সব বোধের অবোধ লীলা

গোকুলে শ্রীকৃষ্ণের আগমনের অনতিকাল পরেই নানাধরনের উপদ্রব শুরু হয়। পুতনা, তৃনাবর্তাসুর, বৎসাসুর ইত্যাদি কংসের দুষ্ট অনুচররা বারবার গোকুলে হানা দেয় শ্রীকৃষ্ণের প্রাণনাশের জন্য। ব্রজবাসীরা শ্রীকৃষ্ণের প্রাণরক্ষার জন্য চিন্তিত হয়ে পড়েন। কংসপ্রেরিত অসুর-রাক্ষসীর উৎপীড়নের হাত হতে কিভাবে অব্যাহতি লাভ করা যায় কিভাবে ব্রজের প্রাণধন নীলমণির জীবন সুরক্ষিত হবে এই বিষয়ে ব্রজবাসীদের মধ্যে আলাপ আলোচনা শুরু হয়। একদিন এইরূপ এক আলোচনা সভায় নন্দমহারাজের ভ্রাতা উপানন্দ গোকুল পরিত্যাগ করে বৃন্দাবনে যাওয়ার পরামর্শ দেন। বৃন্দাবন গোকুল অপেক্ষা অনেকখানি নিরাপদ। আলোচনা সভায় উপানন্দের প্রস্তাব বা পরামর্শ সাদরে গৃহীত হয়। সমস্ত ব্রজবাসী ব্রজজীবন কৃষ্ণের মঙ্গলের জন্য গোকুলের ঘরবাড়ি ভূমিসম্পদ সব পরিত্যাগ করে বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। গোপপুরোহিত শাণ্ডিল্যমুনি বৃন্দাবন যাত্রার জন্য শুভদিন নির্ধারণ করে দেন। শুভদিনে তিনি (শাণ্ডিল্যমুনি) মঙ্গলময় শঙ্খধ্বনি করে বৃন্দাবন যাত্রার সূচনা করেন। শঙ্খধ্বনির শেষে ব্রজের রাজপথ অসংখ্য গোশকটে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। গোশকটের উপরে বাঁশ ও বিভিন্ন বর্ণের দ্বারা নির্মিত একপ্রকার দু’মুখ খোলা ঘেরা মণ্ডপ স্থাপন করা হয় [গ্রাম বাংলার ভাষায় যাকে ছই গাড়ি বলা হয়]। সারিবদ্ধভাবে গোশকট চলেছে রাজপথ দিয়ে—আগে আগে গাভী ও গোবৎসের দল। গাভী ও গোবৎস দেখাশুনার জন্য গোপরা চলেছেন তাদের পিছু পিছু।

ধেনুর দল, গোশকটের পংক্তি অগ্রগমনের ফলে ব্রজপুরের আকাশ-বাতাস ধূলিজালে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। একটু দূর থেকে দেখলে মনে হয় কে যেন শূন্যপথে অবলম্বনহীন মাটির দূর্গ রচনা করে চলেছে নিপুণ শিল্পীর মতো। শ্রেণীবদ্ধ একখানি চলমান শকটের অভ্যন্তরে যশোদা রোহিনী কৃষ্ণ বলরাম। গোশকট আরোহনের আনন্দে নীলমণি আজ বড়ই আনন্দ চঞ্চল। মাঝে মাঝে মা যশোদার কোল থেকে নেমে দু’মুখ খোলা ঘেরাটোপের বাইরে উঁকি মেরে দেখছেন রাস্তার দুপাশের দৃশ্যাবলী। নীলমণির চঞ্চলতায় যশোদা ভীতা-সন্ত্রস্তা হয়ে পড়েন—এই বুঝি আদরের ধন গো-শকট থেকে নীচে পড়ে যায়। তাঁর মাতৃহৃদয় নীলমণির ভাবী বিপদের আশঙ্কায় থেকে থেকে কেঁপে ওঠে। কিন্তু নীলমণি যে বড়ই দুরন্ত। কথা শোনে না একদম। ঝুঁকে বাইরে উঁকি মারতে মা যশোদা নিষেধ করে নীলমণিকে। নীলমণি কর্ণপাত করে না সে কথায়। উল্টে মাকে প্রশ্ন করে—’মা আমরা কোথায় যাচ্ছি।’ জননী যশোদা উত্তর দেন—”পুত্র! বৃন্দাবন নামান বনধামানি।” অর্থাৎ আমার প্রিয় লাল (ছোট ছোট ছেলে-মেয়েকে উত্তর ভারতে লাল ও লালী বলে সম্বোধন করা হয়) আমরা বৃন্দাবনে যাচ্ছি।

নীলমণি তা শুনে কিছুক্ষণ মৌন রহিল। পরে মৌনভঙ্গ করে পুনরায় জিজ্ঞাসা করল মাকে—’কদা সদনমায়াস্যামঃ।’ অর্থাৎ বাড়ী ফিরবো কবে? পুত্রের কথায় যশোদার অধরে মৃদু হাসি দেখা দেয়। তিনি বলেন,—’বাপনীলমণি বাড়ীঘর সব তো আমাদের সঙ্গে সঙ্গে বৃন্দাবন যাচ্ছে।’—’বাড়ী আমাদের সঙ্গেই যাচ্ছে তাহলে গোকুলে আর ফিরবো না। কি মজা, কি মজা, আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে শ্যামসুন্দর করতালি দিতে লাগল।

নীলমণি দাদা বলরামকে জিজ্ঞাসা করল,—’দাদা, বৃন্দাবন বুঝি অনেক দূর?’

—ওটা আমি বলতে পারবো না, মাকে জিজ্ঞাসা কর।

শ্যামসুন্দর মায়ের দিকে ঘুরে জিজ্ঞাসা করেন—’মা বৃন্দাবন কোথায়? যশোদা পুত্রের কথায় উত্তর না দিয়ে চুপ থাকেন। তা দেখে রোহিনীমাতা গোপালকে কোলে তুলে নিয়ে মুখচুম্বন করতে করতে বলেন—’দুষ্টু-মিষ্টি সোনামণি, বৃন্দাবন হচ্ছে যমুনার ওপারে।’

—’ছোট মা, যে যমুনায়—তুমি, মা আমরা স্নান করতাম, খেলা করতাম, সেই যমুনার ওপারে?’

—হ্যাঁ বাবা।

—’আচ্ছা ছোট মা, বলতো বৃন্দাবনে কী এমন আছে, যার জন্য আমরা এত কষ্ট করে গোকুলের বাড়ী-ঘর সব ছেড়ে যাচ্ছি।’

—শুনেছি ওখানে অনেক খেলার জায়গা আছে। অনেক ভালো ভালো খেলনাও ওখানে কিনতে পাওয়া যায়।

—’তুমি সত্যি বলছো ছোটমা।’

—’সত্যি! সত্যি! সত্যি!’

—’বাঃ বাঃ! কী মজা, কী মজা! কী আনন্দ’—আনন্দে ডগমগ হয়ে আনন্দময় নীলমণি ছোটমা রোহিনীর কোলে উঠে নৃত্য করছে। চুমায় চুমায় ভরে দিল রোহিনীর, যশোদার ও অগ্রজ বলরামের মুখকমল। নীলকমলের মধুর ছোঁয়ায় সব মুখকমলগুলি খিল-খিল করে হেসে ওঠে। দাদা বলরামের চিবুকটা ধরে বলে—’এখন আমার কি মনে হচ্ছে জানিস দাউ দাদা?

—কি?

—’গাড়ী (শকট) হতে নেমে তোকে আর বন্ধুদের নিয়ে একছুটে চলে যাই বৃন্দাবনে। ইতিমধ্যে গাড়ীগুলো রাজপথ ছেড়ে বৃন্দাবনের ঘন বনপথ দিয়ে চলতে শুরু করেছে। পথের দুপাশে নানাধরনের বৃক্ষলতা বনের শোভাবর্ধন করে বিরাজ করছে—গাছের শাখায় শাখায় রঙ-বেরঙের পাখীরা গান করছে। বনের শোভা দর্শন করতে করতে সর্বজ্ঞ শিরোমণি আজ মায়ের কোলে বসে অবোধ বা অজ্ঞ শিশুর মতো একটার পর একটা প্রশ্ন করে চলেছে। একটি নতুন বৃক্ষ দেখে কৃষ্ণচন্দ্র যশোদাকে জিজ্ঞাসা করল—’মা, ঐ যে বড় গাছটার পাতাগুলো দুলছে ঐ গাছটার নাম কি? যশোদার উত্তর—’এ অশ্বত্থ গাছ বাবা।’

—আচ্ছা মা, বলতো ঐ যে গাছটা রাস্তার ডান দিকে রয়েছে, ওটা কি গাছ?’

—কোন গাছটার কথা বলছিস সোনা?

—ওই যে গো মা, যে গাছটা অনেক অনেক ডিম প্রসব করে নিজের সারা গায়ে ঝুলিয়ে রেখেছে, ঐ গাছটার কথা বলছি…

গোপালের কথা শেষ না হতেই যশোদা, রোহিনী হোঃ হোঃ শব্দে হেসে ওঠেন।

—মা, তোমরা হাসছো কেন?

—দূর বোকা! গাছ কি কখনও ডিম প্রসব করে?

—’ও গুলো তবে কি গাছ মা?’

—ও গুলো ডুমুর। ডুমুর গাছ। মা যশোদা নীলমণির নাকটা আলতো করে টিপে আদর করেন।

—আচ্ছা ছোট মা, এবার তুমি বলতো, ওই লম্বা লম্বা জটাওয়ালা গাছটার কি নাম?

—রোহিনী উত্তর দেন বটগাছ।

—আচ্ছা দাউদাদা, তুমি বলতো—এই রঙ-বেরঙের পাখীটার নাম কি?’

—ময়ূর।

—কুহু কুহু গান করছে ঐ পাখীটার কি যেন নাম।

বলরামের উত্তর—’কোকিল!’

—মানুষের মতো কথা বলে কোন পাখী?

—’শুকপাখী’ (টিয়া)।

—’মাথাভর্ত্তি ডালপালা নিয়ে ছুটে আসছে ওটা কি?’

—’হরিণ।’

—ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে ওটা কি?

—’ভ্রমর’।

শকটের মধ্যে ভাই প্রশ্ন করছে—দাদা উত্তর দিচ্ছে। দুই মা ওদের কথা শুনে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। দেখতে দেখতে পংক্তিবদ্ধ শকটসমূহ বনের মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। অনতিদূরেই নীলযমুনার কলকল নাদ শোনা যাচ্ছে।

মা যশোদা কৃষ্ণবলরামকে বললেন—বাছা, তোমরা এবার কিছু খেয়ে নাও। মায়ের আদেশে দুইভাই গাড়ী হতে নীচে নেমে এলেন। অন্যান্য শকট থেকেও সখারা সব সেখানে এসে উপস্থিত হল। সখাদের সঙ্গে কৃষ্ণবলরাম জলযোগে মনোনিবেশ করলেন।

 বহুব্যঞ্জন বহুভাঁতি রসোই, ষটরস কে পরকার।

 সূর শ্যাম হলধর দোউ ভাইয়া, ঔর সখা সব গওয়ার।। (সুরদাস)

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন