মাঘ মাস। শীতকাল। ক’দিন পরেই প্রয়াগে কুম্ভমেলা বসবে। তাই চারিদিকে সাজ সাজ রব। বৃন্দাবনের কতিপয় বয়স্ক গোপগোপী স্থির করেছে—এবার তারা কুম্ভমেলা দর্শন করতে যাবে। যাওয়ার দিন নির্দিষ্ট করার জন্য তারা নন্দ মহারাজের কাছে প্রার্থনা জানায়। নন্দ মহারাজ প্রভাতকালীন সভামণ্ডপে বসে তাদের তীর্থযাত্রার জন্য একটা শুভদিন ধার্য করে দেন। সভার কার্য শেষ হলে একজন বয়স্ক গোপ নন্দমহারাজকে জিজ্ঞাসা করেন—তুমি কুম্ভস্নানে যাবে না?
—যাওয়ার তো খুব ইচ্ছা, দেখি কানুর মা কি বলে। ওর মা যদি রাজী হয় তাহলে যেতে পারি।
—আমরা অনেকেই যাচ্ছি তুমি আমাদের দলপতি, যদি সঙ্গে যাও, তাহলে খুব ভালো হয়।
—গৃহের ভিতরে গিয়ে একবার কানুর মাকে বলে দেখি, সে কি বলে। নন্দমহারাজ সভাগৃহ হতে বাসগৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। বাসগৃহের প্রাঙ্গণে সখাদের সঙ্গে কানাই বলাই ক্রীড়ামগ্ন। সকলের অঙ্গ ধূলি ধূসরিত। মা যশোমতী রন্ধনগৃহের দাওয়ায় বসে সকলের জন্য প্রভাতী জলযোগের ব্যবস্থা করছেন। গৃহকর্তাকে প্রবেশ করতে দেখে তিনি অবগুন্ঠনের অন্তরালে মুখকমল ঈষৎ আবৃত করলেন।
কানাই বলাই খেলা ছেড়ে পিতার কাছে উপস্থিত হয়। নন্দ মহারাজ জিজ্ঞাসা করেন—’তোমাদের খেলা কি এখনকার মতো শেষ?’
—’খেলা এখনও শেষ হয়নি, আমাদের খুব ক্ষিধে পেয়েছে, মা’ও অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকি করছে—তাই, খেলা বন্ধ রেখে খেতে চললাম মায়ের কাছে’। কানাই বলাই একসঙ্গে উত্তর দেয়। ভালো করে হাত মুখ ধুয়ে মায়ের কাছে খেতে যাও। এইভাবে ধুলোমাখা গায়ে খেতে বসলে নানা রোগ-ব্যাধি হয়।
—পিতাজী, সখারা সব আমাদের সঙ্গে এখানেই খাবে তো? কানাই পিতাকে জিজ্ঞাসা করে।
—সখারা খেলে তুমি খুশী হবে?
—হ্যাঁ পিতাজী। ওরা আমাদের বাড়ি রোজ রোজ যদি খায়, তাহলে আমি খুব খুশী হই।
—বেশ তাই হবে। এখন থেকে তোমার বন্ধুরা রোজ তোমার সঙ্গে যেমন খেলবে, তেমনি রোজ এখানেই খাবে।
ইত্যবসরে বলরাম একখানি বসার চৌকি নিয়ে এসে বলে—’পিতাজী উপবেশন করুন। তা দেখে কানুও জলপূর্ণ পাত্র নিয়ে এসে বলে—’পিতাজী, হস্তপদ প্রক্ষালন করুন। নন্দমহারাজ দুইভাইয়ের অঙ্গ থেকে ধুলো ঝেড়ে দিয়ে উভয়ের শ্রীঅঙ্গ সিক্ত বস্ত্রদ্বারা মুছে পরিষ্কার করে বললেন—সখাদের নিয়ে রান্নাঘরে খেতে বসগে যাও।’ সখাসহ কানাই-বলাই রান্নাঘরের দিকে রওনা হল। সেখানে প্রভাতীভোজন পর্ব শেষ করে পুনরায় সকলে ক্রীড়ায় মগ্ন হল। নন্দমহারাজও জলযোগ সমাপন করে বিশ্রাম কক্ষে প্রবেশ করেন। কিছুক্ষণ পর যশোমতী মাও এক খিলি পান বাটায় ভরে নন্দমহারাজের বিশ্রাম কক্ষে প্রবেশ করে বলেন—’এই নাও তোমার মুখশুদ্ধির পান।’ যশোমতীর হাতের বাটা থেকে পানটি তুলে নিয়ে নন্দমহারাজ মুখের ভিতরে প্রেরণ করে পালঙ্কে শুয়ে শুয়ে চর্বন করতে লাগলেন। মা যশোমতী নন্দমহারাজের পদপ্রান্তে বসে পদসংবাহন করতে থাকেন। পান চর্বন করতে করতে নন্দমহারাজ যশোমতীকে উদ্দেশ্য করে বলেন—’যশোমতী, চল এবার প্রয়াগে কুম্ভস্নান করে আসি। ব্রজমণ্ডলের অনেকেই যাচ্ছে—চল, আমরাও ঘুরে আসি।
—দুরন্ত কানাইয়ের জ্বালায় আমার কি তীর্থে গিয়ে পুণ্য করার উপায় আছে? ওখানে শুনেছি জলের খুব স্রোত। কানাই যদি ওখানে চঞ্চলপনা করতে গিয়ে জলে ডুবে….আর বলতে পারেন না যশোমতি, হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরেন।
—তুমি মিছে ভয় পাচ্ছ যশোমতী, সঙ্গে অনেক লোক থাকবে। তাছাড়া তুমি না হয় কানুকে নদীর তীরে রোহিনী দিদির কাছে রেখে স্নান করবে—তাহলে তো আর কিছু হবে না।
—কি জানি, যা দূরন্ত ছেলে। দিদি কি ওকে সামলাতে পারবে?
—তোমার চেয়ে কানু রোহিনী দিদির কথা বেশি শোনে। তুমি একটু শাসন করলে কানু ছোটমার কাছে তোমার নামে নালিশ করে। কাজেই ওর জন্য অকারণ আশঙ্কা না করে, চল যাওয়া যাক।
—তুমি যখন বলছো, তখন চল একবার তীর্থের পুণ্যস্নানটা সেরেই আসি। দেখতে দেখতে কুম্ভস্নানের দিন এগিয়ে আসে। কানাই-বলাইও ইতিমধ্যে জেনে গেছে মা, ছোটমা, বাবা সব প্রয়াগের তীর্থস্নানে যাবে। তীর্থযাত্রার জন্য নির্ধারিত দিনের পূর্বরাত্রে শ্রীকৃষ্ণ মনে মনে চিন্তা করল—, শ্রীধাম বৃন্দাবনে আমার উপস্থিতির ফলে এখানে সর্বতীর্থ বিরাজিত। কিন্তু ব্রজবাসীসহ আমার মা-বাবা তা জানে না। আমার এবং আমার ভক্তের পাদস্পর্শধন্য এই বৃন্দাবন—ধামের ধূলিকণার মাহাত্ম্য কী তা ওদের কাছে আমাকেই প্রকট করতে হবে।
লীলানায়ক নতুন লীলার সংকল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল শয্যায় মায়ের পাশে। পরদিন প্রভাতে নন্দ-যশোদা-রোহিনীসহ ব্রজবাসীরা যখন তীর্থযাত্রার জন্য পোঁটলা-পুঁটলি বেঁধে প্রস্তুত প্রায়, তখন হঠাৎ একটি কালো ঘোড়া নন্দমহারাজের বাড়ির মধ্যে ঢুকে অঙ্গনের ধূলায় গড়াগড়ি দিতে থাকে। ধূলায় গড়াগড়ি দেওয়ার ফলে ঘোড়াটির গায়ের রঙ কালো থেকে সাদা হয়ে যায়। তা দেখে বিস্মিত নন্দ-মহারাজ মনে মনে ভাবেন—কি ব্যাপার! এর রহস্য কি? নন্দমহারাজের মনে এই প্রকার প্রশ্নের উদয় হওয়ামাত্র সেই ঘোড়া এক দিব্যসুন্দর পুরুষ রূপধারণ করে নন্দমহারাজের পায়ে প্রণাম জানিয়ে বলে—”হে মহারাজ আমি তীর্থ রাজ প্রয়াগ [এলাহাবাদ]। পাপীগণ আমার তীর্থে স্নান করে পাপ ত্যাগ করে ফলে আমার শরীরের বর্ণ কালো হয়ে যায়। আমি সেই পাপের বোঝা হালকা করার জন্য বছরে একবার এইস্থানে এসে ধূলায় গড়াগড়ি দিয়ে যাই। এখানকার ধূলি নিষ্কাম ব্রজ—গোপগোপীদের প্রেমবারিতে সিক্ত। তাই এই ধূলিতে গড়াগড়ি দিলে আমার সর্ব অঙ্গের পাপ দূর হয়ে যায়।” এই কথা বলে সেই দিব্য সুন্দর পুরুষ অন্তর্হিত হলেন। তাঁর কথা শুনে নন্দমহারাজ ভাবলেন যদি তীর্থরাজ প্রয়াগ আমাদের ব্রজের ধূলায় পবিত্র হওয়ার জন্য এইস্থানে আগমন করে—তাহলে আমরা কেন মিছামিছি এইস্থান ত্যাগ করে প্রয়াগে কুম্ভস্নান করতে যাব? অতঃপর তিনি অপেক্ষমান সমস্ত ব্রজবাসীদের উদ্দেশ্য করে বললেন—”শোন শোন ব্রজবাসীরা সব মন দিয়ে শোন—আজ থেকে আমরা সবাই এই ব্রজধামের ধূলায় গড়াগড়ি দিয়ে প্রয়াগের কুম্ভস্নানের চেয়ে অধিক পুণ্য অর্জন করবো। নন্দমহারাজের কথায় সকল ব্রজবাসী ধূলায় গড়াগড়ি দিতে থাকেন। মহাকুম্ভ স্নানের সূচনা হয়।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন