ন পারয়েহং

ন পারয়েহং

নন্দালয়ে একান্তে শ্রীকৃষ্ণ একদিন আপনমনে খেলা করছেন। সখারা এখনও কেউ এসে পৌঁছায়নি। নন্দনন্দনকে একান্তে খেলতে দেখে ব্রহ্মা সেখানে উপস্থিত হলেন। ব্রহ্মার আগমনের ফলে তাঁর খেলায় সাময়িক বিরতি পড়লো। তিনি গ্রীবাতুলে মনোহর ভঙ্গীতে ব্রহ্মাকে জিজ্ঞাসা করলেন—’কি ব্যাপার বিরিঞ্চিদেব, তুমি এই সময় এখানে?’

—’হে আরাধ্যদেব, যদি অভয় দেন, তাহলে একটি কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করি।’

মৃদু হেসে নীলমণি বললেন—’নিঃশঙ্ক চিত্তে তোমার যা জিজ্ঞাস্য তা ব্যক্ত কর’।

—’হে পরমপুরুষ। যে সমস্ত ব্রজবাসীরা নিজেদের ঐহিক পারলৌকিক সর্বসুখ বিস্মৃত হয়ে, আপনার সেবায় যথা সর্বস্ব সমর্পণ করেছে তাদের প্রতিদানে আপনি কী দেবেন? সব সাধনার অন্তিম লক্ষ্য বা প্রাপ্তি আপনি স্বয়ং। আপনাকে পাওয়ার চেয়ে বড় কিছু পাওয়া সৃষ্টিতে নেই। তবু আমার মন মোহিত হচ্ছে এই ভেবে যে, আপনি স্বয়ং নিজেকে ব্রজবাসীদের কাছে বিকিয়ে দিলেও ওদের দানের তুলনায় আপনার নিজেকে ওদের কাছে দান করা বা বিকিয়ে দেওয়া কী তুচ্ছ নয়? আপনি কি কখনও ওদের কাছ হতে ঋণমুক্ত হতে পারবেন? আপনার স্বরূপ অঘাসুর-বকাসুরাদি অসুররা আত্মীয়স্বজনসহ প্রাপ্ত হয়েছে। এমনকি পুতনা যার বাইরের বেশ সুন্দর, অন্তর মলিনতায় ভরা, সেও বিষমাখা স্তনপান করাতে এসে আপনর স্বরূপ প্রাপ্ত হয়েছে। অন্যদিকে যে ব্রজবাসীরা তাদের ঘর-বাড়ী, ধন-সম্পত্তি, প্রিয়পরিজন শরীর মন-প্রাণ এককথায় সর্বস্ব আপনার শ্রীচরণে সমর্পণ করছে, যাদের সবকিছুই আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত সেই ব্রজবাসীরা যদি অঘাসুর, বকাসুর ও পুতনার মতো একই ফল প্রাপ্ত হয়—তাহলে ওদের কাছে আপনার ঋণ কখনও পরিশোধ হবে? আপনি ঋণী হয়ে থাকবেন ভেবে আমার মন বড়ই চিন্তিত। হে শ্যামসুন্দর! মদনমোহন এইসব ব্রজবাসীদের কাছ হতে আপনার ঋণমুক্তি কিভাবে হবে-তা যদি বলেন তবে কৃতার্থ হই।’

নন্দনন্দন ব্রহ্মার কথা শুনে কিছুক্ষণ মৌন রইলেন। তাঁকে মৌন দেখে ব্রহ্মা মনে মনে ভাবছেন, প্রভুকে এবার জব্দ করেছি। উত্তর দিতে পারছেন না। ব্রহ্মার মনের ভাব বুঝতে পেরে সর্বান্তর্যামী অখিল আত্মা শ্যামসুন্দর বললেন,—”হে ব্রহ্মাজী! তুমি পাগল-টাগল হয়ে যাওনি তো?’

—’এমন কথা বলছেন কেন প্রভু? আপনার চরণে আমার কি কোন অপরাধ হয়েছে?’

—অপরাধ তো তুমি সেই একবারই করেছিলে—গোবৎস, সখাদের চুরি করে। আজ অবশ্য এই জিজ্ঞাসায় তোমার কোন অপরাধ হয় নাই তবে তুমি মনে মনে যা ভাবছো তা ঠিক নয়। তোমার জিজ্ঞাসার উত্তর অবশ্যই আমার আছে। আসল কথা কী জানো ব্রহ্মাজী, ব্রজবাসীদের প্রসঙ্গ উঠলেই আমি যে ভগবান, সর্বেশ্বর-একথাটা ভুলে যাই। তাই তোমার কথার উত্তর না দিয়ে মৌন ছিলাম। যাক যা বলছি তা মন দিয়ে শোন। ব্রজবাসীদের সর্বস্ব সমর্পণের বিনিময়ে আমি কী কিছুই তাদের দিই নি? সাম্রাজ্য, বৈভব, অনন্ত ধনসম্পদ, সবই তো তাদের দিয়েছি। সুতরাং তোমার মনে এ প্রশ্ন উঠছে কেন?

—হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আপনি যা বলছেন সবই ঠিক। কিন্তু সাম্রাজ্য, অনন্ত ধনসম্পদ আসলে কী? বিন্দু নয় কি? যদি বলেন কোথাকার বিন্দু? তাহলে বলবো অচিন্ত্য অনন্ত কৃষ্ণসুধা সিন্ধুর বিন্দু। আপনি সিন্ধু হয়ে এদের বিন্দুর প্রলোভন দিচ্ছেন। একি আপনার যোগ্য প্রতিদান প্রভু? বিন্দু দিয়ে আপনি এদের থেকে ঋণমুক্ত হতে চাইছেন?

—আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু ব্রহ্মাজী, আমি যদি নিজেকে এদের কাছে দান করে দি তাহলে তো ঋণমুক্ত হব।

—না প্রভু। আপনি নিজেকে দান করলেও ঋণমুক্ত হতে পারবেন না।

—কেন?

—আপনি তো পুতনাকেও আত্মদান করেছেন। তাহলে পুতনার থেকে ব্রজবাসীরা কী আর এমন বেশি পাবে।

—তাহলে উপায়? আচ্ছা ব্রহ্মাজী, আমি যদি ব্রজবাসীদের যত আত্মীয় কুটুম্ব আছে তাদের সবাইকে যদি আত্মদান করি—তাহলে কি ঋণমুক্ত হব না?

—হে পুরুষপ্রধান। আপনিই বলুন পুতনার কোন আত্মীয় কুটুম্বকে আপনি আত্মদান করেননি? তৃনাবর্ত, বৎসাসুর, বকাসুর, অঘাসুর এরা কি আপনার আত্মদানের করুণা থেকে বঞ্চিত? হে অখিল ব্রহ্মাণ্ড নায়ক, যে আপনাকে হত্যার ইচ্ছায় বুকের দুধে বিষ মাখিয়ে নিয়ে এল তাকে যে আত্মদান করলেন—সেই একই আত্মদান ব্রজবাসীদের? যারা নিজের অন্তরাত্মাকে পর্যন্ত আপনার চরণে উৎসর্গ করে দিয়েছে তাদের যদি ঐ একই আত্মদান হয় তাহলে বলবো আপনি কোনকালেই ব্রজবাসীদের কাছে ঋণমুক্ত হতে পারবেন না।

—তুমি ঠিকই বলেছো পদ্মযোনি (ব্রহ্মাজী)। আমার জন্য লোকাচার, শাস্ত্রাচার, আত্মীয়স্বজন এমনকি নিজের দেহকেও বিস্মৃত হয়ে যারা সব কিছু ত্যাগ করেছে তাদের ঋণশোধ করা আমার পক্ষে কখনই সম্ভব নয়। তবে অঘাসুর-বকাসুর পুতনাকে আত্মদান করলেও আমার স্বরূপস্থিত যে প্রেম সে প্রেম আমি তাদের দান করি নাই। যা আমি শুধু ব্রজবাসীদের দিয়েছি। যদিও সেই প্রেম তোমার ভাষায় আমার অনন্ত প্রেমসিন্ধুর তুলনায় বিন্দুমাত্র। তবু আমার দেওয়া সেই বিন্দুমাত্র প্রেম পুনঃ আস্বাদনের নিমিত্ত আমি যে তাদের মণিময় প্রাঙ্গনে মূর্তিমান হয়ে ধূলি-ধূসরিত অঙ্গে নৃত্য করি, লুটোপুটি খাই—আমার সেইরূপ দেখে তাদের যে আনন্দ হয়—তাতে কি আমার ঋণমুক্তি হয় না?

—প্রভু, তোমার কথা শুনে আমার চতুর্মস্তক বিঘূর্ণিত হচ্ছে। আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না—তুমিই বলে দাও—তুমি ওদের কাছে ঋণী না অঋণী।’

—দেখ ব্রহ্মাজী, রাসরজনীতে আমি ব্রজের গোপীদের বলেছিলাম ”ন পারয়ে অহং নিরবদ্য সংযুজাং স্বসাধুকৃত্যং বিবুধায়ুষাপি বঃ।…” দেবতার আয়ু পেলেও গোপীদের বা ব্রজবাসীদের ঋণ আমি কোনদিনই শোধ করতে পারবো না। তবে হ্যাঁ গোপীরা যদি নিজগুণে আমার ঋণমোচন করে দেয় তাহলে আমি অঋণী হয়ে যাবো।

—সেটা কি সম্ভব?

—বোধ হয় না।

—তোমার পক্ষে কেন সম্ভব নয় প্রভু?

—দেখ ব্রহ্মাজী, বর্ণের গুরু ব্রাহ্মণ, ব্রাহ্মণের গুরু সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসীর গুরু অবিনাশী [পরমাত্মাস্বরূপ আমি], অবিনাশীর গুরু ব্রজবাসী। এখন তুমিই বল—নিরাকার থেকে নরাকার হয়ে—জগদগুরু থেকে শরণাগত শিষ্য হয়ে গুরুর ঋণ কি কখনও শোধ করা যায়?

ব্রহ্মা নিরুত্তর।

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন