদ্ধার যুদ্ধ করা সহজ হয়ে ওঠে। তোদের কাছে কি আমার ঋণ কম!
—ওকথা বলো না প্রভু—আমরা তোমার সেবক। প্রভুর সেবা করাই তো সেবকদের ধর্ম। অশ্বগুলির কথায় সারথির মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। তিনি বলেন—চল তোদের এবার রথের সঙ্গে যুক্ত করে দি, সূর্যোদয় হতে আর দেরী নাই। আয় সব রথের কাছে চলে আয়—অশ্বগুলি প্রভুকে অনুসরণ করল। সারথি অশ্বগুলিকে রথে যুক্ত করে যমুনার দিকে চেয়ে বলেন—যমুনে, তোমার কোলে নিদ্রাসুখ উপভোগ করে আমি বড় তৃপ্ত। তুমি আমার কাছে বর প্রার্থনা কর। যমুনা বলে—প্রিয়, বৃন্দাবন থেকে আজ অবধি তোমার বিগলিত অঙ্গ সৌরভ বক্ষে ধারণ করে আমি ধন্য। আমার নারী জন্ম সার্থক-তোমার মুখে প্রিয়তমা ডাক শুনে। আমি যখন তোমার প্রিয়া তখন কিছু চাওয়ার থাকে না। প্রভু তুমি, তাই তোমার যদি কিছু প্রার্থনা থাকে তো আমার কাছে নিঃসঙ্কোচে বল—আমি তোমার প্রার্থনা পূরণ করবো। সারথি বললেন বেশ, তবে তাই হোক, তোমার কাছে আমার প্রার্থনা সারাদিন যখন এই অশ্বগুলিকে নিয়ে আমি যুদ্ধভূমিতে রথ চালনা করবো তখন অশ্বগুলির কণ্ঠে তুমি অধিষ্ঠান করে ওদের সারাদিনের পিপাসার কষ্ট থেকে রক্ষা করো।
যমুনা বললেন—তথাস্তু! কিন্তু তোমার তৃষ্ণা নিবারণ কেমন করে হবে? সারথি বললেন,—আমি যুদ্ধের অবসরক্ষণে এমনি করে এসে তোমার বক্ষে নেমে অবগাহন করে—অঞ্জলিভরে তোমার বক্ষামৃত পান করে নিজের তৃষ্ণা নিবারণ করবো—জান তো প্রিয়ার বক্ষামৃতে আমার বড় লোভ! কথাগুলি বলে সারথি মৃদু মৃদু হাসতে থাকেন।
যমুনা বলেন—বক্ষামৃতে তোমার যে লোভ তা আমার অজানা নয়।
গোকুল বৃন্দাবনে এরজন্য তুমি যশোদাকে কম জ্বালাও নি?
—যমুনে, যুদ্ধ যতদিন চলবে—সে জ্বালায় তোমাকেও জ্বলতে হবে-সেটা যেন মনে থাকে?
—প্রিয়তমের জ্বালায় রমনীর রমনীত্ব জ্বলে ওঠে। কাজেই ঐ ভয়ে আমি ভীতা নই—বরং গর্বিত-আনন্দিত নারীত্বের সার্থক বিকাশে।
—এখন তবে আসি প্রিয়ে। যুদ্ধের সময় আগত প্রায়।
—প্রার্থনা করি—জয়ী হও তুমি।
—জয় আমি চাই না, জয় হোক ধর্মের। জয় হোক সত্যের।
—বেশ তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।
সারথি যমুনার কাছে বিদায় নিয়ে রথে আরোহন করলেন। ধীরে ধীরে রথ প্রভাতের আলো ফোটার আগেই-যমুনার দৃষ্টি পথ হতে একসময় মিলিয়ে গেল। যমুনা আপনার গন্তব্য স্থলাভিমুখে রওনা হলেন পুলকিত চিত্তে।
পাঠক আশা করি সারথি কে—তা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন। যারা বুঝতে পারেননি—আসুন বুঝিয়ে দি—এই সারথি আর কেউ নন—ইনি কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের অর্জুনের রথের সারথি—পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ। বৃন্দাবনে ইনি ছিলেন গোপালক—এখানে অশ্বচালক ও অশ্বপালক।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন