পাণ্ডবরা যখন ইন্দ্রপস্থে রাজধানী স্থাপন করে রাজ্য শাসন করতেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ মাঝে মাঝে সেখানে আসতেন। পাণ্ডবদের সঙ্গে রাজনীতি, অর্থনীতি নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। কখনও কখনও অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে বনভ্রমণে বের হতেন। এইভাবে কতিপয় দিন সেখানে অতিবাহিত করে তিনি দ্বারকায় ফিরে আসতেন। দ্বারকায় ফিরে এসে তিনি মহিষীদের নিকট ইন্দ্রপ্রস্থের গল্প করতেন। কথায় কথায় তিনি পঞ্চপাণ্ডবদের পত্নী-মহারানী দ্রৌপদীর ভূয়সী প্রশংসা করতেন। একদিন দ্বারকায় কৃষ্ণের অন্দরমহলে রুক্মিণী, সত্যভামা ও জাম্ববতী এবং অন্যান্য মহিষীগণ তাঁদের প্রাণপতি কৃষ্ণ বিষয়ে আলোচনা করছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে সত্যভামা অন্যান্য মহিষীদের জিজ্ঞাসা করলেন, ”আচ্ছা আমাদের প্রিয়তম ভগবান বাসুদেব দ্রৌপদীর উপর এত সদয় কেন? দুর্বাসার অভিশাপ থেকে, দুঃশাসনের হাত থেকে এককথায় যখন ওই রমণী বিপদে পড়েছেন তখনই আমাদের দ্বারকাধীশ তাঁকে সেই সঙ্কটজনক পরিস্থিতি হতে উদ্ধার করেছেন। ঐ রমণীর কী এমন বৈশিষ্ট্য আছে যে, তিনি বিপদে পতিত হলেই আমাদের প্রভু তাঁকে উদ্ধারের জন্য বারবার ছুটে যান?”
সত্যভামা যখন উপরোক্ত কথাগুলি অন্য মহিষীদের বলছিলেন তখন সেখানে অকস্মাৎ কৃষ্ণ উপনীত হন। কৃষ্ণকে উপস্থিত দেখে রুক্মিণী সত্যভামাদি সকল মহিষীই দ্রৌপদীর প্রতি প্রভুর অহৈতুকী করুণা প্রদর্শনের কারণ কী তা জানতে চাইলেন। প্রভু সেই মুহূর্তে তাঁদের কথার উত্তর না দিয়ে পরদিন প্রভাতে রথযানে সকল মহিষীদের নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। শ্রীকৃষ্ণ যখন মহিষীদের নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে পৌঁছালেন—তখন দ্রৌপদী স্নানান্তে রাজপ্রাসাদের অলিন্দে দাঁড়িয়ে স্বর্ণকঙ্কতিকার দ্বারা কেশবিন্যাস করছিলেন। কেশগুচ্ছের মধ্যে জট জমে থাকার জন্য স্বর্ণকঙ্কতিকার সঞ্চালন পথে বাধার সৃষ্টি হচ্ছিল। তিনি কিছুতেই কেশগুচ্ছকে জটমুক্ত করতে সমর্থা হচ্ছেন না। রাজপ্রাসাদের প্রাঙ্গণ থেকে তা লক্ষ্য করে কৃষ্ণ, রুক্মিণী এবং সত্যভামাকে বললেন—”তোমরা উপরের অলিন্দে গিয়ে দ্রৌপদীর কেশবিন্যাসে একটু সাহায্য কর। কেশের জটগুলি ছাড়িয়ে দিয়ে ওর মাথায় সুন্দর করে কবরী বেঁধে দাও।” কৃষ্ণের কথায় মহিষীগণ দ্রৌপদীর কাছে উপনীতা হয়ে তাঁর কেশরাশি স্পর্শ করতেই বিস্ময়ে চমকে ওঠেন। দ্রৌপদীর প্রতিটি কেশ মৃদু মৃদু স্বরে কৃষ্ণনাম জপ করছে। দ্রৌপদীর কেশরাশি থেকে নির্গত কৃষ্ণনামের ধ্বনি শুনে মহিষীরা বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। নীচে থেকে কৃষ্ণ বলেন,—”কি হলো থমকে দাঁড়িয়ে রইলে কেন সব? ওর কেশগুচ্ছ সুন্দর করে বেঁধে দাও।”
মহিষীরা দ্রৌপদীর কেশের জট ছাড়িয়ে সুন্দর করে কবরী বেঁধে দিলেন এবং পরে কৃষ্ণের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘প্রভু এবার আমরা বুঝেছি, কেন দ্রৌপদীর প্রতি তোমার অহৈতুকী করুণা। আমরা তোমাকে কতটুকু ভালোবাসি তা বুঝি না—কিন্তু তোমার প্রতি দ্রৌপদীর ভালোবাসা যে ত্রিভুবনে অতুলনীয় তাতে সন্দেহ নাই।’ ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে দ্বারকায় ফেরার পথে তাঁদের সবার অন্তরের গভীরে বারবার অনুরণিত হয়—দ্রৌপদীর কেশরাশির কৃষ্ণ নাম ভজনের কথা। ভাবতে ভাবতে তাঁদের নয়নেও দেখা দেয় অশ্রু। দ্রৌপদীর কেশগুলি যেন তাদের কেশের সঙ্গে মিশে কানের কাছে বলছে—
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন