কৌরবদের কাছে পাশাখেলায় হেরে গিয়ে পঞ্চপাণ্ডব, মাতা কুন্তী ও পত্নী দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে বনবাসে যান। দীর্ঘদন যাবৎ নানাবনে পরিভ্রমণ করতে করতে যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চপাণ্ডব, মাতা ও পত্নীসহ আর্যাবর্ত্তের এক বনভূমিতে অধিষ্ঠিত হন। বনের নানা ফলমূল ও পশুপাখি শিকার করে এখানে তাঁরা অতিকষ্টে দিনপাত করেন।
একদিন পাণ্ডবসখা কৃষ্ণ তাদের খবর নেওয়ার জন্য বনভূমিতে এসে উপস্থিত হন। পাণ্ডবজননী কুন্তী ও জ্যেষ্ঠ পাণ্ডবসহ অন্যান্য সকলে বহুদিন পর কৃষ্ণকে নিজেদের কাছে পেয়ে বিশেষ আনন্দিত হলেন। তাঁরা কৃষ্ণকে যথাসাধ্য আদর-অর্ভ্যথনা জানালেন। কৃষ্ণও পাণ্ডবদের সার্বিক কুশল ও নিরাপদে বাস করতে দেখে মনে মনে অত্যন্ত প্রসন্ন হলেন।
অতঃপর আহার ও বিশ্রাম পর্ব শেষ করে কৃষ্ণ পঞ্চপাণ্ডব নির্মিত পত্রকুটিরের অনতিদূরে একটি বিশাল বনবৃক্ষের নীচে উপবেশন করলেন। নির্নিমেষ নয়নে তিনি বনের সৌন্দর্য সুধা পান করতে করতে বিভোর হয়ে গেলেন। সহসা শুষ্ক পত্রের মর্মর শব্দে সচকিত হয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির তাঁর কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। যুধিষ্ঠিরের চোখেমুখে কেমন যেন একটা বিষণ্ণ বিষণ্ণ ভাব। কৃষ্ণ তা লক্ষ্য করে মুখে মৃদু হাসি এনে জিজ্ঞাসা করলেন,—’জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব তোমার মনে কি কোন সংশয় দেখা দিয়েছে?’
”হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরেছো কৃষ্ণ, আজ বেশ কিছুদিন ধরে একটা সংশয় আমার মনকে বড়ই চঞ্চল করে তুলেছে।
যুধিষ্ঠির কৃষ্ণ অপেক্ষা বয়সে বড় ছিলেন তাই কৃষ্ণকে কৃষ্ণ বলেই সম্বোধন করে তার কথার উত্তর দিলেন।
কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের দুই করস্পর্শ করে বললেন, ”জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব তোমার মুখে বিষণ্ণভাব দেখেই বুঝেছি তোমার মনে কোথাও কিছু একটা নিশ্চয়ই ঘটেছে। ধর্মপুত্র, যদি আমাকে তোমার বা তোমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী মনে কর, তাহলে সবকিছু অকপটে বল, আমি যথাসাধ্য তোমার মনের সংশয় দূর করে, তোমার মনকে প্রশান্ত করে মুখের ওই বিষণ্ণভাব অপনোদনের চেষ্টা করব।”
যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের হাত দুটি বুকের কাছে তুলে ধরে কৃষ্ণের সর্ব্বাঙ্গে বিষণ্ণ-মধুর দৃষ্টি বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ”আচ্ছা কৃষ্ণ, লোকে বলে ভগবান নাকি দয়াময়? করুণাময়?—এ বিষয়ে তোমার অভিমত কি?”
যুধিষ্ঠিরের জিজ্ঞাসায় কৃষ্ণ দুই ঠোঁটের মাঝে একফোঁটা হাসি রেখে নীরব রইলেন। কৃষ্ণের এই নিস্পৃহ ভাব দেখে যুধিষ্ঠির আরও চঞ্চল হয়ে উঠলেন। তিনি পূর্বাপেক্ষা উচ্চস্বরে কৃষ্ণের দিকে চেয়ে বললেন—”চুপ করে থেকে আমার প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা কোর না কৃষ্ণ, উত্তর দাও—ভগবান যদি দয়াময়, করুণাময় তবে পৃথিবীতে এত দুঃখ, এত কষ্ট কেন?” কথাগুলো বলতে বলতে যুধিষ্ঠিরের চোখমুখ রক্তিম হয়ে উঠল।
”আপনি অকারণ উত্তেজিত না হয়ে মনকে শান্ত করুন” কৃষ্ণের কথায় যুধিষ্ঠির দন্তদ্বারা জিহ্বা কর্ত্তন করে সলজ্জভাবে প্রকৃতিস্থ হলেন। কিছুক্ষণ উভয়ে উভয়ের দিকে মৌনভাবে চেয়ে রইলেন। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে প্রসন্ন রাখার জন্য বললেন, ”চলুন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব আমরা বনের ভেতরটা এই ফাঁকে একটু বেড়িয়ে আসি।”
যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের কথা প্রত্যাখ্যান করতে পারলেন না। নীরবে কৃষ্ণকে অনুসরণ করে বনের গভীরে রওনা দিলেন। উভয়ে একটা বড় শালগাছের নীচে দাঁড়ালেন। শাল গাছের কিছুটা দূরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিরাট শিমুলবৃক্ষ। শিমুলবৃক্ষের একটি শাখায় ঝুলছে একটা বড় মৌমাছির চাক। সেই চাকে প্রচুর মধু জমে আছে। বিন্দু বিন্দু মধু সেই চাক থেকে ফোঁটাকারে ঝরে পড়ছে নীচে। নীচে যেখানে মধু ঝরে পড়ছে সেখানে একটি লোক ঐ মধুর ফোঁটা লক্ষ্য করে মুখ হাঁ করে নীচে শুয়ে তা পান করছে। মধুর নেশায় তার দুই চোখ তন্দ্রাচ্ছন্ন।
যুধিষ্ঠিরের অগোচরে দৃশ্যটি লক্ষ্য করলেন কৃষ্ণ। তিনি আরও লক্ষ্য করলেন, যে শিমূলবৃক্ষের কিছুটা দূরে যে উঁচু টিলাটা রয়েছে সেখান থেকে একটা বড় অজগর সাপ বের হয়ে ধীরে ধীরে ঐ মধুপানরত লোকটির দিকে এগিয়ে আসছে তাকে গ্রাস করার জন্য। কৃষ্ণ ভ্রুকুঞ্চিত করে মোহন গ্রীবা ঈষৎ নত করে যুধিষ্ঠিরকে আরও কাছে আসতে বললেন। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালেন, কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে শিমূল বৃক্ষস্থিত মৌচাক এবং তৎনিম্নে মধুপানরত লোকটিকে ও লোকটির দিকে ধাবমান যমদূত রূপী অজগরটিকে দেখালেন। যুধিষ্ঠির এই দৃশ্য দেখে যথেষ্ট বিচলিত হয়ে কৃষ্ণকে বললেন, ‘সর্ব্বনাশ লোকটি যে সাপের গহ্বরে যাবে, তুমি একটু অপেক্ষা কর, আমি লোকটিকে সাবধান করে দিয়ে আসি।’ এই বলে যুধিষ্ঠির কালবিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ সেই শিমূল বৃক্ষের নীচে মধুপানরত লোকটির কাছে উপস্থিত হয়ে ব্যগ্র কণ্ঠে বললেন, ”এই যে মশাই শুনছেন তাড়াতাড়ি উঠে পালান, নইলে অজগরে আপনাকে গিলে খেয়ে নেবে। ঐ যে অজগরটা আপনার দিকেই এগিয়ে আসছে।”
লোকটি যুধিষ্ঠিরের কথায় দৃকপাত না করে উপরের মৌচাকের দিকে তাকিয়ে জড়িত স্বরে উত্তর দিল, ”সাপ কোথায়? যতসব মিছে কথা। সাপের ভয় দেখিয়ে আমাকে তাড়িয়ে তুমি বুঝি মধুপান করতে চাও। ওটি হবে না।, সাপই আসুক আর যেই আসুক আমি উঠছি না।” এই বলে লোকটি পুনরায় মধু পানে মনোনিবেশ করল।
যুধিষ্ঠির দেখল লোকটিকে সাবধানের চেষ্টা নিছক নিরর্থক। তাই সেইস্থান পরিত্যাগ করে পুনঃ কৃষ্ণের কাছে এসে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ পর অজগর এসে মানুষটিকে উদরস্থ করল। যুধিষ্ঠির সেই ভয়ানক দৃশ্য কৃষ্ণের সঙ্গে অবলোকন করলেন।
বন থেকে ফেরার সময় যুধিষ্ঠিরের মুখ আনন্দ ও প্রশান্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠল। কৃষ্ণ তা লক্ষ্য করে তির্যকভঙ্গীতে যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করলেন—”জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব তোমাকে যে বড় প্রফুল্ল দেখছি।”
যুধিষ্ঠির বললেন, ‘কৃষ্ণ, এখন আমার মনে কোন সংশয় নেই। তাই বিষণ্ণ ভাবটা চলে যেতেই কেমন যেন প্রসন্ন-প্রসন্ন লাগছে।’ এইরূপ কথাবার্তা আদান প্রদান করতে করতে উভয়ে কুটিরের দিকে রওনা হলেন। কুটিরে পৌঁছে কৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করলেন—”পৃথিবীতে দুঃখ কেন তার উত্তর কি পেয়েছেন জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব?”
যুধিষ্ঠির সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লেন। মৌখিক কোন উত্তর দিলেন না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন