যশোদার অঙ্গনে

নীলমণি শ্যামসুন্দর গৃহ অঙ্গনে সখাদের সঙ্গে খেলায় মত্ত। খেলতে খেলতে খাওয়ার কথা ভুলে গেছে সে। সকাল থেকেই চলছে বিরামহীন খেলা। সখারা কৃষ্ণের নয়ন কমলের উপর একখানি পাতলা রেশমী বস্ত্রের আচ্ছাদন পরিয়ে দিয়ে বাড়ির প্রাঙ্গণে সব ‘কানামাছি’ খেলছে। কৃষ্ণ চোখ বাঁধা অবস্থায় আশপাশেই দাঁড়িয়ে থাকা সখাদের হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করার চেষ্টা করছে। সখারা সরে সরে যাচ্ছে আর বলছে—”কানামাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছোঁ”—ব্রজের গোপীরাও সে দৃশ্য উপভোগ করছেন নন্দমহারাজের বাড়ির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে। মা যশোমতিও রান্না ঘরের বারান্দায় মাখন মিছরি ভর্তি থালা সাজিয়ে বসে আছেন। মাঝে মাঝে নীলমণি সহ সখাদের উদ্দেশ্য করে বলছেন—’বাছারা, বড় ভালো হত যদি একটু খেয়ে নিয়ে আবার খেলতে, ওরে ও লালা বন্ধুদের নিয়ে আমার কাছে আয় না বাবা।’ উপস্থিত গোপবধুরা বলছেন, ‘দেখছ না তোমার নীলমণি এখন খেলায় মত্ত। এসময় তোমার ডাক কি ওদের কানে ঢুকবে?’ ‘এমনিতে আমার লালা তো কিছুই খেতে চায় না। ওর দাদা বলাই এবং অন্য সখারাও হয়েছে ঠিক ওরই মতো। সব ক্ষিধে পেটে ধরে যে কী করে থাকে বুঝি না, এই জন্যই সব দুর্বল-রোগা হয়ে যাচ্ছে।’ গোপবধুদের সাথে কথা বলতে বলতে মা যশোমতীর পয়োধর থেকে দুগ্ধ নিঃসৃত হয়ে বুকের বস্ত্রাঞ্চল ভিজে যায়। তা দেখে গোপবধুরা মুখ টিপে টিপে হাসতে থাকেন। যশোমতি সেদিকে লক্ষ্য না করে বলেন,—’ব্রজে তোদের যত পুত্র আছে আমি তো তাদের সবার ধাত্রী মা। এই ব্রজপুরে এমন কোন ছেলে নেই যে আমার বুকের দুধ পান করেনি। তোদের সবার আশীর্বাদেই তো আমি নীলমণিকে পেয়েছি। ও তো আসলে তোদেরই ছেলে—আমি তো শুধু…। ‘কি হলো তোরা সব হাসছিস যে, শোন তোরা সব ছেলের মা হলেও, এখনও কিন্তু আমার বুকের দুধ খাওয়ার বয়স তোদেরও আছে।’

বাৎসল্যময়ী যশোদার কাছে গোপবধুরা শিশুকন্যা সদৃশা; তাদের পুত্ররাও যশোদার দৃষ্টিতে চিরশিশু। কিছু না খাওয়াটাই যেন বাচ্ছাদের কাছে প্রিয়। ‘আবার খেতে যদি বসে তাহলে পাখীর মতো দু’একটা দানা মুখে তুলেই ওরা খাওয়া শেষ করে দেয়। এইজন্য তো সব দুর্বল-কৃশকায়। দেখলে মনে হয় সব হাওয়া লেগে উড়ে যাবে।’ গোপীদের শুনিয়ে শুনিয়ে উপরোক্ত কথাগুলি বলেন মা যশোমতি। সখাসহ কানু-বলাই খেতে আসতে দেরী করায় তিনি একখানি মৃন্ময় পাত্র নিয়ে তক্র তৈরীতে মনোনিবেশ করলেন (তক্র অর্থাৎ ঘোল)।

—’মাইয়া, তোমার দাউ (বলরাম) কখনও খাওয়া নিয়ে অশান্তি করে?’ গোপবধুরা যশোমতিকে জিজ্ঞাসা করেন।

—’দাউকে যে খাবার দিই না কেন ও সঙ্গে সঙ্গে মুখে পুরে নেবে। ওকে খাইয়েই যা হোক একটু শান্তি পাই। তবে হ্যাঁ স্বর্ণরোমা পদ্মগন্ধা গাভীর দুগ্ধ নির্মিত দহী ওর খুব প্রিয়। নীলমণি, ভদ্র এরা ভালোবাসে পদ্মগন্ধা কপিলার দুধ।’

—’তোমার নীলমণির তো বেশি প্রিয় তোমার বুকের দুধ, তাই না? গোপীরা জিজ্ঞাসা করে।

—”তা যা বলেছিস, তবে সবসময় তো বুকের দুধ দেওয়া যায় না—তাই গাভীর দুধও ওকে পান করাই। ছোট থেকেই এরজন্য আমাকে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। দু ঢোক দুধ পান করানোর জন্য ওকে অনেক অনুনয়-বিনয় করতে হত—এখনও করতে হয়, আমার বলাই-এর কিন্তু ওসব নেই। খাওয়ার ব্যাপারে ও সবার চেয়ে আগে। কিন্তু একবার যদি গোঁ ধরে নাহুঁ নাহুঁ করে তাহলে কার সাধ্যি বলাইকে খাওয়ায়—লাখ চেষ্টা করো ও খাবার-এর পাত্র পানে ফিরেও চাইবে না।” যশোমতি, গোপীরা যখন এইরূপ কথোপকথন করছিলেন তখন সহসা তাঁর আদরের নীলমণি খেলা ছেড়ে—’মাইয়া, ও মাইয়া” উচ্চৈস্বরে ডাকতে ডাকতে মায়ের কাছে এসে উপস্থিত হল।

—’কি হয়েছে অত চিৎকার করছিস কেন? তোর কি কোন গাভী হারিয়েছে?’ গোপীদের মধ্যে একজন যশোদাদুলালকে জিজ্ঞাসা করে। ক্রীড়ার আবেশে তাঁর এটুকু বোধও নেই যে, এ সময় বাড়ি থেকে গাভী কী করে হারিয়ে যাবে। তাই সে (কানু) বিরক্ত হয়ে উত্তর দিল ‘আমার গাভী কেন হারাবে? তুই হারিয়ে গেছিস।’

গোপী হাসতে হাসতে বলে, ‘আমি আবার কোথায় হারালাম?’

আমি তো তোদের বাড়ির প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছি।

—’তবে তোর মেয়ে হারিয়েছে, দেখগে যা!’

নীলমণি দেখল গোপী যখন হারিয়ে যায়নি, তখন কোন না কোন একজনকে তো অবশ্যই হারিয়ে যেতে হবে, তাই সে গোপীকে উপরিউক্ত কথা বলল। গোপী ও কানাইকে নিয়ে মজা করার জন্য বলল, ‘আমার মেয়ে যদি হারিয়ে যায়’—তাহলে যা, তাঁকে খুজে নিয়ে আয়।”

—কেন, আমি তোর মেয়েকে খুঁজতে যাব কেন?’

গোপী সহাস্য বদনে বলে—’সে যে তোর বোন, তুই যে তার ভাই। গোপীর কথায় কানু নীরব হয়ে যায়। সে কেমন করে অস্বীকার করবে যে ঐ গোপীর কন্যা তাঁর বোন নয়। মনে মনে ভাবে গোপী মিথ্যা বলছে। তাঁর বোন কি কখনও হারাতে পারে? গোপী মিছামিছি তাঁকে বিরক্ত করছে। তাই সে ক্ষুব্ধ হয়ে গোপীকে বলে—’তু একটা মল্লু’ (বানর)। মাইয়া, তুই এই গোপীকে মার লাগা। মায়ের দিকে দৃষ্টি পড়তেই নীলমণি দেখে, মা ঘোল তৈরি করছে। সঙ্গে সঙ্গে গোপীদের কথা ভুলে যায়। মায়ের নিকটে উপনীত হয়ে দুই কচি হাতে গলা জড়িয়ে ধরে বলে—’মাইয়া, আমি ঘোল পান করবো।’

যশোমতি গ্রীবা বেঁকিয়ে পুত্রমুখ চুম্বন করে বললেন, ঘোল কেন পান করবে বাছা, মাখন-মিছরি-দুধ-দহী তোমাদের সকলের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি—তুমি সখাদের সঙ্গে নিয়ে খেতে শুরু কর।’

কানাই দেখে গোপীরা সব তখনও দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির প্রাঙ্গণে। তাদের দেখে সে জেদ করে বলে—’মাইয়া আমি ঘোলই পান করবো। সব ঘোলটা আমি একাই খাব, কিন্তু…’

নীলমণির কথা শুনে যশোমতি হাসতে থাকেন। হাসতে থাকে প্রাঙ্গণস্থিতা গোপবধুরা। পদ্মগন্ধা কপিলা গাভীর দুগ্ধ-দহী হতে যে ঘোল হয় তা অনেক সাধ্য সাধনার পরই কানাই দু-ঢোঁক পান করে—আর আজ বলছে কিনা সব ঘোলটাই সে পান করবে। তাই যশোমতি সহ সকলে হাসছেন।

কানাইয়ের দুধে যদি রুচি না আসে, তবে কানাই সেই দুধ অন্যকে পান করতে বলে। ‘দাউ দাদা, ভদ্র সবাই এদিকে আয়, মাইয়া খেতে দিয়েছে, খাবি আয়’ কানাই সবাইকে চিৎকার করে ডাকে। মা যশোমতি ভাবছেন ঘোল পান করার খুশীতে যদি দু ঢোঁক ঘোলই পান করে তো তাই করুক। আহা! বেচারা সকাল থেকে কিছু মুখে দেয়নি।

ইতিমধ্যে বলরাম ভদ্রাদি সখারা সব যশোমতির কাছে উপস্থিত হল। তারা মায়ের কাছে আসতেই কানু বলল, ‘এদের সব দহী-মাখন-মিছরি দে-মাইয়া।’

সখারা জিজ্ঞাসা করে—’কানু, তুই দহী-মাখন-মিছরি খাবি না?’

—’উঁহু, আমি শুধু ঘোলই পান করবো। সব ঘো-ল।’

পূর্বে যে গোপবধূটি কানাইকে নিয়ে মজা করছিল সে পুনরায় বলে—’সব ঘোল তো তোর সামনেই রাখা আছে। খানা যত খুশী। তুই কি ঘোলের মটকা ধরে পান করবি? গোপীর কথা শেষ হতে না হতে কানাই একমুখ ঘোল ফুৎকার যোগে কুলি করার ন্যায় সেই গোপবধুটির সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে দিয়ে বলে—’দেখছ মাইয়া, সেই তখন থেকে আমায় কেমন জ্বালাচ্ছে। নে এবার বোঝ মজা?” যশোমতি গোপীর দশা দেখে গোপালকে মৃদু তিরস্কার করেন এবং গোপীর সারা মুখে ও গায়ে যে ঘোল লেগে আছে আপন বসনাঞ্চল দিয়ে তা মুছতে শুরু করেন। গোপী বলে—যশোদা মা, তুমি গোপালকে ভালো করে খাইয়ে দাও, এখনও বোধহয় ওর পেট ভরেনি, দেখছ না কেমন গোঁসা করে মুখ ফুলিয়ে আমার পানে চেয়ে আছে। ঘোলের দাগ আমিই মুছে নিচ্ছি তোমাকে এরজন্য ব্যস্ত হতে হবে না? যশোমতি গোপীকে বলেন—’কিছু মনে করিস না, জানিস তো আমার নীলমণি বড় চঞ্চল, নটখট (দুরন্ত, দুষ্ট), ভোলে ভালা বোকা সরল।’

গোপবধুটি বলল, ‘নীলমণি বুঝি তোমার একার? আমাদের কেউ নয়।’

—’তা কি কখনও বলতে পারি? আমার নীলমণি যে তোদের সবার আশীর্বাদের প্রসাদ।’ গোপীরা বলে, ‘যাই গো যশোদা মা, স্নানের সময় হয়েছে।”

—আবার সব ও বেলায় আসিস যেন।

—সে দেখব’খন। গোপীরা চলে যায়। নীলমণি ভোজনপর্ব সমাধান করে সখাদের সঙ্গে আবার ক্রীড়ায় মত্ত হয়।

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন