কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে অর্জুনের মন বড় বিষণ্ণ। কেননা, অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য, স্নেহশীল পিতামহ ভীষ্ম এবং আরও অনেক প্রিয়জনদের সঙ্গে তাকে যুদ্ধ করতে হবে। বিষণ্ণ বেদনা ভারাক্রান্ত ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরও। যুধিষ্ঠিরের ভাবনা—এই যুদ্ধে অনেক প্রাণ নিহত হবে। সেইসঙ্গে যদি তাঁর কোন ভাই হত হয়ে যায় তাহলে সে লোকসমাজে এবং মাতা কুন্তীর কাছে মুখ দেখাবে কেমন করে? সবাই তাঁর দিকে আঙুল তুলে বলবে, যুধিষ্ঠির রাজ্য সম্পদের লোভে ভাইদের যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়ে মৃত্যুর কোলে সঁপে দিল। জ্যেষ্ঠ হয়ে কনিষ্ঠ ভাইদের রক্ষা করতে পারল না। এই ভাবনায় যুধিষ্ঠির ম্রিয়মান। এমন সময় শ্রীকৃষ্ণ সেখানে উপস্থিত হলেন। পাণ্ডবদের বিষণ্ণতা দেখে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—কি ব্যাপার? তোমরা এত বিষণ্ণ হয়ে আছ কেন? যুধিষ্ঠির বললেন—যাদের হত্যা করে আমরা বেঁচে থাকতে চাই না—তাদের যুদ্ধে হত করতে হবে ভেবে আমাদের মন বিষণ্ণ। হে কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্র পুত্রগণকে মেরে আমাদের কী আনন্দ হবে? বরং ওদের হত্যা করলে আমাদের পাপই বৃদ্ধি পাবে। আমাদের জ্ঞাতি ভাইদের হত্যা করে আমরা কি সুখ পাব? শ্রীকৃষ্ণ বললেন—দেখ জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব, প্রত্যেক যুদ্ধের আগেই যোদ্ধাদের মনে একটা মানসিক দ্বন্দ্ব আসে। তোমাদেরও এসেছে। জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব তোমার ধর্মজনিত মোহ তোমার চিত্তকে দূর্বল করেছে কিন্তু দুর্যোধনের শক্তিবাদ বা অসুরবাদের কাছে ঐ ধর্মীয় আবেগের কোন স্থান নাই। তোমার ধর্মীয় ভাববাদিতার সুযোগ নিয়ে দুর্যোধন শক্তিশালী হতে সমর্থ হয়েছে। তোমার এই ধর্মীয় মোহের কথা জ্ঞাত আছেন ধৃতরাষ্ট্রও—তিনি ভাবেন তুমি ধর্মীয় মোহবশতই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ থেকে নিবৃত্ত হবে এবং পুত্ররা বিনাযুদ্ধে জয় হাসিল করে রাজ্য ভোগ করবে। তোমার ধর্মীয় দুর্বলতার জন্যই পাণ্ডবদের আজ এই অবস্থা তুমি যদি পাশা না খেলতে তাহলে তোমার ভাইদের আজ এই অবস্থা হত না।
যুধিষ্ঠির নিরুত্তর হয়ে নত শিরে ভূমি অবলোকন করতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর শ্রীকৃষ্ণের দিকে মুখ তুলে বলেন—যদি এ যুদ্ধে তোমার প্রিয়সখা অর্জুনের কোনো বিপদ হয়—কিংবা ধর যদি সে হত হয়—তাহলে আমাদের সকলকে রক্ষা করবে কে? শ্রীকৃষ্ণ মৃদু হেসে বললেন, ”রক্ষাকর্তা স্বয়ং ধর্ম, তবে সে ধর্ম দুর্বলতা নয়। সে ধর্মের ভিত্তি সততা-ন্যায়, বীর্যবত্তা ও সাহসিকতা। তোমার ধর্ম্মমোহ, অর্জুনের স্বজন বধজনিত মোহ, ভীষ্ম, দ্রোণাচার্যর অন্নগ্রহণ মোহযুদ্ধের পরিবেশকে জটিল করে তুলবে—দুর্বলতা পরিহার কর। ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও। আমি চাই ন্যায়ের দণ্ড তোমাদের হাতে থাকুক। দুর্যোধন ন্যায়দণ্ডের অধিকারী হলে তার উগ্রভোগবাদ ভারতের আরও মহাসর্বনাশ ডেকে আনবে।
—কৃষ্ণ, তুমি যা বললে তা সবই ঠিক তবু মনকে বোঝাতে পারছি না। বিশেষ করে অর্জুনের কথা বারবার মনে হচ্ছে। কৌরবপক্ষের সবার লক্ষ্য অর্জুনের প্রাণ।
—জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব, তুমি বারবার অর্জুনের কথাই বলছো—তোমার কথায় মনে হচ্ছে তুমি অর্জুনের জন্য বড়ই চিন্তিত—তুমি ছাড়া আর বুঝি অর্জুনের হিত কেউ চিন্তা করে না, বলতো অর্জুন তোমার কে?
—আমার ভাই।
—তোমার শুধু ভাই। আমার কে হয় জান?
—কে?
—আত্মার আত্মীয়। বন্ধু-শিষ্য ও ভক্ত, ভগ্নিপতি। যুদ্ধে অর্জুন নিহত হলে তুমি হারাবে শুধু ভাই পার্থকে আর আমি হারাব আত্মীয়, বন্ধু, ভগ্নিপতি ও শিষ্য ভক্তকে। তুমি হারাবে একজনকে আর আমি হারাবো একসঙ্গে চারজনকে। এবার বল জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব চিন্তা কার বেশি তোমার না আমার।
যুধিষ্ঠির নিরুত্তর।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন