ব্রজে দেবাঙ্গনা নামে এক গোপকন্যা ছিল। সে একদিন গোশালায় অর্থাৎ গোয়ালঘরে গিয়ে দেখে প্রচুর গোবর জমে আছে। গোবরের বিশালরাশি দেখে ভাবছে, আজ গোয়ালের গোবর সাফ করতে করতেই সারাটা দিন কেটে যাবে। এততো গোবর কখনই বা পরিষ্কার করবো? আর কখনই বা যশোদার লালাকে দেখতে যাবো? সে হয়তো এতক্ষণে মনের আনন্দে বাঁশী বাজাচ্ছে। আমি তাঁর সেই মধুর বংশীধ্বনি না শুনে, গোয়ালের গোবর পরিষ্কার করে মরছি, জানি না কাজ কখন শেষ হবে? এই সময় যদি কেউ আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে তো খুব ভালো হয়। বিশেষ করে কানাই যদি আসে তো খুব মজা হয়।
”আরে ও কানাই-কানাইরে একবার এদিকে আয় না?”’ নন্দমহারাজের বাড়ির দিকে লক্ষ্য করে কানাইয়ের উদ্দেশ্যে দেবাঙ্গনা ডাক দেয়। মনে মনে ডাকে কানাই, কানাই আয়-আয়রে, এদিকে আয় না? একদিকে গোবরের ঝুড়ি মাথায় তুলে বাইরের প্রাঙ্গণে ফেলে জমা করে অন্যদিকে মনে মনে কানাইকে ডেকে চলে। ভক্তের আর্তিভরা ডাকে ভগবানের আসন টলে ওঠে। সহসা কানাই সেখানে এসে উপস্থিত হয়। তাঁকে দেখতে পেয়ে দেবাঙ্গনা আনন্দে ডগমগ। কানাই বলে,—’কিরে গোপী কি করছিস?’ দেবাঙ্গনা উত্তর দেয়,—’দেখছিস তো গোয়াল পরিষ্কার করছি। তুই আমাকে একটু সাহায্য কর না কানাই!’
—কি সাহায্য করবো?
—আমি গোবরের ঝুড়ি ভর্তি করে তোর মাথায় তুলে দিই, তুই তা নিয়ে বাইরের প্রাঙ্গণে গোবরের স্তুপে ফেলে দিয়ে আয়।
—ঠিক আছে, আমি না হয় তো গোবরের ঝুড়ি মাথায় করে বাইরের গাদায় (স্তূপ) ফেলে দিচ্ছি, কিন্তু—কিন্তু কি?
—এলাম সাত সকালে তোর কাছে একটু মাখন নিতে, আর তুই কিনা তার পরিবর্তে আমাকে গোবর ফেলার কাজ দিলি?
—মাখন তো আর এমনি এমনি পাওয়া যায় না, তার জন্য মেহনত করতে হয়, এখন গোবরের ঝুড়ি তো বাইরে ফেলে আয়, পরে না হয় মাখন দেব।
—কতটা মাখন দিবি?
—এক ঝুড়িতে একতাল বা একডেলা পাবি।
কানাই বলে, ‘ঠিক আছে, আমি গোবরের ঝুড়ি বাইরে ফেলছি, তুই গোবর ভরে আমার মাথায় তুলে দে।’
এক-দুই-তিন-চার এইভাবে গুণতে গুণতে কানাই বাইরের গাদায় গোবরের ঝুড়ি খালি করে। দেবাঙ্গনা তার মাথায় গোবরের বোঝা তুলে দেয়। কি সরলতা ভগবানের। এতে তার শ্রেষ্ঠত্বের মহত্বের হানি হয় না।
যাইহোক, দু-চার ঝুড়ি বাইরে ফেলে আসার পর কানাই গোপীকে বলছে—”দ্যাখ গোপী তুই হলি ঝুড়ি ভরে তুলে দেওয়ার লোক, আমি হলাম সেই ঝুড়ি বহন করে নিয়ে বাইরে ফেলার লোক। কিন্তু ঝুড়ি গোনার লোক কই? যাঃ আমি আর তোর গোবরের ঝুড়ি মাথায় করে বইবো না? আমি চললাম মায়ের কাছে—’
—শোন শোন কানাই, আমিই না হয় তোর গোবরের ঝুড়ি অর্থাৎ তুই কত ঝুড়ি বইলি তা গুণে দেব।
—কিন্তু তুই গোবর ভরে দিবি, মাথায় তুলে দিবি, আবার বলছিস গুণে দিবি, এতে যদি তোর গোনা ভুল হয়ে যায়—তাহলে তো আমার মাখন কম পড়ে যাবে? গোপী হেসে বলে ভুল হবে কেন? তুই যতবার ঝুড়ি নিয়ে বাইরে যাবি, আমি ততবার তোর কপালে একটা করে গোবরের টিপ পরিয়ে দেব—তাহলেই সব ঠিক হবে।
কানাই বলল,—’ঠিক আছে, মাথায় ঝুড়ি তুলে দে।’
গোপী তুলে দেয় গোবরভর্তি ঝুড়ি, কানাই ফেলে আসে বাইরে। মাথায় ঝুড়ি তুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোপী কানাইয়ের কপালে একটি করে গোবরের ফোঁটা পরিয়ে দিচ্ছে। ঝুড়ি বইতে বইতে কানাইয়ের সারামুখ লাল হয়ে উঠলো। ওদিকে গোপীও ফোঁটা পরাতে পরাতে তাঁর কপালসহ সারামুখ গোবরের টিপে ভরে দিল। আকাশের তারার মতো তার নীলপদ্ম আননে গোবরের টিপ তারার মতো শোভা পাচ্ছে। গোবরভর্তি ঝুড়ি নিজের মাথায় তুলে কানাই ভক্তরূপা গোপীকে আনন্দদান করছেন। কোন কষ্ট অনুভব করছেন না। কারণ তিনি নিজের দেহকে দেহ বলে ভাবেন না। তাঁর আমিত্ব বা অভিমান যেন অনন্তানন্ত ব্রহ্মাণ্ডে ব্যাপ্ত। এই লীলায় কানাই জগৎকে যেন বলতে চাইলেন—নিজের আমিকে ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে রেখ না। বাস্তবিক আমিত্বের স্বরূপকে স্বরূপতঃ চিনে নাও। সুখ নেওয়ার বস্তু নয়, দেওয়ার বস্তু। এই সুখ কিভাবে দিতে হয় তা ভগবান জীব ও জগৎকে শেখাচ্ছেন। কখনও বাঁশী বাজিয়ে, কখনও মাখন চুরি করে, কখনও বা গোবরের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে কপালে গোবরের তিলক পরে।
জীব আনন্দস্বরূপ, সুখস্বরূপ। তাই সে সুখের জন্য, আনন্দের জন্য চেষ্টা করে কিন্তু সুখ বা আনন্দকে সে ধরতে পারে না। আমাদের পয়সা হলে মটরগাড়ী কিনি, ড্রাইভার রাখি—কেন না তখন নিজে গাড়ি চালাতে সঙ্কোচ হয়। ইজ্জতের প্রশ্ন দেখা দেয় কিন্তু বিশ্বম্ভর কানাইয়ের ঘোড়ার গাড়ি অর্থাৎ রথ চালাতেও সঙ্কোচ হয় না।
দেবাঙ্গনা টিপ পরায়, গোবরের ঝুড়ি মাথায় তুলে দিয়ে বাইরে ফেলতে পাঠায়। নির্বিকার চিত্তে তিনি তা করেন। কাজ শেষে কোমরের পীতাম্বরের কাছা খুলে ঝোলার মতো করে কানাই গোপীকে বলে—এবার এতে মাখন দে। দেবাঙ্গনা একতাল করে মাখন দিচ্ছে আর একটি একটি করে কানাইয়ের কপালে গোবরের টিপ মুছে দিচ্ছে। গোপীর মাখন দেওয়া শেষ হলে কানাই বলে,—’শুধু মাখন আমি কমই খাই, খুব ভালো হতো যদি এর সাথে একটু মিছরী পেতাম।’ দেবাঙ্গনা বলে,—’মিছরী তো আর এমনি এমনি পাওয়া যায় না, তার জন্য অন্য কাজ করতে হবে।’
—কি কাজ? কানাই জিজ্ঞাসা করে।
—একটু নাচ করে দেখাতে হবে।
—ঠিক আছে, এক্ষুণি নাচছি বলে কানাই নাচতে শুরু করেন। নাচ শেষ হলে দেবাঙ্গনা কানাইয়ের ঝোলায় মিছরীচূর্ণ করে মাখনের উপর ছড়িয়ে দেন। কানাই পরমানন্দে তা খেতে খেতে নৃত্য করতে করতে বাড়ির দিকে রওনা হয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন