হেমন্তের শিশিরসিক্ত শীতল বাতাসে নতুন ধানের গন্ধ উৎসবের বার্তা বহন করে আনে ব্রজের নন্দগ্রামে। নতুন ধানের গন্ধে নন্দগ্রামে নবান্নের সানন্দ পদধ্বনি শোনা যায়। শিশু-বৃদ্ধ-তরুণতরুণী-গোপগোপীরা সবাই উৎসবের আনন্দে মাতোয়ারা। অঙ্গনে অঙ্গনে নব শস্যরাশির স্তূপ। অঙ্গে অঙ্গে নব সাজ-সজ্জার বাহারীরূপ। নবান্ন উৎসবে একদিকে যেমন গ্রাম্য দেবদেবীর পূজা হয়, তেমনি অন্যদিকে পশুপাখীর ও পূজা হয়। ঋষি-ব্রাহ্মণ-অতিথিদের অন্ন-মিষ্টান্ন-বস্ত্রাদি-‘রত্ন দান করা হয় প্রচুর পরিমাণে। প্রতিটি গৃহের বহির্দ্বার নানা পত্র-পুষ্প ও পল্লবদ্বারা সুসজ্জিত। আজ যমুনার তীরে গোচারণ বন্ধ। কানাই-বলাই সকাল থেকেই বাড়িতে রয়েছে। সখারা বাইরের রাস্তায় নতুন পোশাক পরে খেলা করছে। মাঝে মাঝে তাদের আনন্দ কোলাহল নন্দালয়ে ভেসে আসছে। কানাই আজ সখাদের সঙ্গে খেলতে না যাওয়ায় দাদা বলাই মা যশোদা সবাই বিস্মিত। কি ব্যাপার দুরন্ত কানাই আজ শান্ত হয়ে মায়ের কোলে বসে কেন? দাদা বলাই ভাবেন কানাইয়ের কি শরীর খারাপ? যশোদা ও ভাবেন আজ আমার নীলমণি এত চুপচাপ কেন? জ্বরটর হয়নি তো? কানাই-এর শরীরে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন—শরীর তো ঠান্ডা রয়েছে। কানাই মিটিমিটি হাসছে। যশোদা কানাইয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞাসা করেন—”কি রে কানাই, আজ খেলতে গেলি না কেন? যা, বাইরের রাস্তায় সখাদের সঙ্গে খেলগে যা’। কানাই বলে—”মা, আজ তোমার কোল ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে সারাটা দিন তোমার কোলেই বসে থাকি।”
কানাইয়ের কথা শুনে মা যশোদার বক্ষের দুগ্ধাধার থেকে স্নেহের অমৃতরস বেরিয়ে আসে। তিনি কানাইয়ের দুই ঠোঁটের ফাঁকে তা চেপে ধরেন। কানাই পরমানন্দে মা যশোদার বাৎসল্য রস পীযুষ পান করতে থাকে। দক্ষিণদিকের স্তনাধার স্বল্পক্ষণ পান করেই কানাই যশোদার বামদিকের স্তনাধার পান করতে যাওয়ার আগেই অগ্রজ বলরাম এসে বাধা দেয়। কানাইকে চোখ পাকিয়ে বলে,—’এই তুই আমার ভাগেরটা খাচ্ছিস যে?’ কানাই বলে,—’বেশ করেছি খাবই তো?’ আমার মায়ের সব দুধই আমি খাব তুমি বলবার কে? তুমি রোহিনী মায়ের দুধ খাওগে যাও।’ কানাইয়ের কথা শুনে যশোদা বলেন—”কানাই তুমি যখন রোহিনী মায়ের দুধ খাও, তখন বলাই তো তোমাকে কিছু বলে না—তাহলে তুমি এখন দাদার সাথে দুধ খাওয়া নিয়ে ঝগড়া করছো কেন? দাদাকে দাদার ভাগটা খেতে দাও।” মায়ের কথায় কানাই বলাই-এর দিকে চেয়ে বলে—”ঠিক আছে দাদা তুমি তোমার ভাগেরটা খাও, আমি আমারটা খাই কিন্তু দাদা রাতের বেলায় তুমি যখন রোহিনী মায়ের কাছে শোবে তখন যেন আমার ভাগের দুধটা খেয়ে নিও না।” ইতিমধ্যে রোহিনী মা ও সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছেন। উভয় জননী কানাই-বলাই-এর দুধ খাওয়া নিয়ে হাসাহাসি করতে থাকেন। কানাই-বলাই মনের সুখে মা যশোদার স্তন সুধা পান করতে থাকে। তা দেখে রোহিনী বলেন আজ উৎসবের দিনে মাঠে গোচারণ বন্ধ অথচ ঘরে গোপালক শিশু দুটির দুরন্ত পনার বিরাম নেই। কানাই বলাই রোহিনীর কথায় কান না দিয়ে উভয়ে উভয়ের পানে চেয়ে মিটিমিটি হাসতে থাকে এবং মহাসুখে মায়ের দুধ পান করতে থাকে।
অন্যদিকে যে সব সখারা রাস্তায় খেলা করছিল তারা তাদের মাঝে কানাই-বলাইকে না পেয়ে কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করছিল। খেলার যে আনন্দ সেই আনন্দ তারা পেয়েও যেন পাচ্ছিল না। তাই মাঝে মাঝে খেলা থামিয়ে তারা কানাই-এর বাড়ির দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিল। কিন্তু কানাই-বলাই কারও কোন পাত্তাই নাই। ওরা দুইভাই আজ যেন প্রতিজ্ঞা করেছে বাড়ি থেকে বের হবে না। সখারা যখন কানাইয়ের বাড়ির দিকে চেয়ে-কানাইয়ের আসার অপেক্ষা করছে—ঠিক তখনই সেই রাস্তার বিপরীত দিকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে : ”এসো এসো খোকাখুকু, এসো গোপগোপী, এসো এসো গ্রামের যত সখা-সখী, এনেছি এক মজার পাখী, বহুৎ জ্ঞানী, দেখামাত্র করে সে ভবিষ্যৎবাণী, বিশ্বাস না হলে নিজে এসে দেখে যাও।’
কানাইয়ের সখারা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে রাস্তা দিয়ে একজন পাখীওয়ালা আসছে। দেখামাত্রই সখারা ছুটে গিয়ে সেখানে তাকে ঘিরে ভীড় করে দাঁড়াল। তাদের দেখাদেখি অনেক গোপ-গোপরমণী ও সেখানে হাজির হল। গোপেদের মধ্যে একজন পাখীওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করল—”তোমার পাখীর নাম কি ভাই?” পাখীওয়ালা বলে, পাখীকেই জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও, পাখীর নাম কি?
তখন সখারা জিজ্ঞাসা করে—”এই পাখী তোর নাম কি?”
পাখী বলে—”আমার নাম সখা।”
পাখীকে মানুষের মতো কথা বলতে দেখে সখারা এবং গ্রামের অন্যান্যরা সব অবাক হয়ে যায়।
গ্রামের কেউ কখনও এমন সুন্দর কথাবলা পাখী দেখেনি। তোতা-ময়না-ময়ূর-এর চেয়েও এই পাখীটা দেখতে অনেক সুন্দর। পাখীওয়ালা পাখীটার একটা পা কালো দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে—দড়ির অন্য প্রান্ত হাতে ধরা আছে, যাতে পাখী উড়ে পালিয়ে যেতে না পারে। পাখীটার প্রতি সকলের উৎসাহ ও কৌতূহল দেখে পাখীওয়ালা পাখীটার খুব প্রশংসা করতে শুরু করে। সে বলল, পাখীটা খুব জ্ঞানী। ভূত ভবিষ্যত বলতে পারে এবং যা বলে সবই সত্য। পাখী মিথ্যা বলতে জানে না। গ্রামে সবাই জিজ্ঞাসা করে—পাখীটা কোথা থেকে এনেছো? পাখী খায় কি? পাখীওয়ালা উত্তর দেয়—পাখীটা এনেছি অনেক দূর হিমালয় থেকে। ফলমূল, শস্য দানা হচ্ছে এর আহার। কানাইয়ের সখাদের মধ্যে একজন বললো,—’ও পাখীওয়ালা তুমি একবার নন্দবাবার বাড়ি চলো। সেখানে আমাদের সখা কানাই আছে, সে তোমার পাখীর সঙ্গে কথা বলবে। আমরা তা শুনবো।’ পাখীওয়ালা বলে—”বেশ চলো, আমি তো তোমাদের নন্দবাবার বাড়ি চিনি না, তোমরা আমায় পথ চিনিয়ে নিয়ে চলো।’ সখারা পাখীওয়ালার আগে আগে যায়। আনন্দে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। নন্দবাবার বাড়িতে প্রবেশ করে সখারা চীৎকার করে বলে—এই কানাই, দেখ দেখ কি সুন্দর একটা পাখী এনেছে দেখ। কানাই তখন দুধ খাওয়া শেষ করে নন্দবাবার কোলে চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল। সখাদের কথা কানে যেতেই চোখ খুলে এক লাফে বাবার কোল থেকে নেমে পাখীওয়ালার দিকে দৌড়ে গেল। পাখীটার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো—”কি রে পাখী তুই আমার কাছে আসবি না? আমার সাথে কথা বলবি না?” মধুর স্বরে পাখী উত্তর দেয়,—’তোর সঙ্গে কথা বলবো না তো, আর কার সঙ্গে কথা বলবো? কথা তো তোর সঙ্গেই বলতে হয়। তুই যে আমার সখা হোস।’
পাখীর কথা শুনে কানাইয়ের চোখে জল আসে। সে পাখীওয়ালাকে বলে—”তাউজী [জ্যাঠা বা কাকামশায়] আমাকে তুমি পাখীটা দিয়ে যাও।” পাখীওয়ালা বলে—”তা কি করে সম্ভব। পাখী যে আমার রুজি রোজগার সব। পাখীটা তোমাকে দিয়ে দিলে আমার সংসার চলবে কেমন করে? এ পাখী আমি তোমায় দিতে পারবো না বাবা।” তখন পাখীটি হঠাৎ বলে উঠলো,—’আমি কানাইয়ের কাছে যাবো। কানাইয়ের সাথে খেলবো। আমি তোমার কাছে আর থাকবো না। তুমি আমার পায়ের দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখ। আমার পায়ে ব্যথা হয়। আমি তোমার কাছে কিছুতেই থাকবো না।’
মা যশোদা অদূরে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন—পাখী, পাখীওয়ালা ও কানাইয়ের কথা। কানাই যখন পাখীটি চেয়েছে তখন কানাইকে ঐ পাখীটি কিনে দিতেই হবে—নইলে কানাই রাগ করবে—রাগ করলে ঘরে তার দুষ্টুমিও বাড়বে। তাই তিনি দেরী না করে প্রচুর মূল্যবান রত্নে পূর্ণ একটি বৃহৎপাত্র নিয়ে পাখীওয়ালাকে বললেন—”এই নাও বাবা তোমার পাখীর মূল্য। আমার কানাইকে তোমার পাখীটি এইবার দিয়ে যাও। আশা করি এতে তোমার রুজি রোজগার ভালোভাবেই সম্পন্ন হবে।’
পাখীওয়ালা পাখীটি কানাইকে দিয়ে দিল। কানাই প্রথমে পাখীটার পায়ে বাঁধা দড়ি খুলে দিল। পাখী উড়ে গিয়ে মনের আনন্দে কানাইয়ের কাঁধে বসলো। কখনও বা উড়ে গিয়ে বলরামের কাঁধে, কখনও বা যশোদার কাঁধে বসে। কানাই পাখীকে আদর করে জিজ্ঞাসা করে—”সখা তুই মাখন মিছরী খাবি তো?” তখন পাখীওয়ালা বলে—”এ কেবল ফল খায়, মাখন মিছরী খাওয়ালে মরে যাবে।” পাখী তা শুনে বলে—সখা ওর কথায় কান দিস না, তুই যা খাওয়াবি আমি তাই খাবো।’ পাখীর কথা শুনে সখারা আনন্দে হাততালি দেয়। হেসে লুটোপুটি খায়। পাখীওয়ালা মূল্য স্বরূপ প্রচুর রত্ন পেয়ে খুশী মনে বাড়ি ফিরে যায়। সখারা পাখী নিয়ে কানাইয়ের সঙ্গে খেলা করে।
দেখতে দেখতে দিন যায়, রাত্রি আসে প্রভাত হয়। কানাই পাখীকে জিজ্ঞাসা করে—’কি রে সখা, তুই আমার সঙ্গে বনে যাবি না, সেখানে অনেক পাকা পাকা ফল আছে তুই ফল খাবি, গান করবি আর আমি গরু চরাবো। তারপর সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি ফিরে আসবো। মা তোর জন্য সোনার খাঁচা তৈরি করে রাখবে। সেখানে তুই বিশ্রাম করবি। পাখী বলে,—’এ তুই কি কথা বলছিস সখা। তুই আবার আমাকে সোনার খাঁচায় বন্দী করে রাখতে চাস। বন্দী করেই যদি রাখবি তবে আদর করে আমার পায়ের বাঁধন খুলে দিলি কেন? সখা আমাকে আর খাঁচায় বন্দী করিস না। আমি তোর কাছেই শুয়ে থাকবো—সেই হবে আমার বিশ্রাম।’
কানাই বলে,—’বেশ ঠিক আছে তাই হবে। কিন্তু সখা, তুই ডিম দিবি কখন? তোর ডিম থেকে বেশ ছোট ছোট বাচ্চা বের হবে, আমরা সবাই মিলে তোর সেই বাচ্চাদের সাথে খেলবো।’
পাখী বলে—সখা তুই কি বোকারে!
—কেন?
—ডিম দেয় পক্ষিনী, আমি তো পক্ষী।
—তোর পক্ষিনী কোথায় থাকে?
—সে থাকে অনেক দূরে-হিমালয়ের ওপারে।
—কানাই পাখীটাকে আদর করে চুমু খায় আর বলে—”পক্ষিনীর জন্য তোর মন খারাপ করে না, যা তাকে ডেকে নিয়ে আয়।’
কানাই পাখীকে আকাশে উড়িয়ে দেয়। পাখী উড়ে যায় হিমালয়ের দিকে। কানাই একদৃষ্টিতে নীল আকাশপানে চেয়ে থাকে।
”নন্দগ্রাম ছেড়ে উড়ে যায় পাখী—মেলে দুই ডানা।
কানাইয়ের কাছে পেয়েছে খুঁজে সে আপনার ঠিকানা।।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন