প্রতিদিনের মতো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে স্নানাদি সমাপন করে যশোদা মা গোপালের জন্য দধিমন্থন করতে বসলেন। গোপাল ঘরের পালঙ্কে শুয়ে আছে। এখনি হয়তো উঠেই বলবে মা ক্ষিধে পেয়েছে, খেতে দাও। তাই যশোদা গোপালের জন্য দধিমন্থন করে মাখন তুলছেন। যশোদার গানের সুরে গোপালের ঘুম ভেঙে যায়। দুই চোখ রগড়াতে রগড়াতে ঘুম-ঘুম চোখে গোপাল পালঙ্ক থেকে নেমে পড়ে এবং ধীরে ধীরে দধিমন্থনরতা মা যশোদার কাছে উপস্থিত হয়। মা গোপালকে দেখে বললেন,—’নীলমণি উঠে পড়েছিস, আয় বাবা, আমি মাখনটা তুলে নিই, তুই একটু দাঁড়া।’
গোপাল বলে—’মা, আমার খু-উ-ব ক্ষিধে পেয়েছে।’
‘আহা বাছারে, এইতো আমি আমার গোপাল সোনার জন্য মাখন তুলছি। একটু অপেক্ষা কর বাবা’—যশোদা গোপালকে অনুনয়ের স্বরে বলেন।
—’না আমি একটুও অপেক্ষা করতে পারব না। আমাকে এক্ষুনি খেতে দাও। টাটকা মাখন দাও।’ গোপাল জেদ ধরে।
—লালা, এমন করে মাকে বিরক্ত করতে নেই। আচ্ছা, আমাকে কি তোর ভালো লাগে না? সব সময় এমন উপদ্রব করিস কেন?
—’তোমাকে আবার কখন উপদ্রব করলাম। দেখছ না আমার ক্ষিধে পেয়েছে।
মাখন দাও তাড়াতাড়ি। আমি কিন্তু টাটকা মাখন খাব। যশোদা ভাবেন—ক্ষুধা-তৃষ্ণা কি জিনিষ লালা ঠিক বোঝে না, তাই ঝোঁকের মাথায় যে কথা মনে আসে সেই কথা ধরে বাচ্চারা যেমন জেদ করে, গোপালও তেমনি জেদ করছে।
চেষ্টা করে দেখি, অন্য কথা বলে যদি লালাকে ভোলাতে পারি। অন্য কথা শুনে লালা যদি কিছুক্ষণের জন্য টাটকা মাখন খাওয়ার কথা ভুলে যায় তাহলে খুব ভালো হয়। মাখন তোলার কাজটা নির্বিঘ্নে শেষ হয়ে যায়। যশোদা তাই গোপালকে অন্যমনস্ক করার জন্য কোলে তুলে নিয়ে বললেন—’দেখ তো উপরে আকাশে ওটা কি? তখন ব্রজপুরের আকাশে সূর্য উদিত হয়নি। শুক্লপক্ষের চাঁদ তখনও গগনে শোভা পাচ্ছে মায়ের কথায় গোপাল আকাশের দিকে চেয়ে বলে—’ওটা তো চাঁদমামা।’
চাঁদের দিকে নজর পড়তেই গোপাল মাখনের কথা ভুলে গেল। চাঁদ নেওয়ার ইচ্ছা হল গোপালের। তাই মাকে বলল, ”আমি চাঁদ নেব—আমার চাঁদ চাই, এক্ষুনি চাই।” মা বলেন,—”হ্যাঁ, চাঁদ নেব—চাঁদ নেব, অনর্গল বলতে থাক বাছা, আমি ততক্ষণে মাখন-তোলার কাজ সেরে নিই।’
গোপাল ছোট হলে কী হবে, ভীষণ চালাক। তাই সে মায়ের দধিমন্থনের রজ্জুটি দু’হাতে চেপে ধরে বলে—’মা, মাখন পরে তুলবি, আগে আমাকে চাঁদ এনে দে।’ গোপালের বায়নার জেরে মা যশোদা থালাভর্তি জল নিয়ে এসে প্রাঙ্গণে নামিয়ে দিয়ে বললেন,—’এই দ্যাখ তোর চাঁদমামা এসে গেছে। নে এর সাথে খেলা কর।’
গোপাল কোল থেকে নেমে জলভর্তি থালায় থাপ্পড় মেরে বলে—’এতো জল, আমি ওই আকাশের চাঁদ নেব। এখনি নেব। গোপালের উপদ্রবে মা যশোদা রেগে যান। তিনি রাগ মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন, ‘সকাল থেকে বড্ড উৎপাত শুরু করেছিস, দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি মজা।’ মা যশোদা গোপালকে দুহাতে করে তুলে নিয়ে গিয়ে বাড়ীর দরজার কাছে নামিয়ে দিয়ে বললেন, ”চলে যা এখান থেকে, ‘চাঁদ নেব, চাঁদ নেব’ করে সকাল থেকে আমাকে জ্বালিয়ে মারলে!”
যশোদা যেই গোপালকে তুলে নিয়ে গিয়ে দরজার কাছে নামিয়ে দিয়েছেন, অমনি গোপালের মুখ রাগে ‘বেলুন ফোলার মতো’ ফুলে গেছে। কোমরে হাত রেখে যশোদার দিকে চেয়ে চোখ পাকিয়ে গোপালও বলে—’ওরে ও বুড়ি থুড়থুড়ি যশোদা মা (গোপাল রেগে গেলেই যশোদাকে বুড়ি থুড়থুড়ি বলে সম্বোধন করতেন) চাঁদ দেবে, কি দেবে না বল।”
—’ওরে দুষ্টু আমাকে শাসানো হচ্ছে!’ চাঁদ না দিলে তুই কী করবি?’ যশোদা রাগতকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন গোপালকে।
—’যদি তুমি চাঁদ না দাও ধূলায় গড়াগড়ি দেব, সারা গায়ে ধূলা-বালি মেখে পড়ে থাকবো মাটিতে। তোমার কোলে কখনও চড়ব না।’
—’তুই কোলে না বসলে আমার বয়ে যাবে! বলরাম আছে, সে এসে আমার কোলে বসবে। তোর যা খুশী কর। চাঁদ তোকে দিতে পারব না।
গোপাল দেখল, এ শাসানিতে কোন কাজ হল না। তাই সে বলল,—’তুমি যদি চাঁদ না দাও, তাহলে আমি সুরভি গাভীর দুধ পান করবো না, মাথার
চূড়ায় ফুলও গুঁজবো না।’ যশোদা বললেন, ‘একে তুই দূর্বল, পাতলা, তার উপর যদি তুই দুধ পান না করিস তোর পেট পিঠে লেগে যাবে। এমনিতেই গায়ের রঙ কালো, দেখতেও বিশ্রী।
মাথায় চূড়া বেঁধে ফুল গুঁজে দিই, তাই একটু দেখতে ভালো লাগে। এখন তুই যদি মাথার চূড়ায় ফুল না গুঁজিস, তোর বলরামের মাথায় চূড়া বেঁধে ফুল গুঁজে দেব। তুই কখনও আর আমার কোলে উঠবি না।”
গোপাল দেখল দ্বিতীয় শাসানিতেও কোন কাজ হল না। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে সে মাকে বলল,—’দেখ, হয় আমাকে চাঁদ এনে দাও, নয়তো এবার আমি এমন একটা কথা বলব যা শুনলে তোমাকে চাঁদ দিতেই হবে।’
—যশোদা বললেন, ‘তোর যদি মন চায়, তুই সবাইকে ডেকে ডেকে বলগে যা, মা চাঁদ দিতে পারবে না।’
—শোন মা, যদি তুমি আমাকে চাঁদ না দাও, তাহলে ব্রজবাসীদের যে পঞ্চায়েত বসে, আমি সেখানে গিয়ে সবাইকে বলব—শোন শোন ব্রজবাসীরা, সব কান খুলে শোন, আমি শুধু নন্দবাবার ছেলে, যশোদার ছেলে নই। যদি তুমি আমার মা হতে চাও, তাহলে প্রথমেই তোমাকে চাঁদ এনে দিতে হবে। নইলে তুমি আমার মা নও, আমিও তোমার বেটা নই।” বলতে বলতে রেগে দরজা ধরে বসে পড়েন মাটিতে।
সাড়ে তিন বৎসরের শিশু গোপাল রাগ করে মাটিতে বসে পড়েছে দেখে যশোদার দু-নয়ন অশ্রুতে ভরে ওঠে। তিনি তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে গোপালকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, ‘সোনামণি, তোকে একটি মিষ্টি কথা বলব’ মায়ের গলা জড়িয়ে গোপাল বলেন, ‘কি কথা, বল।’
—’মাখনের চেয়ে নরম, চাঁদের চেয়ে সুন্দর তোর জন্য একটা বউ আনবো?’
বউ-এর নাম শুনতেই গোপাল চাঁদ নেওয়ার কথা ভুলে যায়। ‘বউ নেব, বউ নেব’ বলে মায়ের বদন চুমায় চুমায় ভরে দেয়। যশোদা বলেন—বউ নিতে হলে, ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুতে হয়। মুখ ধুয়ে খাবার খেতে হয়, তারপর বউ নিয়ে খেলা করতে হয়। লালা, তুই জানিস, বউ কেমন হয়? তুই তো ছোট্ট নীলমণি, তোর বউ যদি লম্বা হয়? তাহলে কি করবি? গোপাল বলল—’মা, আমি যেমন ছোট্ট, তেমনি আমার বউ যেন ছোট্ট হয়। আমি ছোট্ট বউ নেব মা।’
যশোদা বললেন,—’ঠিক আছে, মাখন আমি পরে তুলবো। এখন আমি তোর বউ এনে দিচ্ছি। তোর কত বড় বউ চাই, বলতো গোপাল? গোপাল দু’হাত প্রসারিত করে বলে ‘এত্তো বড়।’ যশোদা গোপালকে কোলে করে ঘরে প্রবেশ করে একটি কাঠের রঙিন পুতুল গোপালের হাতে দিয়ে বললেন—’এই নে তোর বউ, এবার খুশী তো?’
গোপাল বলে,—’মা, কালকে যখন দাউদাদার সঙ্গে বনে বাছুর চরাতে যাব তখন বউকে কাপড়ের খুঁটে বেঁধে নিয়ে যাব কেমন?’
যশোদা গোপালের গালে চুমু খেয়ে বললেন—’দূর বোকা? বউকে নিয়ে কেউ গরু চরাতে যায়? নে, এবার বউ নিয়ে খেলা কর। আমি ততক্ষণ মাখন তুলি।’ গোপাল মায়ের কোল থেকে নেমে বউ নিয়ে খেলা করে ঘরের প্রাঙ্গণে বসে। যশোদা গোপালের জন্য মাখন তুলতে বসেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন