রোজ রোজ গোপালের নামে নালিশ শুনে মা যশোদার কান ঝালাপালা। ‘যশোদা মা তোমার গোপালকে একটু শাসন করো। নইলে আর তো পারি না।’
—কেন কি হয়েছে কি?
—তোমার গোপাল আমাদের ঘরে ঢুকে ননী চুরি করেছে। ভাঁড় ভেঙে দিয়েছে।
—আর কি করেছে আমার গোপাল—বল বল সব বল বাকী রাখিস না কিছু।
—গো দোহনের আগে বাছুর ছেড়ে দেয়। ঘরের ঘুমন্ত ছেলেগুলোকে চিমটি কেটে জাগিয়ে দেয়। গোপালের দৌরাত্ম্য অসহনীয় হয়ে উঠছে আমাদের কাছে—তুমি গোপালকে একটু শাসন করো যশোদা মা, নইলে বড় হলে ও আরও দুষ্টু হয়ে উঠবে?
গোপীরা রোজই সমবেত হয়ে এমনই ভাবে গোপালের নামে নালিশ জানায়।
যশোদা ভাবেন কী করি! কেমন করে আমার গোপালকে শান্ত করা যায়। কী করলে তাঁর এই বদ স্বভাবের পরিবর্তন হবে? একদিন যশোদা থাকতে না পেরে গোপীদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘গোপাল তো আমার একার গোপাল নয়—সে তোদেরও গোপাল, তোরাই বলে দে না গোপালকে কী করে শান্ত করা যায়।’ গোপীরা বললেন, ‘এক কাজ করো নন্দরাণী, তুমি তোমার গোপালকে পাঠশালায় ভর্তি করে দাও। দেখবে পড়তে পড়তে ওর দুষ্টুমি ভাব চলে যাবে।’
কথাটা মন্দ বলিস নাই, আমিও সে কথা যে ভাবি নাই তা নয়। কিন্তু গোপালটা এমন দুষ্টু সে কি পাঠশালায় পড়তে রাজী হবে?
ইতিমধ্যে গোপাল শয্যাত্যাগ করে ঘুম ঘুম চোখে হাই তুলতে তুলতে এবং চোখ রগড়াতে রগড়াতে মায়ের কাছে এসে হাজির হল। গোপীরা গোপালের ঘুম ঘুম মুখের সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে আনন্দ-আপ্লুত চিত্তে আপন আপন বাড়ী ফিরে গেল।
গোপাল এসে মায়ের কোলে বসে। যশোদা গোপালাকে আদর করে বলেন— গোপাল তুমি তো এবার বড় হয়েছো? গোপাল বলে,—’হু—তা কি করতে হবে?’ যশোদা বলেন, ‘ভাবছি এবার তোমায় পাঠশালায় ভর্তি করে দেব। সেখানে তুমি লেখাপড়া শিখবে।’ অবোধ শিশুর মত ভান করে গোপাল মা যশোদাকে জিজ্ঞেস করল, ‘মা, পাঠশালা, লেখাপড়া এসব কি জিনিস মা—এখানে বুঝি ভালো ননী, মিছরি পাওয়া যায়?
—শোন ছেলের কথা, ননী-মিছরী ছাড়া তুই কি কিছুই জানিস না বাবা?
—পাঠশালায় শাস্ত্র পড়ানো হয়। তুই পাঠশালায় ভর্তি হয়ে শাস্ত্র পড়বি।
—শাস্ত্র পড়ে কি হবে মা?
—তত্বজ্ঞান হবে।
—কোন তত্বের জ্ঞান হবে মা?
—ভগবান তত্বের জ্ঞান হবে।
—ভগবান কি মা?
—ভগবান সর্বব্যাপী। সবার অন্তর্যামী।
—সর্বব্যাপী সবার অন্তর্যামী ভগবান কে?
—উনি ত্রিভুবন পতি।
—তোমার হাতের মাখন-মিছরী ছেড়ে তাকে জেনে আমার কি লাভ?
—তাঁকে জানলে জ্ঞান-ভক্তি-বৈরাগ্য লাভ হয়।
—তাতে আমার কি লাভ হবে মা?
—তুই তাঁকে জেনে মোক্ষ লাভ করবি।
—আমার ঐ লাভের কোন ইচ্ছাই নেই।
—তবে তোর ইচ্ছাটা কি শুনি?
—আমার তো দই মাখনই খেতে ইচ্ছা করে মা।
—ভালো কথা, কিন্তু আমাদের ঘরে তো দই মাখনের অভাব নেই, নিজের ঘরের দই, মাখন যত খুশি খা-বন্ধুদের খাওয়া, আমার কোন আপত্তি নেই, কিন্তু লোকের ঘরে চুরি করে খাস কেন? জানিস না এতে তোর স্বভাব দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ব্রজের গোপীরা তোকে চোর বলে—এতে তোর লজ্জা হয় না?
—তোমার ঘরে চুরি করে খেতে যখন লজ্জা হয় না, তখন ওদের ঘরে চুরি করে খেতে কেন লজ্জা হবে মা? তুমি আর গোপীরা কি আলাদা? ওদের ঘর তোমার ঘর কি এক নয় মা?
—মানছি তোর কথা না হয় সত্য—কিন্তু বাবা, তুমি দিন দিন বড় হচ্ছো-এরপর তোমার বিয়ে হবে-এখন থেকে যদি চোর বদনাম রটে যায় তাহলে কেউ কি তোমার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দেবে! চোরকে কেউ জামাই করতে রাজী হবে না—সেটা তো ভাবতে হবে?
—ও নিয়ে তুমি কিচ্ছু ভেব না মা। দেখবে ননী চুরির মতো একদিন তোমার গোপাল মেয়ে চুরি করে এনে তোমার ঘরের বউ করে দেবে।
গোপালের কথা শুনে মা হেসে ফেলেন। আর কিছু বলতে পারেন না।
ইতিমধ্যে গোপালের সখারা যশোদার অঙ্গনে এসে হাজির। হল। গোপাল তাদের সঙ্গে খেলতে চলে গেল। যশোদা ভাবেন, হায় গোপাল আমার বড় হয়ে কবে নিজের ভালোমন্দ বুঝতে শিখবে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন