শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম দুই ভাই অন্তরঙ্গ যাদবমিত্র সাত্যকিকে নিয়ে বনভ্রমণে বের হলেন। তাঁদের পিছু পিছু চলতে থাকে যাদবসেনার দল। দ্বারকা নগরের সীমা অতিক্রম করে রথ দ্রুতবেগে বনভূমে প্রবেশ করল। রথ দ্রুত চলার ফলে সৈন্যদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সারাদিন বনের মধ্যে ভ্রমণ করতে করতে একসময় সন্ধ্যা নেমে আসে। চারিদিক গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে যায়। অন্ধকারে পথ চলা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। রথ নিয়ে অগ্রে গমন কিংবা দ্বারকায় ফিরে আসা সম্ভব নয়। তাই তিনজনে স্থির করলেন—বনের মধ্যে রাত্রি অতিবাহিত করবেন। পালাক্রমে তিনজনের একজন পাহারা দেবেন অন্যদুজন নিদ্রা যাবেন। পর্যায়ক্রমে এভাবে তিন প্রহর কেটে গেলে চতুর্থ প্রহরে তিনজনেই জেগে থাকবেন। অতঃপর সূর্যোদয় হলে তিনজনে বনভূমি ত্যাগ করে নগরে ফিরে আসবেন।
প্রথম প্রহরে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে সাত্যকির। তিনি জেগে রইলেন। শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম দুজনে বৃক্ষের নীচে পত্র শয্যা রচনা করে তার উপর উত্তরীয় বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন। দুইভাই যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন সেখানে হঠাৎ এক ভয়ংকর রাক্ষসের আবির্ভাব হয়। সে প্রহরারত সাত্যকিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমি তোমাদের তিনজনকে খাব বলে এসেছি কিন্তু তুমি চুপচাপ থাক, তাহলে তোমাকে না খেয়ে বাকী দুজনকে (কৃষ্ণ, বলরামকে) খেয়ে আমি চলে যাব।’
রাক্ষসের স্পর্ধা দেখে সাত্যকি ক্রোধে ফেটে পড়লেন। রাক্ষসকে বললেন, ‘যদি তোমার নিজের জীবন বাঁচাতে চাও, তাহলে এইস্থান ত্যাগ করো।” সাত্যকির কথায় রাক্ষসেরও রাগ বেড়ে যায়। সে বলে—’আমার কথা যখন শুনলে না তখন তোমার মাথাটাই আগে কড়মড় করে চিবিয়ে খাই—বলতে বলতে রাক্ষস সাত্যকির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
শুরু হল দুজনের মধ্যে তুমুল লড়াই! লড়াই করতে করতে সাত্যকির রাগ যত বাড়ে রাক্ষসের বলও তত বৃদ্ধি পায়। সে সাত্যকিকে কয়েকবার শূন্যে তুলে মাটিতে আছাড় দেয়। ফলে সাত্যকির দুই হাঁটু ছিঁড়ে যায় এবং মুখে আঘাত লাগে। পুনঃসাহস সঞ্চয় করে ক্রোধে দৃপ্ত হয়ে সে রাক্ষসের উপর আক্রমণ শুরু করে। এইভাবে দু’জনায় লড়াই করতে করতে যখন রাত্রির প্রথম প্রহর কেটে গেল, তখন রাক্ষস হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে পড়ল। রাক্ষস অদৃশ্য হতেই সাত্যকি বলরামকে জাগিয়ে দিয়ে যুদ্ধ ক্লান্ত শরীর নিয়ে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লেন।
এবার বলরামের পাহারা দেওয়ার পালা। তিনি সতর্ক দৃষ্টি নিয়ে পাহারা দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে নিদ্রামগ্ন ভ্রাতা কৃষ্ণ ও মিত্র সাত্যকির দিকে দৃষ্টিপাত করছেন। সহসা সেই রাক্ষসের পুনরাগমন হল। সে এসে বলরামকে পূর্বের ন্যায় বলল, ‘আমি তোমাদের তিনজনকে খাব বলে এসেছি কিন্তু তুমি যদি চুপ থাক, তাহলে ঐ দুজনকে খেয়ে আমি চলে যাব।’
বলরাম ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে রাক্ষসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি যত ক্রোধ প্রকাশ করেন রাক্ষসের শক্তিও তত বৃদ্ধি পেতে থাকে। সাত্যকির মতো বলরামকেও রাক্ষস আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে। উভয়ের লড়াই-এর মধ্য দিয়ে রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরও অতীত হয়ে যায়। রাক্ষসও অদৃশ্য হয়। বলরাম কৃষ্ণকে জাগিয়ে দিয়ে শয্যায় শুয়ে পড়লেন।
এবার নৈশ প্রহরীর ভূমিকায় শ্রীকৃষ্ণ। বলরাম, সাত্যকির শয্যা প্রদক্ষিণ করতে করতে তিনি পাহারা দিচ্ছেন। অদৃশ্য রাক্ষস আবার দৃশ্যমান হল। কৃষ্ণ রাক্ষসকে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন, ”এদের ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে এসেছ কেন? যাও চলে যাও এখান থেকে।”
রাক্ষস কৃষ্ণকে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসতে দেখে ক্রোধে জ্বলে উঠে দাঁতে দাঁত চেপে ঘষতে থাকে। রাক্ষসের দাঁতে দাঁত ঘষা দেখে কৃষ্ণ হোঃ হোঃ করে হেসে উঠেন। ফলে রাক্ষসের রাগ যায় আরও বেড়ে। ক্রোধে উন্মাদ হয়ে সে কৃষ্ণকে আক্রমণ করল। কৃষ্ণ ক্রোধহীন চিত্তে রাক্ষসের আক্রমণ প্রতিরোধ করে হাসতে হাসতে বললেন, ‘ভাই তুমি খুব বাহাদূর আছ দেখছি, তোমার শরীরেও বেশ শক্তি আছে।’ বাধা পেয়ে রাক্ষস আরও ফুঁসে ওঠে, কিন্তু আশ্চর্য্য সে যত ক্রোধে ফুঁসতে থাকে তত তার শরীরের শক্তি কমে যায় এবং আকারও ছোট হয়ে যায়। ছোট হতে হতে একসময় রাক্ষসের শরীর একটা ছোট কীটের আকার ধারণ করল। কীটাকার প্রাপ্ত রাক্ষসকে কৃষ্ণ তখন মাটি থেকে তুলে কটিবস্ত্রের প্রান্তে বেঁধে রাখলেন।
অতঃপর ব্রাহ্মমুহূর্তের নিত্য-অপকর্ম সমাপন করে তিনজনে যখন মিলিত হলেন—তখন বনভূমির তরুশাখায় বিহঙ্গের কলকাকলিতে প্রভাতের আগমনী সঙ্গীত শোনা যাচ্ছে। সূর্য্যের আলোয় স্নান হয়ে জেগে উঠেছে সারা বনভূমি। সাত্যকিও বলরামের সারা শরীরে ক্ষতচিহ্ন, মুখমণ্ডল স্ফীত। তা লক্ষ্য করে কৃষ্ণ উভয়কে জিজ্ঞাসা করলেন, ”তোমাদের এই দশা কেন? কে তোমাদের এই অবস্থা করেছে?”
কৃষ্ণের জিজ্ঞাসার উত্তরে দুজনেই একসাথে বললেন, ‘কি বলবো ভাই, কাল রাতে এক ভয়ংকর রাক্ষস এসেছিল। তার সঙ্গে লড়তে গিয়ে আমরা আঘাত প্রাপ্ত হই, যার ফলে আমাদের এই অবস্থা হয়েছে।’
বলরাম ও সাত্যকির কথা শুনে কৃষ্ণ হেসে ওঠেন এবং বলেন,—’হ্যাঁ, রাক্ষস ভয়ংকরই বটে। আমাকেও কাল রাতে প্রহরা দেওয়ার সময় আক্রমণ করেছিল। তাকে আমি লড়াইয়ে পরাস্ত করে কটি বস্ত্রের প্রান্তে বেঁধে রেখেছি। এই দেখ সেই রাক্ষস।’ বলতে বলতে কৃষ্ণ কটি বস্ত্রের বাঁধন খুলে কীটাকার প্রাপ্ত রাক্ষসকে বের করে উভয়ের সামনে রাখলেন। সাত্যকি ও বলরাম বিস্ময়ে পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়। উভয়কে বিস্মিত হতে দেখে কৃষ্ণ বললেন, ‘তোমরা বোধ হয় জান না অথবা চেন না এই রাক্ষসকে। আসলে এই রাক্ষসটার নাম হচ্ছে ক্রোধ। তোমরা এই রাক্ষসকে দেখে যত ক্রোধ প্রকাশ করবে, এর শক্তিও যাবে তত বেড়ে। ফলে নিজেরই ক্ষতি হবে। আমি ক্রোধের পরিবর্ত্তে হাসতে হাসতে শান্ত চিত্তে এর সঙ্গে লড়েছি। তাই এর আকার এত ছোট হয়ে একটা কীটের আকার ধারণ করেছে। ক্রোধের সঙ্গে লড়াই করার সময়, যদি আমরা ক্রোধ না করি, তাহলে ক্রোধ নিজেকে বৃদ্ধি করার সুযোগ পায় না। বরং ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যায়।’
হঠাৎ বনমধ্যে যাদব সেনাদের কোলাহল শোনা গেল। কৃষ্ণ, বলরাম, সাত্যকি গতদিনের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সেনাদলের সঙ্গে মিলিত হয়ে দ্বারকা নগরের দিকে যাত্রা করলেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন