প্রভাত সূর্য্যের উজ্জ্বল কিরণ ব্রজভূমিতে হালকা সোনালী পর্দার মতো ছড়িয়ে পড়েছে। গোপরাজ নন্দের গোশালায় এক বৃদ্ধ গোপ গোদোহনের স্বর্ণপাত্র দুই হাঁটুর মধ্যে ধরে গোদোহন করছেন। নীলমণি আজ ঘুম থেকে উঠে মায়ের কাছে না গিয়ে চুপিসাড়ে গোশালায় প্রবেশ করে ঐ বৃদ্ধ গোপের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীলমণিকে দেখে গাভীগুলো সমস্বরে ‘হাম্বা’ রবে স্বাগত জানায়। সচকিত হয়ে বৃদ্ধ গোপ ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখেন—নীলমণি দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর গোদোহন বন্ধ হয়ে যায়। তিনি নীলমণিকে অপলক নেত্রে দেখতে থাকেন। বৃদ্ধ গোপ নন্দরাজের বাল্যসখা। বিয়ে থা করেননি। নন্দমহারাজার বাড়িতেই থাকেন। দুগ্ধ দোহন ও গোশালা পরিচর্যার কাজ করেন। গোদোহন, গোসেবার কাজ করলেও, নন্দ মহারাজ তাঁকে প্রীতির চোখে দেখেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার ন্যায় তাঁকে সম্মান করেন। ব্রজের সমস্ত গোপকুমারের তিনি প্রিয় তাউজী। তাউজী সম্বোধনের অন্তরালে তাঁর আসল নাম হারিয়ে গেছে। নন্দনন্দন নীলমণি তাউজীর পাশে এসে দাঁড়াল। কচি কোমল হাত দিয়ে তাঁর গলা বেষ্টন করে বলেন—”তাউজী, আমায় গাভীদোহন শিখিয়ে দেবে?” বৃদ্ধ তাউজীর মনে হল কে যেন তাঁর কানে সুধা ঢেলে দিল। তাঁর হাত হতে অর্ধপূর্ণ দোহনপাত্র স্খলিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। কৃষ্ণ চোখের জল নিজের হাতে মুছিয়ে দিতে দিতে পুনঃজিজ্ঞাসা করল,—’তাউজী, তুমি কাঁদছ কেন? আমাকে গোদোহন শিখিয়ে দেবে না?’
গো-দোহনের মতো একটা তুচ্ছ কাজ শেখার জন্য তাঁর কাছে কেউ প্রার্থনা করবে—একথা স্বপ্নেও ভাবেননি তাউজী। তাই তাঁর নয়নে অশ্রু। কৃষ্ণের অযাচিত করুণায় তিনি নিজেকে ধন্য মনে করে আনন্দে বিহ্বল হয়ে পড়েন। হাত হতে দুগ্ধ দোহনের পতিত পাত্র ভূমি থেকে তুলে নিয়ে তিনি অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে-গোপালের শিরদেশে হাত রেখে বললেন,—’আজ সমস্ত গাভী দোহনের কাজ শেষ হয়ে গেছে। প্রিয় লাল, আমি আগামীকাল তোমাকে গো-দোহন শিখিয়ে দেব।’ আনন্দে উল্লসিত হয়ে গোপাল বলেন—”কাল যেন শিখিয়ে দিতে ভুলে যেও না—আমি না আসা পর্যন্ত অন্ততঃ একটা গাভীকে অদোহন অবস্থায় রেখ।” কৃষ্ণের মধুনিসন্দী কণ্ঠরবে বৃদ্ধ গোপের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায়। তিনি নীলমণি কৃষ্ণের কথার কোন উত্তর দিতে পারেন না। তিনি একদৃষ্টিতে চেয়ে দেখতে থাকেন—নন্দনন্দন ব্রজকিশোরকে। কৃষ্ণ তাউজীর হাতদুটি নিজের কচি হাতে ধরে পুনরায় বলেন—’তাউজী, আমি তো এখন বড় হয়ে গেছি। এই সময় নিজের গাভী নিজেকেই দোহন করতে হয় তাই না?” আচ্ছা তাউজী, আজ সন্ধ্যার সময় যদি শিখিয়ে দাও তাহলে কেমন হয়?’ বৃদ্ধ তাউজী উত্তরে কিছু বলার আগেই কৃষ্ণ পুনরায় বললেন—’তাউজী, ভেবে দেখলাম, সন্ধ্যায় গো-দোহন শেখা সম্ভব নয়।’
—সম্ভব নয়! কেন লাল?’ তাউজী সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেন কৃষ্ণকে।
—’সন্ধ্যার সময় মা গোশালায় আসতে দেবে না। তুমি কালই আমায় গোদোহন শিখিয়ে দিও। কাল প্রভাতে যখন তুমি গোশালায় গাভী দোহন করতে আসবে, তখন আমাকে ডেকে নিও…পরে কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে পুনরায় বললেন—না, তোমাকে ডাকতে হবে না, আমি নিজে নিজেই যথাসময়ে গোশালায় হাজির হয়ে যাব কিন্তু তুমি যেন কাল আসতে ভুলে যেও না।’ বৃদ্ধ গোপকে আগামীকাল আসার কথা মনে করিয়ে দিয়ে কৃষ্ণ গোশালা ছেড়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল।
পরের দিন প্রভাত হতেই গোপাল গোশালায় বৃদ্ধ গোপের কাছে পৌঁছে গেল। আজ সঙ্গে দাদা বলরাম আছে। গোশালায় প্রবেশ করে কৃষ্ণ তাউজীর হাত হতে দোহনী-পাত্র নিজের হাতে নিয়ে বললেন—’চলো, তাউ! আমায় দোহন শিখিয়ে দেবে চল।’ বলরামও সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠল—’হ্যাঁ হ্যাঁ তাউজী, আজ ভাইয়াকে গো দোহন অবশ্যই শিখিয়ে দাও।’ তাউজী কৃষ্ণের হাত থেকে বড় দোহনী পাত্রটি নিয়ে তাঁর হাতে একটি ছোট দোহনী পাত্র ধরিয়ে দিলেন। তারপর কৃষ্ণকে দেখিয়ে দিলেন—কিভাবে গো-দাহনের পাত্র দুই হাঁটুর মধ্যে চেপে ধরে-গাভীর স্তন হতে অঙ্গুলি সঞ্চালন যোগে দুগ্ধ দোহন করতে হয়। নীলমণিও তাঁকে অনুকরণ করে গো-দোহনের মুদ্রায় গাভীর স্তনের পাশ্বস্থিত ভূমিতে উপবেশন করলেন। তাউজী শিক্ষা শুরু করলেন—নীলমণির হাতের আঙুল আপন হাতের আঙুল দিয়ে আলতো করে ধরে গাভীর স্তনে লাগিয়ে দিয়ে বললেন—”বেটা নীলমণি, গাভীর স্তনে আঙুলের চাপ দিতে দিতে স্তনকে আকর্ষণ কর।” তাউজীর কথানুযায়ী তা করতেই গাভীর স্তন হতে দুগ্ধ অঝোর ধারায় ক্ষরিত হতে থাকে। কিন্তু দুধ দোহন পাত্রে না পড়ে নীলমণির উদর-দেশে পতিত হল। কখনও বা মাটিতে, আবার দু’চার ফোঁটা দোহনীপাত্রেও পড়ে জমা হয়। তা দেখে কৃষ্ণ উল্লাসে ফেটে পড়ল। দোহনী পাত্র নিয়ে উঠে নাচতে নাচতে বলরামের কাছে গিয়ে বলল, ‘দাউদাদা, দাউদাদা, দেখ আমি গাভী দোহন শিখে গেছি।’ বৃদ্ধ গোপ নীলমণির আনন্দ উল্লাসভরা নৃত্য দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যান।
পরদিন প্রভাত হতেই কৃষ্ণ যখন নতুন গাভী দোহন শিক্ষার আনন্দে পুনঃদোহন পাত্র হাতে নিয়ে গোশালার দিকে যেতে থাকেন তখন মা যশোদা গোপালকে দেখতে পেয়ে দ্রুত সেখানে উপস্থিত হয়ে গোপালকে গো-দহন হতে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেন। গোপালের জেদও কম নয়। সে গাভী দোহন না করে কিছুতেই নিবৃত্ত হবে না। তখন যশোদা বাধ্য হয়ে গোপালের হাত হতে দোহনী পাত্রটি কেড়ে নিয়ে বলেন—’ওরে ও সোনামণি, কেন বুঝিস না, তুই একটা ছোট্ট অবোধ শিশু, কোন গাভী যদি তোকে লাথি ছোঁড়ে কিংবা শিং দিয়ে গুঁতিয়ে দেয় তখন তোর দশাটা কি হবে তা ভেবে দেখেছিস।’ যশোদা যত বোঝান গোপালের জেদও তত বেড়ে যায়। শেষে নিরুপায় হয়ে যশোদা বললেন—’শোন নীলমণি, প্রথমে তুই তোর বাবার কাছে ভালো করে দোহন শিখেনে; শিখে নেওয়ার পর আমি আপত্তি করবো না। তখন নিজের হাতে দোহনীপাত্র তোর হাতে তুলে দেব। তুই দুগ্ধ দোহন করে নিয়ে আসবি আমার কাছে, কি এবার খুশী তো?
—’ঠিক আছে মা, তাই হবে! আমি এখনই চললাম বাবার কাছে।’
নন্দ মহারাজ তখন গৃহে আপন কাজে ব্যস্ত ছিলেন। গোপাল সেখানে গিয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলে—”বাবাজু! মোহি দুহন শিখওয়াও।” মহারাজ নন্দ এক শুভ মুহূর্ত দেখে লালাকে গোদোহন শিখাবেন—এই প্রতিশ্রুতি দেন। শুভ মুহূর্তের অপেক্ষায় ধৈর্য্য ধরা নীলমণির পক্ষে সম্ভব নয়। সে চায় এখন এই মুহূর্তে গোদোহন শিখতে। অবশেষে নন্দমহারাজও নিরুপায় হয়ে উপানন্দের পরামর্শে গৃহদেব নারায়ণকে স্মরণ করে আজই নলমণির সাধ পূরণের জন্য সচেষ্ট হলেন। কৃষ্ণও আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে জননীর কাছে এসে বলল :
”সুবর্নদোহনী পাত্র মাতা, দাও মোর হাতে।
গোশালায় গোদোহনে যাব আমি পিতৃদেবের সাথে।।”
জননী যশোদা গোপালের হাতে ছোট দোহনী পাত্র ধরিয়ে দিলেন। গোপালের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও গোশালার দিকে এগোলেন। তাঁর পিছু পিছু চলেন ব্রজের যত রমনী, ব্রজের নীলসুন্দরের গো-দোহন লীলা দর্শনের জন্য। গোশালায় নন্দমহারাজ আপন ইষ্টদেব নারায়নকে স্মরণ করে পুত্রের শিরদেশের আঘ্রান গ্রহণ করলেন। অনন্তর গো-দোহন শিক্ষাপর্ব শুরু হল। নীলমণি বাবার কাছ হতে গো-দোহন শিক্ষা মনোযোগের সঙ্গে গ্রহণ করলেন। ঐ দিন মঙ্গলগীত-বাদ্যধ্বনিতে সমগ্র ব্রজপুর আনন্দে মেতে উঠল। মণিদীপমালায় সজ্জিত ব্রজপুরে সে সময় দিবস-রজনীর পার্থক্য বোঝা অসম্ভব হয়ে উঠল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন