গুরু দিলেন বর

অবন্তীনগরের গুরুকুল আশ্রম। আশ্রমের আচার্য্য মহামুনি সন্দিপনী। তিনি ছাত্র বা বিদ্যার্থীদের বেদ-বেদাঙ্গ-যোগ-ধর্ম-শস্ত্র-অস্ত্র ইত্যাদি সকল বিষয়ে শিক্ষা দেন। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিদ্যার্থীরা এখানে এসে মহামুনির সান্নিধ্যে থেকে বিদ্যানুশীলন করতেন। মহামুনি সন্দিপনীও স্নেহ দরদী হৃদয়ে তাদের শিক্ষা দান করতেন। গুরু ও গুরুপত্নীর স্নেহ ভালোবাসায় দূরাগত বিদ্যার্থীরা পিতামাতার অভাব অনুভব করতেন না। বিদ্যার্থীদের গুরুকুলে থেকেই বিদ্যা অধ্যয়ন করতে হবে—এটাই ছিল সে যুগের নিয়ম।

যাই হোক একদিন অবন্তীনগরের এই গুরুকুল আশ্রমে উপনীত হলেন দুই কিশোর বালক। একজনের গায়ের রং বর্ষার নবমেঘ সদৃশ, অন্যজনের দীপ্ত গৌরবর্ণ। দেখে মনে হয় যেন দুই রাজার কুমার। আশ্রম অঙ্গনে প্রবেশ করে দুই কিশোর গুরু সন্দিপনী চরণে কিছু বন্যফল-ফুল ইত্যাদি সামান্য অর্ঘ্য অর্পণ করে বললেন—

 তদ্ব্যঞ্জনং চ :—
 শ্রীমন্মহাকুলজবিপ্রবতংস রত্ন!
 বিদ্যানিধে! বিহিত বৈদিক মর্ম্ম ধর্ম!
 অজ্ঞান দুঃখ বিনিবর্ত্তক! দীনবন্ধো!
 ত্রয়স্ব নৌ স্বয়চরণং শরণং প্রপন্নৌ।। ইনি।। ৪২।।

 [উত্তর গোপাল চম্পূঃ, অষ্টমপূরণ]

দুই কিশোর শ্রীগুরু চরণে অর্ঘ্যপ্রদান করত এইরূপে বিদ্যার্থীভাব প্রকাশ করলেন। হে শ্রীমন্! হে মহাকুলজাত! হে বিপ্রগণের শিরোভূষণ রত্ন! হে বিদ্যানর্ব। হে সমস্ত বৈদিক ধর্মের তত্বাবধায়ক। হে অজানজনিত দুঃখ বিনাশক! হে দীনবন্ধো! আমরা দুইজনে আপনার সুন্দর চরণে শরণাপন্ন হয়েছি। আপনি বিদ্যাদান করে অজ্ঞানজনিত দুঃখ হতে আমাদের দুজনকে ত্রাণ করুন।।

গুরু সন্দীপনী দুই কিশোরের অনিন্দ্যরূপ দেখে মুগ্ধ নয়নে তাদের পানে চেয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞাসা করলেন—বৎস! তোমাদের পরিচয় কি? তোমরা কোথা হতে এসেছো?

‘ভগবন্! আমরা শূরবংশীয় ক্ষত্রিয় বসুদেবের পুত্র। আমার নাম বলরাম-আর এই আমার অনুজ শ্রীকৃষ্ণ। আমরা মথুরা মণ্ডল থেকে আপনার কাছে এসেছি’—দুই কিশোরের মধ্যে অগ্রজ গৌরবর্ণ বলরাম শ্রদ্ধানতচিত্তে উত্তর দেন শ্রীগুরু সন্দিপনীকে।

—উত্তম! তোমরা এখন বিশ্রাম করো। তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে তোমরা পথশ্রমে ক্লান্ত।

—ভগবন্! আমাদের অধ্যয়নের সময় কখন? কৃষ্ণবলরাম একসঙ্গে জিজ্ঞাসা করেন।

—তোমাদের দুজনের ক্ষত্রিয় নন্দন বলে যে অভিমান আছে অগ্রে তা পরিত্যাগপূর্বক এই আশ্রমস্থ অন্যান্য সকল সুশিক্ষিত বিদ্যার্থীদের সঙ্গে বিশ্রামান্তে প্রথমতঃ ভিক্ষা বিষয়ে শিক্ষা করো। তদন্তর অধ্যয়ন প্রসঙ্গ শুরু হবে।

অতঃপর গুরুর কথামত সেদিন বিশ্রাম নিয়ে পরদিন থেকেই আশ্রমস্থ বিদ্যার্থীদের কাছে ভিক্ষাদি বিষয়ে শিক্ষা নিয়ে দুই ভাই গুরুর জন্য মাধুকরী বের হলেন। গুরু সন্দিপনী তাদের মাধুর্য্যমণ্ডিত ব্যবহারে মুগ্ধ হলেন। মুগ্ধ হলেন গুরুপত্নী ও আশ্রমস্থ সকল বিদ্যার্থী।

যথাসময়ে গুরু সান্নিধ্যে থেকে শুরু হল দুই ভাইয়ের অধ্যয়নপর্ব। দুই ভাইয়ের স্পষ্ট বেদমন্ত্র উচ্চারণ, মেধা ও স্মৃতিশক্তি দেখে গুরু বিস্মিত হলেন। ছয়মাসের মধ্যে দুইভাই বেদাদি সকল শাস্ত্রশিক্ষা সমাপন করলেন। গুরুদেবও ইতিমধ্যে ধ্যানবলে জানতে পেরেছেন দুই কিশোরের প্রকৃত পরিচয়। একদিন তিনি নিজ গৃহিণীকে ডেকে বললেন,—’গৃহিণী, যে নতুন বালকদুটি আমার শিষ্য হয়ে অধ্যয়ন করতে এসেছে-ওরা কে জান?’ গৃহিণীর জিজ্ঞাসা—’কে?’

ওরা সকল জ্ঞানের আধার, নরাকারে নিরাকার ব্রহ্ম। দেখ ঈশ্বরের কি লীলা যিনি জগতের ঈশ্বর—সকল কিছুর মূল ; তিনি এসেছেন ছাত্র হয়ে আমার কাছে শিক্ষা নিতে। ওদের দুই ভাইয়ের আগমনে আমার গুরুকুল বিদ্যালয় আজ ধন্য পরমতীর্থে পরিণত হয়েছে।

গুরুসন্দিপনী যখন নিভৃতে তাঁর পত্নীকে উপরোক্ত কথাগুলি বলছিলেন তখন কৃষ্ণ সহসা সেখানে উপনীত হয়ে উভয়ের চরণে প্রণিপাত জানিয়ে গুরুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ভগবন্ আমাদের অধ্যয়ন ও গুরুদক্ষিণার কাজ শেষ হয়েছে—এবার আমাদের স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের অনুমতি প্রদান করুন।’ গুরুদেব ও গুরুপত্নী শ্রীকৃষ্ণ মুখপানে চাইতেই উভয়ের যুগলনয়ন অশ্রুতে ভরে ওঠে। গুরুদেব শ্রীকৃষ্ণের মাথায় হাত রেখে বললেন, ”কৃষ্ণ আমি জানি তুমি কে? তবু লৌকিক জগতে আমি তোমার গুরু, তুমি আমার শিষ্য। তাই গুরু হিসাবে আমি আমার শিষ্যকে যাওয়ার আগে কিছু দিতে চাই। তাই তুমি যাওয়ার আগে আমার কাছে বর প্রার্থনা করো।’ কৃষ্ণ বললেন, ‘হে ভগবন্। আপনার প্রদত্তবিদ্যা ও অকৃপণ স্নেহই আমাদের চলার পথের পাথেয়। আপনি আমাদের দুইভাইকে বিদ্যাদান করেছেন—অজ্ঞান হৃদয়ে জ্ঞানের আলো জ্বেলে দিয়েছেন আশীর্বাদ করুন যেন সেই আলোয় আমরা পথ চলতে পারি।’

তোমার বিনয় ও শ্রদ্ধা আমাকে মুগ্ধ করে। কিন্তু তবুও বলছি তুমি আমার কাছে অন্ততঃ একটা ‘বর’ প্রার্থনা করো—অন্যথায় আমার আচার্য গৌরব নষ্ট হয়ে যাবে।

—ওকথা বলবেন না ভগবন্। ওতে আমার অপরাধ হবে। বেশ, আপনার যখন ইচ্ছা, তখন আপনি আমাকে এই ‘বর’ দিন ভগবন্—আমি যেন মায়ের হাতের ভোজন পাই। মা যেন আমাকে নিজের হাতে খাওয়ার সময় খাইয়ে দেন। আপনার কাছে এই আমার প্রার্থনা। গুরু সন্দিপনী কৃষ্ণকে বুকে চেপে ধরে বললেন, ‘তথাস্তু!’

কৃষ্ণের এই প্রকার বর প্রার্থনা শুনে বলরাম বিস্মিত হলেন, কৃষ্ণ বললেন দাউজী, মা সন্তানের মুখে শুধু ঘি, রুটি, অন্নই তুলে দেন না, ওর সঙ্গে আরও একটু বিশেষ বস্তু মিশ্রিত থাকে, সেই লোভেই আমার গুরুর কাছে ঐ বর প্রার্থনা।

বলরাম বললেন, ‘কৃষ্ণ, মায়ের হাতের মিশ্রিত ঐ বিশেষ বস্তুটি কি?’

কৃষ্ণের উত্তর—মাতৃহৃদয়ের অপার প্রেম ও মমতা।

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন