বড়রা অনেক সময় এমন কিছু কথা বলেন যা ছোটরা শুনে ঠিকমত বুঝতে পারে না। ব্রজপুরে বয়স্ক গোপ-গোপীদের যে কথা শুনে কানাই ও তাঁর সখাদের মধ্যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে তা হল : বলরামের মা রোহিণী, গোকুলের না মথুরার? একবার ব্রজের গোপ-গোপীরা বলে, যশোমতী ব্রজের অধিশ্বরী। আবার যশোমতি মা নন্দবাবা বলেন, রোহিণী ব্রজের অধিশ্বরী। কখনও বলেন ও গোকুলের নয় মথুরার।’
কানাই অনেক ভাবনা চিন্তা করে আপনমনে বিড়বিড় করে বলে, ”রোহিণী মা যদি মথুরারই হয় তাহলে সেই মথুরা কি আমাদের ব্রজমণ্ডলের মধ্যে নয়? যদি মথুরা ব্রজমণ্ডলের মধ্যে হয় তাহলে তো রোহিণীজী আমাদেরই মা। আমাদের সকলের আপনজন। রোহিণীমা এইসময় পেছনে দাঁড়িয়ে শুনতে থাকেন কানাইয়ের কথা। কানাইয়ের কথা শেষ হলে তিনি কানাইকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন—”হ্যাঁ বাবা আমি তোমাদের সকলের মা, তোমাদের সবার আপনজন।” কানাই রোহিণীমায়ের গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করল,—”আমরা তোমাকে ছোটমা বলে ডাকি কেন?
—আমি যে তোমার যশোমতি মাইয়ার চেয়ে বার বছরের ছোট। তাই আমি তোমাদের ছোটমা।
—কিন্তু তুমি তো মাইয়ার চেয়ে লম্বা? মাইয়াও তোমাকে দিদি বলে ডাকে। পিতাজীও তোমাকে ভাবী বলে, তাহলে তুমি ছোট হলে কী করে? সবাই তোমাকে বড় বলে, অথচ তুমি নিজেকে বলছো ছোট, আমি বুঝতে পারছি না সবাই বড় বলা সত্বেও তুমি ছোট হলে কী করে?’
কানাইয়ের কথা শুনে রোহিণীমা হাসতে থাকেন। তাঁর গণ্ডদেশে আপন গণ্ডদেশ স্থাপন করে আদর করতে থাকেন। কানা আদর খেতে খেতে বলে—”আচ্ছা ছোট মা, দাউ দাদাকে সবাই তোমার ছেলে বলে, আমি কি তোমার ছেলে নই?” রোহিণী মাইয়ার দুই চোখ অশ্রুতে ভরে ওঠে। তিনি কানাইয়ের শ্রীমুখকমলে চুম্বন করতে করতে বলেন,—’কে বলে তুমি আমার পুত্র নও? দাউ দাদা যদি ছোট মাইয়ার হৃদয় হয়, তবে তুমি সেই হৃদয়ের স্পন্দন। দাউ দাদা যদি স্পন্দন হয় তবে তুমি অনুভব। তোমার সখারা সব আমার দু-নয়নের আলো।” কানাইকে কোলে নিয়ে রোহিণী মাইয়া আদর করতে করতে নন্দমহারাজের গৃহ সংলগ্ন বাগান বাড়িতে প্রবেশ করেন। বাগানে একটি লতার পল্লবে ফুল ফুটতে দেখে কানাই রোহিণী মাইয়াকে জিজ্ঞাসা করল, ”ছোটমা লতার শাখায় এত ফুল ফুটেছে কেন?”
রোহিণী সহসা এই প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন ভেবে পান না। কিন্তু অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের নায়ক লীলাবেশে যার কোলে বিরাজ করছেন—তাকে উত্তর দেওয়ার জন্য ভাবতে হয়? তিনি কানাইয়াকে পুষ্প শোভিত লতার কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, ”তোমার শৃঙ্গারের জন্য (অর্থাৎ তোমাকে সুন্দর করে সাজানোর জন্য) লতার শখায় অত ফুল ফুটেছে। লতার ফুল সব তোমার খুশির জন্য বাগানে বিকশিত হয়েছে।’
—’সত্যি! ছোট মা, সব আমার জন্য’…আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে কানাই রোহিণীর কোল থেকে ঝট করে নেমে পড়ে এবং ছুটে চলে যায় পুষ্পিত লতাটির নিকটে। লতার গায়ে কোমল কর আলতোভাবে রেখে জিজ্ঞাসা করে কানাই,—’তুই আমার! আমার জন্য পুষ্প প্রসব করেছিস। তুই খুব ভালো। আমি তোর পুষ্প রোজ মাথার কেশচূড়ায় লাগাবো।’ পুষ্পিত লতাকে আদর করে কানাই ফিরে আসে রোহিণী মায়ের কাছে। রোহিণী মায়ের স্থির বিশ্বাস আগামীকাল থেকে এই লতা আরও অধিক পুষ্প প্রসব করবে। কানাই রোহিণী মায়ের কোলে না উঠে, হাত ধরে ধরে বাগানে ভ্রমণ করতে থাকে। একটি তরুর নিকটে দাঁড়িয়ে সে ছোটমাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘এই বৃক্ষটা এত ছোট ছোট ফল দেয় কেন?’ কানাইয়ের প্রশ্নের কোন মাথামুণ্ডু নেই। কিন্তু রোহিণীকে তো কিছু একটা বলতে হবে—তাই তিনি বললেন, ‘এই ফল এসেছে মাত্র। আস্তে আস্তে বড় হবে তারপর পক্ক রসাল মধুর হবে।’
—”কি বললে ছোটমা, এই এসেছে মাত্র, তাহলে তা হেঁটে আসতে ফলটার খুব কষ্ট হয়েছে। আমি একে জলপান করাবো”, কানাইয়ের কথা শুনে রোহিণী মায়ের অধরে নির্মল প্রসন্ন হাসি ফুলের মতো বিকশিত হয়। তাঁর এই আদরের পুত্র ব্রজের জীবনদীপ কত সরল আপন ভোলা স্বভাবের। তিনি কানাইয়ের মাথায় চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললেন, ‘এ তো এখন সরাসরি মুখে করে কিছু খেতে পারে না, যেমন তোমার আদরের পদ্মগন্ধী গাভীটির গৌরব নামক বৎসটি তোমার মতো পাত্র ভর্ত্তি দুধ মুখে করে খেতে পারে না, মায়ের স্তনে মুখ লাগিয়ে পান করে। তুমি বৃক্ষের মূলে জল সিঞ্চন কর। বৃক্ষ মূল দ্বারা জলপান করলেই সব ফল তার ভেতর থেকেই জল পান করে নেবে। কানাই বাগানের জলকুণ্ড থেকে জল সংগ্রহ করে বৃক্ষমূলে সিঞ্চন করতে থাকে এবং সিঞ্চন শেষ হলে ঝুঁকে দেখতে থাকে ফল হচ্ছে কিনা।
এমন সময় মধুমঙ্গল সহ সখারা কলরব করতে করতে কানাই-এর সন্ধানে বাগানবাড়িতে প্রবেশ করল। মধুমঙ্গলকে দেখে কানাই ভেংচি কাটে। মধুমঙ্গল রোহিণীমাকে নালিশ করে—’দেখ রোহিণীমা কানাই আমাকে মুখ ভ্যাঙাচ্ছে।’ তেজস্বী, দেবপ্রস্থ ইত্যাদি কানাইয়ের চেয়ে ছোট বয়সের সখাদের কানাই যদি ভেংচি কাটতো তাহলে মা রোহিণী কানাইকে বলতেন, ‘কানাই ছোট ভাইদের সঙ্গে অমন আচরণ করে না। কিন্তু মধুমঙ্গল কানাই-এর বয়স্ক সখা। সে কানাই-এর চেয়ে বয়সে বড়। তাই রোহিণীমা মধুমঙ্গলকে বললেন, ‘তুমি তো বাবা ব্রাহ্মণের সন্তান। তোমার ছোট্ট যজমান কানুর উপর রাগ না করে তাকে কৃপা করা উচিত। ও তো এখন অবোধ বালক, ওর বিরুদ্ধে নালিশ না করে তোমার উচিত ওকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ করা।’ ছোটমার প্রশ্রয় পেয়ে কানাই তখন বলে ওঠে—’জান তো ছোটমা গতকাল গোচারণের মাঠে, মধুমঙ্গল না আমার কাছে এ-তো-ব-ড় মিঠাই চাইছিল। দুহাত প্রসারিত করে কানাই মিঠাই এর আকার কত বড় তা রোহিণীমাকে বোঝাতে চেষ্টা করে।’
—’জান তো রোহিণীমা, কানাই মিঠাই থেকে ছোট্ট দুটি কণা আমাকে ভেঙ্গে দিতে এসেছিল—আমি তা নেব কেন? তুমি ওকে বলে দাও, এখন থেকে যজমানের কৃপণ হলে চলবে না। ওকে উদার হৃদয় করে গড়ে তোলার জন্যই আমি মাঝে মাঝে ওর হাত থেকে মিঠাই ছিনিয়ে নিয়ে ওকে কৃপা করি। আচ্ছা রোহিণী মা, তোমরা মায়েরা সব মিঠাই অত ছোট ছোট করে তৈরি কর কেন? এবার থেকে খুব বড় বড় করে মিঠাই তৈরি করবে’।
রোহিণী বললেন, ‘বাবা, মিঠাই বড় বড় করে তৈরি করলে তোমাদের ভেঙ্গে খেতে অসুবিধা হবে। তাছাড়া তোমার এই ছোট্ট যজমান বড় মিঠাই হাত দিয়ে তুলে খেতেই পারবে না।’ বলতে বলতে রোহিণীমায়ের মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে। তিনি মধুমঙ্গলের দিকে চেয়ে পুনরায় বললেন, ‘তোমার যদি বড় মিঠাই খাওয়ার সাধ হয়, তবে তুমি আগামীকাল থেকে ওদের সঙ্গে গোচারণে যেও না, বাড়িতে থেকো। আমি তোমাকে তোমার ইচ্ছামত বড় বড় মিঠাই তৈরি করে খাওয়াবো’।
—’দেখ রোহিণীমা, আমি যদি এদের সাথে গোচারণে না যাই তাহলে বনের মধ্যে এই ক্ষুদ্র যজমানকে আশীর্বাদ দেবে কে? বানরে না ভাল্লুকে? সেখানে কী আমার মতো নির্লোভী নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ মিলবে। না-না বড় মিঠাই-এর জন্য আমি আমার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার সুযোগ কাউকে দিতে পারবো না।’ মধু-মঙ্গলের বলার ভঙ্গী দেখে রোহিণীমা সহ সকলেই হাসতে শুরু করেন। সখাদের মধ্যে ভদ্র (কানাই-এর কাকার ছেলেও বন্ধু) সহসা রোহিণীমাকে জিজ্ঞাসা করল, —’মা তুমি মল্লবিদ্যা এবং লাঠি চালাতে জান?’ রোহিণী ভদ্রর প্রশ্ন শুনে গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আমি ক্ষত্রিয় রমণী, তাই ছোট থেকেই পিতাশ্রীর কাছে অশ্বচালনা, রথচালনা, খড়গচালনা, মল্লবিদ্যা, ধনুর্বিদ্যা সবই শিখেছি। তোমরা কেউ অসি চালনা করতে জান?’ সখারা নিরুত্তর। ভদ্র অবাক হয়ে রোহিণীমায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। মনে মনে ভাবে বৃদ্ধ গোপ গোপীরা রোহিণীমাকে রাণী বলে সম্বোধন করে। এই সম্বোধন যে শুধু শুধু নয় তা বুঝতে তার বাকী থাকে না। ভদ্র মধুমঙ্গল সখারা সব রোহিণীমায়ের কাছ হতে বিদায় নিয়ে চলে যায়। রয়ে যায় শুধু কানাই। সখারা চলে যেতেই যে রোহিণী মাকে বলে—’ছোট মা আমাকে একটা গান শোনাও না?’ রোহিণীমা বাগানের কদম্ব তরুতলে কানাইকে কোলে নিয়ে বসলেন। তারপর শুরু করলেন গান—
ওরে আমার হৃদয়ের নিধি, নাড়ী ছেঁড়া ধন।
তোরে জড়িয়ে ধরে, শীতল করি তপ্ত জীবন।।
নয়নের তারা তুই, প্রাণের আনন্দ অনুভব।
সকল সম্পদের সার তুই, ব্রজের গৌরব।।
তুই নীলমণি নন্দ যশোদার বুকের স্পন্দন।
গোঠের রাজা তুই, তোরে পেয়ে ধন্য বৃন্দাবন।।
কানাইকে কোলে বসিয়ে দোলা দিতে দিতে রোহিণী মা গুন গুন স্বরে গান গাইতে থাকেন। রোহিণীর গান শুনে বাগানে তরু শাখার পাখীরা চুপ হয়ে যায়। গোপাল ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত গোপালকে নিয়ে রোহিণীমা গৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে স্বর্ণপালঙ্কে দুগ্ধ-ফেন-নিভ কোমল শয্যায় শুইয়ে দিলেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন