মহাভারতের মহাসমর আরম্ভ হতে তখনও দুদিন বাকী। দুপক্ষই [পাণ্ডব ও কৌরব] কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে শিবির স্থাপন করে যুদ্ধ পূর্ব প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। যুদ্ধে যোগদানের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে রাজা মহারাজরা এসে কুরুক্ষেত্রে আপন আপন পক্ষের শিবিরে প্রবেশ করছেন। উভয়পক্ষের শিবিরে আপন আপন চিহ্ন শোভিত পতাকা পতপত করে উড়ছে। জনকোলাহলে যুদ্ধভূমির পরিবেশ রোমাঞ্চকর হয়ে উঠেছে। পাণ্ডবদের সখা ও হিতাকাঙ্ক্ষী শ্রীকৃষ্ণও দ্বারকা ছেড়ে রণভূমিতে উপনীত হয়ে পাণ্ডব শিবিরে প্রবেশ করলেন। শ্রীকৃষ্ণ আসার কিছুক্ষণ পর দেবরাজ ইন্দ্রও এসে পাণ্ডবশিবিরে যোগদান করলেন। সূর্য তখন অস্তমিত প্রায়, দ্বারকা থেকে সুদীর্ঘ পথ হস্তিনার কুরুক্ষেত্র। এতখানি পথ ভ্রমণ করে শ্রীকৃষ্ণ বড় ক্লান্ত—ইন্দ্রের অবস্থাও তাই। তার ভ্রমণের পথ আরও দীর্গ। কেন না তাকে স্বর্গ থেকে মর্তের কুরুক্ষেত্রে আসতে হয়েছে। সুতরাং পরিশ্রম তো হবেই। ক্লান্ত ইন্দ্রের শরীরের দিকে চেয়ে শ্রীকৃষ্ণ বললেন—”চলো দেবরাজ বাইরে একটু হাওয়া খেয়ে আসি।” ইন্দ্র সম্মতি জানালেন। কৃষ্ণসখা অর্জুনও সঙ্গী হলেন। শুরু হল তিনমনের প্রাক সন্ধ্যাকালীন ভ্রমণ। ঘুরতে ঘুরতে তিনজনে একসময় এক নিবিড় অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করলেন। চলতে চলতে তিনজনেই অনুভব করলেন—তাঁদের প্রচণ্ড জল পিপাসা পেয়েছে। তাই তিনজনে একসঙ্গে জলের সন্ধানে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলেন। হঠাৎ বনের মধ্যে দেখা গেল—এক জায়গায় আলো জ্বলছে। আলো লক্ষ্য করে তিনজনে এগিয়ে চললেন। কিছু দূর গিয়েই তাঁরা দেখতে পেলেন পাতায় ছাওয়া একখানি কুটীর। ইন্দ্র বললেন,—”যদুপতি মনে হচ্ছে কুটীরে একজন রয়েছেন”। শ্রীকৃষ্ণ বললেন—চল ভিতরে গিয়ে দেখা যাক। তিনজনে ভিতরে প্রবেশ করে দেখলেন একজন বৃদ্ধা কুটীরের দাওয়ায় বসে জলন্ত চুল্লীতে রাতের আহার পাক করছে। শ্রীকৃষ্ণ বৃদ্ধাকে জিজ্ঞাসা করলেন—”বুড়ীমা কি রান্না করছো, খুব সুন্দর সুগন্ধ আসছে। বৃদ্ধা ইঙ্গিতে তিনজনকে ভিতরে আসার আহ্বান জানিয়ে বললেন—আর কি রাঁধবো বাবা, রাতের জন্য একটু খিচুড়ি পাক করছি। তোমরা খাবে? যদি বল তাহলে না হয় আর একটু চাল-ডাল মিশিয়ে দি, কেমন? তিনজনে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ে এবং বলে,—”বুড়ীমা খিচুড়ি না হয় খাওয়া যাবে—তার আগে আমাদের জল দাও, বড় পিপাসা পেয়েছে। বৃদ্ধা বললেন—’আহা, বাছাদের আমার জল তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। তোমরা একটু চুলোটা দেখ, আমি পরিমাণমতো চাল, ডাল মিশিয়ে দিলাম। আমি জল নিয়ে এখুনি আসছি।’
বৃদ্ধা কলসী কাঁখে জল আনার উদ্দেশ্যে রওনা হল। কিছুক্ষণের মধ্যে জল এনে তিনজনকে কলসী থেকে ঢেলে দেন। তিনজনে অঞ্জলিভরে জলপান করে পিপাসা নিবারণ করেন। বৃদ্ধা অত্যন্ত দরিদ্র। তার কাছে কোন জল দেওয়ার পাত্র নাই। তাই অতিথি তিনজনকে অঞ্জলি হস্তে জলপান করতে হয়।
ইতিমধ্যে বুড়ীমার রান্না শেষ হয়। বাসনের অভাবে বুড়ীমা কলাপাতা এনে অতিথি তিনজনকে গরম গরম খিচুড়ি পরিবেশন করেন। দেবরাজ ইন্দ্র কলাপাতায় খেতে অস্বস্তি বোধ করেন। হাজার হোক দেবরাজ বলে কথা। রানী শচীদেবী স্বর্গে সোনার থালায় না জানি কতরকমের অন্ন-ব্যঞ্জন প্রস্তুত করে দেবরাজের মুখে তুলে ধরেন। শ্রীকৃষ্ণ কিন্তু নির্বিকার চিত্তে প্রসন্ন মুখে খিচুড়ি খেতে থাকেন। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে অনুসরণ করেন। দু’জনার নির্বিকার ভাব দেখে দেবরাজ ইন্দ্রও চুপচাপ খেতে থাকেন।
অতঃপর তিনজনার ক্ষুধা, পিপাসার নিবৃত্তি হল। তিনজনই বৃদ্ধাকে শ্রদ্ধাসহ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে—কুরুক্ষেত্রাভিমুখে রওনা দেন। পথের মধ্যে দেবরাজ শ্রীকৃষ্ণকে টিপ্পনী কেটে বলেন—”আপনাকে লোকে বলে দীনবন্ধু—তা এই বৃদ্ধার প্রতি আপনার কৃপা কৈ। আপনি এমনই দীনের বন্ধু যে বৃদ্ধা স্নেহময়ী মহিলাকে খাবার বাসনটুকু পর্যন্ত দেন নাই। আপনার যত দয়া ধনীদের উপর। ধনীকে আপনি আরও ধনী করেন। আর এটাই হচ্ছে আপনার ন্যায় বিচার।
দেবরাজের কথা শুনে শ্রীকৃষ্ণ মৃদু মৃদু হাসতে লাগলেন। বললেন দেবরাজ, তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? এই পৃথিবীতো মানুষের কর্মভূমি। এইজন্য আমি এখানে বিশেষ হস্তক্ষেপ করি না। তবু জেনে রাখ, সমগ্র সৃষ্টি আমাতেই সমাহিত। সৃষ্টির সব প্রাণীই আমার অংশ। সৃষ্টির যদি কোন প্রাণীর কষ্ট বা বেদনা হয় তবে তার প্রভাব আমার উপরেই পড়ে। যাক—একসময় তোমার ক্ষোভের বা দুঃখের জবাব আমি দেব—কিন্তু এখন নয়। চল এখন শিবিরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক। শ্রীকৃষ্ণের কথায় ইন্দ্র মনে মনে রুষ্ট হলেন।
পরের দিন প্রভাত কর্ম সমাপন করে তিনজনে পুনরায় ঘুরতে বেরোলেন। যুদ্ধ কাছেই, তাই অর্জুনের মনটা আজ তেমন ভালো নেই। চলতে চলতে পথের মাঝে একজায়গায় বসে পড়ে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বললেন,—সখা, আমাকে ক্ষমা করো। আমার আজ হাঁটতে একেবারেই ভালো লাগছে না। তোমরা বরং ঘুরে এসো। আমি তোমাদের প্রতীক্ষায় এখানেই অপেক্ষা করছি।’ শ্রীকৃষ্ণ বললেন—ঠিক আছে, আজ এখানেই বসা যাক। কিন্তু বেলা তো অনেকখানি হলো। মধ্যাহ্ন সময় আগত প্রায়। ক্ষুধাও পেয়েছে। আজ তোমাকে এবং ইন্দ্রকে পায়েস রান্না করে খাওয়াবো এবং তোমাদের পথশ্রমজনিত ক্লান্তিও দূর করে দেব। দেবরাজের দিকে চেয়ে বললেন—ইন্দ্র, তুমি এক কাজ করো। দেবরাজ বললেন—কি কাজ? কয়েকখণ্ড প্রস্তর সংগ্রহ করে নিয়ে এসো। আমি ঐগুলো দিয়ে চুলা তৈরি করে তোমাদের জন্য চমৎকার পায়েস রান্না করে খাওয়াবো। দেবরাজ বললেন—ঠিক আছে, আমি এখনই পাথর সংগ্রহ করে আনছি। দেবরাজ চলে যেতেই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন—অর্জুন, তুমি কিছু শুকনো কাঠ ও একটু আগুন সংগ্রহ করে নিয়ে এসো। অর্জুন ঐসব দ্রব্য সংগ্রহের নিমিত্ত সরে যেতেই শ্রীকৃষ্ণ একা নির্জনে যোগশক্তি প্রভাবে সুগন্ধি চাল, শর্করা ও দুধ তৈরি করলেন। ইতিমধ্যে অর্জুন কাঠ আগুন এবং ইন্দ্র কয়েকখণ্ড পাথর সংগ্রহ করে এনেছেন। পাথর বহন করে আনতে হয়েছে তাই দেবরাজ কিছুটা ঘেমে উঠেছেন—শ্রীকৃষ্ণ তা লক্ষ্য করে মুচকি মুচকি হাসতে থাকেন। দেবরাজ তা লক্ষ্য করে বলেন—একটা কূয়ো থেকে বড় কষ্ট করে ওগুলো ভেঙে এনেছি। শ্রীকৃষ্ণ উত্তর না দিয়ে রান্নায় মনোনিবেশ করলেন। পায়েস প্রস্তুত হলে তিনজন তৃপ্তি সহকারে ভোজনপর্ব সমাধা করলেন। ইন্দ্র বললেন—পরমান্ন খুব স্বাদিষ্ট হয়েছে। খাওয়ার কিছুক্ষণ পর বিশ্রাম নিয়ে তিনজন গাত্রোত্থান করলেন। ঘুরতে ঘুরতে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেইস্থানে উপনীত হলেন যেখান থেকে কূয়ো ভেঙে ইন্দ্র পাথর সংগ্রহ করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ সেখানে এসে ইন্দ্রকে বললেন—দেবরাজ এখানে তো দেখছি দুটো কূপ রয়েছে। একটা কাঁচা গাঁথা হয়েছে আর একটা বেশ পুরনো গাঁথুনিও পাকা। তুমি পাকা কূয়ো ভেঙে পাথর সংগ্রহ না করে কাঁচা কূয়ো ভেঙে পাথর বের করে নিয়ে গেলে কেন? ইন্দ্র লজ্জায় শির অবনত করলেন। মনে হল তিনি যেন গতদিনের ক্ষোভ মিশ্রিত প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছেন। লজ্জিত বদনে শ্রীকৃষ্ণের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করলেন। শ্রীকৃষ্ণ ইন্দ্রকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন—”দেবরাজ এই কর্মভূমিতে সকলেই আপন আপন কর্মানুযায়ী ফলভোগ করে কিন্তু পরুষার্থ সহকারে যে কর্ম করে সে সুখী হয়। তাছাড়া যারা আমাকে ভালোবাসে তাদের আমি নিধন করতেই ভালোবাসি, কিন্তু কেন জানো? কেন? দেবরাজ জিজ্ঞাসা করেন। উদাত্ত কণ্ঠে শ্রীকৃষ্ণ বললেন—”যস্যাহমনুগৃহ্নামি হরিষ্যে তদ্ধনং শনৈঃ শনৈঃ” যাকে আমি কৃপা করি—তার কাছে আমি ব্যতীত অন্য কোন সম্পদ থাকে না। তার সমস্ত ধন তাই আমি হরণ করি। দেবরাজ বলেন-ওগো কৃপাময়-হরণকার্যে দক্ষ বলেই না তুমি শ্রীহরি। চলো আর কথা নয় এবার শিবিরে ফেরা যাক।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন