বোনের দাদা—দাদার ভাই

শ্রাবণ মাসের রাখী পূর্ণিমা। সমগ্র দ্বারকা নগরী জুড়ে রাখীবন্ধনের উৎসব মহাসমারোহে পালিত হচ্ছে। দ্বারকায় আনন্দ যেন আজ মূর্তিমান হয়ে পরমোল্লাসে নৃত্য করছে। অভিমন্যু জননী সুভদ্রা দ্বারকায় এসেছেন হস্তিনাপুর থেকে। উদ্দেশ্য আনন্দ উৎসবে দাদা বলরাম ও শ্রীকৃষ্ণের হাতে রাখী পরাবেন। প্রাসাদের নিভৃতকক্ষে স্বর্ণ থালিতে প্রজ্বলিত দীপ-পুষ্পমালা-চন্দন-রেশমসূত্রের তৈরী রাখী ও অন্যান্য দ্রব্য সম্ভার সাজিয়ে তিনি অপেক্ষা করছেন অগ্রজ ভ্রাতাদের জন্য।

যথাসময়ে স্নানাদি সমাপন করে নববস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম দুভাই সুভদ্রার কক্ষে প্রবেশ করলেন। ভগ্নী সুভদ্রা সর্বপ্রথম বড়দাদা বলরামকে আরতিবন্দনা করে, কন্ঠে পুষ্পমাল্য অর্পন করে কপালে তিলক অঙ্কিত করে হাতে রাখীর মঙ্গলসূত্র বেঁধে দিলেন। অতঃপর বলরামকে মাখন ও মিছরী খাওয়ালেন। বলরাম মাখন মিছরী খেতে খেতে ভগ্নীকে আশীর্বাদ করলেন। সুভদ্রাও অগ্রজের চরণ স্পর্শ করে প্রণাম জানালেন এবং অগ্রজের দীর্ঘজীবন কামনা করলেন।

অনন্তর সুভদ্রা শ্রীকৃষ্ণের সম্মুখে উপনীতা হয়ে তাঁকেও আরতি বন্দনাদি করে কপালে তিলকাদি রচনা করে, কন্ঠে পুষ্পমাল্য অর্পণকরত হাতে রাখীর মঙ্গলসূত্র পরিয়ে দিয়ে মাখন মিছরী খাওয়ানোর পূর্বেই শ্রীকৃষ্ণ সহসা থালি থেকে মাখন মিছরী নিজ হাতে তুলে নিলেন। তা দেখে বলরাম টিপ্পনি কেটে বললেন, ‘ভগ্নি সুভদ্রে! তোমার এই দাদাটি মাখন চুরির অভ্যাস দেখছি এখনও ত্যাগ করতে পারেনি।’ টিপ্পনী কেটে বলরাম মুচকি মুচকি হাসতে থাকেন। তা দেখে কৃষ্ণ বললেন,—’দাউজী [দাদাজী] চুরি আমি করি কিন্তু খাও তুমি। মাখন চুরি করে খাওয়ানোই আমার স্বভাব—ওতেই আমার আনন্দ।’ থালি থেকে তুলে নেওয়া মাখন মিছরী সুভদ্রাকে খাওয়াতে খাওয়াতে বলরামের কথার উত্তর দিলেন শ্রীকৃষ্ণ। খাওয়া শেষ হলে সুভদ্রা কৃষ্ণকে প্রণাম করলেন। কৃষ্ণ সুভদ্রাকে বললেন,—’ভগ্নি, আজ তোমার জন্য আমি একটা উপহার এনেছি।’

উপহারের কি দরকার? তোমাদের আশীর্বাদ স্নেহ-ভালোবাসাই তো আমার পরম সম্পদ।

—ভগ্নি ভাইয়ের মঙ্গলকামনা করে হাতে যে রক্ষা বন্ধনী বেঁধে দেয় তার বিনিময়ে তাকে কিছু দেওয়াও যে ভাইয়ের কর্তব্য। শুধু মৌখিক আশীর্বাদেই লৌকিক কর্তব্য সম্পন্ন হয় না।

আমাকে উপহার দিয়ে যদি তুমি সুখী হও, তবে তোমার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক।

অতঃপর শ্রীকৃষ্ণ একটি কাঠের সিন্দুক খুলে একটি অপরূপ দারুনির্মিত রথ ভগ্নি সুভদ্রার হাতে তুলে দিলেন। রথের তিনটি প্রকোষ্ঠ। মধ্যের প্রকোষ্ঠটিতে ভগ্নি সুভদ্রার মূর্তি সুন্দরভাবে নির্মিত করে স্থাপন করা হয়েছে। দুপাশের দুটি প্রকোষ্ঠের একটিতে বলরাম ও অন্যটিতে শ্রীকৃষ্ণের মনোহর দারুমূর্তি বিরাজমান। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে—তিনটি দারুমূর্তিই কথা বলতে পারে। যে প্রকোষ্ঠটিতে বলরাম মূর্তি বিরাজমান তার নাম তালধ্বজ রথ, পাশের অন্য যে প্রকোষ্ঠটিতে শ্রীকৃষ্ণ মূর্তি বিরাজ করছে তার নাম গরুড় ধ্বজ রথ, এবং মধ্যের প্রকোষ্ঠটির নাম দেবীদলন রথ—যার মধ্যে ভগ্নি সুভদ্রার মূর্তি শোভা পাচ্ছে।

দারুনির্মিত রথে দারুমূর্তি দেখে অগ্রজ বলরাম অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। উপহাসের সুরে তিনি কৃষ্ণকে বললেন,—’কৃষ্ণ! সুভদ্রা এখন আর ছোট্ট খুকী নয় যে ওকে কাঠের খেলনা বা পুতুল দিয়ে ভুলিয়ে রাখবে। তাছাড়া ভগ্নির এখন পুতুল খেলার বয়সও নেই—যে তোমার দেওয়া পুতুল নিয়ে খেলা করবে। ও এখন অভিমন্যুর মত বীরপুত্রের মা। তুমি দ্বারকাধীশ। উপহার যদি দিতেই হয় তবে ভগ্নিকে ধনদৌলত দাও। কাঠের খেলনা, কাঠের পুতুল দিয়ে আদরের বোনটিকে আর কাঠের পুতুল তৈরি করে মন খুশী করার চেষ্টা করো না। ওসব আজে বাজে তুচ্ছ পদার্থ প্রদান করে ভগ্নির মনোরঞ্জনের প্রচেষ্টা ত্যাগ করো।’ বলরামের কথা শেষ হলে কৃষ্ণ বললেন,—’তুমি ঠিকই বলেছ দাউজী। বৃদ্ধবয়সে কখনও কখনও বাল্যস্বভাব বা বাল্যাবস্থা ফিরে আসে। যেমন তোমার এখনও বাল্য স্বভাব রয়েই গেছে।’

—তার মানে?—বলরামের সবিস্ময় জিজ্ঞাসা।

বাল্যকালে তুমি আমার কালো শরীর নিয়ে খুবই ব্যঙ্গ করতে, সখাদের সামনেই বলতে—বাবা নন্দ গৌরবর্ণের, মা যশোদা গৌরাঙ্গী, আর আমি কেন কালো হলাম। আবার আজ ব্যঙ্গ করে বলছো—দ্বারকাধীশ, ভাইকে ব্যঙ্গ করে বিরক্ত করার অভ্যাসটা তোমার গেল না দাউজী।

—তুমি কি বলতে চাও যে তুমি দ্বারকাধীশ নও?

—দ্বারকাধীশ আমি কখন হলাম—দ্বারকাধীশ তো তুমিই।

—একথার অর্থ?

—দ্বারকার রাজকোষের একটি স্বর্ণ মুদ্রাও কি তোমার বিনা অনুমতিতে ব্যয় হয়? আঠারো অক্ষৌহিনীর সেনানায়ক কে? আমি না তুমি? প্রজা পরিষদের অধ্যক্ষ কে? তুমি-তুমি-সব তুমি দাউজী। আমি তোমার দ্বারকার সব প্রজার পাদ-প্রক্ষালনকারী এক সেবক। উচ্ছিষ্ট পাত্র উত্তোলনকারী এক দাস মাত্র। সমগ্র দ্বারকাবাসীর নিযুক্ত নৃত্যগীত শিল্পকলার অনুরাগী এক ক্ষুদ্র শিক্ষক। দারু শিল্পকার্য আমি ছোট থেকেই ভালোবাসি। সেইজন্য বহুদিন ধরে বেশ কয়েক মাসের নৈষ্ঠিক প্রচেষ্টায় এই দারুশিল্পটি তৈরি করেছি—আজকের দিনটিতে ভগ্নি সুভদ্রাকে উপহার দেব বলে। এটা আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও প্রিয় শিল্পকর্ম—আজ পূণ্য তিথিতে এটাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করা কি ঠিক?

বলরাম নিরুত্তর। শ্রীকৃষ্ণের দুই নয়ন অশ্রু সজল হয়ে ওঠে। সুভদ্রা তা লক্ষ্য করে পরিস্থিতি হালকা করার জন্য কৃষ্ণের বুকে মাথা রেখে বলেন—ভাইয়া, তুমি আমার সঙ্গে হস্তিনাপুর যাবে?

—না বোন, তোমাকে তোমার শ্বশুর বাড়ীতে পৌঁছে দিয়ে আসবে দাউজী।

—তুমি কেন যাবে না ভাইয়া? তুমি ও দাউজীর সঙ্গে চলনা? দুজনায় গেলে খুব আনন্দ হবে। চল না ভাইয়া—

—হিমালয় থেকে কয়েকজন সাধু মহাত্মা আসবেন। সৎসঙ্গ হবে। তাদের সেবা করবে কে?

—তুমি ও বড় ভাইয়া ছাড়া আর যারা রয়েছেন, তাদের হাতে সেবার ভার দিয়ে চল না বোনের বাড়ি একটু বেড়িয়ে আসবে।

—সাধু মহাত্মার সেবা কার্যভার আমি স্বয়ং গ্রহণ করি। অন্য কাউকে এই দায়িত্ব আমি অর্পণ করি না। তুমি তো জানো—সেবা কর্মই আমার প্রথম ও প্রধান ধর্ম।

সুভদ্রা কৃষ্ণ ভাইয়ার কথা শুনে উদাস হয়ে গেলেন। একটা বিষণ্ণতার ছাপ তার সারামুখে ছড়িয়ে পড়লো। কৃষ্ণ তা লক্ষ্য করে সুভদ্রার মাথায় হাত রেখে স্নেহার্দ কণ্ঠে বললেন—এই দারুনির্মিত রথস্থিত মূর্তি হাতে নিয়ে তুমি যখনই আমাদের দুই ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলবে তখন আমরা দুইভাই তোমার কথার উত্তর দেব এবং তোমার সঙ্গে বার্তালাপ ও করবো। বিশ্বাস না হলে তুমি রথস্থিত মূর্তিগুলি পরীক্ষা করে দেখতো পারো।

শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে সুভদ্রা অপলক নয়নে দারুমূর্তিগুলির দিকে চেয়ে থাকেন। সহসা তিনমূর্তির অধর স্পন্দিত হয়ে উচ্চারিত হয়—ওম জগন্নাথায় নমঃ। সমগ্র কক্ষে সেই বাণী অনুরণিত হয়। সুভদ্রা অশ্রুভরা নয়নে শ্রীকৃষ্ণের পাদবন্দনার ছলে পাদপ্রক্ষালন করেন। বলরাম প্রেমার্দ হৃদয়ে শ্রীকৃষ্ণকে বুকে চেপে ধরে বলেন—ভাই কৃষ্ণ, তোমার হৃদয় না বুঝে তোমাকে অনেক ব্যঙ্গ করেছি—আমায় ক্ষমা করো।

কৃষ্ণ বলরামের মুখ চেপে ধরে বলেন—দাউজী, ছোট ভাইয়ার কাছে ক্ষমা চাইতে নেই। ভাইয়া শুধুই তোমার স্নেহের ভাইয়া।

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন