কানাই বলাই বড় হয়েছে। তাঁরা এখন আর সবসময় বাড়ীতে থাকতে চায় না। সখাদের সঙ্গে ব্রজের অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে খেলা করে বেড়ায়। প্রভাত হলেই মা যশোমতি দুই ভাইকে স্নান করিয়ে বস্ত্র-অলংকারে সুসজ্জিত করে দেন। তারপর মাখন-মিছরী রুটি খাইয়ে দিয়ে সখাদের সঙ্গে খেলতে পাঠান। সখাদের মধ্যে মধুমঙ্গল, বসন্ত, অর্জুন, সুদামা, সুবল, তোককৃষ্ণ, মনসুখা, বরুথপ, ঋষভ, ভদ্রাদি প্রভাত হতেই কানুকে খেলার জন্য ডাকতে আসে। অন্যান্য দিনের মতো একদিন সখারা যশোমতির অঙ্গনে এসে সমবেত হয়েছে কানাই-বলাই-এর সঙ্গে খেলার জন্য। মা যশোমতি তখন কানাই-বলাই দুইভাইকে কোলে বসিয়ে খাওয়াচ্ছিলেন। খাওয়া শেষ হলে কানাই-বলাই সখাদের সঙ্গে নিজেদের বাড়ীর অঙ্গনে খেলতে শুরু করে। মনসুখা নামে সেদিন এক নতুন কিশোর কানাইদের বাড়ী খেলতে এসেছে। সহসা তাঁর দিকে দৃষ্টি পড়তেই কানু জিজ্ঞাসা করল,—’তোমার নাম কি ভাই?’ নবাগত কিশোর উত্তর দেয়, ‘আমার নাম মনসুখা।’
তোমার শরীর যা দুর্বল রোগা, তাতে তোমার মনের সুখ তো দূরের কথা, শরীরেও সুখ থাকবে না দেখছি। তোমার বাড়ী কোথায় ভাই? কৃষ্ণ নবাগতকে জিজ্ঞাসা করে।
সে উত্তর দেয়—’আমার বাড়ী ব্রজের প্রান্তসীমার ঘোষপল্লীতে।’
—’দেখ ভাই, কিছু মনে কোরো না, তেমার মতো রোগা-দুর্বল ছেলেকে খেলার সাথী করা আমার পছন্দ নয়। যদি তুমি আমার খেলার সাথী হতে চাও, তাহলে একটু ভালো করে খাওয়া-দাওয়া কর। স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী হও। আমাকে এবং আমার সখাদের দিকে চেয়ে দেখ—আমরা কেমন সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী।”
কৃষ্ণের কথা শুনে মনসুখা বলে—’তোমরা তো স্বাস্থ্যবান হবেই, কেননা তোমাদের ঘরে প্রচুর গাভী আছে, তোমরা পেট ভরে দুধ-মাখন খেতে পাও। আমার বাবার ঘরে মাত্র দু’ তিনটি গাভী আছে। তার মধ্যে একটি দুধ দেয়, সেই দুধ বেচে কোনরকমে আমাদের সংসার চলে। অতএব তোমাদের মতো আমি বলবান স্বাস্থ্যের অধিকারী কেমন করে হব ভাই।”
—’কেন তোমাদের আশপাশের প্রতিবেশীদের বাড়ীতে গাভী নেই? নিশ্চয়ই আছে, যদি থাকে তবে সেখানে চেয়ে খাও না কেন? মনসুখাকে জিজ্ঞাসা করে কৃষ্ণ।
—’রোজ রোজ চাইলে কেউ কি দেয়? দু-একদিন না হয় দিতে পারে।
—’ও তাও তো বটে, এটা তো ভেবে দেখিনি, শোন মনসুখা, যদি তুমি আমাদের খেলার মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাও, তাহলে অবশ্যই তোমাকে বলবান ও স্বাস্থ্যবান হতেই হবে। তাই আমি তোমাকে একা পরামর্শ দিচ্ছি শোন—
মনসুখা কৃষ্ণের দিকে অগ্রসর হয়ে বলে—’বল কি তোমার পরামর্শ’?
কানু মনসুখার দিকে চেয়ে ধীর গম্ভীর সুরে বলে—’এখন থেকে তুমি সবার বাড়ী থেকে চুরি করে মাখন-দুধ-দই খাবে।’
—’বাঃ ভাই বাঃ, সুন্দর তোমার পরামর্শ। চুরি করতে গিয়ে যখন ধরা পড়বো তখন আমার হয়ে পিঠ পেতে প্রহার খাবে কে? তুমি তো জানো না ভাই ব্রজের গোপীদের গায়ে কি অসীম শক্তি। বাব্বা। যা মোটামোটা লাঠি দিয়ে তাঁরা দুধ মন্থন করে! ধরা পড়লে সেই লাঠি দিয়ে মেরে হাড় গুঁড়ো করে দেবে। কাজ নেই ভাই তোমার খেলার সঙ্গী হয়ে—আমি ঘরের ছেলে ঘরেই ফিরে যাচ্ছি।”
মনসুখা প্রস্থানোদ্যত হতেই মধুমঙ্গল তাঁর হাতখানি চেপে ধরে বলে—’চলে যাচ্ছ যে, তুমি বোধ হয় জান না, আমাদের কানুর খেলার দলে যে একবার সদস্য হওয়ার জন্য আসে তাকে কানু সদস্য না করে ছাড়ে না।’ মনসুখা বলে—’তোমাদের কানুর দলের সদস্য হতে হলে তো জীবন বাজী রাখতে হবে। ও আমি পারব না।’
—’ঐ কথা বললে তো চলবে না ভাই! কি রে কানু, তুই চুপ করে আছিস কেন? কিছু একটা বল?’ মধুমঙ্গল কৃষ্ণকে কটাক্ষ করে।
কৃষ্ণ বলে—’ভাই মধুমঙ্গল, কি বলি ভেবে পাচ্ছি না।’
—’শোন কানু, তোর যদি মনসুখাকে খেলার সঙ্গী করার ইচ্ছা হয়, তাহলে তুই এক কাজ কর।
—কী কাজ? কী কাজ? কানু জিজ্ঞাসা করে মধুমঙ্গলকে।
—’তুইতো আমাদের সবাইকে ভালোবাসিস।’
—’হ্যাঁ বাসি।’
—’তাহলে মনসুখাকেও ভালোবেসে আমাদের খেলার দলের সদস্য করে নে।’
—’কিন্তু ওযে বড্ড রোগা-দুর্বল।’
—’রোগা বলে এতই যখন তোর অপছন্দ তখন এক কাজ কর না, তুই সবার বাড়ি থেকে দুধ-দই-মাখন চুরি করে ওকে খাওয়া, তাহলে তোর আর ও রোগা দুর্বল থাকবে না।’
—’কেন? ওর জন্য আমি লোকেদের বাড়ি থেকে দুধ-দই-মাখন চুরি করবো কেন?’ মধুমঙ্গল, তোর এ কেমন বিচার।’
—’হ্যাঁ এই আমার বিচার। ওর জন্য তোকেই চুরি করতে হবে। আমার মনে হয় সকল সখারও সেই অভিমত।
—কানু সখাদের সবাইকে জিজ্ঞাসা করেন—’মধুমঙ্গল যা বলল তাই কি তোদের সবার অভিমত? আমি মনসুখার জন্য ব্রজের ঘরে ঘরে ননী-মাখন চুরি করবো, এতে তোদের সমর্থন আছে কিনা একসঙ্গে আমাকে মুখফুটে বল।’
সবাই সমস্বরে বলে—’আছে-আছে—আমরা সবাই চাই, তুই ব্রজের ঘরে ঢুকে দুধ-দই-মাখন চুরি কর এবং আমাদের তা খাইয়ে আনন্দ দান কর।’
—’বেশ তবে তাই হোক। ব্রজবাসী যে মাখন-ছানা-কংসকে কররূপে পাঠায়—আজ থেকে তা পাঠানো বন্ধ। গ্রামের দুধ-দই-মাখন গ্রামের লোকের অগ্রাধিকার। মনসুখা, তুই দুঃখ করিস না। আমি তোকে ও অন্যান্য সখাদের রোজ চুরি করে দুধ-দই-ছানা-মাখন খাওয়াব। তোদের সবাইকে বলবান-শক্ত সমর্থ করে গড়ে তুলবো। কংস কররূপে দুধ-দই-ছানা-মাখন গ্রহণ করে—দুষ্টদের খাওয়ায়। তারা ব্রজবাসীদের উপর অত্যাচার করে, আমাদেরই পাঠানো দুধ-ছানা-মাখন খেয়ে। এখন থেকে আর তা হতে দেব না। গ্রামের জিনিস গ্রামের লোকেই খাবে।’
নতুন মিত্র মনসুখা বলল—”আমার জন্য রোজ রোজ মাখন চুরি করতে গিয়ে যদি তুমি ধরা পড়ো তাহলে তোমার মা নিশ্চয়ই তা জানতে পারবে এবং তোমাকে আচ্ছা করে পিটবে, তখন কী হবে?”
—’ধরা পড়লে তো পিটবে।’
—’কেন? তুমি কি যাদু জান, যে ধরা পড়বে না।’
—’ভাই মনসুখা, আমার গুরু আমায় এক মন্ত্র শিখিয়েছে—ঐ মন্ত্র জপ করে চুরি করতে গেলে কেউই আমাকে দেখতে পাবে না। যদি ধরাও পড়ি তাহলে ঐ মন্ত্রের বলে আমি ঠিক ছাড়া পেয়ে যাব।’
মনসুখা বলে—’ভাই কানু, কি সেই মন্ত্র?’
কানু—’চুরি করার সময় কফল্লম্ কফল্লম্ মন্ত্র জপ করতে হয়। কফল নামে এক ঋষি এই মন্ত্র প্রথম প্রচার করে। গুরু পরম্পরায় এই মন্ত্র আমি পেয়েছি। অতএব দেরী না করে আজ থেকেই শুরু হয়ে যাক—মাখন-ননীচুরির প্রথম পর্ব।’
মিত্রবর্গ বলল,—কানু, মাখন ননী চুরির আগে আমাদের একটা উদ্বোধন পর্ব হয়ে যাক।’
‘কি পর্ব?’—কানু জিজ্ঞাসা করল।
মিত্রবর্গ বলল,—’নৃত্যপর্ব।’
‘উত্তম প্রস্তাব, হয়ে যাক।’ সখারা মনসুখাকে বলে—’কৃষ্ণকে ঘুঙুর পরিয়ে দাও।’ মনসুখা কৃষ্ণের পায়ে ঘুঙুর পরিয়ে দেয়। কৃষ্ণসহ সখাগণ নৃত্য শুরু করে। নৃত্য শেষ হলে কৃষ্ণ বলে—’এবার ঘুঙুর খুলে দে, ননী-মাখন চুরি শুরু হবে।’ ঘুঙুর পরে মাখনচুরি করতে গেলে সব গড়বড় হয়ে যাবে। ধরা পড়ে যাব।’
মনসুখা কৃষ্ণের পায়ের ঘুঙুর খুলতে যায়। ঘুঙুর কেঁদে ওঠে। নতুন সখা মনসুখাকে বলে—”একবার যখন তোমাদের কৃপায় কানুর ‘চরণে ঠাঁই পেয়েছি, তখন এই পদ থেকে খুলে আমায় সরিয়ে দিও না।” তা শুনে মনসুখা কৃষ্ণকে বলে—’বন্ধু! তোমার পায়ে যে একবার আশ্রয় পায় তাকে তুমি সরিয়ে দিতে চাইছ কেন? তোমার অন্যসখাদের মুখে শুনেছি যে একবার তোমার চরণে ঠাঁই পায় তাকে আর প্রত্যাবর্তন করতে হয় না। চরণ থেকে ঘুঙুরকে কেন সরাতে চাইছ?
কৃষ্ণ—’না সরিয়ে রাখলে যে আমি ধরা পড়ে যাব? মায়ের কাছে প্রহার খাব।”
মনসুখা বলল,—ধরা পড়ে প্রহার খাও খাবে ক্ষতি নেই। তোমার মা যত প্রহার করে করুক। তুমি পিঠ পেতে নিও। কিন্তু যে তোমার চরণে আশ্রয় নিয়েছে তাকে চরণ ছাড়া কোর না কিছুতেই।’
কৃষ্ণ বলল,—’বেশ, তবে তাই হোক।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন