বাকপটু কানহাইয়া

বাকপটু কানহাইয়া

ব্রজের এক গোপী চলেছে মথুরার হাটে ননী বিক্রী করতে। হৃদয়ে তার কৃষ্ণ চিন্তা। কৃষ্ণের দিব্যরূপ মাধুরীর ধ্যানে তন্ময় চিত্তা গোপী বিচার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে—তাই ক্রেতাদের উদ্দেশ্যে হাটে প্রবেশের আগেই সে পথ চলতে চলতে চীৎকার করে বলছে, ‘মাধব চাই মাধব, মাধব নেবে গো…।’ গোপী বলতে চেয়েছিল, ননী চাই, ননী নেবে গো…। তা না বলে সে বলছে, ‘মাধব চাই—মাধব।’ আপনভোলা গোপী ননীর পরিবর্তে মাধব বেচতে চলেছে। গোপীর অন্তর জুড়ে মাধব বাস করে। তাই অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ডের মালিককে সে ভাঁড়ে ভরে বেচতে চলেছে। কৃষ্ণপ্রেমে বিভোর গোপীর হুঁশ পর্যন্ত নেই যে, সে কী বলছে।

নন্দলাল তা শুনতে পেয়ে ভাবছে—আরে এ গোপী বলে কি? মা-ধ-ব নাও-মাধব। মা-ধ-ব চাই। এ যে দেখছি আমাকেই বিক্রী করতে চলেছে। ছুটতে ছুটতে রাস্তার মাঝে গিয়ে গোপীকে আটকে বলছে—”আরে ও ননীওয়ালী! শোন আমি গোকুলের রাজা। আগে আমাকে একটু ননী তো দিয়ে যা।” গোপী নন্দলালকে সামনে দেখতে পেয়ে আনন্দিত হয়। তাঁকে নিয়ে মস্করা করতে ইচ্ছা জাগে। তাই সে নন্দলালকে বলে—”আরে নটখট কানহাইয়া, তুই কি করে গোকুলের রাজা হলি? গোকুলের রাজা তো বলরাম। ননী যদি খাওয়াতেই হয় তো তাকেই খাওয়াবো। নন্দবাবা না জানি কোথা থেকে এই কেলটে ছোঁড়াটাকে এনেছে। নন্দবাবা ফর্সা আর তুই তো নিকষ কালো। কোথা থেকে কুড়িয়ে এনেছে রে তোকে?’

কানহাই রেগে গোপীর আঁচল চেপে ধরে। গোপী বলে,—”ওরে ও লালা শাড়ী ছেড়ে দে—টানিস না, ননীর ভাঁড় মাথা থেকে পড়ে যাবে। মাটিতে পড়ে ভাঁড় ভেঙে গেলে ননী ধুলোয় মিশে নোংরা হয়ে যাবে। শাড়ীতে ও ননী লেগে শাড়ী মাখামাখি হয়ে যাবে। এ অবস্থায় ঘরে ফিরে গেলে শাশুড়ি আমার গায়ের চামড়া আস্ত রাখবে না। এই বলে গোপী নিজশক্তিবলে কানহাইয়ার হাত থেকে শাড়ী ছাড়িয়ে নিয়ে আমার পথ চলতে শুরু করে। কিছুদুর গিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কানহাইয়া রেগে মুখ গম্ভীর করে বসে আছে। গোপীর কষ্ট হয় তা দেখে, সে ফিরে আসে এবং কানহাইয়াকে খুশি করতে চেষ্টা করে। কানহাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় এবং বলে—”ও কানহাইয়া আমার ভুল হয়ে গেছে, এই নে ননী, যত খুশী খা। কথা শোন কানহাইয়া। এমন করে মুখভারী করে থাকিস না। ননী মিছরী যা চাইবি তাই পাবি। আচ্ছা বাবা, আমার অন্যায় হয়েছে স্বীকার করছি। স্বীকার করছি তুই-ই গোকুলের রাজা—কিরে এবার খুশী তো’?

কানহাইয়া একবার বেঁকে বসলে তাঁকে খুশী করা কি এত সহজ! সে রেগে বলে—”আমি তোর কাছে ননী-মিছরী কিছুই চাই না। তুই পালা আমার কাছ থেকে।’ গোপী কানহাইয়াকে খুশী করতে না পেরে ননীর ভাঁড় মাথায় নিয়ে পথ ধরে চলতে থাকে। কানহাইয়া উঠে দাঁড়ায়, পথ থেকে একটা পাথর তুলে নেয় এবং তা গোপীর মাথার ভাঁড় লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে। লক্ষ্য অব্যর্থ। গোপীর মাথার ভাঁড় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কানহাইয়া তা দেখে ছুটে গিয়ে মায়ের কোলে লুকিয়ে পড়ে। ওদিকে গোপী ও কানহাইয়া পিছু পিছু এসে হাজির যশোদা মায়ের কাছে অভিযোগ জানানোর জন্য। গোপী এসে বলে—ও যশোদা মা তুমি তো কানহাইয়াকে কোলে নিয়ে খুব আদর করছো।—দেখ ও আজ আমার কি দশা করেছে—ননীর ভাঁড় ভেঙে দিয়েছে, আমার সারা শাড়ীতে এবং গায়ে ননী লেগে কেমন মাখামাখি হয়েছ দেখ। তোমার ছেলে ভীষণ দুষ্টু হয়েছে—ওকে আদর না দিয়ে একটু শাসন করো।

মা যশোদা নালিশ শুনে কানহাইয়ার দিকে চাইতেই কানহাইয়া বলে মা—ঐ গোপীকে দেখে আমার খুব ভয় লাগছে। ও চলে যাক, তারপর সব কথা তোমাকে খুলে বলবো।

গোপী যশোদার ইশারায় চলে যাওয়ার ছলে বাড়ির থামের অন্তরালে লুকিয়ে থাকে কানহাইয়া কি বলে তা শোনার জন্য। গোপী সরে যেতেই যশোদা জিজ্ঞাসা করেন—বল তুই কেন পাথর ছুঁড়ে ওর ননীর ভাঁড় ভেঙেছিস। কানহাইয়া বলে, মা ঐ গোপী বড় কৃপণ। একটু ননী চাইলে দেয় না। আবার তিন চারদিন আগে তোলা বাসী ননী হাটে বেচতে যায়। তুমিই বলো মা ঐ বাসী ননী যদি কোন গরীব মানুষ কিনে খায় তাহলে তার কি রোগ হবে না? এই ভেবেই তো আমি ওর ভাঁড় ভেঙে দিয়েছি।

কানহাইয়ার মুখ থেকে এই কথা শোনামাত্র যশোদা গোপীকে উদ্দেশ্য করে তিরস্কারের সুরে বলছেন, ‘ওরে ও গোপী, বাসী ননী তুই কেন বেচতে নিয়ে যাস।’

মায়ের কথা শুনে কানহাইয়া হাসতে থাকে। গোপীও সেই হাসিতে যোগ দেয় থামের আড়াল থেকে বেড়িয়ে এসে। যশোদার কোল থেকে কানহাইয়াকে কোলে নিয়ে বলে বাব্বা! তুই কি সুন্দর বলতে পারিস বটে।

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন