দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা

দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা

মহাভারতের মহাযুদ্ধ সন্নিকটবর্তী। পাণ্ডব-কৌরব উভয়পক্ষের শিবিরে জোর কদমে প্রস্তুতি পর্ব শুরু হয়ে গেছে। কৌরব শিবিরে আপন কক্ষে রাত্রিবেলায় অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা। তাঁর চোখে ঘুম নেই। ভাবছেন এই যুদ্ধে কৌরবপক্ষের প্রধান সেনাপতি কে হবেন? নিশ্চয়ই তাঁর পিতা দ্রোণাচার্য্য। ভীষ্ম অতি বৃদ্ধ হয়েছেন। তিনি যুদ্ধের জন্য আশীর্বাদ দিতে পারেন মাত্র, সেনাপতি হওয়ার সামর্থ্য তাঁর নেই। আর যদি কোন কারণে তাঁর পিতা ও বার্ধক্যের কারণে প্রধান সেনাপতির পদ না প্রাপ্ত হন তাহলে তিনি নিজে অবশ্যই ঐ পদ দুর্যোধনের কাছ হতে সম্মানের সঙ্গে প্রাপ্ত হবেন। কারণ কর্ণ সুতপুত্র কাপুরুষ, অহংকারী। সুতরাং ঐ পদের একমাত্র দাবিদার আমিই। কিন্তু আমি যদি সেনাপতি হই—তাহলে আমাকে লড়তে হবে অর্জুনের সঙ্গে। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করাটাও বিশেষ ব্যাপার নয়—ব্যাপারটা হচ্ছে কৃষ্ণকে নিয়ে, কারণ অর্জুনের রথের তিনিই সারথি।

যদি কৃষ্ণের কাছে চক্রটা না থাকতো কিংবা যদি ঐ চক্রটা আমি হাতে পেতাম তাহলে শ্রীকৃষ্ণসহ অর্জুনকে পরাজিত করার কাজটা সহজেই সম্পন্ন হয়ে যেত। কৃষ্ণের ঐ অমোঘ সুদর্শন চক্রটা যদি একবার হস্তগত হয় তাহলে যুদ্ধ জয় আমার অনিবার্য। যুদ্ধ জয় হলে কৌরবসেনা আমার পক্ষে জয়ধ্বনি দেবে। অশ্বত্থামা আপন শিবিরে পায়চারী করতে করতে যেন সেই অনাগত জয়ধ্বনি নিজকর্ণে শুনতে পাচ্ছেন—একথা ভাবতেই তাঁর হৃদয়ে আনন্দের শিহরণ জাগ্রত হল। কিন্তু কৃষ্ণের ঐ সুদর্শন চক্র কী করে তাঁর হস্তগত হবে? কৃষ্ণকে চাইলে তিনি কি তা দেবেন? শুনেছি তিনি ব্রাহ্মণ ঋষিদের কখনও বিমুখ করেন না। আমি ব্রাহ্মণপুত্র আমি যদি তাঁর কাছে গিয়ে ঐ চক্র প্রার্থনা করি তাহলে তিনি কি আমাকে ফিরিয়ে দেবেন? রাত্রি প্রভাত হতে এখনও বিশেষ দেরী আছে। দ্বারকায় গিয়ে একবার কৃষ্ণ সমীপে প্রার্থনা করে দেখা যাক তিনি কী করেন। এইরূপ ভাবতে ভাবতে শিবির ছেড়ে বেরিয়ে এসে অশ্বত্থামা রথের উপর চড়ে বসলেন। রথ ছুটলো দ্বারকার অভিমুখে। অশ্বত্থামা মনে মনে বললেন, আমি ব্রাহ্মণপুত্র। অতএব এই ব্রাহ্মণ হওয়ার সুযোগ আমাকে নিতেই হবে।

দ্বারকার অধিকাংশ লোক অশ্বত্থামাকে চিনতেন। তাছাড়া তিনি ব্রাহ্মণপুত্র। ব্রাহ্মণের অবাধগতি দ্বারকাধীশের কাছে। অশ্বত্থামা সম্পূর্ণ ব্রাহ্মণোচিত পোশাকে সজ্জিত হয়ে কৃষ্ণ সমীপে উপনীত হলেন। কৃষ্ণ সখা অর্জুনের গুরুপুত্রের যথোচিত সম্মান সৎকার করলেন। অশ্বত্থামাও কৃষ্ণ ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে দুই চার রাত্রি সেখানে রয়ে গেলেন। এখনও তাঁর প্রার্থনা তিনি কৃষ্ণকে জানাননি—অথচ সময়ও সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে—তাই একদিন অশ্বত্থামা শ্রীকৃষ্ণের সমীপে উপস্থিত হতেই, শ্রীকৃষ্ণ সখার গুরুপুত্রের চরণে অর্ঘ্য নিবেদন করে এবং প্রণাম জানিয়ে তাঁকে ভোজনে উপবেশন করার জন্য অনুরোধ করলেন। ভোজন শেষে তাম্বুল গ্রহণের পর শ্রীকৃষ্ণ অশ্বত্থামাকে যুক্ত করে বললেন, ‘হে ব্রাহ্মণপুত্র, আপনার আগমনে আমার গৃহ পবিত্র হয়েছে। এখন বলুন আমি কিভাবে আপনার সেবা করতে পারি?’

অশ্বত্থামা বললেন, ‘আমি আপনার কাছে প্রার্থী হয়ে এসেছি। আমি জানি আপনি উদার হৃদয়। ব্রাহ্মণকে অদেয় ও আপনার কিছু নাই। আপনার সুদর্শনচক্র আমাকে প্রলুব্ধ করেছে। যদি কিছু মনে না করেন তো ….’

—আপনি সংকোচ ত্যাগ করে আদেশ করুন কি আপনার প্রার্থনা আমি যথাসাধ্য তা পূরণের চেষ্টা করবো। মৃদু হেসে কৃষ্ণ বললেন।

—আমি আপনার সুদর্শন চক্রের প্রার্থী। এর পরিবর্তে আপনি আমার মাথার মণি নিতে পারেন। সংসারে এই মণি অত্যন্ত দুর্লভ।

—হে ব্রাহ্মণকুমার আপনি যদি সুদর্শনচক্র উত্তোলন করে নিয়ে যেতে পারেন তবে আমার কোন আপত্তি নেই। আর এর জন্য আপনাকে ঐ দুর্লভ মাথার মণিও আমাকে দেওয়ার প্রয়োজন নাই। মণি আপনি নিজের কাছেই রাখুন। সুদর্শন চক্র ছাড়াও অন্য কোন অস্ত্র যদি আপনি ইচ্ছা করেন তাও নিয়ে যেতে পারেন আমার আপত্তি নাই। তবে মনে রাখবেন সুদর্শনচক্র কোন সম্পত্তি নয় যে ওকে ধরে রাখবো। ওটা একটা অস্ত্র। এই অস্ত্রের যথার্থ প্রয়োগ যে জানে, সেই এই অস্ত্রকে প্রয়োগ করার ক্ষমতা রাখে। যে এই অস্ত্রের ব্যবহার জানে না, তার পক্ষে ঐ অস্ত্রের প্রার্থনা করা সমীচীন নয়।’

শ্রীকৃষ্ণের কথা যে যুক্তিপূর্ণ তা অশ্বত্থামা মনে মনে স্বীকার করলেন। কিন্তু সুদর্শন পাওয়ার দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষায় তিনি চক্র উত্তোলনের জন্য এক হাত দিয়ে চক্রটি উঠানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু ব্যর্থ হলেন। পরে দু হাত দিয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে চক্রটি তুলতে চেষ্টা করলেন। এবারও ব্যর্থ হলেন। লজ্জায় অশ্বত্থামার মস্তক নত হল। তিনি বললেন—’আপনার এই চক্র ত্রিভুবনে অদ্বিতীয়, এবং একে হাতে তুলে ধারণ করতে একমাত্র আপনিই সমর্থ।’

—আপনার প্রার্থনা পূরণ হল না আমি দুঃখিত। এখন বলুন আপনি আর কি চান আমার কাছে। অশ্বত্থামা বিষণ্ণ চিত্তে বললেন—আপনি স্বেচ্ছায় যা দেবেন তাই গ্রহণ করবো। ‘বেশ, তবে তাই হোক’—এই বলে শ্রীকৃষ্ণ অশ্বত্থামাকে প্রচুর অশ্ব ও রত্ন দান করে সন্তুষ্ট করলেন। বিদায় নেওয়ার সময় শ্রীকৃষ্ণ অশ্বত্থামাকে বললেন,—’হে ব্রাহ্মণ, যদি অনুচিত মনে না করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?’ অশ্বত্থামা বললেন, ‘বলুন?’

—আপনি চক্র নিয়ে কি করতে চান, দয়া করে যদি আমায় বলেন—

—আমি আপনার চক্র নিয়ে, আপনাকে প্রণাম জানিয়ে আপনার সঙ্গেই যুদ্ধ করতে চাই। আপনি আমার এই ধৃষ্টতাকে মার্জনা করবেন।

—আপনি বোধ হয় ভুলে গেছেন আমি কখনও ব্রাহ্মণের উপর অস্ত্র ক্ষেপণ করি না। কিন্তু ধনঞ্জয় আমার অভিন্ন স্বরূপ। আমার সঙ্গে যুদ্ধ করার আপনার যে বাসনা, তা যথাসময়ে ধনঞ্জয়ই পূরণ করবে।

অশ্বত্থামা কৃষ্ণের কাছে বিদায় নিয়ে বিষণ্ণ চিত্তে হস্তিনাপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন