শ্রীকৃষ্ণ প্রভাসতীরে লীলা সম্বরণ করে নিত্যলোকে প্রস্থান করেন। মহাপ্রয়াণ দিবসের পূর্বসন্ধ্যায় তিনি সারথি দারুককে নির্দেশ দেন, সে যেন রথ নিয়ে অবিলম্বে হস্তিনায় পৌঁছে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে অর্জুনকে দ্বারকায় নিয়ে আসে। দ্বারুক তাঁর নির্দেশমত অর্জুনকে দ্বারকায় নিয়ে আসেন। দ্বারকায় প্রবেশ-এর আগে অর্জুনের বুক কেঁপে ওঠে। শোকস্তব্ধ হৃদয়ে তিনি ভাবেন—কৃষ্ণবিহীন দ্বারকায় কেমন করে প্রবেশ করবেন? দ্বারকায় প্রবেশের পূর্বেই তিনি পথিমধ্যে শ্রীকৃষ্ণসহ বলরামের মহাপ্রয়াণের বার্তাসহ যাদবদের বিনাশের সংবাদ পেয়েছেন। রথের অশ্বগুলিও বুঝতে পেরেছে—তাদের প্রিয়প্রভু আর ধরাধামে নেই। তাই নগরের অভ্যন্তরে প্রবেশ না করে বহির্দ্বারে দাঁড়িয়ে পড়ল। রথ থামতে দেখে দারুক অশ্বগুলিকে সঞ্চালনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। অর্জুন লক্ষ্য করেন—কৃষ্ণ বিহনের বার্তা পেয়ে অশ্বগুলির নেত্র হতে অবিরাম ধারায় অশ্রু ঝরছে। তিনি দারুককে বলেন,—”রথ এখানেই থাক, আমরা এখান থেকে পদব্রজে নগরে প্রবেশ করব।”
রথ হতে অবতরণ করে তিনি ও দারুক অশ্বগুলির গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকেন। অশ্বগুলি যেন অর্জুন ও দারুকের দিকে চেয়ে বলে—”কৃষ্ণহীন নগরে প্রবেশ করতে হয়—তোমরা কর, আমরা পারব না।” দারুকও বেশ কিছুক্ষণ ধরে অশ্বগুলির পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বলেন,—’রথ নিয়ে তোরাও আমাদের সঙ্গে হেঁটে চল। তোদের প্রিয় প্রভুর বৃদ্ধ মা বাবা যে এখন বেঁচে আছেন তাঁদের দেখবে কে? কে দেবে পুত্র শোকসন্তপ্ত মাতা-পিতাকে সান্ত্বনা?’ দারুকের কথা অশ্বগুলি বোধহয় হৃদয়ঙ্গম করতে সমর্থ হল—তাই যাত্রীবিহীন রথ নিয়ে তারা মন্থর গতিতে চলতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দারুক ও অর্জুন রথ-অশ্বসহ দ্বারকা নগরে প্রবেশ করলেন। রাজপ্রাসাদের আস্তাবলের নিকটস্থিত প্রাঙ্গণে রথস্থাপন করে—দারুক অশ্বগুলিকে বন্ধনমুক্ত করে আস্তাবলে ঢুকিয়ে দিলেন। পরে অর্জুনকে বললেন, আপনি প্রাসাদ অভ্যন্তরে প্রবেশ করুন—আমি পথশ্রমে ক্লান্ত অশ্বগুলির পরিচর্যা করবো। অর্জুন বললেন—’দারুক কৃষ্ণবিহীন প্রাসাদে প্রবেশ করার আগে আমার পাদুটি এত ভারী হয়ে উঠল কেন? মাতা দেবকী পিতা বসুদেব প্রাসাদ কক্ষে বসে পুত্রের জন্য বিলাপ করছেন—তা আমি কেমন করে প্রত্যক্ষ করবো। দারুক এখানে প্রবেশের পূর্বে পথে কেন আমার মৃত্যু হল না। প্রাসাদের চারিদিকে সখাকৃষ্ণের স্মৃতি…নগরের প্রতি ধূলিকণায় তাঁর পবিত্র ছোঁয়া…শুধু চির অভয়দাতা সখা নেই পাশে…ডুকরে কেঁদে ওঠেন অর্জুন।
—বীরবর। শোক সংবরণ করুন। মাতা দেবকী-পিতা বসুদেব এ অবস্থায় আপনাকে দেখলে আরও ভেঙে পড়বেন।
—জান দারুক, সখাও বলতো, শোকে মুহ্যমান হওয়া জ্ঞানীর লক্ষণ নয় কিন্তু দারুক যে কক্ষটিতে আমার প্রাণসখা থাকতো সেই কক্ষে আমি কেমন করে প্রবেশ করবো? তুমি আমাকে এ কোন দ্বারকায় আনয়ন করলে? আমাকে আবার রথে চড়িয়ে হস্তিনায় ফিরিয়ে নিয়ে চল। দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বিলাপ করতে থাকেন অর্জুন। অন্তরে প্রতিধ্বনি হয় সেই প্রাণপ্রিয় সখার কম্বুকণ্ঠ নিঃসৃত অমৃত-অভয় বাণী—”অস্ত্র যাকে ছেদন করতে পারে না, অগ্নি যাকে দগ্ধ করতে পারে না, বায়ু যাকে শুষ্ক করতে পারে না, জল যাকে আদ্র করতে পারে না—সেই অবিনাশী আত্মা আমি।” ‘কে? কার কণ্ঠস্বর?’ মুখের উপর থেকে দুহাত সরিয়ে দেখেন—কেউ নাই কাছে। দারুক তাকে একলা রেখে অশ্বশালায় চলে গেছে তাদের পরিচর্যার জন্য। একপা-একপা করে তিনি শ্লথ গতিতে এগিয়ে চলেন কৃষ্ণের কক্ষের দিকে। কক্ষের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হতেই সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে। ছত্রিশ বছর আগে ফেলে আসা একখানা ছবি অর্জুনের স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। যখন সে কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে স্বজনদের দেখে গাণ্ডীব পরিত্যাগ করে ভয়ে শোকে ঘর্মাক্ত হয়ে উঠেছিল তখন সখা কৃষ্ণ তাঁকে শুনিয়েছিল—
”দেহী নিত্যম্বধ্যোহয়ং দেহে সর্বস্য ভারত।
তস্মাৎ সর্বানি ভূতানি ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।।
[গীতা ২য় অধ্যায় ৩০ নং শ্লোক]।
অর্থাৎ হে ভারত [অর্জুন], প্রাণিগণের দেহে আত্মাসদা অবধ্য। সেজন্য কোন প্রাণীর দেহনাশে তোমার শোক করা উচিত নয়।”
অর্জুন ভাবাপ্লুত স্বরে আবৃত্তি করে সখার অভয়বাণী। ‘কে? কে কথা বলে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে? ও কৃষ্ণ! মা-বাবার কথা মনে করে ফিরে এলি বাবা। ইতিমধ্যে অর্জুন কক্ষে প্রবেশ করে দেখেন—কক্ষের এককোণে জীর্ণ আসনে বসে ‘হাকৃষ্ণ-হাকৃষ্ণ’ বলে দেবকী বসুদেব বিলাপ ক্রন্দন করছেন। অর্জুন প্রণাম করেন উভয়কে। বৃদ্ধ বসুদেব-বৃদ্ধা দেবকী, তাদের দৃষ্টি ক্ষীণ, গাত্রচর্মে বলিরেখা। উভয়ের মাথায় শুভ্রকেশ। অর্জুনকে কৃষ্ণ মনে করে উভয়েই জিজ্ঞাসা করেন—দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কার সাথে কথা বলছিলি বাবা?
—তা-ত, আমি কৃষ্ণ নই, আমি অ-র্জু-ন…বলতে পারে না কণ্ঠরুদ্ধ হয় তৃতীয় পাণ্ডবের।
—অর্জুন! বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন বসুদেব।
—হ্যাঁ আমি অর্জুন—আপনার জামাতা, পুত্রের সখা। কোনরকমে নিজেকে শক্ত করে উত্তর দেন অর্জুন।
অর্জুনের মাথায় কম্পমান হাত রেখে বসুদেব জিজ্ঞাসা করেন—’কৃষ্ণের বোনকে সঙ্গে করে নিয়ে এলে না বাবা। বলরাম কোথায় জান? প্রদ্যুম্ন, অনিরুদ্ধ, সাত্যকি এরা সব কোথায় গেছে বলতে পারো?
—অর্জুনের সারা শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। তিনি কাঁপতে থাকেন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখেন।
—না, কেউ কোথাও নেই। বসুদেবের হাতদুটি নিজের হাতের মধ্যে ধরে বলেন—তাত, শান্ত হোন। কৃষ্ণকে তো আমরা এখন একরূপে, একস্থানে দেখতে পাব না। কৃষ্ণের অস্তিত্ব এখন আমাদের সকলের মধ্যে বিরাজমান। কৃষ্ণ আমাদের সকলের মধ্যেই জীবিত তাত।
—কৃষ্ণ যদি জীবিত, তাহলে এই অভাগিনীকে মা বলে ডাকছে না কেন? জিজ্ঞাসা করেন দেবকী।
—অর্জুন দেবকীর দিকে চেয়ে বলেন—’আপনি কৃষ্ণ জননী হয়ে নিজেকে অভাগিনী বলছেন কেন?’
—জগতের যে মা নিজের গর্ভের সন্তানকে বুকের দুধ পান না করিয়ে অপরের ঘরে পাঠিয়ে দেয়—সে যদি অভাগিনী না হয় তবে জগতে অভাগিনী কে? যে জননী তাঁর কচি সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে মুখচুম্বন করতে পারে না—চন্দন, কাজলের টিপ দিয়ে সাজাতে পারে না, সেকি অভাগিনী নয়?
অর্জুন বিষাদময় পরিবেশের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করলেন,—
‘শুনেছি আপনার পুত্রকে যশোদা খুব আদরের সঙ্গে লালন পালন করেছিলেন।
—তাই তো নিজেকে বলি কেন তুই যশোদা না হয়ে দেবকী হলি? আমি তো কখনও কৃষ্ণকে তাঁর প্রিয় মাখন-মিছরী হাতে করে খাওয়াই নি। কখনও লালকে [কৃষ্ণকে] কোলে শুইয়ে পিঠে চাপড় দিতে দিতে ঘুম পাড়ানির গান শোনানোর সৌভাগ্য আমার হয়নি—হবে ও না কোনদিন….দেবকী ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করেন। ‘কৃষ্ণের মতো মহান সন্তানের জননী হয়ে অমন কথা মুখে আনবেন না মা। দেখবেন আপনার হাতে মাখন-মিছরী খাওয়ার জন্য কৃষ্ণকে আবার আসতে হবে ধরণীর বুকে’—অর্জুন সান্ত্বনা দেন দেবকী মাতাকে। দেবকী কিছুটা প্রকৃতিস্থ হয়ে বলেন—’জান অর্জুন একবার আমি কৃষ্ণকে নিজের হাতে মাখন-মিছরী খাওয়ানোর জন্য জেদ করি। আমার পুত্র, আজ হস্তিনা-কাল ইন্দ্রপ্রস্থ—পরশু প্রাগ-জ্যোতিষপুর প্রত্যেকদিন কোথাও না কোথাও রাজকার্যের জন্য বের হয়ে যেত। আর্যাবর্তের জটিল রাজনীতি তাঁকে একদণ্ড দ্বারকার বাসভবনে তিষ্ঠতে দিত না। দ্বারকায় সে খুব কম সময়ই থাকত। একদিন তাঁকে দ্বারকায় অবস্থান করতে দেখে আমি নিজের ঘরে ডেকে পাঠাই। সে এলে আমি বলি—’আজ তোমাকে আমি নিজের হাতে খাওয়াবো। সে কোন কথা বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। আমি তার হাত ধরে ঘরের ঐ কোণটায় আসন বিছিয়ে বসিয়ে দিই—তারপর থালাভর্তি মাখন-মিছরী নিয়ে তাঁর পাশটিতে বসে বলি,—এগুলো খেয়ে নাও বাবা। মাখন-মিছরী তাঁর খুব প্রিয় ছিল। তাই ঐসব বস্তু দিয়ে থালা সাজিয়ে দিলাম। সে আরও যা যা ভালোবাসতো সব দিয়ে তাঁর ভোগের নৈবেদ্য সাজিয়ে দিলাম বাবা…কিন্তু…।
—তারপর…তারপর কি হল মা? অর্জুন ব্যাকুলিত স্বরে জিজ্ঞাসা করেন।
—আমার পুত্র, তোমার সখা স্বর্ণ থালায় সাজানো মাখন-মিছরীর দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর অবিরল ধারায় অশ্রুবর্ষণ করতে শুরু করে। মাথা নামিয়ে মাখন-বিছরী ভর্তি স্বর্ণ থালাটিকে বারবার প্রণাম করতে থাকে।
—এ আপনি কি বলছেন মা কৃষ্ণের চোখে জল? অর্জুন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
—’হ্যাঁ বাবা তাঁকে সেদিন অঝোর ধারায় কাঁদতে দেখে আমি তাঁর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞাসা করলাম—প্রাণাধিক পুত্র, অভাগিনী জননী কি তোমার কাছে কোন অপরাধ করেছে তাই আমার হাতের পরিবেশন করা মাখন-মিছরী মিষ্টান্ন না খেয়ে তুমি ক্রন্দন করছো? জান অর্জুন, আমাকে সেদিন সে কি বলেছিল?’
—কি বলেছিল মা? অর্জুনের সতৃষ্ণ জিজ্ঞাসা।
—চোখের জল ফেলতে ফেলতে সে আমায় দেখে মুখ তুলে বললো—”মা, তুমি যেন ব্যথা পেও না, বৃন্দাবন ত্যাগ করে যখন আমি মথুরায় আসি, তখন অক্রূরের রথে ওঠার আগে আমি মা যশোদাকে কথা দিয়েছিলাম, যখন আবার আমি বৃন্দাবনে ফিরে আসবো তখন তোমার হাতেই মাখন-মিছরী খাব। যদি তোমার কাছে কোন কারণে ফিরে না আসি তাহলে জেনে রেখ আমি আর কোনদিন মাখন-মিছরী খাব না। এখন তুমিই বল—একমা তুমি, অন্যমা যশোদা আমি দুই মায়েরই পুত্র। তুমিই বলে দাও কি আমার করণীয়। আমার এই ধর্মসংকট থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় তুমিই বলে দাও মা।”
দেবকীর কথা শেষ হতেই অর্জুন শিশুসুলভ উৎসুকতা নিয়ে জিজ্ঞাসা করে ওঠেন—তারপর কি করল কৃষ্ণ?
—যা তাঁর করা উচিত ছিল সে তাই করেছে বাবা। তাঁর প্রতি আমার স্নেহ ভালোবাসা ছিল স্বার্থ গন্ধে ভরা। যশোদার স্নেহ প্রেম ছিল নিষ্কাম, স্বার্থগন্ধশূন্য ত্যাগের মহিমায় মহিমান্বিতা। নিঃস্বার্থ হৃদয়ের প্রেম সব সময়েই উঁচুতে বিরাজ করে—বলতে বলতে দেবকীর কণ্ঠ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে। অর্জুন, যদি কখনও কৃষ্ণের সঙ্গে তোমার দেখা হয় তবে তাঁকে বলো—হতভাগিনী দেবকী তাঁর প্রতীক্ষায় আছে। যদিও জানি, সে আর কোনদিন এসে আমার হাতে মাখন-মিছরী খাবে না। তবুও তাকে দেখা হলে বলো সে যেন আসে। অভাগিনী জননী দেবকী তাঁর প্রতীক্ষায় আশাপথ চেয়ে বসে আছে—থাকবেও আমরণ।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন