ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ

ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখে ‘রাধা-রাধা, প্রাণাধিক রাধা, হা রাধা’ বলে চীৎকার করে ওঠেন কৃষ্ণ। ক্রন্দন ধ্বনিতে ঘুম ভেঙে যায় রুক্মিণী সত্যভামাদি সহ সকল দ্বারকাবাসিনী মহিষীদের। প্রভাতে মহিষীরা নিজেদের মধ্যে উক্ত বিষয় নিয়ে চর্চা শুরু করেন। দ্বারকার রাজমহলে তাঁদের ন্যায় সুন্দরী সুন্দরী সহস্র রমণী থাকা সত্বেও, কেন প্রাণপতি স্বপ্নের মাঝে রাধা-রাধা বলে কেঁদে ওঠেন? সে ভাগ্যবতী কে? যাঁর বিহনে কৃষ্ণ কেঁদে কেঁদে ব্যাকুল হন। ফিরেও ভালো করে তাকিয়ে দেখেন না তাঁদের? রাধার পরিচয় জানার জন্য দ্বারকার মহিষীরা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন।

জ্যেষ্ঠা মহিষী রুক্মিণী বললেন, ‘শুনেছি বৃন্দাবনে রাধা নামে এক গোয়ালিনী আছেন—যাঁর চিন্তায় আমাদের প্রাণনাথ বিভোর থাকেন।’ সত্যভামা বললেন, ‘তাই যদি হয় তাহলে তো, রোহিণী মাকে জিজ্ঞাসা করলেই সব খবর পাওয়া যাবে। উনি তো বৃন্দাবনে অনেকদিন ছিলেন, আমাদের প্রাণবল্লভের সমস্ত ক্রিয়া উনি নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছেন। চল, সব আমরা রোহিণী মায়ের কাছে যাই, তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেই সব জানতে পারবো।’

মহিষীরা সকলে রোহিণীমায়ের মহলের দিকে যাত্রা করলেন। সেখানে প্রবেশ করে সকলে রোহিণীমাকে অনুরোধ করে বললেন, ‘মা আপনার পুত্রের বৃন্দাবন লীলার বিষয়ে যা জানেন আমাদের বলুন, দয়া করে কোন কিছু গোপন করবেন না।’

রোহিণীমা পড়লেন বিপদে, মা হয়ে তিনি কেমন করে বলবেন, পুত্রের বৃন্দাবন লীলার কথা? মহিষীরাও নাছোড়বান্দা, না শুনে ছাড়বেন না। অগত্যা রোহিণীমা রাজী হলেন। পুত্রবধুদের বললেন,—’কৃষ্ণ বলরাম রাজসভায় যাওয়ার পর, আমি তোমাদের বৃন্দাবন লীলার কথা শোনাব।’

প্রভাতে স্নান, সূর্য বন্দনা, পিতামাতা ও অন্যান্য গুরুজনদের প্রণাম করে, কৃষ্ণ বলরাম রাজসভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করলেন। রোহিণীমা, মহিষীদের নিয়ে অন্ত:পুরে বসলেন—বৃন্দাবন লীলা শোনানোর জন্য। বৃন্দাবন লীলা শোনানোর আগে দ্বারে প্রহরী রাখলেন কৃষ্ণভগ্নী সুভদ্রাকে। বৃন্দাবন লীলা অপ্রাকৃত-অদ্ভুত। কৃষ্ণের বড় প্রিয়। এ লীলার এমনই মাহাত্ম্য যে, তা কৃষ্ণকে আকর্ষণ করে টেনে নিয়ে আসে। অন্তঃপুরে রোহিণীমা কৃষ্ণের বৃন্দাবন লীলা বর্ণনা করছেন মহিষীদের কাছে। লীলা শুনতে শুনতে মহিষীরা সকলে তন্ময় হয়ে যান।

ওদিকে রাজসভায় কৃষ্ণ-বলরাম ছটফট করতে থাকেন। বৃন্দাবন লীলার অনুপম আকর্ষণ শক্তি—তাঁদের দুভাইকে অন্তঃপুরের দিকে টেনে নিয়ে আসে। দুইভাই রাজসভা ছেড়ে অন্তঃপুরের দিকে পা বাড়ালেন। অন্তঃপুরের দরজার নিকটে উপস্থিত হতেই, সুভদ্রা বাধা দিয়ে বললেন, ”আমি দ্বারের প্রহরী, রোহিণীমায়ের আদেশে এখন অন্তঃপুরের কক্ষে প্রবেশ করা নিষেধ। সুতরাং আমি এখন কাউকে ভেতরে যেতে দেব না—তোমরাও ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করবে না।” নিরুপায় হয়ে দুইভাই দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলেন। সুভদ্রা দুইভাইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে তাদেরকে আটকিয়ে রাখেন। ভেতরে বৃন্দাবন লীলার কথা চলছে। দ্বারকার মহিষীরা ধ্যানমগ্না হয়ে কথা শুনছেন। সুভদ্রা পাহারা থাকা সত্বেও, বাইরে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণ-বলরাম যে বৃন্দাবন লীলার কথা শুনছেন—তা খেয়ালই করেননি রোহিণীমা ও দ্বারকার মহিষীগণ।

কৃষ্ণ-বলরাম-সুভদ্রা তিনজনেই চিন্ময় রসভাবপূর্ণ বৃন্দাবন লীলার কথা শুনতে শুনতে বিহ্বল হয়ে গেলেন। আনন্দে তিন ভাইবোনের চোখে অশ্রু ঝরছে। শরীর রোমাঞ্চিত! অন্তঃপুরে রোহিণীমা তখন শ্রীরাধার প্রেম বর্ণনা করে রাস প্রসঙ্গের চর্চা করছেন। তা শুনতে শুনতে তিন ভাইবোনের শরীরের অবস্থা বিচিত্র রূপ ধারণ করল। তিনজনের হাত পা সংকুচিত হতে হতে শরীরের মধ্যে ঢুকে গেল। সুদর্শন চক্রও বৃন্দাবন লীলার কথা শুনতে শুনতে লম্বা ছড়ির আকার ধারণ করল।

দ্বারকার অন্দর মহলে যখন এই অবস্থা তখন সহসা দেবর্ষি নারদ সেখানে উপনীত হলেন। আপন মনে বীণা বাজাতে বাজাতে কৃষ্ণের সন্ধান করতে করতে তিনি অন্তঃপুরের দরজার নিকট উপনীত হয়ে দেখলেন—তিন ভাইবোনের বিচিত্র দশা। তারা কখনও হাসে কখনও কাঁদে, কখনও কান্না-হাসির মিশ্রণে আনন্দিত হয়ে নৃত্য করে। নারদ এই দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন। ওদিকে অন্তঃপুরে রোহিণী মা তখন শ্রীরাধা বিরহ বণর্না করছেন। তা শুনতে শুনতে কৃষ্ণ-বলরাম-সুভদ্রা ও সুদর্শন চক্র পূর্বরূপ ফিরে পান বা প্রকৃতিস্থ হন। প্রকৃতিস্থ হয়ে নারদকে সামনে দেখে কৃষ্ণ লজ্জিত হয়ে বললেন, ‘হে দেবর্ষি আজ বড় আনন্দের দিন। আজ যে আনন্দ পেলাম তার তুলনা হয় না। এই আনন্দের দিনে তুমি খুশীমত বর প্রার্থনা কর আমার কাছে।’

নারদ বললেন, ‘বর নেওয়ার কথা পরে হবে। আগে বলুন, আজ আপনাদের শরীরের এই অবস্থা কেমন করে হল?’

কৃষ্ণ বললেন—”দেবর্ষি, অন্তঃপুরে মা রোহিণী আমার বৃন্দাবন লীলার বর্ণনা করছেন। ব্যস, তা শুনতে শুনতেই খুশীতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমরা এই অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছি।”

নারদ বললেন,—’তাহলে প্রভু আমাকে এই বর দিন, যাতে আপনাদের চারজনের (কৃষ্ণ, বলরাম, সুভদ্রাও সুদর্শন চক্র) এইরূপ দেখে মর্ত্যবাসী ধন্য হয়। ভগ্নীসহ আপনাদের দুই ভাইয়ের রূপ বড়ই মনোরম। এইরূপ দেখে জগৎবাসীর নয়ন ধন্য হোক।’

কৃষ্ণ বললেন,’তথাস্তু! হে দেবর্ষি তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।’

ব্রজের ব্রজনাথ ভক্তবাঞ্ছা পূরণ করতে পুরীধামে এলেন জগন্নাথ।পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে যে বিচিত্র দারুমূর্তি দেখা যায় তা কৃষ্ণ-বলরাম-সুভদ্রা ও সুদর্শন চক্রের।

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন