রসিক কানাই

সেদিন সকালবেলায় কানাই-এর নামে নালিশ নিয়ে ব্রজের গোপীরা সবাই জড়ো হয়েছে যশোদার অঙ্গনে। যশোদা তাদের দেখে বললেন—কিরে সব সকাল সকাল আমার বাড়ীতে কেন? কিছু দরকার পড়েছে বুঝি তোদের?’

গোপীরা বলে, নাগো নন্দরাণী, আমরা কোনও দরকারে আসিনি—এসেছি তোমার কানাইয়ের নামে নালিশ জানাতে। তোমাকে কিন্তু মন দিয়ে আমাদের সব অভিযোগ শুনতে হবে। যশোদা বলেন, বেশ বল। গোপীরা সব একে একে গোপাল কার বাড়ীতে ননী চুরি করেছে, কার বাড়ীতে ভাঁড় ভেঙেছে, গোদোহনের আগে বাছুর ছেড়ে দিয়েছে—সব শুনিয়ে যায় মা যশোদাকে। কিন্তু গোপীদের মধ্যে একজন গোপী চুপ করে থাকে, সেও মা যশোদার মত সবার কথা শোনে কিন্তু নিজে কিছু অভিযোগ জানায় না মা যশোদার কাছে। তার এই নীরবতা দেখে অন্য গোপীরা তাকে বলে,—’কিরে চুপ করে রইলি যে, তোর ঘরে ঢুকে কানাই কি করেছে নন্দরাণীকে বল? তখন সেই গোপীটি বলল,—’আমার ঘরে ঢুকে কানাই যা করেছে তা বলার যোগ্য নয়। আমি তা বলতেও পারবো না।’ অন্য গোপীরা বলে—ওটি হবে না, তোমাকে বলতেই হবে। যতক্ষণ না তুমি বলছো ততক্ষণ তোমাকে এখান থেকে যেতেই দেব না। সবার পীড়াপীড়িতে গোপীটি তখন অন্য গোপীদের বলল, তোমাদের সবাইকে শপথ করতে হবে এই কথা তোমরা অন্য কাউকে বলতে পারবে না? যদি তোমরা শপথ করো তাহলে বলতে পারি। গোপীরা শপথ করে যে, কথাটা কখনও কারও কাছে প্রকাশ করবে না। তখন সেই গোপীটি বলতে শুরু করে তার ঘরে ঢুকে কানাই কি করেছে সে কাহিনী :

‘তোমরা তো জান দিদি আমার স্বামী সারাদিন মাঠে পরিশ্রম করে, এক একদিন মাঠ থেকে ফিরতে রাতও হয়ে যায়। গত পরশুদিন অনেক রাত পর্যন্ত মাঠে ক্ষেতের কাজ করে আমার স্বামী ঘরে ফিরে আসে ক্লান্ত হয়ে। তারপর কোনরকমে কিছু খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ে। শুতে না শুতেই আমরা দুজনে গভীর নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ি। আমরা জানতেই পারিনি যে, কখন সকাল হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে কানাই আমাদের বাড়ির খিড়কির দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে। আমাদের ঘরের বাইরে অনেক জিনিস পড়ে থাকে বলে আমরা দরজায় ছিটকিনি না দিয়ে শুয়ে পড়ি। তোমাদের দেওরের তো মাথায় চুল নেই—তাই লম্বা দাড়ি রেখে, সেই দাড়ির চুল আঁচড়িয়ে মাথার চুল আঁচড়ানোর সাধটা মেটায়। সেদিন দুষ্টু কানাই ঘরে ঢুকে করেছে কি—তোমাদের দেওরের দাড়ির লম্বা চুলের সঙ্গে আমার মাথার চুল জড়িয়ে আচ্ছা করে গিঁট বেঁধে দিয়ে পালিয়েছে। এদিকে সকাল হয়েছে। প্রতিবেশিনীরা সব চীৎকার করে ডাকছে,—আরে ও বউ যমুনায় জল আনতে যাবি না। এতখানি বেলা হল এখনও শুয়ে আছিস যে, শরীর খারাপ হয়েছে বুঝি? ওদের ডাকে আমার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখি জানালা পথে, খোলা দরজা দিয়ে রৌদ্র সে ঘরে ঝলমল করছে। লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি যেই বিছানা ছেড়ে উঠতে গেছি অমনি তোমাদের দেওর—উঁঃ! উঁঃ! উঁঃ! দাঁড়াও। দাঁড়াও। আমি বলি—অমন উঁঃ! উঁঃ! করছো কেন? তখন তোমার দেওর বলে, আমি কি সাধ কর উঁঃ উঁঃ করছি, পিছন ফিরে দেখ, আমার কি হয়েছে।

বলবো কি পিছন ফিরতেই দেখি তোমাদের দেওর দাড়ি চেপে ধরে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তা দেখে আমি তো লজ্জায় মরি। ও তখন চীৎকার করে বলছে—”কি হয়েছে একবার দেখ! আমি তখন তাকিয়ে দেখি ওর দাড়ির সঙ্গে আমার মাথার চুলে গিঁট মারা। বিয়ের সময় বস্ত্রে বস্ত্রে হয়েছিল গাঁটবন্ধন। বিয়ের পরে দেখি কেশে কেশে কেশবন্ধন। ও বলল, এ নিশ্চয়ই যশোদার ছোঁড়ার কাজ। আমার মাথার চুল টেনে নিয়ে গিয়ে গিঁটটাও বেঁধেছে একেবারে ঠিক দাড়ির নীচে। ওদিকে প্রতিবেশিনীরা চীৎকার করছে—ওরে বউ, তোর দেরী হচ্ছে কেন? নতুন নতুন লালতের শাক, ওরে আমাদের ও এমন দিন ছিল। জল আনতে যাবি কিনা বল। আমি তখন ঘর থেকে চীৎকার করে বললাম—আজ আমার শরীরটা ভালো নেই—আজ যাব না তোমরা যাও।

প্রতিবেশিনীরা চলে গেল। কিন্তু ঘরের কাণ্ডকারখানা তখন শেষ হয়নি। বহু চেষ্টা করেও গিঁট খোলা গেল না। তখন আমার স্বামী বলল,—যাও কাঁচি নিয়ে এসো। আমি বললাম ঠিক আছে যাচ্ছি বলে যেই না পা বাড়িয়েছি কাঁচি আনার জন্য অমনি তোমাদের দেওর বলছে দাঁড়াও, দাঁড়াও আমিও তোমার সঙ্গে যাচ্ছি নইলে আমার সমস্ত দাড়ি ছিঁড়ে তোমার সঙ্গে চলে যাবে। আমি আগে আগে চলি, পিছে পিছে আসে তোমাদের দেওর। একবার বিয়ের সময় অগ্নি ব্রাহ্মণ সাক্ষী করে সাতপাক দিয়েছিলাম। এখন ঘরে দুজনায় দুজনার সাক্ষী হয়ে কত যে পাক খেলাম তার শেষ নেই। যাই হোক কোনরকমে পাশের ঘরে ঢুকে কাঁচি খুঁজে পেতেই আবার আমাদের দুজনার মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। ও বলে তোমার চুলে কাঁচি চালাও? আমি বলি, কেন? তোমার দাড়িতে কাঁচি চালাও? আমি সধবা। সধবার চল কাটা অমঙ্গল, বিশেষ করে বিয়ের পর। তখন ও বলে, একে তো মাথায় চুল নেই। তার উপর দাড়ি কেটে যদি পরিষ্কার হয়ে রাস্তায় বের হই—তখন লোকে জিজ্ঞাসা করবে—কিরে তোর অশৌচ কবে হলো? তখন আমি কি উত্তর দেব?’

কি বলবো যশোদা মা? তোমার গোপালের কুকীর্তির কথা-একথা কি কাউকে বলা যায়? দোহাই তোমাদের তোমরা যেন এই কথাটা আবার পাঁচকান করো না। তাহলে ব্রজের সবাই আমাদের নিয়ে ঠাট্টা মস্করা করবে। গোপীটির অভিযোগ শুনে যশোদাসহ অন্য গোপীরা মুখটিপে হাসতে থাকেন।

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন