কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সমাপ্ত। মহারাজ যুধিষ্ঠির হস্তিনার সিংহাসন অলংকৃত করেছেন। কিন্তু মনে তাঁর শান্তি নেই। বারবার ভাবছেন, আমার জন্যই অনর্থক এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছে। অসংখ্য নর সংহারের কারণ আমি। অনুশোচনায় ভরে ওঠে যুধিষ্ঠিরের হৃদয়। ভীষ্ম এবং শ্রীকৃষ্ণ বুঝিয়েও তাঁর চিত্তকে শান্ত করতে পারছেন না। অবশেষে মহর্ষি ব্যাসদেব বললেন, ”হে ধর্মরাজ, যাঁরা যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে, তাঁদের পুনর্জীবন ফিরিয়ে দেওয়া তো সম্ভব নয়। অসংখ্য প্রাণনাশে যদি তোমার মনে অপরাধবোধের উদয় হয়ে থাকে—তবে প্রায়শ্চিত্ত কর। শাস্ত্রে যুদ্ধজনিত প্রাণনাশের প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান। তোমার পূর্বপুরুষরা তাই করতেন—অতএব তুমিও কর? ব্যাসদেবের পরামর্শ যুধিষ্ঠিরের যথার্থ মনে হল। তথাপি তিনি বললেন—”হে ভগবন্, আপনার পরামর্শ নিশ্চয়ই কল্যাণপ্রদ কিন্তু অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করতে হলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। এইসময় আমাদের কোষাগার শূন্য। বন থেকে ফেরার পর আমাদের তো কোন সম্পত্তিই ছিল না। দুর্যোধন আমাদের সব ধন সম্পদ কপট পাশাখেলায় আত্মসাৎ করেছিল। অনেক কষ্টে যে ধনসম্পদ আমরা সংগ্রহ করেছিলাম—তা যুদ্ধেই ব্যয় হয়ে গেছে।’
ভগবান ব্যাসদেব বললেন, ‘অর্থের জন্য চিন্তা কোর না। মহারাজ মারুত একদা হিমালয়ের নিকটবর্তী স্থানে এক বিশাল যজ্ঞ করেছিলেন। অনেক ত্যাগী-সাধুসন্ত সেই যজ্ঞে উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের দান করার জন্য রাজা মারুত অপার ধনরত্ন যজ্ঞস্থলে একত্র করেছিলেন। ধনরত্নের প্রাচুর্য এত ছিল যে, ব্রাহ্মণদের পক্ষে তা বহন করে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে সাধুসন্তরা ছিলেন সংসার ত্যাগী পুরুষ। তাই ঐ স্থলে এখনও ওইসব ধনরত্ন রাশীকৃত হয়ে পড়ে আছে। বর্তমানে তা মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে—তুমি ঐ স্থলে গমন করে ধনরত্ন সমূহ সংগ্রহ করে নিয়ে এস।’
যুধিষ্ঠির ভাইদের নিয়ে ধনসংগ্রহের জন্য হিমালয়ের দিকে যাত্রা করলেন। যাওয়ার আগে রাজ্যশাসনের ভার ধৃতরাষ্ট্র ও অমাত্যদের হাতে সঁপে দিলেন। পাণ্ডবরা ব্যাসকথিত যজ্ঞস্থানে উপনীত হয়ে প্রচুর ধনরত্ন সংগ্রহ করলেন। প্রত্যাবর্তনের পথে বিশ্রাম নিয়ে তাঁরা হস্তিনাপুরের দিকে আসতে থাকেন, ফলে রাজধানী পৌঁছাতে তাঁদের বিলম্ব হয়।
পাণ্ডবরা অশ্বমেধ যজ্ঞ করছে এই সংবাদ দ্বারকায় শ্রীকৃষ্ণের কাছে পৌঁছে দিলেন দেবর্ষি নারদ। সংবাদ পাওয়ামাত্র তিনি (কৃষ্ণ) হস্তিনাপুরের উদ্দেশ্যে রথে চড়ে পাড়ি দিলেন। পাণ্ডবরা রাজধানীতে পৌঁছানোর আগেই তিনি হস্তিনাপুরে পৌঁছে গেলেন। তাঁর আগমনবার্তা পেয়ে ধৃতরাষ্ট্রসহ অমাত্যবর্গ নগরের বহির্দ্বারে তাঁকে অভ্যর্থনা জানালেন। শ্রীকৃষ্ণ সাত্যকিকে নিয়ে সপরিবারে উপস্থিত হতেই সমগ্র হস্তিনা যে নবজীবন ফিরে পেল। অন্যদিকে পাণ্ডবরা ধনরত্ন নিয়ে ফিরে আসছে এ সংবাদও রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়ল। ফলে সমগ্র নগরী আনন্দ উৎসবে মেতে উঠল। দ্বারকার মহিষীদের দেখে কুন্তীদেবী, দ্রৌপদী ও সুভদ্রা প্রসন্ন হলেন। বিরাটরাজের কন্যা অভিমন্যুর পত্নী উত্তরা ছিলেন আসন্নপ্রসবা। তাঁর প্রসব বেদনা উঠতেই রাজপ্রাসাদ শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠল কিন্তু পরক্ষণেই সেই মঙ্গলধ্বনি বিষাদে পরিণত হল। মহলের অভ্যন্তর থেকে বিষাদের সুর ভেসে আসে। তা শুনে শ্রীকৃষ্ণ অন্তঃপুর অভিমুখে গমন করলেন। মুক্তকেশী কুন্তী কৃষ্ণকে আসতে দেখে চীৎকার করে বলেন—’হে কেশব, হে বাসুদেব তাড়াতাড়ি আগমন কর-বলতে বলতে তিনি কৃষ্ণের দিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে এলেন—তাঁর পিছু পিছু দ্রৌপদী, সুভদ্রাসহ কুরুকুলের সমস্ত মহিলাও দৌড়াতে দৌড়াতে কৃষ্ণের দিকে এগিয়ে এলেন। কুন্তীদেবী কৃষ্ণের কাছে এসে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলেন—”বাসুদেব আমাদের পরম আশ্রয়, আশাভরসার অবলম্বন তুমি। তুমি পাণ্ডবকুলের রক্ষক ও পরিত্রাতা। তোমার আদরের ভাগ্নে অভিমন্যুর মৃত পুত্র প্রসব হয়েছে। অশ্বথামার ব্রহ্মাস্ত্র নবজাতকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। তুমি তো বলেছিলে, অশ্বথামার ব্রহ্মাস্ত্র থেকে কুরুবংশের প্রদীপকে রক্ষা করবে। সূতিকাগৃহে নবজাতকের প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে। তুমি সেখানে ওই প্রাণহীন দেহের উপর তোমার অমৃতদৃষ্টি প্রদান কর। ওই শিশু যদি না বাঁচে আমার পুত্র সহ আমি ও বধূরা কেউ বাঁচবো না। আমার পুত্ররা ওই শিশুর অবর্তমানে না বাঁচলে শ্বশুরকুলের পিণ্ডলোপ পাবে। তোমার ভাগ্নেও পূর্বেই যুদ্ধে প্রাণ ত্যাগ করেছে। অতএব হে কৃষ্ণ, তুমি আমার বংশের শেষ প্রদীপকে প্রজ্বলিত করে দাও।’
শ্রীকৃষ্ণ নিরুত্তর। তাঁকে নিরুত্তর দেখে সুভদ্রা বললেন—’উত্তরাকে একদিন অভিমন্যু বলেছিল, কল্যাণী, তোমার আমার পুত্র মামার বাড়ী গিয়ে মামার ছেলে প্রদ্যুম্নর কাছে ধনুর্বিদ্যা ও দিব্যাস্ত্র প্রয়োগের শিক্ষা গ্রহণ করবে। দাদা, তুমি তোমার পরলোকগত ভাগ্নের কথাকে সত্যে পরিণত কর। ইতিমধ্যে কুন্তীদেবী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকেন। শ্রীকৃষ্ণ কুন্তীদেবীকে মাটি থেকে তুলে বসিয়ে বললেন—’পিসীমা, তুমি শান্ত হও।’ সুভদ্রা বললেন—’দাদা আমার একমাত্র পুত্র অভিমন্যু যদিও যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে, তবু আমার সান্ত্বনা ছিল, যে সে তোমার সেবা করেছে, স্নেহ পেয়েছে কিন্তু তাঁর বালিকাপত্নী উত্তরার বেদনা সহ্য করা আমার পক্ষে দুঃসহ। অভিমন্যুর পুত্র তোমার চরণ দর্শন করতে পারবে না—এই অপযশ আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। তোমার সখারা এখনও ফিরে আসেনি। ফিরে এসে তাঁরা যদি শোনে তুমি উপস্থিত থাকতে—অশ্বথামার ব্রহ্মাস্ত্র তাঁদের বংশপ্রদীপের জীবন ছিনিয়ে নিয়েছে, তাহলে তাঁরা কি কষ্ট পাবে না? আমি তোমার পৌরুষকে জানি। জগতে এমন কিছু অসম্ভব নেই যা তুমি সম্ভব করতে পার না। আমার শ্বশ্রুমাতা, মহারানী পাঞ্চালী তোমার পদতলে পড়ে ক্রন্দনরতা। আমিও তোমার অনাথা ভগ্নী। কোনদিন তোমার কাছে কিছু প্রার্থনা করিনি। আজ হাত জোড় করে তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি, তুমি তোমার পুত্রহীনা ভগ্নীর পৌত্রের জীবন দান কর। যদি আমার পৌত্রের জীবন ফিরে না পাই তাহলে আমি তোমার পায়ে মাথা রেখে প্রাণ বিসর্জন দেব।” শ্রীকৃষ্ণ ভগ্নী সুভদ্রাকে বললেন—’তুমি ও এত নিরাশ, ব্যাকুল হয়েছ। চল, আমাকে উত্তরার কাছে সূতিকা গৃহে নিয়ে চল। আমি ঐ মৃত শিশুকে দেখতে চাই। শ্রীকৃষ্ণের কথা কুন্তী-দ্রৌপদী সবার কানে যেন সুধা ঢেলে দিল। সবার সঙ্গে কৃষ্ণ উত্তরার সূতিকাগৃহে প্রবেশ করলেন। উত্তরা বস্ত্র সংবৃত করে উঠে বসার চেষ্টা করতেই দ্রৌপদী তাঁকে নিবৃত্ত করে শুয়ে থাকতে বললেন। শোকসন্তপ্তা ব্যথিতা বালিকাবধূ শুয়ে শুয়ে হাত জোড় করে কৃষ্ণকে বললেন—’আপনি এসে গেছেন। এখন আমি আপনাকে দর্শন করতে করতে শান্তিতে প্রাণত্যাগ করব। আপনার ভাগিনেয়, আমাকে ত্যাগ করে পূর্বেই চলে গেছে। তাঁর সন্তানও মৃত। বংশের দীপ স্তিমিত। এখন আমি বেঁচে থেকে কী করবো?”
শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ”মা উত্তরা শোকে ভেঙ্গে পড় না। তুমি অভিমন্যুর পুত্রকে লালন পালন করার জন্য বেঁচে থাকবে।”
শ্রীকৃষ্ণ যদি এইকথা বলে সান্ত্বনা না দিতেন, তাহলে উত্তরা ওই মুহূর্তেই প্রাণত্যাগ করতেন। কাতরকন্ঠে উত্তরা বললেন—”মনে ইচ্ছা ছিল পুত্রকে কোলে নিয়ে আপনাকে প্রণাম জানাব। অশ্বথামার ব্রহ্মাস্ত্র সে ইচ্ছায় জল ঢেলে দিয়েছে। এখন অবশ্য আমি আপনার আদেশ পালন করব। কিন্তু তার আগে আপনি আমার পুত্রের জীবন দান করুন।” বলতে বলতে উত্তরা অচৈতন্য হয়ে গেলেন। দ্রৌপদী ও অন্যান্য নারীরা তার শুশ্রুষায় মনোনিবেশ করলেন। কিছুক্ষণ পর চেতনা ফিরে পেয়ে তিনি মৃত শিশুর দিকে চেয়ে চেয়ে বলতে থাকেন—”বৎস, তুমি ধর্মজ্ঞ পিতার পুত্র। তোমার নিকটে সর্বেশ্বর পুরুষোত্তম দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি তোমার পিতার এবং সমগ্র পাণ্ডবদের পূজনীয়। তুমি উঠে তাঁকে প্রণাম করছ না কেন? ওঠ! পুরুষোত্তমের চরণে মাথা রেখে প্রণাম নিবেদন কর।’
ইতিমধ্যে শ্রীকৃষ্ণ ইশারায় দ্রৌপদীকে একটি পাত্রভরে জল আনতে বলেন। জল আনার পর তিনি আচমন করে মৃত শিশুর পাশে বসলেন। নবজাতকের মৃত শরীরে নিজের অভয় বরদ শ্রীকর স্থাপন করে বললেন—”যদি আমার, ধর্ম-ব্রাহ্মণ-সাধুসন্ত ভক্ত বিশেষ প্রিয় হয়। যদি আমি ধৃতরাষ্ট্র ও পাণ্ডুর পুত্রদের সমান চোখে দেখে থাকি, যদি আমার মধ্যে শাশ্বত সত্য প্রতিষ্ঠিত থাকে তাহলে, হে অভিমন্যুর পুত্র তুমি জীবিত হও। যদি আমি কেশী নামক দৈত্য ও কংসকে ধর্মপূর্বক সংহার করে থাকি। আমার মনে যদি শত্রুর প্রতি স্নেহ সতত বিদ্যমান থাকে তাহলে এই মৃত শিশুপুত্র পুনর্জীবন লাভ করুক।”
কৃষ্ণর কথা সমাপ্ত হতেই মৃত শিশু ধীরে ধীরে নেত্র উন্মোচন করে অপলক দৃষ্টিতে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে রইল। পুনর্জীবন প্রাপ্ত শিশুকে কোলে তুলে নেন কৃষ্ণ। মৃত শিশু প্রাণ ফিরে পেতেই সমবেত সকলেই আনন্দে উল্লসিত হয়ে বলে ওঠেন—”জয় ভগবান বাসুদেবের জয়।”
শ্রীকৃষ্ণ ব্রাহ্মণদের ডেকে আনার জন্য আদেশ দিলেন। পিতা অভিমন্যু পরলোকবাসী। পিতামহ অর্জুনও নগরে অনুপস্থিত, অতএব তিনিই পুত্রের জাত কর্মসংস্কার সম্পন্ন করলেন। উত্তরা কৃষ্ণের কাছ হতে পুত্রকে কোলে নিলেন। পুত্রকে অঙ্গে রেখে উত্তরা কৃষ্ণচরণে সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করলেন। ব্রাহ্মণরা স্বস্তিবাচন করলেন। শ্রীকৃষ্ণ বহুমূল্যবান ধনরত্ন জাতকের উদ্দেশ্যে দান করলেন। অনন্তর সকলের দিকে চেয়ে তিনি বললেন—’এই নবজাতক অভিমন্যুতনয় কুরুকুল পরিক্ষীন হয়ে যাওয়ার পর জন্ম লাভ করেছে-তাই এর নাম পরীক্ষিত। সুভদ্রা বললেন—দাদা, এর নামকরণ তুমি ঠিকই করেছ। কিন্তু নামের কারণ ব্যাখ্যা করে বলবে—পৌত্রের পিতামহী সুভদ্রা, আমার দাদা পুরুষোত্তম কৃষ্ণ এই পরিক্ষীন জীবন কুরুবংশের প্রদীপকে পুনরায় রক্ষণ করেছে—অতএব এর নাম পরীক্ষিতই যথার্থ হয়েছে। উত্তরা আনন্দে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। তাই মনে মনে উচ্চারণ করে পিতার অবর্তমানে পুত্রের নাম রাখার অধিকার আমার। কিন্তু গর্ভে থাকার সময় এই পরমপুরুষ যদি পুত্রকে পরিরক্ষণ না করতেন তাহলে শিশু থাকতো কোথায়? অতএব পরীক্ষিত নাম রাখাই উচিত কর্ম হয়েছে।
ইতিমধ্যে পাণ্ডবরা ফিরে এলেন। একশ দিন অতিবাহিত হওয়ার পর যখন শিশুর নামকরণ সংস্কার উৎসবের সময় উপনীত হয়, তখন যে কেউ শিশুর সামনে উপস্থিত হয় তাঁর দিকে চেয়ে শিশু যেন পরীক্ষা করে সে পূর্ব পরিচিত কি না, যাঁকে সে গর্ভে থাকার সময় রক্ষাকর্তার বেশে দেখেছে। অতএব শিশুর নাম পরীক্ষিত রাখাই যথার্থ হয়েছে। আসলে শ্রীকৃষ্ণের দেওয়া নাম বদলায় এমন সাধ্য কার?
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন