পাণ্ডবদের এক বৎসর অজ্ঞাতবাস পূর্ণ হয়েছে। তারা বিরাট নগরের রাজপ্রাসাদে অবস্থান করছেন। মহারাজ বিরাট নিজ কন্যা উত্তরার সঙ্গে অভিমন্যুর বিবাহ দিয়েছেন। বিবাহোপলক্ষে বলরাম কৃষ্ণসহ সুভদ্রা বিরাট নগরে এসেছেন। বিবাহের পর বলরাম দ্বারকায় ফিরে গেছেন। কৃষ্ণ বিরাট রাজার গৃহেই থেকে গেছেন।
পাণ্ডবরা গুপ্তচরের মুখে সংবাদ পেলেন, কৌরবরা সৈন্য সংগ্রহে ব্যস্ত আছেন। এ কারণে পাণ্ডবরাও তারাও সৈন্য সংগ্রহের জন্য দিকে দিকে দূত প্রেরণ করলেন। দ্বারকা থেকে যাদব মহারথী সাত্যকি নিজ চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে বিরাটনগরে উপস্থিত হলেন। অন্যদিকে পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ পাণ্ডবদের রাজ্য সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য একটি অনুরোধপত্র লিখে নিজ পুরোহিতকে অনুরোধ করলেন কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে সশরীরে উপনীত হয়ে পত্রটি পৌঁছে দেওয়ার জন্য। ধৃতরাষ্ট্র পত্র পাঠান্তে পাঞ্চাল রাজপুরোহিতকে বললেন, ‘আমার যা বক্তব্য তা অমাত্য সঞ্জয় বিরাটনগরে গিয়ে পাণ্ডবদের জানিয়ে আসবে।’
ধৃতরাষ্ট্রের বার্তা নিয়ে সঞ্জয় এলেন বিরাটনগরে। তিনি রাজপ্রাসাদে পৌঁছে পাণ্ডবদের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে প্রবেশ করে দেখলেন সেই কক্ষের শয্যায় শ্রীকৃষ্ণ অর্ধশায়িত অবস্থাণ করছেন। অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের যুগল পদকমল সংবাহন করছেন। অর্জুনের দুই চরণের একখানি পালঙ্কের উপর লম্বমান হয়ে মহারানী দ্রৌপদীর কোলে শোভা পাচ্ছে—অন্যচরণ কৃষ্ণপত্নী সত্যভামা নিজের অঙ্কে স্থাপন করে সংবাহন (পা মর্দন করা বা পা টিপে দেওয়া) করছেন। সঞ্জয়কে দেখে সকলেই উঠে অভ্যর্থনা জানালেন। দ্রৌপদী, সত্যভামা কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে অন্তঃপুরের অন্য কক্ষে প্রবেশ করলেন। অর্জুন সঞ্জয়কে উপবেশনের জন্য আসন প্রদান করলেন। উপবেশনান্তে সঞ্জয়, পাণ্ডব ও পাণ্ডবপক্ষীয়দের একত্র করে ধৃতরাষ্ট্রের বার্তা বা সন্দেশ ব্যক্ত করলেন। তিনি বললেন, কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র বলেছেন—”তিনি সন্ধি চান। সন্ধিই শান্তি স্থাপনের সর্বোত্তম উপায়।” অধিকন্তু কুরুরাজ এও বলেছেন যে, ”যদি কৌরবরা বিনা যুদ্ধে পাণ্ডবদের রাজ্যভোগের অধিকার প্রদান না করে তাহলে পাণ্ডবদের উচিত অন্য রাজাদের রাজ্যে থেকে ভিক্ষান্নে দিনাতিপাত করা এতে পাণ্ডবদের কল্যাণ হবে। যুদ্ধে অনর্থক রক্তক্ষয় করে রাজ্য লাভ করা অপেক্ষা ভিক্ষান্নে দিনাতিপাত করা অধিক শ্রেয়। সুতরাং পাণ্ডবরা যেন অনর্থক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পথে অগ্রসর হতে প্রয়াসী না হয়। কারণ ধনতৃষ্ণা বা রাজ্যতৃষ্ণা সর্বদাই অনর্থকারী।’ সঞ্জয়ের মুখে ধৃতরাষ্ট্রের বার্তায় শুধু পাণ্ডবদের উপদেশ প্রদান। যদি কেউ সম্পত্তি বা রাজশক্তি হাতের মুঠোয় চেপে ধরে অন্যকে সে সত্ব ভোগ করতে না দিয়ে কেবল উপদেশ প্রদান করে তবে সেই উপদেশপূর্ণ কথার কি মহত্ব বা মূল্য আছে? ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সঞ্জয়কে বললেন, ”এখানে ভগবান বাসুদেব রয়েছেন, তিনি সমস্ত ধর্মের জ্ঞাতা, নীতিজ্ঞ ও বিচক্ষণ মনীষী। পাণ্ডব ও কৌরব উভয়পক্ষের হিতই তার অভীষ্ট। সুতরাং এবিষয়ে তিনি যে মতামত ব্যক্ত করবেন আমরা তাই গ্রহণ করব। আমরা কখনও তাঁর বচন অমান্য করি না।”
যুধিষ্ঠিরের কথা শেষ হলে শ্রীকৃষ্ণ পালঙ্কে উপবিষ্ট অবস্থায় বিদ্যমান থেকে সঞ্জয়ের দিকে চেয়ে বললেন, ‘অমাত্য মহোদয় আমি যেমন পাণ্ডবদের হিত কামনা করি, সেইরূপ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদেরও সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি ও অভ্যুদয় কামনা করি। আমার একমাত্র ইচ্ছা দুইপক্ষের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হোক। কিন্তু কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র ও তাঁর পুত্ররা যদি লোভের বশবর্তী হয়ে অন্যায়ভাবে পাণ্ডবদের রাজ্যভোগের অধিকার আত্মসাৎ করতে চায়—তাহলে তো যুদ্ধ অনিবার্য। যারা ব্রহ্মবেত্তা জ্ঞানী তারা না হয় মাধুকরী করে দিনাতিপাত করবে। তুমি তো ধর্মজ্ঞ, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের ধর্ম কি তা তোমার অজ্ঞাত নয়। তুমি কোন মুখে বললে—বিনা যুদ্ধে কৌরব রাজ্য সমর্পণ না করলে, পাণ্ডবরা যেন অন্য রাজার রাজ্যে থেকে ভিক্ষা করে জীবন নির্বাহ করে? কোন ধর্মের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে তুমি কৌরবপক্ষকে সমর্থন করতে চাইছ? মহারাজ যুধিষ্ঠির শাস্ত্রজ্ঞ, অস্ত্রবিদ, যজ্ঞানুষ্ঠানকারী। এমতাবস্থায় পাণ্ডবরা কেন স্বধর্মানুযায়ী কর্তব্য কর্ম থেকে বিরত হবে? ক্ষত্রিয়োচিত কর্তব্য যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়ে তাঁরা যদি দৈববশতঃ মৃত্যুও প্রাপ্ত হয়, তবে সে মৃত্যু ভিক্ষান্নে জীবনপাত করার চেয়ে অনেক শ্রেয়। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কি রাজার ধর্ম নয়? অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে পালিয়ে যাওয়াই কি ধর্ম? এরূপ করলে কি শান্তি প্রাপ্ত হওয়া যায়? পাণ্ডবরা তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হোক—এটা কি ধর্মপ্রাণ ব্যক্তির ধর্ম নির্ণয়? ধৃতরাষ্ট্র সহ তাঁর পুত্রেরা অন্যায়ভাবে পাণ্ডবদের রাজ্য সম্পদ ছিনিয়ে নিতে চায়—আর তুমি বলছ কিনা পাণ্ডবরা যুদ্ধ না করে যেন শান্তির জন্য প্রয়াসী হয়? তোমার মুখে শান্তির প্রস্তাব শুনে মনে হচ্ছে, কোন লুটেরা দস্যু গৃহে প্রবেশ করে ধনসম্পদ হরণ করছে, মা বোনেদের অমর্যাদা করছে, গৃহের মালিক রুখে দাঁড়ালেই তাঁকে শান্ত হয়ে থাকার উপদেশ দেওয়া হচ্ছে।” গলার স্বর আরও উঁচুতে চড়িয়ে কৃষ্ণ সঞ্জয়কে বলেই চলেছেন—”তুমি, তোমাদের পক্ষের ধর্মজ্ঞ ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ সেদিন সব কোথায় ছিল, যেদিন একবস্ত্রা দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ করে দুঃশাসন তাঁকে সভামধ্যে বহুলোকের কামাতুর দৃষ্টির সামনে এনেছিল? ওই সময় কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম কেন বাধা দেননি দুঃশাসনকে? এতে তো উভয়পক্ষের কল্যাণ হত। সঞ্জয়, তোমার অন্ধরাজার উপদেশ শুধু ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের জন্য। দুর্যোধন, দুঃশাসনরা যা খুশি হয় তাই করুক—পাণ্ডবরা যেন কিছু না করে। কপট পাশা খেলায় পরাজিত হওয়ার পর যখন সুতপুত্র কর্ণ বলল—পাঞ্চালী কৃষ্ণা, এখন তোমার দুর্যোধন ছাড়া গতি নেই, অতএব তুমি দাসী হয়ে দুর্যোধনের মহলে প্রবেশ কর। তোমার পতিরা খেলায় হেরে গেছে, এখন তুমি দ্বিতীয় পতি গ্রহণ কর। পাণ্ডবরা যখন মৃগচর্ম পরিধান করে বনগমনের জন্য উদ্যত তখন দুঃশাসন বলেছিল—’নপুংসক পাণ্ডবরা সর্বশক্তিহীন হয়ে গেছে। চিরকালের জন্য এরা নরককুণ্ডে পতিত হয়েছে। সঞ্জয় তুমি কি মনে কর ঐসব দুষ্টরা নিজের খেয়ালখুশী অনুযায়ী যা খুশী দুষ্টাচরণ করে বেড়াবে, আর তাই মেনে নিতে হবে? এ কখনই সম্ভব নয়। আমি তা হতে দেব না—এতৎ সত্বেও আমি শান্তি চাই। প্রয়োজনে আমি হস্তিনায় যাব—শান্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবো। সফল হলে নিজেকে ধন্য মনে করবো। মনে রেখ, পাণ্ডবরা বৃক্ষ আর কৌরবরা লতা। বৃক্ষের সহায়তা ছাড়া লতার বৃদ্ধি হয় না। পাণ্ডবরা ধৃতরাষ্ট্রের সেবার জন্যও প্রস্তুত, আবার ন্যায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধের জন্যও তৈরি। এখন ধৃতরাষ্ট্রই স্থির করুন, তিনি কি চান—যুদ্ধ না শান্তি? যদি শান্তি চান উত্তম। অন্যথায় যুদ্ধই যদি তাঁর কাম্য হয় তবে জেনে রাখ, তাঁর পুত্রদের মহাবিনাশের হাত থেকে কেউই বাঁচাতে পারবে না।”
সঞ্জয় নিরুত্তর। ভেবে পাচ্ছেন না কী উত্তর দেবেন তিনি। তিনি নতশিরে দাঁড়িয়ে রইলেন। যুধিষ্ঠির তাকে যথোচিত সৎকার করে, তাঁর মারফৎ হস্তিনাস্থিত গুরুজনদের প্রণাম-অভিবাদন জানিয়ে বিদায় দিলেন।
সঞ্জয় বিদায় নেওয়ার পূর্বে একবার শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে অন্তঃপুরে মিলিত হলেন। অতঃপর হস্তিনাপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন