মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে

বৃন্দাবনের কোলে মুক্তি কেঁদে গড়াগড়ি যায়।
মুক্তি বলে হে মাধব কি হবে মোর মুক্তির উপায়।।

একবার দেবর্ষি নারদ বৃন্দাবনের ধূলায় দাঁড়িয়ে উচ্চৈস্বরে কাঁদছেন। তা দেখে মহাত্মারা জিজ্ঞাসা করছেন,—নারদ তুমি কাঁদছো কেন? তুমি পরম বৈষ্ণব, ভক্ত চূড়ামণি, জ্ঞানী, বিদ্বান, তোমার এভাবে কান্না শোভা পায় না। নারদ বললেন, আমি নিজের জন্য কাঁদি নাই। আমি কাঁদছি সেইসব যোগীঋষি, সাধু-সন্ন্যাসীদের জন্য-যারা ব্রজে না এসে ব্রজের প্রেম আস্বাদন না করে, কৃষ্ণের মোহন মুরলীর ধ্বনি না শুনে সাধন ভজন করছে তাদের জন্য। আমি কাঁদছি, ভাবছি ব্রজরস বিনা, প্রেমাশ্রু বিনা কেমন করে সেইসব যোগীঋষি, সাধুসন্ন্যাসীদের মুক্তি হবে? দিনরাত কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলে নয়নে চিরবর্ষার ধারার মত অশ্রু ঝরবে—আর সেই অশ্রুর আবরণে জগৎ অদৃশ্য হয়ে শুধু কৃষ্ণ কৃষ্ণ দেখবে—পরিণামে তাদের কৃষ্ণপ্রাপ্তি হবে। ”ব্রজগোপী অনুগতি বিনে”—”সাধন ভজন সকলি অসার— গোপী পদে হলে রতি মেলে কৃষ্ণ উপহার।”

মহাত্মারা জিজ্ঞাসা করেন—তুমি যে গোপী অনুগত হয়ে সাধন করতে বলছো সে সাধন কি? নারদ বললেন—তবে শোন এক কাহিনী, যা শুনলে তোমরা সকলেই বুঝতে পারবে গোপী অনুগত হয়ে কৃষ্ণ সাধন কি? এই বলে নারদ শুরু করলেন ব্রজের এক কাহিনী—”একবার কয়েকজন মহাত্মা ব্রজধামে প্রবেশ করে যমুনার তীরে বসে ব্রহ্ম কি? পরমাত্মা কি? জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার বা ব্রহ্মের ঐক্য কোথায়? মোক্ষ কি? ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এমন সময় সেখানে কয়েকজন গোপী জল নিতে এল এবং তারা কান পেতে শুনলো মহাত্মারা কি আলোচনা করছেন। তারপর জল নিয়ে যখন তারা গৃহ অভিমুখে রওনা দিল তখন পথে এক গোপী অন্য গোপীকে জিজ্ঞাসা করছে সখী, এই ব্রহ্ম, পরমাত্মা, জীবাত্মা এইসব কি?

উত্তরে অন্য গোপী বলছেন—মনে হয় আমাদের নটখট কানাইয়ের কোন প্রতিবেশী বা আত্মীয় হবে। সখী এর বেশী আমি কিছু বলতে পারবো না—ওইসব সাধুবাবারা এইসব নিয়ে আলোচনা করছিল-ওরা হয়তো সব জানে। আমরা শুধু জানি কানাই আমাদের প্রাণ—তাঁর সুখেই আমাদের সুখ, তাঁর আনন্দেই আমাদের আনন্দ। তখন আর এক গোপী বলছেন—ওনারা মুক্তি না মোক্ষ কি সব বলছিল সেটা কি জিনিসরে গোপী? উত্তরে তখন সেই গোপী বলছেন আমাদের কানাই-এর মায়ের বাড়ীতে অনেক দাসী কাজ করে তো—মনে হয় তাদেরই একজনের নাম হবে।”

নারদের মুখে ব্রজের কাহিনী শুনে সাধু মহাত্মারা নিরুত্তর। কিছুক্ষণ মৌন থাকার পর সাধু মহাত্মার দেবর্ষিকে জিজ্ঞাসা করলেন—”হে মহাত্মন গোপীদের কৃষ্ণের প্রতি যে ভাব সেই ভাব সাধনের নাম কি? নারদ বললেন—অকৈতব প্রেম। এই প্রেমই পঞ্চম পুরুষার্থ।” মহাত্মারা জিজ্ঞাসা করলেন—আমরা যারা জ্ঞানমার্গী সাধক ব্রহ্মের সাথে নিজেকে এক এবং অভিন্ন ভাবি তাদের পক্ষে দ্বৈতভূমিতে নেমে এই প্রেম কি লাভ করা সম্ভব? নারদ বললেন, ”উদ্ধব কৃষ্ণ নির্দেশে মধুরায় এসেছিলেন কৃষ্ণবলরামের কুশল সংবাদ দিতে এবং নন্দ-যশোদার, গোপ-গোপী-গোঠের সখাদের কুশল সংবাদ নিতে। কৃষ্ণ বলরামের বিরহে ব্রজবাসীদের হৃদয়ে যে যন্ত্রণা হচ্ছে সেই যন্ত্রণাহত হৃদয়ে উদ্ধব যেন কুশল সংবাদদানে একটু শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দেয় এটাই ছিল কৃষ্ণের বিশেষ নির্দেশ। কিন্তু উদ্ধবের ছিল জ্ঞানের অহংকার। তাই সে জ্ঞানের বোঝা মাথায় নিয়ে ব্রজে যমুনার তীরে পৌঁছে, যে সমস্ত গোপী যমুনায় জল ভরে ব্রজের দিকে ফিরছিল তাদের জিজ্ঞাসা করলো—’নন্দবাবার বাড়ী কোনটা? আমি কৃষ্ণের খবর নিয়ে মথুরা থেকে আসছি। গোপীরা অশ্রুসিক্ত নয়নে বললো—হে পথিক ক্ষমা করো; তুমি যে ব্রজধামে নবীন আগন্তুক তা আমরা বুঝতে পেরেছি। উদ্ধব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—”কেমন করে আপনারা বুঝলেন আমি ব্রজে নবাগত?”

গোপীরা বললেন, ‘ব্রজে যারা বাস করে তারা কেউ নন্দবাবার বাড়ী কোথায় একথা জিজ্ঞাসা করে না।’ উদ্ধব লজ্জায় ঘাড় নত করলেন। তা দেখে গোপীরা বললেন, ‘হে পথিক তুমি যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছো—লক্ষ্য করে দেখ তার পাশ দিয়ে এক জলধারা বয়ে যাচ্ছে। ঐ জলধারা ধরে অগ্রসর হয়ে যেতে থাক—যেতে যেতে যেখানে গিয়ে খুঁজে পাবে এই জলধারার উৎপত্তি স্থান—সেটাই আমাদের নন্দ মহারাজার বাড়ী। মনে রাখবে এটা কোন বর্ষার বা নদীর জলধারা নয়—এই জলধারার জন্মস্থান যেখানে সেটাই নন্দমহারাজের বাড়ী। এ জলধারা নন্দ যশোদার অশ্রুধারা এবং তাদের গাভী সকলের অশ্রুধারা। গোঠের সখাদের অশ্রুধারা, ব্রজগোপীদের অশ্রুধারা।’

উদ্ধব গোপীদের মুখে শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে অগ্রসর হলেন নন্দালয়ের দিকে। মিলিত হলেন সবার সঙ্গে। গোঠের সখাদের সাথে, রাধাসহ ব্রজগোপীদের সাথে, নন্দ যশোদার সাথে। উদ্ধব গিয়েছিলেন জ্ঞানের বোঝা মাথায় নিয়ে, ফিরলেন-প্রেমের দীক্ষা নিয়ে। ভাষা নিয়ে এসেছিলেন, ভাব নিয়ে ফিরে গেলেন। জ্ঞানী বিদ্বান হয়ে এসেছিলেন-প্রেমী হয়ে ফিরে গেলেন। গুরুভাব নিয়ে এসেছিলেন—গোপীদের শিষ্য হয়ে ফিরে গেলেন।

মহাত্মারা নারদের মুখে সব শুনে বললেন, ‘এই প্রেম লাভ করার উপায় কি?’ নারদ বললেন, ‘গোপীচরণ পরশ-ধন্য ব্রজের রজ গায়ে-মাথায় মেখে গোপীদের শরণ নাও। প্রেমেই মুক্তির মুক্ত আনন্দ বিচরণ করে। সে আনন্দ আস্বাদনের জন্য মুক্তি ও এখানে প্রেমে বন্দী হয়ে পড়ে থাকে। এই বলে নারদ ‘জয় গোপী-জয় রাধে-জয় মাধব হরি’ বলতে বলতে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।

মহাত্মারা ও হাগোপী-হাগোপী চরণে স্থান দাও বলে আকুলিত অন্তরে প্রার্থনা শুরু করলেন। তাদের প্রার্থনায় গোপীশ্বরী রাধারাণী প্রকট হয়ে মহাত্মাদের দর্শন দিলেন। বললেন, ‘বল কি চাও তোমরা।’

মহাত্মারা বললেন, ‘মাগো, একবার গোপীমণ্ডলের মাঝে তুমি শ্যামকে নিয়ে যুগলে দাঁড়াও, আমরা দর্শন করে মানব জন্ম সফল করি।’

রাধারাণী বললেন, ‘তোমরা মুক্তি চাও না?’ মহাত্মারা বললেন, ‘মুক্তি, সে তো গোবিন্দ সেবা থেকে দূরে সরে থাকার এক যুক্তি বা উপায় ছাড়া কিছুই নয়—আমরা তা চাই না। আমরা গোপী অনুগত হয়ে তোমাদের যুগলের সেবা অধিকার পেতে চাই।’

রাধারাণী বললেন, ‘বেশ, তবে তাই হোক এখন তোমরা গোপীমণ্ডলী পরিবেষ্টিত আমাদের যুগলরূপ দর্শন কর।’

রাধারাণীর অঙ্গ হতে অজস্র গোপীদেহ নির্গত হল এবং তারা মণ্ডলাকারে রাধারাণীকে পরিবেষ্টন করতেই শ্যামসুন্দরও রাধার হৃদয় হতে নির্গত হয়ে রাধার দক্ষিণপার্শ্বে ত্রিভঙ্গ মূর্ত্তিতে দাঁড়ালেন।

মহাত্মারা সেই মূর্ত্তি দর্শন করে আনন্দে ভাবাবিষ্ট হয়ে গেলেন। মুক্তির সাধক যুক্তি হারিয়ে ভক্তিতে পড়লেন লুটিয়ে যুগলচরণে।

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন