রথ নিয়ে অক্রূর এসেছেন বৃন্দাবনে। কৃষ্ণ বলরামকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। দুই ভাই অক্রূরের রথে চড়ে মথুরায় যাবেন ধনুর্যজ্ঞে যোগদান করতে। কৃষ্ণের মথুরা গমনের খবর পেয়ে ব্রজবাসী ম্রিয়মান। আসন্ন কৃষ্ণ বিরহের আশঙ্কায় গোপীরা শোকমগ্না। যশোদা, নীলমণি মথুরায় যাবে এই খবর শুনে নন্দ মহারাজকে অশ্রু সিক্ত নয়নে জিজ্ঞাসা করলেন—”হ্যাঁ গো যা শুনছি তা কি সত্যি?”
—’হ্যাঁ সত্যি! কংস অক্রূরকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছেন, মথুরায় ধনুর্যজ্ঞ হবে। আমি যেন কৃষ্ণ বলরামকে সঙ্গে নিয়ে সেই যজ্ঞে হাজির হই।”
—”ইচ্ছা হলে তুমি বলরাম সহ অন্যদের নিয়ে যাও। আমি গোপালকে তোমার সঙ্গে মথুরায় পাঠাব না।
—ও কথা কেন বলছ, রাজা কংস সম্মান করে রথ পাঠিয়েছেন, না গেলে যে রাজার আদেশের অবমাননা হবে।
—ওখানে আমার নীলমণিকে কে দেখবে? ও বড় লাজুক স্বভাবের। ক্ষিধে পেলে চাইতে জানে না। ওখানে কে ওর ক্ষিধে বুঝে খাওয়াবে বল? দু-চারদিন আগে আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম।
—’দুঃস্বপ্ন! কি দুঃস্বপ্ন দেখেছিলে তুমি?’ নন্দ মহারাজ ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
—আমার নীলমণি আমাকে ছেড়ে চিরতরে চলে যাচ্ছে। মথুরা থেকে অক্রূর যেন ক্রূর কালরূপে বৃন্দাবনে উপস্থিত হয়েছে। ও আমার হৃদয়ের নিধিকে ছিনিয়ে নিতে এসেছে—আমি আমার নীলমণিকে কিছুতেই আমার দৃষ্টির বাইরে যেতে দেব না।
—’দেখ, যশোদা, গোপাল আমাদের এগারোয় পদার্পণ করল, আর কতদিন তুমি ওকে আঁচলে বেঁধে ঘরে রাখবে। বাইরের জগৎ সম্পর্কে ওকে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। বৃন্দাবনের যোগ্য রাজা করে তৈরি করতে হবে ওকে। আমরা পিতা-পুত্র সবাই মিলে দু’চারদিন মথুরায় থেকে আবার ফিরে আসবো। তুমি অনর্থক চিন্তা করে মন খারাপ কর না।
—দু-চারদিনের কথা কি বলছ? আমি একদিনও গোপালকে ছেড়ে থাকতে পারবো না। গোপাল গোচারণে গেলে আমি সারাদিন তার আসা পথ চেয়ে বসে থাকি।
—যশোদা, তোমার ব্যথা আমি বুঝি। কিন্তু কী করবো বল, আমি নিরুপায়। রাজাদেশ লঙ্ঘন করার শক্তি আমার নেই। রাজা রথ পাঠিয়েছেন কানাই বলাইকে নিতে, এখন আমি কী করে বলি যে ওরা যাবে না।
—তুমি কী বলবে না বলবে তা আমি জানি না, আমি গোপালকে কিছুতেই মথুরায় পাঠাবো না-না-না।
—পাগলামি কর না, কংসকে তো জান, সে কিরকম নৃশংস! তাঁর আদেশ অবহেলা করলে আমাকেও সাজা পেতে হবে। ভগ্নী, ভগ্নীপতিকে (দেবকী বসুদেব) যে বিনা দোষে কারাগারে বন্দী করে রাখে, নিজের পিতাকে (উগ্রসেন) কারারুদ্ধ করে যে দুরাচার রাজ সিংহাসনে বসে রাজ্য ভোগ করছে তার আদেশ লঙ্ঘন করলে সে কি আমায় ছেড়ে দেবে ভেবেছ? সে যেরকম নিষ্ঠুর স্বভাবের, তাতে তাঁর পক্ষে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়াও অসম্ভব নয়।
—’আমি কি করে গোপালকে ছেড়ে থাকবো? ওই তো আমার একমাত্র আধার। ও নয়নের আড়ালে চলে গেলে আমি কি নিয়ে বাঁচব বল? আমি খাইয়ে না দিলে যে নিজে খেতে পারে না, খাওয়ার পর হাত-মুখ ধুয়ে না দিলে যে নিজে ধুতে পারে না সেই নীলমণিকে আমার মথুরায় কে দেখবে বল? সেখানে কে তাঁকে ঘুম-পাড়ানি গান শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবে?’
—গোপালের খাওয়া-শোয়া নিয়ে তুমি ভেব না। মথুরায় গিয়ে আমি সব ব্যবস্থা করে দেব। সন্ধ্যা হয়ে এল, তুমি অক্রূরের জন্য ভোজনের আয়োজন কর। আমিও হাত-পা ধুয়ে সন্ধ্যা-বন্দনা সেরে নিই।
নন্দ মহারাজ সন্ধ্যা বন্দনার জন্য হাত-পা ধুয়ে ঠাকুরঘরে প্রবেশ করলেন।
রাত্রিতে ভোজনপর্ব সমাধা হলে, অক্রূরের শয়নের ব্যবস্থা করে নন্দ মহারাজ-যশোদা গোপালকে নিয়ে শুয়ে পড়লেন। রোহিণীমাও আপন কক্ষে পুত্র বলরামকে নিয়ে শুয়ে পড়লেন। যশোদা ছাড়া সবাই ঘুমিয়ে পড়েছেন। ঘুম নেই গোপাল জননীর চোখে। তিনি গোপালকে ঘুম পাড়িয়ে—বাইরের প্রাঙ্গণে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। সবাই তন্দ্রায় আচ্ছন্ন হলেও—যিনি অহোরাত্র নিদ্রাহীন হয়ে পিপীলিকার পদ শব্দটি পর্যন্ত শুনতে পান—তাঁর কাছে যশোদার মর্মভেদী ক্রন্দনধ্বনির বিলাপ তরঙ্গ পৌঁছাতে দেরী হল না। সহসা কপট ঘুম ভেঙ্গে গেল গোপালের। করুণায় ছলছল পদ্ম আঁখি দুটি মেলে দেখলেন—মা বিছানায় নেই। ক্রন্দন ধ্বনি লক্ষ্য করে প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়ে মায়ের পাশটিতে গিয়ে বসল। যুক্ত কর কমলের নিবিড় আবেষ্টনে মায়ের কণ্ঠ নিজের গণ্ডদেশে স্থাপন করে বলল,—”মা তুমি কাঁদছ কেন?’ কিশলয় করপল্লবের মৃদুল স্পর্শ দিয়ে মুছে দিল মায়ের অশ্রু। অনন্তর মায়ের নাকে নিজের নাক ঘর্ষণ করতে করতে বলল,—’মা তুমি কেঁদো না, তুমি কাঁদলে আমি যে দুঃখ পাই, স্থির থাকতে পারি না।”
অশ্রু সংবরণ করে গোপালকে বুকে চেপে ধরে যশোদা বললেন, ‘তোর বাবার কাছে শুনলাম, তুই কাল মথুরা যাবি। কাল থেকে আমাকে মা বলে কে ডাকবে রে গোপাল? কে পান করবে আমার বুকের দুধ! (গোপাল বড় বয়স পর্যন্ত যশোদার বুকের দুধ পান করতেন) ননী খেয়ে ভাঁড় ভেঙে কে এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখবে। রাতে কে আমার কাছে শুয়ে গায়ে পা চাপিয়ে গলা ধরে বলবে—”মা, গল্পো বলো”….কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মা যশোদা।
মায়ের চোখের জল মুছতে মুছতে গোপাল বলল, ‘তুমি যদি কষ্ট পাও, তাহলে আমি যাব না মা।’
—না বাবা, যেতে তোকে হবে। রাজা তোদের নিতে রথ পাঠিয়েছেন, না গেলে তোদের পিতাকে হয়তো কঠোর দণ্ড দেবেন।
—তুমি চিন্তা কর না মা, বরং বাবাকে বলে দাও, বাবা যেন আমাকে ওখান থেকে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসে। আমি অবশ্যই ফিরে আসবো তোমার কাছে। তুমি একদম মন খারাপ কর না।
গোপাল কিন্তু নির্দিষ্ট করে বলল না, কবে ফিরে আসবে। গোপালের আশ্বাসন পেয়ে মা যশোদাও নির্দিষ্ট দিনের কথা জিজ্ঞাসা করতে ভুলে গেলেন। পুত্র ফিরে আসবে শুনেই যশোদার হৃদয় আনন্দে ভরে উঠল। আনন্দে বিহ্বল হয়ে তাই তিনি পুত্রকে বললেন,—’চল বাবা অনেক রাত হয়েছে। শুয়ে পড়বি চল। মাতা ও পুত্র উভয়ে শয়নকক্ষে প্রবেশ করে এক শয্যায় শুয়ে পড়লেন। গোপাল যশোদার বুকের উপর শুয়ে শুয়ে দুধপান করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। যশোদা ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখলেন,—বসুদেব-দেবকী কংসের কারাকক্ষে বসে বসে এগার বৎসর ধরে তপস্যা করছেন। এখন গোপাল যদি ওখানে না যায়—তাহলে উভয়ের (বসুদেব-দেবকী) প্রাণ বিয়োগ হবে। ধীরে ধীরে রাত্রি প্রভাত হয়। প্রাতঃকালীন মঙ্গলাস্নান সমাপনান্তে মা যশোদা গোপালকে নিয়ে সাজাতে বসলেন। মনোহর বেশে লীলা-নটবরকে সজ্জিত করে জননী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রাণ গোপাল, বাপ আমার, তোর মোহন রূপ আবার কবে দেখব রে!’ যশোদার মন আজ উথাল-পাথাল করছে। তীব্র বেদনা বুকে চেপে গোপালের জন্য নিজ হাতে অন্ন-ব্যঞ্জনাদি রন্ধন করে গোপালকে খাইয়ে দিলেন। প্রাঙ্গণে রথ নিয়ে অক্রূর প্রস্তুত। রাধিকা সহ সমস্ত ব্রজগোপী ও গোপগণ নন্দ মহারাজের গৃহপ্রাঙ্গণে বেদনাতুর হৃদয় নিয়ে সমবেত হয়েছেন। শ্রীরাধিকাজী সাধারণ সাজে সজ্জিতা হয়ে এসেছেন। বৃন্দাবনে শ্যাম এর সঙ্গে তাঁর ছিল নিত্য সংযোগ। আজ বিয়োগ পরিস্থিতির উদয় হতেই তিনি লোকলজ্জা পরিত্যাগ করে সর্বসমক্ষে আত্মবিস্মৃতা হয়ে শ্যামসুন্দরকে বললেন—’হে প্রিয়তম, প্রাণবল্লভ, রাধিকার হৃদস্পন্দন, নয়নের আলো—আমাকে ত্যাগ করে ব্রজ ছেড়ে যেও না। তুমি চলে গেলে বৃন্দাবনে চির-অমাবস্যার আবির্ভাব হবে।’ ললিতা, বিশাখাদি ও অন্যান্য গোপীরা অক্রূরকে ঘিরে ধরলেন। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তাঁকে বললেন,—’কেন এসেছ রথ নিয়ে বৃন্দাবনে? তোমার নাম কে অক্রূর রেখেছে—তুমি ক্রূর ভী-ষ-ণ ক্রূর। তোমার হৃদয়ে এতটুকু দয়া-মমতা নেই আমাদের সবাইকে চিরতরে কান্নার সাগরে ডুবিয়ে মেরে ফেলার জন্য তুমি কি শ্যামকে নিতে এসেছে? যদি তোমার ঘরের কাজের জন্য কোন দাসীর প্রয়োজন হয়, তবে আজ্ঞা কর, আমরা সব গোপীরা তোমার ঘরে গিয়ে কাজ করে দেব—কিন্তু শ্যামকে নিয়ে গিয়ে তুমি আমাদের প্রাণ কেড়ে নিও না। অক্রূরজী, তুমি জান না শ্যাম বিহনে বৃন্দাবন শ্মশান হয়ে যাবে। যদি দরকার হয় বলরামকে নিয়ে যাও, শ্যামকে রেখে যাও। মথুরায় পড়ালেখা নারীদের সেবা পেলে শ্যাম আমাদের ভুলে যাবে। শুনেছি মথুরার রমণীরা খুব চতুর। আমরা মূর্খ গোপকন্যা। ওখানে গেলে শ্যাম কি আমাদের মতো লেখাপড়া না জানা রমণীদের মনে রাখবে?’
অক্রূরজী ভেবে পান না, গোপীদের কী বলে সান্ত্বনা দেবেন। রাধিকাজি প্রায় অচৈতন্য হয়ে ভূমিতে লুটিয়ে পড়ে আছেন—তাঁর নয়ন স্থির পলকহীন। শ্রী রাধাকে ঐ অবস্থায় দেখে কৃষ্ণ তাঁর কাছে গিয়ে কানে মুখ রেখে নীচু স্বরে বলল, ‘প্রাণময়ী প্রিয়ে, তুমি ভুলে যেও না—তুমি কে? তুমি-আমি অভিন্ন। আমিই তুমি, তুমিই আমি। আমিই আমাকে আস্বাদন করবো বলে তুমি হয়েছি। অষ্ট সখী হয়েছি। গোঠের সখা হয়েছি। বৃন্দাবনের সবই আমি-তুমি মিলে মিশে হয়েছি। আমারাই লীলার জন্য জগৎ হয়েছি—জীব হয়েছি। আমি-তুমি এক ও অভিন্ন ছাড়া কোথাও দ্বিতীয় বলে কিছু নেই। তোমাকে ছেড়ে যাব কোথা? তুমি যে আমার আনন্দ স্বরূপ আত্মা। যে কাজের জন্য অবতীর্ণ হয়েছি, সেই কাজ সম্পন্ন করতে মথুরায় যাচ্ছি। এতদিন তোমার সঙ্গে প্রেমে নৃত্য করেছি—খেলা করেছি, এবার জগতকে নৃত্য করাতে চললাম। তুমি আমার সচ্চিদানন্দ রূপিণী পরমাপ্রকৃতি হ্লাদিনী শক্তি, তুমি আমি দুজনে মিলে এই লীলাজগৎ রচনা করেছি। আমার লীলা শ্রবণে, কীর্ত্তনে সাধক জীব আমাকে প্রাপ্ত হয়ে পরমধামে উপনীত হবে—তাই আমার এ লীলা অভিনয়। উঠ প্রিয়ে, শোক পরিহার কর।’ রাধিকাজী শ্যামসুন্দরের শ্রীকর ধরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—”হে প্রিয়তম, তোমরা বিরহে কী করে থাকবো?”
—রাধে, তোমার বিরহ বেদনা, অনেক বিরহীর বিরহ জ্বালা উপশম করবে।
—বৃন্দাবনের কুঞ্জবনে আর কি কখনও তোমার সঙ্গে দেখা হবে?
—প্রিয়তমা, প্রকাশ্য ব্রজলীলার এখানেই অবসান। তবে অপ্রকাশ ব্রজলীলা নিত্য চলছে, চলবেও। কুরুক্ষেত্রে একবার দেখা হবে। প্রভাসের কাছে সরস্বতী নদীর তীরে সিদ্ধপুর আশ্রমে একবার সাক্ষাত হবে। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের সময় আরও একবার তুমি আসবে—আমার হৃদয়ে থেকে গীতা অমৃত বলার জন্য। একদিকে আমার হৃদয়ে থেকে আমার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তুমি যখন গীতা বলবে, তখন অন্যদিকে সবার অন্তরালে থেকে তোমার সখীদের নিয়ে সেই গীতা তুমি কর্ণপথে পান করবে। তারপর নরলীলার অবসানে দেখা হবে গোলকে।”
রাধারাণী শ্যামসুন্দরের শ্রীপদে মাথা রেখে বললেন—”তোমার অসীম অমৃত লীলাসিন্ধু বুকে অনন্ত আনন্দ হিল্লোল আমি, তোমাকে আনন্দ দিতে প্রসন্ন চিত্তে বেদনার ভার বয়ে যাব স্বামী।”
শ্রীরাধিকাজী শান্ত হলেন। অতঃপর কৃষ্ণ ললিতা-বিশাখাদির দিকে চেয়ে বলল,—’হে আমার প্রিয় সহচরীগণ, আমি মথুরায় যাচ্ছি, কিন্তু আমার প্রাণ রেখে যাচ্ছি তোমাদের হৃদয়ের সুরক্ষিত প্রহরায়। আমার যাত্রাপথ তোমরা এইভাবে কান্নায় ভিজিয়ে দিও না। জগত কল্যাণকারী আমার এই যাত্রাপথ তোমাদের কান্নার জলে সিক্ত হলে নানা অশুভ-বাধা-বিঘ্ন দেখা দেবে। কাজ শেষ হলে আমি আবার তোমাদের মাঝে ফিরে আসবো। আমার বাঁশী রাধার কাছে রেখে গেলাম। সে যখনই বাঁশীতে ফুঁ দিয়ে আমাকে ডাকবে—আমি তখনই হাজির হব।”
কৃষ্ণের কথায় গোপীদের ক্রন্দন বন্ধ হল। অনন্তর কৃষ্ণ অক্রূরজীকে বলল,—’আমার ব্রজবাসীরা বড়ই সাধাসিধে—সরলপ্রাণ। এরা যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ রথে আরোহণ করা সম্ভব হবে না। বলতে বলতে কৃষ্ণ-বলরাম নন্দবাবার সঙ্গে রথে উঠে বসল। রথ চলতে থাকে। গোপ গোপীরাও রথের পিছু পিছু চলতে থাকেন। রথ একটু দ্রুতগামী হতেই যশোদা রথের পিছু পিছু ছুটতে আরম্ভ করলেন। গোপাল মাকে রথের পিছু পিছু ছুটতে দেখে রথ থামাতে বলল। রথ থামতে যশোদা গোপালকে অপলক নেত্রে দর্শন করতে করতে আরতি করলেন। বললেন ‘বাবা, যেখানেই থাকিস, সুখে থাকিস। শরীরের দিকে লক্ষ্য রাখিস। আর শোন, যাওয়ার আগে তোকে একটা কথা বলি।’
‘কি কথা মা?’ গোপাল জিজ্ঞাসা করল।
—’তুই আমাকে মা বলিস, আমিও তোকে বেটা বলি, কিন্তু আমি জানি তুই আমার পুত্র নোস। তুই দেবকীর পুত্র। আমি তোর পালক মাতা। তোর লালন পালনের জন্য এক সামান্য দাসীমাত্র।’
—’মা! তুমি একি বলছ। লোকে যা বলছে বলুক, আমি সারা জগৎকে বলে যাবো, আমি যশোদার বেটা—আদরের দুলাল।’
—উদুখলের সঙ্গে আমি তোকে দড়ি দিয়ে বেঁধেছিলাম, মথুরায় গিয়ে একথা যেন ভুলে যাস, বাবা।
—মা, আমি সব ভুলতে পারি, কিন্তু তোমার স্নেহ রজ্জুর বন্ধনের কথা কখনও ভুলবো না। যে বাঁধনে তুমি আমাকে বেঁধেছিলে মা, ওটা আমার অলংকার। তা-কি কখনও ভুলতে পারি?’
—আমাকে মনে রাখবি তো? আবার মা বলে কাছে আসবি তো বাবা?
—অবশ্যই আসবো মা, তুমি, তোমার শরীরের দিকে নজর রেখ। আর আমার গাভীদের যত্ন নিও।
—যেখানেই থাকিস, সুখে থাকিস, বেটা—এই আমার আশীর্ব্বাদ।
ধীরে ধীরে রথ চলতে শুরু করল। নির্নিমেষ নয়নে ব্রজবাসী চেয়ে থাকে রথপানে। রথ ধীরে ধীরে ব্রজবাসীদের নয়নের সম্মুখে ধূলিময় মেঘমণ্ডল রচনা করে অদৃশ্য হয়ে গেল। সকলের হৃদয়ের স্পন্দনে স্পন্দিত হয়—শ্যাম ফিরে এসো—ফিরে এসো শ্যাম!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন