পার্থসারথি বিনা পার্থ অচল। ভগবান পার্থসারথি হস্তিনাপুরে থাকলে অর্জুনও হস্তিনায় থাকতেন। পার্থসারথি বাসুদেব দ্বারকায় থাকলে, তিনিও তাঁকে দেখার জন্য মাঝে মাঝে দ্বারকায় উপনীত হতেন।
একবার বাসুদেব যখন দ্বারকায়, তখন পার্থ রথ নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। লীলা সংবরণের আগে এটাই পার্থের অন্তিম দ্বারকায় আগমন। পার্থ অন্দর মহলে প্রবেশ করতেই বাসুদেব তাঁকে নিয়ে স্বীয় কক্ষে প্রবেশ করে পালঙ্কের উপর পাশাপাশি বসে কুশলাদি বিনিময়ের পর বার্তালাপ শুরু করেন। পরস্পর বার্তালাপ করতে করতে পথশ্রমে ক্লান্ত পার্থ একসময় পালঙ্কের উপর নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লেন। পার্থ ঘুমিয়ে পড়তেই শ্রীকৃষ্ণ ভাবেন—এই সুযোগ ভক্তের সেবা করার। জাগ্রত অবস্থায় পার্থ কোনদিনই আমার সেবা গ্রহণ করবে না। আজ পথশ্রমে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে—এই সুযোগে ওর পদসেবা করি। অর্জুনের পায়ের কাছে বসে তাঁর পদসেবা করতে থাকেন কৃষ্ণ।
অন্দর মহলের অন্যকক্ষে তখন সৎসঙ্গ সভা বসেছে। রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী ইত্যাদি মহিষীরা নারদসহ অন্যান্য ঋষিমুনিদের ডেকে ভগবানের কথামৃত শ্রবণ করছেন। প্রভু যখন সামনে থাকেন তখন নয়নভরে দর্শন করেন। নয়নের বাইরে চলে গেলেই তাঁরা মুনি ঋষিদের ডেকে কথা প্রসঙ্গ করেন। অন্দর মহলের একদিকের বৃহৎকক্ষে কথাপ্রসঙ্গ চলছে—অন্যকক্ষে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের পায়ের কাছে বসে তাঁর পদসেবা করছেন। কথাসভায় কথার শেষে প্রধানা মহিষী রুক্মিণী ঋষিমুনিদের এবং ব্রাহ্মণদের কিছু রত্ন-মণিমাণিক্য দান করবেন,—কিন্তু পতি-পত্নী যুগলে উপস্থিত হয়ে দান করতে হয়, তাই রুক্মিণীজি নারদকে ইশারায় বললেন,—”প্রভুকে ডেকে নিয়ে আসুন।”
নারদ রুক্মিণীর কথানুযায়ী প্রভুর কক্ষে প্রবেশ করেই চমকে ওঠেন। বিস্মিত নয়নে দেখেন কৃষ্ণ অর্জুনের পদসেবা করছেন। নারদ কিছু বলার আগেই কৃষ্ণ তাঁকে ইশারায় কোন কথা বলতে নিষেধ করেন। কারণ কথা বললে সদ্য নিদ্রিত অর্জুনের ঘুম ভেঙে যাবে। নারদ নিঃশব্দ পদসঞ্চারে কৃষ্ণের কাছে গিয়ে কানে মুখ রেখে মৃদুস্বরে বলেন,—”অন্দরমহলে আপনার ডাক পড়েছে।” তা শুনে অশ্রু ছলছল নয়নে কৃষ্ণ বললেন,—’পার্থকে ছেড়ে আমি কেমন করে যাই বলো তো নারদ।’
—কেন, যেতে পারবেন না কেন?
—যে ভক্ত, আমাকে ধরে থাকে তাঁকে ছেড়ে যাই কেমন করে।
পার্থ তো শুয়ে রয়েছে, সে তো আপনাকে ধরে নেই।
—সংসারের দৃষ্টিতে পার্থ শুয়ে আছে সত্য কিন্তু দেবর্ষি, পার্থ শুয়েও জেগে আছে। তাঁর শরীরের সমস্ত রোমকূপের ছিদ্র পথে কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! নাম অবিরাম গুঞ্জরিত হচ্ছে। তুমি পার্থর শরীরে কান পেতে দেখ আমার কথা সত্য কিনা! কৃষ্ণের সম্মতি পেয়ে নারদ পার্থের পায়ে কান রাখেন। শুনতে পান অখণ্ড কৃষ্ণ! কৃষ্ণ! কৃষ্ণ—ধ্বনি। হাতে কান রাখেন সেখানেও কৃষ্ণ—কৃষ্ণ ধ্বনি শুনতে পান। শেষে মাথার চুলে কান রাখেন—সেখানেও কৃষ্ণ—কৃষ্ণ ধ্বনি শুনতে পান। পার্থর শরীরের যেখানেই কান রাখেন সেখানে কৃষ্ণ ধ্বনি শুনতে পান নারদ। আনন্দে তাঁর দুচোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে, গদগদ স্বরে তিনি বলেন—ধন্যপার্থ! তুমি ধন্য। কৃষ্ণ নামে তোমার এত প্রেম! নারদ বীণা নিয়ে বসে পড়েন। ভুলে যান তিনি কেন এসেছেন! কি করতে এসেছেন? বীণার সুরে তিনিও নামের ঝংকার তুলে তাতে ডুবে যান।
ওদিকে রুক্মিণী তখন কৃষ্ণ’র আশায় পথ চেয়ে বসে আছেন—নারদের ফিরতে বিলম্ব হচ্ছে দেখে তিনি সত্যভামাকে বললেন,—”মনে হয় দেবর্ষি ওখানে গিয়ে প্রভুকে ডাকতে ভুলে গেছেন। তিনি বোধ হয় ওখানে গল্পে মশগুল হয়ে প্রভুকে ডাকার কথা ভুলে গেছেন। অতএব বোন, তুমি গিয়ে প্রভুকে তাড়াতাড়ি ডেকে নিয়ে এস।” সত্যভামাও ওই কক্ষে প্রবেশ করতেই নারদের দশা প্রাপ্ত হন। তিনিও পার্থর শরীরের রোমকূপ হতে কৃষ্ণ নামের ধ্বনি শুনতে শুনতে ভাববিহ্বল হয়ে ঐ স্থানেই বসে পড়েন এবং ধীরে ধীরে হাততালি দিতে শুরু করেন। রুক্মিণী ভাবেন যাঁকেই পাঠাচ্ছি সেই ওখানে গিয়ে মজে যাচ্ছে—ব্যাপার কি? নিজে গিয়ে স্বচক্ষে দেখে আসি এবং প্রভুকে ডেকে নিয়ে আসি। তিনি দ্রুতপদে কথা সভা হতে উঠে গিয়ে প্রভুর ঘরে প্রবেশ করলেন, সেখানে গিয়ে দেখেন, নারদ বীণা বাজিয়ে কৃষ্ণ নাম করছেন সত্যভামা করতালি দিচ্ছেন। প্রভু আনন্দে আবেশে দুলছেন—অর্জুনের শরীরের রোমপথ দিয়ে ‘কৃষ্ণ কৃষ্ণ’ ধ্বনি নির্গত হচ্ছে। সবার নয়নে অশ্রু। আনন্দ বিহ্বল পরিবেশে এসে তিনিও ভুলে গেলেন নিজেকে। রুক্মিণীকে ভাবাবিষ্ট দেখে কৃষ্ণের অধরে মৃদু হাসি দেখা দেয়। তিনি নীরবে তাঁর দিকে চেয়ে যেন বললেন—”দেখ, আমি কেন তোমার ডাক শুনেও যেতে পারি নাই তা নিজের চোখে চেয়ে দেখ, হৃদয় দিয়ে অনুভব কর।” রুক্মিণী যখন পার্থর শরীরের দিকে ঝুঁকে রোমকূপ হতে নির্গত ‘কৃষ্ণ’-‘কৃষ্ণ’ ধ্বনি শুনতে পেলেন তখন তাঁর এত আনন্দ হল যে, তিনি দুবাহু তুলে নৃত্য শুরু করে দিলেন। রুক্মিনীকে নৃত্য করতে দেখে কৃষ্ণও পার্থর পদসেবা ছেড়ে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে নৃত্য শুরু করে দিলেন। নারদ বীণা বাজাচ্ছেন, সত্যভামা করতালি দিচ্ছেন, কৃষ্ণ-রুক্মিণী নৃত্য করছেন। বৃন্দাবনে রাধাকৃষ্ণ তো নিত্যই নৃত্য করেন। আজ দ্বারকায় কৃষ্ণ—রুক্মিণী নৃত্য করছেন। এ দৃশ্য বিরল। বড়ই মনোরম! দুজনকে নাচতে দেখে কথাসভার কক্ষ থেকে নির্গত হয়ে সবাই সেখানে উপনীত হলেন। অন্তরীক্ষে দেবগণ পুষ্পবৃষ্টি করছেন। খবর পেয়ে ব্রহ্মা সাবিত্রী—শিবপার্বতী ও সেখানে উপস্থিত হয়ে নামসংকীর্তন শুরু করে দিলেন। উচ্চকণ্ঠের সংকীর্তনে পার্থর নিদ্রা ভেঙে গেল। পালঙ্ক থেকে উঠে উপবেশন করে এবং চোখ মেলে তাকায়। সংকীর্তনের আনন্দে তখন সবাই মাতোয়ারা। পার্থ কৃষ্ণর দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ”সখা, তোমার বাড়িতে বুঝি আজ কোন উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে? আমাকে জাগাও নি কেন? আমিও তাহলে তোমাদের সাথে যোগদান করতাম।”
কৃষ্ণসহ উপস্থিত সকলে মুচকি মুচকি হাসছেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন