বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে

ব্রজরাজ নন্দ প্রত্যুষে যমুনায় স্নান সেরে স্বীয় ভবনে ফিরে এসেছেন। নন্দলাল তখন প্রাঙ্গণে বসে খেলা করছিল। তার সারা অঙ্গ ধূলায় ধূসরিত। বাড়ীতে প্রবেশ করে নন্দরাজ পূজার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। নন্দলাল তা লক্ষ্য করে খেলা পরিত্যাগ করে পিতার পিছু নিল। গোপাল সবে মুখে আধো আধো বুলি বলতে শিখেছে। পিতার পিছু পিছু টলমল টলমল করে নন্দলাল কৃষ্ণও পূজার ঘরের দিকে যেতে থাকল। পায়ের নূপুরের আওয়াজে নন্দরাজ পিছু ফিরে দেখেন—পুত্র ধূলালিপ্ত অঙ্গে তাঁর সঙ্গে সঙ্গে পূজার ঘরে প্রবেশ করতে চলেছে। পুত্রকে বাধা দিয়ে তিনি বললেন,—”ভেতরে আছিস না, যা, বাইরের উঠোনে খেলা কর।

আধো আধো স্বরে কৃষ্ণ বলল,—”ভি-ত-লে দা-বো না তে-ন?”

নন্দ মহারাজ বললেন,—”বেটা, আমি এখন ঠাকুর ঘরে পূজা করবো। জয় জয় নারায়ণ হরি—গান করবো।’ এই সময় স্নান না করে পূজার ঘরে ঢুকতে নেই।”

—”যব তেয়ে বয়ো-দয়-দয় নায়ন আমি। আমার তেয়ে বয়ো দয় দয় তোমার তে আতে’?

নন্দবাবা বললেন, ‘ঠিক আছে, তুই দরজায় বস। ভেতরে ঢুকবি না।’

কৃষ্ণ দরজার চৌকাঠে বসল। নন্দবাবার পূজার ঘরে রত্ন সিংহাসনের উপর শালগ্রাম শিলা [নারায়ণ বিগ্রহ] বিরাজ করছেন। পূজার আসনে বসে আচমনাদি সমাপন করে নন্দবাবা শালগ্রাম শিলাকে পঞ্চামৃত দিয়ে স্নান করালেন। প্রথমে যমুনার জল দিয়ে স্নান করালেন। পরে দুধ-দই-ঘৃত মধু দিয়ে স্নান করালেন। তা দেখে কৃষ্ণের জিভ দিয়ে জল বেরোতে থাকে। কিন্তু কৃষ্ণের ভিতরে ঢোকার অনুমতি নেই। চৌকাঠে বসে বসে কৃষ্ণ ভাবছে—বাবা, রোজ রোজ শালগ্রাম শিলা বিগ্রহকে দুধ-দই-ঘি-মধু দিয়ে যখন স্নান করায়, তখন নিশ্চয়ই ওটা (বিগ্রহ) মিষ্টি হয়ে গেছে। খেতে নিশ্চয়ই মধুর হবে। নন্দবাবা স্নানের পর শালগ্রাম শিলায় চন্দন মাখিয়ে তার উপর তুলসীপত্র রাখলেন। অতঃপর গায়ে উত্তরীয় জড়িয়ে নিয়ে দুই আঁখি বন্ধ করে জপে মনোনিবেশ করলেন। কৃষ্ণ দেখল,—বাবা চোখ বন্ধ করে ঠোঁট নাড়িয়ে কী যেন বলছে এই সুযোগ, দুধ-দই-ঘি-মধুতে স্নান করতে করতে শালগ্রাম-অতি মধুর স্বাদ বিশিষ্ট মিঠাইতে পরিণত হয়ে গেছে। এই সুযোগে ঐ মিঠাইটা মুখে পুরে নিই। কৃষ্ণ চৌকাঠ পেরিয়ে ঘরে ঢুকল এবং সিংহাসন হতে শালগ্রাম শিলা তুলে তা নিজের মুখের মধ্যে পুরে নিল এবং বাবার ডানপাশে বসে মিছরী চোষার মতো চুষতে থাকল।

কিছুক্ষণ পর জপ শেষ করে—জপের মালা ঝুলিতে রেখে নন্দমহারাজ শালগ্রাম শিলাকে প্রণাম করতে গিয়ে দেখেন—সিংহাসন শূন্য, শালগ্রাম শিলা নেই। ‘আরো!—শিলা বিগ্রহ গেল কোথায়?’ ফুল তুলসীর স্তুপ সরিয়ে খুঁজতে থাকেন—কিন্তু না, এর মধ্যে তো নাই। বামপাশে চেয়ে দেখেন-সেখানেও নেই। ডানপাশে ঘুরে দৃষ্টিপাত করতেই দেখেন—কৃষ্ণ বসে রয়েছেন। তাঁর মুখটা ফুলে রয়েছে। নন্দ মহারাজ মুখ ফোলা অবস্থায় কৃষ্ণকে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন—’বেটা, তুই এখানে?’ কৃষ্ণ মুখ বন্ধ করে উত্তর দেয়—’উঁ-হু।’

—তুই সারা গায়ে ধুলো মেখে, ঠাকুর ঘরে কেন ঢুকেছিস?

কৃষ্ণ শালগ্রাম মুখে রেখে দাঁতে দাঁত চেপে ঠোঁট বন্ধ করে বলে—’উঁহু! নন্দবাবা দেখলেন কৃষ্ণের মুখ ফুলে রয়েছে। তাই তিনি পুত্রকে জিজ্ঞাসা করলেন,—’লালা, তোর মুখ ফুলে রয়েছে কেন?’

কৃষ্ণ বলে—’উঁহু।’ কৃষ্ণের ‘উঁহু-উঁহু’ শুনে নন্দবাবা রেগে যান। তিনি তাঁর গালে আলতো করে থাপ্পাড় মারেন। সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণের মুখ থেকে লাল-ঝোল মাখানো শালগ্রাম শিলা বের হয়ে মাটিতে পড়ে। শালগ্রামকে মাটিতে ঐ অবস্থায় পড়তে দেখে—নন্দবাবা মাথা চাপড়ে বললেন—’হায়! হায়! হে ভগবান, এ কেমন উৎপাতে ছোঁড়া, যে তোমাকেও গিলে খায়।’ ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি কৃষ্ণর কান ধরে বললেন, ‘যশোদে! তোমার ছেলের কাণ্ড দেখ?’

—কি হয়েছে গোপরাজ? তুমি নীলমণির কানটা এত শক্ত করে ধরে আছে কেন?’ ছেড়ে দাও, নরম কান এতক্ষণ ধরে থাকলে ব্যথায় লাল হয়ে যাবে যে?

—আগে দেখ, তোমার ছেলে কী করেছে?

—ও ছোট ছেলে, কী আর করবে?

—ছোট ছেলে না হয় মানছি, কিন্তু ওর কাণ্ড শোন, আমার নিষেধ সত্বেও ঠাকুর ঘরে ঢুকে সিংহাসন থেকে শালগ্রাম শিলা তুলে নিয়ে মুখে ভরে চুষছিল। হায়! হায়! কি সব্বনেশে ছেলে দেখ, শেষে কিনা ভগবানকে মুখে পুরে চুষে চুষে খায়!

নন্দবাবা শিরে করাঘাত করছেন। যশোদা নন্দবাবার হাত থেকে কৃষ্ণকে মুক্ত করে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বললেন,—’হায় হায় করার কী আছে; বুঝি না বাপু। তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তুমি শুধু শুধু ছেলেটাকে তিরস্কার করলে। ছোট ছেলে, ওর কি জ্ঞান আছে; যে ওটা ভগবান হাত দিতে নেই? হয়তো বড় মিঠাই মনে করে মুখে ভরে নিয়েছে।

—তোমার আস্কারা পেয়েই ও দিন দিন বিগড়ে যাচ্ছে। কোথায় ওকে একটু বুঝিয়ে বলবে, তা না করে বলছ ছোট ছেলে না জেনে করে ফেলেছে। এটা কি ছেলেকে শাসন করার রীতি হল?’ নন্দ মহারাজ চড়াসুরে যশোদাকে বললেন।

যশোদাও কৃষ্ণকে কোলে তুলে নিয়ে তাঁর কানে হাত বুলোতে বুলোতে নন্দমহারাজের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আমার নীলমণি তোমার ভগবানের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।’ নন্দবাবা যশোদার কথায় কান না দিয়ে শালগ্রাম শুদ্ধিকরণে মনোনিবেশ করলেন। প্রথমে শালগ্রাম শিলায় গোবর লেপন করলেন। পরে যমুনার জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে দিলেন। অতঃপর প্রায়শ্চিত্তর জন্য পূজা করলেন। পূজা শেষে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন,—’হে ভগবান, আমার লালা ছোট ছেলে, এখন কিছুই জানে না, অপরাধ হলে ওকে ক্ষমা করে দিও। অবোধ শিশু, তোমাকে মিঠাই মনে করে মুখে পুরে ফেলেছিল, ওর দোষ নিও না ঠাকুর—ওর দোষ নিও না।’ বারবার শালগ্রাম শিলার কাছে ক্ষমা যাচনা করেন নন্দবাবা। ওদিকে যশোদা মা কৃষ্ণকে ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,—”লালা, তুই বাবার পূজার ঘরে ঢুকে ভগবানকে মুখে ভরলি কেন?” কৃষ্ণ বলল, ”মা-ই-য়া, লোজ লোজ গি, মদদু, ডুড ডিয়ে-তান কলায় তো, তাই বাভলাম ওতা এততা মি-থা-ই, মুখে পুলে-দিলাম।”

—আর এরকম দুষ্টুমি কর না, তাহলে বাবার হাতে কান-মলা খেয়ে খেয়ে তোমার কান লাল হয়ে যাবে।

অতঃপর মা যশোদা গোপালকে স্নানের ঘরে নিয়ে গিয়ে ভালো করে স্নান করিয়ে দেন। স্নানান্তে পীতাম্বর বস্ত্র ও রত্নালংকার পরিয়ে গোপালকে মনোহর বেশে সাজিয়ে দেন। মাথার কেশ চূড়ায় ময়ূরের পাখা বেঁধে পায়ে নূপুর পরিয়ে দেন।

নূপূর পরাতেই গোপাল নাচতে শুরু করল। গোপালের মধুর নৃত্য দর্শন করতে করতে যশোদা বলে ওঠেন,—”হে ভগবান, এ নাচ কবে, কোথায় শিখল?” মা তালি বাজান আনন্দে।

নাচে—তা-তা-থৈয়া, তা-তা-থৈয়া-থৈয়া।

নাচে নন্দলালা, নচামেঁ থরি কী মাইয়া।।

সমগ্র বিশ্ব নাচে ভগবানের কোলে। ভগবান নাচেন জননী যশোদার কোলে।

”যশোদা তেরে ভাগ কী—কহী না জায়।”

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন