অগ্রজ বলরাম ও সখাদের নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ কংসের ধনুষযজ্ঞের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে মথুরায় প্রবেশ করলেন। খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই অগণিত নরনারী তাঁদের দেখার জন্য রাজপথে শ্রেণীবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ভীড় জমাতে থাকে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী সকলেই কৃষ্ণ-বলরাম দর্শনের ব্যাকুল অভীপ্সা নিয়ে সমবেত হল। কেউ কেউ শ্রীকৃষ্ণ-বলরামসহ সখাদের শ্রীঅঙ্গে ফুলচন্দন নিক্ষেপ করে অভ্যর্থনা জানাল, কেউ বা কুশাগ্রের দ্বারা পবিত্র জল তাঁদের সবার অঙ্গে সিঞ্চন করতে করতে স্তবস্তুতি করতে লাগল। কেউ করেন আশীর্বাদ, কেউ বা দেন উপহার। শ্রীকৃষ্ণ-বলরাম শ্রদ্ধাবনত শিরে মৃদুহাস্যসহ করস্পর্শ দ্বারা উপহার সমূহকে ধন্য কৃতার্থ করছেন। সঙ্গের গোপবন্ধুরা শুধুমাত্র নয়ন দিয়ে উপহার সমূহ দেখতে থাকেন, গ্রহণ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা কারও নেই।
জনতার অভিনন্দন গ্রহণ করতে করতে তাঁরা যমুনার দিকে অগ্রসর হন। সহসা সেইপথে এসে উপস্থিত হয় মহারাজ কংসের রজক [ধোপা]। রাজপরিবারের সকলের বস্ত্র পরিষ্কার ও রঙ করা তার কাজ। এককথায় সে রাজবাড়ীর ধোপা। সঙ্গে তার শতাধিক কর্মচারী বা সহায়ক। সকলের হাতে স্বর্ণযষ্টি। স্বর্ণযষ্টির শীর্ষদেশে রত্নজড়িত বস্ত্রসমূহ টান টান করে ঝোলান, বস্ত্রে যাতে ভাঁজ না পড়ে তাই এই সতর্কতা। রজকের গায়ের রঙ মিশমিশে কালো-নাদুস নুদুস চেহারা, পাকানো গোঁফ। মদ্যপানের মত্ততায় চোখ দুটি লাল। তার চলনে-বলনে অহংকারের উদ্ধত কর্কশ প্রকাশ। পশ্চাতে চলমান সহকারীরা তারই প্রতিচ্ছবি। সুরামত্ত রজক পথ দিয়ে এমনভাবে চলছে যেন সেই মথুরার রাজা। তাকে আসতে দেখে মথুরার নাগরিকগণ রাস্তার দুপাশে সরে দাঁড়ায়। রাজার রজক—তাই সবাই ভয়ে পথ ছেড়ে দিচ্ছে। রজক সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে আপন অহংকারে চলতে থাকে, সহকারীরা তাকে অনুসরণ করে। নাগরিকদের প্রতি বিনয় বা সৌজন্যের প্রকাশ নেই। বরং নাগরিকরাই সৌজন্য বিনয় প্রদর্শন করে তার ও সঙ্গীদের চলার পথ তৈরি করে দেয়। আগামীকাল ধনুষযজ্ঞ। যজ্ঞোপলক্ষ্যে যে মহোৎসব অনুষ্ঠিত হবে—সেই উৎসবে মহারাজ কংস যে বস্ত্র পরিধান করবেন—সেই বস্ত্র যে রজকের হস্তধৃত স্বর্ণযষ্টিতে শোভা পাচ্ছে। এই কাজের জন্য রাজার কাছ থেকে অগ্রিম পারিশ্রমিক বাবদ বেশ কিছু সুবর্ণ মুদ্রাও সে পেয়েছে। কোমরে বাঁধা বটুয়া থেকে তার ঝনঝন শব্দও শোনা যাচ্ছে। বোধ হয় এইসব ভাবনাই তাকে অন্যদিনের তুলনায় আজ বেশ কিছুটা অহংকারী করে তুলেছে। এরপর মথুরার বিশিষ্ট নাগরিকদের রাজপথে সমবেত হতে দেখে—তার গর্ব যেন আরও অনেকখানি বেড়ে গেছে, রজক মনে মনে ভাবছে আমি মহারাজ কংসের কৃপাপাত্র, —এদের সম্মান সৌজন্য দেখাতে আমার বয়ে গেছে। রাজপথে ওদের চেয়ে আমার অধিকার বেশী। ওদের যদি যেতেই হয়,—ওরা রাজপথের বা রাস্তার দুই প্রান্তদেশ দিয়ে নেমে যাক। আমি মহারাজ কংসের রজক, রাজকর্মচারী—আমি কেন পথ ছেড়ে সরে যাবো!
—কানু, এ অহংকারী দুষ্টুটা কে রে? গোপবন্ধুদের একজন জিজ্ঞাসা করে কৃষ্ণকে।
—মনে হচ্ছে রাজা কংসের রজক। দেখছিস না সবার হাতে স্বর্ণযষ্টিতে রাজবস্ত্র শোভা পাচ্ছে।
—লোকটার এত অহংকার কি ভালো? বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ওর ভয়ে রাস্তার প্রান্তদেশ দিয়ে চলতে গিয়ে পিছলে পড়ে যাচ্ছে—ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে, তুই যা হোক একটা কিছু কর না কানু! আর যে সহ্য হয় না!
—পূজনীয়, সম্মানীয় বড়দের দীর্ঘশ্বাসই বোধ হয় ওর জীবনের অন্তিম লগ্ন বয়ে নিয়ে আসবে। অহংকারে ক্ষমতার অপব্যবহারই মানবজীবনের পতনকে ত্বরান্বিত করে। ‘দাউজী, তুমি কি বলো?’—কৃষ্ণ বলরামকে জিজ্ঞাসা করলেন।
—তোমার কথা-আমার কথা কি আলাদা?—বলরাম উত্তর দিলেন।
দাদা বলরামের সমর্থন পেয়ে কৃষ্ণ সখাদের সঙ্গে কয়েকপদ অগ্রসর হয়ে কংসের রজকের সামনে উপনীত হয়ে বললেন,—”ভাই রজক, আমরা তোমাদের নগরের অতিথি। অতিথি নারায়ণ—তাই আমরা তোমাদের পূজ্য। তোমার কাছে যে সব ধোয়া রঙ করা নতুন নতুন বস্ত্র সম্ভার রয়েছে—তা থেকে আমাদের সকলকে কিছু দাও। আমরা সেসব পরিধান করে ধনুষযজ্ঞে তোমাদের রাজার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাবো। আমাদের সকলের গাত্র মাপ অনুযায়ী পোষাক দিলে তোমার কল্যাণ হবে। দেখ, আমি তোমাদের নগরের শুধু অতিথিই নই—তোমাদের রাজার পরম আদরের ভাগ্নে। সুতরাং সব দিক দিয়েই আমি ও আমার সখারা তোমার বন্দনীয়, অতএব বিলম্ব না করে আমাদের বস্ত্র দাও।”
রজক ভেবেছিল কৃষ্ণ মথুরার নাগরিকদের মতো রাজমার্গের পার্শ্বদেশে অবতরণ করে তাকে পথ ছেড়ে দেবে কিন্তু সে যখন দেখল কৃষ্ণ রাস্তা ছাড়ার পরিবর্তে পথ অবরোধ করে তার কাছে সবার জন্য বস্ত্র চাইছে। তখন সে ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। রজক কৃষ্ণের দিকে চেয়ে উপহাসের সুরে বলল,—’আরে জংলীর দল—এইসব রাজবস্ত্র পরে তোরা কি গরু চরাবি? এমন মূল্যবান বস্ত্র কি তোরা কখনও চোখে দেখেছিস? তোরা এইসব বস্ত্র পরার যোগ্য কি না তা কখনও ভেবে দেখেছিস? তোরা বড় মূর্খ-অসভ্য উচ্ছৃঙ্খল। যদি তোদের বাঁচার ইচ্ছা থাকে তবে রাস্তা ছেড়ে দে! তোরা মহারাজের বস্ত্র চেয়ে অপরাধ করেছিস—মহারাজ জানতে পারলে তোদের সবাইকে কারাগারে নিক্ষেপ করবে। নয়তো হত্যা করবে—তোদের সব সম্পত্তি ছিনিয়ে নেবে।’ রজকের গর্বোদ্ধত কথায় গোপ সখাদের মুখ রাগে লাল হয়ে ওঠে। তারা কৃষ্ণের দিকে চেয়ে বলে,—’কানু, এই দুষ্টের ধৃষ্টতা বাচালতা অসহ্য’। গোপসখাদের হস্তধৃত লাঠি একসাথে উপরে উঠল রজকের মস্তকে প্রহারের জন্য। কিন্তু তৎপূর্বেই কৃষ্ণ ক্রোধে আরক্ত হয়ে ডান হাত উপরে তোলেন এবং হাতের অগ্রভাগ দ্বারা ত্বড়িৎগতিতে মুহূর্তের মধ্যে রজকের মস্তক ধড় থেকে আলাদা করে দেন। মস্তক মাটিতে পড়ে লাফাতে থাকে।
সখারা সমস্বরে বলল, ‘সাবাস কানু! সাবাস।’ রজকের মস্তকচ্যুতি দেখে তার সহকারীরা বস্ত্রসহ স্বর্ণযষ্টি ভূমিতে নিক্ষেপ করে-পিছন দিকে ঘুরে প্রাণের ভয়ে দৌড়তে থাকে। তাদের কোমরে যে স্বর্ণমুদ্রার বটুয়া ঝুলছিল—পালানোর সময় তারা তাও ফেলে দেয়—যদি স্বর্ণমুদ্রার লোভে কৃষ্ণ ও গোপ-বালকরা তাদের পিছু নেয় এই ভয়ে তারা পিছনের দিকে না তাকিয়ে প্রাণপণ দৌড়াতে থাকে। তাদের ভয়ে পালাতে দেখে গোপসখারা আনন্দে হাততালি দেয়। রজক ও তার সহকারীদের ফেলে যাওয়া বস্ত্রসম্ভার কৃষ্ণ ও গোপবালকরা একজায়গায় স্তূপীকৃত করে। কৃষ্ণ সেই বস্ত্রস্তূপের মধ্যে একটি সুন্দর বস্ত্র হাতে নিয়ে বলরামের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ‘দাদা! এই বস্ত্র তোমার জন্য।’ বলরাম কৃষ্ণের হাত থেকে বস্ত্র গ্রহণ করে পরিধান করেন। সখারাও ও শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে আপন আপন পছন্দ অনুযায়ী বস্ত্র পরিধান করল। কৃষ্ণও একখানি বস্ত্র নিজের জন্য হাতে তুলে নেন। কৃষ্ণ-বলরামসহ গোপবালকরা পূর্বপরিহিত বস্ত্রের উপরেই নবসংগৃহীত বস্ত্রসমূহ পরিধান করলেন। অবশিষ্ট বস্ত্র ও স্বর্ণমুদ্রাপূর্ণ বটুয়াপথের ধূলায় পড়ে রইলো। সখাসহ কৃষ্ণবলরাম সেদিকে দৃষ্টিপাতও করলেন না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন