কৃষ্ণের বাঁধন

এক গোপীর নতুন বিয়ে হয়েছে। চারমাস আগে সে ব্রজের এক গোপ তরুণের বধূ হয়ে এসেছে। অন্যান্য গোপবধূদের চেয়ে সে বয়সে ছোট। নন্দের বেটা কানাইকে তার ভালো লাগে। মনে মনে ভাবে, বিয়ের আগে যদি কানাইয়ের দেখা পেতাম। এখন শ্বশুর বাড়ীতে স্বামীর ঘর করতে এসেছি—এখান থেকে তো আর যখন তখন কানাইকে দেখতে যাওয়া চলে না। সেটা উচিতও নয়। হাজার হোক শ্বশুর বাড়ী, কথা উঠবেই। খুব ভালো হয় কানাই যদি একবার তাঁর শ্বশুর বাড়ীতে মাখনচুরি করতে আসে। তাহলে সে কানাইকে ধরে বেঁধে রাখবে—তারপর যশোদাকে খবর পাঠিয়ে ডেকে আনবে। যশোদা এসে কানাইকে তিরস্কার করে যখন মারতে যাবে, তখন সে যশোদাকে আটকাবে। তাহলেই কানাইয়ের সঙ্গে তাঁর খুব ভাব হয়ে যাবে।

ভগবান অর্ন্তযামী। ভক্তের অন্তরের ইচ্ছা-তাঁর কাছে গোপন থাকে না। একদিন কানাই ওই নব গোপবধূর শ্বশুর গৃহে মাখন চুরি করতে এল যে ঘরে ননী মাখন থাকে সেই ঘরে ঢুকে মাখনের হাঁড়িতে যেই হাত ভরেছেন—অমনি নবীনা গোপবধুটি এসে তাঁকে ধরে ফেলল। কানটি কষে মলে দিয়ে বধূটি জিজ্ঞাসা করল,—”এই নটখট কি করছিস? মাখনচুরি? দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি মজা।’ গোপবধুটি কানুকে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যায় এবং থামের সাথে রেশমের দড়ি দিয়ে বেঁধে বলে,—”থাক এখানে, বাঁধা থাক-আমি এখনি তোর মাকে ডেকে নিয়ে আসছি।” গোপবধুটি যশোদাকে ডাকার জন্য গৃহ থেকে বের হয়ে যায়। যাওয়ার আগে গোপালকে ঠিকমতো বাঁধতে সে ভুলে যায়। গোপালের ভীত মুখপানে চেয়ে সে এমন মুগ্ধ হয়ে যায় যে গোপালকে ঠিকমতো থামের সাথে বাঁধতে পারে না। কোনরকম গোপালের চারদিকে দড়িটা থামের সাথে ঘুরিয়ে সে চলে যায় যশোদাকে ডাকতে। কৃষ্ণ ঐ বাঁধন সহজেই খুলে ফেলল এবং দড়িটা যথাস্থানে রেখে পালিয়ে গেল। ওদিকে গোপ-বধূটি যশোদার বাড়ী গিয়ে বলে—”মাইয়া, একবার আমাদের বাড়ী যাবে চল।’

যশোদা জিজ্ঞাসা করেন—’কেন রে?’

—’তোমার আদরের লালা, আমাদের ঘরে মাখন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। আমি তাঁকে থামের সাথে বেঁধে রেখে তোমাকে ডাকতে এসেছি। অন্য গোপীদের কথা শোন আর না শোন, আমার কথা তোমাকে শুনতেই হবে। তোমার গোপালের হাতে এখনও মাখন লেগে আছে—গিয়ে দেখবে চল।’

যশোদা জিজ্ঞাসা করেন,—”চার মাস আগে তোর বিয়ে হয়েছে না? তুই তো সবে নতুন বউ হয়ে এসেছিস। আসতে না আসতেই আমার ছেলের পিছনে লেগেছিস।”

—’মাইয়া, আমি তোমাকে মিথ্যা কথা বলছি না। অন্যেরা হয়তো তোমার কাছে মিথ্যা নালিশ জানাতে আসে কিন্তু আমি মিথ্যা নালিশ নিয়ে আসিনি।

আমার নালিশ যে সত্য তা তুমি আমাদের বাড়ী গেলেই বুঝতে পারবে।’

যশোদা মৃদু হেসে বললেন, ‘আচ্ছা বলছিস যখন চল। পায়ে পায়ে যশোদা নবগোপবধূটির সাথে তাঁর শ্বশুরালয়ে উপস্থিত হয়ে বলেন,—”দেখা, কোথায় আমার কানাইকে বেঁধে রেখেছিস, আমি নিজের চোখে দেখি।”

কোথায় কানাই! কানাই তখন হাওয়া। বধূটি থামের সাথে বাঁধা অবস্থায় কানাইকে দেখাতে না পেরে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। যশোদা বলেন,—”কোথায় আমার কানাইকে বেঁধে রেখেছিস দেখা?”

—’এইখানে থামের সাথে তো বাঁধা ছিল। কোথায় যে গেল?’

—’শোন, নতুন বউ হয়ে এসেছিস তাই ভাবতাম, তুই বোধ হয় ভাল মেয়ে—এখন দেখছি তুইও আর পাঁচজনের মত মিথ্যাবাদিনী। যাই তোর শাশুড়ীকে বলে আসি যে তোমার বউটি একটি মিথ্যুক। মিথ্যুক। মিথ্যুক।

—’মাইয়া, বিশ্বাস কর, আমি মিথ্যা বলিনি। এখানে এই থামটার সাথে কানাইকে বেঁধে রেখে তোমায় ডাকতে গিয়েছিলাম।’

—’বেঁধেই যদি রেখেছিলি, তো আমার লালা গেল কোথায়? ব্রজের গোপীরা মিছামিছি তাঁর নামে নালিশ করতো, এখন দেখছি তুইও তাদের দলে ভীড়েছিস। ব্রজের গোপীদের দেখছি সারাদিন একটাই কাজ, শুধু আমার ছেলের পিছনে লাগা।’ যশোদা গোপবধুটিকে মৃদু তিরষ্কার করে নিজের বাড়ী চলে যান।

নতুন গোপবধূটির লজ্জায় মাথা কাটা যায়। সে যশোদার কাছে মিথ্যাবাদিনী প্রতিপন্না হয়। যশোদার কাছে তাঁর মান মর্যাদা বলতে কিছুই অবশেষ রইল না। পরের দিন গোপবধুটি যমুনার জল নিয়ে বাড়ী ফিরছে, পথে দেখা হয়ে যায় কানাইয়ের সঙ্গে। কানাইকে দেখে বধুটি বলে,—’এই নটখট শোন দাঁড়া!’ কানাই দাঁড়িয়ে পড়ে। বধুটি জিজ্ঞাসা করল, কাল যে তোকে থামের সাথে বাঁধলাম, পালিয়ে এলি কি করে?’ কানাই উত্তর দেয়—”পালাব না তো ঐখানে দাঁড়িয়ে থাকব, মায়ের পিটুনী খাওয়ার জন্য।”

—আমি যে তোকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিলাম। বাঁধন খুললি কি করে?

—’তুই বাঁধতেই জানিস না। দড়ি এদিক-ওদিক করে ঘুরিয়ে দিয়ে চলে গেলি মাকে ডাকতে। এমন সহজ করে বেঁধে রাখলে দড়ি জড়িয়ে কখনও কি কাউকে বেঁধে রাখা যায়? তুই বাঁধতেই জানিস না।”

—’কানাই, তুই বুঝি খুব ভাল বাঁধতে জানিস।’

—’হুঁ। আমি যাকে বাঁধি, সে পালাতেই পারে না।’

—’আমাকে তোর মতন ‘বাঁধন দেওয়া’ শিখিয়ে দিবি?’

—”কেন শেখাবো না, নিশ্চয়ই শেখাব। চল এখুনি তোর বাড়ী গিয়ে তোকে কেমন করে বাঁধতে হয় তা শিখিয়ে দিচ্ছি।”

গোপবধূটি কানাইয়ের কথায় খুশী হয়ে কানাইকে বাড়ীতে নিয়ে এল। জলের কলসীটি যথাস্থানে নামিয়ে রেখে বলল,—”আমায় বাঁধন শিখিয়ে দে?” কানাই বলে,—’কালকের সেই রশিটা (দড়ি) নিয়ে আয়।’ গোপবধু রশি নিয়ে এসে কানাইয়ের হাতে দেয়। কানাই রশিটি হাতে নিয়ে বলে—”এবার থামের কাছে দাঁড়া। তারপর দুইহাত যুক্ত কর।” বধুটি দুইহাত যুক্ত করে দাঁড়ায়। কানাই রশি দিয়ে যুক্ত দুই হাত শক্ত করে বেঁধে পরপর কয়েকটাগ্রন্থি দিয়ে বধূটিকে বলেন ‘বুঝলি প্রথমে দুই হাত এমনি করে বেঁধে রশিটাকে পিছনের দিকে ঘুরিয়ে চক্কর লাগিয়ে দুইহাতের বাহু কোমর দিয়ে নিয়ে এসে পাদুটো জড়ো করে ফের রশিটার কয়েকটা পাক দিয়ে পরপর কয়েকটা গ্রন্থি দিবি—তারপর রশির বাকী অংশটা থামের চারধারে শরীরের সঙ্গে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে শক্ত করে গেরো দিয়ে দিবি।” বলতে বলতে কানাই গোপবধুটিকে থামের সাথে শক্ত করে বেঁধে ফেলল। তারপর বলল, বুঝলি গোপী এইভাবে শক্ত করে বাঁধতে হয়। তোর তো শেখা হয়ে গেল—এখন তাহলে আমি চলি, কেমন?”

—’কোথায় যাচ্ছিস? আমার বাঁধন খুলে দে?’

—দেখ গোপী। তোর সঙ্গে আবার বাঁধন শেখানোর কথা ছিল। বাঁধন খোলা শেখানোর কথা ছিল না। সুতরাং আমি চললাম। কানু গোপবধূটিকে থামের সাথে বেঁধে বাড়ীর ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে খিড়কীর দরজা খুলে পালিয়ে গেল। দুপুরের কিছু আগে বধুটিকে বেঁধে রেখে কানাই চলে গিয়েছিল। বেচারা বাকী সারাদিন বন্ধনরতা অবস্থায় কাটায়। তাঁর স্বামী গরু চরাতে গিয়েছিল। সন্ধ্যায় গরু নিয়ে ফিরে এসে দেখে বাড়ীর দরজা বন্ধ। চীৎকার করে করে বলে—”দরজা বন্ধ রেখেছ কেন খুলে দাও।” ভেতর দিকে বধুটি বাঁধা অবস্থায় উচ্চকণ্ঠে সাড়া দিয়ে বলে—”খিড়কীর দরজা দিয়ে এস।”

স্বামী জিজ্ঞাসা করে—”খিড়কীর দরজা দিয়ে যেতে বলছ কেন?”

”আগে এস তারপর বলছি।” বধূটির স্বামী খিড়কীর দরজা দিয়ে বাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করে দেখে তাঁর বউ থামের সাথে বাঁধা।

সে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে—’কি ব্যাপার? তুমি বাঁধা কেন?’

—বলছি বলছি আগে এক পাত্র জলপান করাও আমাকে।

স্বামী বেচারা জল এনে দেয়। গোপবধূটির জলপান শেষ হলে স্বামী পুনরায় জিজ্ঞাসা করেন—’কে তোমাকে বেঁধেছে বললে না তো?’

—আগে আমাকে বাঁধন খুলে মুক্ত কর। তারপর সব বলছি।

স্বামী বাঁধন খুলে দিল। বাঁধন মুক্ত হয়ে বধূটি বলল—”বড্ড গরম, আমায় একটু হাওয়া কর না গো?” স্বামী পাখা এনে হাওয়া করতে করতে আবার জিজ্ঞাসা করল,—’এবার বল, কে তোমাকে বেঁধেছে?’

বধূটি বলে,—’কেউ আমাকে বাঁধে নি গো।’ ‘তবে তুমি বাঁধা কেন?’ স্বামী পুনরায় জিজ্ঞাসা করল,

—আমি ‘বাঁধন দেওয়া’ শিখছিলাম।

‘কার কাছে?’

বধূটি বলল—”যশোদার বেটার কাছে।”

বধূর কথা শুনে স্বামী হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠে।” আমি তো তোমাকে ফুলশয্যার রাতেই বলেছিলাম—’যশোদার ঐ লালা থেকে সাবধানে থেকো। যতটা পার ওর থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখ। ও খুব দুষ্টু।”

কিন্তু কানাই যাকে একবার বাঁধে, কার সাধ্য তা থেকে মুক্ত করে? গোপবধূটি চিরদিনের জন্য কানাই-এর স্নেহরজ্জুতে বাঁধা পড়ে গেল।

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন