বিচিত্র বরদান

নীল যমুনার তটস্থিত প্রান্তরে নব তৃণ দেখে গাভীর দল মনের সুখে বিচরণ করতে থাকে। গাভীদের মনের সুখে বিচরণ করতে দেখে সখারা কানাইকে বলল, ‘কানু, আজ আমরা তোকে নিয়ে পূজা পূজা খেলা করব।’ কানু বলল,—’সেটা আবার কী খেলা রে?’

—’আমরা সবাই মিলে আজ তোকে কদম গাছের নীচে মাটির বেদিতে বসিয়ে ফুলপাতা মালা দিয়ে সাজাব—তারপর বন থেকে ফল এনে পাতায় নৈবেদ্য সাজিয়ে তোকে ভোগ অর্পণ করব। শিঙ্গা বাজিয়ে শঙ্খধ্বনি করে তোকে আরতি করব। আমাদের পূজায় সন্তুষ্ট হয়ে তুই আমাদের বর দিবি। খুব মজা হবে। তাই না?”

—’সে তোদের যা ইচ্ছা হয় কর। তবে পূজার মন্ত্রগুলো যেন ঠিক ঠাক উচ্চারণ করিস।’

—’ও নিয়ে তুই ভাবিস না কানু, শাণ্ডিল্য মুনির মুখে পূজার মন্ত্র শুনে শুনে, আমাদের সব মুখস্থ হয়ে গেছে। এখন চল তুই কদমতলার বেদিটায় গিয়ে বসবি চল।’

সখাদের অনুরোধে কানু কদমতলার নীচে মাটির বেদিতে বসল। বন থেকে ফল-ফুল-পাতা চয়ন করে আনে সখারা। দোনায় করে যমুনা থেকে জলও নিয়ে এল। (পাতার তৈরি ঠোঙাকে দোনা বলে।)। তারপর ফুল দিয়ে মালা তৈরি করে কানুর গলায়-হাতে পায়ে পরিয়ে দেওয়া হল। পাতার তৈরি মুকুটও কানাইয়ের মাথায় পরিয়ে দিয়ে বনফলের নৈবেদ্য সাজিয়ে বলরামকে প্রধান পৌরহিত্য পদে বরণ করে সকলে পূজায় বসল।

বনফুলের মালা, পাতার তৈরি মুকুট পরিধান করে কানু চুপটি করে বসে আছে বেদিতে। বলরামের পৌরহিত্যে সমবেত কণ্ঠে পূজার মন্ত্র উচ্চারিত হয়—”ওম এতে গন্ধে পুষ্পে রাখাল দেবায় নমঃ। ওম ইদং আচমনীয়, যমুনোদকং গোপালায় স্বাহাঃ। ওম এতৎ ফলং নৈবেদ্যং—গোপকুমারায় গোপালায় স্বাহাঃ।” অতঃপর শিঙ্গা বাজিয়ে ভগ্ন তরু শাখাকে চামরের ন্যায় দোলাতে দোলাতে আরতি শুরু হয়। আরতির শেষে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান ও প্রণাম করল সকলে।

কানু খুশী হয়ে বলল, ”বৎস গোপবালকগণ, তোমাদের পূজায় আমি অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছি, তোমরা বর প্রার্থনা কর।” সখারা পড়লো মুশকিলে কী বর যে নেবে তা ভেবে পায় না। বলরামও কিছু বলে না। সবাইকে চুপ দেখে মধুমঙ্গল বলল—’হে বিশ্বরাখাল কুলাধিপতি, তস্কর শিরোমণি, নাবালক চপল দেব, আপনি আমাদের জন্য প্রচুর পরিমাণে মোদক ও পাক্কান্নের ব্যবস্থা করুন। আমরা পূজাজনিত শ্রমে ক্ষুধায় বড়ই কাতর। বড়ই খুশী হব যদি ভোজনান্তে এই ব্রাহ্মণকুল গৌরব, আপনার প্রিয় বয়স্য মধুমঙ্গলকে, কিঞ্চিৎ সুস্বাদু সুপক্ক অখণ্ড-অভঙ্গ বনফল দক্ষিণাস্বরূপ প্রদান করেন।’

মধুমঙ্গলের বলার ভঙ্গীতে সখাগণ সহ কানাই হাসিতে ফেটে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মধুমঙ্গল পুনরায় বলে ওঠল, ‘পূজা বিগ্রহ-এর হাসতে মানা।’

—’বিগ্রহ, পূজায় প্রসন্ন হয়ে জাগ্রত হলে, হাসিতে দোষ হয় না।’ কানাইও উত্তর দেয়। ইতিমধ্যে যশোদা মাতা, সেবিকা নন্দিনী ও মুখরাকে দিয়ে প্রচুর পাক্কান্ন ও মোদক মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য গোচারণ ভূমিতে প্রেরণ করেন। তাকে আসতে দেখে মধুমঙ্গল সহাস্যে বলল,—’মনে হচ্ছে জাগ্রত বিগ্রহ, ভক্ত মনোবাসনা পূরণে কালক্ষেপ করেননি। আসুন, কালবিলম্ব না করে আমরা সকলে দেবতার বর প্রসাদ গ্রহণে সযত্ন মনোনিবেশ করি।’

যমুনার তটে ভোজনে বসল সখাগণ সহ নন্দনন্দন। ভোজন প্রায় শেষ হব হব এমন সময় বৃন্দাবনের গভীর অরণ্য থেকে দলে দলে সাধু-সন্ন্যাসী বেরিয়ে এসে সেখানে উপস্থিত হলেন—নন্দনন্দন শেষ গ্রাসটি হাতে নিয়ে সবে মুখের কাছে এনেছেন অমনি তাঁরা (সাধু-সন্ন্যাসীরা) সমস্বরে বলে উঠলেন—”আমরা কি প্রসাদ পাব না?’ শেষ গ্রাসটি গ্রহণ না করে হাতে নিয়ে আসন ছেড়ে উঠে এসে সমবেত সাধু-সন্ন্যাসীদের তিলতিল পরিমাণে বিতরণ করলেন শ্রীগোপাল সুন্দর। গোপালকৃষ্ণের কাছে তিল পরিমাণ প্রসাদ পেয়ে সকলেই তৃপ্ত ও খুশী হলেন। নন্দকিশোরকে বনফুলের মালা ও পত্রমুকুটে অপরূপ দেখাচ্ছিল। সেরূপ দেখে মোহিত হয়ে গেলেন আগত সাধুসন্ন্যাসীর দল। শ্যামসুন্দর তাঁদের দিকে চেয়ে স্মিতহাস্যে বলল, ‘আপনাদের কি কোন প্রার্থনা আছে?’

—তারা বললেন, ‘হে অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর, সাধু সন্ন্যাসীদের ভোজন করালে যে দক্ষিণা দিতে হয়, তা কি আপনি বিস্মৃত হয়েছেন?

—’হে আমার আত্মস্বরূপ ভক্তগণ ভোজনান্তে সাধু-সন্ন্যাসীদের যে দক্ষিণা দিতে হয় তা আমি জানি, কিন্তু বনপ্রদেশে আমি কপর্দক শূন্য অবস্থায় গোচারণ করি—এখানে আমি আপনাদের অভিলাষ পূরণ করব কেমন করে?’

—হে আপ্তকাম, আপনার সংকল্পমাত্রেই সকল ইচ্ছারপূরণ হয়। আমরা জানি আপনার অমিত প্রভাব। গোপবালকের বেশে কপর্দক শূন্য অবস্থায় বনে বিচরণ করলেও—আপনার সর্ব সামর্থ্য শক্তি সদা বিদ্যমান। আপনার অদেয় কিছু নেই। তাছাড়া আমাদের কাম্য দক্ষিণাও বিশেষ মূল্যবান নয়।

—’বেশ, তাহলে বলুন, কী দক্ষিণা আপনারা আমার কাছে প্রত্যাশা করেন?’

—’আপনি আমাদের দক্ষিণা স্বরূপ এই বর প্রদান করুন—’আমরা যেন আপনার পাদস্পর্শ ও লীলাধন্য বৃন্দাবনে তরুলতায় পরিণত হই।’ কৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করল,—’আপনারা দুর্লভ মনুষ্য শরীর পেয়ে তা ত্যাগ করে তরু-লতা হতে চাইছেন কেন?’

—’মনুষ্য শরীরে থেকে যাতে পদব্রজে কখনও বৃন্দাবনের বাইরে যেতে না পারি, সেজন্য আমরা তরু-লতা হয়ে আপনার লীলাস্থলের স্থায়ী বাসিন্দা হতে চাইছি। আমরা ব্রজভূমির বাইরে যাব এই অজ্ঞান যেন আমাদের কখনও না হয়—আমরা তরু-লতা হয়ে এখানেই থাকতে চাই। বৃন্দাবনের তরুলতা হয়ে থাকলে আপনার বিরহ কখনও আমাদের সহ্য করতে হবে না। আপনি ক্রীড়া করতে করতে বা গোচারণ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লে আমাদের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেবেন। আমরা আপনাকে পূজার জন্য ফল-ফুল অর্পণ করি বা না করি—আপনি নিজ হাতে আমাদের শাখা থেকে ফল-ফুল চয়ন করে নেবেন। এতেই আমাদের সুখ ও শান্তি। তরুলতা হয়ে থাকলে আমাদের কোন নরকের ভয় থাকবে না—দুঃখ-মোহও হবে না। আপনি আমাদের দক্ষিণা স্বরূপ এই বর প্রদানে স্বীকৃত হন।’

নন্দনন্দন বললেন,—তথাস্তু।’

__

অধ্যায় ৬৩ / ৬৩

সকল অধ্যায়

১. যুদ্ধের অবসরে
২. ইন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ
৩. যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ
৪. শান্তির দূত শ্রীকৃষ্ণ
৫. বহুরূপে বহুরূপী তুমি
৬. মুক্তি কাঁদে বৃন্দাবনে
৭. যশোদার ভাবনা
৮. ঘোড়া ঘোড়া খেলা
৯. গল্প শোনে গোপাল
১০. কৃষ্ণরূপে শুধুই নিমন্ত্রণ
১১. ননীচোর কানাই
১২. বাকপটু কানহাইয়া
১৩. রসিক কানাই
১৪. সবার অলক্ষ্যে
১৫. গোঠের মাঠে একঝলক
১৬. শ্রীকৃষ্ণ ও দেবাঙ্গনা
১৭. পঞ্চ আশ্চর্য্য
১৮. একটি রাতের কথা
১৯. বোনের দাদা—দাদার ভাই
২০. মুক্তি
২১. কৃষ্ণ ও বিদুর পত্নী
২২. রক্ষা বন্ধন
২৩. গুরু দিলেন বর
২৪. ভাই-বোনের লড়াই
২৫. দ্বারকায় প্রার্থী অশ্বত্থামা
২৬. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৭. কৃষ্ণের অতিথি সৎকার
২৮. সূচীশিল্পী গুণক ও কৃষ্ণ
২৯. সুদামা মালী
৩০. অভিন্ন সখা কৃষ্ণ
৩১. ন পারয়েহং
৩২. সব বোধের অবোধ লীলা
৩৩. বৃন্দাবনের ধূলিতে কুম্ভস্নান
৩৪. ঘরে বাইরে লুকোচুরি
৩৫. প্রতীক্ষায় কাঁদে জননী
৩৬. সুলভার বেদনা
৩৭. যাজ্ঞসেনী প্রসঙ্গে
৩৮. সত্যাশ্রয়ী শ্রীকৃষ্ণ
৩৯. ননীচুরির সূচনা
৪০. যদি ব্রজে যাও, অভিমান শূন্য হও
৪১. নামের বাঁধনে বাঁধা ভগবান
৪২. প্রথম গো-দোহন
৪৩. রাখাল রাজা
৪৪. অভিনব মুক্তালীলা
৪৫. কৃষ্ণের বাঁধন
৪৬. তপস্বী কৃষ্ণ
৪৭. দর্পচূর্ণ
৪৮. প্রেমের আদর্শ গোপী
৪৯. বউ নিয়ে খেলে গোপাল
৫০. বাৎসল্যপ্রীতির বন্ধনে
৫১. মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে
৫২. রাতের অরণ্যে
৫৩. রোহিণী মায়ের সাথে
৫৪. ভীম, কৃষ্ণ ও কৃষ্ণমায়া
৫৫. বিরাট রাজার অন্তঃপুরে
৫৬. যশোদার অঙ্গনে
৫৭. জগৎ চায় কৃষ্ণকৃপা, কৃষ্ণ চান…
৫৮. গিরিরাজের পদপ্রান্তে
৫৯. ”দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং…”
৬০. জগতে দুঃখ কেন?
৬১. ব্রজের ব্রজনাথ, পুরীধামে জগন্নাথ
৬২. বাঁশীর সুরে অশ্রু ঝরে
৬৩. বিচিত্র বরদান

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন