ব্রজের এক নবীনা গোপবধূ। সবার মুখে শোনে সে কৃষ্ণকথা। তার অন্তরে জাগে কৃষ্ণ দর্শনের ইচ্ছা। কিন্তু বাদসাধে শাশুড়ি। নবীনা বধূকে ডেকে শাশুড়ি বলে, দেখ বউ, ঘরের মধ্যে থেকে যা খুশি করিস, কিন্তু ভুলেও যেন ঘরের বাইরে পা দিয়ে নন্দের বেটাকে নয়ন ভরে দেখিস না। বধূটি জিজ্ঞাসা করে—”নন্দের বেটাকে নয়নভরে দেখলে কি হবে মা?
—কি আর হবে। ঘরের সব কাজ পণ্ড হয়ে যাবে। যাই হোক তুমি যেন ভুলেও নন্দের বেটাকে দেখার চেষ্টা করো না। সবে নতুন বধূ হয়ে এসেছে, তাই শাশুড়ির আদেশ সে অমান্য করতে পারে না কিন্তু বাড়ীর মধ্যে সে যেখানেই কানপেতে বসে সেখানেই শুনতে পায় নন্দের বেটাকে নিয়ে আলোচনা।
বৃন্দাবনে যেন কানু ছাড়া গীত নাই। প্রতিটি গোপী, গোপবালকের আলোচনার বস্তু নন্দের বেটা। একদিন বধূটি ভাবছে শাশুড়ি তো আমাকে নন্দের বেটাকে দেখতে নিষেধ করলো কিন্তু আমার অন্তর তাঁকে দেখার জন্য এত ছটফট করছে কেন? শ্যামসুন্দর যখন ধেনু ও বৎস নিয়ে মাঠ থেকে ফিরে আসে এবং আমাদের বাড়ীর সামনে পথ দিয়ে যায় তখন শাশুড়ি এসে সামনে দাঁড়িয়ে শ্যাম দরশনে বাধা দেয়। আমার সারা অন্তর ছটফট করে মারে। সারা জগৎ যাঁর গুণ গায় সেই শ্যাম দরশন আমার কবে হবে—কবে একবার শুধু নয়নভরে সেই শ্রীমুখ দর্শন করবো। দুনিয়া যাঁর যশ গায় তাঁর রূপ কেমন একবার নয়নভরে দেখতে ইচ্ছা করে। কী এমন আছে যা দেখলে সংসারের কাজ, সংসারের সব কিছু ভুল হয়ে যায়। শ্যাম দরশনের জন্য তার হৃদয়ের বেদনা একদিন অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছায়, এমন সময়ে শাশুড়ি এসে নয়নের সামনে দাঁড়িয়ে বলে, বউ, আমার দিকে তাকিয়ে থাক, আর কোনদিকে ভুলেও তাকাবি না।
বধুটির অন্তরের বেদনা শ্যামসুন্দর জানতে পারেন। তিনি যেন অন্তর্যামী দয়ালু ভক্তবৎসল। তাই একদিন শ্যামসুন্দর বধূটিকে কৃপা করবার জন্য চুপিচুপি এসে বধূটির পিছনে দাঁড়ালেন। বধূটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে শাশুড়ি। শাশুড়ির চোখে চোখ দিয়ে বসে আছে বধূটি। এমন সময় শ্যামসুন্দর চুপিচুপি পিছনে এসে দাঁড়াতেই—শাশুড়ির দুই চোখের মণিতে প্রতিবিম্বিত হল শ্যামসুন্দরের মনোহর রূপমাধুরী। বধূটি শাশুড়ির নয়নের তারায় শ্যামসুন্দরের ছবি ভাসতে দেখে বলছে, ‘হায়! হায়! কতদিন কতমাস এই রূপদর্শনে বঞ্চিতা হয়েছিলাম। আমার অতীত দিনগুলি সব বৃথাই গেল। হে বিধাতা, একবার ঐ অতীতের দিনগুলিকে পুনরায় আমার বাকী আয়ুর সঙ্গে জুড়ে দাও। আমার শ্যামদরশন বিনে হারানো দিনগুলি ফিরিয়ে দাও ঠাকুর ফিরিয়ে দাও। নয়নের তারায় ভেসে ওঠা রূপ যদি এত সুন্দর হয়—তবে না জানি ওইরূপ নয়নের সামনে দেখলে আরও কত সুন্দর লাগবে’—এই বলে বধূটি ঘাড় ঘুরিয়ে সেই শ্যামরূপ দর্শন করলো অমনি শ্যামরূপে চিত্ত নিবিষ্টা হয়ে বধূটি চিরকালের জন্য শ্যামসুন্দরের হয়ে গেল।
শাশুড়ি ভাবলেন আমার সব চেষ্টা বিফলে গেল। পরের দিন শাশুড়ি যখন দেখলেন শ্যামসুন্দর আবার তাদের বাড়ীর দিকেই আসছে তখন বউকে ডেকে বললেন, বউ তুই রান্নাঘরে যা। রান্নাঘরে অনেক কাজ বাকী আছে। উদ্দেশ্য : বউ যেন ঘরের বাইরে না থাকে। শাশুড়ির নির্দেশে বউ উচ্চৈস্বরে কেঁদে উঠেছে—তার সমস্ত লজ্জা তখন পালিয়েছে। বধূটি তখন শাশুড়িকে বলছে—”মা আজ আপনি যদি আমার শ্যাম দরশনে বাধা দেন তাহলে সে বাধা মেনে আমি ঘরেই রয়ে যাবো। আজ আপনার আদেশ আমি অমান্য করবো না। কিন্তু আগামী কাল যদি আপনার মনে এরূপ আদেশ দেওয়ার ইচ্ছা জাগে, তবে আপনি আর ভুলেও আমাকে ঘরে খুঁজবেন না। শ্যামসুন্দরের গলে যে বনমালা শোভা পাচ্ছে, আমি সেই বনমালার আশেপাশে ভ্রমরীরূপে গুনগুন স্বরে শ্যামের যশোগান করে উড়ে উড়ে বেড়াবো।’
বধূর কথার তাৎপর্য্য হল : আজ যদি যদি আমার শ্যামদর্শন না হয় তাহলে আমার প্রাণভোমরা আর এই দেহে থাকবে না—সে দেহত্যাগ করে বেরিয়ে যাবে শ্যামসুন্দরের বনমালার সুগন্ধ আস্বাদনের জন্য।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন