পাণ্ডবরা দুর্যোধনের চক্রান্তে বারনাবতের জতুগৃহে দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন—এই খবর পেয়ে কৃষ্ণ এলেন হস্তিনায়, খবরের সত্যাসত্য যাচাইয়ের জন্য। হস্তিনায় প্রবেশ করে ভাবছেন কার নিকটে গেলে সঠিক খবর পাবেন। মনে পড়ল বিদুর ও তাঁর পত্নী সুলভার কথা। নিজেই রথ নিয়ে উপনীত হলেন বিদুরের কুটিরের সম্মুখবর্তী প্রাঙ্গণে। বিদুর গৃহে নেই। তিনি আছেন রাজসভায়। ধৃতরাষ্ট্রের প্রধান অমাত্যমণ্ডলীর তিনি অন্যতম একজন। গৃহে আছেন তৎপত্নী ধর্মপ্রাণা মহাসতী সুলভা। স্বামীর মুখে কৃষ্ণকথা শুনতে শুনতে এই মহীয়সী নারীর মন কখন যে কৃষ্ণ রঙে রাঙিয়ে গেছে তা তিনি নিজেই জানেন না। পাতায় ছাওয়া কুটিরের বাইরের বারান্দায় বসে তিনি একখানি ছিন্নবস্ত্র সেলাই করছেন। ছিপছিপে, গৌরাঙ্গী, মাথায় কুঞ্চিত শুভ্র-কালো কেশদাম বন্ধনহীন হয়ে পৃষ্ঠদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। রথ হতে নেমে কৃষ্ণ দ্রুতপদে প্রবেশ করেন—কুটিরের ভেতরে। পদধ্বনি শুনতে পেয়ে সুলভা মুখ তুলে চেয়ে দেখেন—বাড়ির অঙ্গনে আজ মহা অতিথি উপস্থিত। তিনি উঠে কৃষ্ণকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বসার জন্য একখানি কাঠের চৌকি এগিয়ে দেন। কৃষ্ণ চৌকিটি সুলভার বসার জায়গার পাশে স্থাপন করে তাতে উপবেশন করেন [অর্থাৎ যে জায়গায় চৌকি পেতে সুলভা কাপড় সেলাই করছিল]। অতঃপর সুলভার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করেন—এবার বলো কাকীমণি, তোমার সব কুশল তো? সুলভার মনে হয় কৃষ্ণ যেন তার কতদিনের চেনা। যুগ যুগ ধরে কৃষ্ণ যেন তাঁর আপন হতেও আপনজন। তাই সে সংকোচ পরিহার করে বলে—সকল কুশলের মূল যেখানে সেখানে কি অকুশল থাকতে পারে বাবা? এবার বল—তোমার সমাচার কি? পিতামাতা বন্ধু স্বজন সব কুশলে আছেন তো?
—কাকীমণি, তোমাদের আশীর্বাদে সব কুশল। শুধু একটা খবর সত্য না মিথ্যা তা জানবার জন্য মনটা ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। আচ্ছা তোমার কি মনে হয় পাণ্ডবরা জতুগৃহে দগ্ধ হয়ে মারা গেছে।
প্রশ্ন শুনে সুলভা কৃষ্ণের মুখের দিকে চেয়ে লক্ষ্য করে দেখেন—তাঁর প্রসন্ন উজ্জ্বল আননের কোথাও যেন একটা বিষণ্ণতার ছাপ রয়েছে, যা বাইরে থেকে সহজে বোঝা যায় না। কৃষ্ণকমল আননে বিষণ্ণতার অস্পষ্ট ছাপ দেখে তাঁর মাতৃহৃদয় কেঁদে ওঠে। তিনি কৃষ্ণকে দৃঢ়কণ্ঠে বলেন,—পাণ্ডবরা মরেনি তাঁরা মরতে পারে না। তুমি দেখে নিও কৃষ্ণ, একদিন তাঁরা দুর্যোধনের সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে অফুরন্ত শ্রীসম্পদ নিয়ে আবির্ভূত হবেই হবে। আমার মন বারবার বলছে তাঁরা বেঁচে আছে, নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। যদি আমি আমার স্বামী ছাড়া জগতের অন্যসব পুরুষদের পিতা বা পুত্রের দৃষ্টিতে দেখে আসি, তাহলে আমার এ কথা সত্য হবেই হবে।”
—’তাই যেন হয় কাকীমণি, তোমার কথার যেন অন্যথা না হয়।’
—’কৃষ্ণ, তোমার কী মনে হয়? পাণ্ডবরা কি মারা গেছে?’
—’কাকীমণি, অনেক সময় প্রচলিত মিথ্যাকে সত্যের মতো স্বীকার করে নিলে নিজের ও স্বজনদের কল্যাণ হয়।’
—’তোমার কথার অর্থ ঠিক বুঝলাম না।’
—কাকীমণি, আমরা চাই যাদের ঐ সংবাদে আস্থা আছে, তাদের সেই আস্থা অটুট থাক। আমরাও ঐ প্রচলিত সংবাদকে সত্য স্বীকার করে যদি তদনুযায়ী আচরণ করি অর্থাৎ অন্যেরা যেন বোঝে তাদের মতো আমরাও এই সংবাদে বিশ্বাস রাখি। আমাদের আচরণে তারা যেন সন্দিগ্ধ না হয়। তাহলেই নিজের ও স্বজনদের কল্যাণ।
কৃষ্ণের বলার ভঙ্গীতে কিঞ্চিৎ অভিনয় কলার প্রকাশ দেখে সুলভা হেসে ওঠেন।
—’তুমি হাসছো কেন? কাকীমণি, আমি কি কিছু ভুল বললাম।’ বিদুরপত্নী সুলভা হাসতে হাসতে বলেন—’কৃষ্ণ তুমি সত্যসত্যই নটখট (দুষ্টু)। এখানে আমার সামনেও তুমি অভিনয় শুরু করে দিলে?’
—তুমিও এই অভিনয় কলায় পটু হয়ে যাও। এতে তোমার ও তোমাদের প্রিয় পাণ্ডবদের মঙ্গল হবে। সহসা কৃষ্ণ প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে পুনরায় অভিনয়ের ভঙ্গীতে বলে ওঠেন—আচ্ছা, আমি না নয় নটখট মেনেই নিলাম কিন্তু কাকীমণি, তুমিও তো দেখছি আমার চেয়ে কম যাও না?’
—’কেন আমার অপরাধ? সুলভার সবিস্ময় জিজ্ঞাসা।’
—’অনেকক্ষণ ধরে নটখট নটখট বলে যাচ্ছ। একবারও কি জিজ্ঞাসা করেছ আমার ক্ষিধে পেয়েছে কি পায়নি? তুমি কেমন মা গো? ভুলেও তো একবার জিজ্ঞাসা করলে না আমি খেয়ে এসেছি কি না? সেই কোন সকালে হস্তিনায় এসেছি, এখনও মুখে একটা দানাও পড়েনি।’ কোথায় কিছু খেতে দেবে, তা না দিয়ে কেবল নটখট নটখট বলেই যাচ্ছো।
—এবারকার মতো মাপ করে দাও লক্ষ্মী সোনা আমার। আমি এক্ষুনি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি। সুলভা বারান্দা থেকে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন খাবার আনার জন্য কিন্তু হায় বিধি বাম!
সহসা দ্বারকা থেকে রথ নিয়ে ক্রন্দন করতে করতে সেখানে উপনীতা হলেন সত্যভামা। উন্মুক্ত কেশে একাকিনী রথ চালিয়ে তিনি চলে এসেছেন হস্তিনায়। তাঁর পিতা সত্রাজিৎকে স্যমন্তক মণির লোভে শতধন্বা হত্যা করে পালিয়েছে। পিতার শব সুরক্ষিত রেখে তিনি চলে এসেছেন কৃষ্ণকে নিতে। এমন বিপদে কৃষ্ণ ছাড়া সে যাবেই বা কার কাছে? তাঁর কোন ভাই নাই, পিতাও নিহত। বিপদের সময় পত্নী পতির কাছে যাবে না তো কার কাছে যাবে? শ্রীকৃষ্ণ সুলভার উদ্দেশ্যে বলেন,—’আসি গো কাকীমণি, দ্বারকায় বড় বিপদ, তোমার বৌমণি নিতে এসেছে—আমি যাই।’
সুলভা ঘর থেকে একটি কাংস্যপাত্রে কয়েকটি চিঁড়ের নাড়ু ও একগ্লাস জল নিয়ে বাইরে এসে দেখেন অতিথি বিদায় চাইছে। অকল্পনীয় দৃশ্য দেখে বুকটা তাঁর কান্নায় ভরে ওঠে। ক্ষুধার্ত অতিথি খাবার চেয়ে, না খেয়ে চলে যাচ্ছে—গৃহস্থের কি কল্যাণ হবে? খাবারের পাত্র নিয়ে তিনি কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন—এতখানি পথ রথ চালিয়ে এসেছো—আবার এতখানি পথ রথ চালিয়ে যাবে—তোমরা দুজনে নাড়ু খেয়ে একটু জলপান করে নাও।
কাকীমণি, আজ আসি। খাওয়াটা জমা থাক। আর একদিন আসবো। সেদিন তুমি মনের আশা মিটিয়ে আমাকে ভোজন করিয়ে দিও। বলতে বলতে কৃষ্ণ রথে চড়ে বসেন। সত্যভামাও নিজের রথে আরোহন করেন। রথ চলতে শুরু করে দ্বারকার দিকে। তাঁদের চলার পথ পানে চেয়ে সুলভা কান্নায় ভেঙে পড়ে। হাত থেকে নাড়ুর থালা ও জলের গ্লাস পড়ে যায়। সুলভা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। চিৎকার করে বলে,—’হে বিধাতা তুমি কেন এই অভাগিনী সন্তানহীনা নারীর প্রতি এত নিঠুর হলে! আমার কাছে খাবার চেয়ে কৃষ্ণ সারাটা পথ…ক্ষুধা বুকে নিয়ে ফিরে গেল। আমি এমন অপয়া রমণী যে তাঁর শ্রীমুখে একটু খাবার তুলে দিতে পারলাম না। হৃদয়ের এই ব্যথা আমি রাখি কোথায়? ওকি আর কখনও আসবে আমার বাড়ী? কখনও কি ওর মুখে খাবার তুলে দেওয়ার সুযোগ আমি আর পাব, কাঁদতে থাকে সুলভা। সন্তানহীনার বুকের দুগ্ধ আধার থেকে দুগ্ধ ক্ষরিত হয়ে বক্ষের বস্ত্রকে ভিজিয়ে দেয়। তা লক্ষ্য করে সুলভা চুপ হয়ে যায়। এই প্রথম তাঁর জীবনে মাতৃবাৎসল্য ধারার প্রকাশ। উঠে দাঁড়ায় সে। বস্ত্র সংবৃত করে—নাড়ুর পাত্র ও জলের গ্লাস মাটি থেকে তুলে নিয়ে কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করল একবুক বেদনা নিয়ে।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন